লেখকের আগের উপন্যাসঃ নরসের বারে বারে আসে
কালার আউট অব স্পেসঃ এইচ পি লাভক্র্যাফট। অনুবাদঃ দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য
আখরামের পশ্চিমে পাহাড়গুলো এখনো বেশ বুনো। এখনো ও চত্বরে এমন অনেক উপত্যকা রয়েছে যার জঙ্গলে কোন কাঠুরের কুড়ুলের ছোঁয়া পৌঁছোয়নি। অন্ধকার, খাড়াই ঢালগুলোর গায়ে কাত হয়ে ঝুলে থাকা মহীরুহদের ছায়ায় ছায়ায় বয়ে যাওয়া অনেক জলধারাই সূর্যের মুখ দেখে না কখনো। তুলনায় কম খাড়াই ঢালগুলোর গায়ে ছোটো ছোটো খামার; তাদের পাথুরে জমির বুকে শ্যাওলাধরা ঘরগুলো, নিউ ইংল্যাণ্ডের প্রাচীন রহস্যদের বুকে নিয়ে পাহাড়ের পাথুরে কোলে বুঁদ হয়ে থাকে। বাড়িগুলো এখন পরিত্যক্ত। তাদের দেয়াল থেকে প্লাস্টারের প্রলেপ খসে পড়েছে। অব্যবহৃত চিমনিগুলো ভেঙে পড়ছে নিচু, দোচালা ছাদের গায়ে।
এ বাড়িদের আদি বাসিন্দারা অনেক কাল হল চলে গেছে। ভিনদেশিরা জায়গাটাকে পছন্দ করে না। ফরাসি-কানাডিয়ানরা এখানে ডেরা বাঁধবার চেষ্টা করেছিল। পারেনি। চেষ্টা করে হাল ছেড়ে দিয়ে চলে গেছে ইটালিয়ান আর পোলরাও।
না, ধরাছোঁয়া যায় এমন কোন সমস্যা তাদের কাউকেই বিব্রত করেনি। বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল কিছু কাল্পনিক ভয়। কল্পনাপ্রবণদের জন্য জায়গাটা ঠিক সুবিধের নয়। ওখানে থাকতে গেলে মানুষ রাতে দুঃস্বপ্ন দেখে। জায়গাটা পরিত্যক্ত হবার একমাত্র কারণ সম্ভবত সেটাই, কারণ বুড়ো অ্যামি পিয়ার্স তাদের কখনো তাদের সেখানকার পুরোনকালের জাদুর দিনগুলোর কোন গল্প শোনায়নি।
ও এলাকার আদি বাসিন্দাদের মধ্যে একমাত্র এই অ্যামিই টিকে গেছে জায়গাটাতে। লোকটার মাথায় খানিক গণ্ডগোল আছে। তাছাড়া তার বাড়িটা জায়গাটার একেবারে একটেরেতে আখরামের রাস্তাঘাটগুলোর লাগোয়া হওয়াটাও হয়ত তার ওখানে টিকে যাবার আরেকটা কারণ।
একসময় পাহাড় উজিয়ে, উপত্যকাগুলোকে চিরে একটা রাস্তা ওর মাঝখানে ছড়িয়ে থাকা পোড়ো এলাকাটায় গিয়ে ঢুকত। তবে লোকজন ও রাস্তাটায় চলাফেরা বন্ধ করে দিয়ে ওর অনেকটা দক্ষিণ দিয়ে বেঁকে যাওয়া একটা নতুন রাস্তা বানিয়ে নিয়েছে। আস্তে আস্তে ছেয়ে আসা ঝোপঝাড়ের মধ্যে দিয়ে পুরোনো রাস্তাটার চিহ্ন ইতিউতি চোখে পড়ে এখনো। নতুন জলাধারটা তৈরি করবার জন্য ও এলাকার অর্ধেকটা জলের নিচে চলে গেলেও মনে হয় সে রাস্তার খানিকখানিক চিহ্ন জেগে থাকবে। তারপর ওর অন্ধকার জঙ্গলগুলো কাটা পড়বে। পোড়ো এলাকাটা নীল জলের অনেক নীচে তার সব রহস্যকে নিয়ে ঘুমিয়ে পড়বে। জলের বুকে মেঘ আর আকাশের ছায়ায় তার কোন চিহ্ন থাকবে না আর। পুরোনোদিনের বিচিত্র সব স্মৃতি তখন গভীর জলের বুকে লুকিয়ে থাকা রহস্য হয়ে যাবে। আদিম পৃথিবীর বহু রহস্যের মতই আরেকটা সাগরতলের রহস্য হয়ে তা বেঁচে থাকবে মানুষের লৌকিক সাহিত্যে।
নতুন জলাধারের জন্য জরিপের কাজ করতে আমি যখন সে পাহাড়ে গিয়েছিলাম, সেখানকার লোকজন আমায় বলেছিল জায়গাটা অশুভ। কথাগুলো বলেছিল আখরামের লোকজন। সে জায়গাটা কুসংস্কারের পুরনো আখড়া। কাজেই আমি ধরে নিয়েছিলাম, শতাব্দির পর শতাব্দি ধরে গ্রামের বৃদ্ধাদের মুখেমুখে চলে আসা গালগল্পই হবে সে’সব। ‘বাজপড়া মাঠ’ এর মত একটা নাটুকে নাম প্রচলিত লোককথায় কীকরে ঢুকে এল সে নিয়ে একটু অবাকও হয়েছিলাম বইকি।
জায়গাটা শহরের পশ্চিমদিকে। ছায়াছায়া অজস্র উপত্যকা আর ঢাল সেখানে জড়াজড়ি করে থাকে। সে জায়গায় প্রথম পা দিয়েছিলাম একটা ঝকমকে সকালে। কিন্তু তখনো সেখানে ঘন ছায়া জড়িয়ে আছে। গাছগুলো গায়েগায়ে ঘেঁষে দাঁড়ানো। নিউ ইংল্যান্ডের গাছগাছালির তুলনায় তাদের গুঁড়িগুলো বেজায় মোটা। তাদের ফাঁকেফাঁকে ছড়িয়ে থাকা আবছায়া গলিগুলো বড়ো বেশি চুপচাপ। অসংখ্য বছর ধরে জমে ওঠা পচা শ্যাওলার স্তূপে সে জায়গার মাটি তলতলে হয়ে আছে।
পুরোনো রাস্তাটার টুকরোটাকরাগুলোর ধার ঘেঁষে ছোটোছোটো কিছু খামার চোখে পড়ছিল। তাদের কোনটায় একটাদুটো ঘরবাড়ি তখনো দাঁড়িয়ে আছে। কোথাও বা ধ্বসে পড়া ইটপাথরের ফাঁকে ভরাট হয়ে আসতে থাকা সেলারের অবশিষ্টাংশ হাঁ করে আছে আকাশের দিকে। তাদের ওপর লতাপাতা, কাঁটাঝোপের ভিড়। তাদের ফাঁকেফাঁকে বুনো জীবদের চলাফেরার শব্দ।
আর– গোটা এলাকাটার ওপর একটা অস্বস্তিকর অনুভূতি কুয়াশার মত ছড়িয়ে ছিল। জায়গাটাকে জুড়ে থাকা আলোছায়ার জাফরিটার মধ্যে কিছু একটা যেন অলক্ষ্যে অপেক্ষায় আছে। বারবার আমার মনে হচ্ছিল, নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়বার মত জায়গা এ নয়! বারবার মনে হচ্ছিল, যেন সালভাটর রোজার কোন ভয় ধরানো ছবির মধ্যে সশরীরে এসে দাঁড়িয়েছি আমি।
তবে ‘বাজপড়ার মাঠ’ জায়গাটার সঙ্গে এ’সব জায়গার কোন তুলনাই চলে না। একটা প্রশস্ত উপত্যকার একেবারে মাঝখানে ছড়িয়ে থাকা সে জায়গাটায় পা দেবামাত্র অকারণেই শরীর শিউরে উঠেছিল আমার। সেদিকে একনজর চোখ ফেলেই মনে হয়েছিল, এ ছাড়া আর কোন নাম এ জায়গাকে মানাবে না।
বনপাহাড়ের সবুজ-বাদামী ক্যানভাসের বুকে কে যেন একদলা অ্যাসিড ফেলে প্রায় পাঁচ একর মতন জায়গা পুড়িয়ে ছাই করে দিয়েছে। সম্ভবত কোন দাবানলের ফল। কিন্তু—তাই যদি হবে, তাহলে দাবানলের পর ধূসর জায়গাটায় একটা ঘাসের কুঁচিও গজিয়ে উঠল না কেন? প্রশ্নটা মাথায় জাগতেই একটা মৃদু শিরশিরাণি ছড়িয়ে গেল আমার শরীরে।
জায়গাটার দিকে এগোতে পা সরছিল না প্রথমে। তবে, জরিপের কাজে এসে একটা জায়গাকে বাদ দিয়ে চলে আবার কোন অর্থ হয় না। কাজেই খানিক বাদে সাময়িক দুর্বলতাটাকে ঝেরে ফেলে, একরকম জোর করেই আমি পা বাড়ালাম সেদিকে। গোটা মাঠটার বুক জুড়ে ধূসর রঙের মিহি ধুলো বা ছাইয়ের পুরু আস্তর। মাঠের চৌহদ্দি ঘিরে দাঁড়িয়েছিল পচে ওঠা অসংখ্য গাছের গুঁড়ি। তাদের ফাঁকে ফাঁকে ক্বচিৎ দু’একটা জীবন্ত, গাছ। রুগ্ন, ক্ষয়াটে চেহারা নিয়ে ধুঁকছে।
মাঝবরাবর এসে চোখে পড়ল, সেখানে একটা পুরোনো চিমনি আর সেলারের ধ্বংসাবশেষ পড়ে আছে। তার ভেঙে পড়া ইটের পাঁজার পাশে একটা কুয়োর গভীর অন্ধকার মুখ। পচা জল থেকে উঠে আসা বাষ্প সূর্যের আলোয় তিরতির করে কাঁপছিল। তার মধ্যে ফুটে থাকা বিচিত্র রঙটা যে ঠিক কোন রঙ তা ধরা যায় না। জায়গাটায় দ্বিতীয় কোন ঘরবাড়ির চিহ্ন নেই। সম্ভবত পুরোনোদিনেও এ জায়গাটার বদনাম ছিল কোন।
গোটা পরিবেশটা এতটাই অস্বস্তিকর যে সন্ধের মুখমুখ ফেরবার পথে আমি মাঠ ছেড়ে দক্ষিণের ঘোরানো পথ ধরে আখরামে ফিরে এসেছিলাম সেদিন। আকাশটা এত ফাঁকা যে মনে হচ্ছিল সেখানে খানিক মেঘ ছেয়ে এলেও বোধ হয় একটু স্বস্তি পাব।
সেদিন সন্ধেবেলা আমি আখরামের পুরোনো লোকজনকে মাঠটা নিয়ে কিছু জিজ্ঞাসাবাদ করেছিলাম। জানতে চেয়েছিলাম, লোকজন যে পুরোনকালের ‘জাদুর দিন’ গুলোর কথা নিয়ে ফিসফাস করে এ অঞ্চলে তারই বা অর্থ কী?
