ব্রজমোহন হাই স্কুলের হেডস্যার দিগন্ত সান্যাল মহাশয় গুড্ডুদের ক্লাশে ভূগোল পড়ান। গুড্ডু এখন ক্লাশ সিক্সে পড়ে। সাদামাটা মাঝবয়সী সান্ন্যাল বাবু রাশভারি লোক। বেশি কথা বলেন না, মাথায় কাঁচা পাকা চুল, চোখে সাবেকি আমলের কালো ফ্রেমের চশমা আর হাতে সরু চামড়া বাঁধানো লিকলিকে এক চাবুক-যা দেখলেই স্কুলের ছেলেদের বুকের রক্ত হিম হয়ে আসে।
তবে ভূগোল বিষয়টা এমনিতে খারাপ লাগে না গুড্ডুর,মাঝে মাঝে কেবল স্যারের রক্তচক্ষুর ভয়ে দ্রাঘিমারেখা অক্ষরেখা আর সাগর মহাসাগরের বেড়াজালে খেই হারিয়ে ফেলে সে। তারপর আবার গুড্ডুর বাবা মাঝে সাঝেই বাড়িতে থাকেন না,কাজেকর্মে বাড়ির বাইরে থাকতে হয়। তাইতে গুড্ডুর পড়াশুনো নিয়ে বাবার যত রাজ্যের চিন্তা। পড়াশুনো ঠিকঠাক হচ্ছে না শুনলে বাবার রাগ সপ্তমে-
“ভালো করে পড়াশুনো করো গুড্ডু-নয়তো মহাবিপদ-”
তা বিপদ তো গুড্ডুর আর একটা না! বিপদের কি কোন শেষ আছে! এই হেড স্যারের সাথে গুড্ডুর বাবার আবার অনেক দিনের চেনাজানা-বন্ধুত্ব। তাইতে বাবা বাড়ি থাকলে মাঝে মধ্যে স্যার গুড্ডুদের বাড়ি বেড়াতে আসেন। একথা সেকথার পর বাবা গুড্ডু সম্পর্কে জানতে চান, “পড়াশুনো কেমন চলছে ছেলের আমার? একটু চোখে চোখে রাখবেন ,ভারি দুষ্টু—”
গুড্ডু সব শোনে,বুকটা ঢিপ ঢিপ করে ওঠে ওর। যা মাথা গরম লোক সান্যাল স্যার, কী বলতে আবার কি বলে বসেন! এদিকে বাবা রেগে গেলেও তো আবার মহাকেলেঙ্কারী।
কিন্তু নাঃ-আজ অবধি গুড্ডু সম্পর্কে বাবার কাছে কোন খারাপ মন্তব্য করেননি উনি। অন্যদিকে স্যার রাগী লোক হলে কী হবে, ভূগোলের খুঁটিনাটি বিষয়গুলো অত সুন্দর করে বুঝিয়ে দেন যে, তা আর বলার না। মনে যেন গেঁথে যায়। তারপর আবার ক্লাশের প্রতিটি ছাত্রের দিকেই স্যারের কড়া নজর।
তা সেদিন হঠাৎ করে গুড্ডু পড়ে গেল মহাবিপদে। ক্লাশরুমের বাইরে জানালার কাছ ঘেঁসে মস্ত বড় এক বট গাছ। চৈত্রমাস- তাইতে পাতায় পাতায় হলুদ রঙ্ ধরেছে। তারপর দিন কয় না যেতে সব পাতা ঝরে গিয়ে একাকার। দেখতে দেখতে পুরো গাছটাই ন্যাড়া হয়ে গেল। গুড্ডু বসে জানালার পাশের একটি বেঞ্চিতে। ন্যাড়া গাছটাকে আজ ক’দিন ধরেই দেখছিল গুড্ডু, গাছটার ডালে মগডালে বেশকিছু কাকের বাসা। হাতির শুঁড়ের মতো অসংখ্য বটের ঝুরি মাটি ছুঁয়েছে। গাছের তলায় জিভ বের করা মা-কালীর এক মূর্তি। একটা কাকের বাসা-দুটো বাচ্চা কাক—অপলক তাকিয়েছিল গুড্ডু। দুটো ঠোঁট ফাঁক করে বুঝিবা খাবারের অপেক্ষায় বসে। গায়ে পালক গজায়নি, উড়তেও শেখেনি।
কতক্ষণ ওদিকে দেখছিল গুড্ডু নিজেই জানে না। হঠাৎ করে সান্ন্যাল স্যারের বজ্র হুংকার কানে যেতে গুড্ডুর মূর্চ্ছা যাবার জোগাড়-
“এই যে গুড্ডু ক্লাশ থেকে বেরিয়ে যাও—এক্ষুনি বেরোও বলছি। এদিকে আমি পড়াচ্ছি আর উনি বাইরের দিকে তাকিয়ে—বাইরেই যাও এবারে।”
হতচকিত গুড্ডু মুখে টুঁ শব্দটি না করে ক্লাশের বাইরে বেরিয়ে আসে। ওটাই নিয়ম স্যারের। কিন্তু এ কী হল আজ? অমন অন্যমনস্ক আজ কী করে হয়ে পড়ল ও! ভীষণ কান্না পাচ্ছিল গুড্ডুর।
অতবড় এই ইশকুলে অত লম্বা বারান্দা, সামনে ফাঁকা শুনশান মস্ত এক মাঠ, চারদিক খাঁ –খাঁ, কেউ কোথাও নেই –কী করবে সে এখন! আজ আর ক্লাশে ঢুকবার অনুমতি সে পাবে না- ওটা সে ভাল করেই জানে। কিন্তু কোথায় যাবে সে এখন!
