গল্প-ভুতুমের অবাক কাণ্ড পিয়ালী বন্দ্যোপাধ্যায় শীত ২০১৮

পিয়ালী বন্দ্যোপাধ্যায়

ক’দিন ধরে যে কী হচ্ছে কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছে না ভুতুম।

ঘাটশিলা বেড়াতে গিয়েছিল এই বর্ষায়। ফুলডুংরির রাস্তাটায় ঝপঝপ করে খানিকটা বৃষ্টি হয়ে গেল। ছাতা আর নিজস্ব বাইনোকুলার সামলে, ও এগোচ্ছিল লাল কাঁকরমাটিতে মচমচ করকর শব্দ তুলে।

পাখি দেখবে বলে কাল মাঝরাত অব্দি বই নেড়েছে আর ভোর না-হতেই বেরিয়ে পড়েছে। এখানে এত গাছ আর তেমনি পাখির আওয়াজ। কিন্তু এই কাঁকরমাটির শব্দে পাখি পালাবে না ত! সেবার শীতে গজাবুরু ক্যাম্পে গিয়ে লিডার বুড়ুনদার মুখে ও একটা শব্দ প্রথম শুনেছিল, ক্রাঞ্চিং গ্র্যাভেলস! ওরা যখন গজাবুরুর দিকে হেঁটে যাচ্ছিল, তখন বুড়ুনদা বলেছিল, এই যে শব্দ উঠছে তোর পায়ে, এটা তোর মাথায় গেঁথে যাচ্ছে। শহরে ফেরার পর বেশ কিছুদিন ঘুমোনোর সময় তোকে ঘুম পাড়াবে। তারপর যখন আওয়াজটা ফিকে হয়ে আসবে, তখন বুঝবি, আবার বেরোনোর সময় এসে গিয়েছে। তখন আর ঘরে মন টিকবে না।

সত্যিই তাই, এরকমই হয় ওর। কী একটা ছটফট করে ডানা মেলে বুকের ঠিক মাঝখানটায়। ভুতুম তখন নিদেনপক্ষে ওদের বাড়ির গলির শেষের মাঠটায় গিয়ে বসে। পুরোনো শিবমন্দিরের চাতালে পা ঝুলিয়ে। দুলতে দুলতে গান ভাবে কিন্ত গান গাওয়া ওর ঠিক আসে না। একটা ভোমরার মত আওয়াজ বেরোয় গলায়। ভুতুম ভাবে, যাওয়া তো যায় অনেক জায়গায় কিন্তু বাবা! বাবা মানে, বাপ–মানে বাপরে বাপ! শুনলেই গম্ভীর আর ব্যাজার মুখ করবে। রাগলে বাবাকে মা দুর্গার অসুরের মত লাগে। ওদিকে মা-কেও বোঝা দায়। মা, বাবার দলেই কি না, ভুতুম বুঝে উঠতে পারেনি আজো। বাবা ওরকম করলে মা গাল ফুলিয়ে ঘুরে বেড়ায়। ঠিক সময় টিফিন, স্কুলের ভাত, প্রোজেক্টের লাস্ট মিনিট মেক-আপ সব করে দেবে। কিন্তু মুখে টুঁ শব্দটি নেই। অথচ বাবা যখন বাইরে থেকে অফিস করত, তখন এই মা-ই হুটহাট ছুটির দিনে ওদের দু’ ভাইবোনকে নিয়ে দে-হাওয়া। কখনো ব্যান্ডেল, কখনো খিদিরপুর ডক কিংবা এমনিই বাসে চেপে লাস্ট স্টপ পর্যন্ত ঘুরে ফেরা। তবে শপিং মল বা সাজানো পার্কে নিয়ে যাবে না কিছুতেই।