জবাবে বেশি কিছু জানতে পারিনি আমি সেদিন। শুধু বোঝা গিয়েছিল, গোড়ায় যা ভেবেছিলাম, রহস্যটার বয়স তার চেয়ে অনেকটাই কম। পুরোনো কোন লোককথা নয়, বরং সে দিনগুলো দেখেছেন এমন অনেকেই এখনো বেঁচেবর্তে আছেন এ তল্লাটে। ঘটনাটা ঘটেছিল ‘আশি’র দশকে। একটা গোটা পরিবার সেবার ওখান থেকে হারিয়ে যায় বা গুমখুন হয়। তবে সে ব্যাপারে একেকজন একেকরকম কথা বললেও, একটা ব্যাপারে তারা সবাই একই কথা বলেছিল আমায়। তা হল, আধপাগলা অ্যামি পিয়ার্সের গালগল্পে যেন আমি মোটেই বিশ্বাস না করি।
অতএব পরদিন আমি অ্যামি পিয়ার্সকেই খুঁজে বের করলাম গিয়ে। রহস্যময় এলাকাটার একেবারে বাইরের সীমানায়, যেখানে গাছগাছালি সবে ঘন হয়ে উঠছে, সেইখানটায় একটা পুরোনো, জরাজীর্ণ বাড়িতে তার আস্তানা। জায়গাটা ঘিরে প্রাচীন কোন কবরখানার মত গন্ধ।
দরজায় বেশ কয়েকবার ধাক্কা দিতে তবে বুড়োর ঘুম ভাঙল। এলোমেলো পায়ে এগিয়ে এসে দরজা খুলে দিতে তার মুখ দেখে বুঝলাম, আমাকে দেখে মোটেই খুশি হয়নি সে। ভালো করে খেয়াল করে দেখা গেল, প্রথম দৃষ্টিতে যতটা দুর্বল লাগে তাকে ততটা খারাপ দশা তার মোটেই নয়। আধবোঁজা চোখ, গায়ের ছেঁড়াখোঁড়া পোশাক আর এলোমেলো চুলদাড়ির জন্যই আসলে অতটা বিধ্বস্ত লাগে তাকে।
কাজের কথাটায় কীভাবে আসব বুঝতে না পেরে আমি ভান করলাম যেন কোন লেনদেনের কাজে তার কাছে এসেছি। আমার জরিপের কথাটা জানিয়ে এলাকাটার বিষয়ে তাকে কয়েকটা ভাসা ভাসা প্রশ্ন করলাম। দেখা গেল লোকটাকে দেখতে ও’রকম হলেও আসলে বেশ বুদ্ধি রাখে। পড়াশোনার দৌড়ও কম নয়। জরিপের কথা একটু আধটু বলতেই বিষয়টা সে চট করে যেভাবে ধরে নিল, আখরামের কোন মানুষের কাছে আমি ততটা আশা করিনি। এতগুলো খামার, জঙ্গল সব যে জলে ভেসে যাবে তাইতে আখরামের আর দশটা লোকের মত কোন আক্ষেপও সে করল না। বরং মনে হল খবরটা শুনে স্বস্তিই পেয়েছে খানিক। যেন গোটা এলাকাটা জলের নিচে তলিয়ে গেলেই সে খুশি হয়।
আমি সুযোগটা লুফে নিতে দেরি করলাম না। কেন সে বাঁধের খবর শুনে এত খুশি সেটা জিজ্ঞাসা করতে বুড়োর চোখদুটো ঝলসে উঠেই নিভে গেল। তারপর গলা নিচু করে, আমার দিকে ঝুঁকে এসে ডানহাতের তর্জনিটা উঁচিয়ে ধরে সে হড়বড় করে কথা বলতে আরম্ভ করে দিল।
সে সন্ধেয়, ঘরঘরে গলায় ফিসফিস করে সে যে গল্পটা আমায় শুনিয়েছিল, সে গল্প কোন সাধারণ ভূতের কাহিনি নয়। মেরুদণ্ড হিম করে দেয়া সে গল্প চলতেচলতে মাঝেমাঝেই খেই হারিয়ে ফেলছিল সে। কখনো কখনো, প্রফেসরের বিজ্ঞানবিষয়ক কথাবার্তাগুলোর যে টুকরোটাকরা স্মৃতি তার মনে রয়ে গেছে সেগুলোকে জুড়ে গল্পের বৈজ্ঞানিক ভিত্তিটাকে বেশ কষ্ট করেই বুঝে নিতে হচ্ছিল আমায়। গল্পের মাঝে যে জায়গাগুলোতে তার যুক্তির ধারাবাহিকতা ভেঙে পড়েছিল, সেসব জায়গাকে কিছুটা অনুমান দিয়েও ভরাট করে নিতে হয়েছিল।
কিন্তু গল্পের শেষে একটা কথা আমি পরিষ্কার বুঝতে পেরেছিলাম, আখরামের মানুষজন ভুল বলেনি। যে অভিজ্ঞতা এর হয়েছে তারপর কোন মানুষই পুরোপুরি সুস্থ থাকতে পারে না। বুঝতে পারছিলাম, কেন আখরামের অশিক্ষিত লোকজন বাজপড়ার মাঠের নামে ভয়ে কেঁপে ওঠে।
সেদিন সূর্যাস্তের আগে আমি কোনমতে হোটেলে ফিরে আসি। পরদিন বস্টনে ফিরে এসে আমি আমার চাকরিতে ইস্তফা দিয়েছিলাম। ওই আদিম জঙ্গল আর আলোআঁধারী ঢালগুলোতে আর কখনো ফিরে যেতে চাই না আমি। বাজপড়া মাঠের মিহি ছাইয়ের আস্তরের বুকে জেগে থাকা ওই কুয়োটার কাছে আর একবারও গিয়ে দাঁড়াবার সাহস আমার নেই। শিগগিরই জলাধারটা তৈরি হয়ে যাবে। জলের গভীরে তলিয়ে যাবে ওই বাজপড়ার মাঠ। কিন্তু তবু ও এলাকায় আর একটাও রাত কাটাতে আমি রাজি হব না কোনদিন,বিশেষ করে যখন ওর আকাশে ওই ভয়ধরানো তারাগুলো জেগে উঠবে—লক্ষ ডলার দিলেও আমি আর কখনো আখরাম শহরের জল মুখে তুলতে সাহস পাব না—
অ্যামির কাহিনী
ঘটনাটা শুরু হয়েছিল একটা উল্কাপাত দিয়ে। ওর আগে জায়গাটা ভালই ছিল। ডাইনি হত্যার দিনগুলোর পর থেকে দীর্ঘকাল কোন উৎপাত হয়নি ওখানে। এমনকি সেই ডাইনিদের সময়েও মিসকাটোনিকের শয়তানের দ্বীপের তুলনায় ও জায়গাটাকে কম ভয় পেত লোকে। মিসকাটোনিকের যে আদিম যজ্ঞবেদির পাশে শয়তান স্বয়ং তাঁর দরবার বসাতেন, তেমন কোন জায়গার অস্তিত্ব ছিল না এই পাহাড়জঙ্গলে। জাদুর দিনগুলোর আগে এখানকার জঙ্গল ভূতুড়েও ছিল না, সন্ধেগুলোও তেমন ভয়ধরানো হত না।
তারপর ১৮৮২র এক জুনমাসের দুপুরবেলা জায়গাটার ওপরে ভেসে এল ধবধবে সাদা মেঘের দল। বাতাস কেঁপে উঠল পরপর বিস্ফোরণের শব্দে। দূরের উপত্যকার বুকে জেগে উঠল অতিকায় ধোঁয়ার স্তম্ভ। রাতের মধ্যে গোটা আখরাম জেনে গেল আকাশ থেকে বিরাট একটা পাথরের চাঁই নেমে এসে নাহুম গার্ডনারের উঠোনে কুয়োর পাশটায় মাটিতে পড়ে অর্ধেক গেঁথে গিয়েছে।
নাহুমের বাড়ি ঘিরে অনেকটা জমি জুড়ে ফুলফলের বিরাট বাগান ছিল একটা। এখন সেটা মিহি ছাইয়ের পুরু আস্তরমাখা পোড়ো জমি। খবরটা নাহুমই আখরামে এসে জানিয়ে গিয়েছিল সেদিন রাত্রে। আসবার পথে অ্যামি পিয়ার্সের বাড়িতে ঢুকেছিল সে কিছুক্ষণের জন্য।
অ্যামির বয়স তখন চল্লিশ। পরদিন, খবর পেয়ে মিসকাটনিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আসা তিন প্রফেসরের সঙ্গে সে তার বউকে নিয়ে আকাশ থেকে খসে পড়া পাথরটাকে দেখতে গিয়েছিল। পাথরটাকে দেখে অ্যামি একটু অবাক হয়। আগের দিন নাহুম যতটা বলেছিল, ততটা বড়ো মোটেই নয় পাথরটা।
নাহুম অবশ্য সে কথা মানতে একেবারে রাজি নয়। দিব্যিদিশেলা দিয়ে বলে, পাথরটা আদতে বিরাট বড়োই ছিল। নইলে তাকে ঘিরে তাকে ঘিরে থাকা কুয়োর পাশের পোড়া ঘাসের জমির বুকে গর্তটা অতটা বড় কেন হবে?
প্রফেসররা অবশ্য অ্যামির দিকেই মত দিয়েছিলেন। তাঁদের মতে, পাথর কখনো রাতারাতি অমন ক্ষয়ে যেতে পারে না। জিনিসটা তখনো ঠাণ্ডা অবধি হয়নি। নাহুম দাবি করেছিল, রাতে সে পাথরটাকে হালকা আলো দিতেও দেখেছে নাকি।
পাথরটা যে খানিক অদ্ভুত সেটা প্রফেসরদের মানতে হয়েছিল অন্য একটা কারণে। ওর গায়ে হাতুড়ি ঠুকতে গিয়ে তাঁরা দেখেন, জিনিসটা কিছুটা নরম। সাধারণ পাথরের মত শক্তপোক্ত জিনিস নয়। নরম প্লাস্টিকের মত বস্তুটার গা থেকে একটা টুকরো খসিয়ে নেবার বদলে তার একটা ছোটো দলা তুলে তাঁরা নিয়েছিলেন ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষা করবার নমুনা হিসেবে। তবে সে ছোট্ট টুকরোটারও ঠাণ্ডা হবার কোন লক্ষণ ছিল না। শেষে নাহুমের রান্নাঘর থেকে একটা বাটি জোগাড় করে তাইতে ভরে নমুনাটাকে নিয়ে যেতে হয় তাঁদের।
ফেরার পথে অ্যামির বাড়িতে একটু বিশ্রাম নেবার জন্য থেমেছিলেন প্রফেসররা। আর সেখানে বসে থাকতেথাকতেই অ্যামি হঠাৎ খেয়াল করে যে নমুনাটা আরো খানিক ছোটো হয়ে এসেছে আর বাটির নিচের দিকটাকে পুড়িয়ে দিচ্ছে আস্তে আস্তে। প্রফেসররা তাই শুনে একটু চিন্তায় পড়েন, তবে অ্যামির কথায় পুরোপুরি বিশ্বাস করেননি তাঁরা। বলেছিলেন, বোধ হয় যতটা ভেবেছেন তার থেকে খানিক কম নমুনাই তুলে এনেছিলেন তাঁরা পাথরটার গা থেকে।
এর দিনকয়েক পরে প্রফেসাররা যখন সেখানে ফিরে আসেন তখন তাঁরা খুব উত্তেজিত। অ্যামিকেও ফের তাঁরা সঙ্গে নিয়েছিলেন।
পথ চলতেচলতে, অ্যামির প্রশ্নের জবাবে তাঁরা বলেন, পাথরটার মাথামুণ্ডু কিছুই তাঁরা বুঝতে পারেননি। উলটে অদ্ভুতূরে সব আচরণ করে জিনিসটা তাঁদের তাক লাগিয়ে দিয়েছে। কাচ হেন সিলিকনের জিনিসপত্রের ওপরে বেজায় আসক্তি তার। কাঠকয়লার উনোনে গরম করতে তার থেকে কোন গ্যাস বের হয়নি। অক্সি হাইড্রোজেন ব্লো পাইপের তীব্র উত্তাপেও গলে যাওয়া দূরস্থান একটু টসকায়ওনি বস্তুটা।
রাসায়নিক পরীক্ষায় যেসব বস্তুর প্রয়োগ হয় তার সবকটার নাম অ্যামির মনে করে আমায় বলবার প্রশ্ন ছিল না, কিন্তু তার কথাবার্তা থেকে এইটুকু বোঝা যাচ্ছিল যে, সোহাগা থেকে নাইট্রিক অ্যাসিড, অ্যামোনিয়া থেকে কস্টিক সোডা, কেউ কোন ক্ষতি করতে পারেনি এর। গরম করে স্পেক্ট্রোমিটারের সামনে ওর আভা পরীক্ষা করে যেসব রঙের বর্ণালি এসেছে তাতে উল্কার সঙ্গে আসা লোহার যৌগ ছাড়া আর কোন চেনা মৌলের স্বাক্ষরই মেলে না।
তবে এইটুকু বোঝা গেছে, ওর মধ্যেকার অচেনা মৌলগুলো ধাতব। পেটালে পাতলা পাতে বদলে যায় জিনিসটা। সেইসঙ্গে চৌম্বকধর্মও আছে তার।
কয়েকদিন ধরে পরীক্ষানিরীক্ষা চালাবার পর আবিষ্কার করা যায়, কড়া অ্যাসিডে ভিজিয়ে রাখলে, আর কিছু না হোক জিনিসটা খুব আস্তে আস্তে ঠাণ্ডা হচ্ছে। আর সেইসঙ্গে, কোন রাসায়নিকের সঙ্গেই বিক্রিয়া না করলেও, তার ওজন কমে আসছে ধীরলয়ে। তা সেই পদ্ধতিতে খানিক ঠাণ্ডা করবার পর জিনিসটার টুকরোটাকরাগুলো এবারে কাচের পাত্রে এনে রাখা হয়। আর এইখানেই তার সিলিকনপ্রীতির ভেলকি দেখিয়ে দেয় ভূতুরে ধাতু। রাখবার পরদিন পরীক্ষাগারে গিয়ে দেখা যায়, কাচের তৈরি পরীক্ষাপাত্র সহ সম্পূর্ণ উধাও হয়েছে বস্তুটা। কাঠের টেবিলের ওপর যেখানে কাচের পাত্রটা রাখা ছিল, সেখানটায় কেবল একখানা পোড়া দাগ পড়ে আছে।
এবারে প্রফেসরদের সঙ্গে যাত্রায় অ্যামি তার বউকে সঙ্গে নেয়নি আর। অকুস্থলে গিয়ে দেখা গেল, পাথরটা ইতিমধ্যে ক্ষয়ে গিয়ে আরো ছোটো হয়ে গেছে। আগের দিন যে পাথর প্রায় সাত মিটার চওড়া ছিল, এবারে তার ব্যাস ছোটো হয়ে পাঁচ মিটারমত হয়ে গিয়েছে।
হাতুড়ি বাটালি দিয়ে এবারে গরম পাথরটার গায়ে একটা গভীর গর্ত খুঁড়ে তাঁরা দেখেন, ওর ভেতরটা একেবারেই বাইরের মতন নয়। উজ্জ্বল, রঙিন একটা বুদবুদের মত জিনিস গাঁথা রয়েছে সেখানে। জিনিসটার একটা ধার দেখতে পাওয়া যাচ্ছিল গর্ত দিয়ে। সেটার রং, নমুনার বর্ণালিতে পাওয়া রঙের সঙ্গে মেলে, তবে তা ঠিক রং বলতে যা বোঝায় সেরকম নয়। হাতুরির হালকা টোকা দিতে মৃদু টং টং শব্দ উঠছিল জিনিসটাতে। বোঝা যাচ্ছিল, ভঙ্গুর কোন জিনিস দিয়ে তৈরি বস্তুটা ফাঁপা। অবশেষে একজন প্রফেসর জিনিসটার গায়ে হাতুরির একটা জোরালো ঘা দিতে সেটা ফেটে যায়। আর সঙ্গেসঙ্গেই ম্যাজিকের মত একেবারে মিলিয়ে যায় গোটা বুদবুদটা। তিন ইঞ্চি ব্যাসের একটা খালি গর্ত পড়ে থাকে তার জায়গায়। প্রফেসররা অনুমান করেন, ক্ষয়ে যেতে থাকা জিনিসটার ভেতরে অমন বুদবুদ আরো কয়েকটা থাকতে পারে।
