গল্প মিউটেশন  সুবীর মণ্ডল বর্ষা ২০১৭

প্রতি শনিবারে মতো আজও আমরা সায়নদের দোতলায় জড়ো হয়েছিলাম। হঠাৎ সৈকত বলে উঠল, “দেখ, আমি কিন্তু স্যারের কথাটা বিশ্বাস করি না।”

“বিশ্বাস করিস না! আরে, এটা তো একটা ছোটো ঘটনা। আমি তো এর থেকেও বড়ো ঘটনা জানি।” সায়ন বেশ দৃঢ়ভাবেই কথাটা বলল।

“কোন ঘটনার কথা বলছিস বল তো?” এবার আমি মুখ খুললাম।

আমার দিকে তাকিয়ে সায়ন বলল, “ভুলে গেলি! আমাদের ইতিহাস-স্যারের কথাটা। তোকে তো সেদিনই দেখালাম।”

“ওহ! ওইটা?”

“এই, তোরা দু’জন কী আলোচনা করছিস? আমাকেও বল!”

সৈকতের ধমক খেয়ে সায়ন মুখ খুলল, “সেদিন টিফিন পিরিয়ডে সুমন আর আমি  হেডস্যারের সাথে কী একটা দরকারে দেখা করতে গিয়েছিলাম। ফেরার পথে দেখি তেতলার ছাদের দরজাটা খোলা। আমারা সোজা ছাদে উঠে গিয়েছিলাম।”

আমি বললাম, “ছাদে ইতিহাসের প্রণববাবু একা ছিলেন। টিফিন টাইম। বুঝতেই পারছিস বাইরে কেমন রোদের তেজ। তার মধ্যে উনি দু’হাত দু’পাশে ছড়িয়ে চোখ বন্ধ করে দাঁড়িয়েছিলেন। জামাকাপড়ের বাইরে যেটুকু অংশ আছে সেখানকার সবুজ শিরাগুলো চামড়ার নিচে পরিষ্কার ফুটে উঠেছে। এমনকি মুখ ও চোখের পাতায়ও এইরকমভাবে শিরাগুলো দেখা যাচ্ছে। আর ওনার চুলগুলো সব মাথার উপর দাঁড়িয়ে আছে। ওতেও কেমন সবুজ আভা।”

“ক্লোরোফিল, সালোকসংশ্লেষ।” সৈকত প্রায় চেঁচিয়ে উঠল।

“হুম, এখন আমাদেরও তাই মনে হয়। কিন্তু ওইদিন আমরা ভয়ের চোটে পালিয়ে এসেছিলাম। তারপর  টিফিন আওয়ারে আমরা অনেকবার লুকিয়ে লুকিয়ে ওনাকে দেখেছি।”

“আসলে তখন তো জানতাম না যে ওরকম কেন হয়। আজ স্যারের ক্লাসে বুঝতে পারলাম।”

আমাদের এই আলোচনার সূত্রপাত হয়েছে আজ বিজ্ঞান পিরিয়ডে আজিতবাবুর ক্লাসে। তিনি ক্লাসে বলছিলেন, “আজ আমি যে কথা বলব এটি আমার ছোটোবেলার একটি ঘটনা। তোমাদের অবিশ্বাস্য মনে হতে পারে তবে এটা কিন্তু একদম সত্যি ঘটনা।

“আমারা যখন ছোটো ছিলাম তখন এত হসপিটাল, নার্সিং হোম ছিল না। সবকিছুই অনেক দূরে ছিল। রুগি নিয়ে যাওয়ার সময় সে মাঝপথেই মারা যেত। সেই সময় বেশিরভাগ রোগের চিকিৎসা গ্রামের ওঝা বা গুনিনরাই করত। আমাদের গ্রামে ছিল রতন ওঝা। অন্য রোগের চিকিৎসা যাই করুক না কেন, রতন সাপে কাটা রুগির চিকিৎসা খুব ভালো করত। ওর সারা শরীরে অজস্র সাপে কাটার দাগ ছিল। আসলে শুধু সাপে কাটা রুগির চিকিৎসা করলে হবে! ওদের প্রধান কাজ তো সাপ ধরা। আর রতন ছিল এ কাজে ওস্তাদ লোক। কিন্তু কালের নিয়মে রতন একদিন সাপের কামড়েই মারা গেল।”

