আগের পর্বগুলো
অধ্যায় চৌদ্দ
তুরন পাহাড়ে তাদের অপেক্ষায় ছিলেন জাদুকর মাহমুদ। তিনি কিছুটা উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন কারণ সময় গড়িয়ে যাচ্ছে। রাতুলরা গালিচায় চড়ে গুহায় জাদুকর মাহমুদের সামনে গিয়ে থামল।
জাদুকর মাহমুদ বললেন, “কোন অসুবিধা হয়নি তো?”
তোবারক আলী সামান্য হেসে রাতুল ও আকাশের দিকে একবার তাকিয়ে বললেন, “সে তেমন কিছু না। এখন কি আমরা বিন্ধ্রপর্বতে যেতে পারব? না আরো কিছু প্রয়োজন হবে?”
জাদুকর মাহমুদ বললেন, “আর কোন কিছুর দরকার পড়বে না। তবে সেখানে গিয়ে বুদ্ধি খাটিয়ে হারিরিকে উদ্ধার করতে হবে। সময় খুব বেশি নেই। আজ রাতে খুব বড় চাঁদ উঠবে। আজকেই হারিরিকে হত্যা করার প্ল্যান করেছে কোবিলাই। আর সাবধান। ওখানে পাহাড়ায় আছে পিশাচেরা।”
রাতুল দৃঢ়ভাবে বলল, “আমরা অবশ্যই তাকে উদ্ধার করতে পারব। এবং আপনাকেও এই বন্দিদশা থেকে মুক্ত করব।”
জাদুকর মাহমুদ অপ্রস্তুতের হাসি দিয়ে বললেন, “আমার কথা ভেবো না। হারিরিকে উদ্ধার করতে যাও। সময় ফুরিয়ে যাচ্ছে। পৃথিবীর সময় দিয়ে বিচার করলে আর বাকি আছে দুই ঘন্টা বারো মিনিট।”
তোবারক আলী বললেন, “তাহলে চলি মাহমুদ সাহেব। আবার দেখা হবে।”
অতঃপর তিনি বললেন, “সোলেমান বাদশাহর গালিচা; যাও, বিন্ধ্রপর্বতে যাও।”
তাদের তিনজনকে নিয়ে গালিচা উড়ে গুহা থেকে বের হলল। চলল বিন্ধ্রপর্বতের দিকে। পাহাড়, সমতল উপত্যকা, নদী এবং বিস্তৃর্ন রঙবেরঙের ঘাসযুক্ত মাঠ পেরিয়ে গালিচা উড়ে চলল।
রাতুলের মনে তখন দৃঢ় প্রত্যয়। হারিরিকে উদ্ধার করবেই। এছাড়া জাদুকর মাহমুদ অর্থাৎ আকাশের বাবাকেও উদ্ধার করতে হবে বন্দিদশা থেকে। জাদু রাজ্যে বিভিন্ন ঘটনার মুখোমুখি হয়ে রাতুল এবং আকাশ দুজনেরই আত্মবিশ্বাস বেড়ে গেছে। তারা বুঝতে পেরেছে সাহস এবং আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে কাজ করলে অনেক কিছুই করা সম্ভব। ভয় হল কোন অর্জনের পথে প্রধান বাঁধা। কোন কিছু জয় করতে হলে প্রথমেই জয় করতে হয় ভয়কে। উড়ে যাওয়া কিংবা অদ্ভুত প্রাণীদের দেখে এখন আর ভয় পাওয়ার কিছু নেই। এমনকী বিন্ধ্রপর্বতে কী আছে, পিশাচেরা কেমন, তা ভেবেও চিন্তিত হল না কিংবা ভয় পেল না রাতুল ও আকাশ।
একসময় গালিচা উড়ে চলল অগ্নিসমুদ্রের উপর দিয়ে। রাতুল নিচে তাকিয়ে দেখল দাউ দাউ করে জ্বলছে আগুন। টগবগ করছে গলিত আগুনের স্রোত। এমন আগুন সে আর কখনো দেখেনি। কখনো কল্পনাও করেনি।
তোবারক আলী নিচের দিকে তাকিয়ে গম্ভীর কন্ঠে বললেন, “ভয়ানক সব অপরাধীদের এখানে নিক্ষেপ করা হত। কিন্তু গত কিছুদিন আগে কয়েকজন সাধু জাদুকরকে এখানে নিক্ষেপ করেছে কোবিলাই। সে জাদুকররা তার বিরোধীতা করেছিলেন।”
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে তোবারক আলী গম্ভীর হয়ে গেলেন। গালিচা উড়ে চলল। অগ্নি সমুদ্রের উপরে খাঁ খাঁ শূন্যতা। কোন প্রাণী নেই। শুধুমাত্র একটানা আগুনের ঢেউয়ের শোঁ শোঁ শব্দ।
একসময় অগ্নি সমুদ্র শেষ হল। দেখা গেল বিন্ধ্রপর্বতের চূড়া। বিন্ধ্রপর্বতের রঙ হালকা মেটে লাল। পর্বতের সামনে একটি দুর্গ। সেই দুর্গেই রাখা হয়েছে হারিরিকে। গালিচা দুর্গের সামনে গিয়ে থামল।
দুর্গের প্রবেশপথের পাশে ঘুমিয়ে আছে এক লালমুখো ড্রাগন। তোবারক আলী সেদিকে তাকিয়ে তার পকেট থেকে বালিঘড়ি বের করে দেখলেন এবং বললেন, “সময় নেই খুব বেশি। তাড়াতাড়ি কাজ করতে হবে।”
আকাশ বলল, “কিন্তু আমরা ঢুকব কীভাবে?”