এরপর বেশ কয়েকবার ওর গায়ে তুরপুন চালিয়েও দ্বিতীয় কোন বুদবুদের খোঁজ না পেয়ে শেষমেষ প্রফেসররা আরো খানিকটা নমুনা সঙ্গে করে নিয়ে ফিরে যান। এবারেও সেই একই ভেল্কিবাজি– অ্যাসিড, ক্ষার, জল, কোনকিছুতেই কাবু না হওয়া, অ্যাসিডে ডুবলে ঠাণ্ডা হওয়া, আস্তে আস্তে ক্ষয়ে চলা, আর সিলিকনের তৈরি কোন বস্তু পেলে তাকে আক্রমণ করে একে অন্যকে নিশ্চিহ্ন করার পালা চলল তাঁদের পরীক্ষাগারে।
অন্য কিছু না বুঝলেও এই দুবারের পরীক্ষায় বিজ্ঞানিরা একটা বিষয়ে নিশ্চিত হলেন অবশ্য—বস্তুটা পরিচিত দুনিয়ার জিনিস নয়। পৃথিবীর বাইরের কোন অজ্ঞাত দুনিয়ার, অজ্ঞাত বিজ্ঞানের সূত্র মেনে চলা একটুকরো রহস্য।
প্রফেসররা তৃতীয়বার যেদিন আসেন তার আগের রাতে একটা জোরালো ঝড়বৃষ্টি হয়ে গিয়েছিল ও এলাকায়। সকালবেলা নাহুমের জমিতে পৌঁছে তাঁদের হতাশ হতে হয়। নাহুম জানায়, বস্তুটার আরেকটা গুণ হল বিদ্যুৎ আকর্ষণ। রাতে নাকি একঘন্টার মধ্যে ছ’বার গর্তটায় বাজ পড়তে দেখেছে সে। ঝড়বৃষ্টি থামলে বাইরে বেরিয়ে সে দেখে শুধু ঝুরো, ভেজা মাটিতে প্রায় ঢেকে যাওয়া গর্তটা পড়ে আছে সেখানে। পাথরের চিহ্নমাত্র নেই আর। জায়গাটাকে এরপর খুঁড়ে দেখা হয়, কিন্তু তাতেও পাথরটার কোন চিহ্ন মেলেনি সেখানে।
প্রফেসররা অতএব তাঁদের পরীক্ষাগারে ফিরে গিয়ে নমুনার অবশিষ্টাংশটাকে বাঁচিয়ে রাখবার একটা শেষ চেষ্টা করেন। কিন্তু মোটা সিসের বায়ুনিরোধক পাত্রে ভরে রেখেও তার ক্ষয় আটকানো গেল না। সপ্তাহখানেকের মধ্যেই টুকরোটা একেবারে উধাও হল তার সিসের পাত্র থেকে। ফাঁকা পাত্রটার দিকে তাকিয়ে প্রফেসরদের বিশ্বাস হচ্ছিল না তাঁরা ওখানে বহির্বিশ্বের কোন অজানা ধর্মের অজানা বস্তুকে দেখেছিলেন কখনো।
বিজ্ঞানীমহলের বাইরে, আখরামের জনজীবনেও একটা ঢেউ তুলেছিল ঘটনাটা। আখরামের খবরের কাগজগুলোর সাংবাদিকরা নাহুমকে প্রশ্নে প্রশ্নে জর্জরিত করে তুলেছিল। তারপর যখন বস্টন থেকেও এক সাংবাদিক এসে তার বাড়িতে হাজির হলেন, নাহুম তখন এলাকায় বিখ্যাত ব্যক্তি হয়ে গেল।
অ্যামির মতে, নাহুম লোক ভালো ছিল। তাদের দুই পরিবারের মধ্যে যাতায়াত ছিল নিয়মিত। তখন নাহুমের বড়োজোর বছরপঞ্চাশেক বয়েস। রোগাভোগা চেহারা। চাষবাস করে খায়। বউ আর তিন ছেলেকে নিয়ে সুখের সংসার। খবরের কাগজ থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়ের পণ্ডিত সবার কাছ থেকে এহেন মনোযোগ পেয়ে তখন তার গর্বে মাটিতে পা পড়ে না। সুযোগ পেলে যাকে সামনে পায় তাকে ধরে তার উঠোনের উল্কার গল্প শোনাতে বসে।
সে বছর জুলাই আগস্টে, বাড়ির ওপরের দিকে চ্যাপম্যানের নালার পাশে নাহুমের দশ একর জমিতে ভালোই ফসল হয়েছিল। গোটা গরমটাই ছেলেদের নিয়ে সে ফসল তুলতে কাহিল হয়ে পড়েছিল নাহুম।
কিন্তু মুশকিল হল তার পরেই। হেমন্তে তার বাড়ি ঘেরা ফলের বাগানে গাছগুলো নুয়ে পড়ল ফলের ভারে। কিন্তু সে ফল পাকবার পর দেখা গেল সবগুলো একেবারে অখাদ্য। আপেল আর নাশপাতিগুলো চেহারায় বড়ো, রঙদার। কিন্তু হলে কী হয়! ওর স্বাদ কেন যেন তিতকুটে আর পচাটে। এক কামড় খেলে বমি আসে। এমনকি টোম্যাটো আর তরমুজেরও সেই একই দশা। দেখেশুনে নাহুম বলল, ওই আকাশ থেকে খসে পড়া উল্কা তার বাগানের মাটিকে বিষিয়ে দিয়েছে। ওপরের দিকের জমি ঠিক থাকলেও নিচের দিকের জমি ভরে গিয়েছে সেই বিষে।
হেমন্তের পর শীত। সে বছর জোরদার ঠাণ্ডা পড়েছিল সে এলাকায়। এই সময় থেকেই অ্যামির বাড়িতে নাহুমের যাতায়াত কমে আসা শুরু হয়। তার গোটা পরিবারটাই কেমন যেন মনমরা হয়ে পড়ছিল আস্তে আস্তে। চার্চে আসে না। পাড়াপ্রতিবেশীর কাজকর্মে খাওয়াদাওয়াতেও দেখা মেলে না তাদের! জিজ্ঞেস করলে তারা কিছুই বলতে পারত না। শুধু মাঝেমধ্যে বলত শরীর ভালো যাচ্ছে না কারো। মনেও শান্তি নেই।
মাঝেমাঝেই নাহুম একটা কথা বলত এসে অ্যামিকে। সে নাকি বাড়ির কাছাকাছি বরফের ওপর কিছু পায়ের ছাপ নিয়ে চিন্তিত। লাল কাঠবেড়ালি, সাদা খরগোশ আর খ্যাঁকশেয়ালের চলাফেরার চিহ্ন। প্রথমদিন কথাটা শুনে অ্যামি বলেছিল, শীতের বরফে ও ছাপ পড়েই থাকে। জবাবে নাহুম মাথা নেড়ে বলেছিল, “কিন্তু ছাপগুলো ঠিকঠাক নয় অ্যামি। ভালো করে দেখ, যেভাবে ওগুলো থাকা উচিত সেভাবে নেই ওরা। কেমন যেন অন্যরকম। কেমন–”
অ্যামি সে কথায় প্রথমপ্রথম বিশেষ কান দেয়নি। তবে একদিন একটা ছোট্ট ঘটনায় তার মনের সে ভাবটা বদলে গেল। সে রাতটা আকাশে চাঁদ ছিল। কাজের শেষে অ্যামি তার স্লেজ নিয়ে নাহুমের বাড়ির কাছ দিয়ে ফিরছিল। হঠাৎ তার সামনে একটা খরগোশ লাফ দিয়ে রাস্তা পেরিয়ে চলে গেল। সে লাফ এতটাই লম্বা যে অ্যামির স্লেজের ঘোড়া তাতে হকচকিয়ে গিয়ে ক্ষেপে উঠছিল। অনেক কষ্টে রাশ টেনে অ্যামি তাকে সামলায়।
সেদিন থেকে নাহুমের কথাগুলোতে একটু মনোযোগ দিল অ্যামি। এইবার তার নজরে পড়ল, নাহুমদের কুকুরগুলোও খানিক অদ্ভুত আচরণ করছে। কেমন যেন নির্জীব হয়ে পড়েছে জীবগুলো। তেমন জোরে ডাকবার আগ্রহও যেন চলে গিয়েছে তাদের। সকালে নাহুমের বাড়ির কাছ দিয়ে কাজে যাবার সময় এবার অ্যামির নজর পড়ত, কুকুরগুলো যেন ভয়ে জবুথবু হয়ে আছে।
ফেব্রুয়ারির শুরুর দিকে ম্যাকগ্রেগরদের ছেলেরা হাঁস শিকারে বেরিয়ে নাহুমের বাড়ির কাছাকাছি জঙ্গল থেকে একটা অদ্ভুত হাঁস শিকার করে। জীবটার শরীরের গড়নে একটা কিছু বদল এসেছে। মুখটাও ভারী অদ্ভুত, ভয়ধরানো। ছেলেরা বিদঘুটে হাঁসটাকে প্রায় সঙ্গেসঙ্গেই ফেলে দিয়েছিল। ফলে তাদের সঙ্গে আখরাম শহরে এসে পৌঁছোল শুধু একটা ভয়ধরানো জীবের গল্প। ততদিনে নাহুমের বাড়ির কাছাকাছি এলেই ঘোড়াদের ভয় পেয়ে যাবার ব্যাপারটা প্রায় নিয়মিত হয়ে উঠেছে। সব মিলিয়ে নাহুমের বাড়ি ঘিরে তখন গোটা এলাকায় একটা অস্বস্তি গড়ে উঠছিল।
শীত বিদ্যায় নেবার মুখমুখ লোকজন বলতে শুরু করল, নাহুমের বাড়ির চারপাশে বরফ অন্য জায়গার চেয়ে তাড়াতাড়ি গলছে। মার্চের শুরুর দিকে আখরামের অকর্মাদের আড্ডায় একদিন নতুন একখানা গল্প চালু হল। স্টিফেন রাইস নাকি সক্কাল সক্কাল নাহুমের বাড়ির পাশ দিয়ে আসতে গিয়ে দেখেছে বরফ গলিয়ে সেখানে স্কাংক ক্যাবেজ-এর ফুল ফুটতে শুরু করে দিয়েছে। এ সময়টা এ অঞ্চলে ও ফুল ফোটাই দস্তুর, কিন্তু এ ফুলগুলো ঠিক স্বাভাবিক নয়। এত বড়ো বড়ো, উদ্ভট রঙের স্কাংক ক্যাবেজের ফুল নাকি সে কখনো দেখেনি। তাদের দুর্গন্ধ নাকে যেতে এমনকি তার ঘোড়াটাও মাথা বিগড়ে লাফঝাঁপ জুড়েছিল।
সেদিন বিকেলে আখরামের বহু লোকজন নাহুমের বাড়িতে গিয়ে উঠেছিল সে ফুল দেখতে। তাদের দুর্গন্ধে তখন টেকা যাচ্ছে না এলাকাটায়। মাছি ভনভন করছিল ফুলগুলোকে ঘিরে। সেই দেখেশুনে, আর তার সাথে আগের হেমন্তের তিতো ফলের খবর জুড়ে নিয়ে এরপর গোটা এলাকায় গুজব ছড়িয়ে গেল, নাহুমের জমিতে বিষ আছে। বলাবাহুল্য, এর সঙ্গে সেই উল্কাপাতের গল্পটাও জুড়ে দিয়েছিল এলাকার লোকজন।
খবরটা লোকজনের মুখে মুখে হেঁটে বিশ্ববিদ্যালয়েও গিয়ে পৌঁছেছিল। অতএব, উল্কা নিয়ে গবেষণা করা প্রফেসররা ফের একদিন নাহুমের বাড়িতে এলেন। স্কাংক ক্যাবেজের গাছগুলো পরীক্ষা করে তাঁরা রায় দিলেন, সম্ভবত উল্কার টুকরোটা থেকে মাটিতে কোন রাসায়নিক মিশে গিয়ে কাণ্ডটা ঘটেছে। দু একটা বর্ষায় মাটি ধুয়ে গেলেই ফের সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে। বরফে পায়ের ছাপ আর ঘোড়াদের ভয় পাওয়ার ব্যাপারগুলো নিয়ে তাঁরা অবশ্য খানিক হাসাহাসিই করলেন। ভূতুড়ে গুজব ছড়ায় না এমন গ্রামদেশ দুনিয়ায় কোথাও নেই। কাজেই, এর পর থেকে সেই জাদুর দিনগুলোর পুরো সময়টাই প্রফেসররা ধরে রেখেছিলেন, ও জায়গাটা নিয়ে আর বিশেষ কিছু করবার নেই। সেদিকে তাই আর ওর পরে পা বাড়াননি কেউ। শুধু তাঁদের মধ্যে একজন, এর বছর দেড়েক পরে ঐ স্কাংক ক্যাবেজদের কথা স্মরণ করেছিলেন। সে সময় একটা পুলিশি তদন্তের জন্য নাহুমের চত্বরের দু শিশি মাটি গিয়েছিল তাঁর কাছে। তার বিশ্লেষণের সময় যে রঙের বর্ণালি তিনি দেখেছিলেন, সে ছিল ওই স্কাংক ক্যাবেজের রঙ। সে রঙ তিনি তারও আগে দেখেছিলেন, সেখানে আছড়ে পড়া উল্কার উপাদান বিশ্লেষণের বর্ণালিতে, দেখেছিলেন তার ভেতরে লুকিয়ে থাকা সেই বুদবুদের বর্ণিল শরীরে—-
নমুনা হিসেবে আসা মাটিটা অবশ্য সে রঙ বেশিদিন দেখায়নি। দুচারদিন পরেই তার বর্ণালি থেকে নিভে গিয়েছিল সেই অজানা উপাদানের রঙ দেখানো আলো। তবে সে পরের কথা। উপস্থিত নাহুমের বাড়ি ঘিরে তখন আরো কিছু ব্যাখ্যাহীন ঘটনা শুরু হয়েছে। তার বাড়ির চারপাশের গাছপালায় ঋতুবদলের তোয়াক্কা না করে যখনতখন কুঁড়ি ধরতে শুরু করেছে। রাতের অন্ধকারে তারা অদ্ভুত ভঙ্গীতে মাথা দোলায়। নাহুমের মেজ ছেলে, বছর পনেরোর থ্যাডিয়াস দিব্যি গেলে বলে সে গাছদের সে হাওয়াবাতাস ছাড়াই দুলতে দেখেছে অনেক রাত্রে। কেউ কেউ বলত, রাতবিরেতে ওদিক দিয়ে আসতে গিয়ে নাহুমদের জানালা দিয়ে তাদের চোখে পড়েছে, গোটা পরিবারটাই কান খাড়া করে কী যেন শুনতে চাইছে। জিজ্ঞাসা করলে অবশ্য কী শোনবার জন্য তাদের অমন কৌতুহল তা তারা গুছিয়ে বলতে পারত না।
নাহুমদের এই শোনার ব্যাপারটা অবশ্য সবসময় ঘটত না। কাছাকাছি বাইরের লোক না থাকলে হঠাৎ হঠাৎ নিজেদের অগোচরেই তারা ও কাজটা করতে শুরু করে দিত। তবে আস্তে আস্তে তাদের এ ঝোঁকটা বাড়ছিল। ফলে, পাগলামোটা লোকজনের চোখে পড়তে দেরি হয়নি। অতএব শিগগিরই এলাকায় রটে গেল, নাহুমদের কিছু একটা হয়েছে।