“কিন্তু এর মধ্যে আশ্চর্য  ব্যাপার কোথায় স্যার!” সৈকত বেশ জোরেই কথাটা বলল।

গলাটা একটু ঝেড়ে নিয়ে স্যার আবার আরম্ভ করলেন, “এটা তো ভূমিকা ছিল। এরপরেই তো আসল ঘটনা শুরু হল।”

“রতনের এক ছেলে ছিল, হারান। বাপের মতো সেও বড়ো ওঝা হওয়ার স্বপ্ন দেখত। রতন যখন মারা যায় তখন সে দশ বছরের। কিন্তু ওই বয়সে কী তেজ!  আসলে ছোটো থেকে সাপের সাথেই বড়ো হয়েছে তো। তাই তার সাপের ভয় একদম ছিল না। বাবার মৃত্যুতে ও বাবার মৃতদেহ ছুঁয়ে প্রতিজ্ঞা করল, “যার কামড়ে ওর বাবার মরণ হয়েছে তাকে ও নিজের হাতেই মারবে।”

“মারতে পারল?”

রুনার প্রশ্নচিহ্ন মার্কা গোল গোল চোখের দিকে তাকিয়ে স্যার বললেন, “পারল, কিন্তু অদ্ভুতভাবে। ওই সাপকে খুঁজে হারান সেখানে গিয়েছিল যেখানে ওর বাবার মৃতদেহ পাওয়া যায়। অনেক খুঁজেও প্রথমদিন তাকে দেখতে পায়নি। কিন্তু হারান হাল ছাড়েনি। আবার গেল। এবার দেখতে পেল তাকে। কী বিশাল! কালো রঙের সাপ। হারানকে দেখে ফণা তুলে তেড়ে এল ওর দিকে। সাথে তীব্র হুইসেলের মতো হিস হিস ডাক। সে এক ভয়ংকর দৃশ্য। হারান পালাতেও পারল না। তার আগেই সাপটা ছোবল বসিয়ে দিল হারানের পায়ে।”

“হারান বেঁচেছিল?” রুনা যে ভয় পেয়েছে সেটা ওর চোখ দেখেই বোঝা যাচ্ছিল।

“হ্যাঁ, বেঁচেছিল। কিন্তু ওর ওই পা-টা অসাড় হয়ে গিয়েছিল।”

“আর ওই সাপটা?” প্রশ্ন  করল সায়ন।

“সাপটা হারানকে ছোবল দিয়ে নিজেই ছটফট করতে লাগল। পাক খাচ্ছে আর হিস হিস করে কী আওয়াজ! কিছুক্ষণ পরে সাপটা মরে গেল।

“ঘটনাটা সেই সময় অনেকে বিশ্বাস করেনি। একটা সাপ একজন মানুষকে কামড়ে নিজে মরে গেল! কেই বা বিশ্বাস করবে! কিন্তু আমার বাবা বিশ্বাস করেছিল। আসলে ঘটনাটা যেখানে ঘটেছিল, সেই বাগানের কাছ দিয়ে আমার বাবা জমিতে লাঙ্গল দিয়ে ফিরছিল। হারানকে দেখে আর সাপের ওই ডাক শুনে বাবা বাগানে যায়। আর ব্যাপারটা দেখতে পায়। আমাদের ষাঁড়ের পিঠেই হারানকে শুইয়ে বাবা ওকে গ্রামে নিয়ে এসেছিল। পরে  বাবার মুখ থেকেই ঘটনাটা আমি বিস্তারিতভাবে শুনেছিলাম।”

“ইস, ওই জন্য তোরা টিফিনের মাঝে মাঝে হাওয়া হয়ে যেতিস! আমি জিজ্ঞাসা করলে বলতিস, বাথরুম গেছি। আমাকে কেন বাদ দিলি তোরা?” সৈকতের চোখে জিজ্ঞাসা এবং রাগ দুটোই মিশে ছিল।

“আমি ভয়ে ভয়ে বললাম, “আসলে আমরা ভেবেছিলাম বেশি লোক জানাজানি হলে স্যার যদি রেগে যান! আর তাছাড়া তুই যা পেটপাতলা!”

