পুজোর উপন্যাস বারে বারে আসে দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য শরৎ ২০১৬

পুজোর উপন্যাস

uponyasbarebare00 (Medium)

দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য

এক

খৃঃ পূঃ ২০০০

গোটা বাড়িটা দুপুরের দিকে একেবারে চুপচাপ হয়ে যায়।  সিবিলা দুর্গপ্রাসাদের দিকে বেরিয়ে গেছেন সকালবেলায়। রাঙ্গোর দায়িত্ব এইসময় বাজারটা সেরে ফেলা। সে-ও অনেকক্ষণ হল বেরিয়েছে। সূর্য এখন মাথার ওপরে। সেদিকে খেয়াল হতে রিনিয়া গা ঝাড়া দিয়ে উঠে বসল। উনুন ধরাতে হবে। কিছুক্ষণ বাদেই দুপুরের খাবার খেতে বাড়ি ফিরবেন সিবিলা। ঠিক সময়ে রান্নাবান্না শেষ না হলে কপালে মার জুটবে। ও কাজটা করতে সিবিলা বেজায় পটু। কুড়িয়ে পেয়ে এনে ভাইবোনকে বাড়িতে থাকতে দিয়েছেন, তাই তাদের দিয়ে দাসের মত খাটিয়ে উশুল করে নেন। ভুল করলে শাস্তি দিতে কসুর করেন না।

রাঙ্গো অবশ্য মার খেয়ে কিছু মনে করে না। সে হাটেবাজারে ঘোরে। শহরবাজারের খবরও রাখে। সে বলে,“দিদি,সিবিলাকে সারা শহরের মানুষ সাক্ষাত যমের মত ভয় পায় রে। উনি শহরের বিচারক। সামান্য অপরাধেও মৃত্যুদণ্ড দেন। সেদিক থেকে দেখলে আমরা তো অনেক ভালো আছি।”

“ভালো!” শব্দটা নিয়ে মনের মধ্যে একটু নাড়াচাড়া করে নিল রিনিয়া। কে জানে! একেই বোধ হয় ভালো থাকা বলে! কিন্তু নাঃ। আর দেরি করা যায় না। রসুইঘরের একপাশে লতাপাতার স্তূপ রাখা আছে। উনুনে কাঠ সাজানোই ছিল। তার  নীচে খানিক লতা ঢুকিয়ে দিয়ে অন্যমনস্কভাবে আঙুলটা বাড়িয়ে দিয়েছিল সে সেদিকে। তারপর কী খেয়াল হতে তাড়াতাড়ি আঙুল বের করে এনে চকমকিপাথর দুটো হাতে তুলে নিল রিনিয়া। কে জানে কে কখন দেখে ফেলে! গত কয়েকমাস ধরেই তো তার আর রাঙ্গোর ওপরে কড়া নজর রেখে চলেছেন সিবিলা। বিশেষ করে মাসকয়েক আগে স্নানাগারের সামনে সেই গন্ডগোলটা হবার পর থেকে।

পশুপতিদেবের পুজো ছিল সেদিন। এই দিনটা দুর্গপ্রাসাদের দরজা সারা শহরের জন্য খোলা। বিশাল স্নানাগার টইটুম্বুর করে দেয়া হয়েছে পাহাড় বেয়ে নামা ঝর্ণার জলের গতিপথ ঘুরিয়ে। শহরের প্রত্যেকে সেদিন সেখানে স্নান করে পশুপতির পুজো করে। দাসরাও বাদ যায় না। বড়ো পুরুতের হুকুম।

রাঙ্গো আর রিনিয়াও কাজেই স্নানে গিয়েছিল। বাইরে বের হলে একটা লম্বা ঘাসের দড়ি তাদের কোমরে বেঁধে দড়ির অন্যদিকটা হাতে করে ধরে নিয়ে চলেন সিবিলা। দাসদের স্নানে নিয়ে যাবার সেইটেই রীতি। দড়িটা স্নানাগারের পাড়ে একটা খুঁটির সঙ্গে ছোটো করে বেঁধে তাদের জলে ফেলে দিয়েছিলেন তিনি। তখন কয়েকটা ছেলে সাঁতরে এসে রাঙ্গোকে হঠাৎ জলের নীচে ঠেসে ধরল। রাঙ্গো ছটফট করছে দেখে তাদের খুশি আর ধরে না। স্নান করতে থাকা অন্য লোকজনও সেই দেখে বেজায় মজা পাচ্ছে। দাসদের নিয়ে এমন খেলা এ শহরে খুব চলে। শুধু এ শহর কেন, সিন্ধুনদী আর তার অনেকগুলো ডালপালার ধারে ধারে শয়ে শয়ে শহরেই এ খেলার চল।

রিনিয়া প্রাণপণে দড়িতে টান দিচ্ছিল, যদি দড়ি খুলে ভাইটাকে গিয়ে টেনে তুলতে পারে পাজি ছেলেগুলোর হাত থেকে। তাই দেখে লোকজন আরো মজা পেয়ে হুল্লোড় করছে। এমন সময় হঠাৎ সেই ব্যাপারটা ঘটল। কিছুদিন ধরেই ঘটছে এটা তার। মাথার মধ্যে যেন একটা দরজা খুলে গেল হঠাৎ। ঠিক যেন মনে পড়ে গেল, খুব সহজ কাজ এটা। যে কেউ পারে। ইচ্ছে করলেই। কোমরে বাঁধা দড়িটার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে মনে মনে ভাবতেই দড়িটা হঠাৎ কোমর থেকে খুলে এল। একটা সাপের মতই জল থেকে ছিটকে উঠে সেটা আছড়ে পড়ল গিয়ে সিবিলার মুখে। রিনিয়া তখন লাফিয়ে পড়েছে ছেলের দলের মধ্যে।

কয়েকমিনিট পরে মন্দিরের সেপাইরা এসে যখন ছেলেগুলোকে জল থেকে তুলল, তখন তাদের সারা গায়ে লাল লাল দাগ হয়ে গেছে চাবুকের দাগের মত। তারা হলফ করে বলল, সেগুলো রিনিয়ার আঙুলের দাগ।

ব্যাপারটা দেখে সিবিলা ভারী অবাক হয়ে গিয়েছিলেন। আর তার পর থেকেই যতক্ষণ বাড়িতে থাকেন, ঘুরে ঘুরে তাদের কাজকর্ম দেখেন শুধু। তবে শুধু সিবিলা নয়, গোটা শহরই সেদিনের পর থেকে তাদের চোখে চোখে রাখে। মাঝেমধ্যেই ছোটোখাটো এমন দু একটা ব্যাপার ধরাও পড়ে যায়। কদিন আগে সে উনুনে আগুন দিয়েছে সবে, এমন সময় হঠাৎ সিবিলা রান্নাঘরে ঢুকে এসে  বললেন, “আগুন ধরাবার চকমকিদুটো কোথায় রে?”

রিনিয়া তাড়াতাড়ি কুলুঙ্গিতে হাত দিয়ে দেখে সেখানে কিছুই নেই। সিবিলা তখন উনুনের আগুনটার দিকে সন্দেহের চোখে তাকিয়ে হাতের মুঠো খুলে চকমকিদুটো ঠনাৎ করে মেঝের ওপর ফেলে দিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। সেই থেকে রিনিয়া সাবধান হয়ে গেছে খুব। রাঙ্গোকেও সাবধান করে দিয়েছে। রোজ রোজ নতুন নতুন যেসব জাদুশক্তি জাগছে তাদের ভেতর, তা যেন কেউ ধরতে না পারে।

কেন যে সবাই এমন করছে তাদের নিয়ে! তারা তো কারো কোন ক্ষতি করছে না! এমনটা যে হচ্ছে তাতে তাদের দোষটা কোথায়? তারা তো আর ইচ্ছে করে—

বাইরে রাস্তা থেকে একটা বেজায় হইচইয়ের শব্দ উঠল হঠাৎ। ‘ধর ধর, পালালো পালালো’ বলে লোকজন এদিক ওদিক ছুটছে। রিনিয়া চমক ভেঙে কান খাড়া করল। এ গলিটা গিয়ে সটান বাজারের ভেতর পড়ে। শব্দটা সেইখান থেকেই আসছে। কী হল আবার?

যাক গে! বাজারে হইচই তো অমন লেগেই থাকে। রিনিয়া একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে হাঁড়িতে যবের গুঁড়ো তুলে জল ঢেলে দিল তার মধ্যে। টুকরো টুকরো করে কাটা সবজি ঢেলে দিয়েছে তাতে। যবের সুরুয়া সিবিলার প্রিয় খাবার। চকমকিদুটো তুলে নিয়ে উনুনের ভেতরে ধরে তাদের ঠুকল সে কয়েকবার। ঝরঝর করে আগুনের ফুলকি ঝড়ে পড়ছে ভেতরে। পড়ছে, আর নিভে যাচ্ছে বারবার।

কয়েকবার এমনটা হতে রিনিয়া একবার উনুনের কাঠগুলোতে হাত দিয়ে দেখে নিল। একেবারে ভেজা! কিন্তু—কী করে ভিজল? কালকে দুপুরেই তো সে ভালো করে শুকিয়ে রেখেছে ওগুলোকে!

চকমকির ফুলকিতে ও আর ধরবে না এত সহজে। রিনিয়া অসহায় চোখে এদিক ওদিক দেখল একবার। সিবিলা এসে খাবার তৈরি না পেলে—

বাড়িতে কেউ নেই এখন। কে আর দেখবে! রিনিয়া ডানহাতটা উনুনের নিচে ঢুকিয়ে মনঃসংযোগ করল। গরম হয়ে উঠছে হাতটা তার। তারপর একসময় দপ করে জ্বলে উঠল তা উনুনের ভেতর। কাঠের মধ্যে জমে থাকা জল বাষ্প হয়ে উড়ে যাচ্ছে সিঁ সিঁ শব্দ করে।

একটু বাদে দাউদাউ করে জ্বলে উঠল শুকিয়ে যাওয়া কাঠ, আর সঙ্গেসঙ্গে পেছন থেকে একটা শক্ত জাল উড়ে এসে তার গায়ের সঙ্গে জড়িয়ে গেল। একটা হ্যাঁচকা টানে জালে আটকানো অবস্থায় চিৎ হয়ে গিয়ে সে দেখল মাথার কাছে সিবিলা এসে দাঁড়িয়েছেন। পাশে দাঁড়িয়ে আছেন স্বয়ং বড়োপুরুত। মুখটা ভারী গম্ভীর তাঁর।

আর, তাঁদের পেছনে দাঁড়ানো মানুষগুলোর দিকে তাকিয়ে বুকটা হিম হয়ে গেল রিনিয়ার—মৃত্যুগুহার কালো জামা পরা সেপাইদের একটা দল অপেক্ষা করছে সেখানে। তাদের অস্ত্রের ফলায় রোদ চিকচিক করছিল।

“নিজের চোখেই প্রমাণ দেখতে পেলেন আপনি আজ। স্নানাগারের সেই ঘটনার পর থেকেই ভাইবোনের ওপরে নজর রাখছিলাম আমি। শেষে রান্নার কাঠে জল দিয়ে রেখে ফাঁদ পেতেছিলাম, আর তাতেই এই জাদুকরী ধরা দিয়েছে,” বড়োপুরুতের দিকে তাকিয়ে নিচু গলায় বললেন সিবিলা।

“আ-আমি কোনো দোষ করিনি। আমি-”

তার দিক থেকে চোখ ঘুরিয়ে নিয়ে বড়োপুরুৎ জিজ্ঞাসা করলেন, “আর এর ভাইটা?”

সিবিলা মাথা নাড়লেন, “তাকে ধরা যায়নি। বাজারের মাঝখানে সেপাইদের হাত ছাড়িয়ে সে উধাও হয়েছে কিছুক্ষণ আগে।”

“ব্যর্থ সেপাইদের মৃত্যুদণ্ড দেয়া হবে। সামান্য একটা বারো বছরের ছেলেকে-”

“না। তা উচিৎ হবে না। কারণ ধরা পড়বার পর বাজারের সমস্ত মানুষের সামনে সে যে জাদু দেখিয়েছে তাতে সেপাইদের কিছু করবার ছিল না। সে তাদের বাঁধন ছাড়িয়ে আকাশে উড়ে গেছে।”

“অবিশ্বাস্য।”

“বাজারের সমস্ত মানুষ তা দেখেছে। তারা সাক্ষি দেবে। এরা সাধারণ মানুষ নয় মহাপুরোহিত। এরা-”

“বড়োপুরুৎ কঠোর চোখে সিবিলার দিকে ফিরে দেখলেন একবার, “অথচ আপনিই এদের আশ্রয় দিয়েছিলেন একদিন।”

“দুটো সাধারণ অনাথ শিশু ভেবে দয়া করেছিলাম। এখন বুঝতে পারছি এরা শয়তান জিভার চর।”

বড়োপুরুতের ভ্রূ দুটো কুঁচকে উঠল, “কোন প্রমাণ আছে?”

“আছে। কারণ ছেলেটা উড়ে গেছে জিবারা পর্বতের দিকে। তার চূড়া ডিঙিয়ে উল্টোদিকের নিষিদ্ধ উপত্যকায় নেমে যেতে দেখা গেছে তাকে।”

“নিষিদ্ধ উপত্যকা!” বড়োপুরুতের ভ্রূ কুঁচকে উঠল ফের। কুড়ি বছর আগে সেইখানে এক রাতে একটা ভয়ানক বাজ পড়ার মতন শব্দ উঠেছিল। তার পরদিন রাখালেরা জিবারার পাদদেশ থেকে এই মেয়েটাকে কুড়িয়ে পেয়ে বিচারপতি সিবিলার কাছে নিয়ে আসে। শহরে কোন বাচ্চার মা বাবা না থাকলে সেইটাই নিয়ম এখানে। তাদের মুখেই প্রথম জানা গিয়েছিল জিভার আবির্ভাবের কথা। বাচ্চাটাকে যখন তারা কুড়িয়ে পায় তখন নাকি পাহাড়ের চূড়ো ডিঙিয়ে উড়ে এসেছিল সে। কঠোর ভাষায় নিষেধ করেছিল পাহাড়ের অন্যদিকে কাউকে পা রাখতে।

মহাপুরোহিত সামান্য রাখালদের কথায় কান দেননি প্রথমে। একটা ছোটো সৈন্যদলকে পাঠিয়েছিলেন জিবারা পেরিয়ে খবর নেবার জন্য। তারা আর ফিরে আসেনি। শুধু তারাই নয়, এর পর থেকে যে-ই জিবারার চুড়ো ডিঙিয়ে তার অন্যধারে গিয়েছে সে আর ফিরে আসেনি।

এর বছর সাতেক বাদে রাঙ্গো এল। সে-ও একটা রহস্যময় ঘটনা। একদিন গভীর রাতে ঘুম থেকে উঠে সিবিলা আবিষ্কার করেন তিনি নিজের বাড়িতে নেই। শুয়ে আছেন জিবারার পাদদেশে। পাশে একটা পুঁটুলিতে শুয়ে রাঙ্গো হাত পা নাড়ছিল। তদ্দিনে জিবারার দুর্নাম ছড়িয়েছে খুব। অত রাত্রে এইভাবে তার কাছাকাছি নিজেকে দেখে সিবিলার ভয় লেগেছিল বেজায়, তবে বাচ্চাটাকেও ফেলে আসতে মন চায়নি। নিখরচায় একটা দাস পাওয়া! ক’জনের ভাগ্যে তা জোটে?

******

জালে বাঁধা রিনিয়া চুপ করে বসেছিল উনুনের পাশে। রাঙ্গোর উড়ে যাবার খবরটা শুনে তার মাথার মধ্যে কেমন একটা করছিল। বারবার একটা ছবি ভেসে উঠছে সেখানে। সে যেন দেখতে পাচ্ছে, দুপাশে দুহাত ছড়িয়ে দিয়েছে রাঙ্গো। তারপর আস্তে করে মাটি থেকে পা দুটো তুলে নিতেই—আরে! খুব সহজ তো! এইটা কী করে ভুলে ছিল সে এতদিন? সে তো ইচ্ছে করলেই—

“সাবধান—ডাইনিটা পালাচ্ছে—” হঠাৎ করে সিবিলা চিৎকার করে উঠলেন। তাঁকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে সেপাইরা অস্ত্র উঁচিয়ে এগিয়ে এসে একটা বৃত্ত তৈরি করেছে রিনিয়ার চারপাশে। মেয়েটার গায়ের ওপর থেকে সরসর করে জালটা সরে যাচ্ছিল নিজেনিজেই। সবচেয়ে সামনে দাঁড়ানো সেপাইটা ভয় পেয়েছে। তার পাথরের মত মুখে ঠোঁটদুটো থরথর করে কাঁপছিল। হাতের বল্লমটা তুলে ধরে সজোরে সে চালিয়ে দিল মেয়েটার দিকে। মেয়েটা নির্বিকার। বল্লমের ফলাটা মুঠোয় চেপে ধরে একটুকরো পালকের মত ছুঁড়ে দিল সে উলটোদিকে।

দশ হাত দূরে ছিটকে পড়েছে সেপাইটা। কিন্তু সেদিকে তখন কারো নজর নেই। দু হাত দুপাশে ছড়িয়ে ধরে তাদের চোখের সামনে মেয়েটা একটা পাখির মতই ভেসে উঠছে আকাশে। একমুহূর্ত স্থির হয়ে ভেসে রইল সে সেখানে। তারপর রান্নাঘরের পাতার ছাউনি ফুঁড়ে তিরবেগে উঠে গেল খোলা আকাশে।

মানুষগুলোর অবাক চোখের সামনে সে মুখ ঘুরিয়ে নিল জিবারার দিকে। তারপর একটা বিরাট পাখির মত ছিটকে গেল আকাশ বেয়ে। চোখের পলকে শহরের সীমানা ছাড়িয়ে ছোটো হতে হতে তার শরীরটা জিবারার উলটোদিকে মিলিয়ে গেল।

খানিকক্ষণ সেইদিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকলেন বড়োপুরুত। দৃষ্টি কঠিন হয়ে উঠেছে তাঁর। বাচ্চাদুটো পালিয়ে গেছে জিবারার উল্টোদিকেই। ওদিকে জিভার আস্তানা। তার মানে এসব কাজকর্মের পেছনে ওই জিভার হাত আছে। সিন্ধু নদীকে ঘিরে দেড় হাজার শহরের রাজধানী এই মঞ্জাদাহোর নগরীর শক্তি কম নয়। সেই শহরের বুকে সেনাদের মাঝখান থেকে বন্দিকে ছিনিয়ে নিয়ে যেতে যে সাহস পায় সে যে-ই হোক না কেন তাকে দমন করা দরকার।

একটা তেতো হাসি ফুটে উঠল তাঁর মুখে। শুরুতে পাঁচটি নগরীর মিলিত সৈন্যবলই যথেষ্ট হবে। তাতে ব্যর্থ হলে তারপর আরো বড়ো শক্তিপরীক্ষাতেও নামতে তিনি তৈরি। সামান্য রাখালদের ভয় দেখিয়ে বেড়ানো এই জাদুকর এখনও সিন্ধুতীরের শিক্ষিত তলোয়ারের স্বাদ পায়নি। সিবিলার দিকে মুখ ঘুরিয়ে তিনি বললেন, “শিক্বার্খস্বা, অজিবি, দারনুক আর হৈশিল শহরে অগ্নিসংকেতে খবর পাঠান। তিনদিনের মধ্যে দশ হাজার সেরা সৈনিকের প্রয়োজন হবে আমাদের।”

*****

উপত্যকার ঠিক মাঝখানে বিরাট চেহারার গোল পাথরটা পড়েছিল। তার বুকে একটা লম্বা ফাটলের দাগ। রিনিয়া যখন জিবারার চুড়ো পেরিয়ে সেখানে এসে নামল তখন সূর্য পশ্চিমে ঢলে পড়েছে। র‍্যাং সেখানে আগেই পৌঁছে গেছে।

“স্বাগতম রেনি ও র‍্যাং-” গম্ভীর গলায় কথাগুলো শুনে তারা দুজন একইসঙ্গে ঘুরে তাকাল পেছনদিকে।

লম্বা চেহারার মানুষটার চুলদাড়িতে পড়ন্ত রোদ পড়ে চিকচিক করছিল। এগিয়ে এসে তাদের দুজনের কাঁধে হাত রাখলেন তিনি। রিনিয়ার দৃষ্টিতে ভয়ের চিহ্ন ছিল না। নিচু গলায় বলল, “আমরা রিনিয়া ও রাঙ্গো।” মৃদু হেসে মাথা নাড়লেন তিনি। তারপর পাথরটার দিকে ফিরে আঙুলের কয়েকটা সংকেত করলেন।

প্রায় সঙ্গেসঙ্গেই পাথরের ফাটলটা থেকে শিসের মত শব্দ উঠল একটা। উজ্জ্বল আলোর একটা ধারা সেখান থেকে বের হয়ে অনেকটা জায়গা জুড়ে ঝরে পড়ছিল। তাদের ঘিরে গড়ে তুলছিল একটা অস্বচ্ছ শক্তির দেয়াল। দেখতে দেখতে সূর্যের আলো মৃদু হয়ে মিলিয়ে গেল একেবারে। শক্তির আচ্ছাদনে ঘেরা জায়গাটা নরম আলোর প্রভায় উজ্জ্বল হয়ে উঠছিল।

কাঁধে মৃদু চাপ দিয়ে তাদের দুজনকে পাথরটার একপাশে বসিয়ে দিয়ে তর্জনিদুটো দুই ভাইবোনের কপালে ঠেকালেন জিভা। সঙ্গেসঙ্গে নিশ্চল পুতুলের মত থেমে গেল শরীরদুটো। কয়েকমুহূর্ত পরে যখন জেগে উঠল ফের, তাদের চোখের ভাষা বদলে গেছে।

