গল্প সংশোধনাগার চন্দন কুমার দেব বর্ষা ২০১৮

চন্দন কুমার দেব এর আগের গল্পঃ প্রফেসর বৈদ্যনাথ ও প্রফেসর বৈদ্যনাথ

চন্দন কুমার দেব

ফারুখ সিদ্দিকির দশ বছরের জেল হাবিলদার জীবনে কতই না বিচিত্র অভিজ্ঞতা আছে। এই দশ বছরে যত জেল সে ঘুরেছে প্রতিবার তার মনে হয়েছে ইতিহাস যেন আষ্টেপৃষ্টে লেগেআছে জেলের প্রতিটি স্যাঁতস্যাঁতে দেয়ালে, প্রতিটি সেলে। জেলে মৃত ব্যক্তির আত্মা যেন সদা বিরাজমান। প্রতিনিয়ত জানান দেয় তাদের উপস্থিতি। কোন রাতে আদ্ভুত নীরবতার মধ্যে অনুভূত হয় অশরীরির উপস্থিতি।

একবার এক জেলখানায় কয়েকজন কয়েদি ফেরার হওয়ার চেষ্টা করল। কয়েকশ একর জমির ওপর শাল, সেগুন, বড় বড় বুনো গাছ পুকুর সবকিছুতে আচ্ছাদিত ও দশফুট দেয়ালে আবদ্ধ যেন এক দুর্গ। সেখানে দিনের বেলায় কয়েদিরা বিভিন্ন কাজে নিযুক্ত থাকত আর সন্ধ্যাবেলায় সেলে ফেরত যেত।

সারাদিনের কাজের শেষে সবার চোখ এড়িয়ে পালিয়ে কয়েকজন সেই জঙ্গলে ঢুকে পড়ল। অনেক ছোটাছুটির পর শেষ পর্যন্ত তারা পালাতে পারেনি। জেলপুলিশ ভালভাবে ধরতেই পারেনি কারা পালিয়েছিল। কিন্তু অজানা কারণে তারা পালাতে পারেনি। রাত্রি নটা নাগাদ নিজেরাই এসে ধরা দেয়। পরে শোনা যায় যখনই ওরা দেয়াল টপকাতে যায়, দশফুট দেয়াল বিশফুট হয়ে যায়। দেয়ালের গায়ে বড় বড় কুৎসিৎ গিরগিটি ও বিষধর সাপ ঘোরাফেরা করে।

নবীন ফারুখের কাছে ঘটনাটা ছিল আবিশ্বাস্য। জেলের বহু পুরোনো কর্মী লালসিংহ  নিশ্চিত করে যে ঘটনা সত্যি।

লালসিংহ গলা নামিয়ে বলল, “বহু বছরেও এখানে কেউ পালাতে পারেনি। সবাই বলে জঙ্গলের ভেতর যে মাজার আছে অচিনবাবার মাজার সে রক্ষা করে এই জেলখানাকে।”

ফারুখ সেই জেলে যতদিন ছিল একই জিনিস দেখেছে। কৌতহলে একবার  মাজারে গিয়ে দেখল পুকুরের পাশে ইটের তৈরি এক জনমানবশূন্য মাজার। কিন্তু জনমানবশূন্য হলেও আশ্চর্যজনকভাবে কোন আবর্জনা ঘাসপাতা পড়ে নেই। দেখে মনে হয় কেউ আজ সকালেই ঝাঁট দিয়ে গেছে।

ফারুখের বর্তমান জেলখানার বিশেষত্ব হল জেলখানার ভেতরে মর্গ। মর্গের গার্ড জ্ঞানেন্দ্র ডোম, বয়স পঞ্চাশ পঞ্চান্ন হলেও অনেকটা বুড়িয়ে গিয়েছে। আধাপাকা লম্বাচুল সামনের দিকটাই অনেকটা ঝরা, তামাটে মুখমণ্ডল। বত্রিশপাটি দাঁতের কিছু ধংশাবশেষ পড়ে আছে। গাঁজাখাওয়া ভাঙা মুখ ও শরীর। রহস্যে ভরা চেহারার সাথে প্রবল বৈপরিত্য বজায় রেখে সাদাধবধবে কুর্তা ও ধুতি পরে। স্বল্পভাষী। খুব গরমের রাতে দু-চারটা লাশ বের করে নিজে পরমশান্তিতে ঘুমায় শীততাপ নিয়ন্ত্রিত মর্গে। জ্ঞানেন্দ্র ছাড়া এখানে সবকিছু মোটামুটি স্বাভাবিক।

এক রাতে ফারুখের নাইট শিফটে ডিউটি, রাত্রি দশটা থেকে সকাল ছটা। ডিউটি অফিসার হিসেবে তার কাজ হল কয়েদিদের কার্যকলাপ লক্ষ রাখা। কিন্তু তার চেয়ার এত নিরিবিলিতে যে মাঝেমাঝে গা ছমছম করে।

এখানে প্রত্যেক ঘন্টায় ঘড়ি ঢং ঢং শব্দ করে। কিছুক্ষণ আগে দুটোর ঘণ্টা বেজেছে। নিস্তব্ধতায় শুধু শোনা যাচ্ছে টিক্ টিক্। চোখ ভারি লাগছে।

আচমকা তার মনে হল একগাদা বুলেট কেউ মেঝেতে ফেলে দৌড়ে পালাল। চারিদিক ঝনঝনিয়ে উঠল। কিছুই বুঝতে না পেরে সিদ্দিকি আর এক ডিউটি অফিসারকে ডাক দিল, “আশুতোষ!”

হঠাৎ এক আশরীরি হাসির শব্দে তার রক্ত হিম হয়ে গেল।

“বাবু ভয় পেয়েছেন।”

পেছনে ঘুরে সিদ্দিকি দেখল মর্গের গার্ড জ্ঞানেন্দ্র। হাফ ছেড়ে বাঁচল। এর আগে লোকটাকে কত বিচিত্র লাগত। এখন ভয় থেকে বাঁচাবার জন্য অতটা বিচিত্র লাগছে না।

সারারাত্রি জ্ঞানেন্দ্রর কাছে ভয়ানক সব অভিজ্ঞতা শুনে গায়ে কাঁটা দিতে থাকল তার। সে জানল, বুলেটের ঘটনা নতুন না। প্রায়ই হয়।

ডিউটি শেষে ফারুখ বাড়ির যেতে যেতে তার ভয় উধাও হল।

পরেরদিন আবার যখন ফারুখ ডিউটিতে গেল, সব শুনে সে হতভম্ব! গতকাল রাত নটায় জ্ঞানেন্দ্র মারা গেছে। মর্গের অন্যান্য লাশের মাঝখানে তার লাশ উদ্ধার হয়েছে।

ফারুক যখন তাকে দেখতে গেল তখনও জ্ঞানেন্দ্রর চোখখোলা। মনে হয় ঠোঁটের কোনায় হাসি, যেন বলছে , “কি বাবু  বলেছিলাম না এখানে সব ঘটনাই সত্যি………”

জয়ঢাকের সমস্ত গল্পের লাইব্রেরি এই লিংকে

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Twitter picture

You are commenting using your Twitter account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s