গল্প তপনানন্দ সেন ও অতিমাত্রিক মূর্তি অরিন্দম দেবনাথ বসন্ত ২০১৮

অরিন্দম দেবনাথের সমস্ত লেখা

অরিন্দম দেবনাথ

ভোর ছ’টায় মোবাইল ফোনের শব্দে ঘুম ভেঙে গেল। এত সকালে ফোন? আমাকে তো এমনিতেই খুব একটা ফোন কেউ করে না! তাড়াতাড়ি করে বিছানা ছেড়ে উঠে ফোনটা তুলে চোখের সামনে এনে দেখি স্ক্রিনের ওপর একটা নাম জ্বলজ্বল করছে। তপনানন্দ সেন। হাতটা কেঁপে উঠল। ওরে বাবা, এত বড়ো বৈজ্ঞানিক আমাকে ভোরবেলা ফোন করেছেন কেন? ফোনটা তুলে বললাম, “গুড মর্নিং।”

“নমস্কার, তপনানন্দ সেন বলছি। আপনি তো সকালে হাঁটতে বেরোন। একবার আমার বাড়ি ঘুরে যাবেন প্লিজ।” এইটুকু বলে ফোন ছেড়ে দিলেন ভদ্রলোক।

তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে তপনানন্দ সেনের বিশাল বাগান বাড়ির গেটের সামনে পৌঁছতে দারোয়ান দরজা খুলে দিল। বলল, “বাগানে চলে যান, বাবু ওখানেই আছেন।”

উঁচু পাঁচিল দিয়ে ঘেরা প্রায় তিন বিঘে জমির ঠিক মাঝখানে তপনানন্দ সেনের পুরনো আমলের দোতলা বাড়ি। বাড়িভর্তি অজস্র ফুল আর ফলের গাছ। দু’জন মালি, একজন দারোয়ান, দুটো বিশাল কুকুর, আর জনা কয়েক কাজের লোক নিয়ে অবিবাহিত তপনানন্দ সেনের পরিবার।

আমি ছাড়া পাড়ার আর কারও সাথে সেরকম সম্পর্ক নেই এই বৈজ্ঞানিকের। আমার সাথে পরিচয়টাও কাকতালীয়ভাবে হয়ে গেছিল। অনেকদিন আগে জানুয়ারির এক শীতের কুয়াশাভেজা সকালে প্রাতঃভ্রমণ সেরে বাড়ি ফিরছি, দেখি, পাজামা-পাঞ্জাবির ওপর লাল সোয়েটার পরা একজন ভদ্রলোক রাস্তার ধারের কুয়াশাভেজা ঠাণ্ডা ঘাসে হাত বুলিয়ে কিছু খুঁজছেন। ফরসা গোল মুখ। একমাথা চুল। উদভ্রান্ত চোখের দৃষ্টি। হাতে একটা বড়ো পাউডারের মতো কৌটো। একটু ইতস্তত করে জিজ্ঞেস করেছিলাম, “কিছু হারিয়েছেন নাকি?”

লোকটা বলেছিলেন, “একটা স্ক্রু হারিয়ে গেছে।”

বলেছিলাম, “কী সাইজের? এই কুয়াশাভেজা ঘাসের মধ্যে খুঁজে পাবেন কি?”

ভদ্রলোক বলেছিলেন, “পেতেই হবে। ওটা টাইটেনিয়াম দিয়ে তৈরি চুলের মতো সরু স্ক্রু। প্রায় দশ বছর পরিশ্রম করে তৈরি করেছি।”

তপনানন্দ সেনের সাথে সেই আমার প্রথম আলাপ। পাড়ার লোকেরা আড়ালে আবডালে ওঁকে ঘোড়া বৈজ্ঞানিক বলত। কারণ, ভদ্রলোকের বাড়ি থেকে রাত্রিবেলা ঘুড়ি উড়ত। ঘুড়ি থেকে ওঁর নাম হয়ে গেছিল ঘোড়া।