রাতুল এ সময় বুদ্ধিমানের মত একটা কাজ করল। সে তার ব্যাগ থেকে জাদু বইটা বের করে খুলল। তাতে ফুটে উঠল দুর্গের ম্যাপ। সে ম্যাপে লাল রঙ এবং টানা তীর চিহ্ন দিয়ে নির্দিষ্ট করা একটি পথ। এই পথেই এগুতে হবে।
তোবারক আলী ম্যাপটা দেখে বললেন, “এখানে তো দেখাচ্ছে বাঁদিকে আরেকটি পথ আছে। ওদিকে চলো।”
ম্যাপে দেখানো রাস্তা মিলিয়ে দুর্গের প্রবেশপথ বের করতে তারা বাঁদিকে গেল। সেখানে আরেকটি পথ ছিল। রাতুল এবং আকাশ সে পথ দিয়ে ভেতরে ঢুকে পড়ল। ম্যাপে দেখানো পথ ধরে গেলে কোন বিপদ হওয়ার আশংকা নেই। তবে দুর্গের ভেতরে বেশ আলো নেই। আবছা অন্ধকার। তাই পথ ভূল হওয়া অস্বাভাবিক কিছু না। তাই ঢোকার আগে তোবারক আলী বার বার বলে দিয়েছেন, “সাবধানে ম্যাপ দেখে দেখে যাবে। কোন ভয় নেই। সম্ভবত ভেতরে কোন পাহাড়া নেই। পাহাড়া আছে বাইরে। তারা যদি বুঝতে পারে ভেতরে কেউ ঢুকেছে তাহলে সামনে দিয়েই আসবে। আমি এদের রুখব। আর এর মধ্যে তোমরা হারিরিকে খুঁজে বের করে উদ্ধার করবে।”
রাতুল এবং আকাশ এগিয়ে যাচ্ছিল। ম্যাপের দেখানো পথের শেষমাথায় গিয়ে তারা দেখতে পেল একটি সুড়ঙ্গ। সেই সুড়ঙ্গে প্রবেশ করল রাতুল। সুড়ঙ্গের মাথার অংশ বেশ বড়। সেখানে একটি পাথরের বেদীর উপর ত্রিকোণাকার ক্রুশে বাঁধা আছে হারিরি।
রাতুল উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠল না। জাদুরাজ্যের বিভিন্ন ঘটনা তাকে স্থির হতে শিখিয়েছে। সব অবস্থাতেই স্থির থাকতে হয়। উচ্ছ্বাস অনেক সময় অমনোযোগী করে বিপদের দ্বার খুলে দেয়।
রাতুল জাদুর বইয়ের দিকে তাকিয়ে দেখল বইটিতে হারিরি এবং সেই ত্রিকোণাকার ক্রুশের ছবি। রাতুল এগিয়ে গিয়ে দেখল হারিরির হাত পা বেশ ভালো করে বাঁধা। শুধু হাত দিয়ে এ বাঁধন মুক্ত করা সম্ভব না। চারিদিকে তেমন কোন বস্তুও নেই যা দিয়ে খোলা যায়।
আকাশ এই সময় বলে উঠল তার “বৈজ্ঞানিক বক্সের” কথা। বৈজ্ঞানিক বক্সটি ব্যাগেই ছিল। রাতুল তড়িঘড়ি করে বক্সটি বের করল। তাতে বিভিন্ন ধরনের যন্ত্রপাতির মধ্যে ছিল ছোট ধরনের এক ছুরি।
এই ছুরিটা দিয়ে রাতুল কেটে ফেলল হারিরির হাত বাঁধা দড়িটি। পুরোপুরি বাঁধনমুক্ত করার পর দেখা গেল হারিরি অজ্ঞান। আকাশ সুড়ঙ্গের পাশ থেকে ছুঁয়ে পড়া ঝরনার জল এনে ছিটিয়ে দিল মুখে। তাতে জ্ঞাণ ফিরে পেল হারিরি। সে চোখ খুলে হাসিমুখে বলল, “জানতাম তোমরা আসবে। আমি অপেক্ষায় ছিলাম।”
রাতুল বলল, “বাইরে হেডস্যার অপেক্ষায় আছেন বাদশাহ সুলেমানের গালিচা নিয়ে। চল ফেরা যাক এখন।”
হারিরি বলল, তার আগে একটা কাজ আছে বন্ধু। এই দুর্গের ভেতরে আছে রত্ন দীঘি। কাকের চোখের মত স্বচ্ছ জল সেখানে। তার মাঝখানে ফুটে আছে নীলপদ্ম। আমাদের এই পদ্মটি নিয়ে যেতে হবে জাদুকর মাহমুদকে তুরন পাহাড়ের বন্দিদশা থেকে মুক্ত করতে।
আকাশ বলল, “সেটা কোথায়?”
হারিরি বলল, “আমার সঙ্গে চলো।”
হারিরি উঠে সুড়ঙ্গ থেকে বের হয়ে ডানদিকের একটা সরু রাস্তা ধরে চলে গেল এক বিশাল দীঘির সামনে। দুর্গের ভেতরে এমন বিরাট দীঘি কী করে হল তা বুঝার উপায় নেই। উপরে দুর্গের ছাঁদ আর নিচে রত্নদীঘির স্বচ্ছ জল টলমল করছে। দীঘির ঠিক মাঝখানে অপূর্ব সুন্দর এক নীলপদ্ম ফুটে আছে। ফুল এতই উজ্জ্বল বর্নের যে মনে হচ্ছে যেন আলো বিকিরণ করছে। আর একটি ভয়ংকর ব্যাপারও আছে। দীঘিতে কাঠের গুঁড়ির মত ভেসে বেড়াচ্ছে বিশালাকায় কিছু কুমির।
রাতুল জিজ্ঞেস করল, “কিন্তু আমরা দীঘির মাঝখানে পৌঁছাব কী করে?”
হারিরি বলল, “পানকৌড়ির পিঠে চড়ে।”
আকাশ জিজ্ঞেস করল, “কিন্তু কুমিরেরা আক্রমণ করবে না?”
হারিরি বলল, “জাদু রাজ্যে সবচেয়ে ভালোভাবে জলের উপর দিয়ে ভ্রমণ করা যায় পানকৌড়ির সাহায্যে। পানকৌড়ির পিঠে চেপে গেলে খুব সম্ভবত কুমিরেরা টের পাবে না। তারা টের না পেলে আমরা বিনা বিপদে নীলপদ্ম নিয়ে আসতে পারব।”
আকাশ আবার জিজ্ঞেস করল, “কিন্তু তারা যদি টের পেয়ে যায়?”
