গল্প মন কেমন দীপান্বিতা রায় শীত ২০১৭

“মটরুয়া, এ মটরুয়া……সো গঈ কেয়া…..তানি দরওয়াজা খোল দো বাবুয়া……মটরুয়া…..”

শীতকাল। ঘড়ির কাঁটাও দশটার ঘর ছাড়িয়ে গেছে বেশ খানিকক্ষণ। মফস্বল এলাকায় এমনিতেই সন্ধের পর দ্রুত রাস্তাঘাট ফাঁকা হয়ে যায়। আর এই ইস্পাত কারখানার ছোট্ট কলোনিতে তো মানুষের জীবন চলে কারখানার ভোঁ-এর সঙ্গে তাল মিলিয়ে। সকাল ছটায় ফ্যাক্টরির গেট খোলে। তার ঠিক পনেরো মিনিট আগে ঘড়িঘর থেকে বিকট শব্দে ভোঁ বেজে সবাইকে বলে দেয়, সময় হল, এবার কাজে চলো হে….

শিফটে শিফটে ডিউটি। সকালের লোকেরা বাড়ি ফেরে দুপুর দুটোয়। দুপুরে যারা যায় তাদের ছুটি রাত দশটায়। কারখানার চোখ কিন্তু রাতেও খোলা থাকে। তার কাছে হাজিরা দিতে আর একদল গেট পেরিয়ে ঢোকে রাত দশটায়। আকাশের ঘুম ভাঙলে তবে তাদের বাড়ি ফেরার সময় হয়। তাই রাত দশটায়, রাতের লোকেরা গেটের ভিতরে আর দুপুরের লোকেরা নিজের নিজের বাড়িতে ঢুকে পড়লেই রাস্তাঘাট শুনশান। ঘরে ঘরে সবাই আলো নিভিয়ে মশারির নিরাপদ আশ্রয়ে। এলাকাটা মালভূমি অঞ্চল বলে ঠাণ্ডাও পড়ে খুব বেশি। শীতের দিনে ঘড়ির কাঁটা দশটা ছাড়িয়ে আরও অর্ধেক রাস্তা এগিয়ে যাওয়া মানে প্রায় মধ্যরাত। ঝিমঝিমে কুয়াশা ভেদ করে তাই মটরুয়ার বাবার হাঁকডাক শোনা যায় অনেকটা দূর থেকেও।

লালির মা ছোট মেয়ের গায়ে লেপটা টেনে দিতে দিতে বিড়বিড় করে বলেন, “নির্ঘাৎ মেয়েটা ঘুমিয়ে পড়েছে। ওইটুকু মেয়ে কখনও এত রাত পর্যন্ত জেগে থাকতে পারে? এত দেরি করা কেন বুঝি না বাপু। একটু আগে আগে এলেই হয়।”

“নিশ্চয় কোথাও ব্রেকডাউন হয়েছে। সেটা সামলে দিয়ে তবে বেরোতে পেরেছে। যাদবলালের কাজের ধরনটাই ওরকম। কী করব বলো……”

দীপক মিত্র মানে লালির বাবার কথাগুলো শুনে চুপ করে থাকেন প্রতিমা। কিন্তু ঘুমিয়ে পড়েন না। কান পেতে থাকেন। মটরুয়ার বাবা একটু পা-টা টেনে হাঁটেন। কারখানার ধাতুর পাত লাগানো বিশেষ ধরনের জুতোর একঘেয়ে ঠংঠং শব্দের মাঝখানে একসময় কড়াং করে একটা আওয়াজ হয়।ঘুম ভেঙেছে মটরুয়ার। পিতলের ছিটকিনি খুলছে। পাশ ফেরার শব্দে প্রতিমা বোঝেন দীপকও এতক্ষণ জেগেই ছিলেন।

রোলিং মিল কলোনিতে মটরুয়াদের ঠিক পাশের বাড়িটাই হচ্ছে লালি-মিলিদের। মাঝখানে শুধু একটা সিঁড়ির ব্যবধান। দোতলা ব্লকগুলোতে চারটে করে কোয়ার্টার। ওপরে দুটো, নিচে দুটো। মাঝখানে সিঁড়ি। একেবারেই সাধারণ দু-কামরায় থাকার ব্যবস্থা। সামনে ছোট্ট একটুখানি বাগান। সেখানে কেউ শখ করে দু-চারটে ফুলগাছ লাগায়। কেউ এমনিই ফেলে রাখে। আধমানুষ উঁচু কাঁটাতার আর মেহেন্দির বেড়া দিয়ে বাগানগুলোকে আলাদা করা। সবটাই খুব মামুলি, সাধারণ।

