রুচিস্মিতা ঘোষের আগের গল্প–বন্ধু
রঞ্জনের আজ কিছু কাজ ছিল। ঠিক কাজ নয়, বন্ধুর সঙ্গে দেখা করা। তপন থাকে গড়িয়াতে। দীর্ঘদিন পর দুই বন্ধুর সঙ্গে দেখা। আড্ডা মারতে মারতে বেশ রাত হয়ে গেল।
বাস থেকে নেমে সে দেখল, মানুষজন ব্যস্ত হয়ে ছোটাছুটি করছে। তবে কি কোনও গন্ডগোল? এদিক ওদিক তাকাল সে। কই, কোথাও কোনও গন্ডগোল নেই। এই যে মানুষের পায়ে এত ছলাৎ ছলাৎ, মুখে এদিকে ভয়ের লেশমাত্র নেই। বাস, ট্যাক্সি, অন্যান্য যানবাহন সব ঠিকঠাকই চলছে। সে ঠিক বুঝতে পারল না ব্যাপারটা কী, কিন্তু চারপাশের মানুষজনকে দেখে সে নিজের মধ্যেও কেমন একটা ছটফটানি টের পেল। তার মনে হল, তার মনের অতলে অনেকগুলো নাম না জানা পাখি এসে কিচকিচ শুরু করেছে।
রঞ্জন শান্ত প্রকৃতির, তার কোনও শত্রু-টত্রু নেই। এই ব্যস্ততা, উদ্বেগ তার ঠিক পছন্দ হল না। মা-র জন্য একটা ওষুধ কেনার ছিল। সে ভাবল আজই কিনবে, পরক্ষণেই ভাবল, কাল কিনলে কী হয়? তার এইসব ভাবনার মধ্যেই সে হঠাৎ দেখল চারদিক কেমন ফাঁকা হয়ে গেছে। বড়ো বড়ো দোকানগুলো সব বন্ধ হয়ে শহরটায় কেমন এক গ্রাম্য অন্ধকার নেমে এসেছে। রাস্তাঘাটে গাড়ি চলাচলও কমতে কমতে এখন আর তাদের দেখা যাচ্ছে না।
রঞ্জনের চশমা হঠাৎ ঝাপসা হয়ে গেল। এই বৃষ্টির দিনে তো কুয়াশা থাকার কথা নয়। রাস্তার আলোগুলোও মনে হয় পাতলা নাইলনের কাপড় দিয়ে কেউ ঢেকে দিয়েছে। সে চশমাটা খুলে রুমাল দিয়ে মুছে আবার চোখে পরে নিল। সে এবার আকাশের দিকে তাকাল। আকাশ কেমন ঘোলা রঙের। তারা দেখা যাচ্ছে না। হঠাৎই ঝমঝম করে বৃষ্টি নেমে এল। তার ব্যাগে একটি ছাতা নিশ্চয়ই আছে। কারণ, রঞ্জন ঘর থেকে বেরোবার সময় মা অবশ্যই দেখে নেয় তার ব্যাগে ছাতা আছে কি না। আর না থাকলে অত্যন্ত দ্রুততার সঙ্গে একটা ছাতা এনে তার ব্যাগে ভরে দেয়। সে ব্যাগে হাত ঢুকিয়ে দেখল ছাতাটা আছে। সে মাথার ওপর ছাতা খুলে ধরল।
তাহলে কি বৃষ্টির জন্য মানুষজন এত অস্থির হয়ে উঠেছিল? বৃষ্টির মাসে বৃষ্টি হবে, এ আর অস্বাভাবিক কী? রঞ্জন এই রহস্যের সমাধান করতে পারল না।
এখন বাস থেকে নেমে বাড়ি যাওয়ার পথে সে একদম একা। এটাও কি সম্ভব? সে একবার দাঁড়িয়ে চারদিক দেখে নিল। নাঃ! কেউ কোত্থাও নেই। এত অবাক লাগছে তার! কিন্তু আচমকাই সে দেখতে পেল, তার থেকে চার-পাঁচ হাত দূরে একজন লোক দাঁড়িয়ে আছে। আশ্চর্য ব্যাপার তো! কোথা থেকে এল লোকটা! সে তো তখন থেকে তার আশেপাশে কোনও লোকজন আছে কি না তাই