অর্ক পৈতন্ডীর আগের গল্প- পূর্বজন্ম |
আজ যে গল্পটা লিখতে বসেছি সেটা নিছক গল্প নয়। আমার জীবনের একটা সত্যি ঘটনা। তাই গল্পটার নামকরণ কী করব সে বিষয়ে অনেক ভেবেছি। অবশেষে যে নামটা দিলাম সেটা যথার্থ হল কি না সে বিচারের ভার পাঠকেরই রইল।
আমি তখন নতুন চাকরিতে ঢুকেছি। খুব বেশিদিন হয়নি। আগে নিয়মিত খেলাধুলো করতাম। চাকরি পাওয়ার পর কিছুটা সময়ের অভাবে আর কিছুটা সময়ের অভাবে আর কিছুটা আলসেমি করে খেলা ছেড়ে দিয়েছিলাম। ফলে শরীরের ওজনও লাগামছাড়া ভাবে বাড়তে শুরু করল। পুরোনো জামাকাপড় আর আঁটে না! সে এক যা-তা অবস্থা। বুঝলাম, আবার খেলাধুলো শুরু করতে হবে।
আমার দুই বন্ধু সোহম আর পিন্টু সকালবেলা কুমিরডাঙার মাঠে ফুটবল প্র্যাকটিশ করে। চাকরি পাওয়ার আগে আমিও খেলতাম ওদের সঙ্গে। একদিন সকালবেলা উঠে ট্রাকস্যুট গায়ে গলিয়ে পুরোনো দিনগুলোর মতোই আমি হাজির হলাম কুমিরডাঙার মাঠে। মাঠটা আমাদের পাড়ারই লাগোয়া। সেখানে এই সাত সকালেও বেশ কিছু শরীর সচেতন মানুষ বিচিত্র ভঙ্গিমায় কসরত করছেন তাদের মধ্যে থেকে সোহম আর পিন্টু আমাকে দেখে হইহই করে এগিয়ে এল। সোহম বলল, “কুঁড়ের বাদশা! এলি তাহলে! চল চল। আগে মাঠটা চারপাক দৌড়ো তারপর ফ্রি-হ্যান্ড আর ফুটবল।” পিন্টু আমার পেটে টোকা মেরে বলল, “চিন্তা করিস না গুরু। তোর ভুঁড়ি আমরা দুই সপ্তাহে সরু করে দেব। চল, দৌ শুরু কর।”
অতঃপর দৌড় শুরু হল। আমার ভুঁড়ি সরু করার সাধু উদ্দেশ্যে আমার দুই বন্ধু আমাকে বগলদাবা করে মাঠময় চরকি পাক দিতে শুরু করল। এতদিনের অনভ্যাস। তার উপর মাঠটাও বেশ বড়। দু’পাক দিতেই আমি গলদঘর্ম হয়ে গেলাম।
ওরা হাসতে হাসতে বলল, “কী রে! এতেই দম ফুরিয়ে গেল? এখনো যে দু’পাক দৌড়ে বাকি রয়েছে।”
আমি কপালের ঘাম মুছে বললাম, “মাঠের এরিয়াটা যেন বেড়েছে মনে হচ্ছে?”
সোহম চোখ পাকিয়ে বলল, “মাঠের এরিয়া বাড়েনি, তোর ওজন বেড়েছে। চল, চল, দৌড়ো।” বলে আমাকে ফের বগলদাবা করে আবার দ্বিগুন উদ্যমে দৌড় শুরু করল।
ফ্রি-হ্যান্ড হয়ে গেলে পিন্টু বলল, “তোর অনারে আজ এই অবধিই থাকল। ফুটবল না হয় কাল খেলব।” ধুলোমাখা ফুটবলটা তর্জনীর উপর ঘোরাতে ঘোরাতে সোহম বলল, “চল তাহলে শচীনদার দোকানে বসি।”
মাঠের দক্ষিণে যে চায়ের দোকানটার উনুনে সবেমাত্র অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে আমরা তার দিকে এগোলাম।
এই সাতসকালে দোকান প্রায় ফাঁকা। দোকানের বাইরে বেঞ্চে একজন প্রৌঢ় বসে আছেন। এই গরমেও গায়ে তাঁর চাদর জড়ানো। আনমনা হয়ে সম্ভবত চায়ের গেলাসটির জন্য অপেক্ষা করছেন।
ওঁকে দূর থেকে দেখতে পেয়েই সোহম বলল, “এই রে! গুলকাকু যে দেখছি আজ তাড়াতাড়িই চলে এসেছেন।”
আমি অবাক হয়ে জিগ্যেস করলাম, “গুলকাকু? গুলকাকু আবার কে?”
