আগের পর্বগুলো
চা বানাতে গরম জল চাই। জল ফোটানোর জন্য তাপের প্রয়োজন। তাপের সহজ উৎস আগুন। গ্যাস বার্নার, উনুন, মায় মোমবাতি জ্বালিয়েও কাজ চলবে। কিন্তু জল গরম করবার পাত্র একটা তো চাই। হাঁড়ি, কড়াই, কড়াই, সসপ্যান কিছুই নেই। তাহলে জল গরমকরা হবে কেমন করে? কুছ পরোয়া নেই, কাগজের ঠোঙা একটা পাওয়া গেছে। ওতেই জল গরম করা যাবে।
অসহ্য! কথাবার্তার ছিরি দেখ! বলি, কাগজের ঠোঙার গায়ে আগুন লাগলে ওটা তো ফরফর করে জ্বলে যাবে!
দাঁড়াও। অধৈর্য হয়ো না। কাগজের ঠোঙাটা যদি খালি থাকে তাহলে তোমার কথাই ঠিক। খুব সহজেই তাতে আগুন ধরে যাবে। কিন্তু ওটার দুই তৃতীয়াংশ জল ভরে আগুনের আগুনের শিখাটা শুধুমাত্র ঠোঙার তলাতেই লাগাতে থাক। এভাবে বেশ কিছি সময় রেখে দাও। দেখবে ঠোঙা তো পুড়ছেই না, উলটে তাতে থাকা জলই টগবগ করে ফুটতে শুরু করেছে। এখন এর মধ্যে ক’টা চা পাতা ফেলে দিলেই তোমার লিকার চা তৈরি। ইচ্ছে হলে দুধচিনিও মিশিয়ে দিতে পার। কী বললে? একটু আদা আর এলাচ মেশাবে? বাপ রে! তাহলে তো জম্পেশ হয়ে যাবে!
জল থাকা কাগজের ঠোঙাটা পুড়ছে না কেন? এটা জানতে হলে প্রথমেই আগুন লাগা বা জ্বলার কারণটা জানতে হবে। আগুনের জন্য তিনটে জিনিস প্রয়োজন। প্রথমটা হল ইন্ধন, দ্বিতীয়টা অক্সিজেন, তৃতীয়টা হল দহন তাপ। এই তিনের মিলনেই আগুনের সৃষ্টি। এ যেন এক ত্রিভুজ! তিনটে বাহুর মিলিত শক্তি। এর যে কোন একটা না থাকলেই কিন্তু আগুন জ্বলবে না। অথবা জ্বললেও নিভে যাবে।
ইন্ধন হল সেই বস্তু যাতে আগুন ধরে। আমাদের এখানে কাগজটা এক ভালো ইন্ধন। ইন্ধন না হলে আগুন ধরার প্রশ্নই নেই। দ্বিতীয় প্রয়োজন অক্সিজেন। বাতাস থেকেই আমরা আগুন ধরাবার অক্সিজেন পেয়ে থাকি। নিভু নিভু আগুনে একটু দূর থেকে ফুঁ দিতে থাক, দেখবে আবারও দপ করে আগুন জ্বলে উঠেছে। আগুন জ্বলতে থাকা জায়গায় অক্সিজেনের জোগান বন্ধ করে দাও, দেখবে আগুন নিভে যাচ্ছে।
ফায়ার এক্সটিঙ্গুইশার থেকে কার্বন ডাই অক্সাইড আগুনের ওপর ছেড়ে দিয়ে যে আগুন নেভানো হয় তা তোমরা অনেকেই দেখে থাকবে। ওখানে অক্সিজেনকে আগুনের জায়গা থেকে ঠেলে দূরে সরিয়ে দেয়া হয়। আসলে কার্বন ডাই অক্সাইড তো বাতাসের থেকে ভারী, তাই ওটা বাতাসের তলার দিকে নেমে এসে আগুন আর বাতাস তথা তাতে মিশ্রিত অক্সিজেনের মাঝখানে ঢুকে পড়ে ও দুটোকে আলাদা করে দেয়। ফলে অক্সিজেনের অভাবে আগুন নিভে যায়।
এখন আসা যাক আগুন জ্বলার তৃতীয় বাহুটির কথায়, মানে তাপ তথা দহন তাপের কথায়। দহনতাপ হল সেই পরিমাণ তাপ যে তাপে তাপিত হলে তবেই দাহ্যবস্তুতে আগুন ধরে। মনে রেখ, সব ইন্ধনেরই একটা করে নির্দিষ্ট দহনতাপ আছে। আর, এটা প্রত্যেক ইন্ধনেরই আলাদা আলাদা হয়। জল ছিটিয়ে আগুন নেভাবার ক্ষেত্রেও জ্বলতে থাকা ইন্ধনের তাপ ঠাণ্ডা করে তাকে দহনতাপ থেকে নিচে নামিয়ে দিয়েই ওটা করা হয়ে থাকে।
দহনতাপ না পেলে যে একটা দাহ্যবস্তু জ্বলে না তার একটা সাধারণ পরীক্ষা করা যাক। মোটা একটা চ্যালাকাঠ নিয়ে ওটাকে একটা মোমবাতির শিখার ওপর অনেকক্ষণ ধরে রাখলেও দেখবে ওটাতে আগুন ধরছে না। একটু পোড়া পোড়া ধরনের হবে। এখন ওই কাঠ থেকে পাতলা একটা চিলতে ছিঁড়ে এনে ওই শিখার ওপর ধর, দেখবে সঙ্গেসঙ্গে তাতে ফরফর করে আগুন জ্বলে গেছে। এই দুটো ক্ষেত্রেই ইন্ধনের অক্সিজেন একই আছে। কেবল দহনতাপের তারতম্য ঘটছে চ্যালাকাঠ আর তার ছোট্ট চিলতেতে। চ্যালাকাঠের ক্ষেত্রে মোমবাতির শিখা থেকে পাওয়া তাপ কাঠের বাকি অংশ শুষে নিচ্ছিল। তাই তার দহনতাপ পেতে দেরি হচ্ছিল। কিন্তু পাতলা চিলতেটা খুব তাড়াতাড়ি দহনতাপ পেয়ে আগুন জ্বালিয়ে দিল।
কাগজের ঠোঙায় চা বানাবার ক্ষেত্রেও একই ধরণের কাণ্ড ঘটছে। জল থাকা কাগজের ঠোঙায় যখন তাপ দেয়া হয় তখন জল সেই তাপ শোষণ করে ফুটতে শুরু করে। আর ফলে, কাগজটা তার দহনতাপ পায় না। ফলে ঠোঙাটা থাকে অক্ষত। আর আমাদের চা বানানোটাও আরামসে হয়ে যায়।
এ পরীক্ষাটা তোমরা আরেকভাবেও করে দেখতে পার। তিনটে যথেষ্ট বড়ো আকারের বেলুন নাও। ফোলাবার আগে একটাতে বেশ কিছু পরিমাণে জল ভরে নিয়ে সবক’টাকে অর্ধেক পরিমাণ ফোলাও। এবার জল না থাকা বেলুনদুটো একটা একটা করে মোমবাতির শিখার ওপর ধরলেই দুমদাম ফেটে যাবে। এবার জল ভরা বেলুনটা ওই শিখার ওপর সাবধানে ধর, যাতে আগুন, জল থাকা অংশেই লাগে। দেখবে বেলুনটা অনেকক্ষণ ধরে ফাটছে না। একটু কায়দা করে এইটে দেখালে সবাইকে ম্যাজিক দেখিয়ে তাকও লাগিয়ে দিতে পার।