“ধন্যবাদ জিভা,” রিনিয়া বলে উঠল। হ্যাঁ। এইবার তার মনে পড়েছে। সব মনে পড়ে গেছে তার। ইনি জিভা। পাশে দাঁড়িয়ে রাঙ্গোও অবাক হয়ে দেখছিল মানুষটার দিকে। খানিক বাদে সে বলল, “কিন্তু রেনি,আমরা কী করে জিভাকে ভুলে গিয়েছিলাম বল তো? আমাদের চেনা এই সবকিছু ছেড়ে ওই বুনোগুলোর মধ্যে—”

“সেটা একেবারেই স্বাভাবিক র‍্যাং। সমীক্ষা চলবার সময় তোমাদের সমস্ত মূল স্মৃতি গোপন করে রাখা হয়। সেইটাই নিয়ম। তবে এখন এ নিয়ে আলোচনার সময় নয়। মন্ত্রীমণ্ডলী অপেক্ষা করছেন—”

গোল পাথরটাকে ঘিরে একটা টেবিলের ছবি ভেসে উঠেছে। তার চারপাশে একে একে কিছু মানুষজন শূন্য থেকে বের হয়ে এসে আসন নিচ্ছিলেন। তাঁদের দিকে তাকিয়ে গলা উঁচু করে বললেন, “পার্থিব সভ্যতার ওপরে এই পর্যায়ের সমীক্ষা শেষ হয়েছে। স্মৃতিযন্ত্র দুজন ফিরে এসেছে। অনুমতি পেলে তারা তথ্যগুলো পেশ করতে পারে।”

টেবিলের একেবারে মাথায় বসে থাকা নেতাগোছের মানুষটা মাথা নেড়ে সম্মতি দিলেন। রেনি  ততক্ষণে গোল পাথরটার ওপরে উপুড় হয়ে শুয়ে পড়েছে। জিভার ইঙ্গিতে পাথরের ফাটল বেয়ে একটা ধাতব নল সাপের মত হিলহিল করে বেরিয়ে এসে তার মাথার একপাশে নিজেকে জুড়ে নিচ্ছিল তখন। যন্ত্রণায় একবার কুঁকড়ে উঠল রেনির মুখটা। তারপর একেবারে স্থির হয়ে গেল সে। চোখদুটো বোঁজা। যেন স্বপ্ন দেখছে কোন।

বাতাসের গায়ে একটা তিনমাত্রার ছবি ভেসে উঠছিল। পাহাড়ের উল্টোদিকের শহরটার একটা ছোট্ট প্রতিরূপ ভাসছে সেখানে। রেনির গলার স্বর ভেসে আসছিল টেবিল ঘিরে বসে থাকা লোকজনের মাথার ভেতরে-

“সিন্ধু নামের এই নদীটাকে ঘিরে এইরকম দেড় হাজার শহর গড়ে তুলেছে এরা মাত্রই কয়েক শতাব্দির মধ্যে। মেধাস্তর খ-১১।”

“অসম্ভব। এত উঁচু স্তরের মেধা প্রকৃতিতে সম্ভব নয়।” একজন সদস্য প্রতিবাদ করে উঠলেন হঠাৎ।

“অংক ভুল বলে না আলস্টর্ক,” ঘুমন্ত রেনির পাশে দাঁড়িয়ে থাকা র‍্যাং কথা বলে উঠল হঠাৎ, “গণকের পূর্বাভাষ অনুযায়ী আগামী এক থেকে দেড় সহস্রাব্দির মধ্যে এরা নক্ষত্রভ্রমণের-”

********

অন্ধকার পাহাড়ের গা বেয়ে নিঃশব্দে উঠে আসছিল দশ হাজার সেনার বিশাল বাহিনীটা। মঞ্জাদাহোর নগরীর সীমানা পেছনে ফেলে এসে দ্রুত এগিয়ে চলেছে তারা  জিবারার চূড়ার দিকে। শিকারি বেড়ালের মত সতর্ক, নিঃশব্দ পদক্ষেপে কোন শব্দ জাগে না। তারার আবছা আলোয় মনে হবে বিরাট সাপ যেন একটা, এঁকেবেঁকে শিকারের সন্ধানে চলেছে।

সেনাদলের একেবারে সামনে থেকে রাতচরা কোন পাখির ডাক ভেসে এল হঠাৎ। সঙ্গেসঙ্গে জাদুমন্ত্রের মত সমস্ত নড়াচড়া থেমে পাথরের গায়ে মিশে গেল যেন সেই সৈন্যদল।  এবার পরের সংকেতের অপেক্ষা। চূড়ায় পৌঁছতে বেশি দেরি নেই আর।

দলটা থেকে দশজন খোঁজারু বেরিয়ে এসে নিঃশব্দে বুকে হেঁটে উঠে গেল জিবারার চূড়ার কাছে। খানিক বাদে ওপর থেকে তাদের খোলা গলার শব্দ ভেসে এল-“সেনারা উঠে আসুক। কোনো ভয় নেই। জয় পশুপতি।”

যেন একটা বাঁধ ভেঙে গেল সেই শব্দ পেয়ে। হাঁক ছেড়ে সৈন্যের দল ছুটছে জিবারার চুড়োর দিকে। পশ্চিমে সদ্য ওঠা একফালি চাঁদের ম্লান আলোয় ফাঁকা পাহাড়ের উল্টোদিকের উপত্যকার ঠিক মাঝখানে একটা বিরাট চেহারার গোল পাথর দেখা যাচ্ছিল শুধু। আর কোন জনমানুষের চিহ্ন নেই সেখানে।

সার বেঁধে সেইদিকে নামতে শুরু করল সেনাবাহিনী। এ উপত্যকাকে তন্নতন্ন করে খুঁজে দেখতে হবে আজ তাদের। মহাপুরোহিত সে কাজে কোন ত্রুটি রাখতে চান না।

*******

র‍্যাং ও রেনি নামের স্মৃতিযন্ত্র দু’জন পাথরের গা থেকে উঠে দাঁড়িয়েছে। আস্তে আস্তে দুলছিল দুজন। চোখ বোঁজা। জিভা এগিয়ে এসে দু’হাতে তাদের দুজনকে ধরে নিলেন।

“তথ্য নিষ্কাশণ করতে কতক্ষণ সময় লাগল জিভা?”

“এই গ্রহের হিসেবে পুরো তিনদিন রেনি। তোমরা নিশ্চয় ক্লান্ত?”

র‍্যাংয়ের মাথাটা নিজের কাঁধে রেখে মৃদু চাপড় দিতে দিতে রেনি বলল, “হ্যাঁ। অনুমতি পেলে আমরা একটু ঘুমিয়ে নেব এখন।”

টেবিলের মাথায় বসা বৃদ্ধ মানুষটা তাদের দিকে নজর না দিয়ে নিজের মনেই মাথা নাড়ছিলেন, “অবিশ্বাস্য। মাত্র কয়েক শতাব্দির চেষ্টায় উন্নতির এই স্তরে এসে পৌঁছনো-”

জিভা মাথা নাড়লেন, “হ্যাঁ মাননীয় প্রধানমন্ত্রী। তাছাড়া, গণকের হিসেবটা তো শুনলেন। এই গতিতে এগোলে আর এক থেকে দেড় সহস্রাব্দির মধ্যে নক্ষত্রভ্রমণের প্রযুক্তি এদের নাগালে আসবার কথা।”

“তার মানে—”

“মানেটা বোঝা কঠিন নয়। সম্মিলিত গ্রহপুঞ্জের সদস্যপদ পেতে তারপর বেশি সময় লাগবে না এদের। এই গ্রহের গভীরে আমাদের বে-আইনি খনিগুলোর অস্তিত্বও জানতে পারবে এরা। এর ফল-”

“আমি জানি জিভা,” উত্তেজিত গলায় তাঁকে থামিয়ে দিলেন বৃদ্ধ, “গ্রহপুঞ্জের অজান্তে এই গ্রহ থেকে যত পরমাণ দুষ্প্রাপ্য খনিজ আমরা সরিয়ে নিয়েছি, তার দাম চোকাতে হবে সুদে-আসলে।”

“এর সমাধান আছে মহামান্য। গত দুটো সমীক্ষার পর সে প্রস্তাব বারংবার দিয়েওছি। আপনারা রাজি হননি।”

“জানি। সেই পুরোনো প্রস্তাব। এখানকার জীবমণ্ডলকে মুছে দেয়া, তাই তো?”

“হ্যাঁ। গ্রহটা বড়ো নয়। জিটা তরঙ্গের একটা আঘাতই যথেষ্ট হবে।”

“হাঃ। একটা অপরাধ ঢাকতে আর একটা গুরুতর অপরাধ ঘটানো। সপ্তম মহাযুদ্ধের পর থেকেই জিটা তরঙ্গের ব্যবহার নিষিদ্ধ। এতবড়ো একটা ঝুঁকি–”

হঠাৎ জিভার হাত ধরে মৃদু টান দিয়ে দেয়ালের দিকে দেখাল রেনি। সেখানে, আবছা চাঁদের আলোয় দল বেঁধে এগিয়ে আসা একদল সৈনিকের ছবি ভেসে উঠেছে।

“ওরা আমাদের খোঁজেই আসছে জিভা। আমি ওদের চিন্তাতরঙ্গ পড়তে পারছি!” রেনির গলায় আশংকার ছাপ ছিল।

একটুক্ষণ সেইদিক তাকিয়ে দেখলেন জিভা। তারপর  মৃদু হেসে বললেন, “জায়গাটা শক্তিবর্মে ঢাকা। আমাদের ওরা দেখতে পাবে না রেনি। এ উপত্যকা ওদের চোখে একেবারে খালি।” তারপর টেবিলের দিকে মুখ ঘুরিয়ে আগের কথাবার্তার সুতোটা তুলে নিলেন ফের, “ঝুঁকি আছে মানছি, কিন্তু এটাই আমার মতে সেরা সমাধান।”

টেবিলের চারপাশে ঘিরে বসা সদস্যরা নিচুগলায় আলোচনা করছিলেন। তাঁদের চোখ  প্রধানমন্ত্রীর হাতে ধরা একটা ছোটো গণকযন্ত্রের পর্দায় আটকানো। সেদিক থেকে চোখ সরিয়ে বৃদ্ধ মৃদু হেসে বললেন, “দুঃখিত জিভা। এখনই সে ঝুঁকিটা নিতে মন্ত্রীসভা রাজি নয়। উপস্থিত সিন্ধুর ধারে গড়ে ওঠা এই শহরগুলোকে ধ্বংস করে দেয়াই যথেষ্ট হবে।”

জিভা হতাশভাবে মাথা নাড়লেন, “এতে কোন স্থায়ী সমাধান-”

“হবে না জানি। আগের দুবারেও তা হয়নি। এক জায়গায় ধ্বংস করলে সাময়িক পিছিয়ে পড়েও ফের নতুন জায়গায় সভ্যতাকে গড়ে তোলে এরা-” বলতেবলতে হাতের যন্ত্রটার পর্দায় ফের একবার চোখ বুলিয়ে নিলেন বৃদ্ধ, “তবে আমাদের হিসেব বলছে এ শহরগুলো ধ্বংস হলে এই গ্রহের মানুষের অগ্রগতির হার অন্তত পাঁচ হাজার বছর পিছিয়ে যাবে। উপস্থিত সেটুকুই যথেষ্ট। তুমি প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নাও।”

“কিন্তু মহামান্য-”

বৃদ্ধের চোখদুটি কঠিন হয়ে উঠল। ঠান্ডা গলায় বললেন, “আমি আমার সিদ্ধান্ত জানিয়েছি। আগামি এক সপ্তাহের মধ্যে তুমি তা কার্যকর করবে। চার সহস্রাব্দি বাদে ফের একবার সমীক্ষা করবার পর উপযুক্ত সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।”

এ আদেশের বিরুদ্ধে তর্ক চলে না। একটুক্ষণ থেমে থেকে জিভা নিচু গলায় জিজ্ঞাসা করলেন, “সমীক্ষার স্থান?”

“আমাদের গণক তা ঠিক করবে। ভ্রমণকৌটায় প্রয়োজনীয় আদেশ পাঠিয়ে দেয়া হচ্ছে। এখানকার কাজ শেষ হবার পর তা তোমাদের সঠিক জায়গায় পৌঁছে দেবে। এখন বিদায়-”

*******

কাচের পুতুলের মত স্বচ্ছ হয়ে আসতে থাকা মানুষগুলোর দিকে তাকিয়ে অন্যমনস্কভাবে কিছু ভাবছিলেন জিভা। হঠাৎ পেছন থেকে রেনির ডাকে তাঁর চমক ভাঙল। দেয়ালে ভেসে ওঠা ছবিতে বিরাট সেই সেনাবাহিনী তখন পাহাড়ের ঢাল ধরে ফের নিজেদের শহরের পথ ধরেছে।

“কিছু বলবে?”

“সৈন্যদের দিকে আঙুলের একটা ইশারা করল রেনি। ফিরতি পথ ধরা সেনাদলটার মধ্যে একজনের ছবি হঠাৎ বড়ো হয়ে উঠল সেখানে। তার দিকে দেখিয়ে রেনি বলল, “বিচারক সিবিলা। অত্যাচারী সিবিলা। আমাদের পালক। র‍্যাং আর আমাকে অনেক কষ্ট দিয়েছে সে। অনুমতি দিলে তাকে কিছু শাস্তি দিতে চাই।”

“না রেনি। তার কোন প্রয়োজন হবে না আর। প্রধানমন্ত্রীর সিদ্ধান্ত তো শুনেছ। অন্য শাস্তি অপেক্ষা করে আছে এদের জন্য। এখন তার প্রস্তুতি নিতে হবে আমায়। সময় কম। এরপর লম্বা যাত্রা আছে সামনে।”

*******

বর্ষার প্রথম মেঘ যখন সিন্ধুনদীর ওপরে তার ছায়া ফেলে, ভারী সুন্দর লাগে তাকে দেখতে। আলোয়, কালোয়, সবুজে, হলুদে সে ভারী চমৎকার রং। সকালে ঘুম থেকে উঠে নদীর পুবপারের আকাশে আজ সেই মেঘ দেখতে পেয়ে এ গ্রামের মানুষজনের বড়ো আনন্দ। গরমকালের কষ্টের দিন শেষ হবে এবারে।

গ্রামপ্রধানের লোক এসে ঢ্যাঁড়া দিয়ে গেছে খানিক আগে। শহর থেকে বড়োপুরুতের খবর এসেছে, আজ বৃষ্টি নামবে। সবাই তৈরি থেকো। আজ জমিতে লাঙ্গলের প্রথম খোঁচা দিতে হবে। গ্রামের মানুষেরা তাই আজ কেউ ঘরে নেই। যার যার ক্ষেতে লাঙল গরু নিয়ে তারা অপেক্ষা করছে বৃষ্টি নামবার। অবশ্য রোদে পুড়ে ঝাঁই জমিতে লাঙল গাঁথা যাবে না শুরুতে। কিন্তু ওই ছুঁইয়ে দেবার রীতটুকু প্রথম দিনে মানতেই হয়।

পশ্চিমে বেশ কিছু দূরে শহরের বন্ধ দরজাগুলো হাট করে খুলে দেয়া হচ্ছে একে একে। মঞ্জাদাহোর শহরের প্রতিটি মানুষ বর্ষাকে স্বাগত জানায় শহর ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে এসে। আকাশ ভেঙে নেমে আসা প্রথম বৃষ্টির ধারায় লাল-নীল-হলদে পোশাক পরা হাজারো মানুষের সারাদিনের সেই নাচগান আসলে বৃষ্টির ঠাকুরকে খুশি করবার কায়দা। এরা তাকে বলে বর্ষাপুজো।

বাতাস ভারী হয়ে আসছিল আস্তে আস্তে।  রোদের তেজ কমে এসেছে। যেন এক ফুঁয়ে কেউ নিভিয়ে দিচ্ছে বিরাট একটা মশাল। সেই কমে আসা আলোয় শহর ছেড়ে রঙিন পোশাক পরা মানুষগুলো বের হয়ে এল এবারে। তাদের মাথা্র ওপরে জোলো হাওয়ায় ভর করে নেমে আসতে শুরু করেছে বৃষ্টির ফোঁটগুলো।

কিন্তু শুরু হতে না হতেই নাচ থেমে গেল হঠাৎ। থেমে গেছে বাজনদারদের হাত, গাইয়েরা চুপ হয়ে গেছে। ক্ষেতে ক্ষেতে লাঙল হাতে তৈরি চাষীদের চোখও আটকে গেছে হঠাৎ আকাশের গায়ে। সেখানে হঠাৎ করেই কোন অজানা জাদুতে  মিলিয়ে যাচ্ছে জমে ওঠা ঘন বর্ষার মেঘ। না, হাওয়ায় ভেসে যাচ্ছে না তারা। শুধু মিলিয়ে যাচ্ছে। আর তার আড়াল থেকে ফের বের হয়ে আসছে গত দু’মাস ধরে দেখতে থাকা রোদেপোড়া তামাটে আকাশ আর ঝলসে দেয়া গ্রীষ্মের সূর্য–

–জিবারার অন্যধারে বসে মিলিয়ে যেতে থাকা মেঘগুলোকে মনোযোগ দিয়ে দেখছিলেন জিভাও। গোলক আকারের বিরাট পাথরটার গায়ের লম্বাটে ফাটলের মধ্যে থেকে তীব্রবেগে আকাশের দিকে উঠে যাচ্ছে আয়নীভূত জেক্সার গ্যাসের স্রোত। অদৃশ্য এই কণাদের ছোঁয়া পেলে জল ভেঙে গিয়ে বের হয়ে আসে তার গ্যাসীয় উপাদানেরা। জিভার সামনে পৃথিবীর একটা ছোট্ট ত্রিমাত্রিক ছবি স্থির হয়ে ভাসছে। হালকা লাল রঙের একটা বৃত্ত তার গায়ে সিন্ধু আর তার আশপাশের বিস্তীর্ণ এলাকাকে চিহ্নিত করে রেখেছে। বৃত্তের  কেন্দ্রীয় এলাকা থেকে সাদাটে রঙের একটা চাদর ছড়িয়ে পড়ছিল পরিধির দিকে।

গোটা বৃত্তটা সাদা হয়ে যাবার সঙ্গেসঙ্গে এগিয়ে গিয়ে পাথরটাকে একবার ছুঁলেন তিনি। আঙুলের দ্রুত নড়াচড়ায় দুর্বোধ্য কিছু নকশা গড়ে উঠছিল তার গায়ে। সাদাটে এলাকাটা তাঁর আঙুলের সেই সংকেত পেয়ে এইবারে স্থির  হয়ে গেছে।

একটু বাদে পাথর থেকে হাত সরিয়ে নিয়ে মৃদু হাসলেন জিভা। রেনি আর র‍্যাং আগ্রহের সঙ্গে তাকিয়েছিল তাঁর দিকে।

“কাজ হল?”

“হ্যাঁ। আগামি দুশো বছর ধরে জেক্সার আয়নের অদৃশ্য বর্ম ঢেকে রাখবে এই এলাকাটাকে। দুই শতাব্দি ধরে এক বিন্দু বর্ষার জল ঝরবে না এই উপত্যকায়। এখানে আমাদের কাজ শেষ।”

“এর পর?”

