গল্প ১-গান ও পড়াশোনা
এবারে অরস্মিতবাবুর সঙ্গে বেশ কিছুদিন পর দেখা হল। বাইরে মেঘলা গুমোট। ভিতরে উনি একটা বইয়ের ওপর হুমড়ি খেয়ে বসেছিলেন আর পা দোলাচ্ছিলেন। পায়ে একটা নতুন স্যান্ডেল। আমি জিগ্যেস করলাম, “অরোবাবু, জুতোটা কে কিনে দিল?”
বই থেকে মুখ না তুলেই বললেন, “লালকমল আর নীলকমল কিনে দিয়েছে।”
ভ্যাবাচ্যাকা খেলেও একটু সমঝে আবার জিগ্যেস করি, “স্কুল ভাল লাগছে?”
এবারে বললেন, “আমি তো উকুলে যাই না।”
“অ্যাঁ, সে কী! প্রতিদিন সকালে শান্টুবাবু আপনাকে স্কুলে নিয়ে যায় না?”
“না তো।”
“তবে আপনি কোথায় যান?”
অরস্মিতবাবু দূরে কতগুলো গাছের দিকে আঙুল তুলে বললেন, “ওইখানে যাই। ওখানে ওয়ান টু থ্রি ফোর মাঙ্কির সঙ্গে আমি সারাদিন গাছের ওপরে থাকি। লালকমল আর নীলকমলও আসে।”
অরস্মিতবাবু তো দারুণ গুলবাজ হয়েছেন! পরে আরও কানে এল, ঠামির ঠাকুর-আসনের লম্বা চুল লক্ষ্মী ঠাকরুন নাকি প্যাঁচা সমেত ওনার কাছে আসেন। ঠাকরুন আবার নকুলদানাও খেতে দেন। গুল-টুল দিলেও তিনি লোক খারাপ নন, হাসিখুশি থাকেন। তাকে সদানন্দবাবু বলেও ডাকা যেতে পারে।
রবিবাবুর চারটে গান অরোবাবু মোটামুটি রপ্ত করেছেন। তবে তার বয়স যেহেতু দু’বছর দশ মাস, তাই কোনও কোনও শব্দ ঠিকঠাক বলা হয়ে ওঠে না। প্রথমটা একেবারে মোক্ষম গান। কোথাও আমার হারিয়ে যাবার নেই মানা, মনে মনে। আলো আমার আলো। হারে রে রে রে রে, আমায় ছেড়ে দে রে দে রে। পাগলা হাওয়ায় বাদল দিনে। এখানে একটা জিনের ব্যাপার আছে। পাগলা হাওয়ায় গানটা ওনার পিতৃদেব পূষনবাবুরও শৈশবের প্রিয় গান ছিল। উনি ভর সন্ধেবেলায় চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে ওই গানটা গাইতে গাইতে খেলার মাঠ থেকে বাড়ি ফিরতেন। তবে পূষনবাবুর তুলনায় অরোবাবুর সুর ছন্দ তালের ব্যাপারটা এই বয়সেই বেশ নজর করার মতো। অরোবাবু পা ঠুকে ঠুকে বাঁহাত ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে অনেকটা কার্তিক দাস বাউলের মতো নেচে নেচে গান শোনেন এবং করেন। তবে উনি এতটাই ক্ষিপ্রগতি যে ইচ্ছে থাকলেও ছবি তোলা গেল না।
চলে আসার সময় দেখলাম, যে বইটার ওপর উনি হুমড়ি খেয়ে পড়েছিলেন সেটা চমৎকারসব ছবিতে ভরা। মেটারলিঙ্কের ‘দ্য ব্লু বার্ড’। কাজেই আমার মন উদগ্রীব আর কান উৎকর্ণ হয়ে রইল পরেরবার এসে শুনব, অরোবাবুর জন্য প্রতিদিন পার্কে মিটিল আর টিলটিল দাঁড়িয়ে থাকে। ওরা তিনজন নাকি একসঙ্গে নীলপাখি খুঁজতে যাবে। তবে অরোবাবু কি খুঁজে পাবেন শেষমেশ সেই ‘ব্লু বার্ড অফ হ্যাপিনেস’?