তারপর একদিন রাস্তায় কতগুলো ফাজিল ছোঁড়া ভদ্রলোককে এমন খেপিয়েছিল যে ভদ্রলোক নিজের অজান্তে নিজের স্বরূপ দেখিয়ে দিয়েছিলেন। একটি ছেলে ইচ্ছে করে সাইকেল চালিয়ে তপনানন্দকে এমনভাবে পেছন থেকে ধাক্কা মেরেছিল যে টাল সামলাতে না পেরে তিনি পড়ে গেছিলেন। দুটো ছেলে গিয়ে রাস্তা থেকে তপনানন্দকে তুলে, ধুলো ঝাড়ার ভান করে জামাকাপড় টানাটানি করে ওঁর লাল গেঞ্জিটাই ছিঁড়ে দিয়েছিল। একজন আবার ভালোমানুষের মতো মুখ করে বলেছিল, “শুনলাম, আপনি নাকি ঘুড়ি ওড়ানোর জন্যে নোবেল প্রাইজ পাবেন? ভূতুড়ে ঘুড়ি!”

তপনানন্দ ক্ষেপে গিয়ে অট্টহাসি হেসে বলেছিলেন, “পাবই তো! দেখ আমার ঘুড়ি।”

তারপর সবাইকে আবাক করে দিয়ে হাতের বড়ো পারফিউমের মতো কৌটোটার ওপরের নবটাতে চাপ দিতে ভস ভস করে লাল ধোঁয়ার মতো কী বেরিয়ে এসেছিল। কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই লাল ধোঁয়া জমাট বেঁধে একটা বিছানার চাদরের মতো বড়ো শক্তপোক্ত ধাতব লাল চকচকে পাতের মতো হয়ে হাওয়ায় ভাসতে লেগেছিল। তপনানন্দ হাতের বড়ো লম্বা কৌটটায় আবার চাপ দিতেই কৌটোর গা থেকে দুটো কব্জা বেরিয়ে এসেছিল। কব্জাদুটো ওই ভাসমান ধাতব চাদরের কাছে ধরতেই তা চুম্বকের মতো লেগে গিয়েছিল চাদরটার গায়ে। চুম্বকের মতো লেগে থাকা কৌটোটায় চাপ দিতে তা থেকে ইলেকট্রিক পাখার মতো তিনটে ছোটো ছোটো পাখার ব্লেড বেরিয়ে এসে প্রবল গতিতে ঘুরতে শুরু করেছিল। তপনানন্দ চেপে বসেছিলেন সেই ভাসমান চাদরে। তারপর সবাইকে অবাক করে দিয়ে তপনানন্দকে নিয়ে চাদরটা ভাসতে ভাসতে দ্রুত আকাশের উঁচু থেকে আরও উঁচুতে নিঃশব্দে ঘুড়ির মতো উঠে গিয়েছিল।

বেশ কয়েকবার যাতায়াতের সুবাদে বাড়িটা আমার চেনা হয়ে গিয়েছিল। চললাম বাগানের দিকে। গেট থেকে তপনানন্দ সেনের একটা পোষা কুকুর আমার আগে আগে চলল। যেন পথ দেখিয়ে নিয়ে চলেছে।

বাগানের এককোণে পাঁচিল-ঘেঁষা একটি বড়ো নিমগাছের তলায় ঢাকনা দেওয়া একটা বড়ো লোহার ড্রামের পাশে দাঁড়িয়ে কান পেতে কিছু শুনছিলেন মিস্টার সেন। হাতে একটা ফ্ল্যাশ লাইট। অবাক হয়ে গেলাম। দিনের আলোতে খোলা জায়গায় আলো নিয়ে কী করছেন ভদ্রলোক? কাছে পৌঁছতে উনি জিজ্ঞেস করলেন, “কোনও আওয়াজ শুনতে পাচ্ছেন?”

