গল্প এলেম নতুন দেশে রূপসা ব্যানার্জি বসন্ত ২০১৮

golpoelem notun deshe1

এলেম নতুন দেশে

রূপসা ব্যানার্জি

“মুন্নু, ও মুন্নু, কোথায় গেলি? সাড়াশব্দ পাই না কেন? দেখ কান্ড! আবার মোবাইল নিয়ে গেম খেলতে বসে গেছে! কী করব ভগবান! এই মেয়ে যে চোখের বারোটা বাজিয়ে ছাড়বে!” মা প্রতিদিনই এই ফাটা রেকর্ড বাজিয়ে চলেছেন, কিন্তু মুন্নুর তাতে কোনও ভ্রূক্ষেপ নেই! মায়ের মোবাইলটা সামনে দেখলেই তার হাত নিশপিশ করে গেম খেলার জন্য।

আজ তো এই গেম নিয়েই একটা কুরুক্ষেত্র হয়ে গেল। মুন্নুকে ঘুম থেকে তুলতে এসে মা দেখেন মেয়ে সারা গায়ে-মাথায় চাদরমুড়ি দিয়ে ঘুমোচ্ছে অথচ এখন এপ্রিল মাস! অবাক হয়ে মা চাদরটা সরিয়েছেন আর মোবাইলসমেত মুন্নু ক্যাচ-কট-কট! তারপরেই পিঠের উপর একচোট দুমদাম হয়ে গেল। বাবাও খুব বকাবকি করলেন।

যাহ্‌, দিনটাই কী বাজেভাবে শুরু হল! মুন্নু চোখ মুছতে মুছতে এই কথাটাই ভাবছে, আর ঠিক তখনই ডোরবেলটা বেজে উঠল। আরিব্বাস, এ যে রণিমামু! ওর এটাই স্বভাব। কাউকে কিছু না জানিয়ে হুট করে এসে সারপ্রাইজ দেবে। মুহূর্তের মধ্যেই সকলের মেজাজ বদলে গেল। শুরু হয়ে গেল হই-হুল্লোড়। রণিমামু মায়ের পিসতুতো ভাই হলেও নিজের ভাইয়ের মতোই। সে আর তার বাবাও খুব ভালোবাসে মামুকে।

দুপুরবেলা মায়ের মুখে মুন্নুর অতিরিক্ত মোবাইল-গেম খেলার কথা শুনলেন চাইল্ড স্পেশালিষ্ট ডক্টর রণবীর বসু অর্থাৎ, রণিমামু। তারপর বললেন, “বাচ্চাটাকে দোষ দিয়ে লাভ নেই, ছোড়দি। ওর জীবনে কতটুকু আনন্দ আছে বল তো! আছে শুধু কলকাতার এই দমবন্ধ করা পরিবেশ, ছোট্ট ফ্ল্যাটের চার দেওয়াল আর স্কুলের একগাদা হোমওয়ার্ক! বেচারি কেন টিভি আর মোবাইল নিয়ে পড়ে থাকে তা তুই ভেবেছিস কোনওদিন? এক কাজ করবি? মে মাসে ওর গরমের ছুটি পড়লে তোরা তিনজন আমার কোয়ার্টারে এসে কিছুদিন কাটিয়ে যাবি? খুব সুন্দর খোলামেলা পরিবেশ, জানিস! গ্রামের মতো প্রচুর গাছপালা, খোলা মাঠ, আবার শহরের সবরকম সুবিধেও আছে। আমি শিওর, তোদের খুব ভালো লাগবে।”

মামুর দেওয়া প্ল্যান মনে ধরেছিল মা-বাবার। তাই কিছুদিন পর স্কুলে গরমের ছুটি শুরু হলে মা আর মুন্নু একদিন সকালে শিয়ালদা থেকে কাটোয়া লোকাল ধরে পৌঁছে গেল ত্রিবেণী স্টেশনে। বাবার অফিসে কাজের চাপ থাকায় উনি আর যেতে পারলেন না।

ট্রেন থেকে নামতেই হই হই করে ছুটে এলেন মামু। তারপর তাঁর গাড়িতে চেপে মুন্নুরা চলল মামুর কোয়ার্টারে। ব্যান্ডেল তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রকে ঘিরে গড়ে উঠেছে ভারি সুন্দর এক ছোট্ট শহরতলি। স্কুল, পোস্ট অফিস, হসপিটাল সবকিছুই রয়েছে। এই হসপিটালেরই একজন ডাক্তার হলেন রণিমামু। প্রত্যেকটা বাড়ির সামনেই বেশ খানিকটা করে খোলা মাঠ। তার মধ্যে দিয়ে পিচঢালা ছোটো ছোটো গলিপথ ঢুকে গেছে।

