সমস্ত জাতক কথা একত্রে
কেজো-অকেজোর গপ্প
নন্দিনী চট্টোপাধ্যায় (দাস)
“বাবারা আজ তোমরা কিছু শুকনো কাঠ এনে রেখো ।”
গুরুদেবের কথায় শিষ্যরা দল বেঁধে জঙ্গলে চলল।
যখনকার কথা বলছি, তখন শিষ্যরা গুরুদেবের বাড়িতে থেকেই লেখাপড়া করত। তক্ষশিলার এই গুরুদেবের সেইসময় খুব নাম-ডাক। প্রায় শ’পাঁচেক শিষ্য এখানে থেকে পড়াশোনা করে। তখন নিয়ম ছিল গুরুদেব-গুরুমার ঘরের কাজও শিষ্যদের করতে হত, সে রাজার ছেলে হোক কি গরিবের ছেলে।
সব ছেলে তো সমান নয়! এই ছেলের দলে ছিল এক মহা অলস শিষ্য। ভয়ংকর ঘুমকাতুরে সে। সবাই তাকে ক্ষেপানোর জন্য ছড়াও বেঁধেছিল —
অলস দাদা,অলস দাদা
করছ তুমি কী ?
এই দেখোনা আমি কেমন
ঘুমিয়ে পড়েছি!
এই ছড়ায় অবশ্য অলসদাদার কিছু ইতরবিশেষ হত না। তার আলস্য বরং আড়েবহরে বাড়তেই থাকল। সেদিন কী হল, সবাই যখন জঙ্গলে রওনা হবে, হঠাৎ কয়েকজনের খেয়াল হল, “আমাদের অলসদাদাকে তো দেখা যাচ্ছে না!”
খুঁজতে খুঁজতে অবশেষে পাওয়া গেল তাকে। তাদের শোয়ার ঘরের কোণটি ঘেঁষে দিব্যি ঘুমোচ্ছে সে! হাসি হাসি মুখখানা দেখে দেখে মনে হচ্ছে, বোধহয় কোনো সুখস্বপ্নে বিভোর!
“ওরে, সূর্য প্রায় মাথার উপরে উঠল, উঠতে হবে না ?”বন্ধুদের ডাকে ধড়মড় করে উঠে বসল সে। হাই তুলতে তুলতে বিরক্ত মুখে বলল, “কী হল আবার?”
“কী আবার হবে? গুরুদেব শুকনো কাঠ কেটে আনতে বলেছেন। ওঠ, আমাদের সঙ্গে জঙ্গলে চল ।”
ঠেলার নাম বাবাজীবন। অগত্যা সাধের ঘুমটি বিসর্জন দিয়ে বাধ্য ছেলের মত সে কুড়ুল কাঁধে চলল বাকিদের সঙ্গে।
জঙ্গলে পৌঁছে সবাই তো শুকনো ডালের খোঁজ করছে। অলসের পা আর চলে না। বেচারা সবে কাঁচা ঘুম ভেঙে এসেছে!
কিন্তু কপাল তার ভাল। ওমা ! সামনেই একটা দৈত্যের মত ঝাঁকড়া গাছ যে! তার গায়ে কতকালের শ্যাওলা। ওর আড়ালে গিয়ে পড়লে কে আর তাকে দেখতে পাচ্ছে!
যেমন ভাবা তেমনি কাজ! এদিক-ওদিক একঝলক দেখে সুড়ুৎ করে গাছের ওপাশে অদৃশ্য হয়ে গেল সে। তারপর ঘাসের উপর একটা গদি গদি জায়গা দেখে আয়েস করে বসে ভাবল, “খানিক জিরিয়ে নিই এবার।”
ভাবতে-ভাবতেই দু- চোখ জুড়ে যে কখন ঘুম নেমে এল বেচারা টেরটিও পেল না।
এদিকে কাজকর্ম মিটিয়ে বাকি ছেলেরা তখন ফেরার পথ ধরেছে। কিন্তু গুণে দেখা গেল একজন কম।
“আরে অলসদাদা গেল কোথায়?”