“নাহ্‌, কোনও কিছু তো শুনতে পাচ্ছি না। ওহ্‌, কয়েকটা কাক ডাকছে খুব।”

“আর কোনও আওয়াজ পাচ্ছেন না? ভালো করে শুনুন!”

খানিকটা যেন বিরক্ত দেখাল ভদ্রলোককে। “আপনার কান তো ভীষণ শক্তিশালী জানতাম। রাত্তিরে আপনার বাড়ির ছাদে পাখি হেঁটে বেড়ানোর আওয়াজে আপনার একবার ঘুম ভেঙে যাচ্ছিল, মনে আছে? আপানার শক্তিশালী শ্রবণশক্তির সাহায্য নিতেই আপনাকে এত সকালে ফোন করে ডেকে এনেছি! এই ড্রামটার কাছে এসে শুনুন।”

ড্রামটার দিকে এগোতেই ঘৌ ঘৌ করে ডেকে উঠল কুকুরটা। মিস্টার সেন একটা শিস দিয়ে মেন গেটের দিকে আঙুল তুলতে হাঁটা দিল কুকুরটা। ঢাকনা বন্ধ ড্রামটার কাছে যেতে শুনতে পেলাম মশা বা মছির গুনগুনানি। তবে অনেকগুলো নয়। কানের কাছে একটা মশা বা মাছি উড়ে গেলে যেমন পোঁ পোঁ করে আওয়াজ হয়, অনেকটা সেরকম। তবে আওয়াজটা অনেক শক্তিশালী। ঠিক স্বাভাবিক ডানা ঝাপটানির শব্দ নয়। থেমে থেমে আওয়াজটা হচ্ছে। যেন একটা মশা বা মাছি বোঁ করে একটু উড়েই আবার বসে পড়ছে।

“কী বুঝলেন?”

“অনেকটা মশা বা মাছির ওড়ার আওয়াজের মতো লাগছে। ঠিক বুঝতে পারছি না।”

“আজ তো শনিবার। আপনার অফিস কি আজ ছুটি? বাড়িতে যাবার তাড়া নেই তো?” বললেন মিস্টার সেন।

বললাম, “হ্যাঁ, আজ ছুটি। তাছাড়া বাড়িতেও কেউ নেই। সবাই বেড়াতে গেছে, তাই আজকে আমার অখণ্ড অবসর।”

“চলুন, ঘরে গিয়ে বসা যাক। আমার অনেকদিনের পরিশ্রমের ফল…” আচমকা চুপ করে গেলেন মিস্টার সেন। খুব চিন্তিত দেখাচ্ছে ওঁকে। হাঁটা লাগালেন বাড়ির দিকে।

নুড়িপাথর বিছানো পথ ধরে খানিকটা হেঁটে, বড়ো কাঠের ফ্রেমের কাচ দেওয়া দরজা ঠেলে ঢুকে বসলাম বিশাল ড্রয়িং রুমের মাঝখানের চকচকে পালিশ করা কালো বড়ো টেবিলের একদিকে। আর অন্যদিকে উনি। টেবিলের ঠিক মাঝ বরাবর  ছাদ থেকে নেমে আসা একটা শেকলের শেষপ্রান্তে শেডের নিচে জ্বলা একটা আলোর দিকে চুপ করে তাকিয়ে আছেন মিস্টার সেন।

   

ঘরের ভেতরকার দরজা ঠেলে সাদা ধুতি আর হাফ হাতা ফতুয়া পরা একজন লোক এসে নিঃশব্দে দু’কাপ চা আর দু’গ্লাস জল নামিয়ে রেখে চলে গেলেন। সুন্দর গন্ধ ছড়িয়ে পড়ছে কাপ থেকে ওঠা ধোঁয়ার সাথে সাথে। আমি জানি, এই চা মিস্টার সেনের বাড়ি ছাড়া আর কোথাও পাওয়া যায় না। উত্তরবঙ্গে মিস্টার সেনের পারিবারিক চা-বাগানের একটি নির্দিষ্ট অংশে এই চায়ের চাষ হয় শুধুমাত্র ওঁরই জন্য।