“কী? আমি পেটপাতলা! তুই আমাকে এটা বলতে পারলি!” সৈকত তেড়ে মারতে এল আমায়।

সায়ন বাঁচিয়ে দিল। “আরে ছাড় না ওর কথা। তুই সোমবার আমার সাথে গিয়ে দেখে আসবি। এবার খুশি?”

সৈকত যে খুশি হয়েছিল সেটা ওর মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছিল। “বেশ,” ও বলল, “তবে আমিও এইরকম একটা ঘটনা জানি। মনে হয় এই ঘটনার  কারণও  এক।”

“আর তুই আমাদের থেকে সেই ঘটনাটা লুকিয়ে রেখেছিস! ভালো। তবে আমাদের উপর এত হম্বিতম্বি করছিলিস কেন?

সৈকত অপরাধীর মতো মুখ বানিয়ে বলল, “না মানে, তোরা কি জানিস, আমাদের হেডস্যার নিঃশ্বাস না নিয়ে সারারাত কাটিয়ে দিতে পারে?”

“মানে! কী বলছিস তুই? এটা অসম্ভব ব্যাপার। আমরা বিশ্বাস করি না। তুই গুল দিচ্ছিস।” আমি আর সায়ন একসাথেই কথাটা বললাম।

“না রে। আমিও প্রথমে বিশ্বাস করিনি। কিন্তু সেতুমামা যেদিন কথাটা বলল, আমার মনে হল একবার দেখা উচিত। তাই সেদিন রাতে লুকিয়ে স্যারের বাড়ি  গিয়েছিলাম।”

“কী দেখলি?”

“তোরা বিশ্বাস করবি না। স্যারের বাড়িতে কোনও খাট নেই। তার বদলে আছে একটা গদিওয়ালা বাক্স। রিনির দাদু মারা যাওয়ার পর যেমন বাক্স করে গোর দেয়া হয়েছিল, তেমন দেখতে। তবে ওটার থেকে একটু বড়ো। স্যার সেটাতেই রাতে ঘুমায়। আমি  ওটার ঢাকা খুলে দেখেছি।”

“নিশ্চয়ই ওটার মধ্যে নিঃশ্বাস নেওয়ার কোনও ব্যবস্থা আছে।” আমি বেশ জোরের সাথেই কথাটা বললাম।

“না, নেই। কারণ, গত পরশু সকালে আমি নিজেই ওটার মধ্যে কিছুক্ষণ কাটিয়েছি।”

“কী বলছিস তুই! স্যার জানতে পারেনি?”

“না জানারই কথা। কিন্তু কীভাবে যে জানতে পারল কী জানি। কাল আমকে ডেকে বেশ ভালোমতোই ঝাড় দিল।”

“আচ্ছা তোরা ভেবে দেখেছিস, যে সাপের কামড়ে বাবা মরে গেল, সেই সাপ ছেলেকে কামড়ে নিজে মরে গেল? তোরা কেউ বলতে পারবি, এটা কেন হল? আমি বলে দিচ্ছি। এর জন্য দায়ী মিউটেশন।

“মিউটেশন  হল একপ্রকার জৈবিক পরিবর্তন। সাধারণত জীববিদ্যার ক্ষেত্রে  জিনসংক্রান্ত যে পরিবর্তনের কারণে বংশধরদের মধ্যে বংশানুক্রমিক পরিবর্তন দেখা যায়, সেটা হল মিউটেশন। আবার কিছু কিছু মিউটেশন  আছে যেগুলো একেবারে অন্যরকম। আমাদের মানুষের মধ্যে প্রতিনিয়ত যে পরিবর্তন হচ্ছে, মিউটেশন হচ্ছে তার কতকগুলি স্থায়ী। কতকগুলি টিকে থাকে না। তাই আমরা ওই উদাহরণগুলো দেখি না। এই যেমন-”

বলে তিনি ব্যাগে রাখা একটা ইংরাজি  দৈনিক বাইরে এনে তুলে ধরলেন এবং একটি হেডলাইনের প্রতি আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করলেন।