পিন্টু ভ্রুভঙ্গি করে বলল, “গুলকাকু বড় সাংঘাতিক লোক। রোজ সকালে এখানে চা খেতে আসেন। চা খান আর আমাদের পেলে এন্তার গুল ঝাড়েন। উনি নাকি সমস্ত পৃথিবী চষে বেড়িয়েছেন। আন্দামানে জারোয়াদের সঙ্গে কিত্-কিত্ খেলেছেন, হিমালয়ে ইয়েতি শিকার করেছেন।”
আমি ঘাবড়ে গিয়ে বললাম, “তাই নাকি? সত্যি?”
সোহম হেসে উঠল, “তুই কি পাগল হয়েছিস? পিন্টু হয়ত একটু বাড়িয়েই বলল মজা করে, কিন্তু ওঁর গল্পগুলো এ’রকমই প্রায়। আর সেজন্যই তো আমরা নাম দিয়েছি গুলকাকু।”
আমি মনে মনে হাসলাম। গুলকাকু! বেশ মজার নাম দিয়েছে তো সোহমরা। আমার বন্ধুগুলো এই বয়সেও দুষ্টুমি করা ছাড়তে পারল না।
দোকানের সামনে পৌঁছে সোহম বলল, “এ কী কাকু, এই গরমেও চাদর?”
প্রৌঢ়, মানে সোহমদের গুলকাকু গায়ের চাদরটা আরো ভালো করে জড়িয়ে নিয়ে বললেন, “তোমাদের বয়স কি আর আমার আছে কি ভাই? একসময় লেদারের জ্যাকেট গায়ে দিয়ে সাইবেরিয়ায় ঘুরে বেড়িয়েছি। কিচ্ছু হয়নি। তখন রক্ত ফুটত টগবগ করে।”
পিন্টু আমার দিকে তাকিয়ে চোখ টিপল। মানে, এইবার শুরু হল গুল। সোহম খোঁচাল, “সাইবেরিয়া কেন গিয়েছিলেন, কাকু?”
“কাজের জন্য তো অনেক জায়গায় যেতে হত। মেরিন ইঞ্জিনিয়ারদের কি এক জায়গায় থাকার জো আছে? তবে সাইবেরিয়া বেড়াতেই গিয়েছিলাম। বেড়ানোর নেশাও খুব ছিল তো।”
গুলকাকু মৃদু হেসে কথা শেষ করতেই পিন্টু আরেকটা প্রশ্ন ছুঁড়ে দিল। বলল, “সাইবেরিয়ায় শুনলাম নাকি ম্যামথের ফসিল পাওয়া গেছে। আপনিও সে’রকম কিছু দেখেছেন নাকি?”
গুলকাকু নিজের খোঁচা খোঁচা দাড়িওয়ালা গালে হাতে বুলিয়ে বললেন, “ম্যামথ-ট্যামথ দেখিনি। তবে হাতি বিস্তর দেখেছি। সাইবেরিয়ায় নয় আফ্রিকায়। কেনিয়ার জঙ্গলে একবার হাতির পালের মুখোমুখি পড়ে গিয়েছিলাম। ভাগ্য ভাল বলে বেঁচে ফিরেছি।”
পিন্টু বলল, “তা একটা হাতির বাচ্চা-টাচ্চা ধরে আনলে পারতেন। পুষতেন।”
আমি আর সোহম খুক খুক হেসে উঠলাম। কিন্তু গুলকাকু পিন্টুর রসিকতা যেন বুঝতেই পারলেন না। বললেন, “ওরকমভাবে ধরে আনা যায় নাকি? আচ্ছা বুদ্ধি তো তোমাদের! তাছাড়া জেনে রাখো আফ্রিকান হাতি পোষ মানে না। ধরে রাখলে না খেয়ে খেয়ে উপোস করেই মরে যায়।”
গুলকাকু একটু থেমে আমাদের উপর চোখ বুলিয়ে বলতে শুরু করলেন, “হাতি আনিনি ঠিকই, তবে কেনিয়ার এক উপজাতি গ্রাম থেকে মাসাই যোদ্ধার মূর্তি খোদাই করা একটা হাতির দাঁত এনেছিলাম।এত অপূর্ব জিনিস তোমরা কখনো দেখনি।”
পিন্টু বলল, “আমি কখনো হাতির দাঁতই দেখিনি। তাহলে তো একদিন আপনার বাড়ি যেতেই হবে দেখছি।”
পিন্টুর কথা শুনে গুলকাকু মুখ দিয়ে একটা আক্ষেপসূচক শব্দ বের করে বললেন, “ওটাই তো মুশকিল। আমার বাড়িটা যে বড্ড ছোট। একটাই মোটে ঘর। আমার স্ত্রীও খুবই অসুস্থ। ঐ ঘরেই শয্যাশায়ী। ঐ রুগির বাড়িতে আর তোমাদের কী করে আসতে বলি বল?”
