দেশ ও মানুষ সব পর্ব একত্রে
মিসলা রুটি
শুভাশিস বিশ্বাস
ছোটোবেলায় যখন মামাবাড়ি (মুর্শিদাবাদ) যেতাম, গ্রামের বাড়িতে দেখতাম মুনীষ (মাঠে যারা কাজ করে)দের জলখাবারে কলাইয়ের ডাল দিয়ে তৈরি একরকম রুটি দেওয়া হত। ওরা বলতো মিসলা রুটি। এর সঙ্গে দেয়া হত নুন আর শুকনো লংকা বাটা। আর ৬ টা করে বিড়ি। লোকে বলতো চাষাদের নাস্তা। অনেকক্ষণ পেটে থাকে।
মুসলিম প্রধান গ্রাম। বেশির ভাগ মানুষ আধপেটা খেয়ে থাকত। তাই মুনীষদের কাছে টাকা-পয়সার চেয়ে মিসলা রুটির টান অনেক বেশি ছিল।
এই চাষাদের নাস্তা আমাদের দেওয়া হত না। খেলে নাকি পেট ছেড়ে দেবে। খাবারটা একবার টেস্ট করে আমি ওর প্রেমে পড়ে গেলাম।
কিন্তু তারপর চাইলেও তো আর আমাকে দেওয়া হবে না! কী মুশকিল! বাড়ির মেয়েরা ঠাট্টা করে বলত ফুচনের (আমার মার ডাক নাম) বেটা তো দেখছি চাষা।
মিসলা রুটি আর না পেয়ে আমি একদিন একটা ফন্দি আঁটলাম। প্রতিদিন ১২টা নাগাত চাষাদের খাবার মাঠে দিতে যেতে হত। বাড়িতে এই কাজটা করার আর ঠিকমত লোক পাওয়া যেত না। অমি এই কাজটার ভার নিলাম।
তাতে বাড়ির সবাই খুশি। কানা উঁচু কলাইকরা থালাতে মিসলা রুটি সাজিয়ে গামছা দিয়ে বেঁধে আমার মাথায় চাপিয়ে দিত।আমার সমবয়সীরা জখন খেলাতে মগ্ন, আমি তখন চলতাম মাঠে। মাথাই নাস্তা, হাতে জলন্ত লুদা(বিড়ি ধরাবার আগুন)।
গমের ভুঁই(জমি)-এর আল ধরে হাঁটা। কী যে ভাল লাগত! আলের ধারে বাবলা গাছের ছায়াতে বসে খাওয়া। বিড়ি দেবার সুবাদে সবাই আমার বন্ধু।
আমি মিসলা রুটি খাবার আবদার করতাম। ওরা বলত, “মামু এ খাবার চাষাতে খায়। তুমি খাবে কোন দুঃখে। তাছাড়া আমরা মুসলিম, আমাদের সাথে তোমাদের একসঙ্গে খেতে নেই।”
আমি নাছোড়বান্দা। শেষে কাউকে বলা যাবে না এই শর্তে ভাগ পেতাম। এ-সব আজ থেকে ৪০ বছর আগেকার ঘটনা। কিন্তু গতকালকের একটা ঘটনা সেইদিনের কথা আবার মনে করিয়ে দিল। সকালে ধুলিয়ানের গঙ্গার ধারে ঘুরে বেড়াচ্ছি। দেখি এক জায়গায় জটলা। সবাই গোল গোল কী যেন খাচ্ছে।
জিজ্ঞেস করলে উত্তর এল, “ও জেনে কী করবেন বাবু? এ চাষার খাবার মিসলা রুটি।”
শুনে আমি থ। এ-খাবার এখনো বেঁচে আছে! আমি খেতে চাইলে তারা রাজি হল না। অগত্যা পরিচিত সরকারবাবুর শরণাপন্ন হলাম। তিনি বাধা দিয়ে কিছু একটা বলতে য়াবার আগেই থামিয়ে দিলাম।
কিন্তু সরকারবাবু আমাকে নদীর ধারে ওদের সাথে খেতে দেবেন না। তাতে নাকি ওঁর এবং সায়েবের(মানে আমার)প্রেস্টিজ যাবে। খেতে হবে ওঁর অফিসে।
উপায় না দেখে আমি নিমরাজি হলাম। তারপর তিনি লোক পাঠিয়ে মিসলা রুটি আনালেন। আমাকে প্লেটে মিসলা রুটি সাজিয়ে খেতে দিল। সঙ্গে ধনেপাতার চাটনি আর লেবু। নুন লংকা বাটা আর দেয় না।
খাওয়ার কথা বাবলা গাছের ছায়ায়, খেলাম এ সি রুমে বসে। তাতে আমার কী আসে যায়? আমি এক টুকরো ছিঁডে মুখে দিয়ে চোখ বন্ধ করলাম। চলে গেলাম আমার ছোটোবেলার সেই বাবলা গাছের ছায়ায়।