গল্প ২- পুজোর দিনে
পুজোর সময় অরোস্মিতবাবুর সঙ্গে বেশ কিছুটা সময় কাটানোর সুযোগ পাওয়া গেল। ওনার তিন বছর একমাস বয়স হয়ে গেছে এতদিনে। ব্যক্তিত্ব অনেক পরিণত হয়েছে। মান-অপমানবোধ প্রখর। কিছুটা লায়েক হয়েছেন। সেই সঙ্গে মিচকে আর ফাজিল। ঠিক পুজোর আগে আগে সন্ধেবেলা মনোজদের মতো অরোবাবুদের অদ্ভুত বাড়িতে গিয়ে দেখি ওনাকে নানান কিছু জিগ্যেস করা হচ্ছে। স্কুলে ভর্তি হতে হবে। তারই একটা মহড়া চলছে। একটু ঠাহর করে দেখলাম, বার বার প্রশ্ন করে তার মগজ পরীক্ষা করার ব্যাপারটা উনি একেবারেই ভালোভাবে নিচ্ছেন না। তাই শুনতে পেলাম উনি বলছেন, বাবার নাম বাবা। আকাশের রং ব্রাউন। রাইম শোনাতে বললে আলুটি বালুটি মালুটি যা মনে আসছে বলে চলেছেন। একসময় তো উঠে চলে গেলেন পর্যন্ত। যেতে যেতে বলে গেলেন, কারোর সঙ্গে কোনও কথা বলব না। খুবই মেজাজি মানুষ বোঝা গেল।
এরপর পুজোর ক’টাদিন আমরা একসঙ্গে থাকলাম। ওনাকে আর একটু কাছ থেকে দেখার সৌভাগ্য হল বইকি। আমাদের বাবা খোলা উদাত্ত গলায় খুব আবেগ দিয়ে চণ্ডী পড়তেন। দুর্বল এবং অক্ষম অনুসরণ হলেও ভাবলাম ট্র্যাডিশনটা বজায় থাক। জয়ন্তী মঙ্গলা কালী বলার পরেই শুনলাম একটা রিনরিনে মিঠে গলা…. ভদ্দকালী কপালিনী। মুখে একটা মারাত্মক ফিচেল হাসি। কি জানি কখন ওনার বাবার কাছ থেকে শুনে নিয়েছেন হয়ত। আবার শুনেছি জমাদার বাদল বাথরুম সাফাই করতে এলে উনি ফিচলেমি করে পাগলা হাওয়ায় বাদল দিনে গেয়ে ওঠেন। আমার বাড়িতে এসে ধুলোপড়া তানপুরাটা ট্যাং ট্যাং করে বাজিয়েছেন, ওটা নাকি পিয়ানো। একদিন ঠাসিয়ে-ঠুসিয়ে ভাত খাওয়ানোর পর উনি আমাদের দিকে তাকিয়ে বললেন, “আবার এখন মুসাম্বিলেবু খাওয়াবে বলছে…।” বলার ভঙ্গিতে এমন একটা কর্তাগিরি ছিল যে কেউ আর এগুতে সাহস পেল না।
পুজোর সময় মেলায় গিয়ে খেলনাগাড়ি-টারি চালিয়ে অরোবাবুর সে এক আলাদা কনফিডেন্স। উনি ঠিক করেই ফেললেন শান্টুবাবুর আর দরকার নেই। উনি সে কাজটা বেশ ভালোই পারবেন। শুধু তাই নয়, এরপর থেকে উনি পদে পদে শান্টুবাবুর খুঁত ধরতে লাগলেন, বাঁদিকে ঘোরাও, খালি ব্রেক দিচ্ছে, কিচ্ছু জানে না। মাঝে একদিন বললাম, “অরোবাবু, আমার সঙ্গে দিল্লি যাবেন?”
উনি এককথায় ঘাড় কাত করে ‘হ্যাঁ’ বললেন। কিন্তু উনি তো অনেক পার্শ্বচরিত্র নিয়ে ঘোরাফেরা করেন। তাই জিগ্যেস করলেন, “মা? বাবা? ঠামি?”