“ভ্রমণকৌটাকে যাবার জন্য তৈরি কর রেনি।”

গোলকাকার পাথরটা আস্তে আস্তে মাটির ভেতরে ডুবে গেছে। ওপর থেকে তার কোন চিহ্ন দেখা যায় না আর। সেইখানে বসে, সবার চোখের আড়ালে, নিঃশব্দে সে তার কাজ করে চলবে আগামী দুই শতাব্দি ধরে। তিলে তিলে ধ্বংস করবে সিন্ধুর ধারে গড়ে ওঠা এই সভ্যতার প্রত্যেকটা জনপদকে।

হাতের একটা ইশারায় সামনে ভেসে থাকা পৃথিবীর ত্রিমাত্রিক ছবিটা একটু কেঁপে উঠে মিলিয়ে গেল। প্রখর রোদঝড়া দুপুরে সাঁইসাঁই করে শুকনো হাওয়া বয়ে চলেছে গোটা এলাকাটা জুড়ে।

*******

“ভ্রমণকৌটা তৈরি আছে জিভা।”

রেনির ডাক পেয়ে জিভা তার দিকে ঘুরে দেখলেন একবার। সোনালী রঙের চৌকো একটা কৌটোকে মাটির ওপর বসিয়ে রেখে সে ডাকছিল। ওর মধ্যে লুকিয়ে রয়েছে পরবর্তী সমীক্ষাস্থলের ঠিকানা।

ঢাকনা খোলা কৌটোটাকে ঘিরে দাঁড়ালেন তাঁরা তিনজন। তার ভেতরে ভেসে থাকা তীব্র অন্ধকার একটা বিন্দু বনবন করে ঘুরছে। যেন টের পেয়েছে চারপাশে অপেক্ষায় থাকা যাত্রীদের উপস্থিতি। তারপর হঠাৎ এক তীব্র আকর্ষণে শরীর তিনটে একসঙ্গে ঝাঁপ দিল কৌটোটার খোলা মুখের দিকে। চোখের পলকে মিলিয়ে গেল তারা ঘুরতে থাকা কালো ফোঁটাটার মধ্যে। সেখানে দেশকালহীন শূন্যতার ভেতরে এইবার সংরক্ষিত থাকবে তারা, যতদিন না ফের একবার জাগবার সময় আসে।

আস্তে আস্তে ঢাকনা নেমে এল কৌটোর মুখে। বন্ধ কৌটোটা বাতাসে ভেসে উঠে স্থির হয়ে রইল এক মুহূর্ত। তারপর তার ভেতরের যন্ত্রগণকের নির্দেশ মেনে ছিলেছাড়া তিরের মত ছুটে গেল উত্তরপূর্ব দিকে বহুদূরের এক বিরাট পর্বতমালার পথে–

দুই

১৯৯৫ খৃস্টাব্দ

ভয়াল রামবাসা গিরিসংকট। তার আকাশছোঁয়া খাড়াই পাঁচিলের দক্ষিণে জমাটবাঁধা রিঙ্গান হ্রদ আর উত্তরে রামবাসা গ্লেসিয়ার। সে পাঁচিলের মাথায় এখনো কোন অভিযাত্রীর পা পড়েনি। এখন শেষ হেমন্ত। দীর্ঘ নৈঃশব্দের পর পাহাড় জেগে উঠেছে ফের। হাঁকার দিয়ে উঠেছে মরসুমী ব্লিজার্ড। তীব্র পশ্চিমা হাওয়ায় ভর করে রাতের অন্ধকারকে চিরে ছুটে চলেছে ধারালো বরফকুঁচির স্রোত। মরশুমের প্রথম বরফ।

তুষারনদীর বুকে খানিক এলাকা জুড়ে মৃদু কাঁপুনি জাগল হঠাৎ। তলা থেকে কোনো প্রচন্ড চাপে চিড় ধরছে জমাটবাঁধা কালো, প্রাচীন বরফের স্তরে। পুরোনো বরফ লড়ছিল। সহজে সে নিজের জমি ছেড়ে দিতে রাজি নয়। কিন্তু  লাভ হল না। একটু বাদেই কামানের গোলা ছোঁড়বার মতন শব্দ করে ফেটে গেল বরফের স্তর। বড়ো বড়ো চাঁইগুলো পালকের মত বাতাসে ছিটকে উঠে আছড়ে পড়ছে নীচে। টুকরো টুকরো হয়ে ছড়িয়ে যাচ্ছে চারপাশে। একটু বাদে ফাটলের মধ্যে দিয়ে আকাশের দিকে মুখ বাড়াল প্রায় দশ মিটার ব্যাসার্ধের নিখুঁত একটা পাথরের গোলক। অবিশ্রান্ত ঝরে পড়া তুষারকণারা তার ওপরে দ্রুত সাদা আস্তরণ তৈরি করে ফেলছিল।

খানিকক্ষণ সেইভাবেই পড়ে রইল গোলক। তার সারা দেহে তিরতিরে কাঁপন উঠছিল। তার অদৃশ্য সেনসররা তখন জরিপ করে নিচ্ছে চারপাশের পরিবেশকে। মিনিটখানেকের মধ্যেই পরীক্ষানিরীক্ষা শেষ হল গোলকের। এবারে হঠাৎ করেই তাপমাত্রা বাড়াল সে। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে হিমাংকের নীচে থেকে বেড়ে তা জলের স্ফুটনাংককে ছাড়িয়ে গেল অবহেলায়। হিস হিস শব্দ করে বাষ্পের কুন্ডলি উড়ে যাচ্ছিল চারপাশে। আস্তে আস্তে উজ্জ্বল হয়ে উঠছিল তার উত্তপ্ত শরীর। তারপর হঠাৎ একসময় কানফাটানো শব্দ তুলে বিস্ফোরণ ঘটল তার গায়ে। তার পেট বরাবর আড়াআড়িভাবে একটা নিখুঁত জ্যামিতিক গড়ণের ফাটল ধরেছে–

*******

“শব্দটা শুনলে বিশ্বনাথন?”

রিঙ্গানের ধারে মেষপালকদের পরিত্যক্ত ঘরটার ভেতরে একটা টর্চ জ্বলে উঠল। বিশ্বনাথনও স্লিপিং ব্যাগশুদ্ধু উঠে বসেছেন। কান পেতে শুনছেন বাইরের দিকে।

“কিছু একটা ফাটবার মতন আওয়াজ সেন,” পাহাড়ের দেয়ালটার উল্টোদিক থেকে এল বলে মনে হল,” বিশ্বনাথন মাথা নাড়লেন, “এই ঝড়ের মধ্যে পাহাড় পেরিয়েও আমাদের কান অবধি এসেছে মানে বেশ বড়োসড়ো কিছু শব্দই হবে।”

“কী হতে পারে বলো তো?”

শব্দটা একেবারে অন্যরকম। প্রাকৃতিক নয়। বুকের ভেতরে গড়ে উঠতে থাকা শিরশিরানিটাকে চাপা দিলেন বিশ্বনাথন, “পাহাড়ের ওপাশটায় বোধ হয় কোন গ্লেসিয়ার আছে। চলন্ত বরফের টানাপোড়েণে এমন শব্দ হতেই পারে। আল্পসের উঁচু এলাকায় আমি আগেও শুনেছি।”

“বেরিয়ে দেখব নাকি একবার?”

“উঁহু। একদম নয়। জায়গাটা অচেনা। অন্ধকারে ঝড়ের মধ্যে বাইরে বের হওয়া ঠিক হবে না।”

“বুড়ো হয়ে যাচ্ছ নাকি বিশ্বনাথন? ভয় পাচ্ছ?”

“ভয় নয় জ্যোতির্ময়, সাবধানতা। দিনের বেলাতেই ক্যাম্পের রাস্তা হারিয়েছি। এখন এই দুর্যোগের মধ্যে বেরিয়ে নতুন বিপদ ডেকে আনবার মানে হয় না। ঝড় থামলে তখন ভাবা যাবে। এখন শুয়ে পড়ো।”

“ঘুম আসছে না হে। আজ সন্ধেয় কসমিক রে ডিটেকটারগুলো তুলে এনে রিডিং নেবার কথা ছিল। সেগুলো এই ঝড়ে কোথায় উড়ে যাবে কে জানে। গোটা পরিশ্রমটাই বৃথা গেল এযাত্রা।”

“আর বৃথা। যা ঝড় ছেড়েছে তাতে কাল সকালে বেরিয়ে দেখতে পাবে গোটা এলাকার ভুগোলটাই হয়ত পালটে গেছে বরফের গুঁতোয়। ভালোয় ভালোয় নাগবস্তির ক্যাম্পে ফিরতে পারলে হয় এখন। বাঁচলে পরে ফের পরীক্ষানিরীক্ষা করবার সুযোগ পাবে।”

“বলাটা সহজ। কিন্তু আবার একটা নতুন এক্সপেডিশান করবার মত টাকা মঞ্জুর হবে তো?”

“উফ্‌। সে ভাবনাটা আমার ওপর ছেড়ে দাও তো! আমি যখন তোমার রিসার্চ গাইড তখন টাকা মঞ্জুর করাবার দায়িত্বও আমার। নাও। এখন শুয়ে পড়,” বলতে বলতে স্লিপিং ব্যাগের চেন একেবারে সবটা টেনে নিয়ে কাত হয়ে শুলেন বিশ্বনাথন। সাক্ষাত নরকে গিয়ে পড়লেও তাঁর কখনো ঘুমের অসুবিধে হয় না।

*******

পাথরের বুকে সদ্যগজানো ফাটলটার ভেতরে মৃদু গুঞ্জন উঠল হঠাৎ। প্রায় সঙ্গেসঙ্গেই তার ভেতর থেকে লাফ দিয়ে বাতাসে ভেসে উঠল একটা সোনালি কৌটো। আয়তনে হাতের মুঠোর মতন হবে তা।

ঝোড়ো হাওয়ার ধাক্কাকে উপেক্ষা করে কয়েক মুহূর্ত স্থির হয়ে ভেসে রইল কৌটো। তারপর তার ওপরের অর্ধেকটা নিঃশব্দে খুলে গিয়ে উগড়ে দিল একরাশ উত্তপ্ত বস্তুকণার স্রোত। চোখ ধাঁধানো আলোর রেখার মত সে স্রোত বনবন করে পাক খাচ্ছিল। আর পাক খেতেখেতেই আকার বদলে একটা মানুষের অবয়ব নিচ্ছিল তা।

মাত্রই কয়েক মুহূর্তের ব্যাপার। তার পর ছ’ফুট লম্বা রোগাটে মানুষটা খাড়া হয়ে দাঁড়িয়ে চারপাশে দেখে নিলেন একবার। তাঁর শক্তিশালী মন পাহাড়ের অন্যধার থেকে দুজন মানুষের মস্তিষ্কতরঙ্গের সাড়া পাচ্ছিল। এই পরিবেশে এত কাছাকাছি দুজন মানুষের খোঁজ পেয়ে যাবেন তা তিনি ভাবেন নি। এদের মধ্যে কোন একজন রেনি আর র‍্যাঙের অভিভাবক হবার যোগ্য কিনা সেটা যাচাই করে নেয়া দরকার। এখানেই কাজ হয়ে গেলে আর খোঁজাখুঁজির দরকার হবে না।

তরঙ্গদুটির দিকে মনঃসংযোগ করে ধ্যানস্থ হলেন তিনি। খানিক বাদে যখন চোখ খুললেন, তখন তাঁর মুখে একটুকরো হাসি। ভাগ্য সদয়। এরা স্থানীয় উপমহাদেশের বাসিন্দা। মস্তিষ্কে অতি উচ্চমানের মেধা ও বিপুল জ্ঞানভাণ্ডার রয়েছে। পথ হারিয়েছে এরা। সেটা কোন সমস্যা নয়। সে পথ তিনি সহজেই দেখিয়ে দিতে পারবেন এদের।

পাশে ভাসন্ত বাক্সের ভেতরে স্থির হয়ে থাকা অন্ধকার বিন্দুটার দিকে হাত বাড়িয়ে দিলেন তিনি। আঙুলগুলো অকল্পনীয় গতিতে নড়াচড়া করে জটিল কিছু নকশা গড়ে তুলছিল। গাণিতিক ভাষায় কিছু নির্দেশ। বাক্সের যন্ত্র তার অর্থ ঠিকই বুঝে নেবে।

আঙুলের ভাষা শেষ হতে না হতে ফের একবার সচল হয়ে উঠল কালো বিন্দু। বস্তুকণার অপেক্ষাকৃত ছোটো আরেকটা ধারা উগড়ে দিল সে মানুষটির সামনে।

কয়েকমুহূর্ত বাদে তাঁর সামনে বরফে শুয়ে থাকা ফুটফুটে মেয়েটিকে কোলে তুলে নিলেন তিনি। পোশাকের ভাঁজ থেকে খানিকটা কাপড় বের করে এনে যত্ন করে জড়িয়ে দিলেন তার গায়ে। মেয়েটার বয়স বড়োজোর বছরখানেক হবে। টলটলে দুটো চোখ মেলে সে একবার তাকিয়ে দেখল তাঁর দিকে। তারপর পরিষ্কার গলায় বলে উঠল, “আর র‍্যাং?”

“এখন নয় রেনি। তার জাগবার সময় হবে ঠিক সাত বছর পরে। চিরকালই তো তোমরা আট বছরের ছোটোবড়ো ভাইবোন হয়ে কাজ করতে গিয়েছ।”

“অভিভাবকের সন্ধান পাওয়া গেছে কি?”

“হ্যাঁ। কাছাকাছিই আছেন। দুজন উপযুক্ত মানুষ পাওয়া গেছে। একজন বয়স্ক। অন্যজন অপেক্ষাকৃত তরুণ। তুমি তোমার পছন্দমতন বেছে নিতে পার। তবে আমার মনে হয় কমবয়েসি মানুষটি বেশি উপযুক্ত হবেন। মনদুটিকে দেখতে চাও?”

“নাঃ। আপনার বিচারের ওপর আমার ভরসা আছে জিভা। এবারের কাজের এলাকা?”

“ভারতবর্ষ। স্থানীয় উপমহাদেশ। তোমার কাজ-”

“জানি জিভা। এর আগে তিনবার যা করেছি-”

“তবু—চার হাজার বছরের ঘুমের পর জেগে উঠে কাজে যাবার আগে একবার স্মরণ করে নেয়া ভালো।”

“বেশ। আমার, এবং আমার পরে আসা র‍্যাং-এর কাজ হবে অভিভাবকের সমাজের প্রতিটি জিনিসকে খুঁটিয়ে দেখা ও মস্তিষ্কে তার বিবরণ ধরে রাখা। তারপর সময় হলে ফিরে এসে আপনার বিশ্লেষণের জন্য তা জমা করা হবে। নিছক একটা যন্ত্রের মতন কাজ জিভা। আপনাদের সমীক্ষাযন্ত্র। তার বেশি কিছু নয়।” একটা বিষণ্ণ হাসি ফুটল রেনির মুখে।

“না রেনি। তোমাদের কাজের মূল্য তুমি জানো না। প্রস্তরযানের কুড়ি কিলোমিটার ব্যাসার্ধের সুরক্ষাবৃত্তের বাইরে সশরীরে আমি পা দিতে পারি না। এই গ্রহের পরিবেশ আমার জন্য বিষাক্ত। কিন্তু তোমাদের মত জৈবযন্ত্রের জন্য তা কোন বাধা হবে না। এ গ্রহের পরিবেশের উপযুক্ত করেই সৃষ্টি করা হয়েছে তোমাদের। কাজ সাফল্যের সঙ্গে শেষ হলে অকল্পনীয় পুরষ্কার অপেক্ষা করে আছে তোমাদের জন্য।”

বলতে বলতে নিজের মনেই একচিলতে হাসি খেলে গেল জিভার ঠোঁটে। পুরস্কার! জারাফা গ্রহের তৃতীয় উপগ্রহের অন্ধকার বুকে কাজ শেষ হওয়া এমন লক্ষ লক্ষ যন্ত্রদাসের দেহ পড়ে আছে। জারাফার সভ্যসমাজে যন্ত্রজীবদের কোন জায়গা নেই।

রেনির উজ্জ্বল চোখদুটো তাঁকে জরিপ করছিল। সেদিকে ফিরে মাথার চিন্তাটা ঝেরে ফেলে দিয়ে জিভা বললেন, “এখন এসো। স্মৃতি লুকোবার সময় হল। রাত শেষ হয়ে আসছে—”

*******

কোলে ঘুমন্ত মেয়েটার মাথায় মৃদু হাত বুলিয়ে দিচ্ছিলেন জিভা। নির্দিষ্ট নকশায় হাতের প্রত্যেক আসাযাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে একটু একটু করে ঘুমিয়ে পড়ছে তার মূল স্মৃতি। কিছুক্ষণ পরে হঠাৎ তাঁর কোলের মধ্যে কেঁপে উঠল মেয়েটা। চিৎকার করে কাঁদছে সে। অবোধ, অর্থহীন বাচ্চা মেয়ের কান্না।

“পুরনো সেই দিনের কথা

ভুলবি কীরে হায়

ও সে চোখে দেখা প্রাণের কথা

সে কি ভোলা যায়—”

কাঁধের ওপর তাকে ফেলে মৃদু চাপড় দিতে দিতে গান গাইছিলেন জিভা। অভিভাবকের স্মৃতি হাতড়াতে গিয়ে এ গানটি খানিক আগেই খুঁজে পেয়েছেন তিনি। মানুষটার প্রিয় গান। এবারে তা এই মেয়েটারও প্রিয় গান হয়ে উঠবে—

-রামবাসা টপ থেকে গ্লেসিয়ারের দিকে নেমে আসা আইসফলটার দিকে এইবার ঘুরে দাঁড়ালেন তিনি। ঝড় কমে আসছে দ্রুত। মেঘ কেটে গিয়ে চাঁদ উঠেছে। পুরু বরফের ওপর তার ঝলমলে আলো পড়েছিল। মাঝে মাঝে দমকা হাওয়ায় চাঁদমাখা বরফের কুঁচি উড়ে যাচ্ছিল তাঁদের ঘিরে। মাথা তুলে রামবাসা টপ এর দিকে একবার চাইলেন জিভা। তারপর মেয়েটাকে কোলে ধরে রেখে বাতাসে ভেসে উঠে তিরবেগে উড়ে চললেন আইসফলের সাদা দেয়ালের গা ঘেঁষে–

uponyasbarebare01 (Medium)

ঝড় থেমে গেছে একেবারে। দেয়ালের ফুটোফাটা দিয়ে চাঁদের ধবধবে আলো ঢুকে আসছিল ঘরের ভেতরে। স্লিপিং ব্যাগের মধ্যে জেগে ছিলেন জ্যোতির্ময় সেন। ঘুম আসছে না। পাশে বিশ্বনাথন মরার মতন ঘুমোচ্ছেন।

হঠাৎ দরজার কাছ দিয়ে একটা ছায়ার মত কিছু ভেসে গেল এক মুহূর্তের জন্য। জ্যোতির্ময় সতর্ক হলেন। কোন অস্ত্র নিয়ে বের হননি তাঁরা আজকের আউটিং-এ। বাইরে নরম বরফের ওপর হালকা একটা আওয়াজ আসছে। কান পাতলেন তিনি। পায়ের শব্দ। মৃদু চাপে মুড়মুড় করে বরফ ভেঙে এগিয়ে আসছে এদিকে।

হাত বাড়িয়ে বিশ্বনাথনের গায়ে মৃদু ঠেলা দিলেন জ্যোতির্ময় সেন। বিশ্বনাথন নড়ল না। একটু ভয়ভয় করছিল তাঁর। জায়গাটা সম্পূর্ণ অচেনা। হাতঘড়িতে সময় দেখাচ্ছিল রাত তিনটে বেজে পাঁচ। ফের একবার ধাক্কা দিলেন তিনি বিশ্বনাথনের গায়ে। এবারে একটু জোরে। তবু নড়লেন না তিনি। নিঃসাড়ে ঘুমোচ্ছেন। এমনটা হবার কথা নয়। বিশ্বনাথন ঘুমের মধ্যেও বেড়ালের মত সতর্ক থাকেন। এর আগেও একাধিক গবেষণা অভিযানে তিনি তা দেখেছেন।

কিন্তু সে নিয়ে ভাববার সময় আর তখন নেই তাঁর। পায়ের শব্দটা আরো কাছে এগিয়ে এসেছে। পচা পাইনকাঠের ভঙ্গুর দরজার এখানে ওখানে ফুটো দিয়ে চাঁদের আলো আঙুল বাড়িয়ে দিয়েছে। স্লিপিং ব্যাগ থেকে বেরিয়ে হামাগুড়ি দিয়ে বন্ধ দরজার সামনে এসে দাঁড়ালেন তিনি। চোখ রাখলেন একটা ফুটোর গায়ে–

নীলচে রুপোলি চাঁদের আলোয় ধূ ধূ করছিল বরফছাওয়া রিঙ্গানের বুক। তার ওপর হেঁটে  আসছেন একজন মানুষ! কোলে ছোটো একটা পুঁটুলি! পুঁটুলিটা নড়ছে! দুটো ছোটো ছোটো হাত বেরিয়ে জড়িয়ে ধরেছে লম্বা মানুষটার গলা—

কাছে –আরো কাছে এগিয়ে এলেন তিনি। তাঁর লম্বা চুলদাড়িতে বরফের কুঁচি। সারা শরীরে চাঁদের আলো চুঁইয়ে পড়ছে। কোলে ধরা ছোট্ট মানুষটা জেগে উঠেছে এবার। মাথা ঘুরিয়ে এদিক-ওদিক দেখছে।

হঠাৎ কেমন করে যেন মনের ভেতর থেকে সব ভয় মুছে গেল জ্যোতির্ময় সেনের। যেন কেউ ঠান্ডা একটা হাত বুলিয়ে দিল তাঁর উত্তপ্ত মস্তিষ্কে। আগন্তুক শত্রু নন। বন্ধু। কোনো অজ্ঞাত পথে তাঁর মনকে সে খবর তিনি পাঠিয়ে দিয়েছেন।

বিশ্বনাথন নিশ্চল হয়ে শুয়ে আছেন। তাঁর দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসি ফুটল জ্যোতির্ময়ের ঠোঁটে। ও এখন জাগবে না। তিনি এখন জানেন, আগন্তুক কোন সাক্ষি রাখতে চান না এ ঘটনার। ধীরে ধীরে দরজা খুলে বাইরে এগিয়ে এলেন জ্যোতির্ময় সেন।

কোন কথা হল না। সামনে দাঁড়িয়ে তাঁর চোখে চোখ রাখলেন মানুষটি কয়েকমুহূর্তের জন্য। জ্যোতির্ময়ের মাথার ভেতর ঝমঝম করে বেজে উঠল কিছু কথা- কয়েকটি নির্দেশ, ফিরে যাবার পথের হদিশ।

কোলে ধরে রাখা বাচ্চা মেয়েটাকে এইবার বাড়িয়ে ধরলেন তিনি জ্যোতির্ময়ের দিকে। দুহাতে তাকে কোলের মধ্যে জড়িয়ে নিলেন জ্যোতির্ময়। তারপর মাথা নিচু করে বললেন, “ধন্যবাদ জিভা। এবার আমার আর নাগবস্তি অবধি ফিরে যেতে কোন অসুবিধে হবে না। সাত বছর পর এইখানে এসে দ্বিতীয়জনকেও আপনার থেকে নিয়ে যাব আমি। তাদের যত্ন, শিক্ষাদিক্ষার ত্রুটি হবে না। আমার ছেলেমেয়ে নেই।”

আশীর্বাদের ভঙ্গীতে ডানহাতটা একবার উঁচু করে ধরলেন জিভা। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে জ্যোতির্ময়ের দিকে কয়েকমুহূর্ত তাকিয়ে থাকলেন। তারপর লম্বা লম্বা পায়ে এগিয়ে গেলেন উত্তরদিকের রামবাসা গিরিসংকটের দিকে। দেখতে দেখতে বরফের গায়ে চাঁদের আলোর মায়াবি আবছায়ায় মিলিয়ে গেল তাঁর লম্বা শরীর। জ্যোতির্ময়ের মাথার মধ্যে তখনও তাঁর শেষ কথাক’টি গুণগুণ করছিল, “এ সাধারণ মেয়ে নয়। আজ থেকে কুড়ি বছর পর এর মধ্যে তার চিহ্ন ফুটে উঠবে। তখন তুমি এদের আমার কাছে ফিরিয়ে আনবে। মনে রেখো—আজ থেকে ঠিক কুড়ি বছর—”

*******

চাঁদের আলো মরে এসেছে প্রায়। পুবদিকে আকাশ রাঙা হয়ে উঠেছে একটু একটু। হঠাৎ বিশ্বনাথনের হাতঘড়ির অ্যালার্মটা টিঁ টিঁ করে বেজে উঠল। সেই শব্দে ঘুম ভেঙে গিয়ে মেয়েটা খিলখিল করে হেসে উঠেছে। তার হাসির শব্দ রঙিন আলোর টুকরোর মতন ছড়িয়ে পড়ছিল ঘরটার মধ্যে।

ধড়মড়িয়ে উঠে বসলেন বিশ্বনাথন। ঘুম ভাঙা চোখে অবাক হয়ে দেখছেন মেয়েটার দিকে। তাকে যত্ন করে কোলে তুলে নিয়ে জ্যোতির্ময় বললেন, “আমার মেয়ে। ওর নাম রেখেছি রঞ্জা। কোন প্রশ্ন করবে না বিশ্বনাথন। আমি জবাব দেব না। এই জমাট বাঁধা হ্রদটার নাম রিঙ্গান। ওপাশে রামবাসা গিরিসংকট। ওর ওপারে একটা বিরাট গ্লেসিয়ার আছে। রামবাসা গ্লেসিয়ার। আমি এখান থেকে ক্যাম্পে ফেরবার রাস্তাটা জানি। বেশি দূরে নয়। চলো।”

“গুগল-এ আজকাল একটা নতুন ফিচার হয়েছে। রিভার্স ইমেজ সার্চ। কখনো দেখেছিস দিদি?”

