গল্প নিরুদ্দেশ সংবাদ শুভলক্ষ্মী ঘোষ বসন্ত ২০১৯

শুভলক্ষ্মী ঘোষ

“ওগো শুনছ? সব্বনাশ হয়ে গেছে! কাঁকনকে না খুঁজে পাচ্ছি না। ”

ব্রতীনবাবু আয়েশ করে রোদ্দুরে পিঠ দিয়ে বসে খবরের কাগজ পড়ছিলেন। নিরুত্তাপ গলায় বলে উঠলেন, “আরে দেখই না, এদিক ওদিক কোথাও একটা আছে। ”

“না গো না, আমি ছাদ, বাথরুম, বাগান, সব যায়গায় তন্ন তন্ন করে খুঁজে এসেছি, কোত্থাও নেই, নইলে আর তোমায় বলছি কী!”

“হুমমম……”   

“আরে, কী হল? অদ্ভুত তো!!…… আরে শুনছ? শুনতে পাচ্ছ কী বলছি?”

“শুনছি তো… আচ্ছা আমি এখন কি করব বল দিকি? তুমি তো নিজেই সব যায়গা খুঁজে দেখে এসেছ বললে!”

“কী মুশকিল, আমি দেখে এসেছি বলে তুমি আর একবার ভালো করে খুঁজে দেখবে না? মেয়েটা কোথায় গেল, কী করছে, তোমার একটা তাপ-উত্তাপ নেই? কি দায়িত্বজ্ঞানহীন লোকরে বাবা!!”

“দেখ মল্লিকা, আমি তোমার মত মেয়ে নিয়ে সর্বক্ষণ আদিখ্যেতা পচ্ছন্দ করি না। বাড়িতে নেই, তো বাইরে কোথাও আছে, খেলাধুলো করছে। দেখ না, অপেক্ষা কর, ঠিক চলে আসবে একটু পরে।” ব্রতীনবাবু আবার খবরের কাগজে মন দিলেন।

“আমি না তোমার কাণ্ডজ্ঞান দেখে হতবাক হয়ে যাচ্ছি, জান তো! বাইরে আছে মানে? চাদ্দিকে কী হচ্ছে, তুমি খবর রাখ না? কেউ যদি এই ভর দুপুরবেলা মেয়েটাকে তুলে নিয়ে যায়! … আরে হল টা কী? বেরোবে তুমি একবার? পাশের বাড়িগুলোতে দেখে আসবে?… উফফফ… আর পারি না এই লোককে নিয়ে।”

“এই জন্য, জানো তো, ঠিক এই জন্য আমি তোমাকে বার বার বারন করেছিলাম। রিটায়ারমেন্টের পর এই বয়েসে এসে ফালতু ঝক্কি ঝামেলা আমার অসহ্য লাগে। পই পই করে তখন বললাম, সুশীলের বাড়ি থেকে মেয়েটাকে এনো না, ও যেমন আছে ওখানে থাক, এই বুড়ো বয়সে এতখানি দায়িত্ব নেওয়া কি চাট্টিখানি ব্যাপার!… তা কে কার কথা শোনে! বেশ ছিলাম দুজন বুড়ো বুড়ি… তা নাও এখন, ঠ্যালা সামলাও।”

“হ্যাঁ গো, তোমার কি মন বলে কিচ্ছুটি নেই? ওই অতটুকু মা মরা দুধের শিশু, সুশীল ঠাকুরপো পারতো একরত্তি মেয়েটাকে একা হাতে সামলাতে? দেখেছ তো, সারাদিন কী-রকম দস্যিপনা করত আমাদের কাঁকন! নিভা বেঁচে থাকলে সে একরকম হত, তখন আমি না হয় কিছু ভাবতুম না…”

“তাহলে আর কী, নিজে শখ করে মা হয়েছ যখন, তখন নিজেই ভাবো, আমাকে আর এ’সবের মধ্যে জড়িয়ো না।”