খানিক চুপ করে বসে থেকে মিস্টার সেনের হুঁশ ফেরাতে আমি বললাম, “মিস্টার সেন, চা দিয়ে গেছে। খেয়ে নিন, ঠাণ্ডা হয়ে যাবে।”

“সরি সরি, আপনাকে ডেকে এনে বিড়ম্বনায় ফেললাম। ফটোগ্রাফি সম্পর্কে আপনার ইন্টারেস্ট আছে?” চায়ের কাপ একটা চুমুক দিয়ে বলে উঠলেন মিস্টার সেন।

“একটা সময় ফিল্ম ক্যামেরায় ছবি তুলতাম। একটা আসাই পেনটেক্স ক্যামেরা ছিল আমার। এখন একটা ছোটো ডিজিট্যাল ক্যামেরা আছে। তাতে ভালোই ছবি ওঠে। তবে এখন মোবাইলের ক্যামেরাতেই যা ছবি ওঠে তাতে আর অন্য ক্যামেরা লাগে না। ওই মাঝে মাঝে ঘুরতে গেলে ক্যামেরাটা নিয়ে যাই। কোনও ছবি তুলতে হবে? আমার এক ফটোগ্রাফার বন্ধু আছে, তাকে ডাকতে পারি।” বললাম আমি।

“না না, আমার ফটোগ্রাফারের কোনও প্রয়োজন নেই। আমার সঙ্গে আসুন, কতকগুলো জিনিস আপনাকে দেখাই।”

বিশাল ড্রয়িং রুমের একপাশের একটা ছোট্ট দরজার সামনে দাঁড়িয়ে দরজার পাশের একটা প্যানেলের ওপর কতগুলো বোতাম টিপলেন মিস্টার সেন। দরজাটা খুলে গেল। হালকা আলোয় ভরে উঠল ঘরটা। ঘরটা এত বড়ো যে গোটা ছয়েক টেবিল টেনিস বোর্ড বসে যাবে। ঘরের ভেতরে কনকনে ঠাণ্ডা। একটা আলমারি খুলে দুটো জ্যাকেট বের করে একটা নিজের গায়ে গলিয়ে আর একটা আমাকে দিয়ে বললেন, “পরে নিন। ফেদার জ্যাকেট। না হলে ঠাণ্ডা লেগে যাবে। এই ঘরের তাপমাত্রা এক ডিগ্রি সেলসিয়াস।

“আমি আর আমার সহকারী কাকা ছাড়া আপনিই তৃতীয় ব্যাক্তি যিনি এই ঘরে ঢুকলেন। যিনি চা দিয়ে গেলেন, তিনিই কাকা। ছোটোবেলায় এই কাকাই আমাকে গল্পের ছলে বিজ্ঞানের মজা মাথায় ঢুকিয়েছিলেন। সেরকম প্রথাগত শিক্ষা ওঁর নেই। কিন্তু ওঁর মাথায় সবসময় নতুন নতুন চিন্তা ঘোরে।” বললেন মিস্টার সেন।

ঘরের ঠিক মাঝখানে একটা বড়ো টেবিল। তাকে ঘিরে দুটো চেয়ার। টেবিলের ওপর স্তূপ করা অনেক বই আর কয়েকটা খোলা খাতা। অনেকগুলো ছোটো ছোটো খোপ ঘরটার ভেতরে। এক ঝলকে দেখলাম, প্রতিটা খোপ ভর্তি নানান যন্ত্রপাতিতে। কয়েকটা আমার পরিচিত। স্কুলের ল্যাবরেটারিতে দেখেছিলাম। একটা ছোটো খোপের ভেতরে লোহার আলমারিতে থরে থরে রাখা কাচের জারে রংবেরঙের তরল পদার্থ। ঘরের দেওয়ালে একটা বিশাল বড়ো সাদা বোর্ডের ওপর কালো ও লাল কালিতে হাতে লেখা অজস্র নোট ও ফর্মুলা। দুটো কম্পিউটার রয়েছে ঘরে।