রঞ্জা চুল বাঁধছিল। দেরি হয়ে যাচ্ছে তার। ফিতেটা কামড়ে ধরে বলল—“উম্‌ম্‌–”

রঙ্গন স্ক্রিন থেকে চোখ না সরিয়েই বলল,“উম্‌ম্‌ মানে কী? অ্যাঁ?”

“উঃ। এই ছেলে একেবারে কমপিউটারের পোকা হয়েছে। সকালে ঘুম থেকে উঠে থেকে দেখছি খুটখাট করেই চলেছে কিবোর্ড নিয়ে।”

“আ রে কী পেয়েছি একবার দেখই না শুধু! চমকে যাবি।”

রঞ্জার চুল বাঁধা শেষ হয়ে গিয়েছিল। ব্যাগে কাগজপত্রগুলো ঢোকাতে ঢোকাতে পর্দার দিকে একনজর দেখল সে। সেখানে বিরাট বিরাট ফুটবলের মত তিনটে পাথরের ছবি ভাসছে।

“ধুস্‌!ও তো নিউজিল্যান্ডের সেই বিখ্যাত মোরেকি লাইমস্টোন বোল্ডার। কাল রাতেই তো তোকে দেখালাম। সেইটাই আবার তুই আমাকে ঘুরিয়ে দেখাবি?”

“হুঃ। তুই আবার ভূতত্ত্ব নিয়ে রিসার্চ করবি? ভালো করে দ্যাখ একবার পাথ্রগুলো। ওগুলো মোরেকি বোল্ডার? কিচ্ছু জানে না।”

রঙ্গন মিটমিট করে হাসছিল। কথাগুলোর ফল কী হবে সে তার ভালো করেই জানা। সেটা ফলতে দেরিও হলনা। রঞ্জা ব্যাগট্যাগ আছড়ে ফেলে তার চুলের মুঠি ধরতে ছুটে আসছে। সঙ্গে শাসানি, “চুপ করে দাঁড়িয়ে মার খাবি তুই বলে দিলাম। নড়বি না। আমি তোর থেকে আট বছরের বড়ো দিদি। এই—এই হাত পা ছুঁড়বি না বলে দিচ্ছি। উঃ কী কেঠো কেঠো হাত! আজ তোর একদিন কি—ও মা –মা—শুনে যাও তোমার গুণধর ছেলে কী—”

কথাগুলো বলতেবলতেই কমপিউটার বন্ধ করতে গিয়েছিল রঞ্জা। কিন্তু কাজটা পুরো করা হল না তার। তার শিক্ষিত চোখ পর্দার ওপরে পাশাপাশি ভাসতে থাকা তিনটে ছবির ওপরে ফের একবার আটকে গেছে। খানিক বাদে ফিসফিস করে বলল,“এগুলো—এগুলো তো মোরেকি বোল্ডার  নয়!তাহলে—”

রঙ্গন তাকে আসতে দেখেই একলাফে খাটের ওপর গিয়ে উঠেছিল। এইবারে দিদিকে শান্ত হতে দেখে টুক করে বেড়ালের মতন একটা লাফ মেরে এসে তার পাশে দাঁড়াল, “কাল তোর দেখানো মোরেকি বোল্ডারের একটা ছবি নিয়ে গুগলে একইরকম দেখতে অন্য ছবির জন্য পাত্তা লাগিয়েছিলাম। গাদাগাদা ছবি এল। সব ওই মোরেকি বোল্ডারের ছবি। শেষে মোরেকি শব্দটাকে বাদ দিয়ে খুঁজতে এই তিনটে ছবি এল বুঝলি! এর একটাও নিউজিল্যান্ডের না-”

রঞ্জা তখন তার কথা আর শুনতে পাচ্ছে না। ছবিতিনটের মূল ওয়েবপেজগুলোকে আলাদা আলাদা ট্যাবে খুলে নিয়ে সঙ্গের লেখাগুলোর ওপর চোখ বোলাচ্ছিল সে। আর ফিসফিস করে বলছিল, “প্রথমটা তুর্কিস্তানের ‘গুবেক্‌লি টেপে’ গুহাক্ষেত্রে, রেডিও কার্বন ডেটিং বয়েস বলছে বারো হাজার বছর—এটা ইজরায়েলের হেভেল এইলট মরু অঞ্চলের! আট হাজার বছর। আর এইটে সিন্ধু নদীর অববাহিকায়– চার হাজার বছর—”

“হুঁ হুঁ। আরো আছে। তিনটের গায়েই খেয়াল করেছিস? ঠিক একরকম দেখতে একটা করে লম্বা ফাটল। কেসটা বেশ সাশপিশাস কিন্তু। তাই না?” রঙ্গনের চোখদুটো জ্বলজ্বল করছিল। তার ভুতত্ত্ববিদ দিদিকে এমন চমকে দেবার সুযোগ তো বেশি আসে না!

“দেখেছি। ফাটলগুলো প্রাকৃতিক নয় রে ভাই! কোনো পাথর ওইভাবে একেবারে নিখুঁত জ্যামিতিক আইন মেনে ফাটতে পারে না! আর এই যে—এই দাগগুলো ভালো করে দ্যাখ—” আপনমনেই কথা বলতে বলতে রঞ্জা ফাটলের জায়গাগুলোকে বড়ো করে তুলছিল পর্দার বুকে- “বিস্ফোরণের চিহ্ন! ইমপসিবল। অতকাল আগে, ঠিক চার হাজার বছর পরপর পৃথিবীর একএকটা জায়গায় একইরকম দেখতে পাথরের গায়ে এরকম করে বিস্ফোরণ ঘটানো—ধুস, মাথাটাথা সব গুলিয়ে দিলি তুই আমার। দাঁড়া দেখি—”

“রঞ্জা দশটা কিন্তু বাজে। তোর বাবার মিটিং আছে এগারোটা থেকে। আর দেরি হলে কিন্তু,” মার কড়া গলাটা ও’ঘর থেকে ভেসে আসতে সাইটগুলোকে তাড়াতাড়ি বুকমার্ক করে দিয়ে রঞ্জা উঠে দাঁড়াল।

“রাত্তিরে ফিরে দেখব, বুঝলি? এখন দৌড়ুই।”

ডঃ সেন গাড়িতে বসে বসে একটু অধৈর্যই হয়ে উঠছিলেন। মেয়েটা সবসময় দেরি লাগাবে। ডাক দিতে যাবেন, তখন দেখা গেল রঞ্জা দৌড়ুতে দৌড়ুতে আসছে। গাড়িতে উঠে বসে কাচটা তুলে দিতেদিতেই বলে, “ও বাবা, ভাই কী দারুণ একটা জিনিস বের করেছে দেখো আজকে ফিরে এসে-”

গাড়ি গিয়ারে ফেলতে ফেলতে ডঃ সেন অন্যমনস্কভাবে ঘাড় নাড়লেন। রাগ হচ্ছিল একটু। এদের ছেলেমানুষী মাঝেমাঝে সমস্যা তৈরি করে দেয়। প্রতিরক্ষা দফতর থেকে একজন উচ্চপদস্থ অফিসার আসছেন আজকের মিটিংটার জন্য। সকালে উঠে তাড়াহুড়ো করে তৈরি হচ্ছেন তখন শিখা এসে বলে, “আজ কিন্তু তুমি রঞ্জাকে ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাসে ছেড়ে দিয়ে তারপর ইনস্টিটিউটে যাবে।”

“আজ একটু ঝামেলা আছে শিখা,” পাশ কাটাতে চেয়েছিলেন তিনি।

শিখা কিন্তু নাছোড়। বলে, “মেয়ের পেপার প্রেজেন্টেশান আছে আজকে। যা তুকতাক মানে মেয়ে! তুমি না নিয়ে গেলে নাকি ওর পরীক্ষা খারাপ হয়। তাছাড়া ওর ক্যাম্পাস থেকে তোমার ইনস্টিটিউট আর কতোটাই বা দূর গো?”

অগত্যা অপেক্ষা করা। আসলে শিখা ওদের একটু বেশিই আদর দেয়। কুড়িয়ে পাওয়া অনাথ ছেলেমেয়েদুটো। সাত বছর ব্যবধানের সেই দুটো রাত এখনো জ্যোতির্ময়ের চোখে ভাসে! রিঙ্গান হ্রদের ধারে মেষপালকদের সেই পরিত্যক্ত কুঁড়ে! গভীর রাত্রে বরফের বুকে মরা চাঁদের আলোয় জিভার এসে দাঁড়ানো–কেউ দেখেনি–

পুরোনো স্মৃতিগুলো ঘাঁটতে ঘাঁটতেই রাগটা কমে আসছিল তাঁর। পাশে বসে বসে রঞ্জা কলকল করে কথা বলে চলেছে। তুর্কিস্তানে, ইজরায়েলে, সিন্ধু উপত্যকায় মোরাকি বোল্ডারের মতন দেখতে একএকটা পাথর–তাতে ফাটলের দাগ, চার হাজার বছর বাদে বাদে এক্সপ্লোশান, এইসব। একটা অদ্ভুত কল্পনার জগতে বাস করে দুই ভাইবোন। গাড়ি গিয়ারে ফেলতে ফেলতে ডঃ সেন নরম গলায় বললেন, “ওসব ছেড়ে প্রেজেন্টেশানটার দিকে মন দে রঞ্জা। আজ তোদের বোর্ডে সুন্দররাজু থাকবে। ব্যাটা মহা পাজি কিন্তু। স্টুডেন্ট লাইফ থেকে দেখছি তো ওকে!”

“ও নিয়ে তুমি একদম ভেবো না বাবা। উত্তর কাশ্মীরের পাথরের স্তর নিয়ে কাজ করেছি। ওতে আমাকে বোকা বানানো মুশকিল আছে।”

“সে জানি,” প্রফেসর সেনের মুখে একটুখানি গর্বের ছোঁয়া ছিল। মেয়েটার মাথা আছে। সাত বছর বয়সে ক্যালকুলাস রপ্ত করে ফেলেছিল। ছটা ভাষায় মাতৃভাষার মতই দক্ষতা। জিওলজিতে রেকর্ড নম্বর পেয়ে মাস্টার্স শেষ করল মাত্র আঠার বছর বয়সে। তার পর থেকে গত দু বছর ধরে খুব খেটেছে নিজের গবেষণার কাজটা নিয়ে। কতবার যে কাশ্মীরে ফিল্ড করে এল! আপার কাশ্মীরের অন্ধিসন্ধি চিনে গিয়েছে এর মধ্যেই। জায়গাটার দিকে ওর একটা আলাদা টান আছে। থাকবারই কথা। ও জানে না, ওইখানেই–কুড়ি বছর আগে—

কুড়ি বছর—কথাটা মনে হতেই মেরুদণ্ডের ভেতর দিয়ে একটা হিমশীতল ছোঁয়া নেমে গেল ডঃ সেনের। জিভা বলেছিলেন–

“ও বাবা, কোথায় যাচ্ছ? এসে গেছি তো! থামাও,থামাও—” বলতে বলতে গাড়ি ভালো করে থামতে থামতে না থামতেই দরজা খুলে একটা তুড়ুক লাফে বাইরে গিয়ে নেমেছে রঞ্জা।

“অল দা বেস্ট। ভালো করে—”

রঞ্জা ততক্ষণে দূরে দাঁড়ানো একদঙ্গল ছেলেমেয়ের দিকে হাত নাড়িয়ে ছুট দিয়েছে। ছিপছিপে শরীরটা যেন হাওয়ায় উড়ে চলেছে তার।

ড্যাশবোর্ডের ঘড়ি দেখাচ্ছিল বেলা দশটা পঁয়তাল্লিশ। হাতে সময় নেই আর। তাড়াতাড়ি গাড়ি গিয়ারে ফেললেন ডঃ সেন।

*******

“জেন্টলমেন, বিষয়টা গোপনীয়। প্রধানমন্ত্রীর দফতর সরাসরি ঘটনাক্রমের দিকে নজর রেখে চলেছেন। বলাবাহুল্য, এ বিষয়ে এই ঘরের বাইরে কোন কথা-” বলতেবলতেই ল্যাপটপের গায়ে একটা পেনড্রাইভ লাগিয়ে একটা ফোল্ডার খুলে ফেলেছেন প্রতিরক্ষা দফতরের যুগ্ম অধিকর্তা বিমল বেহেরা।

“গত আগস্ট মাসে সেনাবিভাগ থেকে কাশ্মীরের উচ্চতর এলাকার দুর্গম অঞ্চলে একটা অভিযান পাঠানো হয়েছিল। সেখানে হঠাৎ করেই একটা অসময়ের তুষার ঝড়ে অভিযাত্রী দলটা হারিয়ে যায়।”

“তাদের কোন সন্ধান-”

“না। উধাও অভিযাত্রীদের সন্ধানে আকাশপথে দু’বার সেখানে অনুসন্ধানী দল পাঠাবার চেষ্টা হয়েছিল। কিন্তু প্রতিবারই এলাকাটার কাছাকাছি এসে পৌঁছোবার সঙ্গেসঙ্গে বিমানের যাবতীয় ইলেকট্রনিক যোগাযোগব্যবস্থা অকেজো হয়ে পড়ায় সেগুলো ব্যর্থ হয়ে ফিরে আসে।”

“যন্ত্রগুলো অকেজো হয়ে গিয়েছিল?”

“না। দশটা বিভিন্ন ফ্রিকোয়েন্সি ব্যান্ডে কাজ করছিল বিমানগুলোর রেডিও যোগাযোগ। সেগুলো প্রত্যেকটাই ওই এলাকায় ঢোকবার সঙ্গে সঙ্গে জ্যাম হয়ে জায়।

“এরপর ভারতীয় দূরসংবেদি উপগ্রহ লীলাবতীকে এই কাজে লাগানো হয়। গত নভেম্বর মাসে লীলাবতী এলাকাটা থেকে একটা বিচিত্র পাথরের ছবি তুলে পাঠিয়েছে—”

বলতেবলতেই পর্দায় বরফঢাকা বিস্তীর্ণ পাহাড়শ্রেণীর মধ্যে একটা হিমবাহের ছবি ফুটে উঠেছে। তার গায়ে একটা কালচে ফুটকি ক্রমশ বড়ো হয়ে উঠছিল পর্দা জুড়ে। একটা অতিকায় ফুটবল আকারের পাথর। তার বুক জুড়ে লম্বা ফাটলের চিহ্ন একটা।

“আজ আমাকে গোল পাথরে পেয়েছে দেখছি। সকালে বাড়িতে, তারপর কাজে এসেও–” মনে মনে বললেন ডঃ সেন।

“জায়গাটা উত্তর কাশ্মীরের জনবিরল এলাকায় রিঙ্গান হ্রদ পার হয়ে রামবাসা গিরিসংকটের পেছনদিকে একটা গ্লেসিয়ারের ওপরে। এইবার এই ছবিদুটো দেখুন। ১৯৯৫ সালে একটি মার্কিন জরিপ উপগ্রহের তোলা একই স্থানাংকের দুটো ছবি—

বেহেরার কথাগুলো যেন অনেক দূর থেকে ভেসে আসছিল ডঃ সেনের কানে– রামবাসা গিরিসংকট—রিঙ্গান হ্রদ–

পর্দায়, ঝাপসা সাদাকালো একটা ছবি ধীরে ধীরে পরিষ্কার হয়ে উঠছিল। ধবধবে সাদা বরফে মোড়া হিমবাহটা শুয়ে আছে পাহাড়ের নীচে। তার বুকে পাথরটার কোন চিহ্ন নেই।

“এ ছবিটা ১৯৯৫ এর সেপ্টেম্বর মাসের শুরুতে তোলা। এবার সে বছরের অক্টোবর মাসের শেষ নাগাদ তোলা দ্বিতীয় ছবিটা দেখুন-”

একটা বিস্ময়ের শব্দ ছড়িয়ে গেল সারা ঘর জুড়ে। হিমবাহের বুকে ফাটলের দাগওয়ালা পাথরটা ফিরে এসেছে।

“জরিপ উপগ্রহটা অত উঁচু থেকে এত ছোটো বস্তুর পরিষ্কার ছবি তোলবার উপযোগী ছিল না। তবে ঘটনাটা যে ১৯৯৫ সালের হেমন্তকালেই ঘটেছিল সেটা এর থেকে পরিষ্কার।

“এবারে ২০১৪র নভেম্বরে লীলাবতীর শক্তিশালী ক্যামেরায় তোলা ছবিতে এই ফাটলটাকে ভালো করে লক্ষ করুন-” বলতেবলতেই মাউসের টানে পাথরের গায়ের লম্বা দাগটা বিবর্ধিত হয়ে পর্দার এপাশ থেকে ও’পাশে ছড়িয়ে পড়ল।

“ফাটলটার চরিত্র থেকে একটা জিনিস পরিষ্কার। এটা প্রাকৃতিক নয়।”

“ঠিক।” ইনস্টিটিউটের ডিরে্কটর সুশোভন চৌধুরি মাথা নাড়লেন, “এত নিখুঁত জ্যামিতিক গঠন কোন প্রাকৃতিক ফাটলের হবে না।”

ডঃ বেহেরা মাথা নেড়ে ফের নিজের কথার সুতোটা ধরে নিলেন, “অনুমানটার পেছনে আরো একটা কারণ আছে,” বলতে বলতেই কয়েকটা ফোল্ডার তিনি এগিয়ে দিচ্ছিলেন সকলের সামনে, “পাথরটা নিয়ে লীলাবতীর যাবতীয় স্পেক্ট্রাল অ্যানালিসিস রিডিং আর সে বিষয়ে আমাদের বিশেষজ্ঞদের মতামতগুলো এখানে রয়েছে।”

ফোল্ডারটার পাতাগুলোয় একবার চোখ বোলালেন ডঃ চৌধুরি। তাঁর দৃষ্টি তখন তীক্ষ্ণ হয়ে উঠেছে। তারপর মাথা নেড়ে বললেন, “আশ্চর্য! এখানে দেখাচ্ছে পাথরটায় কোন তেজষ্ক্রিয় উপাদান নেই। অথচ ফাটলটায় ক্ষীণ তেজষ্ক্রিয়তার চিহ্ন পেয়েছে লীলাবতী? রিডিংগুলোয় কোন-”

“ভুল নেই ডঃ চৌধুরি। আমাদের বিজ্ঞানিদের ওপর আস্থা রাখতে পারেন আপনি।

“তাহলে- কারণটা কী হতে পারে?”

“ফাটলটা কোন ছোটোমাপের নিয়ন্ত্রিত আণবিক বিস্ফোরণের ফল হতে পারে কি?”

“অসম্ভব। এত ছোটোমাপের আণবিক বিস্ফোরণের প্রযুক্তি এখনো আমাদের জানা নেই।”

“সেইটাই প্রতিরক্ষা বিভাগের উদ্বেগের কারণ ডঃ চৌধুরি। কাজটা যে-ই করে থাক তার হাতে আমাদের অজানা কোন প্রযুক্তি এসেছে। ঘটনাটা ১৯৯৫ সালের হেমন্তকালের। অর্থাৎ কুড়ি বছর ধরে ব্যাপারটার বিষয়ে অন্ধকারে ছিলাম আমরা। সন্দেহটা সত্যি হলে দেশের নিরাপত্তার ওপরে এর সুদূরপ্রসারী প্রতিক্রিয়া হবে। এ নিয়ে পরবর্তী পদক্ষেপ নেবার আগে তাই সরকার আপনাদের কাছ থেকে একটা সেকেন্ড ওপিনিয়ন চায়-”

 “হুম। বিষয়টা নিয়ে স্টাডি রিপোর্ট তৈরি করবার কাজটা আমি ডঃ জে সেনকে দিচ্ছি। আন্দাজ কতটা সময় লাগবে তোমার সেন?” প্রশ্নটা করে সামান্যক্ষণ অপেক্ষা করলেন ড: চৌধুরি। তারপর উত্তর না পেয়ে জ্যোতির্ময় সেনের দিকে ফিরে তাকিয়ে একটু অবাক হয়ে বললেন, “সেন, তুমি ঠিক কী করছ বল তো?”