“শোনো চ্যাটার্জী মশাই, তুমি গা করছ না তো! কাঁকনকে খুঁজে না পেলে আমি কিন্তু আজ অনর্থ করব এই তোমাকে পষ্ট বলে রাখলুম। থানা-পুলিশ, যা খুশি কর, কিন্তু আমার কাঁকনকে যেভাবে হোক তুমি আজ খুঁজে এনে দেবে। তোমার মত বে-আক্কেলে লোকের জন্য আমি আমার অমন ফুটফুটে মেয়েটাকে কোল ছাড়া করতে পারব না। ও আজ তোমার জন্য, শুধু তোমার অন্যায় আচরণে অভিমান করে চলে গিয়েছে। ওইটুকু একটা বাচ্চা, না হয় একটু খেতে ভালোবাসে, তা বলে তুমি ওইভাবে মেয়েটার গায়ে হাত তুলবে? পারতে? নিজের মেয়ে হলে পারতে?” মল্লিকা ডুকরে কেঁদে উঠলেন। 

ব্রতীনবাবু গম্ভীর হয়ে বসে রইলেন কিছুক্ষণ। সত্যিই আজ কাঁকনকে বড্ড বকাঝকা করে ফেলেছেন, মাথাটা অমন দুম করে গরম না করলেই হত বোধ হয়। আসলে কিছুই না, রবিবারের দুপুরে গরম কষা মাংসের ঝোল ঝরঝরে বাসুমতী চালের ভাতে এক ফালি গন্ধরাজ লেবু দিয়ে মেখে খাওয়ার রেওয়াজ এ বাড়ির অনেকদিনের। সক্কাল সক্কাল তাই ব্রতীনবাবু বাজার থেকে রেওয়াজি খাসির মাংস কিনে মল্লিকাকে রগরগে করে রান্না করতে বলেছিলেন। মল্লিকা দুপুরে সেই মাংসের ঝোল ভাত রেঁধে বেড়ে খেতে ডাকার পর, বেশি না এই মিনিট দশেক মত ওঁর আসতে দেরি হয়েছে। আর যায় কোথায়, কাঁকন ওমনি সেই ফাঁকে ওঁর বাটি থেকে মাংসের টুকরোগুলো তুলে সোজা মুখে।

ব্রতীনবাবু স্নান সেরে খেতে এসে দেখেন মেয়ে চেয়ারে গুছিয়ে বসে তারিয়ে তারিয়ে মাংস খাচ্ছে, আর এদিকে থালা, জলের গ্লাস উলটে, টেবিল, চেয়ার, ঘরের মেঝে মাংসের ঝোল আলুতে একেবারে মাখামাখি। ব্যাস, খিদের মুখে মাথাটা গেল গরম হয়ে, দুম করে মারলেন এক চড়! কাঁকন সেই যে ঠোঁট ফুলিয়ে মাথা নিচু করে খাবার ঘর থেকে চলে গেল, তারপর সত্যিই তো, মেয়েটাকে আর চোখে দেখেন নি। মল্লিকা তারপর সব পরিষ্কার টরিস্কার করে কাঁকনকে কত করে খেতে ডাকলেন, কোন সাড়া শব্দ নেই। মালতী’র মা এঘর ওঘর খুঁজে দেখল, সে মেয়ের আর দেখা পাওয়া যায় না!

আচ্ছা, বাবা হয়ে মেয়েকে টেবিল ম্যানার্স শেখানোর চেষ্টাটা কি ভুল? মেয়ে তো বড় হচ্ছে, লোকের বাড়ি গেলে সেখানে যদি কারুর প্লেট থেকে খাবার তুলে নিয়ে খেতে শুরু করে, তাহলে মানসম্মান বলে কিছু থাকবে? বাপ হয়ে মেয়েটাকে এইটুকু শাসন করতে পারবেন না… এ কেমন কথা!