‘Magnetic  Boy – The Russian Super Hero of the Future’

“ভেতরের খবর হল, রাশিয়ার KALYA KRUGLYACHUMKO সাতবছর পর্যন্ত একজন সাধারণ ছেলে ছিল। কিন্তু ২০১০ সালে একদিন তাদের অ্যাপার্টমেন্টে খারাপ রেফ্রিজারেটর থেকে সে একটা ইলেকট্রিক শক পায়। যার ফলে তার মধ্যে চৌম্বকত্ব তৈরি হয় ও সে ‘ম্যাগনেটিক বয়’তে পরিবর্তিত হয়। সাধারণত ধাতুর তৈরি চামচ, কয়েন এইসব ও আকর্ষণ করতে পারছে। তবে প্রতিদিন নাকি ওর শক্তি বৃদ্ধি  পাচ্ছে।”

পড়া শেষ করে তিনি বললেন, “ওই ইলেক্ট্রিক শক খাওয়ার পর ছেলেটির মধ্যে এমন কিছু পরিবর্তন হয়েছে যার কারণে ও চুম্বকে পরিণত হয়েছে। এই মিউটেশন  স্থায়ী  হতে পারে আবার ক্ষণস্থায়ী হতে  পারে।”

“আমাদের ভূগোলের দ্বিজেনবাবুও নিঃশ্বাস না নিয়ে অনেকক্ষণ ডুবে থাকতে পারেন।”

“তুই কী করে জানলি?” সৈকত আর সায়ন দু’জনেই আমার দিকে ঘুরে তাকাল। তাদের চোখে জিজ্ঞাসা।

“আসলে সেদিন বড়োমামার সাথে গোলদিঘিতে ছিপ ফেলতে গিয়েছিলাম। ওদিকেই তো দ্বিজেনবাবু থাকেন। উনি তখন স্নান করছিলেন। আমাদের ছিপ নিয়ে যেতে দেখে জলে ডুব দিলেন। আমরা অন্য পাড়ে গিয়ে বসলাম। মামা নিজের ছিপে মন দিলেন। আর আমি মাঝে মাঝে পুকুরের দিকে দেখছিলাম। কিন্তু ওনাকে জল থেকে উঠতেই দেখিনি।”

“সেদিন মামা একটাও মাছ পায়নি রে। খালি ফাতনা নড়ে ওঠে আর টানলে লবডঙ্কা। ঘন্টাখানেক পর যখন চলে আসছি তখন পুকুরের মাঝখানে ভুস করে কী যেন ঠেলে উঠল। চেয়ে দেখি দ্বিজেনবাবু। চিৎ সাঁতার দিয়ে ঘাটের দিকে আসছেন। সারা শরীরে একটা রুপোলি আভা।”

আমাদের আলোচনা আর বেশি এগোল না। সন্ধে হয়ে এসেছিল, তাই আমি আর সৈকত যে যার বাড়ির দিকে হাঁটা দিলাম।

“আচ্ছা, তোমরা কেউ সুমাত্রার নিশাচর মানুষের নাম শুনেছ?”

আজ সোমবার। লাস্ট পিরিয়ডে অজিতবাবুর ক্লাসে স্যার হঠাৎ এই প্রশ্ন করলেন। আমরা একসাথে ‘না স্যার’ বলে চেঁচিয়ে উঠলাম। তখন উনি বললেন, “আজ থেকে ৭৫০০ বছর আগে সুমাত্রায় একটা ভয়াবহ অগ্ন্যুৎপাত হয়। সবকিছুই পুরু ছাইয়ের নিচে চাপা পড়ে। তৃণভোজী, মাংসাশী সব প্রাণীরাই সে ছাইয়ের নিচে চাপা পড়েছিল। আরশোলা, ব্যাঙ, টিকটিকির মতো কিছু প্রাণী আর হাতেগোনা কিছু মানুষ বেঁচে ছিল। বাতাসে অক্সিজেনের পরিমাণ কমে গিয়েছিল। অ্যাসিড বৃষ্টি ও অন্যান্য  ক্ষতিকর গ্যাস থেকে বাঁচার জন্য তারা গুহায় আশ্রয় নিল। এইরকম কিছু মানুষ এখনো সেখানে বেঁচে আছে।”

