গল্প জড়োয়া হারের রহস্য সহেলী চট্টোপাধ্যায় শরৎ ২০১৮

সহেলীর আরো গল্পঃ জন্মান্তর রহস্যভাই আর বোনের গল্পহাইজ্যাক কাণ্ড

সহেলী চট্টোপাধ্যায়

স্কুল থেকে ফিরেই ভিক্টর দেখল মায়ের মুখ থমথমে হয়ে আছে। সকালে বেরোবার সময়ও মা বেশ স্বাভাবিক ছিলেন। প্রতিদিন স্কুল থেকে ফেরার পর মা তাকে ভাত বেড়ে দেন। ওভেনে খাবার গরম করে দেন। নানারকম গল্প করেন। ওর স্কুলের খবর নেন। মায়ের রান্নার হাত বেজায় ভালো। আজও মা গরম করে দিলেন। কিন্তু মাছের ঝোলে নুন দিতে ভুলে গেছেন অথবা দিলেও খুব কম দিয়েছেন। এইরকম ঘটনা সাধারণত কখনও ঘটে না। একমাত্র মায়ের মুড অফ থাকলেই ঘটে। ভিক্টর মাকে কথাটা বলবে ভাবল, কিন্তু মায়ের মুখ দেখে বলল না। এখন বললে কপালে দুঃখ আছে। ছেলেকে খেতে দিয়ে সুচরিতা পাশেই বসে থাকেন। আজ তাঁর মন একটুও ভালো নেই।

হঠাৎ মোবাইল বেজে উঠল শব্দ করে। ভিক্টর কান খাড়া করে শুনতে থাকে। তবে বিশেষ লাভ হয় না। ফোনটা আসার পর সুচরিতার মুখ কালো হয়ে যায় আরেক পোঁচ। বললেন, “এখনও পেলে না! আচ্ছা, আমি এক্ষুনি আসছি। আর ঘণ্টা খানেকের মধ্যে।”

এই কয়েকটি কথা বলেই ফোন রেখে দেন। ভিক্টর আর কৌতূহল চেপে রাখতে পারে না। বলেই ফেলে, “কার ফোন, মা? তুমি এত টেনশন করছ কেন?”

সুচরিতা কখনও ছেলেকে ছোটো বলে তুচ্ছ জ্ঞান করেন না। বিশেষ করে রাজস্থানের ঘটনার পর থেকে ওকে অনেক সমীহ করে চলেন (রহস্যভেদী ভিক্টর)। বললেন, “আজ তোর কোচিং নেই। আমি তোর মামার বাড়ি যাচ্ছি। ওখানে একটা ব্যাপার ঘটে গেছে। তুই ইচ্ছা করলে আমার সাথে যেতে পারিস বা বাড়িতে থেকে রেস্টও নিতে পারিস।”

বাড়িতে থেকে রেস্ট নেওয়া ভিক্টরের ধাতে নেই।

ভিক্টরের ক্লাস এইট। আজ সোমবার। শনি, রবি, সোম, মঙ্গল তার প্রাইভেট টিউশান থাকে না। তাছাড়া ওর একটা বড়ো গুণ, ও কোচিং ক্লাশে বিশেষ যায় না। নিজের পড়াশোনা সে নিজেই করতে পারে। স্কুলকে ফলো করে। বিভিন্ন রেফারেন্স বই ফলো করে। শুধু বুধ আর শুক্রবার তার প্রাইভেট টিউশান থাকে অঙ্কের। ইংরাজি বাড়িতে দাদুই দেখান। ভিক্টর প্রতিবছর স্ট্যান্ড করে। আর রবিবার সকালগুলো মা তাকে গান শেখান। এখন বাড়িতে দাদু-ঠাম্মা নেই। পুরী গেছেন দিন সাতেকের জন্য। মার্চে পুরীর আবহাওয়া বেশ মনোরম।

সুচরিতা বাড়িতে তালা ঝুলিয়ে ভিক্টরকে নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন একটা উবের ধরে। চন্দনপুর যেতে চল্লিশ মিনিট লাগল। ভিক্টররা এখন কলকাতা থেকে দূরে একটা মফঃস্বল শহরে থাকে। ওর মামার বাড়ি চন্দনপুরের কাছেই।