যদিও লালির সেরকম মনে হয় না মোটেই। সে তো জন্ম থেকে এখানেই বেড়ে উঠেছে। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন, ছিমছাম কলোনিটাকে তার দিব্যি লাগে। লালিদের বাগানটা ছোট হলেও তিনটে বড় বড় গাছ আছে। অশ্বথ্থ, নিম আর পেয়ারা। তারমধ্যে পেয়ারা গাছটা লালির সবথেকে পছন্দের। বছরে দুবার, শীত আর বর্ষায় গাছে পেয়ারা ধরে। তার আগে সুন্দর সাদা সাদা ফুল ফোটে।

পেয়ারাগাছটার চেহারাটিও বেশ মজাদার। মোটা কাণ্ডটা অল্প একটু ওঠার পরেই  এপাশ-ওপাশ ডাল বেরিয়েছে। তাই সিঁড়ি বাওয়ার মত বেশ এডাল-ওডাল করে চট্ করে পৌঁছে যাওয়া যায় মগডালে। আবার মোটা ডালে দুপাশে দু-পা ঝুলিয়ে বসাও যায় আরাম করে। মায়ের মারের হাত থেকে বাঁচার জন্য পেয়ারাগাছটাই লালির নিরাপদ আশ্রয়। সেরকম দরকারও প্রায়শই হয়। তার কারণ, মায়ের মতে লালির রকমারি দুষ্টুবুদ্ধি।

আর লালি মনে করে আসল কারণ হল তার ছিঁচকাঁদুনে বোন মিলি। লালি এখন ক্লাস সিক্স। তারমানে যথেষ্ট বড় আর হোমরাচোমরা। মিলির উচিত দিদিকে যথাযথ সম্মান করে চলা। কিন্তু মিলি তো তা করেই না, উপরন্তু লালি যদি বড় দিদির অধিকারে তাকে একটু কান মুলে দেয় কিংবা মাথায় গাঁট্টা মারে, তাহলে এমন চিল চিত্কার জোড়ে যে প্রতিমা নির্ঘাৎ খুন্তি হাতে ছুটে আসেন। মিলির কোনও দোষ তিনি সহজে দেখতে পান না। তাই খুন্তির ঘা লালির পিঠে পড়ারই সমূহ সম্ভাবনা থাকে। সেক্ষেত্রে লালিকে পেয়ারা গাছের মগডালে উঠে বসতেই হয়। মোটাসোটা প্রতিমা নিচে দাঁড়িয়ে খানিকক্ষণ খুন্তি হাতে চেঁচামেচির পর হতাশ হয়ে রান্নাঘরে চলে যান।

কারখানা থেকে বাবা বাড়ি ফিরলে তাঁর কাছে নালিশ হয় ঠিকই, কিন্তু সেটা নিয়ে লালির তেমন কোনও দুশ্চিন্তার কারণ নেই। কারণ মা যতই রেগে চিত্কার করেন বাবাও ঠিক ততখানিই চোখ পাকিয়ে তাকান লালির দিকে। তারপর গম্ভীর মুখ করে আলতোভাবে লালির কানটি ধরে যেন কত জোরে আড়াইপ্যাঁচ দিচ্ছেন এমনভাবে হালকা করে মুলে দেন। লালিও যেন কত ব্যাথা পাচ্ছে এমনভাবে মুখখানা কাঁচুমাচু করে ফেলে। ব্যাস, মা খুশি হয়ে বাবার জন্য পরোটা ভাজতে যান।

মিলিও ততক্ষণে দিদির শাস্তি দেখে কাঁদোকাঁদো। তাই দুইবোনে ভাব হতে দেরি হয় না। মা পরোটা আর ডিমভাজা নিয়ে এলে বাবা তার থেকে দু-টুকরো কেটে দুজনের মুখে পুরে দিয়ে চা খেতে খেতে মায়ের কাছে সারাদিনের গল্প শোনেন। মিলিও লালিকে নিয়ে বাগানে এস তাদের লোহার লম্বা গেটটায় চড়ে প্লেন প্লেন খেলে। কিংবা দুজনে দুজনের ফ্রকের ঝুলটা ধরে মুখে কু-ঝিকঝিক আওয়াজ করতে করতে ট্রেন চালায়।