এমনিতে গুড্ডু যথেষ্ট সাহসী। সাপ ব্যাঙ জোঁক কোন কিছুকেই সে ভয় পায় না। এমন কি ভূত যে ভূত- ভূতেও না। সেবারে তো একটা জলঢোঁড়া সাপকে লাঠিতে পেঁচিয়ে হাতের কায়দায় পুকুরের জল থেকে টেনে তুলে তারপর লাঠির ঘায়ে ঘায়ে মেরেই ফেলেছিল সে। সাপ দেখে তো বাড়ির লোকের সে কী চিৎকার! এমন আরো কত কী! কিন্তু সান্যাল স্যার রেগে গেলে যে সাপের চেয়েও ভয়ংকর মনে হয় ওর!
ক্লাশরুমের বাইরে দরজার ওপাশে বাঁ দিকের দেওয়াল ঘেঁসে চুপটি করে দাঁড়িয়ে রইল গুড্ডু। কী লজ্জা কী লজ্জা! কত কথাই না মনে আসছিল ওর। রোজ রোজ কত ছেলেই তো সান্যাল স্যারের হাতে শাস্তি পায়। আর বেশির ভাগ সময় ক্লাশ থেকেই বের করে দেন উনি। কিন্তু গুড্ডুর যে আজ প্রথম।
প্রতিটি ক্লাশ থেকে শিক্ষক- শিক্ষিকার গলায় পড়ানোর আওয়াজ কানে আসছে।এদিক ওদিক তাকাচ্ছিল গুড্ডু –কেউ দেখে ফেলছে না তো! এখন প্রতিটি মুহূর্ত যেন এক একটি ঘন্টা। একসময় ক্লাশ শেষ হল, ঘন্টা পড়ল, হেডস্যার গুড্ডুদের ক্লাশ থেকে বেরিয়ে এলেন। দরজার বাইরে একপাশে দাঁড়ানো গুড্ডুর দিকে চোখ পড়তে বললেন, “যাও ক্লাশে গিয়ে বসো গে যাও।এ কী চোখে আবার জল দেখছি যে?”
ঘাম দিয়ে বুঝি জ্বর ছাড়লো গুড্ডুর। হাতের চেটোয় চোখের জল মুছে ক্লাশে ঢুকতে যাবে কী- সব ছেলে ওর দিকে দিকে চেয়ে দেখছে এখন। মন খারাপের চূড়ান্ত।
বাড়ি ফিরেও গুড্ডু চুপচাপ। মা জিজ্ঞাসা করল, “কী রে গুড্ডু মন খারাপ দেখছি যে বড়! কানমলা খেয়েছিস্ বুঝি ইশকুলে?”
গুড্ডু চুপ। মুখে কথা নেই। ভাবছিল বিষয়টা এখানেই মিটে গেলে হয়,বাবার কানে উঠলে আর রক্ষে কোথায়! এমনিতে বাবা জানবে কী করে- কিন্তু হেডস্যার যদি ওদের বাড়ি বেড়াতে এসে বলে বসেন, “আপনার ছেলেটি পড়াশুনোয় বড্ড অমনোযোগী। এদিকে ক্লাশে পড়াচ্ছি-আর ও বাইরে তাকিয়ে—”
অতসব ভাবতে ভাবতে আজ বিকেলে মাঠে আর খেলতে যাওয়া হলো না গুড্ডুর। বারান্দায় বসে বসে মায়ের দেওয়া আখ চিবোতে চিবোতে বড় রাস্তার ওদিকটায় তাকিয়ে ছিল সে। এরই মধ্যে ছাতা বগলে –সাদা ধূতি পাঞ্জাবী গায়ে কে আসছে এদিকে? হেডস্যার নয় তো!