দেখে চলেছে। সে তো কাউকে আসতে দেখেনি। তার খুব ইচ্ছে হল সে লোকটার খুব কাছে গিয়ে দেখে সে মানুষটাকে চেনে কি না! তাহলে গল্প করতে করতে যাওয়া যাবে। কিন্তু ছাতা দিয়ে লোকটা এমনভাবে তার মুখ ঢেকে রেখেছে যে, কিছুই দেখা যাচ্ছে না। রঞ্জনের স্বভাবের সেই অদম্য কৌতূহল তাকে পেয়ে বসল। সে লোকটার দিকে এগিয়ে গেল। লোকটা বোধহয় টের পেয়েছে। তখুনি কয়েক পা পিছিয়ে একটা ভাঙাবাড়ির বারান্দায় গিয়ে উঠল। এই ভাঙাবাড়ির মালিক কে রঞ্জন তা জানে না। অনেকদিন ধরে বাড়িটা এভাবেই পড়ে আছে। রঞ্জন একটু অবাক হল। লোকটা কি তাকে দেখে ভয় পেল? ভয় পাওয়ার মতো তো কিছু নেই। লোকটা এমন ভাব করছে যেন সে কিছুই দেখছে না। কিন্তু রঞ্জন আলবাত জানে লোকটাও তাকে লক্ষ করছে।
এ আবার কেমন অবস্থা! কলকাতা শহরে তো দাঙ্গা লাগেনি। ১৪৪ ধারাও জারি হয়নি। শুধু বৃষ্টির দিনে বৃষ্টি পড়ছে। তাই বলে একজন লোক আর একজন লোককে দেখে ভয় পাবে! লোকটা কি ভাবছে রঞ্জনের মতিগতি ভালো নয়? সে তাকে খুন করবে? অবাক হবার কিছুই নেই। ভাবতেই পারে। আজকাল খুনোখুনি তো লেগেই আছে। রঞ্জন ঘড়ি দেখল। রাত এগারোটা। এমন কিছু রাত নয়। তবে বৃষ্টি আর নির্জন পরিবেশ রাতটাকে আরও গভীর করে তুলেছে। সে ভাবল নিকুচি করেছে। লোকটা কে, জেনে তার কী হবে! সে বরং জোরে জোরে পা চালিয়ে বাড়ির দিকে হাঁটা দিল। পরক্ষণেই ভাবল, লোকটাকে একা ফেলে সে চলে যাবে!
বৃষ্টি এত জোরে পড়ছে যে রঞ্জন ভিজে চুপসে গেছে। তার হাতঘড়ির কাঁচটা ঝাপসা হয়ে গেছে। চারদিকের নির্জনতা যেন বরফের মত ভারী। অথচ রঞ্জন যেতে পারছে না। এক জটিল পরিস্থিতি তাকে আটকে রেখেছে। লোকটার কথা ভুলতে পারছে না। লোকটার কি ঘরদোর কিছু নেই? সারারাত ছাতা মাথায় এই ভাঙাবাড়িতে দাঁড়িয়ে থাকবে? নাকি লোকটার অন্য কোনও মতলব আছে? কারও আসার কথা তার সঙ্গে দেখা করার জন্য? অবৈধ কোনও লেনদেন?
রঞ্জন লোকটার সঙ্গে আলাপ করার জন্য কোনও অজুহাত খুঁজছিল। সে পায়ে পায়ে এগিয়ে গেল ভাঙাবাড়িটার দিকে। একটু দূর থেকেই বলল, “ও দাদা, আপনার হাতে কি ঘড়ি আছে? এখন ক’টা বাজে বলতে পারেন?”
লোকটা তার হাতটা সামনে মেলে ধরল। সময় দেখে বলল, “সাড়ে এগারোটা।” বলেই চুপ করে গেল। রঞ্জন ভাবল, আচ্ছা লোক তো! রঞ্জনের মনে লোকটার সম্পর্কে এত প্রশ্ন জাগছে আর রঞ্জন সম্বন্ধে কি লোকটার মনে একটাও প্রশ্ন নেই? কিন্তু রঞ্জন নাছোড়বান্দা। জোর করে জিজ্ঞেস করে বসল, “আপনি যাবেন কোথায়?”