বুঝলাম এরা মুখ্য পার্শ্বচরিত্র। আমি বললাম, “হ্যাঁ হ্যাঁ, ওরাও যাবে।”
এরপর শুরু করলেন গৌণ পার্শ্বচরিত্রের তালিকা। রিঙ্কু? রিনা? টুম্পা? শান্টু? পুচু? আমি এবার ধীরে ধীরে মাথা নাড়ি। এরপর শুরু হল কাল্পনিক পার্শ্বচরিত্রের তালিকা, লুখখি ঠাকুর? প্যাঁচা? রাক্ষস? ডোনাল্ড ডাক, মিকি…
ওরে বাবা! আমার বাড়িতে এত্ত লোকের জায়গা নেই যে!
পুজো শেষ হয়ে গেল। অরোবাবুও নিজের বাড়ি ফিরে গেলেন। কলকাতা ছাড়ার আগে দেখা করতে গেলাম। বললাম, “অরোবাবু, আপনি চলে যাবার পর খুব কেঁদেছি জানেন! আমি আর আপনার পিশেমশাই দু’জনেই, খুব কেঁদেছি আপনার জন্য। অরোবাবু একপলকে শান্তভাবে শুনলেন তাঁর অনুরাগীদের কথা। তারপর রিনরিনে গলায় বললেন, “খুব কেঁদেছ তোমরা?”
আমি একেবারে গদগদ হয়ে গেলাম। শুনলাম অরোবাবু বলছেন, “কাঁদতে কাঁদতে তোমাদের নাক দিয়ে সদ্দি বেরিয়ে গেছিল?”
গল্প ৩–অরোর ঠামি
আমাদের অরোস্মিতবাবু বেশ গুছিয়ে বুড়োটে বাংলা বলে থাকেন। যেমন পোকামাকড়, আদরযত্ন, বকাবকি, দিতে পার, করতে পার, মানে সাড়ে তিন বছরের তুলনায় ওঁর কথা বলার ধরন বেশ পরিণত। আমাদের মাকে নিয়ে ঘোরতর দুঃখের কঠিন সময় চলছে বেশ কিছুদিন ধরে। এরই মধ্যে একদিন দেখি অরোস্মিতবাবুর বাবা খুব বিরক্ত। ল্যাপটপের মধ্যে নাকি একটা লালরঙের বোতামের মতো থাকে, সেইটা পাওয়া যাচ্ছে না। আরোবাবুকে তলব করা হল। উনি বেশ প্রফুল্লমুখেই জানালেন উনিই লাল বোতামটা খুঁটিয়ে তুলে ফেলেছেন। ওনার বাবা এবার জিজ্ঞেস করলেন, “কোথায় রেখেছ?”
আরোবাবু বললেন, ওনার খেলনাগুলোর মধ্যে।
“যাও, নিয়ে এসো।”
কিন্তু আরোবাবু বোতামটা পেলেন না। ওনার বাবা এবারে খুব রেগে গিয়ে বলল, “সবসময় বড়োদের জিনিসে হাত দাও, এটা আমার অফিসের কাজের জিনিস! আমি এখন কাজ করব কেমন করে? কেন তুমি হাত দিয়েছ? এর আগেও তোমাকে আমি ধরতে বারণ করেছি, তুমি মোটে কথা শোন না।”
পিতাপুত্রের বাকবিতণ্ডার দিকে স্মিতহাসি দিয়ে তাকিয়ে আছেন ছবির ফ্রেমবন্দি আমাদের বাবা, অরোর দাদু। সামনে চা বিস্কুট, রাখা আছে ওনার চশমা, মোবাইল ফোন, পেন, খবরের কাগজ। যেন এখুনি এসে বসবেন। অরোর বাবা গজগজ করেই চলেছে। অরোবাবু মেঝেতে পায়ের বুড়ো আঙুল ঘষটাচ্ছে, করমচার মতো ঠোঁটটা নীচের দিকে ঝুলে পড়েছে, মারবেল গুলির মতো ওনার দুটো নীল চোখের তারা ওপর নীচ করছে। আর গঞ্জনা সইতে না পেরে অরোবাবু এবারে তার রিনরিনে গলায় বুড়োটে বাংলায় দাদুর হাসিহাসি মুখের দিকে তাকিয়ে বলে উঠলেন, “এতো কাজের জিনিস, তা দাদুর কাছে রেখে গেলেই পার।”