হারিরি আকাশের দিকে তাকিয়ে সামান্য হেসে বলল, “তাহলে বিপদ হবে। সাংঘাতিক বিপদ। এই কুমিরেরা শত শত বছর ধরে রক্ত পায় নি। রক্তের ক্ষুধায় এরা কাতর। এক ফোঁটা রক্তের গন্ধেই এখানে কুমিরদের মধ্যে হুলস্থুল লেগে যাবে।”
আকাশ হতাশ মুখে তাকাল রাতুলের দিকে। রাতুল তখন মনযোগের সঙ্গে একটা কুমিরের ভেসে যাওয়া দেখছে। খুব শান্ত শিষ্ট ভালোমানুষের মত কুমির ভেসে যাচ্ছে।
হারিরি দীঘির এক কোনে জলকেলী করতে থাকা একটি পানকৌড়ির পিঠে চেপে বসল। তার মত রাতুল এবং আকাশও পানকৌড়ির পিঠে চাপল। জাদু রাজ্যে পানকৌড়িরা জানে কেউ জল ভ্রমণ করতে হলে তাদের পিঠে চড়বে। সুতরাং তারা কোন আপত্তি করে না। পিঠে চড়িয়ে ভ্রমণ করায়। এতেই তাদের আনন্দ। সুতরাং রাতুলরা পানকৌড়িদের পিঠে চড়তে চাইলে তারা খুশি হল।
সন্তপর্নে হারিরি, রাতুল এবং আকাশ পানকৌড়িদের নিয়ে যেতে লাগল নীলপদ্মের কাছে। তিনজনই গিয়েছিল যাতে বিপদ এলে একে অপরকে সাহায্য করতে পারে। পানকৌড়িরা অবিশ্বাস্য সাতার কুশলতায় ভাসমান কুমিরদের পাশ দিয়ে চলল নিঃশব্দে। রাতুলের পানকৌড়ি একটি ভাসমান কুমিরের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় রাতুল নিঃশ্বাস প্রায় বন্ধ করে রাখল ভয়ে। এসময় সে তার বুকের ভেতরের ঢিবঢিব শব্দ স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছিল।
নীলপদ্মের কাছে গিয়ে রাতুল ও আকাশ দু পাশে তাদের পানকৌড়ি নিয়ে অবস্থান করল। আর হারিরি নীলপদ্মের কাছে গিয়ে পদ্মটি এক নিশ্বাসে ছিঁড়ে ফেলল। তারপর পানকৌড়ি ঘুরিয়ে দ্রুত ফিরতে শুরু করল। রাতুল এবং আকাশও তাদের পানকৌড়ি ছুটাল দ্রুত। তিনটি পানকৌড়ির একই দিকে দ্রুত চলে যাওয়ার শব্দে একটা কুমির ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল। তার জ্বলজ্বলে লাল দুটি চোখ থেকে যেন তরল আগুন বেরোচ্ছে।
কুমিরটা যেন রক্তের গন্ধ পেয়েছে। সে বুঝতে পেরেছে পানকৌড়ির উপরে আছে অন্যকিছু। আরো কয়েকটা কুমিরের মধ্যেও সাড়া পড়ে গেল। হারিরি বলল, “কুমিরেরা টের পেয়ে গেছে। দ্রুত পানকৌড়ি ছুটাও।”
কুমির তিনটা তাদের বিশাল শরীর নিয়ে পানকৌড়িদের পিছন ধাওয়া করল। পানকৌড়িরাও ছুটতে লাগল খুব দ্রুত। তিনটা কুমির আস্ফালন করে এগুতে লাগল। ফলশ্রুতে আরো কয়েকটি কুমিরের দৃষ্টি গেল এদিকে। এরাও পানকৌড়িদের দিকে ফিরল।
পানিতে পানকৌড়িকে কেউ আঘাত করে না। তাই কুমিরদের লক্ষ্য পানকৌড়ির পিঠে চড়া বস্তুদের প্রতি।
হারিরি অবিশ্বাস্য গতিতে পানকৌড়ি ছুটিয়ে তীরে পৌছাতে পারল। ঠিক তখনি প্রথম আঘাত আসল কুমিরদের পক্ষ থেকে। পানির নিচ থেকে লাফিয়ে ঠিক আধহাত সামনে দিয়ে চলে গেল একটা আস্ত কুমির। আরেকটু হলে কুমিরের ধারালো দাতে বিদ্ধ হত রাতুল। পানকৌড়ির পিঠ থেকে পড়তে পড়তে রাতুল নিজেকে সামলে নিল।
তারপর সে লাফিয়ে পানিতে পড়ে কয়েক হাত সাঁতরে চলে এল পাড়ে। সে পানিতে পড়ায় সরাসরি রক্তের গন্ধ ছড়িয়ে পড়ল পানিতে। আর রত্ন দীঘিতে শুরু হল কুমিরদের আস্ফালন। ভয়ংকর সে দৃশ্য। কুমিরেরা হুংকার ছুঁড়ছে, লাফিয়ে উঠছে, ভুস ভুস করে পানি ছাড়ছে। পুরোপুরি অভাবনীয় দৃশ্য।
রাতুল এবং হারিরি ভয় জড়ানো চোখে তাকিয়ে ছিল দীঘির দিকে। কারন পাড় থেকে কয়েকহাত দূরে কুমিরদের আস্ফালনের মাঝখানে নিশ্চুপে অবাক হয়ে পরিস্থিতি বুঝার চেষ্টা করছে পানকৌড়ি এবং তার উপরে আতংকিত আকাশ। রক্তের গন্ধে কুমিরদের মাথা খারাপ হয়ে গেছে। তারা কী করছে কিছুই ঠিক নেই।
হারিরি আকাশের ফেরার ব্যাপারে আশা হারিয়ে ফেলেছিল। কারণ এই দীঘির কুমিরদের হিংস্রতার ব্যাপারে জাদুরাজ্যের সবাই জানে। রক্তের নেশায় উন্মত্ত একদল কুমির ঘিরে আছে পানকৌড়ির উপরে বসা ভয়ার্ত আকাশকে। এ অবস্থায় তার বেঁচে ফেরার আশা করা যেন দুঃসাহস।
কুমিরদের অস্থিরতা আরো বাড়ল। এরই মধ্যে ভয়ার্ত অবস্থায় হলেও রাতুল একটা ব্যাপার লক্ষ করে চমকে উঠল। কয়েক মিনিট চলে গেছে কিন্তু কুমিরেরা এখনো আকাশকে আক্রমণ করেনি। নিজেরাই শুধু উন্মত্তের মত্ত আস্ফালন করছে।
রাতুল তখন ভয়ার্ত কন্ঠে ফিসফিস করে হাত দিয়ে ইশারা করে আকাশকে বলল, “চলে আয়। ভয় পাবি না। আস্তে আস্তে চলে আয়।”
সম্বিৎ ফিরে পেল আকাশ। চারদিকে কুমিরদের চাপা গর্জন এবং ক্ষুধার্ত আন্দোলনের ভেতর দিয়ে পানকৌড়ি নিয়ে এগুতে লাগল সে। স্বচ্ছ রত্নদীঘিতে উত্তাল পানির উপর পানকৌড়ি ধীরগতিতে এগুচ্ছিল পাড়ের দিকে।