লোকটা প্রথমে জবাব দিল না। তারপর বলল, “নারকেল বাগান।”
“সে কি? সে তো অনেক দূর! যানবাহনও তো চলছে না। এতটা পথ আপনি হেঁটে হেঁটেই যাবেন?”
ঠিক সেই সময়ই আকাশ ফেটে বিদ্যুৎসহ এক ভয়ানক শব্দে বাজ পড়ল। রঞ্জন চমকে উঠল আর বিদ্যুতের সেই আলোর ঝলকানিতে দেখে ফেলল লোকটার মুখ। পুরুষমানুষের মুখে এমন মেয়েলি ভাব কেন?
এবার লোকটা নিজের থেকেই বলল রঞ্জনকে, “চলুন, আপনাকে একটু এগিয়ে দিই।”
“আপনার নাম?” রঞ্জন জিজ্ঞেস করল।
লোকটা হঠাৎ বিষম খেল। তারপর কাশতে থাকল। কাশি থামলে বলল, “আমার নাম মানস।”
এরপর তারা দু’জন হাঁটতে থাকল। বৃষ্টির জোর বেশ ভালোই। সঙ্গে হাওয়াও আছে। ভিজিয়ে দিচ্ছে দু’জনকে।
রঞ্জন বলল, “বৃষ্টি যে থামছেই না। মা-র জন্য একটা ওষুধ কেনার ছিল। আজ আর হল না।”
লোকটা জবাবে কিছু বলল না। আবার সেই নীরবতা। অসহ্য লাগছে রঞ্জনের। অদ্ভুত তো লোকটা! প্রথমে তাকে দেখে ভয় পেল। আবার নিজেই যেচে তাকে এগিয়ে দিতে চাইল। এখন আবার কোনও কথাই বলছে না।
এদিকে রাত বাড়ছে। দু’জনেই ভিজছে। একসঙ্গে দু’জন লোক হাঁটছে অথচ কেউ কাউকে চেনে না। এই বৃষ্টি আর ঠান্ডার মধ্যে আর একটি মানুষের সান্নিধ্যে রঞ্জন কেমন যেন এক উষ্ণতা অনুভব করছে। এদিকে বৃষ্টির জলে জুতো ভারী হয়ে গেছে। প্যান্টের নিচের দিকটাও ভিজে ভারী। ওরা দু’জন ছাড়া রাস্তায় কোনও লোক চোখে পড়ছে না। নিঃসঙ্গ ভিজছে সব দোকানঘাট, ঘরবাড়ি। রাস্তার হলুদ আলোগুলো বৃষ্টিতে ধুয়ে যাচ্ছে।
হঠাৎ লোকটা দাঁড়িয়ে পড়ল। বলল, “এবার যেতে পারবেন তো?”
রঞ্জন বলল, “আর আপনি? নারকেল বাগান। সে তো এখনও অনেক দূর!”
রঞ্জনকে অবাক করে দিয়ে লোকটা বলে উঠল, “আমি তোকে মিথ্যে বলেছি রঞ্জন। আমি মানসীদি। মনে আছে তোর? দাসবাবুদের পুকুরে ডুবে মারা গিয়েছিলাম। আমি নারকেল বাগানে থাকি না। থাকি ওই ভাঙা পোড়ো বাড়িটায়। বলেই সে উলটোদিকে হাঁটা দিল।”
রঞ্জনের সমস্ত শরীর কাঁপছে ভয়ে আর উত্তেজনায়। দাসবাবুদের পুকুরের থেকে মানসীদির মৃতদেহ ওরা কয়েকজন ছেলে মিলে উদ্ধার করেছিল।
মানসীদি চলে যাওয়ার পর হঠাৎ বৃষ্টি থেমে গেল। আশেপাশের বাড়িগুলোতে এখন আলো দেখা যাচ্ছে। তার মানে এখনও লোকজন জেগে আছে। সে স্তম্ভিত। একটু আগে ঘটে যাওয়া সব ঘটনার কোনও ব্যাখ্যা খুঁজে পাচ্ছে না। তার পা সরছে না। সে দেখল দূর থেকে একটা মানুষ তারই দিকে হেঁটে আসছে। হাঁটার ধরনটা দেখেই রঞ্জন বুঝতে পারল, এত রাত হয়ে গেছে বলে তার বাবা তাকে খুঁজতে বেরিয়েছে।
গ্রাফিক্স্ ইন্দ্রশেখর