এরপর গরমের মুখমুখ যখন তার বাড়ির চারপাশে পাথরকুঁচির ঝোপগুলো ফের গজাতে আরম্ভ করল, দেখা গেল তাদেরও চেহারার বদল হয়েছে। ফুলের রঙগুলো একটু আলাদা হলেও স্কাংক ক্যাবেজের রঙের সঙ্গে তার বেশ মিল। সে ফুলের একটা গোছা সঙ্গে নিয়ে নাহুম আখরামের এক খবরকাগজের সম্পাদককে দেখিয়েছিল। ভদ্রলোক মনোযোগ দিয়ে সেগুলো দেখলেন, ওর ওপর উড়ে বেড়ানো, আকারে বেড়ে ওঠা প্রজাপতিদের অদ্ভুত আচরণের কথা শুনলেন, আর তারপর গেঁয়ো লোকের কুসংস্কার নিয়ে একটা দমফাটা হাসির নিবন্ধ ছেপে দিলেন তাঁর কাগজে।
এপ্রিলের শুরু থেকে গোটা এলাকার লোকজনের মধ্যে একটা উত্তেজনা দেখা দিল, আর ওই সময় থেকেই আখরাম থেকে নাহুমের বাড়ির পাশ দিয়ে চলে যাওয়া রাস্তাটার ব্যবহার কমতেও শুরু করল একটু একটু করে। ব্যাপারটা ঘটেছিল নাহুমের বাড়ির চারপাশের গাছপালাগুলো নিয়ে। তার ফলের বাগানের সমস্ত জাতের গাছে অদ্ভুত সব রঙের ফুল ফুটতে শুরু করে সে সময়। পাথুরে মাটি ফুঁড়ে উঠে আসা চিরকালের চেনাপরিচিত ঝোপঝাড়গুলোর চেহারা আর ফুলের রঙও আমূল বদলে গিয়েছিল। প্রত্যেকটা রঙ আলাদা কিন্তু খুঁটিয়ে দেখলে বোঝা যায়, আসলে তারা, যেন প্রিজমের মধ্যে দিয়ে দেখা একটাই মূল রঙের নানান রূপ। সে রঙ পৃথিবীর চেনা কোন রঙ নয়। ডাচম্যান’স ব্রিচেস-এর ফুলগুলো দেখলে ছুঁতে ভয় লাগে, রক্তচাঁপার ফুলের মোলায়েম লাল রঙের মধ্যেও সেই কুৎসিত রঙের ইশারা দেখা যায়।
সে ইশারা নিয়ে অ্যামির সঙ্গে নাহুমের কথা হয়েছিল অনেকবার। দুজনেরই মনে হয়েছিল এ রঙ উল্কার ভেতরে পাওয়া সেই বুদবুদের রঙের সঙ্গে মেলে। বাড়ির চারপাশের জমিতে চাষবাসের কাজ বন্ধ করে দিল নাহুম। জানত ওতে পণ্ডশ্রমই হবে। শুধু মনের ভেতর একটা ক্ষীণ আশা ছিল তার। যদি এই এতসব গাছ মিলে এযাত্রা মাটির বিষটাকে শুষে নিয়ে বের করে দিতে পারে তাহলে পরের বার হয়ত—
নাহুমের মনের অবস্থা তখন ভালো নয় একেবারেই। তার খুব কাছাকাছি কেউ যেন নিঃশব্দে ওঁত পেতে আছে, এমন একটা অনুভূতি তাকে সবসময় ঘিরে থাকে। প্রতিবেশীদের তার বাড়িতে আসা বন্ধ হয়ে যাওয়াটা তাকে খানিক মনমরা করে দিয়েছিল তা ঠিক, কিন্তু তার স্ত্রীর ওপর ওর ছাপ পড়েছিল আরো বেশি। ছেলেগুলো অবশ্য রোজ স্কুলে যেত। ফলে তাদের এ নিয়ে বিশেষ হেলদোল ছিল না। তবে স্কুলেও এ নিয়ে নানান কথাবার্তা কানে আসতে তাদের মধ্যেও একটা ভয় গড়ে উঠছিল আস্তে আস্তে। তিন ভাইয়ের মধ্যে থ্যাডিয়াসটা আবার একটু বেশি কল্পনাপ্রবণ। কাজেই আর দু’ভাইয়ের তুলনায় তার মনের ওপর চাপটাও পড়ছিল বেশি।
মে মাসে শুরু হল পোকামাকড়ের উপদ্রব। নাহুমের বাড়িটা তাদের কল্যানে প্রায় নরক হয়ে উঠল। পোকামাকড়গুলোর চেহারা বদলে গেছে। রাতের বেলা তাদের হাবভাব একেবারে বদলে যায়। নাহুমদের তখন পাগল পাগল দশা। সারারাত তারা কান খাড়া করে জেগে থাকে, এদিকওদিক এলোমেলো দৌড়োয়—কিন্তু কী যে খোঁজে, কীসের যে ভয় পায় তা তারা নিজেরাও জানে না। আর এই সময়েই তারা খেয়াল করল, কিছুদিন আগে থ্যাডিয়াস ভুল দেখেনি। বাড়ি ঘিরে থাকা গাছগুলো অন্ধকারে সত্যিই দোলে। কোন হাওয়াবাতাস ছাড়াই। ব্যাপারটা প্রথম খেয়াল করেছিলেন মিসেস নাহুম। চাঁদনি রাতে জানালার পাশে খানিক দূরে দাঁড়ানো ম্যাপল গাছটা মাথা দোলাচ্ছিল। একফোঁটা বাতাস ছিল না তখন সেখানে।
এর পরের ব্যাপারটা অবশ্য নাহুমদের নজরে পড়েনি প্রথমে। সেটা দেখেছিল অন্য একজন। ততদিনে বাড়ি ঘিরে অদ্ভুতুরে ব্যাপারস্যাপারে নাহুমরা অনেকটা অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে। সম্ভবত সেজন্যই এ জিনিসটা তাদের নজর এড়িয়ে গিয়েছিল।
ঘটনাটার খবর দেয় বোল্টন থেকে আসা এক উইন্ডমিলের সেলসম্যান। স্থানীয় গালগল্পের খবর তার জানা ছিল না। ফলে রাতের অন্ধকারে সে নাহুমের বাড়ির পাশের রাস্তাটা ধরেই গাড়ি নিয়ে আসছিল আখরামের দিকে।
আখরামে পৌঁছে সে যে খবরটা দেয় সেটা তার পরদিন সেখানকার খবরের কাগজে ছেপে বের হয়েছিল। সেখান থেকেই নাহুম বিষয়টা জানতে পারে। সেলসম্যানের বক্তব্য, রাস্তা দিয়ে আসবার সময় দূর থেকে গাছগাছালির ফাঁকে দাঁড়ানো একটা বাড়ি তার চোখে পড়ে। যে জায়গাটায় বাড়িটা সে দেখেছে বলে জানায়, তাতে বোঝা যাচ্ছিল, নাহুমেরই বাড়ির কথা বলছে সে। সে বলে, বাড়িটাকে ঘিরে অনেকটা জায়গা জুড়ে ঝোপঝাড়, গাছপালাগুলোয় অন্ধকার খানিক হালকা ছিল। গোটা জায়গাটা ঘিরে একটা মৃদু অথচ স্পষ্ট আলো ছড়িয়েছিল। ওরই মধ্যে একটুকরো আলো হঠাৎ উঁচুতে উঠে আস্তে আস্তে নাহুমের দরজার দিকে এগিয়ে যায়। ব্যাপারটা কী সেটা খোঁজ করবার মত সাহস তার ছিল না। প্রাণপণে গাড়ি চালিয়ে সে সেখান থেকে একেবারে শহরের মধ্যে এসে উঠেছে।
এই অবধি নাহুমের জমিতে যা বদল এসেছিল তা শুধুই তার বাড়ি ঘেরা গাছগাছালির ফুলফলে। তাদের পাতায়,বা মাটির বুকে গজানো ঘাসের ওপর তার কোন ছাপ পড়েনি। শত গণ্ডগোলের মধ্যেও নাহুমের গরুগুলোর কোন অসুবিধে হয়নি তাই। কিন্তু মে মাসের শেষাশেষি দেখা গেল তাদের দুধেও সেই তিতকুটে স্বাদ এসে জমা হচ্ছে। অতএব গরুগুলোকে বাড়ির সীমানা ছাড়িয়ে উঁচু জমিতে নিয়ে চলে গেল নাহুম। প্রায় সঙ্গেসঙ্গেই দুধের স্বাদ ঠিক হয়ে গেল ফের। এর কিছুদিন বাদেই দেখা গেল রোগটা ঘাস আর গাছের পাতাতেও ছড়িয়ে পড়ছে। খুব তাড়াতাড়ি সবুজ রঙ হারিয়ে মরাটে চেহারা ধরছে সেগুলো। হাতে ধরে চাপ দিলে মুড়মুড় করে ভেঙে যায়।
ততদিনে অ্যামি ছাড়া এলাকার আর কোন লোক নাহুমের বাড়ির ছায়া মাড়ায় না। তবে অ্যামির যাতায়াতও কমে আসছিল ক্রমশ। এরপর, স্কুলের ছুটি পড়তে নাহুমদের সঙ্গে বাইরের দুনিয়ার শেষ যোগাযোগটাও অবশেষে কেটে গেল। আখরামের দিকে তাদের কেউই তখন আর পা বাড়ায় না। কেনাকাটার কিছু দরকার হলে অ্যামিকে দিয়েই কাজ সারছিল তখন তারা। শরীর, মন দুইই ভেঙে পড়ছিল তাদের। ফলে, কিছুদিন পরে যখন খবর এল যে মিসেস নাহুম পাগল হয়ে গেছেন তখন শহরের একটা লোকও তাতে আশ্চর্য হল না।
ঘটনাটা ঘটেছিল উল্কা পড়বার ঠিক এক বছরের মাথায়। জুনের সে দিনটায় মহিলা হঠাৎ গলা ফাটিয়ে চিৎকার শুরু করলেন তাঁর উঠোনে দাঁড়িয়ে। বাতাসে নাকি কারা ভেসে বেড়াচ্ছে। কিন্তু সে ‘কারা’টা যে কী তার কোন ব্যাখ্যা তিনি দিচ্ছিলেন না। অসম্বদ্ধ সেই চিৎকারে কোন নাম ছিল না। শুধু ‘ওই যে সে, ওই তো ওরা, ওগুলো উড়ছে’ এইরকম সব শব্দ। কখনো এদিক ওদিক তাকিয়ে বলেন, “শুনতে পাচ্ছ না? ওই তো—শোনো শোনো—ওই যে-কানে তালা লাগিয়ে দিল যে–আমার রক্ত শুষে নিল গো—এই কে রে তুই—আমার গলা জড়িয়ে ধরেছিস? ছাড় ছাড় –আঃ লাগে—ওগো আমায় বাঁচাও—কিছু করছ না কেন তুমি–”
প্রথমপ্রথম নাহুম প্রাণে ধরে তাঁকে আটকে রাখতে পারেনি। যতদিন পেরেছে বাড়িতেই ছেড়ে রেখেছিল। কিন্তু তারপর ছেলেরা যখন তাদের মাকে ভয় পেতে শুরু করল, তখন আর তাঁকে ছেড়ে রাখা সম্ভব হল না। একদিন থ্যাডিয়াসের দিকে বিশ্রি মুখ করে তেড়ে যেতে সে যখন ভয়ে জ্ঞান হারাল, নাহুমকে তখন একরকম বাধ্য হয়েই দোতলার একটা ঘরে তালাচাবি বন্ধ করে রাখতে হল তার স্ত্রীকে।
নাহুমের স্ত্রীর পাগল হয়ে যাবার কয়েকদিন আগে সে বাড়িতে অন্য একটা ঘটনা ঘটেছিল। সেটা এখানে বলে নেয়া যাক। নাহুমের চারটে ঘোড়া ছিল। প্রত্যেকটাই সুশিক্ষিত ঘোড়া। একদিন রাতে হঠাৎ করেই তারা ক্ষেপে ওঠে। আস্তাবলের ভেতরে তাদের চিৎকারে আর খুরের ধাক্কায় একটা তোলপাড় শুরু হয়ে গিয়েছিল সেই রাত্রে। শব্দ পেয়ে নাহুম বাইরে এসে আস্তাবলের দরজা খুলে দিতে না দিতে তারা দড়িকাড়া ছিঁড়ে দৌড়ে পালিয়ে যায় পাহাড়ের দিকে। গোটা একটা সপ্তাহ লেগে গিয়েছিল নাহুমের, ঘোড়া চারটেকে খুঁজেপেতে ফিরিয়ে আনতে। কিন্তু ফিরিয়ে আনবার পর দেখা গেল ঘোড়াগুলো আর কোন কাজে লাগবার অবস্থায় নেই। কিছু একটা ঘটে গেছে তাদের মাথায়। যাবতীয় শিক্ষাদিক্ষা ভুলে গিয়ে একেবারে উন্মাদ হয়ে গেছে দুর্ভাগা জন্তুগুলো। শেষমেষ নাহুম গুলি করে চারটে ঘোড়াকেই তাদের সব যন্ত্রণার হাত থেকে মুক্তি দেয়।
তখন খড় কাটবার সময়। কাটা খড় বয়ে আনবার জন্য ঘোড়ার খুবই দরকার ছিল নাহুমের। অগত্যা নিরুপায় হয়ে সে অ্যামির থেকে একটা ঘোড়া ধার নেয়। কিন্তু বাড়ির কাছাকাছি আসতেই সে পা ঠুকে দাঁড়িয়ে পড়ে। হাজার চেষ্টাতেও তাকে বাড়ির ভেতরে এক পা-ও ঢোকাতে পারেনি নাহুম। যতক্ষণ সেখানে সে দাঁড়িয়েছিল, ততক্ষণ একটানা ভয়ার্ত চিৎকারও থামেনি তার। নিরুপায় হয়ে নাহুমকে শেষে কিছু লোকজন নিয়ে নিজেই খড়ের বোঝা টেনে আনবার কাজে লাগতে হয়।
ওদিকে, তার বাড়ির চারপাশের গাছপালাগুলো ততদিনে প্রায় গোটাটায় মরাটে হলদেটে রঙ ধরেছে। এমনকি ফুলগুলোও তাদের রঙ হারাচ্ছে তখন। রঙ হারাবার সঙ্গে সঙ্গে বিকৃত হয়ে উঠছিল সেগুলোর চেহারা। বাড়ির সামনের উঠোনের গোলাপ, জিনিয়া হলিহকের কেয়ারির ফুলগুলো এমন কিম্ভুতকিমাকার চেহারা নিচ্ছিল যে
নাহুমের বড়ো ছেলে জেনাস না পারতে একদিন মুড়িয়ে ছিঁড়ে ফেলে দিল ফুলের বাগানটাকে। প্রায় সেই একই সময়ে তার বাড়িতে ছেয়ে যাওয়া পোকামাকড়ের মধ্যে একটা মড়ক ছড়িয়ে পড়ছিল। প্রতিদিন চারপাশে গাদা হয়ে পড়ে থাকে তাদের শরীর। তার বাগানের মৌচাকগুলো ততদিনে খালি হয়ে গেছে। মৌমাছিরা তাদের চাক ছেড়ে পালিয়ে গেছে গভীর অরণ্যে।