অদ্ভুত হলেও সত্য উন্মত্ত কুমিরেরা সেদিকে লক্ষ দিচ্ছিল না। হয়ত তারা অত্যধিক পানির আন্দোলনের জন্য কোনদিক থেকে আসছে রক্তের গন্ধ দিশা পাচ্ছিল না। কুমিরদের দৃষ্টি শক্তি খুব ক্ষীণ হয়। আর এই লালচোখো কুমিরেরা আদৌ দেখতে পায় কি না সন্দেহ। দেখতে পেলে রাতুল আকাশ কিংবা হারিরি কারোরই বেঁচে থাকার উপায় ছিল না।
ভয় প্রকাশে একটা কথা আছে “মেরুদন্ড দিয়ে ভয়ের শীতল স্রোত বয়ে গেল”, আকাশের অবস্থাটা প্রকাশে বলা যায় তার শুধু মেরুদন্ড না সমস্ত শরীর দিয়েই শীতল স্রোত বয়ে যাচ্ছিল। নিশ্চিত মৃত্যু চারিদিকে ওঁত পেতে আছে। হা করে আছে। আক্রোশে গর্জন করতে করতে ডাকছে। এর মাঝে রাতুলের ডাকে কিছুটা সাহস ফিরে পেয়ে আকাশ পানকৌড়ি নিয়ে এগুতে লাগল। নিঃশ্বাস বন্ধ করে রয়েছিল সে যাতে কোন শব্দ না হয়। পানকৌড়ি সন্তপর্নে কিন্তু ধীরে ধীরে গতি বাড়িয়ে দিল। ভয়ংকর সব কুমিরদের পাশ দিয়ে ফিরে এল পাড়ে।
পাড়ে এসেই আকাশ লাফিয়ে ছিটকে পড়ল। খুব জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিল কয়েকবার। রাতুল এবং হারিরিও আকাশের তীরে আসার মধ্যকার এই সময়টাতে প্রায় নিঃশ্বাস বন্ধ করে উদ্বিগ্ন অবস্থায় তাকিয়েছিল।
তিনজন প্রায় নিরাপদেই ফিরে আসতে পারল শেষপর্যন্ত। নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে ফিরে আসা আকাশকে জড়িয়ে ধরে সাহস দিল রাতুল। বলল, “বেশ ভালো করেছিস। ভয় পেয়ে যদি আশা ছেড়ে দিতি তাহলে এতক্ষনে কুমিরের পেটে হজম হয়ে যেতি।”
আকাশ মুখ কাঁচুমাচু করে বলল, “ভয় পেয়ে পেশাব করে দিয়েছিলাম। তারপরই গরমে হঠাৎ সাহস ফিরে পেলাম।”
হারিরি বলল, “পানকৌড়িদের ধন্যবাদ। আজ আমি বুঝতে পারলাম কেন এদের বলা হয় জলে ভ্রমণ করার জন্য জাদু রাজ্যের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য বাহন। এখন চল আমাদের যেতে হবে। নীলপদ্ম উদ্ধার হয়েছে। এটা তুরন পাহাড়ে নিয়ে গেলেই তুরন পাহাড়ের উপর কালো জাদুর মায়া কেটে যাবে। জাদুকর মাহমুদ বন্দিদশা থেকে মুক্ত হবেন।”
রাতুল বলল, “তাহলে যাওয়া যাক। হেডস্যার তো দুর্গের বাইরে আছেন অপেক্ষায়।”
হারিরি বলল, “বাইরে বোধহয় পিশাচেরা চলে এসেছে ইতিমধ্যে। রক্তবীজ পিশাচেরা এই কুমিরদের থেকেও ভয়ংকর।”
রাতুল, হারিরি এবং আকাশ রত্মদীঘির পাড় থেকে হেঁটে আবছা অন্ধকার পথ পেরিয়ে দুর্গের বাইরে গেল। দুর্গের বাইরে তখন অবস্থা ধুন্ধুমার। তোবারক আলী গালিচার উপরে শূন্যে উঠে আছেন। আর নিচে পাঁচ ছয়টা অদ্ভুত প্রাণী উপরে গালিচার উপর দাঁড়িয়ে থাকা তোবারক আলীর দিকে তাকিয়ে ফোঁসফোঁস করছে। বাদুরের মত মুখ, দুই হাত, দু পা। গোলাটে দুই চোখ, মুখের পাশ দিয়ে বেরিয়ে আছে ধারালো দাঁত। প্রাণীটির গায়ের রঙ মিশমিশে কালো।
দুর্গের পাশে রাখা ছিল বর্শা। রাতুল এবং আকাশ দুটি বর্শা হাতে নিল। হারিরি ছিল একটু পেছনে। রাতুল, আকাশ এবং হারিরিকে দেখে এগিয়ে এল পিশাচেরা।
তোবারক আলী চিৎকার করে বললেন, “সাবধান! এই পিশাচদের থেকে দূরে থাকো।”
একটি পিশাচ দ্রুত এগিয়ে এসেছিল রাতুলের সামনে। রাতুল তার বর্শাটা পিশাচের গলায় বিদ্ধ করে দিল। ফোঁটা ফোঁটা রক্ত ঝরল পিশাচের গলা থেকে। টকটকে লাল রক্ত।
হারিরি চিৎকার করে উঠল, “পিছনে সরে আসো। এদের মেরো না।”
উপর থেকে তোবারক আলী বললেন একই রকম কথা, “এদের রক্ত ঝরিয়ো না।”
রাতুল অবাক হয়ে গিয়েছিল। সে জিজ্ঞেস করতে যাচ্ছিল, কেনো। কিন্তু তার আগেই দেখতে পেল গলায় বর্শার আঘাত খেয়ে মৃত পিশাচের রক্তের ফোঁটা থেকে নতুন তিনটিও পিশাচ মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে।
রাতুল পিছনে সরে আসল।
হারিরি বলল, “এজন্যই এদের বলে রক্তবীজ। এদের রক্ত থেকে নতুন পিশাচের জন্ম হয়।”
তোবারক আলী বললেন, “এদের সঙ্গে যুদ্ধে না গিয়ে তোমরা এমন কোথাও দাঁড়াও যাতে আমি গালিচার সাহায্যে তোমাদের উঠিয়ে নিতে পারি।”
রাতুলদের পাশে একটি চারফুট উঁচু টিলা ছিল। রাতুল, হারিরি এবং আকাশ দৌড়ে গিয়ে সে টিলায় উঠল। তিনদিকে মুখ করে তিনজন তিন বর্শা হাতে দাঁড়াল। ফোঁসফোঁস করতে করতে এগুল পিশাচেরা।
তোবারক আলী বললেন, “কোন রক্তপাত নয়। শুধু মাথায় বাড়ি দিবে। আমি আসছি।”