ভিক্টরের মামার বাড়িটা বিশাল জায়গা জুড়ে। সাদা রঙের দোতলা বাড়ি। সামনে পেছনে অনেকখানি জায়গা। ভিক্টরের মামার বাড়ির দাদু খুব বড়ো ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন। তিনিই শখ করে বানিয়েছিলেন। দাদু বহুদিন হল মারা গেছেন। তখন সে খুব ছোটো।

দোতলায় দিদার ঘরে আসর বসেছে। সবার মুড অফ। দিদা, মামা, মামিমা, মামাতো দিদি পিয়ালী সবাই মুখ কালো করে বসে আছে। মাসির মন সবচেয়ে খারাপ। আজ কলেজেই যায়নি। পড়তে যায় না, পড়াতে যায়।

মায়ের মুখে ভিক্টর সব শুনেছে। মাসির বিয়ের ঠিক হয়েছে কিছুদিন। জুনের প্রথমেই বিয়ে। দিদা কিছু পুরনো গয়না ব্যাঙ্ক থেকে আনিয়েছিলেন মাসিকে দিয়ে। কথাটা বাইরের কারোরই জানার কথা নয়। একমাত্র মামা-মামিমা আর মাসি ছাড়া। আজ সকাল থেকেই একটি বহুমূল্য জড়োয়ার রত্নহার গায়েব হয়েছে। এই হারের সাথে অনেক সেন্টিমেন্ট জড়িয়ে আছে। ভিক্টরের দিদাকে বৌভাতে ওঁর শাশুড়িমা দিয়েছিলেন।

গয়নাগুলো পরশু লকার থেকে আনা হয়েছিল। দিদার ঘরের গোদরেজের আলমারিতে থাকত যার চাবি সবসময় দিদার আঁচলে বাঁধা থাকে। রাতে ঘরের দরজা বন্ধ করে ঘুমোন। ঘর থেকে বেরোবার সময় ঘরে তালা চাবি দিয়ে বেরোন। ওর মামার বাড়ির প্রত্যেকেই সেটা করেন। তালা দরজার সাথেই লাগানো থাকে। এই কোম্পানির তালার চাবি বানানো খুব শক্ত। মাসি ক’দিন দিদার পাশেই ঘুমোচ্ছে, যদিও তার নিজের আলাদা ঘর আছে।

বহুদিনের দেখাশোনা করার লোক বাসন্তী খুবই বিশ্বস্ত। তার বয়স প্রায় পঞ্চাশ হবে। ভিক্টরের মা-মাসিকে মানুষ করেছে কোলে পিঠে করে। ভিক্টরকে খুব ভালোবাসে। বহুদিন সে এই বাড়িতে কাজ করেছে। নিজের স্বামী ছিল না। এই পরিবারে কাজ করে নিজের মেয়েকে লেখাপড়া শিখিয়েছে, ভালো ঘরে বিয়ে দিয়েছে। এখন দিদার সঙ্গে সঙ্গে থাকে। মাঝে মাঝে মেয়ের বাড়ি যায়। তার শোবার ঘর আলাদা। সে এই গয়নার ব্যাপার জানলেও তাকে সন্দেহের প্রশ্নই ওঠে না। তার শরীরটা ক’দিন ভালো যাচ্ছে না, তাই ঘরে শুয়ে আছে। চিন্তার কথা হল, গুটিকয় পক্স বেরিয়েছে গায়ে। আজ সবে তিনদিন। সুচরিতা শুনেই বলেছেন, স্নেহাকে মানে ভিক্টরের মাসিকে সঙ্গে করে নিয়ে যাবেন। নিজের কাছে কিছুদিন রাখবেন।

বাসন্তীদিদার ঘরটা দোতলায় হলেও দিদা মাসি আর মামার ঘর থেকে অনেকটা দূরে। ঘরের পেছনদিকে বাগান। আম, জাম, কাঁঠাল, লিচু ইত্যাদি বড়ো বড়ো গাছ সেখানে।