দেখতে দেখতে দুপুর গড়িয়ে সন্ধে হতে চলল। এতক্ষণ ধরে খেলাধুলাও তো করে না কারুর সাথে! অল্প অল্প ঠান্ডা পড়তে শুরু করেছে, বেলা তাড়াতাড়ি ছোট হয়ে আসছে… ব্রতীনবাবুর বেশ চিন্তা হচ্ছিল এবার। 

বুড়ো-বুড়ির এই ছোট্ট সংসার ওই মেয়েটাই ভরিয়ে রাখত সবসময়। বয়েসকালে ছেলে পুলে হয়নি বলে মল্লিকা কাঁকনকে চব্বিশ ঘণ্টা বুকে করে আগলে রাখেন, সর্বক্ষণ চোখে হারান, মেয়েকে নিয়েই ওঁর যত আহ্লাদ, যত ভাব-ভালোবাসা।

ব্রতীনবাবু প্রথমদিকে কাঁকনকে বাড়িতে নিয়ে আসার ব্যাপারে আপত্তি জানালেও, পরে ওঁরও বড্ড মায়া পড়ে গেছিল। আগে অফিস থেকে ফিরে আসতেন যখন, মেয়েটা টলমল পায়ে যেখানে থাকত ঠিক চলে আসত ওঁর কাছে । তারপর তো সে আর কিছুতেই কোল থেকে নামবে না, তাকে তখন হাতে করে দুধ বিস্কুট খাইয়ে দিতে হবে, কোলে করে বেড়াতে নিয়ে যেতে হবে, খাটে বালিশ নিয়ে দাপাদাপি করতে হবে, বল নিয়ে ছোড়াছুড়ি খেলতে হবে… কত্ত আবদার…

দেখতে দেখতে পাঁচ পাঁচটা বছর হয়ে গেল……… ব্রতীনবাবু আর বসে থাকতে পারলেন না, এক রাশ অস্বস্তি নিয়ে চাদরখানা কাঁধে ফেলে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে পড়লেন। বাড়ি ফিরলেন যখন, তখন প্রায় ন’টা বাজে… ক্লান্ত, বিধ্বস্ত … শরীরে আর দিচ্ছিল না।

“শুনছ, এ ভারি দুশ্চিন্তার ব্যাপার হল বুঝলে, আশেপাশের বাড়ি, বাজার, পার্ক, সব ঘুরে দেখে এসেছি। নাহ, কেউ কোন হদিশ দিতে পারল না… এবার তো সত্যিই ভয় হচ্ছে! মেয়েটা কোথায় চলে গেল বল দিকি!!”

মল্লিকা হাউ হাউ করে কেঁদে উঠলেন, “দু’টুকরো মাংসের জন্য আজ তুমি যা করলে, তার কোন ক্ষমা নেই, জান তো! কাঁকনটাকে না পাওয়া গেলে আমি জীবনে আর এ-বাড়িতে মাংস ঢুকতে দেব না, এ তুমি দেখে নিও। আমার ওইটুকু মেয়ে, রাস্তাঘাট কিচ্ছুটি চেনে না, কী হবে এখন? সে কি আর আছে? তুলে নিয়ে বেচে দিয়েছে কেউ!! এরপর সুশীল ঠাকুরপোকে তুমি কী জবাব দেবে একবার ভেবে দেখেছ? সহ্য হল না, আমার এইটুকু সুখ তো্মার সহ্য হল না…”

ব্রতীনবাবু মাথা নিচু করে আসস্তে আস্তে শোয়ার ঘরে এসে ঢুকলেন। কী বলবেন, কী করবেন কিছুই বুঝে উঠতে পারছেন না। মল্লিকার প্রেশার আছে, এইভাবে চলতে থাকলে ও তো অসুস্থ হয়ে পড়বে! নিজেকে বড্ড অপরাধী মনে হচ্ছিল।

খাটে এসে চুপ করে বসে থাকতে থাকতে কখন চোখের পাতা বুজে এসেছে খেয়াল নেই, হঠাৎ কেমন একটা খচমচ শব্দে ব্রতীনবাবু উঠে বসলেন।

কী রে? কীসের আওয়াজ ওটা? কোথায় হচ্ছে? এই ঘরেই তো মনে হয়!! চোরটোর ঢুকল নাকি! সদর দরজা সেই বিকেল থেকে হাট করে খোলা! মল্লিকার তো আজ কোনোদিকে হুঁশ নেই।

ব্রতীনবাবু বালিশের তলায় রাখা টর্চখানা নিয়ে সাবধানে চুপিচুপি খাটের নিচে উঁকি দিলেন। একীইইই… আরে ওইইই তো … ওই তো কাঁকন! দেখ কান্ড, গায়ে একখানা কাঁথা পেঁচিয়ে কেমন অঘোরে ঘুমুচ্ছে!   