তিনদিক থেকে আগত পিশাচদের মাথায় বর্শা দিয়ে বাড়ি দিচ্ছিল রাতুল, আকাশ এবং হারিরি। তোবারক আলী গালিচা নিয়ে চলে এলেন টিলার মাথায়। কিন্তু কারো উঠার মত অবস্থা নেই। পিশাচেরা আসছে একের পর এক। উন্মত্ত রক্তবীজ পিশাচেরা।
আকাশ বলল, “আমরা উঠব কীভাবে? একটু ফাঁকা পেলেই তো পিশাচেরা উঠে পড়বে টিলায়।”
হারিরি একটা পিশাচের মাথায় ঘা দিয়ে ফেলে দিল। সঙ্গে সঙ্গেই চলে এল আরেকটা।
রাতুল বলল, “একটা উপায় আছে। সবাই একসঙ্গে বর্শা এদের গলায় বিদ্ধ করতে হবে। তাহলে অন্যগুলো রক্তের জন্য আসতে কিছুক্ষণ দাঁড়াবে আর রক্ত থেকে নতুন পিশাচ তৈরি হতেও সময় লাগবে। এই সময়ে আমরা উঠে যাবো গালিচায়।”
আকাশ বলল, “দারুণ।”
হারিরি বলল, “ঠিক আছে।”
তোবারক আলী উপর থেকে বললেন, “কিন্তু সাবধান। রক্তে পিশাচের সংখ্যা কিন্তু বেড়ে যাবে।”
রাতুল গুনল, “এক, দুই, তিন।”
সঙ্গে সঙ্গে যে পিশাচেরা এসেছিল তাদের গলায় বিদ্ধ হল রাতুল, আকাশ এবং হারিরির বর্শা। বর্শা বের করতেই গল গল করে বেরিয়ে এল রক্তের ধারা।
অন্য পিশাচেরা থমকে দাঁড়াল।
তোবারক আলী নিচে নামিয়ে আনলেন গালিচা। আকাশ এবং হারিরি নিচে নেমে আসা গালিচায় লাফিয়ে উঠে গেল। গালিচা এসেছিল রাতুলের বাঁদিকে। ফলে সে লাফিয়ে উঠতে পারল না। সে একা রইল টিলায়। রক্তবীজ পিশাচ কবলিত টিলায় শুধুমাত্র বর্শা হাতে দাঁড়িয়ে থাকা মানে নিশ্চিত মৃত্যু।
তোবারক আলী গালিচা আবার ঘুরিয়ে আনলেন ততক্ষণে রক্ত থেকে নতুন পিশাচেরা মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে এবং অন্য পিশাচেরা এগুতে শুরু করেছে। হারিরি হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল। রাতুল একটা পিশাচের বুকে বর্শা বিদ্ধ করে লাফিয়ে হারিরির হাত ধরল। হারিরির হাতে ধরা ঝুলন্ত রাতুলকে নিয়ে গালিচা উড়ে গেল।
তোবারক আলী বললেন, “শাবাশ!”
হারিরির হাত ধরে রাতুল গালিচায় উঠল। আর এদিকে পিশাচেরা টিলায় উঠে ফোঁসফোঁস শব্দে পরাজিত আক্রোশে লাফাতে লাগল। গালিচা উড়ে চলল তুরন পাহাড়ের দিকে।
অধ্যায় পনের
জাদুকর মাহমুদ গ্রহ নক্ষত্রের হিসাব করে দেখলেন সব কিছু মিলে যাচ্ছে। তার বন্দি থাকার দিন ফুরিয়ে এসেছে। হারিরি মুক্ত হয়েছে কোবিলাই এর প্রায় দুর্গম বন্দিশালা থেকে। অসম্ভব কাজ সম্ভব হয়েছে। তাহলে এবার কি কালো জাদু সম্রাট হতে চাওয়া কোবিলাই এর পতন হবে?
জাদুকর মাহমুদের গুহায় জাদুর গালিচায় ভর করে এসে প্রবেশ করলেন তোবারক আলী, হারিরি, রাতুল এবং আকাশ।
জাদুকর মাহমুদ তোবারক আলীকে বললেন, “আপনি জাদু সম্রাট নিকোলাই পুত্র হারিরিকে নিয়ে বিন্ধ্রপর্বত ত্যাগ করার সঙ্গে সঙ্গে গ্রহ নক্ষত্রদের গতিপথ বদলে গেছে। এটা দেখেই আমি বুঝতে পেরেছি আপনি চলে আসছেন।”
তোবারক আলী রাতুল, আকাশ এবং হারিরির দিকে ইঙিত করে বললেন, “আমি কিছু করি নি। সব কৃতিত্ব এদের।”
হারিরি এগিয়ে গিয়ে জাদুকর মাহমুদের হাতে নীলপদ্ম দিতে দিতে বলল, “এটা আপনাকে বন্দিদশা থেকে উদ্ধার করবে।”
জাদুকর মাহমুদ নীলপদ্মটি হাতে নিলেন। অনেকদিন ধরে তিনি এর অপেক্ষায় আছেন। আজ এই নীলপদ্মের সাহায্যে তিনি বন্দি অবস্থা থেকে মুক্তি পাবেন। জাদুকর মাহমুদ একবার তার ছেলে আকাশের দিকে তাকালেন। ছেলেটার সঙ্গে তার দীর্ঘদিন দেখা হয় নি এখানে বন্দি থাকার কারণে।
জাদুকর মাহমুদের গুহার মশালের পাশে বসেছিল হীরামন পাখি। মাহমুদ ইশারা করতেই সে সামনে এসে বসল। জাদুকর মাহমুদ বললেন, “এখন আমি হীরামন পাখিকে নিয়ে একটি মন্ত্র বলব। এরপর তার সামনে নীলপদ্মটি দিলে সে একে ঠোকরে খাবে। যদি সত্যি সত্যি এটি সেই কালো জাদু কাটানোর নীলপদ্ম হয়ে থাকে তাহলে তুরন পাহাড় ঘিরে যে কালো জাদুর জাল বিস্তার করে আমাকে আটকে রেখেছে কোবিলাই, তা ভেঙে যাবে।”
জাদুকর মাহমুদ গম্ভীর স্বরে হীরামন পাখিকে উদ্দেশ্য করে মন্ত্র বলা শুরু করলেনঃ
রূপকথার হীরামন পাখি
তুমি জাদু জগতের বিস্ময়, খোলে রাখো আলোকিত দুই আঁখি
যেখানে তমসা ঘনায়ে আসে
যেখানে ঘিরে আসে কালবৈশাখীর মত অভিশাপ
নাল নীল সাদা কালো অদ্ভুত পাপ
সেখানে তুমি ফিরিয়ে নিয়ে আসো সোনালী সকাল
ভরে দাও মায়ায় মোদের অন্তরের জীর্ন দেয়াল
নিয়ে আসো নিস্তরঙ্গ আলোকিত দিন
অবিচার, অন্যায় মিলায় হয়ে ক্ষীণ, অতিক্ষীণ
তোমার ডানায় করে ভর
দুর্দিনের সন্ধ্যার পরপর
উদ্বেলিত করে আকাশ বাতাস পাতালপুরী
সৌভাগ্যের বার্তায় উদ্ভাসিত হয় এই মায়াপুরী
তুমি বিস্ময়! হে পাখি! হে বিপদ বিণাশী বিহঙ্গম!