ডঃ সেন তখন তাঁর কথা শুনতে পাচ্ছিলেন না। ফ্যাকাশে মুখে ফোল্ডারের পাতাগুলোর দিকেই দেখছিলেন তিনি। ভ্রুদুটো কুঁচকে উঠে গিঁট পাকিয়ে গিয়েছে তাঁর। আর মুখে বিড়বিড় করে নিজের অজান্তেই বলে চলেছেন—“কুড়ি বছর—১৯৯৫এর হেমন্ত-রামবাসা গ্লেসিয়ার-”

“সেন?”

ফোল্ডার থেকে মুখ তুলে ডঃ সেন এদিক ওদিক চাইলেন একবার। তারপর বললেন,“হঠাৎ করেই একটু অসুস্থ বোধ করছি স্যার।”

“কী হল হঠাৎ?” ডঃ চৌধুরি উদ্বিগ্ন গলায় জিজ্ঞাসা করলেন। সেনের মুখের ফ্যাকাশে ভাবটা তাঁর চোখে এড়িয়ে যায় নি।

ম্লান হেসে মাথা নাড়লেন জ্যোতির্ময় সেন, “বিশেষ কিছু নয়। একটু বিশ্রাম নিলে ঠিক হয়ে যাবে।”

“মানে? এধরণের জরুরি একটা কাজ ফেলে রেখে আপনার সায়েন্টিস্ট বিশ্রাম নিতে চললেন?” বেহেরার গলায় বিরক্তি চাপা থাকছিল না, “নষ্ট করবার মত সময় আমাদের নেই ডঃ চৌধুরি। আপনার কাছে সায়েন্টিস্টের অভাব নেই। দরকার হলে আপনি আর কাউকে এ দায়িত্বটা-”

চৌধুরি স্থির চোখে বিমল বেহেরার দিকে কিছুক্ষণ দেখলেন। তারপর ঠান্ডা গলায় বললেন, “জ্যোতির্ময় আমার ছাত্র বটে কিন্তু প্রতিভায় ওর স্তরের বৈজ্ঞানিক এখন খুব বেশি নেই। কাজটা ও-ই করবে। এতে যদি আপনার কোন আপত্তি থাকে তাহলে আমি আপনার ডিফেন্স সেক্রেটারি শীতল মহাজনের সঙ্গে কথা বলব। সে আমার ছাত্রী ছিল।” বলতেবলতেই  জ্যোতির্ময়ের দিকে ঘুরে তিনি বললেন, “কাজটা করতে কতটা সময় নেবে জ্যোতির্ময়?”

জ্যোতির্ময় একটু অস্বস্তিভরা মুখে বললেন,“আমি ফোল্ডারটা সঙ্গে করে নিয়ে যাচ্ছি। দু’একটা দিন সময় দিন। আর,বেহেরাসাহেবের পেনড্রাইভের ছবিগুলো আমার কাজে লাগবে। যদি মিটিং-এর শেষে কাউকে দিয়ে আমার বাড়িতে ওটা একটু পাঠিয়ে দেন তো ভালো হয়–”

বিমল বেহেরা হাঁ হাঁ করে উঠছিলেন। নথিগুলো একান্তই গোপনীয়। উঠে দাঁড়িয়ে তাঁর দিকে ভ্রু কুঁচকে ডঃ চৌধুরি বললেন, “নথিপত্রের নিরাপত্তার দায়িত্ব আমি নিচ্ছি। কিন্তু ওকে ওর কাজটা ওর মত করে করতে দিন।”

*******

রাত গভীর হয়েছে। জানালায় বৃষ্টির শব্দ হচ্ছিল। বাড়িটা নিঃঝুম হয়ে আছে। সামনে কমপিউটারের ডেস্কের ওপরে বাঁধানো ফ্রেম থেকে দুটো হাসিমুখ তাকিয়ে আছে জ্যোতির্ময়ের দিকে। রঞ্জা আর রঙ্গন। তাঁর পাঁজরের দুটো হাড়। বুকের ভেতরটা টনটন করে উঠছিল তাঁর। ১৯৯৫ সাল—রিঙ্গান হ্রদের পাশে দাঁড়িয়ে তাঁর কোলে রঞ্জাকে তুলে দেবার পর জিভার বলা শেষ কটা কথা, সেদিনকার মতই মাথার মধ্যে ফের বেজে উঠছে বারবার—“কুড়ি বছর পরে–মনে রেখো-”

সেই হেমন্তে একটা বৈজ্ঞানিক অভিযানে গিয়ে রামবাসা গিরিসংকটের পাশ থেকে কোলজোড়া মেয়ে পেয়ে ফিরে এসেছিলেন তিনি। আজ, ঠিক কুড়ি বছর পরে ফের সেই রামবাসা হিমবাহের বুকের একটা রহস্য এসে দাঁড়িয়েছে তাঁর সামনে। তারও সূচনা হয়েছিল সেই একই সময়ে–

হঠাৎ টেবিলের ওপরে রাখা বিমল বেহেরার দেয়া ফোল্ডারের কাগজগুলোকে দলা পাকিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দিলেন তিনি। অসম্ভব! এটা একটা কাকতালীয় ঘটনা ছাড়া আর কিছু নয়। রঞ্জা আর রঙ্গন প্রতিভাধর বটে কিন্তু অসাধারণত্বের কোন লক্ষণ তাদের মধ্যে নেই। একেবারেই স্বাভাবিক সুস্থ দুটো ছেলেমেয়ে। তাছাড়া,চিরটাকাল তাঁদের দুজনকেই বাপ মা বলে জেনে এসেছে রঞ্জা আর রঙ্গন। প্রাণে ধরে আসল কথাগুলো কখনই তাদের বলে উঠতে পারেন নি তিনি। আজ এমন হঠাৎ করে তাদের বিদায় দেয়া—না, এ তাঁর পক্ষে সম্ভব নয়। কিছুতেই না।

কিন্তু তারপরেই ২০০২ সালের সেই দ্বিতীয় রাতটা ফের ভেসে এল তাঁর চোখের সামনে-রিঙ্গান হ্রদের পাশে-তাঁর মুখোমুখি জিভা। হাতে তুলে দিলেন ছোট্টো রঙ্গনকে। হাসিখুশি ছেলেটা—জ্বলজ্বলে চোখে তাঁকে দেখছিল। যাবার আগে ফের একবার তার দিকে ফিরে তাকিয়েছিলেন জিভা। মাথার ভেতর গুণগুণ করে উঠেছিল শান্ত গলার সেই আদেশ—আর তেরো বছর। সঠিক সময়ে কিছু লক্ষণ ফুটে উঠবে ওদের মধ্যে। ভুলো না–

ভেতরে ভেতরে ছটফট করছিলেন জ্যোতির্ময়। কার কাছে খুলে বলবেন তিনি এই কথাগুলো? কে তাঁকে- 

*******

“বাবা, ঘুমোবে না তুমি আজকে?”

পেছনে রঙ্গনের গলার আওয়াজ পেয়ে চমকটা ভেঙে গেল ডঃ সেনের। মায়ের পাশ থেকে বিছানা ছেড়ে কখন যেন উঠে এসেছে এ ঘরে। চড়া আলোয় চোখদুটো পিটপিট করছে তার। তাকে দু হাতে জড়িয়ে ধরে তিনি বললেন, “এই যাই রে। আর একটু কাজ শুধু—”

“উঁহু। কিছুতেই না। হবে না। তুমি আজ রাত্তিরে আমাকে গল্পও শোনাওনি। এখন শুতেও আসছ না। আমার ভয় লাগে না বুঝি?”

“কীসের ভয় রে পাগলা?”

“সেই স্বপ্নটা আবার দেখলাম। যে লম্বা লোকটা! বড়োবড়ো চুলদাড়ি। জ্বলজ্বলে চোখ—”

“সে আবার কী?”

“জানি না। আজকাল মাঝেমাঝেই দেখি। ও বাবা জানো দিদিভাইও বলছিল স্বপ্নে বুড়োটাকে দেখেছে। কীসব যেন বলছিল ওকে। কোথায় কোন পাহাড়ের কথা। আমি তাই শুনে দিদিভাইকে যা ক্ষেপিয়েছি সে তুমি-” বলতেবলতেই হঠাৎ মনিটরের দিকে নজর গেছে তার। সেখানে ভেসে থাকা লীলাবতীর তোলা ছবিটা দেখেই ঘুমটুম কোথায় উধাও হয়ে গেছে চোখ থেকে। বলে, “আরে? আরো একটা গোল পাথর!”

“আর একটা মানে? আর গোল পাথর কোথায় দেখলি-”

বলতেবলতেই ডঃ সেনের মনে পড়ে গেল, সকালবেলায় রঞ্জা ওরকম কিছু একটা বলছিল বটে। মাথা ঘুরিয়ে রঙ্গনের দিকে তাকিয়ে বললেন, “আমায় দেখা দেখি?”

“ইজি। তুমি একটু সরে বোসো—” বলতেবলতেই তাঁর চেয়ারের একপাশে নিজের শরীরটা গুঁজে দিল রঙ্গন। তারপর দক্ষ হাতে কিবোর্ডে কিছু ঠিকানা টাইপ করে এনটারের বোতামটা টিপে দিয়ে হাসিমুখে বলল, “এইবার—আসছে। দ্যাখো শুধু মজাটা একবার।”

ডঃ সেনের বিস্মিত চোখের সামনে তখন এক এক করে ভেসে উঠছিল—চার হাজার বছর অন্তর পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে হাজির হয়ে চলা একএকটা গোল পাথর—তাদের শরীরে সেই রহস্যময় ফাটলের চিহ্ন-

হঠাৎ মনে মনে চমকে উঠলেন জ্যোতির্ময়। আরো একটা মিল আছে! তিনটে জায়গাই কোন না কোন উন্নত সভ্যতার জন্মভূমি, তিনটে সভ্যতাই ধ্বংস হয়ছে—নানা কারণে হারিয়ে গেছে পৃথিবীর বুক থেকে! কেন? ওর সঙ্গে ওই পাথরগুলোর কোন সম্বন্ধ আছে কী? অথবা—জিভার? রামবাসায় গোল পাথরের আবির্ভাব আর জিভার সঙ্গে তাঁর প্রথম দেখা হবার সময়টাও তো প্রায়–

“ও বাবা। কী ভাবছ বলো তো মুখটা অমন শক্ত করে? ওরকম কোরো না। হাসো—হাসো! আচ্ছা দাঁড়াও তোমাকে একটা মজার খেলা দেখাই, তাহলেই মন ভালো হয়ে যাবে। দিদিভাই কাল শেখাল আমায়-” বলতেবলতেই হঠাৎ করে স্থির চোখে কমপিউটারটার দিকে ঘুরে তাকিয়ে রইল রঙ্গন।

“রঙ্গন, এখন খেলাটেলা নয়। কাল সকালে-”

কথাটা পুরো শেষ করতে পারলেন না ডঃ সেন। হঠাৎ করেই একেবারে চুপ করে গেছে রঙ্গন। শরীর শক্ত করে সে একদৃষ্টে তাকিয়ে রয়েছে কমপিউটারের মনিটারের দিকে। কমপিউটারের পর্দায় নিজে থেকেই হঠাৎ জেগে উঠেছে একটা ইলেকট্রনিক পিয়ানোর ছবি। জিনিসটা ডঃ সেন চেনেন। একটা ছোট্ট প্রোগ্রাম। বিনিপয়সায় মেলে ইন্টারনেটে– আর তারপর, হঠাৎ টুংটাং শব্দ করে বেজে উঠল ছবিটা।

“দাঁড়াও ম্যাক্সিমাইজ করে দি,” ফিসফিস করে কথাটা রঙ্গন উচ্চারণ করতেই পিয়ানোটা গোটা পর্দা জুড়ে বসল এবারে। আর, তার চোখের মণির যাতায়াতকে অনুসরণ করেই যেন বা, একটা রবীন্দ্রসঙ্গীতের সুর বাজিয়ে চলেছে তা তখন-“পুরনো সেই দিনের কথা—”

“এই গানটা তো তোমার ফেভারিট, তাই না বাবা? দিদিভাইয়েরও। ভালো বাজিয়েছি, না?”

ডঃ সেন অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন বারো বছরের ছেলেটার দিকে। তারপর আস্তে আস্তে বললেন, “কিন্তু, কী করে করলি তুই? মাউস বা কিবোর্ড না ছুঁয়ে-”

মিটিমিটি হাসছিল রঙ্গন, “ম্যাজিক। দিদিভাই শিখিয়ে দিল।”

“দিদিভাইও পারে?”

“উরিব্বাস দিদিভাই আরো অনেক মজার খেলা জানে। কোত্থেকে শেখে রোজ রোজ কে জানে! আমাকেও শিখিয়ে দিচ্ছে তো। এই খেলাটা খুব সহজ কিন্তু বাবা। এই দেখো—কিচ্ছু না—শুধু পর্দাটার দিকে তাকাও—তা-কা-ও- তারপর খুব কষে ভাবো- সা-সা-নি-সা-গা-গা-রা-সা-সা-রা-গা-গা-”

পর্দায় ফের বেজে উঠেছে রবীন্দ্রসঙ্গীতের সুরটা। মেরুদণ্ড দিয়ে একটা হিমশীতল স্রোত বয়ে যাচ্ছিল ডঃ সেনের। জিভা বলেছিলেন, সময় হলে ওদের মধ্যেও তার লক্ষণ—

“হাসো বাবা, একটু হাসো—”

রঙ্গন তাঁর কোলের ওপর উঠে গালদুটো টেনে ধরেছে। চোখ ফেটে জল বের হয়ে আসছিল তাঁর। অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন,“হ্যাঁ রে রঙ্গন,কাল তোর ম্যাথস টেস্ট আছে না?”

“আছে তো! ও আমি সব পারব।”

“ও কথা বললে হয়? রাত্তিরে ঠিক করে না ঘুমোলে পরে হলে বসে ঘুমিয়ে পড়বি যে! এখন চল,শুবি।”

“তাহলে তুমিও শোবে চলো আমার সাথে। আমায় গান গেয়ে ঘুম পাড়িয়ে দেবে।”

“চল।”

কমপিউটার বন্ধ করে রেখে রঙ্গনকে কোলে তুলে নিলেন জ্যোতির্ময়। বারান্দার শেষপ্রান্তে দু’ভাইবোনের ঘর। সেখানে ঢুকে তাকে শুইয়ে দিয়ে পাশে একটা চেয়ার টেনে বসলেন। ওপাশের চৌকিতে রঞ্জা ঘুমোচ্ছে। ঠোঁটোদুটো নড়ছে তার। স্বপ্ন দেখছে নাকি? রঙ্গনের পিঠে চাপড় দিতে দিতে মৃদু গলায় গান গাইছিলেন তিনি। বাইরে বৃষ্টি নেমেছে। মৃদু ছপছপ আওয়াজ আসছিল। সানশেডের ওপর বৃষ্টি পড়বার শব্দ-

খানিক বাদে রঙ্গন ঘুমিয়ে পড়লে আস্তে আস্তে উঠলেন জ্যোতির্ময়। রঞ্জার চৌকির পাশে গিয়ে তার মাথায় হাত বুলিয়ে আস্তে আস্তে ডাকলেন, “রঞ্জা-”

“উঁ?”

চোখ খুলে বাবাকে ঝুঁকে থাকতে দেখে একটু হাসল সে। তারপর ফের পাশ ফিরে চোখ বুঁজতে যাচ্ছিল, জ্যোতির্ময় বাধা দিলেন, “উঠে একটু এ’ঘরে আয় তো! জরুরি কথা আছে কয়েকটা।”

“এত রাত্তিরে? সকালে বললে হত না বাবা?” চোখ কচলাতে কচলাতে উঠে বসল রঞ্জা।

“না। ব্যাপারটা সিরিয়াস।”

পড়ার ঘরে এসে তার মুখোমুখি বসলেন জ্যোতির্ময়। রঞ্জা একটু ভয় পেয়েছে। বলে,“কী হয়েছে বাবা?”

“সব বলব। বড়ো হয়েছিস। এইবারে তোকে জানানো দরকার। কিন্তু তার আগে একটা কথা বল।খানিক আগে রঙ্গন একটা আশ্চর্য ব্যাপার করে দেখাল। হাত দিয়ে না ছুঁয়ে কমপিউটারটা ব্যবহার করছিল ও। বলল,তুই শিখিয়েছিস।”

“আ-আমি—মানে-”

“আমি শুনছি।”

সোজা হয়ে বসল রঞ্জা। তার ঘুম কেটে গেছে এইবারে। আনমনে মাথা নেড়ে বলল, “আমি নিজেও বুঝতে পারছি না বাবা ঠিক কী হচ্ছে আমার। মাসদুয়েক হল জিনিসটা শুরু হয়েছে। ব্যাপারটা এত অদ্ভুত যে তোমাকে কী করে বলব তাই বুঝে উঠতে পারছিলাম না।”

“ভেঙে বল।”

“বলবার চেয়ে বরং করে দেখাই। কমপিউটারটার দিকে দেখ।”

জ্যোতির্ময়ের অবাক চোখের সামনে তখন বন্ধ কমপিউটারের ইউ-পি-এস এর সুইচটা নিজেনিজেই অন হয়ে গেছে। চালু হয়ে গেল কমপিউটারের সুইচটাও। বুট হয়ে চলেছে কমপিউটার। একের পর এক মেসেজগুলো ভেসে উঠছে তার পর্দায়—

“টেলিকাইনেসিস-”

“দাঁড়াও দাঁড়াও,” তাঁকে বাধা দিল রঞ্জা, “বন্ধ করবার সময় কোন স্ক্রিনটা তোমার সামনে খোলা ছিল সেইটে খুঁজছি। আমার চোখের দিকে তাকাও বাবা–”

তীক্ষ্ণ হয়ে উঠেছে রঞ্জার চোখদুটো। তাঁর চোখের রেটিনা ফুঁড়ে যেন মস্তিষ্কের ভেতরটা অবধি পড়ে নিতে চাইছে সে। কয়েকটা মুহূর্ত শুধু। তারপরেই একটুকরো হেসে ফের কমপিউটারের পর্দার দিকে মুখ ফেরাল রঞ্জা, “এটা করতে এখনো একটু সময় লাগছে, কিন্তু রোজ ভাইয়ের সঙ্গে প্র্যাকটিশ করে করে সময়টা কমিয়ে আনছি আমি। রিডিংটাও অনেক নিখুঁত হয়ে আসছে, “উম্‌, পিয়ানো অ্যাপ্লিকেশন—দাঁড়াও। এদিকে আরেকবার তাকাও দেখি—আমার চোখের দিকে—নাঃ-ফাইল লোকেশানটা তোমার কাছে নেই–কমপিউটারটার মধ্যে দেখি—ডি ড্রাইভ—ফোল্ডার-রঙ্গন—ব্যস! এই যে। কমপিউটার বন্ধ করবার এইটাই খোলা ছিল না সামনে?”

পর্দায় ফের ভেসে ওঠা রঙ্গনের সেই পিয়ানোটার দিকে তাকিয়ে অবাক হবার বদলে বুকের ভেতর একটা তীব্র যন্ত্রণা যেন পাক দিয়ে উঠল জ্যোতির্ময়ের। আর সন্দেহ নেই। অকাট্য প্রমাণ তাঁর চোখের সামনে। এইবার?

uponyasbarebare3 (Medium)

রঞ্জা তখন নিজের মনেই বলে চলেছে, “ভাইয়ের আবার জিনিসপত্তর নাড়ানোচাড়ানোর দিকটা আমার চেয়ে বেশি ভালো হচ্ছে, বুঝলে বাবা, মাইন্ডরিডিংটা হচ্ছে কিন্তু বড্ডো ভুলভাল করে। খুব চঞ্চল তো! কিন্তু এটা ঘটছে কীভাবে বাবা?”

“জানি না রে। এখনো অবধি মানুষের মস্তিষ্কের এমন ক্ষমতা থাকবার কোন প্রমাণ পাওয়া যায় নি।”

“রঞ্জা খুক করে একটু হাসল, “বাবা! তুমি বলছ আমি মানুষ নই? ধুত! তার মানে তো তুমি,মা সবাই-হি হি-”

“থাম রঞ্জা। একটা ছোটো পরীক্ষা করব। আমার চোখের দিকে তাকা। ঠিক কোন ছবিটা আমি ভাবছি সেইটা দেখতে পাচ্ছিস?”

ফের তীক্ষ্ণ হয়ে উঠল রঞ্জার চোখের দৃষ্টি। মাথায় তীব্র একটা যন্ত্রণার ঝলক ছুটে এল জ্যোতির্ময়ের। তবু জোর করে ছবিটাকে মনের মধ্যে ফুটিয়ে রাখলেন তিনি—

“তুমি—তুমি একে দেখেছ?” হঠাৎ রঞ্জার কাঁপা কাঁপা গলার কথাগুলো কানে যেতে চমকে উঠলেন জ্যোতির্ময়। মাথার ব্যথাটা থেমে গেছে। রঞ্জার চোখ আবার স্বাভাবিক, “এ লোকটাকে আমি মাঝেমাঝেই স্বপ্নে দেখি বাবা। ভাইও দেখে। একটা বিরাট উঁচু পাহাড়, তার একপাশে একটা ছড়ানো লেক আর অন্যদিকে একটা গ্লেসিয়ার। পাহাড়টার মাথায় দাঁড়িয়ে থাকে লোকটা। ও কে বাবা?”