খোঁজ খোঁজ পড়ে গেল চারদিকে। বাঘে খেল নাকি? অবশেষে যখন তাকে পাওয়া গেল তখন বিকেল গড়িয়ে গেছে। তখনো সে দিব্যি নাকটি ডাকিয়ে ঘুম দিচ্ছে। বিরক্ত সঙ্গীরা এক ঠেলা মেরে ওর ঘুমের দফারফা করে আশ্রমের পথে এগিয়ে গেল ।
অলস আর কী করে! সবাই তো ফিরে যাচ্ছে। এদিকে ছায়া নামছে বনে। জঙ্গলে আবার বুনো জন্তুর ভয়! কিন্তু এক গাঁঠরি কাঠ তো তাকে নিয়ে যেতেই হবে । অথচ শুকনো ডাল খোঁজারও আর সময় নেই। তাই একটা ছোটখাট গাছ দেখতে পেয়ে মরিয়ার মত তার উপর কুড়ুল চালাতে লাগল অলসদাদা।
কিন্তু যে কাজের যা নিয়ম তা না মেনে তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে তার চোখে লাগল ডালের খোঁচা। চোখ দিয়ে জল পড়তে লাগল অনবরত। লালও হয়ে গেল চোখ।
শেষপর্যন্ত পাগলের মত সদ্যকাটা ডালগুলো আঁটি বেঁধে মাথায় নিয়ে দুদ্দাড় করে গুরুদেবের বাড়ির দিকে ছুটল সে। সেখানে পৌঁছে সবার জমা করা কাঠের গাদার উপরের দিকে তার বোঝাটা রেখে চুপি চুপি ঘরে গিয়ে ঢুকল অলসদাদা। নিজের মনেই বলল, “এবারে একটু বিশ্রাম না নিলে আর পারা যাচ্ছে না । যা ধকল গেল সারাদিন!”
পরেরদিন আবার গুরুদেবের ব্রাহ্মণভোজনের নেমন্তন্ন। শিষ্যরাও যাবে তাঁর সাথে এমনই ঠিক ছিল। কিন্তু সকালবেলা ছেলেদের ডেকে তিনি বললেন,”বাপু হে, তোমরা যাও নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে। আমি একটা কাজে আটকে গেছি। আমার যাওয়া হবে না; সেটা ওঁদের বুঝিয়ে বোলো। আর একটা কথা, অনেকটা পথ হাঁটতে হবে , তোমরা কেউ খালিপেটে যাবে না । রাঁধুনী দিদিকে বল তাড়াতাড়ি খানিক জাউ রান্না করতে।”
সেইমত রাঁধুনীদিদিকে বলে ছেলেরা তৈরি হতে গেল ।
কিছু বাদে খেতে এসে সবাই দেখতে পেল কোথায় কী ! রাঁধুনীদিদি চোখ মুখ লাল করে নাগাড়ে ফুঁ দিয়ে চলেছে উনুনে । রান্নাঘর ধোঁয়ায় ভর্তি ।শিষ্যরা কাশতে কাশতে বলল, “কী ব্যাপার গো দিদি ? রান্না হয়নি?”
রাঁধুনীদিদির চোখ দিয়ে তখন জলের ধারা বইছে। আঁচলে মুছে কোনোরকমে বলল,” কাঁচা কাঠে আগুনই জ্বলছে না বাবারা , তাই দেরি হচ্ছে ।”
“কাঁচা!!” শিষ্যরা আকাশ থেকে পড়ল, “আমরা তো বেছে বেছে সব শুকনো কাঠ এনেছিলাম গো! তুমি কাঁচা কাঠ পেলে কোথায় ?”
“ কেন ?গাদার সবচেয়ে উপরের কাঠগুলোই তো এনেছিলাম আমি! এখন দেখচি সব কাঁচা !”
তখন খোঁজ পড়ল সবচেয়ে শেষে কে ফিরেছিল । কারণ তার কাঠটাই ছিল সবার উপরে ।
সবার মুখে একটাই নাম ঘুরেফিরে এল -”অলসদাদা!”
গুরুদেব ছেলেদের কাছে সব শুনলেন ।
রোদ ততক্ষণে বেশ চড়ে গেছে । খাওয়াদাওয়া সেরে ভোজবাড়িতে পৌঁছতেপৌঁছতেই বেলা গড়িয়ে যাবে। কাজেই শেষ পর্যন্ত আর যাওয়া হল না ।
এদিকে অলসদাদা গুটি গুটি পায়ে সরে পড়তে গিয়ে পড়ে গেল একেবারে গুরুদেবের সামনে। তার চোখটা তখনও ফোলা। অধোবদনে দাঁড়িয়ে রইল সে।
বুদ্ধদেব সে জন্মে ছিলেন এই গুরুদেব । তিনি ছেলেটির মাথায় হাত বুলিয়ে হাসলেন, ”দেখলে তো সময়ের কাজ সময়ে না করলে কী হয় ?” বলে বাকী শিষ্যদের দিকে তাকালেন, “আশা করি সকলেই সেটা বুঝতে পেরেছ !”
বুঝতে পেরেছে সবাই , এমনকি অলসদাদাও ! তার মুখ দেখে সেটা বোঝা গেল ।
ছবিঃ শ্রীময়ী