তুমি বন্ধু আমাদের! প্রিয়, অতি প্রিয় নিজ প্রাণের সম!
মন্ত্র পড়ার পর তিনি নীলপদ্মটি হীরামন পাখির সামনে মেলে ধরলেন। পাখিটি কিছুক্ষণ নীলপদ্মের দিকে তাকিয়ে থাকল। তারপর ধীরে ধীরে ঠোকর বসাতে লাগল। প্রতিটি ঠোকরের সঙ্গে তুরন পাহাড়ে ঝলসে উঠছিল বিদ্যুৎ।
প্রায় এক মিনিটের মধ্যেই সম্পূর্ণ নীলপদ্ম খেয়ে ফেলল হীরামন পাখি। তারপর সে খুব অদ্ভুতভাবে উপরের দিকে তাকিয়ে হা করে এক হুংকার ছাড়ল। হাজার হাজার ছোট কালো পোকার মত বস্তু বেরিয়ে যেতে থাকল তার মুখ থেকে। এ এক অদ্ভুত দৃশ্য! রাশি রাশি কালো পোকার মত বস্তু হীরামন পাখির মুখ থেকে উড়ে যাচ্ছে। এভাবে চলল প্রায় মিনিটখানেক। এরপর হীরামন পাখি স্বাভাবিকভাবে কয়েকবার ডানা ঝাপটে উড়ে গিয়ে বসল মশালের ধারে।
জাদুকর মাহমুদ হাসিমুখে বললেন, “জাদু কেটে গেছে। আমি এখন তুরন পাহাড়ের বাইরে যেতে পারব। তোবারক আলী সাহেব, এখনি আমাদের কোবিলাইকে আঘাত করতে হবে। আমি গ্রহদের গতিবিধি লক্ষ করে দেখেছি। এখনই তার খারাপ সময়। এছাড়া আমরা যদি এখন সামান্য দেরী করি তাহলে সে তৈরি হয়ে আমাদের উপর আক্রমণ করবে। হারিরিকে ছিনিয়ে নিয়ে হত্যা করবে।”
তোবারক আলী বললেন, “কিন্তু এর আগে আমাদের তো রাজপ্রাসাদের জাদুকরদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে। তাদের মতামত কী জানা দরকার। তাদের মতের ব্যাপারে আমি কিছু জানি না।”
জাদুকর মাহমুদ বললেন, “আমি আমার হীরামন পাখি ব্যবহার করে রাজপ্রাসাদের অভিজাত জাদুকরদের সঙ্গে যোগাযোগ রেখেছি সবসময়। তারা কোবিলাই এর রাজত্ব কখনোই মেনে নেবেন না। কালো জাদুর অধীনে জাদু রাজ্য চলে গেলে তাদের ক্ষমতাও কিছু থাকবে না। একবার কোবিলাই জাদু রাজ্যের সম্রাট হয়ে গেলে কালো জাদুকরদের রাজপ্রাসাদের জাদুকর রূপে নিয়োগ দেবে। তখন পুরাতন জাদুকরদের অবস্থান হবে অগ্নিসমুদ্রে।”
তোবারক আলী বললেন, “তারা কি আমাদের সাহায্য করবেন?”
জাদুকর মাহমুদ বললেন, “আমরা যদি আক্রমণ করি তাহলে অবশ্যই করবেন। কোবিলাইকে কেউই পছন্দ করেন না, কিন্তু ভয় পান। বিড়ালের গলায় ঘন্টা আমাদেরই বাঁধতে হবে।”
জাদুকর মাহমুদের জাদু ক্ষমতা সম্পর্কে শুনেছিল রাতুল। সে জাদুকর মাহমুদকে জিজ্ঞেস করল, “আপনি কি আমাকে একটু সাহায্য করতে পারবেন?”
জাদুকর মাহমুদ আগ্রহী কন্ঠে বললেন, “অবশ্যই রাতুল। কী সাহায্য বলো?”
রাতুল বলল, “আমরা জাদুরাজ্যে যখন এসেছিলাম তখন হাতিপাড়ার হাতিরা আমাদের সাহায্য করেছিল। সম্ভবত এর জন্য কোবিলাই এর গন্ডারেরা হাতিপাড়া আক্রমণ করেছে। আমি তাদের বর্তমান অবস্থা জানতে চাই।”
জাদুকর মাহমুদ বললেন, “এটা কোন ব্যাপারই না”। বলে তিনি তার সামনে রাখা একটি ঝুড়ি থেকে কিছু কাঠের গুঁড়ার মত বস্তু নিয়ে শূন্যে ছুঁড়ে দিলেন। তাতেই কাজ হল। গুঁড়াগুলো গোল হয়ে বৃত্ত তৈরি করল। এর ভিতরে ফুটে উঠল হাতিপাড়ার দৃশ্য।
সমস্ত এলাকা তছনছ হয়ে গেছে। বড় বড় শিংওয়ালা হিংস্র গন্ডারেরা তুমুল বেগে ঝাঁপিয়ে পড়ছে হাতিদের উপরে। হাতিরাও বিপুল বিক্রমে পালটা আঘাত করছে। এ এক ভয়াবহ যুদ্ধ!
