তরুণকুমার সরখেল এর সমস্ত লেখা একত্রে
এপ্রিল মাস পড়তে না পড়তেই পলাশটাঁড়ের মাঠ যেন আগুনে জ্বলতে থাকে। এ অঞ্চলে রোদের বেশ দাপট। কয়েক সপ্তাহ আগেও মাঠ জুড়ে ছিল লাল পলাশের মেলা। সেই ফুল এখন ঝরে গিয়ে রোদে ঝলসে গেছে। হাওয়ায় উড়ে বেড়াচ্ছে এলোমেলো।
আজ আকাশ মেঘলা। সকাল থেকেই ঠাণ্ডা হাওয়ায় পলাশটাঁড়ের মাঠজুড়ে হালকা লাল ধুলোর পর্দা উড়ে বেড়াচ্ছে।
সাদা ধুতি ও সাদা পাঞ্জাবি পরা, কাঁধে কাপড়ের ব্যাগ ঝোলানো বয়স্ক লোকটি অনেকক্ষণ ধরেই মাঠে ইতস্তত ঘুরে বেড়াচ্ছেন। নবগ্রাম হয়ে নীলডি যাবার রাস্তার দু’পাশে করঞ্জগাছের সারি। গাছে সবে নতুন পাতা এসেছে। সে কারণে মনে হচ্ছে রাস্তাটা নতুন করে সেজে উঠেছে।
সেই চমৎকার রাস্তাটি এসে মিশেছে নীলডি প্রাইমারি হেলথ সেন্টার মোড়ে। এই মোড় থেকেই শহরে যাবার বাস পাওয়া যায়। খুব সকাল সকাল শহর থেকে একটা বাস ঠিক এই মোড়ে এসে থামে। সাদা ধুতি-পাঞ্জাবি পরা লোকটি সেই বাস থেকে নেমে সোজা পলাশটাঁড়ের মাঠে চলে এসেছেন।
পলাশটাঁড় থেকে উত্তরমুখে ছোট্ট পায়ে চলা পথের শেষে পাবড়া প্রাইমারি স্কুল। লোকটি আনমনে হাঁটতে হাঁটতে এসে পৌঁছালেন সেখানে। স্কুলের কাছেই তিনটি বড়ো অশ্বত্থগাছ। হাওয়ার ঝাপটায় গাছের পাতাগুলি পত পত করে উড়ছে। শক্ত মাঠ জুড়ে লাল কাঁকর বিছানো। মাঝে মাঝে নরম কচি ঘাস কাঁকল ভেদ করে মাথা উঁচু করে আছে। হাঁটতে হাঁটতে লোকটি একটি হলুদ-কালো পাখি দেখে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন। পাখিটাকে তিনি চেনেন, বউ-কথা-কও। কিন্তু অনেকে এই পাখিটাকে ‘কিষ্টর খোকা হোক’ বলে ডাকে।
অনেকক্ষণ মাঠে ময়দানে ঘোরার ফলে তাঁর বেশ খিদে পেয়েছে। কিন্তু খাবার পাবেন কোথায়? এমন সময় দেখলেন, স্কুলের ছোটো ছোটো ছেলেমেয়েরা হৈ-চৈ করতে এসে অশ্বত্থগাছের নীচে শক্ত পাথুরে মাটিতে লাইন দিয়ে বসে পড়ল। দুপুরের বরাদ্দ আহার গরম খিচুড়ি আর আধখানা ডিমসেদ্ধ সবার পাতে পড়ল। ছেলেমেয়েরা সুর-র্ সুর-র্ শব্দ করে থালা পরিষ্কার করে খেয়ে ফেলল। তারপর পাশের টিউবওয়েলে গিয়ে নিজেদের থালা ধুয়ে নিল।
লোকটি গরম খিচুড়ির গন্ধ পেয়ে সেখানে গিয়ে হাজির হলেন। কাঁধের ঝোলা মাটিতে রেখে বাবু হয়ে ঘাসের উপর বসে পড়লেন। ভাবখানা যেন তাকে খেতে ডাকা হয়েছে। স্কুল চত্বরে এরকম ভবঘুরে প্রায়দিনই দেখা যায়। শিক্ষক উপানন্দবাবু লোকটিকে পেট পুরে খাওয়ানোর নির্দেশ দিয়ে স্কুলরুমে ঢুকে পড়লেন। লোকটি খুব ধীরেসুস্থে খাবার খেতে লাগলেন। খেতে খেতেও মাঝে মধ্যেই চারপাশটা দেখছেন। যদি আরও দু-একটি নীলকন্ঠ অথবা ফিঙে-টিঙে চোখে পড়ে।