কিন্তু লালি তো এখন একটু বড় হয়ে গেছে! তাই এই খেলাগুলো তার ঠিক পছন্দ হয় না। বড্ড বেশি ছেলেমানুষী মনে হয়। অথচ মিলি তো এছাড়া অন্য কিছু খেলতেই পারে না। একটু যে ছোঁয়াছুঁয়ি খেলবে তারও উপায় নেই। মিলি ছুটে তাকে ধরতেই পারবে না। একবার চোর হলে যদি সারাক্ষণ চোর হয়েই থাকতে হয় তাহলে মিলিরই বা খেলতে ভালো লাগবে কেন। মুশকিল হচ্ছে লালিদের এই রাস্তাটায় অনেকগুলো কোয়ার্টার থাকলেও ঠিক লালির সমবয়সী কোনও বাচ্চা নেই। হয় তারা মিলির মত ছোট। আর নয়তো এতটাই বড় যে লালিকে খেলতে নেবে না। তাও লালি মাঝে মধ্যে বড়রা যখন মোড়ের মাথায় হইহই করে ধাপসা কিংবা বুড়ি-বাসন্তী খেলে তখন সেখানে গিয়ে ঢুকেছে, কিন্তু পাত্তা পায়নি বিশেষ।

গতবছর গরমের ছুটিটা তাই লালির একটু মনমরাভাবেই কাটছিল। সেই সময় হঠাৎ একদিন এসে হাজির হল মটরুয়া। যাদবচাচার মেয়ে। লালিদের পাশের কোয়ার্টারটাই যাদবচাচার। কালো মত মানুষটি। লম্বা বেশি নয়। তবে বেশ পেটানো চেহারা। খাকি রঙের প্যান্টের সঙ্গে তেলচিটে, কালির দাগ মাখা ওভারঅল পরে জুতোর ঠংঠং শব্দ তুলে কারখানায় যায়। একাই থাকে। নিজেই রান্নাবান্না করে খায়। লালির সঙ্গে যাদবচাচার এমনিতে কোনও কথাবার্তাই হয় না। তবে ওদের বাগানে একটা বড় বেলগাছ আছে। লালিকে সেখান থেকে মাঝে মাঝে মায়ের পুজোর জন্য বেল পাতা পেড়ে আনতে হয়। গরমের শুরুতে গাছে ফুল ফোটে। ভারি চমত্কার সুগন্ধ তার। তারপর বর্ষার শুরুতে যখন ঢুপঢাপ বেল পড়তে শুরু করে তখন যাদবচাচা লালিকে ডেকে বলে, “এ বেটি বেল লে যা। ভাবিকো দে দেনা।”

মা বেল পুড়িয়ে শরবত বানান। বাবা খেতে ভালোবাসেন। যাদবচাচা নিশ্চয় ভালোবাসে না। কারণ মা কখনও চাচাকে শরবত দেন না। বরং শীতের দিনে মাঝেমধ্যে বেশি করে দুধ আর এলাচগুঁড়ো দিয়ে চা বানান। বাবা গিয়ে যাদবচাচাকে ডেকে আনেন। দুজনে মিলে বসে চা খায় আর গল্প করে। বাবার কাছেই লালি শুনেছে, যাদবচাচা নাকি খুব ভালো মিস্ত্রি। হাতের কাজে রীতিমত নাম-ডাক আছে। কারখানার সাহেব-সুবোরাও খাতির করে চলে।

এহেন যাদবচাচার বারান্দায় একদিন সকালবেলা একটা বাচ্চামত মেয়েকে বসে থাকতে দেখে লালি তো অবাক। তার থেকে সামান্য একটু ছোট হবে হয়ত মেয়েটা। রোগাসোগা চেহারা। মাথার ঢেউ খেলানো চুলগুলোতে একটা বেণী বেঁধে নিচে একটা লাল ফিতের ফুল। তবে বেণীটা সম্ভবত আগের দিন রাতে বাঁধা হয়েছে। তাই আলগা হয়ে গিয়ে দুপাশ থেকে চুল বেরিয়ে পড়েছে। চোখেমুখে সকালের আলোয় একদম অচেনা একটা জায়গাকে দেখার বিস্ময়।