তোবারক আলী বললেন, “আমার মনে আছে আগে একবার গন্ডারদের সঙ্গে হাতিদের যুদ্ধ হয়েছিল। তখন অবশ্য কোবিলাই এর জাদু শক্তি ছিল না গন্ডারদের সঙ্গে। তখনো যুদ্ধ স্থায়ী হয়েছিল একটানা তিনবছর। আর এবার যেহেতু কোবিলাই এর জাদুশক্তি আছে, বলা যায় না কী হয়।”
জাদুকর মাহমুদ বললেন, “ভুলে যাবেন না, হাতিদের মধ্যেও জাদুকর আছেন। যুদ্ধে উভয় পক্ষই শক্তিশালী। কিন্তু আমার ভয় হচ্ছে শিশুদের নিয়ে। ওরা তো দীর্ঘমেয়াদি যুদ্ধে বেঘোরে মারা পড়বে।”
রাতুল একই কথাই ভাবছিল। হাতিপাড়া এবং হাতিদের প্রতি তার মায়া জন্মে গেছে। সে বলল, “এ যুদ্ধ থামানো যায় না?”
জাদুকর মাহমুদ বললেন, “থামাতে হলে গন্ডারদের নিষ্ক্রিয় করতে হবে জাদুশক্তির সাহায্যে।”
রাতুল বলল, “তাহলে তাই করুন।”
তোবারক আলী বললেন, “কিন্তু তাহলে তো কোবিলাই টের পেয়ে যাবে আমরা তার বিরুদ্ধে যুদ্ধে নামছি। কারণ গন্ডারদের উপর তার কালো জাদু শক্তির পাহারা আছে।”
জাদুকর মাহমুদও ভাবছিলেন কী করবেন। জাদু ব্যবহার করে গন্ডারদের নিষ্ক্রিয় করলে সে তথ্য সঙ্গে সঙ্গেই পৌছে যাবে সরাসরি কোবিলাই এর কাছে। সে বুঝে ফেলবে জাদুকর মাহমুদ মুক্ত হয়েছেন। কারণ তিনি ছাড়া কোবিলাইয়ের কালো জাদুশক্তির জাল কাটিয়ে গন্ডারদের নিষ্ক্রিয় করা অসম্ভব ব্যাপার।
রাতুল, হারিরি এবং আকাশ একযোগে অনুরোধ করল জাদুকর মাহমুদকে জাদু শক্তিকে ব্যবহার করে গন্ডারদের থামানোর জন্য। শেষপর্যন্ত মাহমুদ রাজি হলেন। তিনি গুহায় অগ্নিকুন্ডলী তৈরি করে কিছু কাঠের গুঁড়ার মত বস্তু ফেলে দিলেন। সেখানে গোলাকৃতির একটা দরজা তৈরি হল। মাহমুদ বললেন, “এই দরজা দিয়েই আমরা এক মুহুর্তে হাতিপাড়ায় যেতে পারব। সেখানে গিয়েই আমি গন্ডারদের নিষ্ক্রিয় করব। সবাই আমার পিছু পিছু দরজা দিয়ে প্রবেশ করবে।”
জাদুকর মাহমুদ হীরামন পাখি কাঁধে নিয়ে দরজা দিয়ে চলে গেলেন। তারপর গেল রাতুল, আকাশ, হারিরি এবং সবশেষে তোবারক আলী।
রাতুল এক পা দিয়েই দেখল সে হাতিপাড়ায় চলে এসেছে। যুদ্ধ চলছে ধুন্ধুমার। জাদুকর মাহমুদ সামনে চলে গেছেন। তিনি গন্ডারদের উদ্দেশ্য করে কী যেন বিড়বিড় করছেন আর গন্ডারেরা নিষ্ক্রিয় হয়ে যাচ্ছে।
তোবারক আলী আসতে আসতে প্রায় সব গন্ডার নিষ্ক্রিয় হয়ে সুবোধ বালকের মত ফিরে যেতে লাগল। হাতিপাড়ায় শুরু হল হই হই বিজয়োল্লাস।
এক শুঁড়ওয়ালা হাতি স্লোগান দেয়া শুরু করতেই অন্য অনেকে তার সঙ্গে যোগ দিল,
“জিতিলো রে জিতিলো
হাতিপাড়া জিতিলো”
“গন্ডারের চামড়া
তুলে নেম আমরা”
“চারিদিকে একী শুনি
হাতিপাড়ার জয়ধ্বনী”
“হই হই হই হই
গন্ডারলীগ গেলো কই?”
ইত্যাদি বিভিন্ন ধরনের স্লোগান। হইহুল্লোড়ের ভেতর নিজের দুর্বল পায়ে ভর করে গুহা থেকে বেরিয়ে এলেন সেই বৃদ্ধ জাদুকর হাতি। তিনি তাঁর দাড়ি শুঁড় দিয়ে নেড়ে ক্ষীণ কন্ঠে বললেন, “তোমরা এসব কী শুরু করেছ? পরাজিত শত্রুকে ক্ষমা করতে হয়।”
বৃদ্ধ হাতির এ কথায় স্লোগান দিতে থাকা হাতিরা বেশ লজ্জা পেল। তারা চুপ মেরে গেল। তখন বৃদ্ধ হাতি বললেন, “যাদের জন্য তোমরা যুদ্ধে জিতলে সেই জাদুকর মাহমুদ ও তার সঙ্গীরা দাঁড়িয়ে আছেন। তোমরা তাদের দিকে লক্ষ না দিয়ে উল্লাসে মেতেছ!”