“কাঁকন… ও কাঁকন… লক্ষ্মী মা আমার, আয়, বেরিয়ে আয়। কাঠের তলায় অমন করে ঢুকতে আছে? ওখানে জুজু থাকে বলেছি না! আয় মা, বেরিয়ে আয় সোনা… বুড়ো বাপটা কি পারে ওই কোনা ঘুপচিতে ঢুকে তোকে বের করে আনতে? আয় বাবু, আয়… আয়… উফফফ, কী দুশ্চিন্তাটাই না হচ্ছিল এতক্ষণ? হ্যাঁ রে আমাদের যে বয়েস হয়েছে, সেটা বুঝিস না? মা সেই কখন থেকে তোকে কত করে ডাকছে, একবারের জন্যও সাড়া দিসনি কেন বল দিকি? চুপ করে অন্ধকারে ঢুকে বসে আছিস, মশা কামড়ে তো শেষ করে দিচ্ছে একেবারে, হ্যাঁ? এত্ত রাগ বাপের উপর?… আয় আয়… এবার বেরিয়ে আয়.”

কিছুক্ষণ গোঁজ হয়ে বসে থাকার পর কাঁকন অবশেষে খাটের তলার রাশিকৃত বাসন, স্যুটকেশ, তোরঙ্গ, এক গুচ্ছ মাকড়শার জাল, গোটা তিনেক টিকটিকি, খান পাঁচেক আরশোলা ঠেলেঠুলে সরিয়ে হামাগুড়ি দিয়ে বেরিয়ে এল।      

ব্রতীনবাবু চিৎকার করে গিন্নি কে ডাকলেন, “মল্লিকা, আরে শুনছওওওও। শিগগিরি দেখে যাও… এই যে, এই ঘরে… শেষমেশ তোমার হারানিধিকে খুঁজে পেয়েছি। নাও, এবার সামলাও দিকি! আর তাড়াতাড়ি বেশি করে মাংসভাত মেখে রেডি কর। আহা রে… সেই দুপুর থেকে না খাওয়া… নাও নাও… দেখ তো, মেয়ে আর কী খাবে জিজ্ঞেস কর ভালো করে।”

মল্লিকা হাচোড়পাঁচোড় করতে করতে ছুটে এসে এক গা ধুলো মাখা কাঁকনকে জড়িয়ে, ধরা গলায় জিজ্ঞেস করলেন, “বল দিকি মা, কী খাবি? কী খেতে ইচ্ছে করছে? বল তো! বল, আমি এক্ষুনি ব্যবস্থা করছি।” 

ব্রতীনবাবু আর মল্লিকাদেবীর পাঁচ বছরের কন্যারত্ন, আদরের কাঁকন, আহ্লাদি আহ্লাদি মুখে খাটের তলা থেকে গোটা ছয়েক বড়োসড়ো, প্রায় ছিবড়ে করা খাসির মাংসের হাড়, আর দু’টুকরো আধখাওয়া আলু বের করে এনে মায়ের মুখে মুখ ঘষতে ঘষতে গদগদ ভাবে উত্তর দিল, “ভৌউউ…ভৌউউউউউ”

অলঙ্করণঃ শিমূল 

জয়ঢাকের সমস্ত গল্পের লাইব্রেরি এই লিংকে

1 thought on “গল্প নিরুদ্দেশ সংবাদ শুভলক্ষ্মী ঘোষ বসন্ত ২০১৯

  1. শিমূলকে আমার আন্তরিক ভালোবাসা জানাই… এমন মিষ্টি একটা প্রচ্ছদ এঁকে দেওয়ার জন্য। জয়ঢাক পত্রিকাকে আমার ধন্যবাদ রইল।

    Like

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Twitter picture

You are commenting using your Twitter account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s