লালিকে দেখেই মেয়েটার চোখদুটো চকচক করে ওঠে, তারপরেই ফিক্ করে হেসে দেয়। লালিও অমনি এক ভোঁ দৌড়ে সোজা মায়ের কাছে রান্নাঘরে, “মা মা, যাদবচাচার বাড়িতে একটা মেয়ে এসেছে। বারান্দায় বসে আছে।”

লালির কথা শুনে মা একটু আশ্চর্য হয়ে তাকান। রান্নাঘরেরই একপাশে চেয়ারে বসে বাবা চা খাচ্ছিলেন। কাপটা জানলার তাকে নামিয়ে রেখে বলেন, “হতে পারে। যাদবলাল তো বাড়ি গেছিল। হয়তো মেয়েকে নিয়ে এসেছে। কত বড় রে মেয়েটা?”

“এই আমার মতই…. না না আমার থেকে একটু ছোট হবে….”

“ওঁর তো শুনেছি তিন মেয়ে। এটা তাহলে বোধহয় ছোটটা….”

কিছুক্ষণের মধ্যেই মায়ের কাছে যাবতীয় বৃত্তান্ত জেনে ফেলে লালি। মেয়েটার নাম মটরু। যাদবচাচার ছোট মেয়ে। বয়স বছর দশেক মানে লালির থেকে একটু ছোট। যাদবচাচার নাকি নিজে রান্না করে খেতে অসুবিধা হচ্ছে। তাই দেশে গিয়ে মেয়েকে নিয়ে এসেছেন।

“ওইটুকু মেয়ে নিজে নিজে রান্নাবান্না, বাসনমাজা সব করবে কী করে গো ? ওদের তো আর কোনও কাজের লোকও নেই। তাছাড়া ওর বাবার তো কখনও সখনও নাইট-ডিউটিও পড়ে। তখন মেয়েটা থাকবে কোথায়?”

যাদবচাচার কাণ্ডকারখানা দেখে মা দুশ্চিন্তায় পড়লেও কার্যকালে কিন্তু দেখা গেল, মটরু বেশ কাজের মেয়ে। অন্তত বাপ-বেটির মত রান্না সে করতে পারে। রান্নার পদ অবশ্য বেশি নয়। রুটির সঙ্গে ডাল আর একটা ভাজি। ভৈঁসা ঘি বয়ামে ভরা থাকে। তাই একটু মাখিয়ে দেওয়া। তারপর বাসনক’টা ধুয়ে ফেলা। সরকারি চুল্লায় কয়লা ঠেসে মুখ বন্ধ করে রাখলে রোজ রোজ আগুন দেওয়ারও দরকার পড়ে না। তবে রান্না আর বাসনক’টা ধুয়ে রাখা ছাড়া আর কোনও কাজ মটরু করে না। ঘরে ধুলো জমে। ছাদ থেকে ঝুল নেমে আসে নাকের ডগায়। তাতে তার কিছু যায় আসে না। সে আপনমনে বাগানে ঘুরে বেড়ায়। মোড়ের মাথার গুমটি দোকান থেকে চুরান কিনে এনে মনোযোগ দিয়ে বসে বসে চাটে আর অপেক্ষা করে কতক্ষণে লালি স্কুল থেকে ফিরবে।

লালির সঙ্গে দারুণ ভাব হয়ে গেছে মটরুয়ার। যদিও ওর নাম মটরু কিন্তু যাদবচাচা যেহেতু মটরুয়া বলে ডাকে, তাই লালিও ওকে মটরুয়াই বলে। স্কুল থেকে ফিরে, খাওয়া-দাওয়া সেরে লালি বাগানে বেরোলেই মটরুয়া চলে আসে দরজার হুড়কোটা টেনে দিয়ে। তারপর চলে নানারকম খেলা। রাস্তায় গোল, চৌকো নানারকম ঘর কেটে কিৎ কিৎ, ডাংগুলি, লাল লাঠি কিংবা নিদেন পক্ষে স্কিপিং দড়ি নিয়ে লাফানো। সব খেলাতেই মটরুয়ার দারুণ উত্সাহ। আগের বছর জন্মদিনে বাবা ওদের দুবোনকে দুটো ব্যাডমিন্টন রাকেট কিনে দিয়েছিলেন। মটরুয়া ব্যাডমিন্টনটা শিখে নেওয়ার পর দারুণ খেলা জমে। মাঝেমাঝে মিলি এসে ঝামেলা করে অবশ্য। কারণ একটা রাকেট তো তার। তাই তাকেও খেলায় নিতে হবে। তখন চোখে চোখে ইশারা করে  মটরুয়া কিংবা লালির মধ্যে কেউ একজন কিছুক্ষণের জন্য মিলিকে র‍্যাকেটটা দিয়ে দুধুভাতু করে খেলতে দেয়।

