গল্প ভোগ প্রসাদ সঙ্গীতময় দাস বসন্ত ২০১৯

“বাবা, বাতাসা এনেছ বাজার থেকে?” নয় বছরের রিনি প্রশ্ন করল।

“এই রে! একদম ভুলে গেছি যে-”

“তা হলে কী হবে?” রিনির উৎকণ্ঠা বেড়ে যায়।

ব্যাপারটা তাহলে প্রথম থেকেই শুরু করা যাক। গতকাল বিকেলে রিনির মামা ফোন করেছিল। দাদুর নাকি খুব শরীর খারাপ। সেই শুনে রিনির মা একরাশ উৎকণ্ঠা নিয়ে হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে গেলেন।

রিনির মামাবাড়ি বারাসাতে। রিনিরা থাকে ভবানীপুরে। ওখান থেকে মেট্রোতে দমদম। দমদম থেকে ট্রেনে বারাসাত। কতবার গেছে রিনি। বললে রিনিও একা চলে যেতে পারে। কিন্তু মা রিনিকে সঙ্গে নিয়ে গেলেন না। বাবার কারখানায় নাইট ডিউটি চলছে। ভোরবেলা বাড়ি ফিরবেন।

অন্যসময় হলে রিনির বাবা কারখানা থেকে সোজা বারাসাথ চলে যেতে পারতেন। কিন্তু অত ভোরে গাড়িঘোড়ার সমস্যা। তাই স্থির হল রিনি বাড়িতে থাকবে। তারপর আগামীকাল বিকেলে বাবা আর রিনি বারাসাত পৌঁছে যাবে।

যাবার আগে মা পইপই করে বলে গিয়েছিলেন- দ্যাখ, ফ্রিজে একটা তরকারি করে রেখে গেলাম। দুধ আছে, ভাত আছে, এই দিয়ে খেয়ে নিস। কেউ এলে দরজা খুলবি না, সে যত জানাশোনা লোকই হোক। দিনকাল ভীষণ খারাপ। অ্যালার্ম দিয়ে দিয়েছি ৪টের সময়। ঘুমিয়ে কাদা হয়ে যাস না আবার। বাবা এলে জানালা দিয়ে দেখে দরজা খুলে দিস। বাবার কাছে সদর দরজার চাবি নেই কিন্তু।

“আর শোন বাবাকে বলবি কাল যেন বাজার থেকে অল্প বাতাসা কিনে আনে”  – সদর দরজার সামনে দাড়িয়ে রিনির মায়ের হঠাৎ কথাটা মনে পড়ল।

“কেন বাতাসা কী হবে আবার?”

“আমার ঠাকুর কি উপোস করে থাকবে সোনা? তোমরা নিজেরা তা হলে কাল না খেয়ে থেকো।” রিনির মা’র গম্ভীর গলা, “বাতাসা নেই। বাতাসা নিয়ে এলে স্নান করে ঠাকুরকে একটু পুজো দিও দয়া করে।”

দয়া নয়। প্রত্যেকটি হল আদেশ। একটু ভুলচুক হলে আর দেখতে হবে না। অতএব এখন সবকটা আদেশ রিনিকে অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলতে হবে। লিখে নিতে পারলে ভাল হত। কিন্তু মনে মনে বেশ একটা স্বাধীনতার গন্ধ পাচ্ছিল রিনি। কি মজা কাল সকাল পর্যন্ত সে স্বাধীন। পড়াশোনা নেই। যত ইচ্ছা টিভি দেখবে। কম্পুটার গেম খেলবে।

 যথারীতি মায়ের পদাঙ্ক অনুসরণ করে পইপই করে বলে দিয়েছিল রিনি। কিন্তু বাবাটা যেন কী! বাজারে গেলে ঠিক একটা না একটা কিছু ভুলে যাবে। বতাসা আনেনি। কী হবে এখন!

“আরে এত টেনশন নিচ্ছিস কেন। তোর মার গোপালকে উপোসী রেখে খাব? আমার ঘাড়ে কি দুটো মাথা আছে নাকি? দ্যাখ না কি করি!” এই বলে বাবা বসে গেল মাছ ধুতে।

রান্নাবান্না করে, খেয়েদেয়ে, বাসনকোসন মেজে পাড়ি দিতে হবে বারাসাত। বুড়োর আবার ভীষণ জ্বর। কী জানি আবার ডেঙ্গু-টেঙ্গু বাধাল কি না!

দুপুরবেলা স্নান টান সেরে খাওয়ার ঠিক আগে রিনি বাবাকে জিজ্ঞাসা করল “ বাবা। পুজো করবে না? ঠাকুরকে জল বাতাসা না দিলে কিন্তু মা ভীষণ রাগ করবে।”

“হুম। তা তো ঠিক। আচ্ছা, আমরা যদি আমরা ঠাকুরের ভোগ প্রসাদ খাই, তা হলে কী’রকম হয় বল তো!”

“সে আবার কী?” রিনি আবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করল।

বাবা কিছু না বলে একটা ছোট থালায় ভাত, বাটিতে ডাল, আর এক টুকরো মাছ সাজিয়ে বলল “চল গোপালকে দিয়ে আসি।”

“ এ মা। এ তো সকড়ি!  তুমি গোপালকে ভাত-মাছ দেবে নাকি?” মেয়ে অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করল।

“সকড়ি কেন হবে বোকা মেয়ে! I do not agree with you.” বাবা হো হো করে হেসে উঠলেন।

“শোন, তুই নিজে খেয়ে দেয়ে সেই খাবার থেকে ঠাকুরকে দিলে তা হল সকড়ি, এঁটো। কেন বল তো?”