সেপ্টেম্বর নাগাদ দেখা গেল ছোটো গাছ, ঝোপঝাড়গুলো সব মরে ধুলো হয়ে ঝরে পড়ছে তার বাড়ির চারপাশে। নাহুমের ভয় হচ্ছিল, তার ফলের গাছগুলোও বোধ হয় জমি থেকে বিষ শেষ হবার আগেই মরে যাবে। ওদিকে বাড়িতেও তখন অবস্থা দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে। চিলেকোঠার বদ্ধ ঘরের ভেতরে তার স্ত্রী তখন সারাটা দিন শুধু প্রাণপণে চিৎকার করেন। এহেন বিড়ম্বনায় পড়ে নাহুম আর তার ছেলেদের তখন মাথা ঠিক রাখাই দায় হয়ে উঠেছে। লোকজনের মুখ দেখা তখন তারা একেবারেই বন্ধ করে দিয়েছে। এমনকি স্কুল তখন খুলে গেলেও নাহুমের ছেলেরা আর সেখানে ফিরে যায়নি।
জুলাই মাসের মাঝামাঝি দেখা গেল নাহুমের স্ত্রী কথা বলা একেবারে বন্ধ করে দিয়েছেন। সোজা হয়ে দাঁড়াতেও ভুলে গেছেন তিনি। বন্ধ চিলেকোঠার ভেতর চার হাতপায়ে হামাগুড়ি দিয়ে ঘোরেন কেবল। রাতের অন্ধকারে তাঁর গা থেকে হালকা আলো বেরোয়। ততদিনে নাহুম তার বাড়ি ঘেরা ঝোপজঙ্গলের বুকেও সে আলো দেখতে অভ্যস্ত হয়ে গেছে।
এই অবস্থায় একদিন অ্যামিই এসে আবিষ্কার করে, নাহুমের কুয়োর জল নষ্ট হয়ে গেছে। একটা নোনতামতন বিশ্রি স্বাদ হয়েছে তাতে। সেইসঙ্গে পচা দুর্গন্ধ। ব্যাপার দেখে অ্যামি নাহুমকে একটা নতুন কুয়ো খোঁড়বার পরামর্শ দিল। নাহুম তাতে কান দেয়নি। মনেমনে এতটাই কাবু হয়ে পড়েছে সে তখন যে ও’সব স্বাদগন্ধের ব্যাপারে তার ভালোমন্দ বোধটাই হারিয়ে গিয়েছে তখন। ছেলেদের নিয়ে তখন সে ওই বিশ্রি জলই খায়, সঙ্গে দুবেলা দুমুঠো অখাদ্য কিছু খাবার, আর সেই খেয়েই তারা সারাদিন যন্ত্রের মত রোজকার উদ্দেশ্যহীন কাজকর্মগুলো সেরে চলে। তাদের দেখলে তখন মনে হত, যেন একেবারে হাল ছেড়ে দিয়েছে তারা। অজানা যে অভিশাপ তাদের তিলেতিলে ধ্বংসের দিকে এগিয়ে নিয়ে চলেছে তার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবার ইচ্ছেটুকুও আর তাদের মধ্যে অবশিষ্ট নেই তখন। যেন, অদৃশ্য কোন পাহারাদারের সারির মধ্যে দাঁড়িয়ে মৃত্যুদণ্ড পাওয়া কয়েকজন মানুষ যন্ত্রের মত হেঁটে চলেছে তাদের বধ্যভূমির দিকে।
সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি একদিন সকালে থ্যাডিয়াস একটা বালতি হাতে কুয়ো থেকে জল আনতে গেল। খানিক বাদে খালি বালতি কুয়োর ধারে ফেলে বাতাসে হাত ছুঁড়তে ছুঁড়তে যখন সে ফিরে এল ততক্ষণে সে বদ্ধ উন্মাদ। কখনো হাসে, কখনো কাঁদে, আর বারবার কুয়োটার দিকে আঙুল তুলে দেখিয়ে বলে, “রঙ ঘুরছে—ক–ত রঙ ঘুরছে—”
এক বাড়িতে দুজন মানুষের মাথা খারাপ হয়ে যাওয়াটা খুবই কষ্টের, কিন্তু নাহুম লোকটাও তেমনই শক্ত মনের মানুষ। সপ্তাহখানেক পাগল ছেলেটাকে বাড়িতে ছেড়ে রাখবার পর, যখন সে এখানে ওখানে আছাড় খেয়ে চোট পেতে আরম্ভ করল, তখন নাহুম তাকে তার মায়ের ঘরের মুখোমুখি আরেকটা ঘরে নিয়ে আটকে রাখল। সেই দুই ঘর থেকে পাগল মা আর ছেলে মিলে একসঙ্গে অবোধ্য ভাষায় চিৎকার জুড়ল যখন, তখন সে শব্দ সহ্য করা কোন স্বাভাবিক মানুষের পক্ষে কঠিন ছিল। নাহুমের ছোটোছেলে মেরউইন তখন বড়োই ছোট। সে শুধু সেই চিৎকার শোনে আর বলে, “ওরা কথা বলছে বাবা। অন্য পৃথিবীর ভাষায় কথা বলছে। ওই শোন—”
আসলে থ্যাডিয়াস ছিল মেরউইনের খেলার একমাত্র সাথী। প্রথমে মা আর তারপর প্রিয় দাদাটার এভাবে পাগল হয়ে যাওয়া তার মনে খুব লেগেছিল নিঃসন্দেহে।
থ্যাডিয়াসের পাগল হয়ে যাবার দু একদিনের মধ্যে নাহুমের পোষা জীবজন্তুগুলোর মধ্যে মড়ক লাগল। প্রথমে গেল হাঁসমুরগিগুলো। হঠাৎ করেই ফ্যাকাশে হয়ে উঠে দু একদিনের মধ্যে সবগুলো মরে সাফ। নাহুম তার দু’একটাকে খাবার জন্য কাটতে গিয়েও শিউরে উঠে টেবিল থেকে সেগুলোকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিল। ওদের মাংস একেবারে শুকিয়ে গিয়েছে। ছুরির ঘা দিলে তাতে কাঠ কাটবার মত খসখস ঘসঘস শব্দ ওঠে। শুয়োরগুলো বিশ্রীরকম মোটা হয়ে উঠছিল প্রথমে। তারপর হঠাৎ চেহারাগুলো বিভৎসভাবে বিকৃত হয়ে উঠে মারা পড়ছিল তারাও। তাদের মাংসেও অখাদ্য তিতকুটে স্বাদ।
নাহুম ততদিনে একেবারে কিংকর্তব্যংবিমূঢ় হয়ে উঠেছে। পোষা জীবগুলোকে সে বাড়ির চারপাশের অসুস্থ ঘাসপাতা ছুঁতে দেয়নি কখনো। তাদের তবে কেন এমনটা হচ্ছে সেটা বোঝার সাধ্য তার ছিল না। এলাকার কোন পশুচিকিৎসকও তার বাড়িতে পা দিতে নারাজ। এরপর গরুগুলোর পালা এল। শুয়োর আর হাঁসমুরগির দলের পরিণতি দেখে নাহুম তখন দ্বিগুণ সাবধান হয়েছে। গরুগুলোকে সে তাদের গোয়ালে তালাচাবি মেরে আটকে রাখছিল। কিন্তু সেখানেও দেখা গেল হপঠাৎ হঠাৎ তাদের কয়েকটা বেজায় শুকিয়ে উঠছে। কখনো শরীরের কোন অংশ, আবার কখনো কখনো গোটা শরীরটাই গুটিয়ে যেন ঢুকে যাচ্ছে ভেতরের দিকে। দুএকদিন এইরকম হবার পর হঠাৎ তাদের গায়ের রঙ ফ্যাকাশে হয়ে উঠে গোটা শরীরটা কাঠের মত শক্ত হয়ে মারা যাচ্ছিল প্রাণীগুলো। কোন জীবাণু সংক্রমণের সম্ভাবনা ছিল না। কোন বিষাক্ত পোকামাকড়ও কামড়ায়নি তাদের। সে বিষয়ে নাহুম আগেই সাবধান হয়েছিল। এই করে করে ফসল কাটবার সময় এল যখন, ততদিনে নাহুমের পোষা জীবজন্তুর সঞ্চয় শেষ হয়ে গেছে।
এমনকি তার কুকুরগুলোও পালিয়ে গিয়েছিল তাকে ছেড়ে। তিনটে কুকুর একসঙ্গে একদিন রাতে উধাও হয়ে গেল! তাদের আগেই বিদেয় হয়েছিল বাড়ির পাঁচপাঁচটা পোষা বেড়াল। তবে তাদের উধাও হওয়ায় নাহুমের ক্ষতিবৃদ্ধি হয়নি বিশেষ। কারণ বেড়ালগুলো যার প্রিয় বন্ধু ছিল সেই মিসেস নাহুম তখন বদ্ধ উন্মাদ, আর তাছাড়া, তাদের অবর্তমানে উৎপাত করবার মত একটাও ইঁদুর তখন অবশিষ্ট ছিল না নাহুমের বাড়িতে। তারাও উধাও হয়েছে। কোথায়, কে জানে!
উনিশে অক্টোবর সকালে নাহুম হঠাৎ টলতে টলতে অ্যামির বাড়িতে এসে হাজির। বলে, আগের দিন রাতে নাকি থ্যাডিয়াস মারা গেছে। যেভাবে মৃত্যু এসেছে তার সে কথা নাহুমের নিজেমুখে বলবার ক্ষমতা ছিল না। থ্যাডিয়াসের ঘরে সে তার যা অবশেষ পেয়েছিল সেটা সে বাড়ির পেছনের জমিতে একটা কবর খুঁড়ে গোর দিয়েছে। থ্যাডিয়াসের চিলেকোঠার জানালায় মোটা গরাদ ছিল। আর দরজায় তালা। গরাদ বা তালা কোনটাই ভাঙেনি। কাজেই বাইরে থেকে কেউ বা কিছু রাতে তার ঘরে ঢোকেনি সেটা পরিষ্কার।
অ্যামি আর তার স্ত্রী মিলে নাহুমকে যথাসাধ্য সান্ত্বনা দিয়েছিল, কিন্তু সেটা করতে গিয়ে বারবার ভয়ে কেঁপে উঠছিল তারা। নাহুমের গোটা পরিবারটাকে ঘিরেই আতঙ্কের একটা ঘেরাটোপ নেমে এসেছে যেন। সে পরিবারের যে কোন সদস্যের স্পর্শেও যেন নামহীন কোন অশুভ দুনিয়ার স্পর্শ।
ঘোর অনিচ্ছাসত্ত্বেও অ্যামিকে সেদিন নাহুমের সঙ্গে তার বাড়িতে যেতে হয়েছিল। কারণ, নাহুমের একার পক্ষে ছোট্টো মেরউইনের কান্না সামলাবার ক্ষমতা ছিল না। তার আরেক ছেলে জেনাসের অবশ্য কোন কান্নাকাটি ছিল না। কিছুকাল যাবত সে কেমন একটা হয়ে গিয়েছে তখন। বাবা যা করতে বলে, যন্ত্রের মত করে, আর বাকি সময়টা ফাঁকা দৃষ্টি মেলে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে শুধু।
সেদিন, মেরউইনের বিলাপের জবাবে মাঝেমাঝে চিলেকোঠার অন্য ঘরটা থেকে একটা ক্ষীণ আওয়াজ ভেসে আসছিল। সেই শুনে অ্যামির প্রশ্নের জবাবে নাহুম জানায়, তার স্ত্রী বড়ো দুর্বল হয়ে পড়েছেন দিনকতক ধরে।
সন্ধের মুখমুখ নাহুমের বাড়ি থেকে একরকম জোর করেই বের হয়ে এল অ্যামি। ওই আলোছড়ানো ঝোপঝার আর হাওয়া বিনা মাথা নাড়ানো গাছপালার ভিড়ে সে কোনমতেই রাত্রে থাকতে রাজি নয়। সত্যি বলতে কি অ্যামির ভাগ্য ভালো যে তার মাথায় কল্পনার ছিটেফোঁটাও নেই। তাই শেষমেষ মাথাটা সামান্য খারাপ হয়েই সে ছাড়া পেয়েছে। যা সে দেখেছে, শুনেছে, জেনেছে, সেগুলোকে জুড়ে একটা গোটা ছবি তৈরি করবার মত কল্পনাশক্তি থাকলে তার বদ্ধ উন্মাদ হয়ে যেতে দেরি হত না।
পাহাড় জুড়ে নেমে আসা সন্ধের আলোআঁধারি পেরিয়ে যখন সে জোরপায়ে হেঁটে নিজের বাড়ি ফিরে আসছে, তখনও নাহুমের ছোটো শিশুটা আর তার উন্মাদ মায়ের চিৎকার তার কানে ঝনঝন করে বাজছিল।
এর দিনতিনেক বাদে নাহুম ফের এসে অ্যামির বাড়িতে এসে আছড়ে পড়ল। অ্যামি তখন বাড়ি ছিল না। মিসেস পিয়ার্স বুকভরা আতঙ্ক নিয়ে নাহুমের মুখ থেকে আরো একটা বিয়োগান্ত নাটকের গল্প শুনলেন সেদিন। এবারে মেরউইনের পালা ছিল। অনেক রাতে লন্ঠন আর এক বালতি জল নিয়ে বাইরে বের হয়েছিল সে। আর ফিরে আসেনি। দাদা মারা যাবার পর থেকেই মেরউইন যেন ভেঙে খানখান হয়ে গিয়েছিল। যখন তখন চিৎকার ছাড়া আর কোন অভিব্যক্তিই তার অবশিষ্ট ছিল না। বাইরে বের হবার খানিক পরে উঠোনের এক কোন থেকে একটা তীক্ষ্ণ আর্তনাদের শব্দ উঠেছিল শুধু। শব্দ শুনে তার বাবা বাইরে বেরিয়ে দেখে লন্ঠনের আলো উধাও। সেইসঙ্গে মেরউইনেরও কোন চিহ্ন নেই।
নাহুম ভেবেছিল লন্ঠন আর বালতিটাও বুঝি উধাও হয়েছে মেরউইনের সঙ্গে। কিন্তু সারাটা রাত পাহাড়েজঙ্গলে ঘুরে ছেলেটাকে খুঁজে সকালবেলা বাড়িতে পা দিয়ে সে দেখে কুয়োর পাশে ভেঙে চুরচুর একটা ধাতুর পিণ্ড। খানিকটা গলেও গিয়েছিল সেটা, কিন্তু তবু জিনিসটা যে একসময় একটা লন্ঠন ছিল তা বোঝা যায়। ওর পাশে দুমড়ে যাওয়া একটা লোহার পাতের গায়ে জেগে থাকা একটা মোটা হাতল বলে দিচ্ছিল, সেটা মেরউইনের নিয়ে যাওয়া বালতিটা।
নাহুম তখন সব ভাবনাচিন্তার ঊর্ধ্বে চলে গেছে। মিসেস পিয়ার্সও একেবারে হতভম্ব হয়ে গিয়েছিলেন সব শুনে। খানিক বাদে অ্যামি বাড়ি ফিরে স্ত্রীর মুখে সব শুনে মাথা নাড়ল। এর ব্যাখ্যা দেয়া তারও সাধ্যের বাইরে।
মেরউইন আর নেই। লোকজনকে সে খবর দিয়ে লাভও নেই কোন। আখরাম শহরে গিয়ে সে খবর দিয়েই বা কী লাভ? ওরা গেঁয়ো মানুষগুলোকে নিয়ে খানিক হাসিঠাট্টাই করবে শুধু।
“থাড চলে গেল, মেরউইন চলে গেল। আমার দিকেও কিছু একটা এগিয়ে আসছে অ্যামি। আমি টের পাচ্ছি–” নাহুম ফিসফিস করে বলে চলেছে তখন, “আমি জানি এবার আমার পালা। জেনাস আর ওর মা যদি তার পরেও বেঁচে থাকে, তাহলে ওদের তুমি একটু দেখ। কিন্তু–কেন এমন হল অ্যামি? কার বিচারে এ শাস্তি পেলাম আমি? সজ্ঞানে কখনো কোন অধর্ম তো কখনো করিনি!”
