শুভ্রা ভট্টাচার্যের আগের গল্প ঝিল্লি
জন্মের পর সাধারণত বাচ্চারা মা-বাবা অথবা মম-ড্যাড এ জাতীয় কথাই প্রথম শেখে । কিন্তু ডোডোর ক্ষেত্রে একটু ব্যতিক্রম। ডোডো জন্মের পর প্রথম যে কথাটা শিখেছে তা হল ‘বু’ । মা-এর পর এই ‘বু’-ই তার সমস্ত দুনিয়া । ব্রো বা ব্রাদার (বা ভাই) , যে একটি এক বছরের শিশুর বুলিতে ‘বু’-এ পরিণত হয় , সে আসলে একটি কোয়ালা । ডোডোর বাবা একদিন ফরেস্ট থেকে কুড়িয়ে পান সঙ্গী হারা ছোট্ট কোয়ালাটিকে । বাড়ি নিয়ে এসে খুব অল্প দিনের মধ্যেই পোষ মানিয়ে নেন ।
ডোডো জন্মের কয়েক বছরের মধ্যেই মা কে হারায় । তখন থেকেই মা হারা ডোডোর একমাত্র সাথী বু । ডোডোদের কম্পাউন্ডে নানা রকমের গাছ আছে । সেখানেই সারাদিন বু-এর সঙ্গে খেলাধূলা করে চার বছরের শিশুর সারাটা দিন কাটে । বু -কে নিজে হাতে ফল খাইয়ে তবেই সে খায় । সকালে ঘুম থেকে উঠে থেকে বু -এর সাথে খুনসুটি , ঘুমন্ত বু -কে ঠেলে ঠেলে জাগানো , খাওয়ানো , স্নান করানো , গা ব্রাশ করে দেওয়া এই সব কাজ তো মায়ের থেকেই শেখা । এর মধ্যেই বু আবার বারে বারে ঘুমিয়েও পড়ে । ফল খাওয়াতে খাওয়াতে বা যখন গায়ের লোম চিরুনি দিয়ে আঁচড়ে দেওয়ার সময় বু ঘুমে ঢুলতে থাকে, ডোডো খিলখিলিয়ে হেসে ওঠে ।
উত্তর কলকাতা নিবাসী সাগর বিশ্বাস চাকুরী সূত্রে প্রায় আট বছর ধরে স্ত্রীকে নিয়ে অস্ট্রেলিয়ায় থাকছিলেন। ডোডোর জন্মের পরই খুব জটিল একটা রোগে তাঁর স্ত্রী অসুস্থ হয়ে পড়েন । অসুস্থ স্ত্রীর চিকিৎসার কোনও ত্রুটি রাখেননি তিনি । তাঁর সঞ্চিত প্রায় সমস্ত অর্থ দিয়েই তাঁকে বাঁচানোর চেষ্টা করেছিলেন । তবু শেষ রক্ষা হল না । স্ত্রীর মৃত্যুর পর এই বিদেশ বিভূঁইএ একা ছেলেকে নিয়ে খুব অসহায় হয়ে পড়েন । ডোডোর দেখাশুনার জন্যে তিনি অনেক কষ্টে একজন পরিচারকের ব্যাবস্থাও করেন । কিন্তু এভাবে আর কতদিন চালানো যাবে তা নিয়ে তিনি যথেষ্ট চিন্তায় ছিলেন । কারণ যা অর্থ সঞ্চয়ে আছে তা নিয়ে অস্ট্রেলিয়ার মত এত ব্যায়বহুল স্থানে বাড়ি ভাড়া সমেত অন্যান্য খরচ বেশিদিন বহন করা যাবে না । অতঃ কিম তিনি পুনরায় কলকাতায় ফিরে আসার সিদ্ধান্ত নেন।
এদিকে এক সঙ্গে বাড়তে থাকা দুই ভাইয়ের বন্ধুত্বও উত্তরোত্তর বেড়েই চলেছে। বু আজকাল আবার গাছের চেয়ে ডোডোর খাটটাই ঘুমোবার জন্যে বেশি পছন্দ করছে। একটা মাত্র সিঙ্গল বিছানা দুজনের শোবার জন্যে যথেষ্ট নয়, তবু ওইটেতেই গুঁতোগুঁতি করে দুজনের শোয়া চাই। সুযোগ পেলেই ডোডো বু-কে নিয়ে পড়াতে বসে। আর পড়তে পড়তে এতদিনে অর্ধেক বইটাই বু -এর পেটে হজম হয়ে গেছে ।