সেই মা-কে লুকিয়ে কিছু করতে ওর মন চায় না। কিন্তু কী যে হয় মাঝে মাঝে! থেকে থেকে ওর হাত-পা যেন নিজের কন্ট্রোলে থাকতে চায় না। পালাতে চায়। একলা বাসে বাসে সারা শহর। সেদিনই এই নিয়ে তুলকালাম হল। মা বলে দিয়েছিল মামারবাড়ি যেতে।  দিদুকে একটা দরকারি বই দিয়ে আসতে। ও বাসস্টপে দাঁড়াতেই সামনে একটা হাওড়ার বাস চলে এল । বে—শ ফাঁকা। ও না-উঠে পারে! মামারবাড়ির উল্টোদিকে বাঘাযতীন।

পৌঁছেছিল ঠিকই, কিন্তু আড়াই তিনঘন্টা পর। শুধু নাকি পুলিশ ডাকা বাকি ছিল। শুধু বকুনি নয়, দু-চার ঘা পিঠেও পড়েছিল সেদিন। ও দেখেছে কিছুতেও ওর কান্না আসে না। তার বদলে  দুচোখ বুজে  ফ্যালে আর তখনি হুড়মুড় তোলপাড় করে সবুজ এসে জুড়ে বসে ওর মনে। সরসর করে সরে সরে যাচ্ছে সবুজের নানা শেড। যেমন হয় ট্রেনে বা বাসে। ছাদের জলের ট্যাংকির ওপর বসে। আর তখন মনে পড়তে থাকে কিছুকাল ধরে ঘটে চলা আশ্চর্য ব্যাপারগুলো। গাছগুলো ওর মনখারাপ বুঝতে পেরে যায় কিংবা ও গাছেদের।

একদিন হল কী, স্কুল যাওয়ার জন্যে বাসস্ট্যান্ডের গাছতলাটার দিকে ও এগোচ্ছিল। ভাদ্রমাসের চড়া রোদে চারদিক ঝমঝম করছে। পৃথিবীর সমস্ত লোক যেন ওই গাছতলাতেই জুটেছে। অথচ এই গাছটাকে মনে হয় যেন ওর নিজের আবিষ্কার। কতজন আসে, দাঁড়ায়, চলে যায়। কেউ কি বলে দিতে পারবে ওর নাম? কখন কী রঙের ফুল ফোটে, কী রকম ফল হয়!  কাপক, শ্বেত শিমুল,জাভা কটন। মোবাইলে ছবি তুলে গুগলে সার্চ করে সব মিলিয়েছে ভুতুম।

গাছ ছুঁয়ে আজ আর দাঁড়ানো হবে না, এই ভেবে মাথায় হ্যাংকারচিফ বেঁধে একপাশে দাঁড়ায় ভুতুম। রোদে চোখ কুঁচকে দূর থেকে আসা বাসের নাম্বার মেলাচ্ছে, হঠাৎ — আঃ কী আরাম! ছায়া! মাথা তুলে দেখে বড় পাতাওয়ালা ডালটা তার মাথার ওপরেই! কিন্ত কী করে হয়! অন্তত বিশজন মানুষ গাছটার ছায়া শুষে নিচ্ছে দেখেই তো ও নিজে সরে, রোদে দাঁড়িয়েছিল! ভাবতে ভাবতে বাস এসে গেল।

বাড়ি ফিরে ও ব্যাপারটা নিয়ে ভাববে ভাবছে, তখনি আরো কতগুলো আশ্চর্য ঘটনা মনে পড়ে গেল   ওর। ছোটবেলায় ভবানীপুরে মামারবাড়ি যেত। গেট দিয়ে ঢুকতে না-ঢুকতেই এক মিশ্র গন্ধ ঘিরে ফেলত ওকে। কামিনী কিংবা হাসনুহানা। নাকি নিমফুল!–  কে জানে! বাগান পেরিয়ে সিড়ি আর রক। সেই রক বেয়ে নেমে আসত লাল আলতা-পরা পায়ের হাসিমুখ দিদান। একদিন বর্ষায় যেতেই দিদান বলল, আজ ভুতুমকে সবুজ ফুল দেখাব! ছোট্ট ভুতুম ভাবল সে কি এপ্রিল ফুল নাকি! ফুল আবার সবুজ হয়!! বলতে বলতেই দিদানের লম্বা ফর্সা হাত বেয়ে চোখ গেল, আরে সত্যি!