এরপর প্রায় দু সপ্তাহ নাহুমের থেকে কোন সাড়াশব্দ না পেয়ে শেষমেষ নিজের ভয় ঝেরে ফেলে অ্যামি একদিন তাদের বাড়িতে গিয়ে উঠল। গোটা খামারবাড়িটার চেহারা বুকে ধাক্কা দেয়। তার চিমনিতে ধোঁয়া নেই। শুকনো হলদেটে ঝোপঝারে ঘেরা, দেয়াল আর ছাদের কোনা থেকে ঝরে পড়া লতাপাতার ভঙ্গুর স্তূপ, নভেম্বরের আকাশে পাতাহীন নখের মত শুকনো ডালপালা বাড়িয়ে ধরা মরা গাছের দল, জায়গাটাকে ভূতুড়ে একটা চেহারা দিয়েছে।
নাহুম তখনো বেঁচে ছিল। রান্নাঘরে একটা চেয়ারের ওপর সে শুয়ে। সেখানে ঢুকে হি হি করে কেঁপে উঠেছিল অ্যামি। ঘরটা বরফের মত ঠাণ্ডা। তার আগুনহীন চিমনিতে জমে থাকা ঝুলকালি হেমন্তের হাওয়ায় ঘরের মধ্যে ভেসে এসে উড়ে বেড়াচ্ছিল চারপাশে।
“জেনাস, চুল্লিতে কাঠ দে আরো খানিক,” বলতেবলতে অ্যামির দিকে ঘুরে তাকিয়ে নাহুম একটু হেসে বলল, “আগুনে আরেকটু কাঠ দিলেই ঠাণ্ডাটা কম লাগবে, বুঝলে অ্যামি!”
তার নির্বোধ মুখটার দিকে তাকিয়ে অ্যামি বুঝতে পারছিল, সবচেয়ে শক্ত দড়িটাও এইবার ছিঁড়ে গেছে। উন্মাদ হয়ে গিয়েছে নাহুম। পৃথিবীর কোন দুঃখ, কোন ভয়ই আর তাকে জ্বালাতে পারবে না।
জেনাস কোথাও ছিল না। নাহুমকে জিজ্ঞাসা করেও লাভ হল না কোন। নানাভাবে ঘুরিয়েফিরিয়ে সে প্রশ্ন যতবার করল অ্যামি, ততবারই একই জবাব দিয়ে গেল সে, “কুয়োর ভেতর! ও তো কুয়োয় থাকে এখন—”
খানিক বাদে অ্যামির মাথায় হঠাৎ নাহুমের স্ত্রীর কথাটা আসতে প্রশ্নের ধারা বদলাল সে। চিলেকোঠার একটা ঘরে আটকে রাখা মানুষটার কী পরিণতি হয়েছে তা কে জানে।
তার প্রশ্নের জবাবে প্রশান্তমুখে নাহুম বলল, “ন্যাবি? কেন, এই তো! সামনেই আছে তো তোমার! দেখ দেখ–”
অ্যামি ঠিক করল এবার তাকে নিজেকেই খুঁজে দেখতে হবে। নাহুমকে সেখানে রেখে, দেয়ালের পেরেকে ঝোলানো চাবির গোছাটা তুলে নিয়ে সে সিঁড়ি বেয়ে ওপরে গেল। মুখমুখি ঘরগুলোর মধ্যে একটারই দরজায় তালা দেওয়া। একের পর এক চাবি দিয়ে চেষ্টা করে শেষে তিন নম্বর চাবিটা তালার ভেতর ঘুরল। একটু নাড়াচাড়া করতে খুলে এল তালাটা। নিচু সাদা দরজাটা হাট করে খুলে ধরল অ্যামি। সঙ্গেসঙ্গেই একটা তীব্র দুর্গন্ধ এসে ধাক্কা দিল তার নাকে।
ঘরটার ভেতরে অন্ধকার। মোটা গরাদ দেয়া ছোটো জানালাটা দিয়ে আলো আসছিল না বিশেষ। ঘরের কাঠের মেঝেটা ফাঁকা-
দুর্গন্ধে মাথা ঘুরে শরীরে পাক দিচ্ছিল অ্যামির। একটু বাদে ঘর থেকে বের হয়ে এসে অন্য ঘরে ঢুকে বুক ভরে নিঃশ্বাস নিয়ে ফের সে এসে ঢুকল সেই ঘরটায়। এইবার তার নজরে পড়ল, এককোণে, মেঝের ওপর একটা কালো দলা পড়ে আছে। এগিয়ে গিয়ে জিনিসটাকে একটুক্ষণ খুঁটিয়ে দেখেই তার গলা দিয়ে একটা ভয়ানক চিৎকার উঠে এল।
চিৎকারটা করবার সঙ্গেসঙ্গেই ঘরের জানালার সামনে একমুহূর্তের জন্য একটা মেঘ ভেসে উঠেছিল যেন। পরমুহূর্তে একটা অস্বস্তিকর বাষ্পের সান্দ্র নিঃশ্বাস যেন স্রোতের মত তাকে বেড় দিয়ে ঘুরে উঠল। তার চোখের সামনে ভেসে উঠছিল কিছু অবোধ্য, অচেনা রঙের নকশা।
সে মুহূর্তে তার ভাববার ক্ষমতা থাকলে হয়ত সে রঙটার সঙ্গে বছরদেড়েক আগে দেখা সেই উল্কার পেটের বুদবুদটার রঙের সাদৃশ্য দেখতে পেত সে। কিন্তু তখন সে’সব ভাববার সময় তার ছিল না। ঘরের কোণ থেকে খটখটে হয়ে শুকিয়ে ওঠা ভূতুড়ে শরীরটা তখন আস্তে আস্তে তার দিকে এগিয়ে আসছে। আর আসতে আসতেই, নড়াচড়ার কাঁপুনিতে ছোটোছোটো টুকরোয় গুঁড়িয়ে যাচ্ছিল তার ভঙ্গুর শরীর—
নাহুমের পোষা জীবজন্তুগুলো আর থ্যাডিয়াসের কপালে যা ঘটেছিল, এর কপালেও যে তা-ই ঘটেছে তাতে অ্যামির সন্দেহ ছিল না। কোন সাধারণ মানুষ হলে এ দৃশ্য সহ্য করে সজ্ঞানে থাকতে পারত না। কিন্তু অ্যামি সে ধাতুতে গড়া নয়। কল্পনা বা আবেগের ছিটেফোঁটাও নেই তার মস্তিষ্কে। দৃঢ়পায়ে দরজা দিয়ে বের হয়ে এসে সে, টেনে টেনে এগিয়ে আসতে থাকা অবয়বটার মুখের ওপর দরজাটা বন্ধ করে দিল। নাহুম এখনো বেঁচে আছে। আগে তাকে সাহায্য করা দরকার।
অন্ধকার, সরু সিঁড়িটা বেয়ে নেমে আসতে আসতেই হঠাৎ পায়ের নিচের রান্নাঘর থেকে একটা দমাস করে শব্দ শুনে অ্যামি চমকে উঠেছিল। ওপরের ঘরে ঢুকে সে চিৎকার করে উঠতেই যে ভেজা, রঙিন বাষ্পটা তাকে ঘিরে ঘুরে উঠেছিল, তার কথা মন পড়ে মেরুদণ্ড দিয়ে একটা কাঁপুনি নেমে গেল তার। ও ঘরে ঢুকে কোন অশুভ শক্তিকে জাগিয়ে তুলল সে?
নিচের ঘর থেকে তখন বারবার অদ্ভুত কিছু শব্দ উঠছে। ভারী কিছু কেউ যেন টেনে নিয়ে চলেছে কাঠের মেঝের ওপর দিয়ে, আর সেইসঙ্গে কোনকিছু প্রবল বেগে শুষে নেবার একটা আঠালো, অপরিচ্ছন্ন শব্দ।
প্রাণের ভয় মানুষের চিন্তাভাবনাকে খানিক তীক্ষ্ণ করে তোলে। এক মুহূর্তের জন্য, শব্দটা কানে যাবার সঙ্গেসঙ্গে ওপরের ঘরে দেখা সেই শুকনো, ভূতুড়ে চেহারাটা ভেসে উঠেছিল অ্যামির চোখে। হা ঈশ্বর, কোন রাক্ষুসে দুনিয়ায় সে ভুল করে পা দিয়েছে এসে! সিঁড়ি বেয়ে নিচে বা ওপরে, কোনদিকেই যাবার শক্তি তখন আর নেই তার। পাথরের মত সেখানে দাঁড়িয়ে থেকে সে শুনে চলেছিল সেই হাড় হিম করা শব্দ, আরো একটা মানুষের অপ্রত্যাশিত পরিণতির ইঙ্গিত!
জায়গাটা পুরো অন্ধকার ছিল না অবশ্য। প্রাচীন বাড়িটার কড়িবররগা থেকে শুরু করে, তার দেয়াল, সিঁড়ির কাঠের ধাপ, সেই সবকিছুই একটা ফ্যাকাশে, মৃদু আলো ছড়াচ্ছিল চারপাশে। এ আলো সে চেনে। নাহুমের বাড়িকে তা ঘিরে থেকেছে গত দেড়টা বছর। এ আলো সাহস দেয় না। কেবল ভয় বাড়িয়ে তোলে।
ঠাৎ একটা তীক্ষ্ণ চিঁহিহি ডাকে চমকটা ভেঙে গেল অ্যামির। সে শব্দের সঙ্গে মিশে যাচ্ছিল অ্যামির ঘোড়ার ক্ষুর আর গাড়ির চাকার আওয়াজ। হঠাৎ কিছু দেখে ভয় পেয়ে গাড়িটা নিয়ে প্রাণপণে ছুট দিয়েছে তার ঘোড়াটা। আর তারপরেই ওপর থেকে জলের ভেতর ভারী কিছু পড়বার মত ঝপাস করে শব্দ উঠল একটা। কুয়োটা!! ওর কাছেই তো অ্যামি তার ঘোড়াশুদ্ধ গাড়িটাকে ছেড়ে এসেছিল! তাহলে কি ভয় পেয়ে তার গাড়িশুদ্ধ ঘোড়াটা ওই কুয়োর ভেতর-
হঠাৎ শরীরের সব জড়তা ঝেরে ফেলল অ্যামি। চিলেকোঠার ঘরে ঢোকবার আগে একটা শক্তপোক্ত লাঠি সঙ্গে নিয়েছিল সে। সেটা চেপে ধরে পায়ের নিচে আবছা আলোকিত সিঁড়িটার দিকে একবার তাকাল সে। তলার ঘর থেকে একটা দুর্বল খসখস শব্দ উঠছিল। লাঠিটা বাগিয়ে ধরে সিঁড়ি বেয়ে নেমে এসে করিডোর বেয়ে রান্নাঘরের দিকে এগিয়ে গেল অ্যামি।
কিন্তু সে অবধি পৌঁছোবার কোন প্রয়োজন হল না তার। যার খোঁজে সে সেখানে যাচ্ছিল সে নিজেই তখন এগিয়ে এসেছে তার দিকে। তখনও প্রাণ রয়ে গেছে তার শরীরে। নিজেনিজেই হামাগুড়ি দিয়ে সে সেখান অবধি এসেছে নাকি কোনকিছুতে তাকে সেখানে টেনে এনে ফেলে দিয়ে গেছে তা অ্যামি জানে না। নাহুমকে ছেড়ে আসবার পরের আধঘন্টা সময়ের মধ্যেই গোটা ঘটনাটা ঘটে গেছে, অথচ তার দিকে করুণ চোখে তাকিয়ে থাকা নাহুমের শরীরটা এরই মধ্যে সম্পূর্ণ ফ্যাকাশে হয়ে উঠেছে। মরা একটা গাছের ডালের মত হয়ে ওঠা শরীরটা থেকে খসে পড়ছে শুকনো চামড়া, মাংসের ভঙ্গুর দলা।
শরীরটা ছোঁবার সাহস অ্যামির ছিল না। বেঁকেচুরে শুকিয়ে ওঠা মুখটায় জেগে থাকা চোখদুটোর দিকে তাকিয়ে সে দূর থেকেই প্রশ্ন করল, “কী হয়েছিল নাহুম? কে—”
নাহুমের বিকৃত মুখের গায়ের ঠোঁটহীন ফুটোটা নড়ে উঠেছিল অনেক কষ্টে—“কেউ না—কেউ না—জ্বালা–রং—শুধু রঙ—ঠাণ্ডা, ভেজা রঙ—তবু জ্বালিয়েপুড়িয়ে দেয়—আমি দেখেছি অ্যামি—ছেড়ে যেতে দেয় না—টেনে ধরে রাখে—তুমি টের পাবে সে আসছে—তবু পালাতে পারবে না—ওহো হো–আমার ফুলগুলো—থ্যাডিয়াস—মার্নি—জেনাস—যা কিছু জ্যান্ত—তার জীবন চুষে নিয়ে—আঃ-কুয়োটায় রাতে আলো জ্বলে— ঐ পাথরে চড়ে এসেছিল—প্রফেসররা বুদবুদটা ফাটালো কেন অ্যামি—আমার মাটিতে বিষ–ওর বীজ—হাজার হাজার–প্রাণ খেয়ে বাঁচে—বাড়ে—আমার জেনাস—শক্তপোক্ত ছেলেটা—কুয়োর ধারে যেতে ওকে ধরল—ওঃ—আমি ওকে দেখেছি অ্যামি–
“-লড়াই দিয়েছিল ছেলেটা আমার—তুমুল লড়াই—কী যন্ত্রণা—আগে মনটাকে খেল—তারপর ভেতর থেকে ওকে পুড়িয়ে দিয়ে—আমার চোখের সামনে অ্যামি—তুমি ঠিক বলেছিলে—কুয়োর জলে বিষ—অ্যামি সাবধান—ও এই পৃথিবীর নয়—প্রফেসর বলেছিল—ও এসেছে অন্য কোন দুনিয়া থেকে–ওর বড়ো খিদে–অনেক—অনেক—”
এরপর আর কোন কথা বের হয়নি নাহুমের মুখ দিয়ে। কথা বলার পরিশ্রমে মুখের হাড়গুলো দুমড়ে গিয়ে চোয়াল ভেঙে পড়েছিল তার।
নাহুমের শরীরের যে অবশিষ্টাংশটুকু পড়ে ছিল, তার ওপরে একটা টেবলক্লথ চাপা দিয়ে অ্যামি এরপর পাগলের মত ছুটে বের হয়ে যায় সে বাড়ি থেকে।
ঘোড়ার খোঁজে কুয়োটার ধারেকাছে এগোবার সাহস হয়নি তার। অবশ্য তাতে লোকসান কিছু হয়নি। খানিক বাদে বাড়ি পৌঁছে সে দেখে গাড়ি নিয়ে তার ঘোড়া খানিক আগে নিজেনিজেই বাড়িতে এসে পৌঁছেছে। জন্তুটার গায়ে হাত বোলাতে বোলাতেই একটা নিঃসীম আতঙ্ক তাকে গ্রাস করেছিল এসে। তাহলে কুয়োয় ঝাঁপ খাবার শব্দটা!! তার মানে, নাহুমকে শেষ করবার পর বাড়ি থেকে বের হয়ে ওই কুয়োর মধ্যে কেউ একটা—