“তারা কি নিশাচর?” প্রশ্ন করল সায়ন।

“হ্যাঁ। দীর্ঘদিন গুহার অন্ধকারে কাটানোর ফলে এদের মধ্যে মিউটেশন হয়ে এরা নিশাচরে পরিণত হয়েছে। আর এদের মধ্যে তৈরি হয়েছে রোগ প্রতিরোধ করার অসাধরণ ক্ষমতা।”

এই তথ্যগুলো আমিও ভালোভাবে জানতাম না। সেদিন একটা পুরনো শারদীয় পূজাবার্ষিকীতে পড়লাম। উপন্যাসটির নাম ‘মাঝে মাত্র চব্বিশদিন’। লেখক অভিজ্ঞান রায়চৌধুরী। লেখক অসাধরণভাবে এই  ঘটনার বর্ণনা করেছেন।

ফেরার পথে সৈকত বলে উঠল, “আমিও একরকম নিশাচর মানুষকে চিনি।”

“তো কে সেই নিশাচর মানুষ?” সায়ন প্রশ্ন করল।

“অজিতবাবু।”

“মানে?” সৈকতের কথা শুনে আমি আর সায়ন দু’জনেই চমকে উঠলাম।

ও বলে চলল, “কাল রাতেই দেখলাম অজিতবাবু হেডস্যারের বাড়ি থেকে বেরোলেন।”

“তো, কাল তো চাঁদের আলোয় ভালোই রাস্তাঘাট দেখা যাচ্ছিল।” আমি বললাম।

“দেখা যাচ্ছিল ঠিকই। কিন্তু তোরা তো জানিস, রাতের শেষ আর সূর্য ওঠার আগের কিছু মুহূর্ত খুব অন্ধকার হয়ে থাকে। অজিতবাবু সেসময় হেডস্যারের বাড়ি থেকে  ফিরছিলেন। ওনার কাছে কোনও টর্চ ছিল না। আর ওনার চোখ সবুজ হয়ে জ্বলছিল।”

“তুই ওইসময় হেডস্যারের ঘরে কী করছিলিস?” আমি প্রশ্ন করলাম।

“আরে, আমি তো হেডস্যারের বাক্স দেখতে গিয়েছিলাম।”

“ওই রাত্তিরে! ক’দিন পরে তুইও নিশাচর মানুষ হয়ে যাবি রে।”

অন্যদিন হলে সৈকত আমাকে কয়েক ঘা দিয়ে দিত। কিন্তু আজ দুপুরে প্রণববাবুর সালোকসংশ্লেষ দেখার পর কেন জানি ওর মনটা ভালো হয়ে ছিল। তাই আমার কথা শুনে ও হেসে ফেলল। ওর মুখে হাসি দেখে আমরাও হাসার সাহস করলাম।

সৈকত হাসতে হাসতেই বলল, “জানিস, আমার মনে হয় ভ্যাম্পায়াররাও নিশাচর মানুষ।”

“দূর! ওরা তো  মানুষই নয়।” সায়ন বলল।

“কে বলল মানুষ নয়! ওরাও মানুষ। ওদের মধ্যে কোনও জৈবিক পরিবর্তন হয়ে ওরা ভ্যাম্পায়ারে পরিণত হয়েছে।”

সন্ধেবেলায় মাঠ থেকে খেলে বাড়ি ফিরছিলাম। বাড়ির কাছাকাছি প্রায় এসে গেছি এমন সময় রিনির সাথে দেখা। রিনি আমাদের পড়শি। ওদের আর আমাদের বাড়ি রাস্তার এপার আর ওপার। মানে মুখোমুখি। রিনি আমাকে দেখে মুখ ভেঙিয়ে বলে উঠল, “এই যে বীরপুরুষ, সন্ধে পর্যন্ত  কোথায় ছিলি? বিকাল থেকে তোকে খুঁজছি।”

“কেন রে?”