ভিক্টর এক ফাঁকে ঘরটা উঁকি দিয়ে দেখে এসেছে। জানালা-দরজা সব বন্ধ। দরজার ফুটোয় চোখ লাগিয়ে সে দেখেছে। ঘর অন্ধকার করে বাসন্তীদিদা মশারি টাঙিয়ে শুয়ে আছে। সবাই দোতলায় থাকে। বাসন্তীদিদা এখন শুধু ফল আর দুধ খাচ্ছে। তাও কমলামাসি বাইরে থেকে ট্রে করে খাবার এনে দরজার সামনে রেখে যাচ্ছে। ভেতরে ঢুকছে না। মামিমা বলছিলেন।

কমলামাসি চলে যাওয়াতে আজ মামিমাকেই দিতে হয়েছে। খালি বাসনপত্র আবার ট্রেতে করে বাসন্তীদিদা দরজার সামনে রেখে দিচ্ছে। আর বাসন মাজার ঠিকে ঝি সকাল-বিকেল বাসন মেজে আর ঘরদোর ঝাঁট দিয়ে মুছে চলে যায়। সেই সময় কেউ না কেউ ঘরে থাকেন। ঠিকে ঝির ভরসায় কেউ ঘর খালি রেখে যান না। বাড়ির প্রত্যেকেই খুব সাবধানী। তবুও এইরকম ঘটনা ঘটে গেল।

একতলায় কেউ থাকে না। সুন্দর করে সাজানো গোছানো থাকে। অতিথি এলে একটা রুম খুলে দেওয়া হয়। নিচে বসবার ঘর, ডাইনিং, বাথরুম আর কিচেন আছে। মামার মক্কেলরাই বেশি আসেন সাধারণত। ভিক্টরের মামা উকিল। ড্রয়িং জুড়ে তাঁর মোটা মোটা বইয়ের র‍্যাক।

নিচের আরেকটা ঘরে থাকে কমলামাসি। তার দায়িত্ব হল বাড়িঘর পরিষ্কার করা আর রান্নার কাজে মামিমাকে সাহায্য করা, দিদার পায়ে তেল মালিশ করা। কমলামাসির ভয়ডর কম। সে একাই থাকতে পারে। কমলামাসি বছর পাঁচেক হল আছে। তবে আজ সকালে কমলামাসিকে তার ছেলে এসে নিয়ে গেছে সাতদিনের জন্য।

সুচরিতা মাকে জিজ্ঞাসা করলেন, “তোমার আলমারি, দেরাজ সব ভালো করে দেখেছ?”

“হ্যাঁ রে, সুচি। তোর মা এখনও বুড়ো হয়নি। সব মনে রাখতে পারে। সব ভালো করে দেখেছি তন্নতন্ন করে। বিছানার তলা এমনকি গদিগুলো উলটেপালটে দেখেছি। একবার নয়, বারবার। বউমাকে জিজ্ঞাসা কর। ও আমার সঙ্গে ছিল।” দিদা বলেন।

মামিমা চৈতি দিদাকে সমর্থন করলেন। বললেন, “এমনকি আমাদের ঘরগুলোও দেখেছি। পাছে ভুল করে চলে আসে।”

পিয়ালী সবার জন্য চা করে আনল। সে এইচ.এস. দেবে সামনের বার। এইসব কাজ টুকটাক ভালোই করতে পারে।

“পুলিশে খবর করা ছাড়া আর উপায় নেই।”

মামা এবার মুখ খুললেন। “তখন থেকেই মাকে বলছি। মা রাজী হচ্ছেন না।”

“আরে, রাজী কি সাধে হচ্ছি না! এসেই জুতো পায়ে সারা ঘর তছনছ করবে! তার চেয়ে বাড়িতে আগে ভালো করে দেখি। পেলাম না যখন এবার থানায় খবর দিতেই হবে।”

“অনেক পুরনো আমলের গয়না। আমার ঠাকুরমার জিনিস ছিল। আর আমার খুব পছন্দ ছিল হারটা। ঠাকুরমার আশীর্বাদ ছিল আমার কাছে।” স্নেহা, ভিক্টরের মাসি এতক্ষণ পর কথা বলল। গলায় আক্ষেপ ঝরে পড়ে।

“আচ্ছা, কখন বুঝতে পারলে যে গয়নাটা নেই?”