মা বললেন, “আরে বাহ্‌! এ তো সেই ছোটোবেলা ঝুলনের সময় আমরা যে বালি দিয়ে রাস্তা বানাতাম, সেরকম মনে হচ্ছে।”

মুন্নুর মনটাও খুব খুশি খুশি লাগছিল। এত গাছ সে আগে দেখেনি।

মামুর ঘরের সামনে গাড়ি থামতেই হাসিমুখে বেরিয়ে এলেন পিসিদিদু, মানে রণিমামুর মা। খুব আদর করে ওদের ভিতরে নিয়ে গেলেন তিনি।

golpoelem notun deshe 2

এখানে এসে মুন্নুর রুটিন একেবারেই বদলে গেছে। সকালে উঠে পিসিদিদু ওর হাতে গত রাতের একটা বাসি রুটি ধরিয়ে দেন কাকদের খাওয়ানোর জন্য। বারান্দায় দাঁড়িয়ে টুকরো টুকরো করে সেই রুটি বাইরে ছুড়ে দেয় সে আর সব কাকগুলো কা কা করে উড়তে উড়তে চলে আসে। কেউ মাটি থেকে খুঁটে খায়, আবার কেউ শূন্যে ডিগবাজি খেয়ে রুটির টুকরো ক্যাচ লুফে নেয়। মুন্নু হাততালি দিয়ে নাচতে থাকে।

আর একটু বেলা হলেই মাঠে ঘাস খেতে আসে সাদা, কালো, বাদামি রঙের কত গরু! টাউনশীপের বাইরে আশেপাশের গ্রাম থেকে গরুগুলো এখানে চরতে আসে। জানালা দিয়ে ওদের দেখতে খুব ভালো লাগে মুন্নুর। একদিন দেখল, একটা ছোট্ট মিষ্টি বাছুর এসেছে তার মায়ের সঙ্গে। মাকে চিনতে না পেরে অন্য গরুদের কাছে গিয়ে তাদের দুধ খাচ্ছে চুক চুক করে। আর সেই গরুরা কিন্তু একটুও রাগ করছে না, বরং ওর গা চেটে আদর করে দিচ্ছে। পিসিদিদু বললেন, “এরা হল ওর সই-মা, মানে মায়ের বন্ধু।”

কোনও কোনও গরু আবার ওদের রান্নাঘরের জানালার নিচে এসে বসে থাকে। জানে তরকারি বা ফলের খোসা মিলবার চান্স আছে এখানে। দিদু হাসতে হাসতে মুন্নুকে বলেন, “যা, আমের খোসা, কলার খোসা কী আছে দিয়ে দে ওকে।”

একবার এই নিয়ে একটা দারুণ মজা হল। মস্ত বড়ো কালো একটা মহিষ এসেছে ফলের খোসা খেতে। পিসিদিদুর হাত থেকে খাচ্ছে মহিষটা। মুন্নুর খুব ইচ্ছে হল সেও হাতে করে ওকে খাওয়াবে। একটা আমের আঁটি নিয়ে যেই দিতে গেছে, অমনি মহিষটা ভোঁস করে বিকট আওয়াজ করে বসল! আর মুন্নু? খোসা ফেলে ঘরের মধ্যে এক দৌড়! “বাবা রে, কামড়ে দিল রে!”

পিসিদিদু তো  হেসেই খুন! বললেন, “দূর পাগলি! মহিষ আবার কামড়ায় নাকি? বেচারার অত বড়ো শরীর, নিঃশ্বাস ফেললে তো অনেকটা হাওয়া বেরবে, তাই না? ওই জন্যই ওরকম শব্দ হয়েছে। তুই এমন ভয় পেলি, যে বেচারা দুঃখ পেয়ে চলে গেল।”