সেদিন চিনেছিল কাঁঠালিচাঁপা। আজ একপশলা ভাদুরে বৃষ্টির পর ছাদে গিয়েই কাঁঠালিচাঁপা আর দিদানের জন্যে মনটা হুসভুস করে উঠলো কেমন! সাতার কাটতে গিয়ে জলে ডুবলেই যেমন ভেসে ওঠে তেমনি মনটা কিছুতেই বসছে না থিতিয়ে। দিদান নেই আর,আচ্ছা গাছটা কি এখনো আছে মামারবাড়ি? মা-ও আর যায়না কতদিন। এই কেঠো শহরে  কোথায় পাবে ও সেই গন্ধ!

ভাবতে ভাবতে চলেছে সাদার্ন এভিন্যু দিয়ে সাঁতার ক্লাসে।এমন সময় গন্ধের পিছুডাক! রিফ্লেক্সে ঘাড় ফেরাতেই হল বাঁদিকে। পাশের সবুজ গাছটায় একটামাত্র কাঁঠালিচাঁপা ফুটে। বিস্ময়ের ঘোরে ভুতুমের বুকে হাতুড়ির ঘা। কী করে হয়! কে বলবে ওকে।

যত নষ্টের গোড়া ওই স্কুলের বায়ো স্যার। উনিই তো একটা সবুজ মলাটের বই পড়তে দিয়েছিলেন ওকে। অব্যক্ত। জগদীশ বোসকে চেনার সেই শুরু। লোকটা কী পাগল ছিল, এতবড় একজন মানুষ, গাছের অনুভূতি টুকে রাখতে কত কী উদ্ভট নামের মেশিন আবিষ্কার করে ফেলেছিল, শোষণমান, কুঞ্চনমান। কখনো তারের সূক্ষ্ম পেন বানিয়ে কাচের ওপর ফুটে ওঠা ছবি  নজর করেছে। মেঘলা দিনে আর রোদ্দুর ভরা দিনে গাছেদের মন ভাল আর খারাপ হওয়ার খবর নিয়ে নোট করেছে।

সে-সব না হয় হল। কিন্তু ঘাটশিলার ব্যাপারটা? পায়ে পায়ে ভুতুম এগিয়ে গিয়েছিল অনেকটা। ভোরে সবাই যখন ঘুমন্ত ও বেরিয়ে পড়েছিল। একটা অদ্ভুত পাখির শিস ওকে টানছিল। একজায়গায় এসে সেটা তীব্র হল। ভুতুম তখন পাশেই একটা গাছ পেয়ে ঠেস দিয়েছিল যাতে উঁচু গাছের ডগার দিকটা ভাল করে দেখতে পারে। চোখে বায়নোকুলার লাগিয়েছিল। এইপর্যন্ত মনে আছে ওর। এরপরই দাদা দাদা ডাক শুনে চমকে ঊঠেছে ও। কী আশ্চর্য! ও ঘুমিয়ে পড়েছিল নাকি? কিন্ত ও তো পাখি দেখার জন্যে একটা গাছে ঠেসান দিয়েছিল। আর ওই গাছটায় ও এখন প্রায় চিত হয়ে   শুয়ে কী করে! গাছ এমন ভাবে বেঁকেছে যে পুরো শরীরটা  শুয়ে আর পা দুখানা একটু মাটির ওপর ঝুলছে, মাথাটা দিব্যি আরামকেদারার মত সাপোর্ট দেওয়া,তাই পড়েও যায়নি। বোন কাছে এসে ঠেলতেই চোখে পড়ল দূরে ক্যামেরা হাতে মায়ের দিকে। ছবি তুলে মা হাসতে হাসতে বলছে এই গাছপাগলা! কোন ভোরে উঠে বেরিয়েছিস! আবার ঘুমোবার জন্যে দিব্য ইজিচেয়ারের মত  গাছটা খুঁজে বের করেছিস তো!

 জয়ঢাকের সমস্ত গল্প ও উপন্যাস

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Twitter picture

You are commenting using your Twitter account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s