মিস্টার সেন আমাকে বড়ো টেবিলটার পাশের একটা চেয়ারে বসতে বলে টেবিলের ওপর থেকে একটা বড়ো ফটো অ্যালবাম বের করে খুলে ধরলেন আমার সামনে। তারপর একটার পর একটা ছবি উল্টে যেতে লাগলেন। সব ফুলের ছবি। প্রথমে ভেবেছিলাম, আসল ফুল বোধহয় কাগজের ওপর সাঁটানো। ভুল ভাঙল মিস্টার সেনের কথায়।

“এগুলো সব ত্রিমাত্রিক ছবির প্রিন্ট। আমার অনেকদিন আগের আবিষ্কার। আমার ল্যাবরেটারিতেই প্রিন্ট করা। বিশেষ ধরনের প্লাস্টিকের ওপর বাজার-চলতি মেশিনে ছাপানো। কিন্তু প্লাস্টিকের ওপরের রাসায়নিকটা আমার নিজের তৈরি। এরকম প্রিন্ট বাজারে পাবেন না।”

কথাটা একদম সত্যি। আমার ড্রয়িং রুমেও দোকান থেকে কেনা একটা গোলাপের থ্রিডি ছবি ঝুলছে। সেটা একেক দিক থেকে একেকরকম লাগে ঠিকই, তবে এই ছবিগুলো একদম আসল ফুলের মতো! এরকম ছবি আগে দেখিনি।

“কী করে ছবির মতো আসল বস্তুর অবিকল নকল বানানো যায় তাই নিয়ে অনেকদিন ধরে গবেষণা চালাচ্ছিলাম। সম্প্রতি একটা ক্যামেরা কোম্পানির সাথে যৌথ গোপন গবেষণায় একটা হাজার মেগাপিক্সেল ক্যামেরাও তৈরি করিয়ে আনিয়েছি। শুধু তাই নয়, এই ক্যামেরা প্রতি সেকেন্ডে একশো ছবি তুলতে পারে। ফলে একটা মুভমেন্টের অনেক ডিটেল পাওয়া যায়।

“এইগুলো দেখুন।” আলমারি খুলে মিস্টার সেন বের করে আনলেন একটা বড়ো বাক্স। বের করলেন কয়েকটা আসল গোলাপ ফুল। কিন্তু সবক’টা হুবহু এক। ভুল ভাঙল মিস্টার সেনের কথায়। “এগুলো সব নকল। একই বিষয়ের অনেকগুলো বিভিন্ন অ্যাঙ্গেলে তোলা ছবি কম্পিউটারে বিশেষ সফটওয়্যার মিশিয়ে একটি অতিমাত্রিক আকার দিয়ে তারপর সেটাকে কম্পিউটার-চালিত প্লাস্টিক মোল্ডিং মেশিনে একদম আসলের মতো নকল সৃষ্টি করে বিশেষ ইঙ্কজেট স্প্রে প্রিন্টারে অবিকল আসলের মতো রং করে এই ছবি অথবা মূর্তি যাই বলুন তৈরি। হাতে নিলে তবেই বুঝতে পারবেন যে এগুলো নকল। খুব হালকা, তাছাড়া এর স্পর্শটাও খসখসে। এগুলো সেলোফেন পেপারের মতো পাতলা অথচ শক্ত হালকা প্লাস্টিক উপাদানে তৈরি। সব বস্তু আমার ল্যাবরেটারিতে তৈরি। তবে মূল উপাদানগুলো যেমনি প্লাস্টিকের দানা, মোল্ডিং মেশিন, প্রিন্টার ক্যামেরা এগুলো বিভিন্ন প্রস্তুতকারক সংস্থার গবেষণাগারে আমার নক্সায় প্রস্তুত। তারপর সেগুলো আমার ল্যাবরেটারিতে এনে প্রয়োজনীয় পরিবর্তন করে জুড়ে নিয়েছি।