“দুপুরে খাবার পর। আলমারির লকার খুলে বার করে দেখি হারটা মিসিং। অন্যসব গয়না মানে দুল, চেন, আংটি আর হাতের বালাজোড়া ঠিক আছে। সব গয়না তো আনিনি লকার থেকে।” দিদা বললেন।

ভিক্টর ফট করে জিজ্ঞাসা করল, “কমলামাসির ছেলের নাম কী?”

স্নেহা বলল, “শিবেন। কাল রাত্তিরে এসেছিল। আজ সকালে ওরা রওনা দিল।”

“আজ সকালে মানে? শিবেন কি একরাত্তির ছিল বাড়িতে?”

“হ্যাঁ। কাল দুপুরে দুটো নাগাদ এসেছিল। লাঞ্চ সেরে ঘুমোতে ঘুমোতে দিনের আলো শেষ। তাই মা বলল, রাত্তিরটা থেকে কাল সকালে কমলাকে নিয়ে যেতে।”

সুচরিতা মাথা নাড়লেন। “তোমাদের উচিত হয়নি শিবেনকে এইভাবে অ্যালাউ করা। বাড়িতে যখন গয়না এনেছ, আরও সাবধান হওয়া উচিত ছিল।”

চৈতি সুচরিতাকে সমর্থন করলেন। “সে আমিও একই কথা বলে আসছি।”

সুচরিতা মাকে জিজ্ঞাসা করলেন, “গয়নাগুলো আনতে গেলে কেন হঠাৎ? বিয়ের তো এখনও দেরি আছে।”

“কী যে বলিস, সুচি! পালিশ করতে দিতে হবে না! সব কি বিয়ের মাথায় মাথায় করব নাকি! কতদিনের গয়না বল তো!” দিদা মাকে বকে উঠলেন।

ভিক্টর বলল, “শিবেন কি ওপরে, মানে দিদার ঘরে এসেছিল?”

“সন্ধ্যায় সে আমার ঘরে এসেছিল প্রণাম করতে। কিছু কথাবার্তা বলি। এই সন্ধেবেলা যেতে বারণ করি।”

“আর কিছু কথাবার্তা হয়েছিল?”

“আর… হ্যাঁ, মনে পড়েছে। তুমি কী করছ এখন, বউ কেমন আছে – এইসব।”

“শিবেন কী করে? সে বিয়ে করেছে বলছ।”

“ও যে কখন কী করে বলা শক্ত। কখনও মুদির দোকানে কর্মচারী তো কখনও ফুলুরির দোকান, কখনও ফুচকার ব্যাপারী। কমলা খুব দুঃখ করে ছেলের এমন উড়নচণ্ডে স্বভাবের জন্য। বছর খানেক হল বিয়ে দিয়েছে। আবার মদের নেশাও আছে।” স্নেহা বলল।

“এমন লোককে রাখাটা ঠিক হয়নি।” ভিক্টর জিজ্ঞাসা করল, “এখন সে কী করছে?”

“বলল তো কাজ পেয়েছে নতুন। কোন একটা স্কুলে ঘণ্টা বাজাবে আর কীসব করবে।” দিদা বললেন।

“হুম। খুব গুণের লোক বোঝা যাচ্ছে।”

ভিক্টর দিদার ঘরে ভালো করে চোখ বুলিয়ে দেখে নিয়েছে আগেই। পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন বিছানায় সাদা চাদর পাতা। বালিশের ওয়াড়ও সাদা। ঘরে দুটো গোদরেজের আলমারি। একটায় দিদার যাবতীয় দরকারি কাগজপত্র, আরেকটায় জামাকাপড় থাকে। আর একটা বুকশেলফে কিছু বই, যার বেশিরভাগই আধ্যাত্মিক। একটা বড়ো ফ্যাশনেবল টিভি আছে। একপাশে ছোটো একটা সিংহাসনে গোপাল ঠাকুর। ধূপ জ্বলছে। রুমের লাগোয়া বাথরুম।