কিন্তু মুন্নুর ভয় আর গেল না। সে দূর থেকেই খেতে দেয় জানালা দিয়ে ছুড়ে।

দুপুরে সবার খাওয়া হয়ে গেলে পিসিদিদু আর মুন্নু বাইরে বাগানে এসে দাঁড়ায়। সঙ্গে ঠোঙায় করে বেঁচে যাওয়া ভাত, মাছের কাঁটা, মাংসের হাড় সব গুছিয়ে নিয়ে আসে। এখনকার গেস্ট হল রোগা, দুর্বল কুকুর লালু। সে এসে লেজ নাড়তে নাড়তে খাবার খায়, খাওয়ার পর ওখানেই শুয়ে নেয় একটু। মুন্নু তখন অনেক গল্প করে লালুর সঙ্গে। কথা বলতে না পারলেও লালু কান খাড়া করে সব শোনে, মাঝে মাঝে ভুক ভুক করে লেজ নেড়ে নতুন বন্ধুর কথায় সায় দেয়।

পাড়ার কয়েকটা বাচ্চার সঙ্গেও বেশ ভাব হয়েছে মুন্নুর। বিকেলে সবাই মিলে মাঠে লুকোচুরি, ছোঁয়াছুয়ি আরও অনেক কিছু খেলে। পড়াশুনো করতেও এখন আর অত খারাপ লাগে না। চটপট পড়া শেষ করে দিদুর মুখে রূপকথা শোনে সে। ফ্রী থাকলে মামু আশেপাশের গ্রাম ঘুরিয়ে দেখান। আবাক হয়ে দেখে সে। কুঁড়েঘর, পুকুর, ধানক্ষেত সবই ওর কাছে নতুন। এইভাবেই স্বপ্নের মতো দিনগুলি কাটতে লাগল ঝড়ের গতিতে।

মাসখানেক হল কলকাতায় ফিরেছে মুন্নুরা। স্কুল খুলে গেছে। মোবাইল, টিভি নিয়ে আর কোনও অশান্তি হয় না এখন। মুন্নু সময় পেলেই ড্রয়িং খাতায় ছবি আঁকে – গ্রাম, গরু-বাছুর, লালু ভাত খাচ্ছে, ছেলেমেয়েরা মাঠে খেলছে এইসব ছবি। তার নতুন অভিজ্ঞতা নিয়ে স্কুল ম্যাগাজিনে একটা গল্প লিখে জমা দিয়েছে সে। বেঙ্গলি টিচার মিতা-ম্যাম খুব ভালো বলেছেন লেখাটা দেখে। গল্পের নাম কী দেবে মুন্নু বুঝতে পারছিল না। ম্যাম বলেছেন, “নাম দাও ‘এলেম নতুন দেশে’।

ছবিঃ অংশুমান

জয়ঢাকের সমস্ত গল্পের লাইব্রেরি এই লিংকে

লেখক পরিচিতিঃ
রূপসা ব্যানার্জী
কম্পিউটার  সায়েন্স এ  বি.টেক।  পাঁচ বছর স্কুল/ কলেজে শিক্ষকতা  করেছি।  শখ – গল্পের বই পড়া, গল্প ও ছড়া লেখা এবং গান গাওয়া।

13 thoughts on “গল্প এলেম নতুন দেশে রূপসা ব্যানার্জি বসন্ত ২০১৮

  1. বাহ, গত শারদীয়ার পর মুন্নু আবার ফিরেছে গল্পে। অনেন শুভেচ্ছা রইল। 🙂

    Like

  2. ছোটবেলা কিছুক্ষণের জন্য ঘুরে এলাম

    Like

  3. আবদার- জয়ঢাকে যারা প্রথম লিখলেন তাদের একটা সংক্ষিপ্ত পরিচয় তাদের লেখার সাথে দিয়ে দিলে তাদের জানতে সুবিধা হয়। আর আমাদের মতো বুড়োরা, যারা আশীর্বাদ করার সুযোগ পায় টায় না, তারা একটু দুহাত তুলে, বুঝতেই তো পারছেন, হে হে…

    Like

  4. আবদার- জয়ঢাকে যারা প্রথম লিখলেন তাদের একটা সংক্ষিপ্ত পরিচয় তাদের লেখার সাথে দিয়ে দিলে তাদের জানতে সুবিধা হয়। আর আমাদের মতো বুড়োরা, যারা আশীর্বাদ করার সুযোগ পায় টায় না, তারা একটু দুহাত তুলে, বুঝতেই তো পারছেন, হে হে…

    Like

  5. কিছুক্ষনের জন্য ফিরে গিয়েছিলাম ছোটবেলায়। লেখিকাকে ধন্যবাদ ছেলেবেলাকে খুঁজে দেবার জন্য। খুব ভালো লাগল।

    Liked by 1 person

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Twitter picture

You are commenting using your Twitter account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s