পিন্টু আমার কানে কানে বলল, “বাড়ি যাওয়ার কথা বললেই এড়িয়ে যায়। না হলে গুলগুলো সব ধরা পড়ে যাবে যে!”
সোহম বলল, “ হাতির দাঁতটা তাহলে এখানেই আনুন না একদিন।”
গুলকাকু আঁৎকে উঠলেন, “এই বুড়ো মানুষটাকে শেষে জেল খাটাতে চাও নাকি? জানো না, ওসব জিনিস এখন বে-আইনি? দেখতে পেলেই পুলিশ ধরবে।”
গুলকাকু চা খেয়ে বাড়ির পথ ধরলেন। পিন্টু বলল, “কী চালাক লোক দেখেছিস। কিছুতেই ফাঁদে পা দেন না।”
তবে পিন্টুরা যা-ই বলুক না কেন আমার কিন্তু গুলকাকুকে বেশ ভালোই লাগল। গুলবাজরা মজার মানুষ হন। ওঁদের কল্পনাশক্তিও প্রবল হয়। আমাদের গুলকাকু তো আবার ওঁর মনগড়া, বানানো গল্পগুলোর সুরক্ষার জন্যও অনেকরকম গল্প বানান।
পরদিন সকালেও একই কাণ্ড। মাঠ থেকে ফেরার সময় শচীনদার দোকানে ঢুকতেই গুলকাকু আমাদের পাকড়াও করলেন বললেন, “কী হে তিনমূর্তি, তোমারা তো দেখছি সাঁতার কেটে এসেছ।”
সত্যিই আমরা দারুণ ঘেমে ছিলাম। ফুটবল খেলাটা আজ জমেছিল খুব। পিন্টু বলল, “যা বলেছেন কাকু। এত গরম লাগছে যেন মনে হচ্ছে আগ্নেয়গিরির মধ্যে বসে আছি।”
অমনি কাকুর চোখ ছোটোছোটো হয়ে এল। বললেন, “আমি দেখেছি।”
সোহম আমার পায়ে চিমটি কাটল। অর্থাৎ গুল আরম্ভ হতে চলেছে। গুলকাকু বলতে শুরু করলেন, “সাউথ অ্যামেরিকায় একটা আগ্নেয়গিরির চূড়ায় ওঠার অভিজ্ঞতা হয়েছিল।”
পিন্টু ফুট কাটল, “লাভা আনতে গিয়েছিলেন বুঝি বোতলে ভরে?”