এক একদিন আবার খেলা তেমন জমে না। সেদিন দুই বন্ধুতে বসে বসে গল্প করে। লালির তো গল্প অনেক। স্কুল, স্কুলের বন্ধু আর দিদিমণিদের গল্প। মামাবাড়ি আর ঠাকমার বাড়ি যাওয়ার গল্প। মটরুয়ার গল্পের অবশ্য স্থান একটাই, আরা জেলায় তাদের পিলাপাতি গাঁও। তবে বৈচিত্র অনেক। লালির ভারি ভালো লাগে মটরুয়ার কাছে তাদের গাঁওয়ের গল্প শুনতে। সেখানে নাকি তাদের এই রোলিং মিল কলোনির মত ইঁট-সিমেন্টের বাড়ি হয় না। মাটির বাড়ি। মোটা মোটা দেওয়াল। ভিতরটা নাকি গরমির দিনেও ঠাণ্ডা থাকে। মটরুয়ারদের বাড়ির সামনে মস্ত উঠোন। রোজ তার মা আর দিদি মিলে সেটাকে পরিষ্কার করে মুছে রাখে। সেই উঠোনে একটা খাটিয়া পেতে বসে থাকে মটরুয়ার দাদি । খাটিয়ায় বসে বসেই সারা সংসারের ওপর কড়া নজর রাখে । আর দাওয়ায় যে বিশাল নিমগাছটা আছে, তার ফল মাটিতে পড়লেই সেগুলো কুড়িয়ে কুড়িয়ে জড়ো করে । ওই নিমফল পিষে তেল বের করা হয়। নিমের তেল নাকি শরীরের পক্ষে খুব ভালো। শীতের দিনে ওই দাওয়াতেই বসে রোদে পিঠ দিয়ে ভাত খাওয়া হয়। গরমকালে খাটিয়া পেতে শোয়া।

মটরুয়াদের ঘরের সঙ্গে লাগোয়া সবজি ক্ষেত। সেখানে ভিন্ডি, বেগুন হয়। মাচা বেঁধে ধুঁধুলের লতা ওঠানো থাকে। এক কোনে একটা মস্ত ইঁদারা আছে। শুখার দিনে সারা গাঁওয়ের মানুষ মটরুয়াদের ইঁদারা থেকে জল নিতে আসে। ওদের ইঁদারার জল নাকি কখনও শুকোয় না। রাতে ঘুমের মধ্যেও নাকি মটরু ইঁদারা থেকে জল তোলার ক্যাঁচকোঁচ শব্দ শুনতে পায়। মা মাঝে মাঝে রাগ করে কিন্তু দাদি নাকি বলে দিয়েছে জল নিতে কাউকে বারণ করা চলবে না।

বাপু কারখানায় কাজ করে টাকা পাঠায়। তাই গাঁওয়ে জমি-জিরেত আছে । গাই, ভঁইসও আছে। দাদি নিজে হাতে দুবেলা দুধ দোয়। অড়হড়ের ক্ষেত আছে মটরুদের। লম্বা লম্বা সরু গাছ। ক্ষেতের মধ্যে ঢুকে গেলে তাদের মত ছোট বাচ্চাদের খুঁজেই পাওয়া যায় না। গাছে যখন অড়হরের শুঁটি আসে তখন সেই কাঁচা অড়হড় খেতে খুব মিঠা। মটরু ক্ষেতে নেমে কোঁচড় ভরে অড়হড় তুলে আনত। দিদিরা বড় বলে ওদের যখন-তখন বাড়ি থেকে বেরোন মানা। তাই সেই কাঁচা অড়হড় বাড়ি এনে তিন বোনে মিলে খেত। অড়হড় পাকলেই কোথা থেকে উড়ে আসে ঝাঁকে ঝাঁকে টিয়াপাখি। সবুজ গা। টুকটুকে লাল ঠোঁট। টিয়াপাখি খুব ভালো লাগে মটরুর। এই রোলিং মিল কলোনিতে কোথাও টিয়াপাখি নেই দেখে ভারি আশ্চর্য লাগে তার। চারটে ব্লক দূরে কৃষ্ণাদিদিরা বাড়িতে টিয়াপাখি পোষে। মাঝে মাঝে গিয়ে সেই খাঁচার পাখিটাকেই দেখে আসে সে। মটরু মুখে না বললেও তার কথা শুনে লালি বুঝতে পারে গাঁওয়ের জন্য মন কেমন করে তার। মন কেমন করে মা আর দিদিদের জন্য।