মাসির ঘরও খুব ছিমছাম। দিদার ঘরে একটা দরজা আছে সেটা দিয়ে মাসির রুমেও যাওয়া যায়। মাসি ভেতর থেকে বন্ধ রাখে দরজাটা। এখন সেটা খোলা। মাসি কলেজে পড়ায়, তবে পার্ট টাইম। আলমারিভর্তি শাড়ি-চুড়িদার, আরও নানানরকম পোশাক। মাসি সাজগোজ করতে খুব ভালোবাসে। ড্রেসিং টেবিলের ওপর প্রচুর কসমেটিকস আর জাঙ্ক জুয়েলারি। ভিক্টর সব দেখতে থাকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে।

এরপর মামার ঘর, মামির ঘর, পিয়ালীদির ঘর সব একে একে দেখে নেয় ভিক্টর। সবাই তাকে অবাক হয়ে দেখছে। পিয়ালীদির মুখে অবজ্ঞার হাসি। কিন্তু এইসব নিয়ে সে মাথা ঘামায় না।

নিচতলার ঘরগুলো ও এক ফাঁকে দেখে নেয়। কিচেনটা অনেক সময় নিয়ে দেখে। কিচেনের আবর্জনা ফেলার জন্য একটা ডাস্টবিন আছে ছোটো। ভিক্টর দেখল, এখনও সব নোংরা ফেলা হয়নি। কিছু ওষুধের খালি ফয়েল আর খালি ওষুধের শিশি। শিশিটা খুব ছোটো। ইঞ্জেকশনে যেমন ব্যবহার করা হয়, অনেকটা সেইরকম।

সে একদৌড়ে ছাদে আসে। এখানে প্রচুর ফুলগাছের টব। নানানরকম ফুল ফুটে ছাদটা খুব সুন্দর দেখাচ্ছে। মামিমার শখ। নিজের হাতে প্রতিদিন যত্ন করেন। একটা পাতাবাহারি গাছের টবের মাটি একটু এলোমেলো হয়ে আছে। মাটি টব থেকে বেরিয়ে নিচে পড়ে আছে। ভিক্টর হাত দিয়ে ঠিক করতে যায়। মনে হয় কেউ এই গাছের গোড়ায় গর্ত করে কিছু রেখেছিল। ভালো করে গর্ত বোজানো হয়নি।

দোতলায় আবার দিদার ঘরে যায়। মামিমাকে প্রশ্ন করে, “টবের গাছগুলোয় জল দাওনি ক’দিন?”

“আজ সকালে দেওয়া হয়নি রে। ছাদেই যাইনি। কাল সন্ধের আগে দিয়েছি। কেন রে?”

“তুমি কাল বিকেলের পর আর ছাদে যাওনি? জামাকাপড় মেলতেও না?”

“না। জামাকাপড় কাচিনি আজ। সব ওয়াশিং মেশিনের ওপর রয়েছে, দ্যাখ।”

“আচ্ছা, বাসন্তীদিদার ঘরে কি টিভি-রেডিও আছে? বা স্মার্ট ফোন ইউজ করে?”

“নাহ্‌! ওপরে একটাই টিভি তোর দিদার ঘরে। আমরা কিছু দেখতে হলে দিদার ঘরেই আসি। আর নিচে ড্রয়িংয়ের টিভি তোর মামা দেখে। রেডিও-ও নেই ও-ঘরে। আর স্মার্ট ফোন তো বাসন্তীমাসি ব্যবহার করতে পারে না।”

“কিচেনের ডাস্টবিনের নোংরা কি আজ ফেলা হয়নি?”

“নাহ্‌! আজ মিউনিসিপ্যালিটি থেকে নোংরা ফেলার গাড়ি আসেনি। রোজ আসে না তো। সপ্তাহে দু’দিন।”

ব্যস, ভিক্টর লাফিয়ে ওঠে। মামার কানে কানে চুপি চুপি কীসব কথা বলে। মামার চোখে মুখে অবিশ্বাস।