আগেই দেখেছি গুলকাকু রসিকতা বোঝন কম। এটাও বুঝলেন না। বললেন, “আরে ভাই, লাভা কি সবসময় তরল অবস্থায় পাওয়া যায়? সে তো অগ্ন্যুৎপাতের সময় আগ্নেয়গিরির ভেতর থেকে বেরিয়ে আসে। আমি যখন গিয়েছিলাম তখন আগ্নেয়গিরি শান্ত। আর জ্বালামুখে একটা হ্রদ তৈরি হয়েছে। আমাদের দলের একজন সায়েন্টিস্ট ঐ জলের স্যাম্পেল নিয়ে টেস্ট করেছিলেন। খুব সালফার ছিল ঐ জলে। আমি সেবার আগ্নেয়গিরির চূড়ার আশপাশ থেকে কিছু পাথর এনেছিলাম। ওরকম পাথর তোমারা কখনো দেখনি।”
সোহম বলল, “তাহলে একদিন আপনার বাড়িতে…।”
সোহমের কথা শেষ হওয়ার আগেই গুলকাকু চা শেষ করে বাড়ির পথে হাঁটা দিলেন।
এরকমই চলছিল কয়েকমাস ধরে। সকালে মাঠে কসরত আর তারপর শচীনদার দোকান থেকে চা সহযোগে গুলককুর গপ্পো। আচমকা একদিন আমরা গুলকাকুকে বেকায়দায় ফেলার সুযোগ পেয়ে গেলাম।
সেদিন মাঠ থেকে শচীনদার দোকানে যেতেই গুলকাকু বললেন, “গুটেন মর্গেন।”
আমরা মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝলাম না। পিন্টু চাপা গলায় বলল, “মাথাটা বিগড়েছে মনে হচ্ছে।”
গুলকাকু মিটিমিটি হাসলেন, “এর মানেটা জানো না বুঝি?”
আমরা মাথা নাড়লাম। না। জানি না। গুলকাকু বললেন, “জার্মান ভাষায় গুড মর্নিংকে বলে গুটেন মর্গেন। অর্থাৎ আমি তোমাদের সুপ্রভাত জানালাম।”
সোহম বলল, “আপনি জার্মান ভাষা জানেন?”
“জানি তো।” গুলকাকু বললেন, “আমি আরো সাতটা ভাষা জানি। তাছাড়া আমার ছেলেও জার্মানিতে থাকে।”
“তাই নাকি?” আমরা অবাক, “বলেননি তো আগে! কী করে আপনার ছেলে?” আমরা আশা করছিলাম এবার গপ্পো আরম্ভ করবে, কিন্তু না। গুলকাকু খুব নির্লিপ্ত উত্তর দিলেন, “ডাক্তার।”
হঠাৎ আমার মাথায় একটা দুষ্টুবুদ্ধি খেলে গেল। গুলকাকুকে একটু প্যাঁচে ফেললে কেমন হয়? বললাম, “আপনার ছেলে আপনাকে চিঠিপত্র লেখে নিশ্চয়ই?”
এই অদ্ভুত প্রশ্ন শুনে গুলকাকু থতমত, “কেন বল তো?”
“না মানে…তাহলে আপনি আমার একটা উপকার করতে পারবেন। আমি বললাম।
গুলকাকু আরো অবাক। বললেন, “উপকার?” আড়চোখে তাকিয়ে দেখলাম আমার বন্ধুরাও কম অবাক হয়নি।
আমি বন্ধুদের দিকে চোখ টিপে বলতে শুরু করলাম, “আসলে আমি ডাকটকিট মানে স্ট্যাম্প কালেকশন করি। বলতে পারেন এটাই আমার একমাত্র নেশা। কত দেশের যে স্ট্যাম্প সংগ্রহ করেছি তার ঠিক নেই। কেবল জার্মানির স্ট্যাম্পই আজ অবধি জোগাড় করতে পারিনি। তাই আপনার ছেলে জার্মানিতে থাকে শুনে একটা আশা জাগল মনে। আপনার ছেলে নিশ্চয়ই আপনাকে চিঠি লেখে জার্মানি থেকে। তার থেকে একটা- দুটো স্ট্যাম্প যদি আপনি আমাকে দেন তো খুব উপকার হয়।”
এই ঘটনাটা যে সময়ের তখন বাজারে মোবাইল ফোন আসেনি। ঘরে ঘরে এত টেলিফোনও থাকত না। ই-মেল তো অনেক দূরের বস্তু। সেই সময় চিঠিপত্রের কোন বিকল্প ছিল না। ডাকবিভাগের সাম্রাজ্য তখন মধ্যগগনে। সুতরাং গুলকাকু কোনও অজুহাত খাড়া করতে পারলেন না। অস্বস্তিতে পড়লেন। সেদিন আড্ডা জমল না। গুলকাকু চুপচাপ চা খেয়ে তাড়াতাড়ি চলে গেলেন।