“কেন?”

“কারণ সেখানে তুমি ভগবানকে তোমার উচ্ছিষ্ট দিচ্ছ।  তাকে যেন ভিক্ষা দিচ্ছ। ভগবানকে কি ভিক্ষা দেওয়া যায়! তিনিই তো আমাদের ভিক্ষা দেন রে!”

“কিন্তু মা যে বলে ভাত হল সকড়ি?” রিনির প্রতিবাদী কণ্ঠ।

“মা অত ভেবে বলে না। চল না এক্সপেরিমেন্ট করে দেখি ঠাকুর পছন্দ করে কি না? গোপাল তো রোজ সেই বাতাসা খায়। আজ গোপাল নিশ্চয় খুশি হবে।” বাবার প্রত্যয়ী স্বর।

“আচ্ছা তুই কালীপূজোতে ভোগের খিচুরি খেয়েছিস তো?”

“হ্যা, খাব না কেন?”

“তবে! খিচুরি কি গম দিয়ে হয় নাকি?”

“কী যে বল। ও তো চাল আর ডাল!” খিলখিল করে হেসে উঠল রিনি।

“তাহলে বল খিচুরি হল ডাল-ভাত। তা সেটা যদি সকড়ি না হয় তা হলে আমরা যা রান্না করলাম তা সকড়ি হয় কি করে?”

এত কচকচি এতক্ষণে রিনির কাছে বেশ বিরক্তিকর হয়ে উঠল। বিরক্তির স্বরে বলল, “দূর! যা পারো কর গিয়ে। মাকে বলে দেব। চেল্লাবে। বুঝবে তখন।”

এই প্রথমবার এ বাড়ির গোপাল ভাত-ডাল মাছের স্বাদ পেল। ধূপধুনো দিয়ে পুজো করার সময় বাবা বললেন, “দ্যাখ রিনি। গোপালের মনে হচ্ছে বেশ ভাল লেগেছে। চোখদুটো কিরকম চকচক করছে?”

রিনির মনে হল গোপাল যেন সত্যি সত্যি বলছে, “রিনি, তোরা কী ভাল ভাল জিনিস খাস রে! আর আমার বেলা শুধু বাতাসা! ক্যান রে আমার কি ভাল ভাল জিনিস খেতে ইচ্ছে করে না?”

দুপুরে ভাত খাওয়ার আগে রিনি আর বাবা গোপালের প্রসাদ ভাগ করে খেল।

দাদুর শরীর এখন ভালার দিকে। জ্বর নেমে গেছে। মামা- মাসির মুখে হা-হা-হি-হি ফিরে এসেছে। বেশ আড্ডা চলছে জমিয়ে। ঠিক সেই সময় মা’র হঠাৎ বাজে প্রশ্নটা মনে পড়ল।

“ঠাকুরকে জল বাতাসা দিয়েছিলি রিনি?”

ব্যাস রিনির বেলুন ওমনি ফটাস। আমতা আমতা করে বলল “ইয়ে মানে বাবা গোপালকে ভাত ডাল আর মাছ দিয়ে পূজো করেছে মা।”

“মানে?”  মা’র সুতীক্ষ্ণ প্রশ্ন।

আস্তে আস্তে সব বলল রিনি। ঘরের মধ্যে বেশ থমথমে ভাব। রিনির মামাবাড়ি একটু গোঁড়া ব্রাহ্মণ পরিবার। রিনির বাবার সাথে বিয়েতে আপত্তি ছিল দাদুর। কংসবেনে পরিবারে ছেলের সাথে বিয়ে দিতে চাননি দাদু। শেষ পর্যন্ত ভালবাসার জয় হয়।

বেশ কিছুক্ষণ গম্ভীর থাকার পর রিনির মা বললেন, “তোর বাবা কিছু ভুল বলেনি রে রিনি। আসলে ভগবান তো আমাদের সবাইকে খুব ভালবাসে। তাই ভালবেসে কিছু দিলে ভগবান খুব আনন্দ পায়। ঠিক আমাদেরই মত। আর আমরা কেবল রিতি-রেওয়াজই দেখি। ভালবাসার কথাটা বেমালুম ভুলে যাই।”

“ঠিক বলেছিস। তাই তো পুজোর রীতিনীতি নিয়ে, ধর্ম নিয়ে এত দলাদলি, মারামারি!” মামা বললেন।

“তোর বাবা তো আর একবার এ-বাড়িতে বিপ্লব বাঁধিয়ে দিল রে!”এই বলে মাসি হিহি করে হেসে উঠলেন।

“ভাত-ডাল-মাছ গোপালের খুব ভাল লেগেছে গো মাসি। আমি শুনেছি গোপাল বলছে, তোরা এত ভাল ভাল খাস, এবার থেকে আমাকেও এসব না দিলে আমি বেড়াল হয়ে চুরি করব কিন্তু। আমার কিন্তু চুরি করা স্বভাব যায়নি।” সোৎসাহে বলে গেল রিনি।

“তাই?” সবাই ঘর কাঁপিয়ে হেসে উঠল।

অলঙ্করণঃ শিমূল

জয়ঢাকের সমস্ত গল্পের লাইব্রেরি এই লিংকে

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Twitter picture

You are commenting using your Twitter account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s