সাগরবাবু দক্ষিণ কলকাতায় একটি বেশ বড় সড় ফ্ল্যাট কিনেছিলেন স্ত্রী পুত্রকে নিয়ে থাকবেন ভেবে । পরবর্তী কালে কলকাতা ছেড়ে অস্ট্রেলিয়ায় বদলি হয়ে গেলেন। তিনি ঠিক করলেন ডোডোকে নিয়ে উত্তর কলকাতার বাড়িতে না গিয়ে তিনি ফ্ল্যাটেই গিয়ে উঠবেন । কিন্তু বু-কে এখানেই রেখে যেতে হবে তাছাড়া কোনও উপায় নেই । এ কথা ডোডোকে জানাতেই তার চোখ ছলছল করে উঠল। সে জেদ ধরে বসল যে কোনও উপায়েই বু -কে সে এখানে রেখে যেতে রাজি নয় । সাগরবাবু ছেলেকে বোঝালেন, “বু অস্ট্রেলিয়ার জল হাওয়ার বাইরে কিছুতেই বাঁচবে না । আর আমাদের কাছে এত টাকা নেই যে আমরা এই বাড়িতে বেশিদিন থাকতে পারব।”
“বাড়িতে থাকতে হলে টাকা দিয়ে থাকতে হয়? আর টাকা দিতে না পারলে কী হবে বাবা ? ”
“টাকা দিতে না পারলে আমাদের আর এই বাড়িতে থাকতে দেবে না সোনা । আমাদের বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেবে।”
ডোডো তবু মুখ ভার করে রাখে । তার চোখে অপার বিস্ময় । সে ভাবতেই পারছে না যে বু -কে না নিয়েই তাকে চলে যেতে হবে ।
“বাবা, আমরা না থাকলে বু -কে কে খাইয়ে দেবে ? কে ঘুম পাড়িয়ে দেবে আর চান করিয়ে দেবে?” চার বছরের শিশু ফ্যালফেলিয়ে চেয়ে থাকে তার বাবার দিকে। কিন্তু তার বোধযোগ্য সদুত্তর সাগরবাবুর অজানা। তিনি অনেক কষ্টে অসহায় ছেলেকে শান্ত করেন। তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েই নিয়েছেন। দেশে ফিরতে তাঁকে হবেই। ডোডোকে দেখাশুনার জন্যে একজন বয়স্ক পরিচারককে তিনি রেখেছিলেন। তাঁদের দেশে ফিরে যাওয়ার প্রস্তাব শুনে তিনিও খুব কান্নাকাটি করলেন। সাগরবাবু তাঁর প্রাপ্য বকেয়া সব মিটিয়ে দিলেন। এমন সময় তাঁর পাঞ্জাবীতে একটা ছোট্ট টান পড়ল। ফিরে দেখেন ডোডো দাঁড়িয়ে আছে বু-কে নিয়ে। তার দুই গাল বেয়ে নেমে এসেছে অভিমানী জলের ধারা। আর তার হাতে ধরা তার সাধের পিগিব্যাঙ্কখানা ।
“তুমি আমার সব টাকা গুলো নিয়ে ওদের দিয়ে দাও বাবা । তাহলে তো আর কেউ আমাদের বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেবে না বলো ? আমরা বু-কে ছেড়ে যাচ্ছিনা তো বাবা?”
সাগরবাবু বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেলেন। অপরাধীর মত হাঁটু মুড়ে বসে পড়লেন ছেলের সামনে। ডোডোকে বুকে জড়িয়ে ধরে ঝরঝরিয়ে কেঁদে ফেললেন ।
এরপর দক্ষিণ কলকাতার ফ্ল্যাটটা বিক্রি করে সাগরবাবু ডোডো আর বু কে নিয়ে অস্ট্রেলিয়ার “কুমা” শহরের অনতিদূরে অন্য একটি ছোটো বাড়িতে শিফট হলেন । বাড়ি বদলের ব্যাপারে অফিস থেকেও সাহায্য পাওয়া গেল। ডোডোর আর বু -কে ছেড়ে থাকার ভয় নেই। বাবা কথা দিয়েছেন বু –এর জন্যে আরেকটা খাট বানিয়ে দেবেন । দুই ভাই পাশাপাশি থাকবে ।
ছবিঃ তন্ময়
জয়ঢাকি গল্প-উপন্যাসের লাইব্রেরি এইখানে