খানিক বাদে একদল পুলিশ আসে জীপে করে। অফিসার বাসন্তীদিদার দরজার সামনে দাঁড়ায়, হাতে রিভলবার। বাড়ি ঘিরে ফেলেছে পুলিশে। আর দু’জন পুলিশ দরজায় ধাক্কা দেয়। ধীরে ধীরে দরজা খুলে দিল বাসন্তীদিদা। দুর্বল অশক্ত শরীরে দাঁড়িয়ে থাকতে পারছে না সে। দিদার মুখ ঘোমটায় ঢাকা। রুগ্ন গলায় জানায়, পক্স হয়েছে তাই এই মুখ সে কাউকে দেখাবে না। পক্স শুনে প্রত্যেকেই নিরাপদ দূরত্বে দাঁড়িয়ে পড়ে। বাড়িতে সবার মুখে হতাশা। পুলিশ অফিসার কড়া চোখে ভিক্টরের দিকে তাকায়।

ভিক্টর বিন্দুমাত্র না ঘাবড়ে পকেট থেকে ছোটো একটা কৌটো বার করে একটু নিচু হয়ে বাসন্তী দিদার চোখ লক্ষ্য করে ছড়িয়ে দিল। তার আগে অবশ্য রুমালে মুখ ঢেকে নিয়েছিল। তারপরই বীভৎস কাণ্ড। বাসন্তীদিদা যন্ত্রণায় আর্তনাদ করে উঠল। কিন্তু তার গলা কোনও দুর্বল অসুস্থ বৃদ্ধার গলা নয়। বিকট পুরুষের কণ্ঠ। “উফ্‌, জ্বলে গেল!”

পুলিশ অফিসার এগিয়ে গেলেন। বাসন্তীদিদার পরনের সাদা শাড়ি সাদা চুল ধরে টানতেই বোঝা গেল এ কোনওমতেই বাসন্তীদিদা নয়। একজন পুরুষ মানুষ। চোখে গোল মরিচের গুঁড়ো ছড়িয়ে দিয়েছে ভিক্টর। এই কায়দাও ফেলুদার থেকে শেখা।

মামা অবাক হয়ে বললেন, “শিবেন, তুই!”

হেঁচে-কেশে অস্থির শিবেন। ঘরের বাথরুম থেকে আসল বাসন্তীদিদাকে অচেতন অবস্থায় উদ্ধার করা হল। ঘুমের ইঞ্জেকশন দিয়ে অজ্ঞান করে রেখেছিল শিবেন। আর নিজে সাদা শাড়ি পরে সাদা চুল লাগিয়ে দিদার ভেক ধরে। বলতে থাকে, আমার পক্স হয়েছে। তাকে এই কাজে সাহায্য করেছিল কমলা।

পুলিশের মারের মুখে শিবেন সব কথা স্বীকার করে। কমলা বহুদিন আগেই আলমারির আর দরজার ডুপ্লিকেট চাবি বানিয়ে ফেলেছে। পাঁচবছর ধরে কাজ করে সে এই পরিবারের বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জন করে। শিবেনও আসা-যাওয়া করত মাঝে মাঝে যেন মার খবর নিতে আসে। সে তার ছেলেকে নিয়ে আগেও এই কাজ করেছে আলাদা নামে, আলাদা রাজ্যে। সুযোগ বুঝে শিবেন রাতের অন্ধকারে হার সরিয়ে ছাদে পাতাবাহারের টবের মধ্যে পুঁতে রাখে। তারপর আবার সুযোগমতো সরিয়ে ফেলে। মাকে নিয়ে চলে যায়। তবে সে কোথাও যায় না। বাসন্তীকে তিনদিন আগেই ঘায়েল করে ঘরের মধ্যে ঘুমের  ইঞ্জেকশন দিয়ে রেখে দিয়েছিল এবং নিজে বাসন্তী সেজে বসে। কমলা তাকে সাহায্য করে গেছে প্রতি ক্ষেত্রেই। কারোর সামনে আসলেই ধরা পড়ে যেত, তাই পক্সের অভিনয় চালিয়ে যেতে হয়। যেদিন নিজের আসল রূপে দেখা করতে আসে সেই রাতেই সে গয়না সরায়। রাতে ঘুমের ওষুধ খাইয়ে দেয় কমলা খাবারের সাথে মিশিয়ে। তাই কেউ জাগেনি। পরেরদিন মাকে যেন বাড়ি নিয়ে যেতে এসেছে এইরকম ভান করে। হারটা কমলা সঙ্গে করে নিয়ে গেছে। তাই ঘর তল্লাশি করেও কিছু পাওয়া যায় না।