“প্রায় পাঁচ বছরের কঠিন গবেষণার ফল এই গোলাপগুলো। কিন্তু আমি মোটেই খুশি হতে পারছিলাম না এগুলো নিয়ে। আমি চাইছিলাম, মূর্তিগুলো এমনভাবে বানাতে যেগুলো হবে প্রাণহীন আসল। মাদাম তুসোর মোমের মূর্তির মতো। তবে সবই হবে মেশিনে। ওজন, স্পর্শ, আকৃতি সবকিছু হবে একদম আসলের মতো। বড়ো কিছু বানানো এই ছোটো ল্যাবরেটারিতে ছোটো মেশিনে সম্ভব নয়, তাই ফুল দিয়েই গবেষণা চালাচ্ছিলাম।

“গত সপ্তাহে এক হাজার মেগাপিক্সেলের ক্যামেরাটা হাতে আসে। আসুন, আপনাকে ক্যামেরাটা দেখাই।”

আমাকে উনি নিয়ে গেলেন একটা খোপের ভেতর। একটা ট্রাইপডের ওপর ক্যামেরাটা আটকানো। একটা অনেক মোটা ল্যাপটপ কম্পিউটারের মতো সাইজ, সামনে দুটো লেন্স। পেছনের বড়ো স্ক্রিনটা বাদ দিলে দেখতে অনেকটা আদ্যিকালের বক্স ক্যামেরার মতো।

“ক্যামেরা কোম্পানির তৈরি এই ক্যামেরাটার সাথে গত পরশু আমি একটা লেসার ডিভাইস জুড়ে মশার ছবি তুলেছিলাম। তারপর গতকাল দুশোটা ছবি বিশেষ কম্পিউটার প্রোগ্রামে প্রসেস করে একটা ছবি বানিয়ে মোল্ডিং মেশিনে মূর্তি বানিয়ে দেখি, অবিকল মশা তৈরি হলেও আমার ভুলে মূর্তিটা অনেক ভারী আর মশার মাপের থেকে কয়েকশো গুণ বড়ো হয়ে আকারে প্রায় শালিক পাখির মতো হয়ে গেছে। আমার যা যা পছন্দ হয় না সেগুলো বাগানের ওই লোহার ড্রামে জমা করে কাকা কিছুদিন পর পর পুড়িয়ে নষ্ট করে দেন। আজ খুব ভোরবেলা আমার পোষা কুকুরদুটো ওই ড্রামটাকে ঘিরে খুব চিৎকার করছিল। গিয়ে যা দেখলাম… চলুন নিজের চোখে দেখবেন।”

ভারী ক্যামেরাটা একটা বড়ো ব্যাগে ভরে নিয়ে আমার জ্যাকেটটা চাইলেন মিস্টার সেন। আমার আর ওঁর জ্যাকেটদুটো আলমারিতে রেখে ঘর থেকে বেরিয়ে দরজাটা লক করে, কাকাকে ডেকে সঙ্গে নিয়ে চললেন বাগানের দিকে।

ড্রামটার কাছে পৌঁছে মিস্টার সেন বললেন, “কাকা, ড্রামে আগুন লাগানোর সব জিনিস কাছে আছে তো?”

