শুভাশিসের আগের লেখাঃ মিসলা রুটি
শুভাশিস বিশ্বাস
কাজের সুত্রে ধুলিয়ান এর কাছে রতনপুরে এসেছি। এ অঞ্চলে এই প্রথম। দুটি ইউনিটের কাজ শেষ করতে হবে। কাজের বড় তাড়া, সময় মেপে কাজ শেষ করতে হবে, টার্গেট বেধে দিয়েছে যে।
সকাল ৯ টা থেকে কাজ শুরু করে দিয়েছি এখন প্রাই বেলা তিনটে, এবার পেটে কিছু না দিলে আর চলেনা। সংগি হজরা বাবু কে নিয়ে চললাম খেতে। চোতমাসের পড়ন্ত দুপুরে রাস্তাই লোকজন কম।
এটা মুসলিম অধ্যুষিত এলাকা। শতকরা আশি ভাগ মানুষ মুসলিম। বেশির ভাগই গরিব, কিন্তু ভারি ভাল মানুষ। একটা দোকানে রুটি-সবজি পাওয়া গেল। খেতে বসে খিদেটা মালুম হল। পেটপুরে খেয়ে, বাইরে এসে একটা সিগারেটে সুখটান দিলাম।
বাইরে বেশ গরম। সবাই একটু জিরিয়ে নিতে ব্যস্ত। রাস্তার উলটো দিকে আখের রস বিক্রি হচ্ছে। এখানে আখ কে “কুসুর” বলে। আখ কে “কুসুর” আর ছোলার ডাল কে “বুটের ডাল ” বলে ডাকতে একমাত্র মুর্শিদাবাদেই দেখেছি।
আমার মামার বাড়ি মুর্শিদাবাদে, ছেলেবেলাই মামাবাড়িতে ছোলার ডাল বললে বড়রা ঠাট্টা করে বলত দেখ রে বুট শহরে গিয়ে ভদ্রলোক হয়ে ছোলা হয়েছে।
ছেলেবেলায় মামার বাড়িতে মাঠ থেকে ছোলার শাক তোলা আর কুসুরের রস খাওয়াটা বেশ মজার ব্যাপার ছিল। গ্রামের মাঝখানে অনেকটা জাইগা জুড়ে কুসুর মাড়াই এর কল বসত। প্রায় এক মাস জুড়ে চলত সে সব কর্মকান্ড। গ্রামের মাথারা কার কবে কুসুর মাড়াই হবে সে’সব দিন আগে থেকে ঠিক করে দিত। সেই হিসেব করে কুসুর কাটতে হবে যে। সবার বাড়ি থেকে পালা করে গরু পাঠাতে হত মাড়াই কলে, সে এক এলাহি ব্যাপার।
এই এক মাস গ্রামে যেন মেলা বসে যেত। আমাদের তো আনন্দ আর ধরে না। খোলার (কুসুর মাড়াই যে খানে হত তাকে গ্রামের সবাই এই নামেই ডাকত) ধারে নংড়া চাচা (মানুষটার একটা পা একটু টেনে হাঁটত, তাই এই নাম) পাঁপড়ভাজার দোকান দিত। দিদা আমাকে লুকিয়ে পাঁপড় খাবার পয়সা দিত। পাঁচপয়সা করে দাম। সমবয়সী বন্ধুরা বেশির ভাগই মুসলিম এবং ভীষণ গরিব। একটা পাঁপড় কিনে ভাগ করে খাওয়া।
তবে মূল আকর্ষণ ছিল কুসুরের রস। কাগজি লেবুর ডাল ভেঙে আনা হত। লেবুর পাতা আর কুসুর এক সাথে মাড়াই করে সেই রস খাওয়া হত। সেই স্বাদ এখনো মুখে লেগে আছে।
খোলাতে দেখভালের জন্য সব সময়ের লোক থাকত। অসীম তার ক্ষমতা। হাতে লম্বা কঞ্চি, সেইটি উঁচিয়ে চারিদিক দেখভাল করছেন। আমরা কুসুরের রস খাবার বায়না করতাম। হাতে কাগজি লেবুর ডাল। উনি রে রে করে কঞ্চি উঁচিয়ে তেড়ে আসতেন। এ আমাদের প্রতিদিনকার চেনা ছবি। শেষে রাজি হতেন। লেবুর পাতা আর কুসুর একসাথে মাড়াই করে বড় ঘটিতে রস দিয়ে য়েত। সবাই পালা করে ঘটিতে চুমুক দিয়ে খাওয়া। হিন্দু-মুসলিম এক সাথে। খাবার শেষে পুকুর ঘাটে ঘটি ধুয়ে ফেরত দিয়ে হত।
আজ রাস্তার উলটো দিকে কুসুরের রস দেখে হঠাৎ ছেলেবেলার সেই সব দিনের কথা মনে পড়ে গেল। খোঁচা মেরে হাজরাবাবুকে বল্লাম, “চলুন আজ কুসুরের রস খাওয়া যাক।”
বেলাশেষে বিক্রিবাটা কম। দু’জন খদ্দের পেয়ে রসওয়ালা খুশি। দশ টাকা গ্লাস, সঙ্গে পাতিলেবুর রস। খেতে মন্দ নয়। ছেলেবেলার স্বাদ নাই বা পেলাম তাতে কী, আমিও যে বুড়ো হতে চললাম।
হাজরাবাবু তাগাদা দিচ্ছিলেন। এবার কাজে বসতে হবে। টার্গেট বেঁধে দিয়েছে যে!