একটুক্ষণ চুপ করে থেকে জ্যোতির্ময় ক্লান্ত গলায় বললেন, “এইবারে তোর সব কথা জানবার সময় হয়েছে মা। তোদের দুজনের কেউই আমাদের নিজের ছেলেমেয়ে নোস রে। লোকটার নাম জিভা। ও-ই—তোদের আমার হাতে–”

*******

–বসবার ঘরের দেয়ালঘড়িতে টং টং করে তিনটে বাজল। বাইরে বৃষ্টি থেমে গেছে। এ বাড়ির চারপাশে অনেক গাছ। তার পাতা থেকে টুপটাপ ঝরে পড়া জলের ফোঁটার শব্দ পাওয়া যায়। জ্যোতির্ময়ের গল্প শেষ হয়ে গেছে অনেকক্ষণ। দুজনেই নিস্তব্ধ হয়ে বসেছিলেন মুখোমুখি।

রঞ্জা একদৃষ্টে তাঁর চোখের দিকে তাকিয়েছিল। একটু বাদে যখন কথা বলল, উত্তেজনার ছিটেফোঁটাও নেই তার গলায়, “ঠিকই ভাবছ তুমি বাবা। ওখানে একবার যেতে হবে আমাদের। পালিয়ে বাঁচা যাবে না। রঙ্গন আর আমি দুজনেই তোমার সঙ্গে-”

 “রঙ্গন-মানে- ও যে বড্ডো ছোটো রে! ওকে কোনোখানে সরিয়ে দিয়ে-”

রঞ্জা হাসল একটু, “ও ঘুমিয়ে আছে,তবু আমি এইখানে বসে ওর মস্তিষ্কের শব্দ শুনতে পাচ্ছি বাবা। সবে তো দু’মাস হল নিজের মধ্যে এই ক্ষমতাটা আমি টের পেয়েছি। তবু, হাজার মানুষের ভিড়ের মধ্যে থেকেও আজকাল আমি ওর উপস্থিতি টের পেয়ে যাই। তাহলে জিভার ক্ষমতা কতটা হতে পারে? তার হাত থেকে কোথায় লুকিয়ে রাখবে তুমি ওকে? না বাবা। বিপদ থেকে পালিয়ে গিয়ে নয়। আমরা একসঙ্গে ওর মুখোমুখি হব। তাছাড়া, কেন লোকটা চার হাজার বছর অন্তর এইভাবে ঘুরে আসছে,সেইটাও বোঝা দরকার। পৃথিবীর স্বার্থেই। আ-আমরা ভাইবোন হয়ত ওর জাতের জীব! ওর সাথে পাল্লা দিতে গেলে আমাদের তোমার প্রয়োজন হবে—”

বলতেবলতেই বাবার মুখের দিকে চোখ যেতে নরম হয়ে এল রঞ্জার গলা, “মনখারাপ করবে না বলছি। আমি আর রঙ্গন তোমাদের ছেলেমেয়ে। কথা দিচ্ছি,তোমাদের ছেড়ে আমরা কক্ষণো কোত্থাও যাব না।”

“রঙ্গনকে এসব কথা এত ভেঙে-”

রঞ্জা মিটিমিটি হাসল,“পাগল নাকি? সবসময় স্পাইডারম্যান সুপারম্যান করে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। এক্ষুণি এসব কথা ওকে বলে বিপদ বাধাই আর কি। কালকেই ইশকুলে গিয়ে অ্যানাউন্স করে দেবে’খন বন্ধুদের কাছে। ও তুমি কিচ্ছু ভেবো না। ওকে কখন, কতটা জানাব সে আমার দায়িত্ব। নাও,এখন গিয়ে শোও তো! আমিও ঘুমিয়ে নিই আর একটু।”

মাথা নাড়লেন জ্যোতির্ময়, “ঘুম আমার আর আসবে না আজকে। তুই শো গে যা। একটা মেল পাঠাবার আছে। সেইটে সেরে গিয়ে শুয়ে পড়ছি।

“উফ্‌ফ্‌ বাবা তুমিও না! আজ রাত্তিরেই মেলটা করে ফেলতে হবে তোমায়? সাধে রঙ্গন এত অধৈর্য ছেলে হয়েছে!” বলতে বলতে পড়ার ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল রঞ্জা।

*******

রাত ভোর হয়ে আসছিল। বাইরে পাখি ডাকছে একটা দুটো। সামনে পর্দায় খোলা লম্বা মেলটা যাবার জন্য তৈরি। তার শেষ লাইন ক’টায় আরো একবার চোখ বোলালেন জ্যোতির্ময়,

-“বিশ্বনাথন, জানি তোমার বয়স হয়েছে। শরীরও অশক্ত। কিন্তু তবু, একেবারে স্বার্থপরের মত তোমাকে সঙ্গে চাইছি যে তার কারণ, ও এলাকাটা আমি বাদে আর যদি কেউ খানিকটাও চেনে সে তুমি। অভিযানটা বিপজ্জনক। দুজন একসঙ্গে থাকলে, একজনের যদি কিছু হয়েও যায়, অন্যজন তাহলে অন্তত ছেলেমেয়েদুটোকে গাইড করতে পারব। একা ঠিক ভরসা পাচ্ছি না—”

মাউস পয়েন্টারটা সেন্ড বোতামের ওপর স্থির হয়ে আছে। কাঁপা কাঁপা আঙুলে মাউসে মৃদু চাপ দিলেন জ্যোতির্ময়–

******

 “তুমি কি নিশ্চিত সেন?”

টেবিলের উল্টোদিকে বসে থাকা জ্যোতির্ময় মাথা নাড়লেন, “ডঃ বেহেরা ভুল অনুমান করেননি। সব খুঁটিয়ে দেখে আমি তাঁর সাথে সম্পূর্ণ একমত। ফাটলটা একটা খুব ছোটোমাপের আণবিক বিস্ফোরণেরই ফল।”

“থ্যাংক ইউ। শীতল গত চারদিন এই রিপোর্টটার জন্য ব্যস্ত হয়ে উঠেছিল। আমি এটা ওকে পাঠাবার বন্দোবস্ত করছি। এবারে সরকার যা করে করুক। আমাদের কাজ শেষ।”

“ওঁরা কেসটা নিয়ে কী করবেন সে ব্যাপারে কোন আন্দাজ দিয়েছেন?”

“শীতল বলছিল প্রয়োজন হলে ওখানে অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে কিছু লোক পাঠাবে সরেজমিনে ব্যাপারটা দেখে আসতে।”

“একটা কথা বলব স্যার? ওঁকে এক্ষুণি কিছু করে বসতে মানা করুন। তাড়াহুড়ো না করাই ঠিক হবে এক্ষেত্রে। আরো একটু দেখেশুনে তৈরি হয়ে নিয়ে তারপর ফোর্স পাঠালে বোধ হয়-”

চোখ থেকে চশমাটা খুলে নিয়ে সেটাকে মুছতে মুছতে ডঃ চৌধুরি বললেন, “কথাটা ভুল বলোনি জ্যোতির্ময়। কিন্তু দেশের নিরাপত্তার প্রশ্ন উঠে গেছে যেখানে, সেখানে সাবধানতার জন্য আরো  দেরি করাটা বোধ হয় ভুল পদক্ষেপ হবে। এমনিতেই অনেক দেরি হয়ে গেছে আমাদের–”

“ঠিক স্যার। তবে আমি দেরি করবার কথা বলিনি।”

“তাহলে?”

“বলছিলাম, শুরুতেই ফোর্স না পাঠিয়ে ছোটো একটা বিশেষজ্ঞদল পাঠানো উচিত হবে ওখানে। নিউক্লিয়ার সায়েন্সটা ভালো বোঝেন এমন কয়েকজন মানুষ। জায়গাটা সম্পর্কে কেউ বিশেষ কিছু জানে না। বিশ বছর আগে একটা উন্নত টেকনোলজির প্রয়োগ করা হয়েছে ওখানে। যে বা যারা সেটা করেছে তারা এতদিনে সেখানে কতটা শক্তি জড়ো করেছে সেটা না জেনে হঠাৎ করে সেনা পাঠালে তার ফল খারাপ হতে পারে।”

“তোমার কথায় যুক্তি আছে। আমি শীতলের সঙ্গে আলোচনা করব ব্যাপারটা নিয়ে।”

মনে মনে এইবার শেষ পদক্ষেপটা নেবার জন্য তৈরি হলেন জ্যোতির্ময়। সাধারণত মিথ্যে বলেন না তিনি। কিন্তু এটা কোন সাধারণ পরিস্থিতি নয়। আসল কথাগুলো এঁকে বললে বিশ্বাস করবেন না। কৌশলে কাজ করতে হবে।

“আমার একটা প্রস্তাব আছে। রামচন্দ্র বিশ্বনাথনকে তো চেনেন আপনি।”

“কসমিক রে রামচন্দ্র তো? চিনব না কেন? সে-ও তো আমারই ছাত্র! এখন জিআইএফআর-এ আছে,তাই না?”

“হ্যাঁ স্যার। আমার প্রথম পেপারের গাইড। তার পরেও একসঙ্গে অনেকবার কাজ করেছি আমরা। ”

“তা-ও জানি। কন্ট্রোলড ফিউশানের ওপরে তোমাদের গতবারের জয়েন্ট পেপারটা আমার কাছেই এসেছিল মতামতের জন্য। অসাধারণ কাজ। তা, হঠাৎ তার কথা কেন?”

“আমি আর রামচন্দ্র মিলে জায়গাটা একবার ঘুরে আসতে চাইছিলাম প্রথমে।”

কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন ডঃ চৌধুরি। তারপর আস্তে আস্তে বললেন, “অবাস্তব প্রস্তাব জ্যোতির্ময়। তোমাদের মত দুই প্রথম সারির বৈজ্ঞানিককে এরকম একটা অজানা অচেনা বিপদের মুখে ঠেলে দেয়া আমার মতে উচিত হবে না।”

“হবে স্যার। তার কারণ আছে। প্রথমত, কাজটা করবার যোগ্যতা আমাদের আছে তা আপনি মানবেন। দ্বিতীয় কারণ, রামবাসা এলাকায় আমরা দুজন আগেও গিয়েছি। সেটা সেই ১৯৯৫ সালের হেমন্তেই। পথ ভুল করে অবশ্য,কিন্তু তা হলেও জায়গাটা আমাদের পরিচিত। সে অভিজ্ঞতা খুব বেশি মানুষের নেই। আর সবচেয়ে বড়ো কথা, সেনা পাঠাবার আগে ও জায়গায় একটা গবেষণা অভিযান পাঠাবার প্রস্তাবটা যুক্তিসম্মত। আপনি সুপারিশ করলে ওতে সরকারের আপত্তি হবে না।”

“সেইখানটাতেই তো আমার সবচেয়ে বড়ো আপত্তি জ্যোতির্ময়। স্বার্থপর চিন্তা বলতে পারো। কিন্তু তোমাদের মত আমার দুই সেরা ছাত্রকে এইভাবে বিপদের মুখে ঠেলে দিতে-”

“পারতে হবে স্যার। আমাদের জীবনের দাম দেশের নিরাপত্তার থেকে বেশি নয়। আপনার ছাত্র হলেও নয়।”

খানিকক্ষণ চুপ করে বসে রইলেন ডঃ চৌধুরি। তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, “ডিবেটে ইউনিভার্সিটিতে চিরকাল চ্যাম্পিয়ন হতে। এখনো অভ্যেসটা দেখছি যায়নি। তোমার যুক্তি মেনে নিলাম। যা ব্যবস্থা করবার করো। আমি শীতলের সঙ্গে কথা বলে নিচ্ছি। সবরকম সাহায্য পাবে তোমরা। তবে একটা শর্ত আছে।  আমার সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রেখে চলবে। কোন কারণে যোগাযোগ বন্ধ হলে আমি প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেব।”

“সম্ভব হবে না স্যার। একবার পহেলগাঁও ছাড়িয়ে মনবস্তি চৌকে পৌঁছোবার পর থেকে মোবাইল কানেকশান-”

“জানি,” তাঁকে হাত নেড়ে থামিয়ে দিলেন ডঃ চৌধুরি, “শীতলকে বলে দিচ্ছি। একটা স্যাটেলাইট ফোন যাবে তোমাদের সঙ্গে। শ্রীনগর পৌঁছে ক্যান্টনমেন্ট বোর্ডের অফিস থেকে পেয়ে যাবে। তুমি টুর প্রোগ্রাম বানাও।”

“ধন্যবাদ স্যার।” উঠে দাঁড়িয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে আসবেন জ্যোতির্ময়, এমন সময় হঠাৎ ডঃ চৌধুরি তাঁর টেবিলের পেছন থেকে বের হয়ে এসে তাঁর মাথায় হাত ছোঁয়ালেন, “আমি তোমার জন্য গর্বিত জ্যোতির্ময়। যেদিন ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট হয়েছিলে রেকর্ড নম্বর পেয়ে সেদিনের চেয়েও আজ আমার আরো বেশি গর্ব হচ্ছে তোমাকে নিয়ে। এমন ছাত্রের মাস্টার হতে পেরেছি আমি সেটা আমার গর্ব।”

*******

খানিক বাদে নিজের অফিসে ফিরে এসে কম্পিউটারটাকে চালু করলেন জ্যোতির্ময়। বিশ্বনাথনের জবাবি মেল এসে গেছে সকালবেলাতেই। ফের একবার সেটার ওপর চোখ বোলাচ্ছিলেন তিনি-

ডিয়ার সেন,

তোমার লম্বা মেল পেলাম একেবারেই অবিশ্বাস্য গল্প বলেছ তুমি নিতান্ত তোমার কাছ থেকে এসেছে নইলে কথাগুলো আর কেউ বললে পাগলের প্রলাপ বলেই উড়িয়ে দিতাম প্রতি চার হাজার বছর অন্তর বুকে জ্যামিতিক ফাটল নিয়ে একটা করে গোলাকার পাথরের উদয়, তার সবচেয়ে নতুনটার বুকে তেজষ্ক্রিয় বিস্ফোরণের চিহ্নজিভার ভবিষ্যৎবাণী, টেলিকাইনেসিস, এসব সায়েন্স ফিকশনের গল্পেই মানায় ভালো

অনেক ভেবেছি নিয়ে বিজ্ঞানের দুনিয়ায় এমন বোকা বানাবার চেষ্টা তো মাঝেমধ্যেই হয়ে থাকে কিন্তু তবু, তোমার কথাগুলোকে পুরোপুরি উড়িয়ে দিতে পারছি না যে, সে কেবল ওই রঞ্জার জন্য তোমার কোলে তার আসার ব্যাপারটা তো আমার নিজের চোখে দেখা! আর, বৈজ্ঞানিক কৌতুহল বাদ দিলেও, তোমার অন্য যুক্তিটাতেও জোর আছে। ছেলেমেয়েদুটোকে একজনের ভরসায় ছেড়ে দেয়াটা অনুচিত হবে। আমি যাব। কবে কোথায় মিট করব জানিও।  

বিশ্বনাথন

কি বোর্ডটা টেনে নিয়ে তিনি তাকে তাড়াতাড়ি একটা জবাব লিখতে বসলেন। হাতে আর সময় নেই বেশি।

পকেটের মোবাইল ফোনটা টিঁ টিঁ করে বেজে উঠল হঠাৎ। রঞ্জার ফোন। সবুজ বোতামটা টিপে ফোনটা কানে তুললেন তিনি।

“হ্যালো বাবা। কী হল মিটিং-এ?”

“ডান। রাতে এসে কথা বলছি। তুই কেনাকাটার লিস্টটা বানিয়ে ফ্যাল। আর রঙ্গনকে-”

“হ্যাঁ। এইবার ওকে জানানো দরকার। সে আমি ম্যানেজ করে নেব। সব ভেঙে বলছি না এক্ষুণি। যতটুকু দরকার ততটুকুই বলব শুধু। তুমি ভেবো না।”

চার

পাহাড়ে

“আপনি কী করতে চলেছেন তা ঠিক জানেন তো ডঃ সেন? এলাকাটা একেবারেই মেনস্ট্রিমের বাইরে। কিছু স্যাটেলাইট ডেটা ছাড়া ও এলাকাটা সম্পর্কে খুব বেশি তথ্য কিছু নেই আমাদের কাছে। এমনকি কোন ট্রেক রুট খোলবার পারমিশানও দেয়া হয় না ওদিকটা। তাছাড়া এরা দুজন যে আসবে সঙ্গে সে কথাও তো–” সুভাষ রাঠোর উদ্বিগ্ন চোখে একবার একবার রঞ্জা আর রঙ্গনের দিকে দেখে নিয়ে জ্যোতির্ময়ের দিকে ফিরলেন। ঝকঝকে চেহারার অফিসারটি সবে কিছুকাল হল শ্রীনগরের এই বাদামিবাগ ক্যান্টনমেন্টের দায়িত্ব নিয়ে এসেছেন।

ক্যান্টনমেন্ট বোর্ড অফিসের এই জানালাটা দিয়ে দূরে একটা হেলিপ্যাড দেখা যায়। বিরাট বিরাট পোকার মত উড়ুক্কু যুদ্ধযানগুলো সেইখানে ঝিম ধরে স্থির হয়ে আছে মেঘফাটা রোদের ভেতর। হেলিপ্যাড ছাড়িয়ে বহুদূরে নীল পাহাড়ের রেখার মাথায় হালকা মেঘের প্রলেপ। সেদিক থেকে চোখ ফিরিয়ে জ্যোতির্ময় বললেন, “আপনি চিন্তা করবেন না। আমি ও এলাকায় আগেও গিয়েছি। বহাল তবিয়তে ফিরেও যে এসেছি তা তো দেখতেই পাচ্ছেন।”

রাঠোর মাথা নাড়লেন, “কারেক্ট স্যার। আপনার ফোল্ডারটা আমি দেখেছি। সায়েন্টিফিক এক্সপিডিশান। এবারেও তো তাই লিখেছেন। কিন্তু আমার চিন্তাটা-” তাঁর চোখের দৃষ্টি ফের একবার রঞ্জা আর রঙ্গনের দিকে ঘুরে এল।

জ্যোতির্ময় মৃদু হাসলেন, “আপনার উদ্বেগটা বুঝতে পারছি মিঃ রাঠোর। কিন্তু, আমার ছেলেমেয়েদের নিয়ে একদম চিন্তা করবেন না। ওদের সঙ্গে আনাটা একেবারেই আমার ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত। রঞ্জা কাশ্মীরের পাহাড়ি এলাকাগুলো চষে বেড়ায় একাএকাই। এখানকার পাহাড়-পর্বত নিয়েই ওর পড়াশোনা কাজকর্ম। ও সঙ্গে থাকলে আমার সুবিধে হবে। আর রঙ্গনকে আমি এমনিই নিয়ে এলাম। শক্তপোক্ত হয়ে বড়ো হয়ে উঠুক ছেলেটা।”

রাঠোরের মুখটা এইবার খুশি-খুশি হয়ে উঠল। রঙ্গনের দিকে হাতটা বাড়িয়ে ধরে বললেন, “বেস্ট অব লাক ইয়ংম্যান ফর ইওর ফার্স্ট এক্সপিডিশান।” তারপর টেবিলে রাখা একটা চৌকো বাক্স জ্যোতির্ময়ের দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন, “আপনাকে আর দেরি করাব না স্যার। এই যে—এই ইস্যু রেজিস্টারে একটা সই করে দিন প্লিজ। ৫০০ মিনিটের টকটাইম রয়েছে স্যাটফোনটাতে। সোলার চার্জার আর অন্যান্য সমস্ত অ্যাসেসরি বাক্সের মধ্যেই পেয়ে যাবেন। আপনার কলটাইম হবে প্রতিদিন সকাল সাড়ে সাতটা। ডঃ চৌধুরির নম্বরে ফোন করলেই আমরা জেনে যাব। রাইট?”

রঞ্জা চুপ করে বসে ছিল একপাশে। এইবারে হঠাৎ মুখ খুলল সে, “একটা প্রশ্ন ছিল। আপনি বলছিলেন ওদিকটায় এখনো কোন ট্রেক রুট খোলবার অনুমতি দেয়া হয়নি। কেন জানতে পারি কি?”

“স্থানীয় লোকজনের আপত্তি ম্যাডাম। নিজেরাও ওই রামবাসা পাস টপকে গ্লেসিয়ারের দিকে ঢোকে না, বাইরের কাউকে  আসতেও দেয় না। ও এলাকায় কোন এক অপদেবতা নিয়ে গালগল্প চালু আছে। ও জায়গায় নাকি তার পাথরের প্রাসাদ। কেউ সেদিকে গেলে অপদেবতা রেগে গিয়ে লোকজনের ক্ষতি করে। ভরা গরমেও ব্লিজার্ড ডেকে আনে।”

রঞ্জা হেসে ফেলল, “কেউ যখন যায় না তখন পাথরের প্রাসাদের গল্পটা চালু হল কী করে?”