যা ভেবেছে ঠিক তাই। হেডস্যারই বটে আর গুড্ডুদের বাড়ির এদিকেই আসছেন। কী হবে এবারে? নিশ্চয়ই গুড্ডুর ব্যাপারে কথা বলতে চান বাবার সাথে।
বাড়ির বৈঠকখানার ওদিকটায় যেতে যেতে বারান্দায় বসা গুড্ডুকে দেখে স্যার বললেন, “কী রে গুড্ডু? আখ খাচ্ছিস বুঝি? খুব ভাল- খুব ভাল।”
পর্দা সরিয়ে স্যার সোজা ঢুকে পড়লেন বৈঠকখানা ঘরে। ওখানে বসে বাবা কী সব কাগজপত্র ফাইল নাড়াচাড়া করছিলেন। ওপাশে দরজার পেছনে গা ঢাকা দেয় গুড্ডু। ধীরে ধীরে বাবার সাথে স্যারের পুরনো দিনের গল্প গুজব জমে ওঠে। মা চা দিয়ে গেলেন। চা খাওয়া সেরে খানিক একথা সেকথার পর স্যার এবারে উঠে দাঁড়ালেন, “এবার তবে আসি। তা বিপিন তোমার ছেলে কোথায়?”
বাবা হাঁক পাড়লেন, “ওরে ও গুড্ডু—কোথায় রে?”
দরজার পেছন থেকে গুড্ডু পায়ে পায়ে এসে হাজির। হাসি হাসি মুখ- যেন কিচ্ছুটি জানে না।
গুড্ডুকে দেখে স্যার বললেন, “ঐ দেখো যে জন্যে আসা সেটাই বলা হয়নি।”
গুড্ডুর বুকটা ধড়ফড় করে ওঠে। ওরে বাবা রে! একথা সেকথায় বোধকরি ভুলে বসেছিলেন,গুড্ডুকে সামনে দেখে ফের মনে পড়ল।
কিন্তু নাঃ। অবাক কান্ড! ওসব কিচ্ছুটি না,মুখ ফিরিয়ে বাবাকে উদ্দেশ্য করে স্যার বললেন, “গুড্ডুকে আমার সাথে একটু নিয়ে যাচ্ছি বিপিন। ফের সাথে করেই দিয়ে যাব।”
তারপর গুড্ডুর কানে ফিসফিসিয়ে বললেন, “গুড্ডু কাকের ছানা দেখবি চল। কাক না হয়ে এ আবার কোকিল ছানাও হতে পারে, বুঝলি? কারণ দুষ্টু কোকিল তো আবার কাকেদের বাড়িতে ডিম পেড়ে রাখে।আর বোকা কাক কোকিলের ডিমকে নিজের ডিম ভেবে বসে বসে তা দেয় তাই না?”
বাবা মাথা নেড়ে অনুমতি দিলে হেড স্যার গুড্ডুর হাত ধরলেন, “চল গুড্ডু তাড়াতাড়ি চল। স্কুলে যেতে হবে তো।”
গুড্ডুর চোখ থেকে বুঝি বা জল বেরিয়ে আসবে।ওর সব ধারণাই তবে মিথ্যে! স্যার গুড্ডু সম্পর্কে বাবাকে তো কিছু বললেনই না উল্টো আবার হাত ধরে কাকের ছানা দেখাতে নিয়ে যাচ্ছেন!
হাঁটতে হাঁটতে ওরা ইশকুলে এসে পৌঁছোল। ঐ তো শেকড়বাকড়ে ঘেরা সেই বট গাছ। শেষ বিকেলে সূর্যাস্তের রক্তিম আভা গাছের ডালে মগডালে আর পাখির বাসায়। বড্ড সুন্দর দেখাচ্ছে এখন! কাছেপিঠে কোথাও একটা ব্যস্ত কোকিলের কূহু ডাক শোনা যাচ্ছে, যেন শেষ বিকেলে ঘরে ফেরার আগে অমন ডেকে ডেকে প্রকৃতিকে সে আজকের মতো বিদায় জানাচ্ছে।
গুড্ডুর পিঠে স্যারের আলতো হাতের স্নেহ স্পর্শ, “বাগান থেকে মইটা নিয়ে আসব নাকি রে? তাহলে আরো ভাল করে দেখতে পাবি। কিন্তু ওদের বেশি বিরক্ত করলে তো আবার ওরা ঠুকরে দেবে মাথায়। চল্—তার চেয়ে স্কুলের উঁচু বারান্দাটায় একটু তফাতে দাঁড়িয়েই দেখি বরঞ্চ।”
এতক্ষণে হুঁশ ফেরে গুড্ডুর। এ কোন হেড স্যার! গুড্ডুদের ইশকুলের হেডমাস্টার দিগন্ত সান্যাল বাবু কি? যাঁর ভয়ে ইশকুলের ছোট-বড় সকলেই থর থর কাঁপে, কই-মনে হচ্ছে না তো!
ছবিঃ অংশুমান