মটরুর সঙ্গে লালির অতখানি ভাবসাব প্রতিমার খুব একটা পছন্দ হয় না। একে তো স্কুল-টুলের পাট নেই মেয়েটার। তার ওপর চিরকুট্টি নোংরা। রুক্ষ চুলে তেল-চিরুণি কিছুই পড়ে না। উকুনও থাকতে পারে। গায়ে সাবান দেওয়ার তো প্রশ্নই নেই। স্নানটাও রোজ ঠিকমত করে কিনা সন্দেহ। জামা-কাপড় ময়লা, ধুলোমাখা । সাধারণত দু-তিন মাসে একদিন যাদবলাল সোডা-সাবান দিয়ে নিজের আর মেয়ের জামা-কাপড় একসঙ্গে ফুটিয়ে দেয়। মটরু সেদিনটা পেনি পরেই ঘোরে। তারপর কয়েকদিন জামাটা একটু পরিষ্কার থাকলেও আবার যে কে সেই। কিন্তু লালিক এসব কথা এক কান দিয়ে শুনে অন্য কান দিয়ে বের করে দেয় । স্কুল থেকে ফিরে জামা-কাপড় ছাড়ারও তর নেই, মুখে দুটো গুঁজেই ভোঁ দৌড়।

লালির বাবাকেও বলে কোনও লাভ নেই। গম্ভীর মুখে সবকথা শুনবে ঠিকই। কিন্তু তারপর নির্ঘাৎ বলবেন, “আরে এগুলো কোনও চিন্তা করার ব্যাপারই নয়। সমবয়সী, তাই বন্ধুত্ব হয়েছে। দুজনে একসঙ্গে খেলছে। বন্ধু তো মানুষের অনেকরকমই থাকে…..”

প্রতিমা তাই গতবছরটা চুপচাপই ছিলেন। কিন্তু এবছর লালির হাফ-ইয়ার্লি পরীক্ষার রেজাল্টটা একটু বাড়াবাড়ি রকম খারাপ হওয়ায় আর মেনে নিতে পারলেন না, “পড়া নেই শোনা নেই সারাটা দিন শুধু টো-টো কোম্পানি। যখনই দেখছি মটরুর সঙ্গে খেলে বেড়াচ্ছে। খবরদার যদি আর বাড়ির বাইরে পা বাড়িয়েছ। স্কুল থেকে ফিরে খাওয়া-দাওয়া সেরেই পড়তে বসবে। নম্বর যা হয়েছে তাতে তো এবার আর নতুন ক্লাসে ওঠা হবে বলে মনে হচ্ছে না…..”

দীপকের খুব একটা ইচ্ছা ছিল না। তবু প্রতিমার তাড়নায় একজন প্রাইভেট টিউটরের ব্যবস্থাও হল। লালি স্কুল থেকে ফেরার একটু পরেই তিনি পড়াতে আসেন। তাই বিকেলে খেলা বন্ধ। ছুটির দিনগুলোকেও একেবারে নিশ্ছিদ্র রুটিনে মুড়ে দিয়েছেন প্রতিমা। হাতে মাত্র একটা মাস সময়। তারপরেই অ্যানুয়াল পরীক্ষা। ততদিন অন্তত মেয়ের ব্যাপারে কোনওরকম নাক গলানো চলবে না বলে কড়ার করে নিয়েছেন দীপককে দিয়ে।

বেচারা লালির শুকনো মুখটা দেখলে কষ্ট হয় দীপকের। কিন্তু তার থেকেও বেশি কষ্ট হয় মটরুকে দেখলে। লালির তো তবু স্কুল আছে, স্কুলের বন্ধু আছে, পড়াশোনা আছে। মটরুর তো কিছুই নেই। সারাদিন সে শুধু ছোট্ট বাগানটাতেই একলা ঘুরে বেড়ায়। মাঝে মাঝে দু-হাঁটুতে মুখ রেখে উদাস দৃষ্টিতে তাকিয়ে বসে থাকে। দীপক লক্ষ করেছেন, লালির স্কুল থেকে ফেরার সময় হলেই বাগানের গেটটার কাছে গিয়ে দাঁড়ায় মটরু। কিন্তু মায়ের ভয়ে লালি বেচারি বন্ধুকে একটু হাত নেড়েই ঘরে ঢুকে পড়ে।