খানিক বাদে ফের গাড়ি হাঁকিয়ে আখরামে গিয়েছিল সে। নাহুম সপরিবারে মারা গেছে বলে খবর দিয়েছিল কর্তৃপক্ষের কাছে। কীভাবে কী হয়েছে তার কোন বিস্তারিত বিবরণ সে তাঁদের দেয়নি। শুধু বলেছিল, যে রোগে তার পোষা জীবজন্তুদের প্রাণ গেছে সেই একই রোগ সম্ভবত শেষ করে দিয়েছে সে বাড়ির অন্যান্যদেরও।
অ্যামি তাঁদের আরো জানায় যে মেরউইন এবং জেনাস হারিয়ে গিয়েছে। এরপর থানায় প্রচুর জিজ্ঞাসাবাদের শেষে অ্যামির সঙ্গে তিনজন অফিসার, একজন করোনার, একজন পশুচিকিৎসক ও একজন ডাক্তার অকুস্থলে তদন্তের জন্য যান। সে সময় বিকেল হয়ে আসছিল। দিনের আলো ছাড়া সেখানে যাবার ব্যাপারে অ্যামির আপত্তি থাকলেও পুলিশ সে আপত্তি মানেনি। তবে শেষমেষ, সঙ্গে এতজন মানুষ থাকায় ফিরে যেতে ততটা ভয় লাগেনি অ্যামির।
ছ’জন সরকারি মানুষের দলটাকে নিয়ে ওয়াগনটা অ্যামির গাড়ির পিছুপিছু বিকেল চারটে নাগাদ নাহুমের খামারবাড়িতে এসে পৌঁছয়। ভুতূরে বাড়িটার চেহারা দেখেও বিশেষ হেলদোল হয়নি তাদের। উদ্ভট আর বীভৎস জিনিস দেখবার অভিজ্ঞতা তাদের কম নয়। কিন্তু সে বাড়ির দোতলায়, আর নিচতলার মেঝেতে টেবিক্লথের তলায় যে দৃশ্য তারা দেখেছিল তাতে সেই পোড়খাওয়া মানুষগুলোও থমকে গিয়েছিল কিছুক্ষণের জন্য। মানুষের শরীরের বিকৃত সে অবশিষ্টের দিকে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকা যায় না। এমনকি ডাক্তারও একমুহূর্তের জন্য সেগুলোকে দেখে চোখ ফিরিয়ে নিয়ে রায় দিয়েছিলেন, পরীক্ষা করবার মত বিশেষ কিছুই অবশিষ্ট নেই সেগুলোতে।
সেদিন খামারবারির থেকে দু’শিশি মাটির নমুনা গিয়েছিল তাদের সঙ্গে। সে মাটির পরীক্ষার ফলাফল আগেই বলা হয়েছে। স্পেক্ট্রোস্কোপে মাসখানেক ধরে তাদের মধ্যে সেই অজানা উপাদানের বর্ণালি ধরা পড়বার পর সে বর্ণালি মিলিয়ে যায়। পড়ে থাকা ধুলোটা পরিচিত কার্বনেট আর ফসফেটের একটা ক্ষারীয় মিশ্রণ হিসেবে চিহ্নিত হয়। তবে সে অনেক পরের কথা। সেদিন বিকেলে তারা সে সব কিছুই জানতে পারেনি।
তখন সূর্য অস্ত যাচ্ছে। তার মায়াবি আলোয় হাঁ করে থাকা কুয়োর বিরাট মুখটার দিকে বারবার অ্যামিকে তাকাতে দেখে পুলিশের এক গোয়েন্দা তাকে জেরা করতে শুরু করল এসে। লোকগুলো কুয়োর বিষয়ে তার বক্তব্য শুনে একেবারে ক্ষেপে উঠতে পারে এমন আন্দাজ করলে অ্যামি অবশ্য প্রাণ গেলেও তাদের কিছু বলতই না। কিন্তু সেটা সে আর আগে থেকে বুঝবে কেমন করে? জেরার মুখে অ্যামিকে শেষমেষ বলতেই হয় যে কুয়োটায় কিছু একটা আছে বলে নাহুমের ভয় ছিল। এতটাই ভয় যে হারিয়ে যাওয়া ছেলেদুটোকে খুঁজতেও সে কুয়োটার কাছে এগোয়নি কখনো।
এ কথা শোনবার পরে, অ্যামির হাজারো অনুরোধ উপরোধে কান না দিয়ে, সেই সন্ধের মুখেই কুয়োটার জল খালি করে সেটাকে পরীক্ষা করার কাজ শুরু করে দিল পুলিশ। বালতির পর বালতি দুর্গন্ধ ভরা জল তুলে ফেলা হচ্ছিল নাহুমের উঠোনে। সে গন্ধে নাকে রুমাল চাপা দিয়েও স্বস্তি পাচ্ছিল না লোকজন। অ্যামি তখন দম বন্ধ করে তাকিয়ে ছিল দ্রুত খালি হয়ে আসতে কুয়োটার দিকে।
জল বেশি ছিল না কুয়োটাতে। সেটাকে খালি করতে তাই বেশি সময় লাগেনি। মেরউইন আর জেনাস, দুজনকেই পাওয়া গেল ওর ভেতরে। সবটা নয় অবশ্য। দুটো কঙ্কালের গায়ে তখনো লেগে থাকা কাঠের মত শক্ত খানিক ফ্যাকাশে হয়ে যাওয়া চামড়া আর মাংসই অবশিষ্ট ছিল শুধু। পাওয়া গেল একটা ছোটো হরিণ আর একটা কুকুরের দেহাবশেষ, আর ছোটোছোটো কিছু জীবজন্তুর হাড়গোড়। কুয়োর তলায় জমে থাকা থকথকে কাদায় ক্রমাগত বিষাক্ত কোন গ্যাসের বুড়বুড়ি কাটছিল। তার দেয়ালের হাতল ধরে ধরে তলাটা পরীক্ষা করতে নেমেছিল যে লোকটা সে তার হাতের লম্বা ডান্ডাটা তাতে ঢুকিয়ে দিয়েও তল খুঁজে পেল না সেই থকথকে কাদার।
খানিক বাদে কুয়োর ধার ছেড়ে লোকজন যখন বাড়ির ভেতর ফেরত এল তখন অন্ধকার নেমে এসেছে। পুরোনো বসবার ঘরে বসে লন্ঠনের আলোয় গোটা কেসটা নিয়ে আলোচনা চলছিল তখন। গোটা দলটাই কিংকর্তব্যংবিমূঢ় হয়ে গেছে। এ বাড়ির গাছপালার মৃত্যু, দুটো অস্বাভাবিক বিকৃত মৃতদেহ আর কুয়োর মধ্যে দুই কিশোরের শরীরের মধ্যে কোন যোগসূত্র খুঁজে পাচ্ছিল না কেউ। এটা ঠিক যে, এলাকায় চালু গুজবগুলো তারা শুনেছিল। কিন্তু প্রকৃতির নিয়মকে মানে না এমন কিছু যে এখানে ঘটে থাকতে পারে সেটা হাজার চেষ্টাতেও তারা মন থেকে মেনে নিতে রাজি নয়। উল্কার থেকে বাড়ির মাটিতে বিষ ঢুকেছে ধরে নিলে গাছপালাগুলোর মৃত্যুর কারণ পাওয়া যায়। কিন্তু যারা ও মাটির থেকে ওঠা কোনকিছু খায়নি তারা? যদি ধরে নেয়া যায় কুয়োর জলে বিষ ছিল, তাহলেও তো দুটো তরতাজা তরুণের ওর জলে গিয়ে ঝাঁপ দেবার কোন ব্যাখ্যা মেলে না। তাছাড়া গাছ, পশু, মানুষ– প্রত্যেকটা মৃতদেহ এমন ফ্যাকাশে আর ভঙ্গুর হয়ে উঠলই বা কীভাবে?
কথাবার্তা চলতেচলতে জানালার পাশে বসা করোনারই প্রথম কুয়োর মুখে গড়ে উঠতে থাকা মৃদু আভাটা খেয়াল করেন। ততক্ষণে রাত গভীর হয়েছে। নাহুমের বাড়ির চারপাশের মাটি আর শুকনো ঝোপঝাড়ও আস্তে আস্তে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে মৃদু আলোর আভায়। আকাশে চাঁদ ছিল, কিন্তু সে আভা যে চাঁদের নয় সে বিষয়ে কারো কোন সন্দেহ ছিল না। ওরই মধ্যে কুয়োর মুখের আভাটা হঠাৎ বেশ দানা বেঁধে উঠে, হঠাৎ সার্চলাইটের লম্বা রশ্মির মত কুয়োর মুখ ছেড়ে বাইরে উঠে এল। কুয়ো থেকে তুলে ফেলা জলের খানিক খানিক তখনো এখানে ওখানে জমে আছে। তার বুকে সেই রশ্মির প্রতিবিম্ব তিরতির করে কাঁপছিল।
হঠাৎ সেদিকে তাকিয়ে থরথর করে কেঁপে উঠল অ্যামি। ও রশ্মির রঙ সে চেনে! উল্কাটা এখানে এসে পড়বার পর থেকে বারেবারে ও রঙ সে দেখেছে। শেষবার তার দেখা সে পেয়েছিল সেদিন সকালে, নাহুমের স্ত্রীর চিলেকোঠার ঘরে—
তাদের ঘোড়াগুলো বাইরে তখন ভয়ে চিৎকার জুড়েছে। ঘরের ভেতর প্রত্যেকে উঠে দাঁড়িয়েছে তখন। তাদের মধ্যে প্রথমেই একজন গাড়োয়ান ঘোড়াগুলোকে শান্ত করতে বাইরে যাবার জন্য পা বাড়িয়েছিল। অ্যামি কাঁপা কাঁপা হাতে তাকে গিয়ে আটকাল, “ওখানে বেরিও না—আমরা যা জানি তার চেয়ে বেশি কিছু আছে এ জায়গাটায়—নাহুম মরবার আগে বলেছিল ওই কুয়োতে কিছু একটা থাকে—নাহুম তাকে দেখেছে—ও এই দুনিয়ার কেউ নয়—”
অ্যামির গলায় কিছু একটা ছিল। লোকগুলো খানিকটা হতভম্ব হয়ে থমকে গেল। কুয়ো থেকে বেরিয়ে আসা আলোর ধারাটা তখন ক্রমশই জোরালো হয়ে উঠছে।
খানিক বাদে হঠাৎ জানালার পাশ থেকে একজন গোয়েন্দার আঁতকে ওঠার শব্দ পাওয়া গেল। আকাশের দিকে চোখ ফেলেছিল সে। তার চোখকে অনুসরণ করে ওপরের দিকে তাকিয়ে গোটা দলটাই নির্বাক হয়ে গিয়েছিল কয়েক মুহূর্তের জন্য। একফোঁটা হাওয়া ছিল না কোথাও। তবু, সেই চাঁদনি রাতের মায়াবি আলোয় বাড়িটাকে ঘিরে থাকা সমস্ত গাছের মৃতদেহগুলো তখন নড়তে শুরু করেছে। বুনো সর্ষের শুকনো ঝারগুলো ছবির মত স্থির। সরকারি গাড়িটার ক্যাম্বিশের ছইতেও কোন নড়াচড়ার আভাস নেই। আর সেই নিশ্চল, নিস্পন্দ রাতের আকাশে, উঠোন ঘিরে দাঁড়ানো বড়ো বড়ো গাছগুলো তাদের পাতাহীন শুকনো ডালপালাগুলোকে, মন্ত্রবলে জেগে ওঠা কঙ্কালের হাড়ের মত দুলিয়ে চলেছে অনবরত। চাঁদের আলোয় উজ্জ্বল মেঘের টুকরোগুলোকে নখ দিয়ে খামচে নেবার ব্যর্থ চেষ্টায় যেন বা ক্রমাগত ছটফট করে চলেছে তারা। সে নড়াচড়ায় একটা পৈশাচিক চেতনার ছাপ ছিল। যেন তাদের শেকড় জড়িয়ে থাকা কোন ভয়াল অস্তিত্ত্ব মাটির গভীর থেকে ছাড়া পাবার ছটফটানিতে ক্রমাগত ধাক্কা মেরে চলেছে তাদের মৃত শরীরে।
কয়েক মুহূর্তের জন্য নিঃশ্বাস নিতেও ভুলে গিয়েছিল যেন ঘরের ভেতরে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষগুলো। তারপর হঠাৎ একখণ্ড অন্ধকার মেঘ এসে ঢেকে দিল চাঁদের মুখ। কয়েক মুহূর্তের জন্য বাতাস খামচাতে থাকা ডালগুলোর ছবি মিলিয়ে এল আকাশের পটভূমিতে।
আর তারপরেই ফের একবার একসঙ্গে একটা ভয়ার্ত আওয়াজ বের হয়ে এল লোকগুলোর গলা থেকে। গভীর অন্ধকারেও ফের একবার পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে নড়তে থাকা গাছগুলোকে! তাদের মাথায় মাথায় হাজার হাজার ছোটোছোটো আলোর শিখা! অপ্রাকৃতিক আলোর সেইসব টুকরোর ঝাঁক, যেন কোন জলার বুকের আলেয়ার মতই তালে তালে দুলছে, নিচু করে চেপে ধরছে প্রত্যেকটা ন্যাড়া ডালকে। যেন হাজার হাজার মৃতভোজী জোনাকি মহা উল্লাসে নেমে আসতে চাইছে গাছের মাথায় তাদের জন্মভূমি থেকে পৃথিবীর বুকে।
একইসঙ্গে, কুয়ো থেকে বের হয়ে আসা আলোর ধারাটা তখন জোরালো হয়ে উঠেছে। তীব্র একটা স্রোতের মত তা কুয়োর মুখ থেকে ধেয়ে যাচ্ছিল সটান আকাশের দিকে।
পশুচিকিৎসক ভদ্রলোক কাঁপাকাঁপা হাতে বন্ধ দরজার গায়ে একটা চেয়ার চেপে দিলেন এগিয়ে গিয়ে। ভয়ে অ্যামির তখন গলা দিয়ে শব্দ বের হচ্ছে না। পাশে দাঁড়ানো এক গোয়েন্দার জামার হাতা ধরে টান দিয়ে সে তখন বাইরের গাছগুলোর দিকে দেখাচ্ছিল। গাছগুলোর শরীর তখন একটা ঠাণ্ডা, রঙিন আলোয় ভরে উঠছিল। ঘোড়াগুলোর ভয়ার্ত চিৎকারে কান পাতা দায়, কিন্তু ঘরের একজন মানুষেরও বাইরে বেরিয়ে তাদের শান্ত করবার সাহস ছিল না।