স্কুলঘর থেকে ছেলেমেয়েদের একসাথে সুর করে পড়ার শব্দ কানে আসছে। সেই সুর লোকটির কানে যেতেই তিনি বিড় বিড় করে কবিতা আওড়াতে লাগলেন।
“টালি দেওয়া ঘরে পাঠশালা বসে স্যাঁতসেঁতে মেঝে ঘর,
গুটিকয় ছেলে সুর করে পড়ে, দুষ্টুমি দিন ভর।
ঘাসে ঘাসে ফুল প্রজাপতি ওড়ে, রেণু মাখে ডানা ভরে
সারাদিন ধরে পাঠশালা ঘরে সোনা-কুচি রোদ ঝরে…”
স্কুলরুমের দরজার পাশে দুটো কাঠের চেয়ার পেতে রাখা আছে। লোকটি এসে চেয়ারে বসলেন। তারপর ঝোলা থেকে খাতা বের করে নিজের মনে লিখতে লাগলেন –
“সামনের মাঠে পুকুরের পাড় কাঁচা বাঁশ দিয়ে ঘেরা
হুটোপুটি করে জলে ঝাঁপ দেয় ছোট ছোট বালকেরা।”
আসলে তিনি এসব দেখেই লিখলেন। একপাশে বাঁশ দিয়ে ঘের দেওয়া একটি পুকুর রয়েছে। সেই পুকুরের জলে হুটোপুটি করছে আট-দশটি ছেলে।
লোকটি লেখা থামিয়ে এবার ছেলেমেয়েদের আওড়ানো কবিতা শুনতে লাগলেন।
“ঐ যে দেখো মাঠের ধারে আলোকলতার বনে
পথ ভুলে কি সোনালি রোদ গাইছে আপনমনে?
ঐ যে দেখো শাপলা বনে রসুন ফড়িং নাচে
রোদ ঝিকমিক আলোর খেলা স্বচ্ছ জলের কাচে।”
এ পর্যন্ত শুনেই লোকটি দ্রুত স্কুলরুমে ঢুকে পড়লেন। এ কার কবিতা পড়ে শোনাচ্ছে এরা? এটা তো তাঁর লেখা কবিতা।
তাঁকে হঠাৎ করে ক্লাসরুমে ঢুকে পড়তে দেখে সবাই কবিতা বলা থামিয়ে দিয়েছে। লোকটির কিন্তু সেদিকে খেয়াল নেই। তিনি আপনমনে বেশ জোরে জোরে কবিতার পরের লাইনগুলো আওড়াতে লাগলেন।
“ঐ যে দেখো রাংতা মোড়া…” এতটা বলেই তিনি চুপ করে গেলেন। নাহ্, স্কুলশিক্ষকের অনুমতি ছাড়া তাঁর এভাবে ঢুকে পড়া বোধহয় ঠিক হল না। লোকটি লজ্জিত হয়ে বাইরে বেরিয়ে এলেন। পেছনে পেছনে এলেন উপানন্দবাবু।
দু’জনে দুটো চেয়ারের উপর এসে বসলেন। উপানন্দবাবু লোকটিকে ভালো করে দেখে তাঁর নাম জিজ্ঞেস করলেন। লোকটি বললেন, “আমার নাম অমরশঙ্কর ভটাচার্য।”
“কী আশ্চর্য। চালচিত্তির কবিতাটির লেখক তো অমরশঙ্কর ভটাচার্যই। তা আপনি এখানে কোথায় এসেছিলেন?”
“তা তো জানি না। তবে বাসের জানালা থেকে দেখলাম জায়গাটা ভারি সুন্দর। হালকা হাওয়ায় মাঠময় সাদা শিমুল তুলো ভেসে বেড়াচ্ছে। তাই বাস থেকে নেমে এদিকটায় চলে এলাম। তবে আপনার স্কুলের ছেলেমেয়েরা আমার কবিতা শিখল কেমন করে?”
উপানন্দবাবু বললেন, “ওটা তো চতুর্থ শ্রেণির বাংলা বইয়ের পাঠ্যসূচির কবিতা। এ বছরই নতুন সিলেবাসে কবিতাটি যুক্ত হয়েছে। খুব সুন্দর লেখেন আপনি। তা কবিতাটি যে পাঠ্যসূচিতে এসেছে এটা আপনি জানতেন না?”
“না তো। মানে হয়েছে কী, বেশ কিছুদিন হল আমি লেখালেখি থেকে বিযুক্ত। তবে অনেকদিন পর আজ দু-একটা লাইন লিখেছি। আচ্ছা, এই জায়গাটার কী নাম বলুন তো?”