অ্যানুয়াল পরীক্ষা বলে কথা। রাত্তিরে তাই আজকাল খাওয়া-দাওয়ার পরও পড়তে বসতে হয় লালিকে। দশটার ভোঁ বেজে যাওয়ার পরে যাদবলাল যখন এসে মটরুকে ডাকাডাকি করে, তখন বইয়ের পাতায় চোখ থাকলেও লালির কানদুটো যে সেদিকেই খাড়া হয়ে থাকে বুঝতে অসুবিধা হয় না বাবার।

প্রতিমা অবশ্য গম্ভীর মুখে উল বোনেন। তবে কেন জানি না রোজই ডাকাডাকিটা শুরু হলেই বোনা থামিয়ে একমনে ঘর গুণতে থাকেন। মটরুর ছিটকিনি খোলার শব্দটাই হলেই বোনার কাঁটা দুটো সচল হয় এবার। আর মিলি বাবার কোলের কাছ থেকে ঘুমো ঘুমো মুখটা তুলে বলে, “মটরুদিদি একলা একলা কী করে ঘুমোয় বাবা ? অন্ধকারে ভয় লাগে না ?”

কদিন ধরেই জব্বর ঠাণ্ডা পড়েছে। বিকেল হতে না হতেই রাস্তাঘাট শুনশান। এদিকে লালির পরীক্ষাও শুরু হয়ে গেছে। বাড়িতে তাই বেশ একটা গম্ভীর পরিবেশ। এরমধ্যে অফিসের কাজে দীপককে কয়েকদিনের জন্য বাইরে যেতে হয়েছিল। ফিরে এসে মনে হল প্রতিমা যেন একটু বেশিরকম চুপচাপ। কারণটা জানতে চাইলে চোখের ইশারায় চুপ করে থাকতে বললেন প্রতিমা। একটু পরে লালি পাশের ঘরে বই-খাতা নিয়ে বসে পড়লে নীচু গলায় বললেন, “মটরুটার খুব শরীর খারাপ। ভীষণ জ্বর। উঠতে পারছে না। এদিকে কারখানায় ব্রেকডাউন চলছে। তাই ওর বাবাকে ডিউটিতে যেতেই হচ্ছে।”

“সে কী ! তুমি জানলে কী করে?”

“কদিন ধরেই লক্ষ করছিলাম, মেয়েটাকে একেবারেই বাইরে দেখা যাচ্ছে না। তো সেদিন বেলপাতা পাড়তে গিয়ে মনে হল ঘর থেকে গোঁ গোঁ আওয়াজ আসছে। বারান্দায় উঠে দেখি দরজা খোলা। মটরু মাটিতে পড়ে আছে। খাটিয়াতেই শুয়ে ছিল। জ্বরের ঘোরে গড়িয়ে পড়ে গেছে। গা দেখি একেবারে পুড়ে যাচ্ছে।”

“ডাক্তারকে খবর দিয়েছিলে ?”

“ওর বাবাকে না জিজ্ঞাসা করে কী করে দিই বলো ? কোনওরকমে মেয়েটাকে তুলে শোয়ালাম। এই ঠাণ্ডায় একটা কাঁথা গায়ে দিয়েছে। বিছানাটা চিটচিটে ময়লা। দুর্গন্ধ বেরোচ্ছে। বাড়ি থেকে একগ্লাস দুধ আর ক্যালপল নিয়ে গিয়ে খাওয়ালাম। একটা কম্বলও দিয়ে এসেছি গায়ে চাপা দেওয়ার জন্য।”

কোনওরকমে বুকের মধ্যে চেপে রাখা নিঃশ্বাসটা ছেড়ে দীপক বললেন, “লালিকে কিছু বলোনি বুঝি?”

“না। বললেই বড্ড মনখারাপ হয়ে যাবে। আটকানোও যাবে না। কান্নাকাটি করবে। আর দুটো মোটে পরীক্ষা বাকি। কিন্তু তুমি যাদবলালকে বলো ছুটি নিতে। ওইটুকু বাচ্চা মেয়ে। অত জ্বর….বাড়িতে একলা থাকতে পারে ! হাসপাতালে দিতে বলো নাহলে…..”