আমার প্রশ্ন শুনে রিনি ফিক করে হেসে বলল, “আজ ছ’টা বেজে তেরো মিনিটে পূর্ণিমা লেগেছে। পুরো চাঁদ উঠবে। রাতে ছাদে আসবি? দু’জন মিলে একসাথে চাঁদ দেখব।”

ও পূর্ণিমার রাতে চাঁদ দেখবে। আর আমাকে সঙ্গী হতে হবে? ভালো পাগল  তো! আমি বলে দিলাম, “দেখ, তুই চাঁদ দেখবি, দেখ। আমি কিন্তু ঘুমাব। কাল মঙ্গলবার। সকালে আমার পড়া আছে। আমি তোর সাথে জাগতে পারব না।”

রিনির দিকে আর তাকালাম না। তাড়াতাড়ি পা চালিয়ে চলে এলাম। আর কিছুক্ষণ থাকলে আমাকে ও রাজি করিয়েই ছাড়ত।

বাড়ি ফিরে টিফিন সেরে পড়তে বসলাম। কিন্তু আমার মাথা থেকে ওই মিউটেশন ব্যাপারটা কিছুতে যাচ্ছিল না। খালি ঘুরে ফিরে ওটাই মনে পড়ছিল। এইসব ভাবতে ভাবতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম বুঝতে পারিনি। মায়ের ডাকে ঘুম ভাঙল।

“কী রে, শরীর খারাপ নাকি! তুই তো এভাবে ঘুমাস না কখনও। দেখি, কপালটা দেখি।”

মা নিজেই আমার কপালে হাত রাখল। তারপর সঙ্গে সঙ্গে হাত সরিয়ে নিয়ে বলল, “আজ কি পূর্ণিমা লেগেছে!”

আমি বললাম, “হ্যাঁ।”

মা বলল, “প্রতি পূর্ণিমায় তোর এই জ্বর আসাটা ভালো লক্ষণ নয়। আমাদের পরিবারে কারও এরকম হয় না। রাতের খাবার খেয়ে, একটা প্যারাসিটামল খেয়ে ঘুমা। জ্বর না কমলে কাল ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাব।”

ঘুম যখন ভাঙল, তখন কত রাত কে জানে। কেমন অস্বস্তি হচ্ছে। বাইরে কে যেন গান করছে। জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখি পাগলিটা ওদের ছাদে বসে আমাদের ঘরের দিকে মুখ করে গান করছে। কী গান বুঝতে পারলাম না, তবে সুরটা বেশ সুন্দর।

পায়ে পায়ে কখন ছাদে চলে এসেছি বুঝতে পারলাম না। পাগলিটাকে দেখে মনে হচ্ছে যেন একটা ধূসর কুকুর ছাদে বসে জোছনা মাখছে। আমাকে দেখে ওর মুখে হাসি খেলে গেল। তারপরেই একটা লাফ দিয়ে আমাদের ছাদে চলে এল। অন্য কেউ হলে হয়তো ভয় পেয়ে যেত। আমার কাছে কিন্তু এটা মামুলি ব্যাপার। আমিও চারপায়ে ওর দিকে এগিয়ে গেলাম। তারপর দু’জনে পাশাপাশি বসে একসাথে জোছনা মাখতে লাগলাম।

দূর থেকে আমাদের যদি কেউ দেখে ভাববে দুটো কুকুর পাশাপাশি বসে আছে। কারণ, মাঝরাতে কারোর ছাদে দুটো নেকড়ে পাশাপাশি বসে আছে, এইরকম   পাগল ছাড়া আর কেউ ভাবতে পারে না।

দূরে চেয়ে দেখি সায়ন আর সৈকতও আসছে। বেশ বড়ো বড়ো লাফ দিচ্ছে।

আচ্ছা, এই যে প্রতি পূর্ণিমা রাতে আমরা মানুষ থেকে নেকড়ে হয়ে যাই, চাঁদের আলোয় বসে একসাথে জোছনা মাখি, এটাও কি মিউটেশন!

অজিতবাবুকে একদিন সময় করে জিজ্ঞাসা  করতে হবে। উনি বলবেন তো!

ছবিঃ তন্ময়

জয়ঢাকের গল্পঘর   

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Twitter picture

You are commenting using your Twitter account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s