তারপর তিনি এগিয়ে জাদুকর মাহমুদের কাছে গিয়ে বললেন, “আপনি না হলে হাতিপাড়ায় আরেকটি বড় যুদ্ধের মধ্যে থাকত অনেকদিন। আপনাকে ধন্যবাদ।”
জাদুকর মাহমুদ বললেন, “আপনার কথা অনেক শুনেছি জাদুকর হাতি। জাদু জগতে আপনার অবদান অনেক। আপনাদের সামান্য সাহায্য করতে পেরে আমি কৃতার্থ বোধ করছি।”
বৃদ্ধ হাতি বললেন, “আপনি নিশ্চয়ই কালো জাদুকর কোবিলাইকে ধ্বংস করতে নেমেছেন। সমস্ত হাতিপাড়া আপনার সঙ্গে থাকবে। আর আপনি কী ব্যাঙদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন?”
জাদুকর মাহমুদ বললেন, “না। পানির নিচে আমি যেতে পারি না।”
তোবারক আলী জিজ্ঞেস করলেন, “ব্যাঙদের কাছে কেন?”
বৃদ্ধ হাতি বললেন, “ব্যাঙদের কাছ থেকে কিছু তথ্য জানতে হবে। জাদুকর মাহমুদ তুরন পাহাড়ে বন্দি ছিলে। আমার চারপাশে ছিল কালো জাদুর জাল। এরই মধ্যে কোবিলাই কালো জাদুর জগতে অনেক কিছু করে ফেলেছে
নিশ্চয়ই। সেসব জানতে হবে ব্যাঙদের কাছ থেকে। জাদু রাজ্যে একমাত্র তারাই বলতে পারবে কীভাবে কোবিলাইকে ধ্বংস করা সম্ভব।”
তোবারক আলী বললেন, “আমিও তো পানির নিচে যেতে পারি না।”
হারিরি বলল, “আমি যেতে পারি। আমার সঙ্গে রাতুল এবং আকাশও যেতে পারবে। তারা এখনো স্থল কিংবা জলের জাদুর মধ্যে একটাকে গ্রহণ করে নি। তাদের কোন জাদু শিক্ষা নেই।”
জাদু রাজ্যে যেসব মানুষের যাতায়াত আছে তারা স্থল এবং জলের জাদুর মধ্যে যেকোন একটাকে গ্রহণ করে শিক্ষা নেন। যারা স্থলের জাদু শিক্ষা নেন তারা পানির নিচে যেতে পারেন না। যারা জলের জাদু বিদ্যা নেন তারা স্থলে সে জাদু বিদ্যার প্রয়োগ ঘটাতে পারেন না।
জাদুকর মাহমুদ বললেন। “তাহলে তো ঠিক আছে। তবে আমি বুঝতে পারছি না তোমরা গিয়ে কিছু করতে পারবে কি না।”
বৃদ্ধ হাতি বললেন, “ব্যাঙদের সঙ্গে কখনোই যুদ্ধে জড়াবে না। ওদেরকে বুঝিয়ে বলবে। মনে রাখবে তারা জাদু রাজ্যের অন্যতম শক্তিশালী প্রাণী।”
রাতুল, আকাশ এবং হারিরি জাদুর গালিচায় উঠে দাঁড়াল। হারিরি গালিচাকে বলল, “যাও সুলেমান বাদশাহর গালিচা, ব্যাঙদের দেশে যাও।”
গালিচা নড়ে উঠল এবং শূন্যে ভেসে উঠল তাদের নিয়ে। তারপর উড়ে যেতে লাগল নীল সমুদ্রের দিকে। দ্রুত উড়ে পৌছে গেল সমুদ্রে। সমুদ্রে পৌছে খুব শান্তভাবেই পানিতে ডুবে গেল। আর রাতুল, আকাশ এবং হারিরি দেখতে লাগল পানির নিচের জগতের অদ্ভুত সব দৃশ্য।
বিকট দর্শন সব মাছ। কোনটা ঘোড়ার মত, কোনটা শেয়ালের মত, কোনটা বকের মত লম্বা ঠোঁটওয়ালা। বিরাট বিরাট কয়েকটি জলহস্তী কয়েকটি সিলমাছকে তাড়া করছে।
আকাশ জিজ্ঞেস করল, “আমাদের নিঃশ্বাস নিতে কষ্ঠ হচ্ছে না কেন?”
হারিরি উত্তর দিল, “জাদু রাজ্যে পানির নিচের জগত অন্যরকম। গালিচা আমাদের সরাসরি নিয়ে যাবে ব্যাঙদের দেশে।”
গালিচা পানির নিচেও আকাশে ওড়ার মত ভাসতে ভাসতে একটি টিলার পাশে গিয়ে থামল। পানির উপরের জগতের মত এখানেও বেশ স্পষ্টভাবে সব কিছু দেখা যায়। তবে এটা যে পানির নিচের দেশ তাও বুঝা যায়। কিন্তু গায়ে পানি লাগছে না।
রাতুল বলল, “আমরা বোধহয় ব্যাঙদের দেশে এসে গেছি।”
দেখা গেল একটি প্রায় ছ’ফুট লম্বা ব্যাঙ দু পায়ে মানুষের মত হেটে হেটে এগিয়ে আসছে।
সে গালিচার সামনে দাঁড়িয়ে বলল, “তোমরা কারা? এখানে কি চাও?”
হারিরি বলল, “আমি জাদু সম্রাট নিকোলাই পুত্র হারিরি। তোমাদের কাছ থেকে কিছু তথ্য জানতে এসেছি।”
ব্যাঙ বলল,”তোমরা কী হাতিদের কাছ থেকে এসেছ? গায়ে হাতির গন্ধ দেখতে পাচ্ছি।”
হারিরি বলল, “জাদুকর বৃদ্ধ হাতি তোমাদের কাছে আসতে বলেছেন।”
ব্যাঙটি এবার বেশ গুরুত্ব সহকারে তাকাল। আরো দুটি ব্যাঙ এসে জড়ো হয়েছে তার কাছে।
ব্যাঙ বলল, “কি জানতে চাও তোমরা?”
হারিরি বলল, “তোমাদের নিশ্চয়ই জানা আছে কালো জাদুকর কোবিলাই জাদু রাজ্যের সম্রাট হতে চাইছে অন্যায়ভাবে। আমরা তার সম্পর্কে তথ্য জানতে চাই। আমরা তাকে ধ্বংস করব।”
ব্যাঙ বলল, “কিন্তু আমরা কীভাবে বিশ্বাস করব তোমরা বৃদ্ধ জাদুকর হাতির কাছ থেকেই এসেছ?”
রাতুল, আকাশ এবং হারিরি এর উত্তর কি দিবে ভেবে পেল না।
ছবিঃ ইন্দ্রশেখর