“লোকাল কুসংস্কার। কাছাকাছি লোকালয়গুলোর দু একজন মানুষ দাবি করে তাদের ওই অপদেবতা দেখা দিয়েছেন। সঙ্গে করে নিয়েও গেছেন তাঁর প্রাসাদের কাছে। একটা বিরাট বলের মত পাথর। তার মাঝখানে একটা ফাটল।”

রঞ্জা আর রঙ্গনের দিকে একবার ঘুরে দেখলেন জ্যোতির্ময়। তাদের মুখচোখেও কৌতুহলের ছাপ পড়েছে এইবার। রাঠোরের অবশ্য সেদিকে চোখ নেই তখন। নিজের মনেই গল্প বলে চলেছেন–

 “স্থানীয় লোকজন এই প্রত্যক্ষদর্শীরদের খানিক ভয়েভক্তিতে মেনে চলে। ক্ষমতাশালী লোক সব। অঢেল সম্পত্তি। নিজেদের এরা কাদেজ বলে ডাকে। ও এলাকায় অন্য লোকের ঢোকবার ব্যাপারে এই কাদেজরাই আপত্তিগুলো তোলে।”

“বুঝলাম। স্থানীয় কিছু প্রভাবশালী মানুষ সমস্যাটা তৈরি করছে। আর ওই ব্লিজার্ডের গল্প? ওর সত্যিমিথ্যে তো সহজেই জানা যায়। ওয়েদার স্যাটেলাইটের চোখ এড়িয়ে কখনো-”

 রাঠোর গম্ভীরভাবে মাথা নাড়লেন, “রাইট ডঃ সেন। জুলাই আগস্ট নাগাদ সত্যিই ওখানে তিনতিনটে বড়ো ব্লিজার্ড ঘটেছে গত দশ বছরে, আর-”

“অ্যাক্সিডেন্টাল ঘটনা।”

“আমার কথাটা শেষ করতে দিন প্লিজ। ব্রিগডিয়ার পদ্মনাভনের মুখে যতটুকু শুনেছি, ওর মধ্যে শেষ ঘটনাটা গত আগস্ট মাসের। আমাদের মাউন্টেন ডিভিশনের রামবাসা এক্সপিডিশানের সময়। কোন পূর্বাভাস ছিল না, কিন্তু জওয়ানরা রিঙ্গান পেরিয়ে রামবাসা বেয়ে ওঠা শুরু করবার সঙ্গেসঙ্গে একবারে হঠাৎ করেই ঝড়টা ওঠে। দলটার কোন খোঁজ পাওয়া যায়নি।”

“তারপর?”

“কিছুই নয়,” হাত উলটোলেন রাঠোর, “আকাশপথে দুটো অভিযান হয়েছিল তাদের খুঁজে বের করবার জন্য। দুটোই ব্যর্থ হয়। দলটাকে-”

“লেফটেন্যান্ট মুস্তাক আহমেদ বাইরে অপেক্ষা করছেন স্যার—” হঠাৎ ইন্টারকমটা বেজে উঠে তাঁর কথাগুলোকে মাঝপথে থামিয়ে দিল।

“রাঠোর উঠে দাঁড়িয়ে হাতটা বাড়িয়ে ধরলেন জ্যোতির্ময়ের দিকে, “আমার একজন ভিজিটর রয়েছেন বাইরে। পরে ফের কথা হবে আপনাদের সঙ্গে। গুড লাক।”

*******

ক্যান্টনমেন্ট অফিস থেকে বের হতে হতে ফোনে বিশ্বনাথনের মেসেজটা চোখে পড়ল জ্যোতির্ময়ের। ফ্লাইট পৌঁছে গেছে। ওদের হোটেলেই উঠেছেন। বাইরে বেরিয়ে একটা অটোরিকশা ডেকে তাতে উঠে রঞ্জা বলল, “হোটেল নিউল্যান্ড। চোদ্দো নম্বর ঘাট। বুলভার্ড রোড দিয়ে চল।”

মেঘরৌদ্রের আলোছায়া ভরা ভিড় রাস্তা দিয়ে অটো চলেছে। খানিক বাদে রঙ্গন হঠাৎ বলল, “আরেকটা ফোন। টের পেয়েছিস দিদিভাই?”

“জানি,” ঘাড় নাড়ল রঞ্জা, “ঠিক ফোন না, বুঝলি? ওইরকম অন্য কিছু একটা। মুস্তাক নামের লোকটাকে সেটা দেবার কথা রাঠোরসাহেবের। আমাদের সঙ্গে সেটার কিছু একটা যোগ আছে।”

“আমাদের সঙ্গে যোগ আছে–মানে?” জ্যোতির্ময়ের ভ্রূদুটো কুঁচকে উঠেছে তখন।

“জানি না। ভাবনাগুলো নিখুঁতভাবে পড়তে পারি না এখনো। তাতেই যতটুকু বুঝেছি-”

“রাঠোর কতটা জানে?”

“মনে হয় যতটুকু বলেছে তার বেশি এ লোকটা কিছু জানে না বাবা। একদম সিধেসাদা মন। আর্মির হুকুম তামিল করছে শুধু।”

“তাহলে আমাদের সঙ্গে যোগ আছে সেটা বলছিস কী করে?”

“অত ডিটেলে বুঝতে পারিনি। শুধু একটা অনুভূতি। মুস্তাক আহমেদ নামটা, একটা চিঠি আর একটা যন্ত্রের কথা বারবার ভেসে উঠছিল ওঁর মনে। আমাদের সঙ্গে তার যোগ আছে–”

*******

ক্যান্টনমেন্ট বোর্ড অফিসে, ছোটো একটা বাক্স আর গালা দিয়ে শিলমোহর করা চিঠিটা লোকটার হাতে তুলে দিয়ে রাঠোর নিজেও মাথা নাড়ছিলেন তখন, “আপনার গড়ুর কমান্ডো ফোর্সের উইং কমান্ডারের চিঠি। এতে কী নির্দেশ রয়েছে তা আমি বলতে পারব না লেফটেন্যান্ট আহমেদ। তবে এই দলটার সঙ্গে থাকাকালীন বাক্সের  কমিউনিকেটরটা আপনি অফ করতে পারবেন না, এইটুকু শুধু আপনাকে বলতে পারি। বাকি সমস্ত নির্দেশ ওই খামের মধ্যে রয়েছে।”

লম্বা ছিপছিপে মানুষটা খামটা হাতে নিয়ে একটু ইতস্তত করলেন। তারপর মুখটা ছিঁড়ে ছোটো একটা কাগজ বের করলেন তার থেকে। ভাবলেশহীন মুখে কাগজটার দিকে চোখ বুলিয়ে নিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, “আপনার শ্রেডারটা একবার ব্যবহার করতে পারি মিঃ রাঠোর?”

“নিশ্চয়। ওই যে সোফার পাশে রাখা রয়েছে দেখুন—”

চিঠিটা নিঃশব্দে শ্রেডারের মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়ে এসে আহমেদ বাক্সটা খুললেন। ভেতরে একটা চওড়া রিস্টব্যান্ড রাখা ছিল। তার গায়ে একটা লাল রঙের বড়োসড়ো ছোপ রয়েছে। রাঠোর সেইটার দিকে কৌতুহলী চোখে দেখছিলেন। আহমেদ সেটা নজর করে মৃদু হাসলেন, “প্রতিরক্ষা গবেষণাকেন্দ্রের নতুন আবিষ্কার স্যার। আমাদের গড়ুর কমান্ডো ফোর্সকে গোটাকয়েক ইস্যু করা হয়েছে ক’দিন হল। দু’হাজার থেকে পাঁচ হাজার মেগাহার্তজের  দশ হাজারের বেশি বিভিন্ন ফ্রিকোয়েন্সিতে সিগন্যাল পাঠাতে পারে। এই লাল দাগটা একটা প্যানিক বাটন। টিম বিপদে পড়লে বোতামটাকে পাঁচ সেকেন্ড অন্তর বারদুয়েক টিপতে হবে শুধু। ওর সিগন্যালকে আটকাবার মতন বড়ো জ্যামার বানানো সম্ভব নয়। শুধু বুঝতে পারছি না, কী এমন বিপদ আসতে পারে এ যাত্রায় যার জন্য–”

টেবিলে রাখা টাইমপিসটা টিঁ টিঁ করে বেজে উঠল হঠাৎ। রাঠোর উঠে দাঁড়িয়ে হাতটা বাড়িয়ে দিলেন মুস্তাকের দিকে, “আমার আর একটা মিটিং আছে এগারোটা থেকে। অতএব–বেস্ট অব লাক লেফটেন্যান্ট মুস্তাক।”

“ধন্যবাদ মিস্টার রাঠোর। শুভকামনাটা কাজে আসবে বলেই মনে হচ্ছে,” কথাটা বলে একগাল হেসে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন মুস্তাক আহমেদ। নীচে অপেক্ষায় থাকা জিপসির কাছে এগিয়ে যেতে ড্রাইভার বেরিয়ে আসছিল। তার থেকে গাড়ির চাবিটা নিয়ে চালকের আসনে উঠে বসতে বসতে মুস্তাক বললেন, “আগামীকাল মানবস্তি থেকে গাড়িটা ফিরিয়ে আনবেন পাণ্ডেজি। চাবি মানবস্তি চৌকের শর্মা ভাণ্ডারে রাখা থাকবে–”

একটা গর্জন তুলে ধুলো উড়িয়ে গাড়িটা ছুট লাগাল বোর্ড অফিসের চত্বর ছেড়ে।

*******

 “ইস! বিচ্ছিরি জায়গা। কী নোংরা আর ধুলো! একটা কোল্ড ড্রিংক খেলে হত।” রঙ্গন গাড়ি থেকে নামতে নামতে বিড়বিড় করছিল। ড্রাইভারকাকা, বাবা আর বিশ্বনাথনকাকা মিলে গাড়ির ছাদ থেকে তাদের স্যাকগুলো নামাচ্ছেন।

রঞ্জা আগেই নেমে পড়ে এদিকওদিক ঘুরে দেখছে। এলোমেলো ছড়ানো কিছু বিবর্ণ বাড়ি নিয়ে এই মানবস্তি। গাড়ি চলার পথ এইখানে এসে শেষ। এরপর হাঁটা। ধুলো ওড়া এবরোখেবরো রাস্তাটার শেষপ্রান্তে একটামাত্র দোকান। সেদিকে দেখিয়ে রঞ্জা বলল, “চল রঙ্গন ওদিকটা গিয়ে দেখি তোর কোল্ড ড্রিংক মেলে কি না!”

দোকানটার মাথার ওপরে আঁকাবাঁকা তুলির টানে লেখা একটা সাইনবোর্ড—“শর্মা ভাণ্ডার।” কোল্ড ড্রিংক পাওয়া গেল না কিন্তু প্লাস্টিকের পাউচে ভরা একটা মিষ্টি শরবতমত কিছু বিক্রি করছে। খেতে মন্দ নয়। তাই কিনে দুভাইবোন চুমুক দিচ্ছে তখন লম্বামতন একজন স্থানীয় মানুষ দোকানের ভেতর থেকে বের হয়ে এসে ওদের সামনে দাঁড়ালেন।

“ট্রেকার?”

রঞ্জা ঘাড় নাড়ল।

“ঘোড়া লাগবে?”

খালি পাউচটা পাশে রাখা একটা ভাঙা বালতির মধ্যে ফেলে দিয়ে রঞ্জা বলল, “লাগবে। গাড়ির কাছে গিয়ে বাবার সঙ্গে কথা বলুন।”

“লোকটা কিন্তু এদিককার নয় দিদিভাই, বুঝলি?” পেছন পেছন আসতে আসতে রঙ্গন নীচু গলায় বলল।

“রঙ্গন, ভালো করছিস না কিন্তু,” চোখ পাকিয়ে ধমক দিল রঞ্জা, “প্রয়োজন না থাকলেও যখন তখন যার তার মনের ভেতর উঁকি দেয়া ঠিক নয়। পারিস বলেই করে ফেলতে হবে এ কেমন কথা?”

“হি হি। বেশি না। জাস্ট একটু উঁকি দিয়েছি।”

“হাসবে না রঙ্গন। তোমাকে কয়েকটা জিনিস আমি বারণ করে দিচ্ছি। কথা না শুনলে মার খাবে এই বলে দিলাম।”

দিদির এই গলাটাকে রঙ্গন বেশ সমঝে চলে। একউ থমকে গিয়ে বলল, “কী রকম?”

এক নম্বর, কক্ষণো, ফের বলছি কক্ষণো, গুরুজনের মনের ভেতরে ঢুকবে না। বাবা, বিশ্বনাথনকাকা, আমি-”

“তুই গুরুজন? হি হি-”

“হাসবি না। এটা একেবারে স্ট্রিক্ট বারণ। নাম্বার টু, সবার সামনে কোনো অবস্থাতেই এমন কিছু করবি না যাতে কেউ বুঝতে পারে আমরা আলাদা।”

রঙ্গন চোখ কুঁচকে কিছু একটা ভাবল। তারপর মুচকি হেসে বলে আমি আরো একটা ওইরকম আলাদা জিনিস শিখে গেছি। তুই জানিস না।”

“কী রে?” রঞ্জা কৌতুহলী চোখে তার দিকে ফিরে চাইল।

“বলব না। বারণ করেছিস।”

“উফফ। চুপিচুপি দেখা না!”

দিদিকে বিষয়টা দেখাবার জন্য রঙ্গন এমনিতেই ছটফট করছিল। তাকে দ্বিতীয়বার বলবার দরকার হল না। রঞ্জার সামনে মুখ করে দাঁড়িয়ে সে বলল, “এই দ্যাখ। হাতদুটো দুপাশে ছড়া—এই যে এইভাবে—ছড়া ছড়া-”

হাতদুটো দুপাশে ছড়িয়ে দাঁড়িয়েছে রঙ্গন। রঞ্জাও দেখাদেখি হাতদুটো দুপাশে ছড়িয়ে দিল। “এইবার ভাব—তুই একদম হালকা হয়ে গেছিস—ভাব—ভাব— হুঁ। এইবার পায়ের দিকে তাকা—দ্যাখ কী মজা–”

হঠাৎ বুকের ভেতরটা থরথর করে কেঁপে উঠল রঞ্জার। নীচের দিকে না তাকিয়েও পরিষ্কার বুঝতে পারছিল সে, তার পা দুটো মাটি ছেড়ে খুব সামান্য ওপরে ভেসে উঠেছে। দূর থেকে বোঝা যাবে না, কিন্তু এই মুহূর্তে মাটিকে না ছুঁয়েই স্বচ্ছন্দে হাওয়ায় ভর করে দাঁড়িয়ে রয়েছে তার শরীরটা!

তাড়াতাড়ি হাতদুটোকে নামিয়ে আনল সে। পায়ের তলায় ফের তার পরিচিত মাটির স্পর্শ। দূর থেকে বাবা হাতছানি দিয়ে ডাকছিলেন তাদের। তাড়াতাড়ি সেইদিকে এগিয়ে গেল রঞ্জা আর রঙ্গন।

*******

এইখানে পাহাড়ের গায়ে কোন পথের দাগ নেই। মেঘের ভেতর থেকে খাড়াই নেমে আসা পাহাড়ের শরীরে যতদূর চোখ যায় ছোটোবড়ো পাথরের টুকরো আলগাভাবে জমে উঠে তৈরি করেছে সাক্ষাৎ মৃত্যুফাঁদ, বোল্ডার জোন। স্থানীয় মানুষের ভাষায় এর নাম দুশমনী ঢালান। খাড়াই ঢাল বেয়ে তা নেমে গেছে বহু নীচ দিয়ে বয়ে চলা সিদ্দা নদীর দিকে। ওইদিকে সিলাবাদ। সহজ রাস্তায় নাগবস্তি থেকে পিঠুডহর হয়ে সেদিকে যেতে প্রায় চারদিনের পথ পড়ে। সেলিম তাই এই রাস্তাটা ধরেছে। কঠিন, তবে সময় কমে যাবে তিনদিন।

এখানে, বোল্ডারের স্তূপের ফাঁকে ফাঁকে বরফগলা জলের অজস্র ধারা বয়ে চলেছে। বহু নীচে গিয়ে তারা এক হয়ে গিয়ে তৈরি করেছে সিদ্দা নদীর তেজি ধারা। মেঘের আড়াল থেকে তা চোখে পড়ে না। শুধু মৃদু ঝরঝর শব্দ কানে ভেসে আসে। জলে ভিজে ওঠা পিছল বোল্ডারে ছাওয়া এই ঢাল দেখলে অতিবড়ো সাহসীরও বুক কেঁপে ওঠে।

পাথুরে এলাকাটার একেবারে মাথায় এসে একলা মানুষটা তার ঘোড়া থামাল। গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি ঝরছে। ঘোড়াটা ভয় পেয়েছে। নাগবস্তি থেকে রওনা হবার পর এতক্ষণ বরফজমাট উৎরাই বেয়ে মেঘের রাজ্য থেকে নেমে আসবার সময় এতটুকু বিচলিত হয়নি সে। কিন্তু এইবার সে তার আরোহীকে পিঠে নিয়ে আর এগোতে নারাজ।

ঘোড়া থেকে নেমে দাঁড়াল মানুষটা। সামনে খাড়া নেমে যাওয়া বোল্ডার এলাকাটার মধ্যে তার অভিজ্ঞ চোখ ঠিকই খুঁজে নিয়েছে অদৃশ্য কোন রাস্তার চিহ্ন। ঘোড়ার কাছে ঘেঁষে এসে পিঠে কয়েকটা আদুরে চাপড় দিল সে। কানে কানে কিছু বলল। তারপর সাবধানে লাগাম ধরে এগিয়ে চলল সেই পাথুরে এলাকার মধ্যে দিয়ে।

প্রায় শ’খানেক মিটার এইভাবে নেমে আসবার পর ছেঁড়া ছেঁড়া মেঘের ফাঁক দিয়ে বহু নীচের উপত্যকাটার ঝলক দেখা গেল একবার। ঘোড়াটা সেদিকে দেখে খুশি হয়ে উঠেছে। চটপট এই ভয়ানক পাহাড়ের আওতা ছেড়ে সে ফিরে যেতে চায় তার পরিচিত অঞ্চলে।

কিন্তু তার মালিকের তখন সে ইচ্ছে আর একেবারেই নেই। পেছনে ফেলে আসা পথটার দিকে তখন চোখ ঘুরে গেছে তার। সেখানে বাতাসের মধ্যে ধীরে ধীরে স্পষ্ট হয়ে উঠছিল একজন মানুষের মূর্তি। তীব্র পাহাড়ি হাওয়ায় পাকা চুলদাড়ির রাশ এলোমেলো উড়ছিল তাঁর। ঘোড়াটা এইবার তাঁর উপস্থিতি টের পেয়েছে। তীব্র আতংকে চোখগুলো বড়োবড়ো হয়ে গেছে তার। লাগামের দড়িটায় টান মারছে হাত ছাড়িয়ে পালাবার জন্য। সেদিকে তখন নজর দেবার সময় নেই ঘোড়ার মালিকের। লাগামটাকে একটা বড়োসড়ো বোল্ডারে পাক দিয়ে রেখে সে ততক্ষণে পেছনদিকে ঘুরে নতজানু হয়েছে সামনে এসে দাঁড়ানো মানুষটার দিকে।

“উঠে দাঁড়াও কাদেজ সেলিম। কোথায় চলেছ তুমি?”