অগ্নিবর্ণ গাছগুলো তখন তাদের পাতাহীন ডালগুলোকে আকাশের দিকে সটান ঘুরিয়ে ধরেছে। একইসঙ্গে আলো ছড়াতে শুরু করেছে গোটা বাড়িটাই। খানিক বাদে হঠাৎ ঘোড়াগুলোর প্রাণপণ টানে তাদের বেঁধে রাখা গাছটার শুকনো শরীর ভেঙে পড়ল। একসঙ্গে চিৎকার করতে করতে গাড়ি টেনে নিয়ে পালিয়ে গেল তারা জঙ্গল পেরিয়ে।
কুয়োয় নেমেছিল যে লোকটা সে তখন আপনমনেই বিড়বিড় করছে, “জায়গাটার কোন তল নেই। ওর মধ্যে কিছু একটা ছিল জানেন! আমি টের পাচ্ছিলাম। লাঠি দিয়ে জায়গাটাকে খুঁড়ে, খুঁচিয়ে–আমি—তাহলে কি ওইতেই কাদার তলা থেকে কিছু একটা জেগে উঠে—”
কথাটা সে শেষ করবার আগেই হঠাৎ কুয়োর মুখ থেকে উঠে আসা আলোটা একমুহূর্তের জন্য স্থির হয়ে দাঁড়াল। তারপর একটা ফুলের মত চারপাশে তার মাথাটাকে ছড়িয়ে দিয়ে শিখাগুলোর জমাট বুনোটে বিচিত্র কিছু চেহারা তৈরি করতে শুরু করে দিল। অ্যামির ঘোড়াটা বাইরে রাস্তায় বাঁধা ছিল। গলার শক্তপোক্ত বাঁধন এবারে আর ছিঁড়তে পারেনি সে। দূর থেকেই তার ছটফটানি আর চিৎকার কানে এলেও সে মুহূর্তে কিছুই করবার উপায় ছিল না অ্যামির। এইবার হঠাৎ একটা ভয়ংকর চিৎকার করেই একেবারে থেমে গেল সে। দূরে দেখা যাচ্ছিল, তার সাদা শরীরটা লুটিয়ে পড়েছে ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যাওয়া গাড়িটার ওপরে। তাকে ঘিরে তখন পাক খাচ্ছিল কুয়ো থেকে উঠে আসা আলোর একটা স্রোত—
ঠিক সেই সময় একজন ডিটেকটিভের চিৎকারে ঘরের ভেতরের দিকে নজর ফিরে এল সবার। বাইরের দৃশ্য ভালো করে দেখবার আশায় লন্ঠনগুলো নিভিয়ে দেয়া হয়ছিল খানিক আগে। অন্ধকার ঘরটার ভেতর তখন তখন আস্তে আস্তে জেগে উঠছিল মৃদু আলোর আভা। তার রঙ অ্যামির চেনা!! আস্তে আস্তে ঘরটার দেয়াল থেকে তার দরজা জানালায় তার মেঝেতে, কাঠের পিলারে ছড়িয়ে যাচ্ছিল আভাটা। সেইসঙ্গে লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়ে উঠছিল তার ঔজ্জ্বল্যও।
“পালাতে হবে এখান থেকে। এক্ষুণি!” বিড়বিড় করতে করতে উঠে দাঁড়াল অ্যামি। তার সঙ্গীসাথীদের তখন আর প্রতিবাদ করবার মত অবস্থা নেই। নিঃশব্দে উঠে অ্যামির পেছনপেছন বাড়ির খিড়কির দরজা দিয়ে বের হয়ে এল তারা। তারপর নাহুমের উঠোনকে পেছনে ফেলে চড়াই বেয়ে যখন বেশ খানিকটা উঁচুতে উঠে তার গরু চড়াবার মাঠটাতে এসে পৌঁছেছে, ততক্ষণে চাঁদ একবার উঁকি দিয়েই ফের ঢেকে গেছে ঘন একতাল মেঘের পেছনে। চারপাশে ছেয়ে থাকা গাঢ় অন্ধকারের মধ্যে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছিল তারা।
অনেক নিচে নাহুমের খামারবাড়ির গোটা এলাকাটাই তখন ঢেকে গিয়েছে তার কুয়ো থেকে উঠে আসা বিচিত্র রঙের আলোর বন্যায়। সেই ফুটন্ত, ঝিকিমিকি রামধনু আলোর আলিঙ্গণে ডুবে থেকে, গনগণে হয়ে ওঠা মৃত গাছেদের দল যেন এক ভূতুড়ে নাচের তালেতালে আকাশের দিকে ছুঁড়ে দিচ্ছিল অগুণতি ছোটোছোটো আলোকশিখাকে। যেন একদল সদ্যোজাত সর্পশিশু মায়ের নিরাপদ আলিঙ্গনে ধরা থেকেই আকাশের পথ বেয়ে খুঁজে নিতে চাইছে তাদের নতুন ঠিকানা, নতুন কোন চারণভূমি—
আর তারপর, একেবারে হঠাৎ, কোন ইঙ্গিত ছাড়াই রামধনু আলোর স্রোতটা একটা চোখঝলসানো আলোর পিণ্ড হয়ে কুয়ো ছেড়ে ছিটকে উঠল আকাশের গায়। প্রায় সঙ্গেসঙ্গেই তার আলোয় ভাস্বর হয়ে ওঠা মেঘের গায়ে খুলে গিয়েছিল একটা অন্ধকার গর্ত। চোখের পলক ফেলতে না ফেলতে সে গর্ত বেয়ে উধাও হল আলোর গোলক। মানুষগুলো আকাশের গায়ে অসহায়ভাবে তাকিয়ে দেখেছিল, বহু দূরে, আকাশের গায়ে জ্বলন্ত সিগনাস, ডেনেবদের আড়াল করে দিয়ে আকাশগঙ্গার চিকিমিকি শরীরে মিলিয়ে গেল তার ছটা।
পরের মুহূর্তেই তাদের ফের একবার ফিরে তাকাতে হয়েছিল পায়ের অনেক নিচে নাহুমের খামারবাড়ির দিকে। সেখানে তখন মড়মড় শব্দ করে ফেটে যাচ্ছে আলোকিত গাছগুলোর শরীর, ফেটে যাচ্ছে নাহুমের কাঠের তৈরি প্রাচীন বসতবাড়িটাও। আর তাদের বুক থেকে, গোটা খামারটাকে ছেয়ে থাকা বিষাক্ত বাষ্পের পর্দা ছিঁড়ে আকাশের দিকে উঠে আসছিল, ছোটোছোটো বর্ণিল আলোকশিখার একটা অতিকায় ঝাঁক! কয়েকটা মুহূর্ত মাত্র। তার পরই মেঘের গায়ে খুলে থাকা গর্তটার পথে তাদের পূর্বসূরীর পথ ধরে উধাও হল আলোকশিখার ঝাঁক।
ভীত মানুষগুলোর পায়ের নিচে তখন ফের ছেয়ে এসেছে নিবিড় অন্ধকার। সে অন্ধকারের বুক থেকে উঠে আসা তীব্র একটা হাওয়ার ঝাপটা তখন পাহাড়জোড়া বনভূমির সঙ্গে তাদেরও টালমাটাল করে দিচ্ছিল। অন্ধকারে হাতড়ে হাতড়ে মাঠঘাট ভেঙে অ্যামিরা এরপর ফিরে গিয়েছিল আখরামের দিকে। নাহুমের বাড়ির শেষ দশা কী হল তা ফিরে দেখবার মত সাহস আর তাদের হয়নি সে রাত্রে।
আখরাম পৌঁছোবার খানিক আগে অ্যামির বাড়ি। মাঠ ছেড়ে খানিকদূরে মূল রাস্তায় উঠে একটুখানি হাঁটলেই সেখানে পৌঁছোন যায়। কিন্তু দলের অন্যদের ছেড়ে সেদিকে একলা এগোতে গিয়ে হঠাৎ থমকে দাঁড়িয়েছিল সে। বাকিদের অনুরোধ করেছিল, তার সঙ্গে যেন একবারটি তারা তার বাড়িতে আসে। এমন একটা অভিজ্ঞতার পরে এই ভয়টুকু স্বাভাবিক। কাজেই সে নিয়ে কেউ তাকে কোন প্রশ্ন করেনি।
কিন্তু সে ভয়ের সঠিক কারণ কেবল অ্যামি একলা জানত। কারণ, সবাই যখন আকাশে আলোকশিখার ঝাঁকের চলে যাওয়া দেখতে ব্যস্ত সে সময় সে হঠাৎ একবার নাহুমের অন্ধকারে ঢেকে যাওয়া খামারের দিকে ফিরে তাকিয়েছিল। সে অন্ধকারের বুকে, নাহুমের কুয়োর কাছে তখন হঠাৎ জেগে উঠেছিল একটামাত্র দুর্বল আলোকশিখার খণ্ড। তারপর, চোখের পলক ফেলবার আগেই ফের কুয়োর ভেতরে হারিয়ে গিয়েছিল পথভোলা সেই আলোর টুকরো। অ্যামি তার রঙটা ঠিকই চিনতে পেরেছিল। সে জানত, মাটির নীচে কোথাও তখনো জেগে আছে তা—অপেক্ষায় আছে—
সেই থেকে অ্যামি আর কখনো সম্পূর্ণ স্বাভাবিক হতে পারেনি। পঞ্চাশটা বছর কেটে গেছে তার পর। এর মধ্যে অ্যামি একদিনের জন্যও আর নাহুমের কুয়োর ধারে যায়নি। যেদিন নতুন জলাধারটা নাহুমের জমিটাকে সলিলসমাধি দেবে সেদিন সে শান্তিতে ঘুমোবে। আমিও নিশ্চিন্ত হব সেদিন। কারণ, সেদিন আমিও ওই কুয়োর মুখ থেকে উঠে আসা বাষ্পে একটা বিচিত্র, ব্যাখ্যাহীন রঙ দেখেছিলাম।
******
গ্রামগঞ্জের মানুষ অদ্ভুত সব গল্প বলে। তারা বলে, এখনো নাহুমের কুয়োয় কেউ আছে। কেউ কিছু দেখেনি যদিও, তবু নাহুমের ঘটনাটার পর আখরামের পশ্চিমের ওই পাহাড়ি এলাকাটায় কিছু খারাপ প্রভাব রয়ে গিয়েছিল বলে লোকজনের বিশ্বাস। ছোটোছোটো খামারগুলোর বাসিন্দারা দুঃস্বপ্ন দেখত। ভয়ংকর সব স্বপ্ন। মাথার দোষ দেখা দিত অনেকেরই। অথচ একবার তেমনটা শুরু হলে তারা সে এলাকাটা ছেড়ে কিছুতেই বের হতে পারত না। জোর করে টেনে নিয়ে গেলে নিজেরাই ফিরে আসত আবার। তারপর আস্তে আস্তে শুকিয়ে মারা যেত।
শেষে এলাকার শক্তপোক্ত মনের যে লোকজন তখনো সুস্থ ছিল, তারা রণে ভঙ্গ দিয়ে পাহাড় ছেড়ে পালাল। যারা রয়ে গেল তাদের মধ্যে কেউ বাঁচেনি, এক ওই আধাপাগলা অ্যামি ছাড়া। সম্ভবত তার বাড়িটা নাহুমের খামারের থেকে বেশ অনেকটা দূরে আছে বলে, এলাকা ছেড়ে পালাবার ক্ষমতা না থাকলেও এতদিন প্রাণে বেঁচে আছে সে।
জলাধারটা তাড়াতাড়ি হয়ে যাওয়া প্রয়োজন। আখরামে এখন একটা নতুন গুজব উঠেছে। যদিও সে নিয়ে হাসাহাসি হচ্ছে বিস্তর। পশ্চিমের পাহাড়ের জঙ্গলে নাকি রাত্রে জ্বলন্ত ওকগাছদের নড়েচড়ে বেড়াতে দেখা গেছে। তবে সেটা যদিও বা গুজব হয়, তবু এ কথাটা সত্যি যে নাহুমের খামার ঘিরে খুব আস্তে আস্তে গাছেদের ফ্যাকাশে হয়ে ওঠবার রোগটা ছড়াচ্ছে। প্রথমে ফ্যাকাশে, তারপর নিজেদের সমস্ত রস হারিয়ে ঝুরঝুরে গুঁড়ো হয়ে ঝরে পড়ে। এখনো খুব আস্তে যদিও, তবু হিসেবমত বছরে কয়েক ইঞ্চি পরিধিতে বেড়ে যাচ্ছে তা।
অ্যামিকে নিয়ে আমার ভয় হয় আজকাল। নাহুমের পরিবার ছাড়া একমাত্র সে ওই বস্তুটার সংস্পর্শে এসেছিল সবচেয়ে বেশি। গোটা ঘটনাটার সময় সে বারেবারে নাহুমের বাড়িতে গিয়েছে। তার বাড়ির জল খেয়েছে। আচ্ছা, নাহুম কেন একেবারে একা একা থাকে? কেন সে জায়গাটা ছেড়ে চলে যেতে পারে না? কেন? জলাধারের কাজ করবার জন্য যখন লোকজন ওখানে যাবে, আ-আমি ওদের বলব যেন খেয়াল রাখে—অ্যামি যেন কুয়োটার ধারেকাছে না যায়—
জিনিসটা যে ঠিক কী তা আমি জানি না। সম্ভবত কেউই তা জানে না। তবে হ্যাঁ, পরিচিত বিশ্বের কোন চেনা বস্তু যে সে নয় সেটুকু আন্দাজ করতে পারি। জ্যোতির্বিদরা পৃথিবী আর মহাকাশে এখন অবধি যত বস্তুর খোঁজ পেয়েছেন, ও জিনিস তাদের কারো দলেই পড়ে না। ও শুধুই মহাকাশ থেকে ভেসে আসা একটুকরো আলো, যে আলোর রঙ পরিচিত বিশ্বের বর্ণালীতে কখনো ছিল না। পরিচিত মহাবিশ্বের বাইরে থেকে ভেসে আসা সে বর্ণদূতদের একজন হয়ত এখনও তার নতুন এই চারণভূমিতে—গোপনে–
আচ্ছা জলের তলায় কি—-
ছবিঃ অর্ক পৈতণ্ডী(হেডপিস ও সাদাকালো ছবি) ও ঋত্বিক
জয়ঢাকের গল্প উপন্যাসের লাইব্রেরি
আহা ! বেশ বেশ বেশ !
LikeLike
এত লেখেন কখন সেটাই মাথায় ঢোকে না।
LikeLiked by 1 person
লকডাউন পর্বে পরপর পড়লাম আপনার অনুবাদে লাভক্র্যাফট। এবার রাতে ঘুমোব কী করে?
LikeLike