গজগজ করতে থাকেন প্রতিমা। সেদিনও রাতে বেশ দেরি করেই ফেরে যাদবলাল। পায়ের শব্দে টের পান দীপক। তবে ডাকাডাকি শোনা যায় না। পরের দিন মটরুর বাবার সঙ্গে কথা বলে একটু বিরক্ত হয়েই বাড়ি এসে প্রতিমাকে বলেন, “এদের ব্যাপার-স্যাপার কিছু বুঝি না। ছুটি নাকি নিতে পারবে না। প্ল্যান্টে একটা নতুন অর্ডার এসেছে। সেটার কাজ চলছে। আরে বাবা, সাহেবকে তো বলতে হবে যে মেয়ের এরকম অসুখ। সেও বলবে না। এদিকে হাসপাতালে দিতেও রাজি নয়…….”

“মেয়েটা কেমন আছে দেখলে ?”

“বলল তো একটু ভালো আছে। জ্বরটা নাকি কমেছে। দেখে তো কিছু বুঝলাম না…..”

“আর বুঝেও কাজ নেই। আজ লালির অঙ্ক পরীক্ষাটা হয়ে যাক। কাল সকালেই আমি মেয়েটাকে এখানে নিয়ে চলে আসব……”

“সে কী গো ! লালির ইতিহাস পরীক্ষা তো এখনও বাকি…..”

“থাকুক গে। অমন বাপের ভরসায় রাখলে মরে যাবে তো মেয়েটা….ওসব পরীক্ষা আমাকে দেখাতে এস না…..”

হতবাক দীপককে প্রায় মুখ ঝামটা দিয়ে উঠে যান প্রতিমা। লালি খবরটা জেনে যায় রাতেই। মটরুদিদিকে বাড়িতে আনা হবে জেনে মিলিও বেজায় খুশি। দুই বোনেই ভোর থেকে উঠে ছটফট করছে। কিন্তু যাদবলাল রাতে অনেক দেরি করে ফিরেছে। তাই তার ঘুম থেকে ওঠার জন্য অপেক্ষা করছিলেন প্রতিমা। কিন্তু লালির তো অত দায় নেই। সে কোন সময় সুট্ করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেছে প্রতিমা কিংবা দীপক কেউই টের পাননি।

হঠাৎ মেয়ের চিত্কারে দুজনে ছুটে বেরিয়ে এসে অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে পড়েন। যাদবলালের কোয়ার্টারের বারান্দায় একটা বাচ্চা মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সেটাকে একেবারে মটরুর মতই দেখতে। কিন্তু তার চুলগুলো পরিষ্কার করে তেল দিয়ে দু-বিনুনিতে বাঁধা। নিচে লাল ফিতের ফুল। পরনে একটা ধপধপে কাচা জামা, সঙ্গে কমলা রঙের সোয়েটার। দু-চোখে আবার হালকা একটু কাজলের টান। প্রতিমাকে দেখে একগাল হেসে মেয়েটা বলে ওঠে,   “মাঈ আ গইলবা চাচি। বাপু নে তার ভেজা থা। বুখার সুনকর কালহি সামকো টিরেন মে আ গয়ী মেরে মাঈ।”

“মটরুয়াদিদির মা এসে গেছে, মটরুয়াদিদির মা এসে গেছে…..” দুহাতে তালি দিতে দিতে লাফাচ্ছে মিলি। প্রতিমা একটু মুচকি হেসে দীপকের দিকে তাকিয়ে বলেন, “যাক্, যাদবলাল তাহলে ব্যবস্থাটা ঠিকঠাকই করেছে। যাই গিয়ে মটরুয়ার মায়ের সঙ্গে একটু আলাপ করে আসি। লালি তুমি পড়তে বোসো, ইতিহাস পরীক্ষা বাকি আছে কিন্তু…..”

মেয়ের করুণ মুখের দিকে তাকিয়ে এবার আর নিজেকে সামলাতে না পেরে হো-হো করে হেসে ওঠেন লালির বাবা।

অলঙ্করণঃ অর্ণব চক্রবর্তী

জয়ঢাকের সমস্ত গল্পের লাইব্রেরি এই লিংকে

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Twitter picture

You are commenting using your Twitter account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s