“কমলার তো পরিচয়পত্র দেখেই আমরা কাজে রেখেছিলাম!” মামা বললেন।

“অমন নকল পরিচয়পত্র ওদের কাছে কত যে থাকে! পুলিশ ভেরিফিকেশন করিয়ে রাখতে বলি এইজন্য। তবে তাতেও লাভ হয় না সবসময়।”

“কিন্তু গয়নাটা নিয়েই তো তারা গা ঢাকা দিতে পারত। রয়ে গেল কেন বাড়িতে?” স্নেহা প্রশ্ন করে।

“আসলে শিবেন আর কমলার আরেকটা প্ল্যান ছিল বাড়িতে ডাকাতি করার। একটা জড়োয়ার হারে তারা সন্তুষ্ট ছিল না। খুব শিগগিরই তারা একটা ডাকাতি করত। ওদের একটা ডাকাতদলও আছে। কমলাও আশা করা যাচ্ছে খুব তাড়াতাড়ি ধরা পড়বে। বা এমনও হতে পারে, ও যাবার সুযোগ খুঁজছিল কিন্তু পাচ্ছিল না। হার নিয়ে আপনারা সবাই খুব ব্যস্ত ছিলেন। ও ঘাবড়ে গিয়ে থাকবে।”

এতগুলো কথা বলে অফিসার এবার ভিক্টরকে জিজ্ঞাসা করলেন, “বাসন্তীদিদার ওপর তোমার সন্দেহ হল কী করে?”

“কারণ অনেকগুলো। এক, বাসন্তীদিদাকে তিনদিন ধরে কেউ সামনাসামনি দেখেনি। মামিমা দেখলেও মুখ দেখতে পায়নি। খাবার দেওয়ার সময়ও না। শুধু ট্রে ঘরের সামনে রেখে দিয়েছে। তাই খটকা লাগে তখনই।

“দুই, দিদার ঘরের সামনে কিছু শুকিয়ে যাওয়া মাটির দাগ দেখেছিলাম।

“তিন, আমি যখন এখানে ঘোরাঘুরি করছিলাম তখন ঘরের ভেতর থেকে আমি একটা লোকের গলা পেয়েছিলাম। কিন্তু জিজ্ঞাসা করে জানতে পারলাম, বাসন্তীদিদার ঘরে টিভি-রেডিও কিছু নেই। তখনই বুঝলাম, গোলমাল কিছু একটা আছে।

“চার, রান্নাঘরের কিচেনের ডাস্টবিনে কিছু ওষুধের খালি পাতা আর ইঞ্জেকশনে যে ওষুধ পুশ করে সেইরকম ছোটো কাচের শিশি এখনও আছে। আমার অনুমান, ওগুলো ঘুমের ওষুধ হতে পারে।”

“সব পরীক্ষা করব আমরা। ইঞ্জেকশনের নিডলও পাওয়া গেছে শিবেনের থেকে।” অফিসার জানালেন।

বাড়িতে এখন ডাক্তার এসেছেন। বাসন্তীদিদার পরিচর্যায় ব্যস্ত সুচরিতা আর স্নেহা। ডাক্তারবাবু বললেন, “বিপদ কেটে গেছে।”

পুলিশের দল শিবেনকে নিয়ে চলে গেছে খানিকক্ষণ হল। ভিক্টরের বাবাও অফিস ছুটির পর এই বাড়িতে চলে এসেছেন। ফেরার সময় তিনি ফ্রায়েড রাইস আর চিলি-চিকেন কিনে এনেছেন। ডিনারে বসার আগেই ফোনটা পেলেন ভিক্টরের মামা সুবিমলবাবু। কমলা আর তার বাকি দলবল ধরা পড়েছে। হারটাও পাওয়া গেছে। আর সাহসিকতার জন্য ভিক্টরকে পুরস্কার দেওয়া হবে সরকার থেকে।

অলঙ্করণঃ মৌসুমী

জয়ঢাকের সমস্ত গল্প ও উপন্যাস

3 thoughts on “গল্প জড়োয়া হারের রহস্য সহেলী চট্টোপাধ্যায় শরৎ ২০১৮

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Twitter picture

You are commenting using your Twitter account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s