পিন্টু আর সোহম এতক্ষণ অবাক মুখে গোল গোল চোখ করে আমাকে দেখছিল। গুলকাকু চলে গেলে আমি ওদের সব বুঝিয়ে বললাম। ওরা তো শুনে হেসেই খুন। পিন্টু বলল, “গুলকাকু কাল এলে আবার চেপে ধরব। হয় জার্মানির স্ট্যাম্প দিতে হবে নয়তো স্বীকার করতে হবে যে ওঁর গপ্পোগুলো সব মিথ্যে।”
গুলকাকু আমাদের ফন্দিটা হয়তো আঁচ করেছিলেন। পরদিন থেকে আমরা আর ওঁর দেখা পেলাম না। বেশ কিছুদিন কেটে গেল। এবার আমাদের খারাপ লাগল। বয়স্ক মানুষটার সঙ্গে এতটা মজা না করলেও হত। বানয়ে বানিয়ে গল্প বললেও তো মানুষ হিসেবে উনি খারাপ ছিলেন না। বাড়ি গিয়ে দেখা করারও উপায় নেই। গুলকাকুর বাড়ির ঠিকানা আমরা কেউ জানি না। এমনকি অবাক ব্যাপার, আমরা কেউ এখনো গুলকাকুর ভালো নামটাও জানি না।
পৃথিবীতে, বিশেষ করে হয়তো মানুষের মনে কোনও ব্যাপারই বেশিদিন স্থায়ী হয় না। গুলকাকুও তার ব্যতিক্রম হলেন না। ধীরে ধীরে আমাদের মন থকে উনি পুরোপুরি মুছে গেলেন। গুলকাকুর অধ্যায়টা আমাদের জীবনে এখানেই শেষ হয়ে যেতে পারত। কিন্তু হল না। ব্রহ্মাণ্ডের সেই অদৃশ্য গল্পকার হয়তো শেষটা অন্যরকমই ভেবেছিলেন।
এরপর পাঁচটা বছর কেটে গেছে। অফিসে কাজের চাপ বেড়েছে। সোহম আর পিন্টুও চাকরি পেয়ে গেছে। সকালে আর ব্যায়াম করতে যাওয়া হয় না। পিন্টুই ছিল ফুটবল খেলায় সবচেয়ে বেশী উৎসাহী। ও চাকরি নিয়ে জামশেদপুর চলে গেছে। সুতরাং আমাদের তিন-জনের টিমটাই আর নেই। সোহমও আজকাল দারুণ মুটিয়েছে খেলা ছেড়ে দিয়ে।
একদিন হঠাৎ আমার জামাইবাবু আমাকে খবর পাঠালেন যে উনি বদলি হয়ে আমাদের শহরে মানে বোলপুরে আসছেন। আমি যেন তার জন্য একটা বাড়ি দেখে রাখি। উনি কিনবেন। সেই কথা শুনে আমি পরিচিতদের একটু খোঁজখবর নিতে বললাম। প্রথম খবরটা সোহমই আনল। বাগানপাড়ায় একটা একতলা বাড়ি বিক্রি আছে। জামাইবাবু ওদিক থেকে ক্রমাগত তাড়া দিচ্ছেন, তাই ঠিক করলাম দু-এক দিনের ভেতরই গিয়ে বাড়িটা দেখে আসব।
সেইমত একদিন আমি আর সোহম হাজির হলাম বাড়ি দেখতে। একতলা বাড়ি, রঙচটা। কোনও এককালে রঙ করানো হয়েছিল হয়তো। কিন্তু এই সন্ধেবেলা দেখে বুঝতে পারলাম না যে সেটা সবুজ না নীল। তবে বাড়ির সামনের বাগানটা খুব ভাল লাগল। বাড়ির ভেতরে বিশেষ দেখার কিছু নেই। একটা ঘর, সঙ্গে বাথরুম আর রান্নাঘর। দক্ষিণে একচিলতে বারান্দা। যে ভদ্রলোক আমাকে বাড়িটা দেখাচ্ছিলেন তার নাম সুকোমল রায়চৌধুরী। বাড়িটা ওঁর দাদার ছিল। দাদা কিছুদিন হল মারা গেছেন। বর্তমানে উনিই মালিক। আমি জিগ্যেস করলাম, “কিছু মনে করবেন না, একটা কথা জিগ্যেস করি। আপনার দাদা কি নিঃসন্তান ছিলেন?”