“ওদিকটা পলাশটাঁড়। এদিকে পাবড়া প্রাইমারি স্কুল।”
গল্প করতে করতেই সহকারী শিক্ষক ছেলেমেয়েদের ছুটি দিয়ে দিলেন। ছাত্রছাত্রীরা হৈ হৈ করে ক্লাসরুম থেকে বের হয়ে এল। তারপর কাঁকুরে মাঠ দিয়ে ছুটতে ছুটতে কে কোথায় হারিয়ে গেল।
উপানন্দবাবু দেখলেন পলাশটাঁড়ের মাঠ ভেঙে একজন যুবক দ্রুত পা ফেলে স্কুলের দিকে এগিয়ে আসছে। এসময় শহর থেকে এখানে আসার একটা মিনিবাস আছে। স্কুলসংক্রান্ত কোনও মিটিংয়ের চিঠি নিয়ে কেউ আসছেন কি? উপানন্দবাবু মনে মনে ভাবলেন।
যুবকটি কাছে এলে অমরশঙ্করবাবু তাকে চিনতে পারলেন। তিনি উপানন্দবাবুর দিকে তাকিয়ে বললেন, “এ হল নীল। আমার ছেলে। নীল আমার খোঁজেই এখানে এসেছে। আসলে আসবার সময় ওদের জানিয়ে আসিনি তো।”
নীল কাঁকুরে মাটিতে আরাম করে বসে পড়ল। তারপর ব্যাগ থেকে জলের বোতল বের করে এক চুমুক দিয়ে বলল, “বাবা, আজ তুমি আমাকে ভীষণ চিন্তায় ফেলে দিয়েছিলে। এভাবে কাউকে কিছু না জানিয়ে বেরিয়ে পড়ে? শুনলাম শহরে ফেরার শেষ বাস পৌনে পাঁচটায়। আর দেরি করা চলবে না।”
পলাশটাঁড় থেকে ফিরে এসে অমরশঙ্করবাবু নতুন জীবন ফিরে পেলেন। আসলে বেশ কিছুদিন ধরেই তার স্মৃতিভ্রম হয়েছিল। সারাদিন তিনি কী করছেন, কোথায় যাচ্ছেন কিছুই মনে রাখতে পারছিলেন না। শহরের চৌহদ্দির মধ্যেই তাঁর সকাল থেকে রাত কেটে যাচ্ছিল। লেখালেখির কাজও সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে গিয়েছিল।
সেই অমরশঙ্করবাবু আবার লেখায় মন দিয়েছেন। আসলে কচিকাঁচা ছেলেমেয়েদের গলায় নিজের লেখা কবিতা শুনতে পেয়ে তিনি যারপরনাই রোমাঞ্চিত হয়েছেন। ছোটো ছোটো ছেলেমেয়েদের সুরেলা গলায় কবিতা শুনতে শুনতে তিনি নিজেকে আবার নতুন করে আবিষ্কার করেছেন। খুঁজে পেয়েছেন হারিয়ে যাওয়া স্মৃতির ভাণ্ডার। পলাশটাঁড়ের লাল কাঁকুরে মাটি তাকে ভীষণভাবে উজ্জীবিত করেছে। অনেকদিন পর পড়ার ঘরে এসে তিনি লিখতে বসেছেন।
“মাঠ বলল, ছোট্ট খোকন সোনা,
রোদ মেখে নাও আমার কাছে এসে,
দেখবে কেমন পাড়ি দিতে জানি,
তোমায় নিয়ে রূপকথার এক দেশে…”
রূপকথাপুর কী শুধু রূপকথাতেই থাকে? কত অজানা অচেনা রূপকথার দেশ এই বাংলাতেই ছড়িয়ে রয়েছে, এটা তাঁর জানা ছিল না। সেইসব স্থানে পাড়ি দিলে মনপ্রাণ সত্যিই ভালো হয়ে ওঠে। পলাশটাঁড়ের মাঠ তার কাছে এক রূপকথার দেশ।
তিনি তাঁর এই ছোট্ট পড়ার ঘরের জানালা দিয়ে দিব্যি দেখতে পাচ্ছেন, সারা মাঠজুড়ে শিমুলের তুলো ভেসে বেড়াচ্ছে। স্কুলের কচিকাঁচার দল বাড়ি ফেরার পথে সেই তুলো ধরতে হুটোপুটি করছে। এলেমেলো বাতাসে শুকনো গাছের পাতা আর রাঙা ধুলোর মিহিজাল মিলেমিশে উড়ে বেড়াচ্ছে মাঠময়। এত বড়ো মাঠের ছবি তার এই ছোট্ট কবিতায় তুলে ধরা কি সম্ভব?
অমরশঙ্করবাবু লেখা থামিয়ে নতুন করে ভাবতে বসলেন।
গ্রাফিক্সঃ ইন্দ্রশেখর
জয়ঢাকের গল্প কবিতা ছড়া পড়তে শুরু করেছি। আজ অফিসে সি এল নেব। না হলে এত সব পড়ার সময় পাবো না। জয়তু জয়ঢাক।।
LikeLiked by 1 person
হ্যাঁ। জয়ঢাক বের হওয়া মানেই পুজর ছুটির মেজাজ! 😀 😀
LikeLike