ঠামির ঘনঘন হাসপাতাল যাওয়া আর শেষপর্যন্ত বাড়িতে না ফেরা অরোবাবুকে রীতিমত ভাবিয়ে তুলেছে। ঠামি হাসপাতালে আছে, কবে আসবে, মনখারাপ লাগে, এসব কথা তিনি বহুবার সবাইকে বলেছেন। ঠামিকে দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না অথচ পিপিকে (পিসি) বেশি বেশি করে আজকাল দেখা যাচ্ছে। ঠামিকে যে দেখাশোনা করত সেই রিঙ্কুকেও পিপির সাথে বেশি করে দেখা যাচ্ছে। অরোবাবু তার পিসির ওপর চটে লাল। তার মনে হল, এদের মধ্যে কোনও কার্যকারণ সম্পর্ক আছে। ওই পিসিটাই যত নষ্টের গোড়া। ঠামিকে দিল্লিতে নিয়ে চলে গেছে। আর রিঙ্কুকে দেখলেই অরোবাবু প্রচণ্ড সওয়াল শুরু করে দিচ্ছেন। পিপির মুখ ভার। একমাত্র ভাইপো তাকে ভুল বুঝছে। অরোবাবুর বাবাও এই ভুল ভাঙানোর অনেক চেষ্টা করছে।
একদিন অরোবাবু ওনার বাবার হাতটা ধরে বললেন, “বাবা শোনো, আলোচনা আছে।”
বাবা বলল, “হ্যাঁ হ্যাঁ, বল।”
অরোবাবু বললেন, “আমার ছোটোঘরে চল।”
ওটা ওনার অফিসঘর। ওখানে ওনার দুনিয়ার খেলনা জড়ো করা আছে। সেখানে গিয়ে বাবার চোখে চোখ রেখে অরোবাবু জিজ্ঞেস করলেন, “ঠামি কোথায়?”
বাবা বলল, “ঠামি বেড়াতে গেছে। বাসুদেবদাদু ঠামিকে বেড়াতে নিয়ে গেছে।”
অরোবাবু হন্তদন্ত হয়ে দাদুর ছবির সামনে এসে বেশ চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বললেন, “তুমি একটা বাজে কাজ করেছ। কেন করেছ? কেন ঠামিকে নিয়ে গেছ?”
এরকমভাবে প্রায় প্রতিদিনই ছবির মধ্যে বসে দাদু ধমক খেতে থাকেন। অরোবাবুর দুই দাদু, বাসুদেব আর কমলেশ। একদিন কেউ একজন মোবাইল ফোন এনে বলল, “নাও দাদুর সঙ্গে কথা বল।”
অরোবাবু ঝাঁপিয়ে পড়ে বলতে লাগলেন, “তুমি ঠামিকে কেন নিয়ে গেছ? এখনও দিয়ে যাচ্ছ না কেন? তুমি খুব খুব বাজে কাজ করেছ।”
ওপাশ থেকে কমলেশদাদু বলতে থাকেন, “আমি না, আমি না, ঠামিকে তো তোমার বাসুদেবদাদু বেড়াতে নিয়ে গেছে।”
অরোবাবু অবিশ্যি এখানেই থেমে থাকেননি। উনি ঠামির ফ্রেমবন্দী ছবিকেও খুব একহাত নিয়েছেন। হুমকি দিয়েছেন, আর কোনওদিন কথা বলবেন না। আকাশের দুটো পাশাপাশি তারাকে বাবা একদিন দেখিয়ে দিয়েছে। কিন্তু অরোবাবু ঠামি আর দাদুর মুখ তার মধ্যে দেখতে পাননি। হঠাৎ একদিন দেখলাম দাদু আর ঠামির ছবির সামনে কয়েকটা খুচরো পয়সা রাখা আছে। কে রাখল? অরোবাবুর বাবা জানাল, “ওটা অরোবাবু রেখেছেন, দুজনে মিলে বেড়াতে বেরিয়েছে, পয়সা লাগবে না?”
ছবিঃ অংশুমান