কাকা পাঁচিলের ধারের একটা টিনের শেডের নিচের লোহার পাল্লা দেওয়া সিমেন্টের আলমারি থেকে একটা প্লাস্টিকের জার, একটা গোল লোহার নেট আর একটা আঁকশি বের করে নিয়ে এলেন। প্লাস্টিকের জারের ওপর কালো কালিতে লেখা কেরোসিন।

ড্রামটার নিচের অংশটা খানিকটা কেটে সেটা আবার একটা কব্জা দিয়ে জুড়ে একটা আংটা দিয়ে আটকানো। কাকা গিয়ে আংটাটা খুলে টান দিতে একটা লোহার অংশ খুলে গেল। বুঝলাম, উনুনের মতো নিচ থেকে হাওয়া ঢোকার জায়গা ওটা। নিচের অংশটা খুলতে মশার গুনগুনানির আওয়াজটা আরও স্পষ্ট হল। মিস্টার সেন বললেন, “কাকা, ড্রামের ওপরের ঢাকনা খুলে নেট চাপা দাও।”

কাকা নিঃশব্দে হুকুম পালন করে সরে দাঁড়ালেন একপাশে। ড্রামের ওপরের ঢাকনাটা খুলতে মনে হল, কোনও সাউন্ড সিস্টেমে মশার আওয়াজ হচ্ছে। মিস্টার সেন আমাকে বললেন, “একবার নেটের ওপর থেকে ড্রামে উঁকি মেরে দেখুন তো কিছু বুঝতে পারছেন কি না।”

ড্রামের ভেতর উঁকি মেরে আঁতকে উঠলাম। দেখি, একটা চড়াই পাখির সাইজের মশা ডানা ঝাপটিয়ে উড়ে বেড়াচ্ছে ড্রামের ভেতর।

“কী দেখলেন?” প্রশ্ন করলেন মিস্টার সেন।

আমি বললাম, “নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছি না। চড়াই পাখির মতো বড়ো মশার কথা স্বপ্নেও কল্পনা করিনি। ওই পুঁচকে সাইজের মশা অতিষ্ঠ করে দিচ্ছে। এরকম চড়াই পাখির মতো মশা হলে তো…”

মিস্টার সেন বললেন, “এই মশাটা প্রযুক্তিবিদ্যার অন্যতম বড়ো আবিষ্কার। আমার ধারণার বাইরে। লেসার-রে সহযোগে হাজার মেগাপিক্সেল ক্যামেরা শুধু মশার বাইরের ডিটেল ছবিই তোলেনি। ওর ভেতরের সমস্ত অঙ্গপ্রত্যঙ্গ থেকে রক্তের উপাদান, স্নায়ু, ধমনী পর্যন্ত কপি করে ফেলেছিল। আমি নিজেও বুঝতে পারিনি। মশার বিশাল ভারী মূর্তিটা আমার পছন্দ হয়নি, তাই ওটাকে ফেলে দিয়েছিলাম আমার আবর্জনা নষ্ট করার ড্রামে। মেশিন যে ওকে সত্যিকারের রক্তমাংসের মশায় পরিণত করেছিল বুঝতে পারিনি। ড্রামের গরম অনেকটা স্ফুটন যন্ত্রের মতো কাজ করে মশাটাকে জীবন্ত করে তোলে। ভাবতে পারেন, মশার জায়গায় একটা বাঘ হলে কী হবে? কাকা, ড্রামে আগুন দাও।”

আমি কিছু বলার আগেই কাকা ড্রামে কেরোসিন তেল ঢেলে একটা জ্বলন্ত দেশলাইকাঠি ছুড়ে দিলেন। দাউ দাউ করে আগুন জ্বলে উঠল ড্রামের ভেতর। মিস্টার সেন তড়িৎগতিতে নেটটা সরিয়ে ব্যাগে ভরা ক্যামেরাটা ফেলে দিলেন জ্বলন্ত ড্রামে। বললেন, “দরকার নেই এই সর্বনেশে আবিষ্কারের।”

ছবিঃ শিমুল

জয়ঢাকের সমস্ত গল্পের লাইব্রেরি এই লিংকে

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Twitter picture

You are commenting using your Twitter account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s