প্রশ্নটা শুনে সুকোমলবাবু কিছুক্ষন চুপ করে থাকলেন তারপর একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে বললেন, “নিঃসন্তান ছিলেন না। এক ছেলে আছে। তবে থেকেও নেই। বিদেশে থাকে। আসত না, এমনকি চিঠিপত্রও লিখত না। বাবা-মার সঙ্গে কোনও যোগাযোগই রাখত না।”
“সেকী?” আমরা অবাক। এরকম উত্তর আশা করিনি।
সুকোমলবাবু চশমার কাচ মুছতে মুছতে বললেন, “দাদা কত খরচ করে ছেলেকে ডাক্তারি পড়াল। বিদেশে রেখে। ফিরল ছেলে? ছেলের জন্য দুঃখে বৌদির মনের রোগ হয়ে গিয়েছিল। শেষদিকে বাড়িতে যে আসত তাকেই খোকা বলে ভাবতেন। যার জন্য দাদা বাড়িতে কাউকেই আসতে বলত না। বৌদি মারা যাওয়ার পর খবর পাঠানো হয়েছিল। তা-ও ছেলে এল না।”
আমি জিগ্যেস করলাম, “এরকম কেন করল?”
সুকোমলবাবু বললেন, “শুনেছি কোনো একটা বিষয়ে বাবার সঙ্গে মনোমালিন্য হয়েছিল ছেলের। তা বলে তার সাজা তুই মাকে দিবি? এটা তো ঠিক না।”
ঘরের পরিবেশ আচমকা ভারী হয়ে গেল। ঘরের অল্প পাওয়ারের আলোটা যেন পরিবেশটাকে আরো বিষাদময় করে তুলছে। আমি ঘড়ি দেখে সোহমকে বললাম, “চল, এবার উঠি।”
সোহম উত্তর দিল না। ও তাকিয়ে আছে ঘরের একমাত্র কাচের শো-কেসের দিকে।
শো-কেসে হরেক রকমের জিনিস ঠাসা। ছোট-বড় মূর্তি, নানারকম পুতুল, এমনকি দু”একটা পাথরও চখে পড়ল। অবশেষে যে জিনিসটার উপর আমার চোখ আটকাল সেটা সোহম আগেই দেখেছে। সেটা একটা যোদ্ধামূর্তি খোদাই করা হাতির দাঁত। অত সুন্দর জিনিস আমি কখনো দেখেছি।
সুকোমলবাবু বললেন, “ওটা মাসাই মূর্তি। আমার দাদা এনেছিল আফ্রিকা থেকে। আমার দাদা মেরিন ইঞ্জিনিয়ার ছিল তো, তাই অনেক দেশ…।”
সুকোমলবাবুর আর কিছু বলার দরকার ছিল না। আমরা ততক্ষণে দেওয়ালে ঝোলানো রজনীগন্ধার মালা দেওয়া ফটোটা দেখে ফেলছি।
সুকোমলবাবু বললেন, “উনিই আমার দাদা সত্যব্রত রায়চৌধুরী।”
সোহম বিস্মিত হয়ে বলল, “গুলকাকু।”
আমি ওকে থামিয়ে দিয়ে বললাম, “আরে গুলকাকু বলিস না রে। গুলকাকু মারা গেছেন। বল সত্যকাকু। সত্যকাকুরা কখনো মরেন না। চিরদিন বেঁচে থাকবেন আমাদের মনের গভীরে।” বাইরে বেরিয়ে রাতের আকাশের দিকে চেয়ে রইলাম। সত্যকাকু আজ হয়তো ওখানেই আছেন। তারাদের মাঝে অথবা অসীম শূন্যে একা।
ছবিঃ লেখক
জয়ঢাকি গল্প-উপন্যাসের লাইব্রেরি এইখানে
চেনা পথে হাঁটতে হাঁটতে ছন্দ বদল … মন ছুঁয়ে গেল ।
কাহিনি এবং চিত্র, দুটোই ভারি সুন্দর । অভিন্দন ।।
LikeLike
arkadar ei galpota asambhob bhalo laglo..eta ki sotyi ghotechilo naki kolpona?
LikeLike