“সিলাবাদে। সপ্তাহের কেনাকাটা সারতে। আদেশ করুন মহান জিভা।”

“ভালো। সিলাবাদে তোমার জন্য কাজ আছে। সেখান থেকে নাগবস্তির দিকে বাইরের দুনিয়ার মুসাফিররা আসছে।”

“এই পথে? বাইরের মানুষ? অসম্ভব। এ পথ বাইরের পৃথিবীর কাছে এখনো অজানা মহান জিভা।”

“না। এই পথে নয়। তোমাদের মতন পাহাড়িরা ছাড়া এই পথ বাইরের লোক চেনে না। তারা আসছে সিলাবাদ হয়ে পিঠুডহরের পথে। নাগবস্তি পেরিয়ে আমার প্রাসাদের কাছে আসতে চায়।”

সেলিমের চোখদুটি ঝিকিয়ে উঠল, “আপনার বাসস্থান নিরাপদ থাকবে। আমাকে ভরসা করতে পারেন। নাগবস্তির পরে এক পা এগোতে দেব না আমি তাদের।”

“না। এই মুসাফিরদের আমার প্রয়োজন। তুমি নিজে গিয়ে তাদের আমার কাছে নিয়ে আসবে।”

কিছুক্ষণ চুপ করে রইল সেলিম। রহস্যময় মানুষটাকে সরাসরি দেখেছে তার মতন আরো আটজন কাদেজ। তাঁর শক্তির কিছু কিছু নমুনা নিজের চোখেই দেখেছে তারা। তাদের তিনি অনেক দিয়েছেন। তাঁর শক্তিতেই কল্যানেই রামবাসাকে ঘিরে বিশ কিলোমিটার পর্যন্ত পাহাড়ি এলাকায় নিজের নিজের অঞ্চলে সমাজের মাথা হয়ে উঠেছে প্রত্যেকে। শুধু শর্ত একটাই-বাইরের মানুষ যেন  তাঁর এলাকায় পা না রাখতে পারে তা নিশ্চিত করতে হবে। অন্য অন্য কাদেজদের মতই সে-ও সে কাজ নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করে চলেছে গত বেশ কয়েক বছর ধরে।  

এ সময়টার মধ্যে মাত্র তিনবার তিনজন কাদেজ ব্যর্থ হয়েছিল তাঁর আদেশ পালনে। তখন জিভার আদেশে অসময়ে ভয়াল বরফঝড় ধেয়ে এসে আটকে দিয়েছিল রামবাসার দিকে এগিয়ে আসা অভিযাত্রীদের।  ব্যর্থ হওয়া কাদেজরা ক্ষমা পায়নি। পাথরের প্রাসাদ থেকে বের হয়ে আসা নরকের ঘন অন্ধকার আলোকবিন্দু, সবার চোখের সামনে শুষে খেয়েছে তাদের। তাদের বদলে নতুন কাদেজ নিয়োগ করেছেন জিভা।

আজ হঠাৎ করে তাঁর মুখে একেবারে বিপরীত কথা শুনে একটু চমকেই গেছে সে। তবু, জিভাকে প্রশ্ন করা বারণ। মাথা নেড়ে সে বলল, “আমি এখুনি রওনা দিচ্ছি।”

“অপেক্ষা করো সেলিম। যাদের মুখোমুখি হতে চলেছ তুমি তারা সাধারণ মানুষ নয়। তোমার স্মৃতি তাদের কাছে গোপন থাকবে না। আমি চাই না নির্দিষ্ট সময়ের আগে তারা আমার কথা জানতে পারুক। আমি নিজে তোমার সঙ্গে যাব।”

“আপনি! কিন্তু কীভাবে মহান জিভা? আপনি সশরীরে প্রস্তরপ্রাসাদ থেকে এত দূরে-কীভাবে-”

“তার জন্য তোমার শরীরটি আমার প্রয়োজন হবে কাদেজ—” বলতেবলতেই তার কাছে এসে কপালের দুপাশে হাত ছোঁয়ালেন জিভা। হালকা আগুনের শিখার মতন সে ছোঁয়ায় রক্তমাংসের সাড়া ছিল না।

একটা ঝাঁকুনি দিয়ে স্থির হয়ে গেল সেলিমের শরীরটা। তারপর, নিশ্চল পুতুলের মত পাথরের বুকে লুটিয়ে পড়ল তা।

কয়েকমুহূর্ত পর ফের যখন চোখ খুলল সে, তখন আমূল বদলে গেছে সে চোখের ভাষা। চারপাশে একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে নিজের অবস্থান ঠিক করে নিল মানুষটা। তার দৃষ্টিতে ধরা পড়া সেই পাহাড়ের দৃশ্য সরাসরি সম্প্রচারিত হচ্ছিল রামবাসা হিমবাহের দুর্গম বুকে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটার সামনে। এই কাদেজের মস্তিষ্ক এখন সম্পূর্ণ তাঁর নিয়ন্ত্রণে। প্রথমে সিলাবাদে গিয়ে দেখতে হবে। সেখানে না পেলে পিঠুডহরের দিকে এগিয়ে গিয়ে-

সেলিমের স্মৃতি থেকে সামনের রাস্তার খুঁটিনাটিগুলো উদ্ধার করে নিয়ে শরীরটাকে তার ঘোড়াটার দিকে এগিয়ে দিলেন জিভা—

–ঘুরে দাঁড়িয়ে ঘোড়ার লাগামটা পাথরের গা থেকে খুলে আনল সেলিম। তারপর ডানদিকে বেঁকে পাহাড়ের বিপজ্জনক গা বেয়ে বোল্ডারে পা ফেলে ফেলে রওনা হয়ে গেল সিলাবাদের দিকে।

*******

বড়ো বড়ো প্রাচীন পাইনের দল ছায়া ফেলেছে এখানে। পায়ের তলায় পাইন নিডলের পুরু গদিতে হাঁটবার শব্দ শোনা যায় না। সকালবেলা তাঁবু গুটিয়ে রওনা হবার পর প্রায় ঘন্টাতিনেক হেঁটে তারা যেখানটায় এসে পৌঁছেছে, দূর থেকে সেইখানে কোন পথ দেখা যায় না।

“যাব কোথা দিয়ে বাবা?”

জ্যোতির্ময় সামনে হঠাৎ করেই হাজির হওয়া বিরাট খাদটার দিকে তাকিয়েছিলেন। হাতের ডাইনে যতদূর চোখ যায় খাড়া পাহাড়ের দেয়ালের গায়ে গায়ে পাইনের জঙ্গল একটানা নেমে গেছে নীচের দিকে। দেয়ালটা একটা অর্ধবৃত্তাকার পাক মেরে মিশে গেছে উল্টোদিকের পাহাড়ের গায়ে। সেখানে অনেক উঁচুতে সিদ্দা নদীর ধারাটাকে দেখা যায়। ধবধবে সাদা একটা আঁকাবাঁকা দাগের মতন পাহাড় থেকে নেমে এসে সে নীচের খাদ দিয়ে বয়ে চলেছে সমতলের দিকে। মানবস্তির কাছে গিয়ে সমতলে মেশা এই নদীটাকে চোখে চোখে রেখে এই ক’দিন এগিয়ে চলেছেন তাঁরা। রিঙ্গান হ্রদের গায়ে ওর উৎসমুখ।

“ঘাবড়াস না। রাস্তা আছে। আয়,” বলতেবলতে এদিকওদিক তাকিয়ে একটা মরা গাছের গুঁড়ি ধরে দেয়াল থেকে নীচের দিকে পা বাড়ালেন তিনি। নজর করলে দেখা যায় সরু একটা খাঁজ পাইনবনের গা ঘেঁষে পাহাড়ের দেয়ালের গায়ে গায়ে এগিয়ে গিয়ে উঠে গেছে দূরে সিদ্দার নেমে আসা ধারার দিকে।

মুস্তাক সবার পেছনে ঘোড়াদুটো নিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন। রাস্তাটার দিকে ভালো করে একবার দেখে নিলেন তিনি প্রথমে। তারপর বললেন, “আপনি উঠে আসুন স্যার। আমি আগে ঘোড়াদুটোকে পার করে নিই। পেছনে থাকলে হঠাৎ যদি ক্ষেপে ওঠে তাহলে মুশকিল হয়ে যেতে পারে। আর, আপনারা চাইলে ঘোড়ার পিঠে বসেও পাড় হয়ে যেতে পারেন জায়গাটা। ওরা ঠিক সামলে নিয়ে যাবে।”

“উঁহু। দরকার হবে না,” মাথা নাড়লেন জ্যোতির্ময়, “তুমি ঘোড়া সামলে এগোও। আমরা পেছনে আসছি। রঙ্গন, ঘোড়া এগিয়ে গেলে তুই আমার ঠিক পেছনে থাকবি। আমার স্টেপগুলো খেয়াল করে করে সেইমত আসবি। আর রঞ্জা তুই বিশ্বনাথনকাকাকে সামনে রেখে সাবধানে নিয়ে আয়। শ’খানেক মিটারমতো লম্বা হবে এ জায়গাটা, যদি না আমার স্মৃতি কিছু ভুল করে থাকে। তারপর ওপাশের পাহাড়ে পৌঁছোলে নদী অবধি রাস্তা বেশ ভালো। সন্ধের মধ্যে পিঠুডহরে পৌঁছে ক্যাম্প করতে পারব।”

ঘোড়াদুটো আগে আগে চলেছে। মুস্তাক যে পাহাড়ের কোনখানে কী ভাবে পা দিয়ে চলেছেন তার ঘোড়াদের নিয়ে সে কেবল তিনিই জানেন। তাঁকে দেখলে মনে হবে যেন সমতলের বুকে চওড়া কোন রাস্তায় বিকেলের ভ্রমণে বেরিয়েছেন। কখনো পাশ দিয়ে উজিয়ে ওঠা পাহাড়ের গায়ে পা রেখে, কখনও রাস্তা ছেড়ে নিচের ঢালু খাদের দেয়ালে পা দিয়ে ঘোড়া তাড়িয়ে নিয়ে চলেছেন গুণগুণিয়ে গান গাইতে গাইতে।

রওনা হবার পরপরই দুর্ঘটনাটা ঘটল। এ জায়গায় পায়ে চলার খাঁজটা পাহাড়ের ঢালের সঙ্গে মিশে কাত হয়ে রয়েছে একেবারে। নুড়ি পাথরের ছোটো ছোটো টুকরো ছড়ানো তার ওপরে। হাতের লাঠির ধারালো মাথা দিয়ে পাহাড়ের দেয়ালে ঠেস দিয়ে দিয়ে একটু একটু করে এগোচ্ছিলেন জ্যোতির্ময়। হঠাৎ পায়ের তলায় নুড়িগুলো সড়সড় করে খসে পড়ল খাদের ভেতর। ভারসাম্য হারিয়ে হাতের লাঠিটা ফেলে দিয়ে একটা মরা গাছের সরু ডাল জাপটে ধরেছিলেন তিনি, কিন্তু শেষরক্ষা হল না। মৃদু মট করে একটা শব্দ হয়ে ডালটা ভেঙে এল তাঁর হাতে। যেন প্রতিবর্তক্রিয়াতেই রঙ্গন একটা লাফ দিয়ে পাশের পাহাড়ের দেয়ালের ফুটচারেক উঁচুতে পাদুটো তুলে দিয়ে একটা শক্তপোক্ত ডাল জাপটে ধরল। খোলা দুটো হাত দিয়ে বাবার শরীরটা জড়িয়ে ধরবার ইচ্ছে ছিল তার, কিন্তু ততক্ষণে থতমত খেয়ে তার ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়েছেন বিশ্বনাথন। ভারসাম্য হারিয়েছেন তিনিও।

রঞ্জা হঠাৎ হাতদুটো ছড়িয়ে দিল দুপাশে। হালকা হয়ে আসছে তার শরীর। দু’দুটো মানুষকে এভাবে মরতে দেয়া যায় না—

-কিন্তু সে কিছু করবার আগেই চোখের সামনে তার একটা অবিশ্বাস্য ঘটনা ঘটতে শুরু করেছে। হঠাৎ ঘোড়া ছেড়ে ঘুরে দাঁড়িয়েছেন মুস্তাক। হাতে উঠে এসেছে লিকলিকে একটা দড়ি। তার একপ্রান্তে বাঁধা একটা ফাঁস জ্যোতির্ময়ের দিকে ছুঁড়ে মেরেছেন তিনি, আর একইসঙ্গে অন্যপ্রান্তটাকে পাক দিয়ে ধরেছেন একটা শক্তপোক্ত পাইনগাছের গায়ে। নিখুঁত লক্ষে ফাঁসটা যখন জ্যোতির্ময়ের কোমরে আঁট হয়ে বসেছে, ততক্ষণে পাশের জঙ্গল থেকে রাস্তার ওপর ঝুঁকে পড়ে বিশ্বনাথনের কোমর জড়িয়ে ধরেছে একটা অচেনা মানুষ।

মুহূর্তের ভগ্নাংশের মধ্যে ঘটে গেল ঘটনাদুটো। রঞ্জা নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিল না। সাবধানে দড়ি ধরে জ্যোতির্ময়কে শক্ত পাথরের ওপর তুলে আনছিলেন মুস্তাক। ততক্ষণে অচেনা মানুষটা বিশ্বনাথনকে সোজা করে দাঁড় করিয়ে দিয়ে রাস্তার ওপর নেমে এসেছে।

“আপনি—”

স্থানীয় মানুষটা অপরিষ্কার দাঁত বের করে হাসল। চোখের কোণে চামড়া কুঁচকে উঠেছে তার। ভারী বন্ধুত্বপূর্ণ মুখটা। রঞ্জার দিকে বড়ো বড়ো নীল চোখদুটো মেলে তাকিয়ে সে বলল, “আমার নাম সেলিম। সেলিম হামাদান। কাছাকছি একটা সহজ রাস্তা আছে তো। সেটা ছেড়ে এই রাস্তায় এলেন কেন? আমার সাথে আসুন আপনারা।”

“আপনি-এখানে ঠিক সময়ে এলেন কী করে?”

সেলিম ফের হাসল। পাহাড়ি মানুষের সরল, সাদাসিধে হাসি, “এই পাহাড়ই আমার মা-বাপ বহেনজি। আমাদের অত রাস্তাঘাট লাগে না। গ্রাম ছেড়ে কাজের খোঁজে বেরিয়েছি। গিয়েছিলাম  সিলাবাদের দিকে। যদি কোন টুরিস্ট ট্রেকারের দল পাই তো গাইডের কাজ করবার ইচ্ছে ছিল।”

“পেলে না?”

“দরে পোষাল না মালিক। বড়ো কম টাকা দিচ্ছিল ওরা। ফেরার পথে পাহাড়ের ওপর থেকে সোজা নেমে আসছিলাম রাস্তা কম করবার জন্য, তখন আপনাদের দেখলাম এই রাস্তায় ঢুকছেন এসে। এ তো মরার ফাঁদ। শখ করে কেউ এখানে আসে?”

বলতেবলতেই মুস্তাকের দিকে তাকিয়ে রাগী গলায় সে বলে উঠল, “কেমন ঘোড়াওয়ালা হে তুমি? পথঘাট চেনো না কিছু, ওদিকে লোক নিয়ে বেরিয়ে পড়েছ। আজ পাহাড়ে দুটো মানুষ মরলে তার জবাবদিহি কী করতে তুমি?”

uponyasbarebare4 (Medium)

মুস্তাক নিঃশব্দে গালাগালটা হজম করে গেলেন। তারপর মাথা তুলে বললেন, “ভালো রাস্তাটা কোনদিকে?”

“এসো আমার সঙ্গে।”

*******

এ পথটা অপেক্ষাকৃত চওড়া। তবে জানা না থাকলে তার খোঁজ পাওয়ার সাধ্য নেই কারো। পিছু হটে ফের পাইনবনে ফেরৎ গিয়ে খানিক দূর এগোতে পাহাড়ের গায়ে একটা ফাটল। সটান নেমে গেছে সেটা নীচের জংলা ঝোপঝাড়ের মধ্যে। সেখানটায় গিয়ে সেলিম শেকড়বাকড় ধরে ঝুল খেয়ে তলায় নেমে গেল। তারপর খানিক নীচে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে বলল, “আসুন।”

নেমে এসে ওরা দেখে ঝোপঝাড়ের মধ্যে দিয়ে দিব্যি একটা ট্রেল এঁকেবেঁকে ওপরদিকে উঠে গেছে পাহাড়টাকে পাক দিয়ে। ওপর থেকে তার অস্তিত্ব বোঝা  যায় না।

চলতে চলতেই অনর্গল কথা বলে চলেছে লোকটা, “শীতের দিনে গ্রাম ছেড়ে ভেড়ার পাল নিয়ে এই পথ ধরে নীচে নামি আমরা। আর গরম এলে ফের—”

“তোমার গ্রাম কোথায় সেলিম?” তার কথাটা শেষ করতে না দিয়ে রঞ্জা হঠাৎ প্রশ্ন করল।

“নাগবস্তি।”

“কী করো?”

গোটাকয় ভেড়া আছে। তাছাড়া মাঝেমধ্যে গাইডের কাজও করি এ চত্বরে।”

“ভালো টুরিস্টের দল পাও?”

সরল মুখে হাসল সেলিম, “পাই বইকি। নইলে সংসার চালানো মুশকিল হত।”

লোকটা মিথ্যে বলছে। সিলাবাদে একটা গোটা দিন বিশ্রাম করেছে রঞ্জারা। ছোট্টো বস্তি। বড়োজোর ত্রিশচল্লিশঘর লোক। সেখানে কোন টুরিস্টের দল ছিল না। তবে আসছিল এ সিলাবাদের দিক থেকেই। তাহলে কি সেখান থেকে তাদের পিছু নিয়েছে? কেন? কে লোকটা?

ভাবতে-ভাবতে লোকটার চোখের দিকে তীক্ষ্ণ চোখে একঝলক তাকিয়েই দৃষ্টি ঘুরিয়ে নিল সে। একটা দেয়ালের গায়ে ধাক্কা খেয়েছে যেন তার মনটা। মাথায় তীব্র যন্ত্রণার একটা ঝলক ছড়িয়ে গেল এক মুহূর্তের জন্য। লোকটার মনের ওপরে একটা কঠিন আবরণ ছেয়ে রয়েছে। তার সাধ্য ছিল না সে দেয়ালকে ভেঙে ভেতরটা দেখে। লোকটা নির্বিকার। মাথা নীচু করে আগে আগে চলেছে।

একটু পিছিয়ে পড়ে রঞ্জা মনে মনে ডাক দিল—“রঙ্গন।”

“বল,” রঙ্গনের জবাবি সাড়া এল রঞ্জার মনের ভেতর।

“সেলিমের মনটা একবার দ্যাখ তো—”

“কেন? তখন তো মুস্তাককে নিয়ে খুব বকা দিলি। এবারে-”

“আঃ। যা বলছি তাই কর।”

নিঃশব্দ হয়ে গেল রঙ্গনের মন। একটু পরেই ফের রঞ্জার মনের ভেতর তার চিন্তাটা ভেসে উঠল, “এটা কী? আমার মাথায় যন্ত্রণা হচ্ছে—ও দিদিভাই—”

“ছেড়ে দে, ছেড়ে দে শিগগির—”

বলতেবলতেই হঠাৎ থেমে গেল রঞ্জা। সেলিম ঘুরে তাকিয়েছে তার দিকে। চোখের দৃষ্টি আমূল বদলে গেছে তার। কুটিল, হিংস্র এই দৃষ্টি তার বহুকালের পরিচিত। কোথায় দেখেছে সে একে? কোথায়–

মাথার ভেতরে দ্বিতীয় কারো উপস্থিতি টের পাচ্ছিল সে। জোর করে ঢুকে আসছে তার মনের মধ্যে। হঠাৎ আক্রমণে ভেঙে পড়ছিল তার মনের প্রতিরোধ। অজস্র স্মৃতির দল বুদবুদের মতন ভেসে উঠছে সেখানে। এ জন্মের স্মৃতি নয় তারা—যেন বহুকাল আগে—মঞ্জাদাহোর শহরের বুকে- সে আর ভাই-জিবারা পাহাড়ের ওপাড়ে বিরাট সেই পাথরের গোলকটা—আর—আর—জিভা-হ্যাঁ-

–আস্তে আস্তে তার সব প্রতিরোধ ভেঙে গুঁড়িয়ে যাছিল। আগন্তুক মনটা নীরবে আক্রমণ করে চলেছে–

হঠাৎ কে যেন কথা বলে উঠল তার মাথার মধ্যে। রঙ্গনের গলা, “দিদিভাই অ্যাটাক—আমি সঙ্গে আছি—একসাথে–ওয়ান—টু-থ্রি-নাউ—”

দুটো শক্তিশালী মন একসঙ্গে আঘাত করল আগন্তুক মনটাকে। প্রায় সঙ্গেসঙ্গেই মনের ওপর থেকে তীব্র চাপটা সরে গেল রঞ্জার।

নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ ফিরে পেয়ে দ্বিগুণ উৎসাহে আক্রমণে ফিরে এল রঞ্জা। রঙ্গন সঙ্গে আছে যখন তখন দুনিয়ায় কোনো কিছুকেই আর সে ভয় পায় না। একটা প্রবল ধাক্কায় আগন্তুক মনটার শেষ চিহ্নটাকেও মুছে ফেলে সামনের দিকে তাকিয়ে দেখল সে। সেলিম বড়ো বড়ো পদক্ষেপে সরে যাচ্ছে তার কাছ থেকে।

রঙ্গন তার পাশে পাশে হাঁটছিল পিছিয়ে এসে। হঠাৎ নিচু গলায় বলল,  “লোকটাকে ছাড়ব না। ফাঁক পেলেই একসাথে ধরব আবার। কতক্ষণ আটকাবে আমাদের!”

“লোকটা কে হতে পারে কোন আন্দাজ করতে পারিস?”

“উঁহু। মনটাকে অ্যাটাক করবার মুহূর্তে কয়েকটা ছবি টের পেয়েছিলাম শুধু। সেই ফাটলওয়ালা পাথরটার ছবি—আর-আর একটা পুরোনো শহরের ছবি—বুঝলি দিদি—আমি তার ওপর দিয়ে ভেসে যাচ্ছিলাম—লোকটা সেখানে ছিল—মানে এ লোকটা, তবে ঠিক এ নয়—বেশ কনফিউজিং—”

রঞ্জা চুপ করে কিছু ভাবছিল। খানিক বাদে বলল, “একবার যখন মনে পড়তে শুরু হয়েছে তখন নিজেই তুই সব বুঝতে পারবি রঙ্গন। উপস্থিত শুধু এইটুকু জেনে রাখ এর সঙ্গে জিভা নামে একটা লোকের সম্পর্ক আছে। সে আমাদের বন্ধু নয়।”

“তুই কিন্তু আমায় সবটা খুলে বলিসনি দিদিভাই। একটু একটু বলেছিস।”

রঞ্জা চুপ করে রইল। প্রথম যে রাত্রে জ্যোতির্ময় তাকে সব খুলে বললেন, সেদিন ঘরে ফিরে লুকিয়ে অনেক কেঁদেছিল সে। বুকের ভেতরটা ভীষণ মুচড়ে মুচড়ে উঠেছিল তার। প্রাণের চেয়েও বেশি ভালোবাসে তারা তাদের মা-বাবাকে। অতটুকু ছেলেটাকে সেসব কথা খুলে বললে সে যে কত দুঃখ পাবে কে জানে। তার চেয়ে থাক। নিজেনিজেই সব বুঝতে পারবে কিছুদিনের মধ্যেই।”

“কীরে? বল? নইলে কিন্তু আমি নিজেই-”

“কী করবি? আমার পারমিশান ছাড়া আমার মনের মধ্যে ঢুকবি? মার খাবি কিন্তু রঙ্গন তুই আমার হাতে এবারে।”

“আমি কি তাই বলেছি নাকি?”

রঞ্জা চোখ পাকাল একবার, “তাহলে ওসব প্রশ্ন বেশি কোরো না। ছোটো আছিস, ছোটোর মত থাকবি। এখন যা, বাবার কাছে যা। সঙ্গে সঙ্গে থাকবি বাবার।”

“ইশ! ভারী তো বড়ো! সবসময় এক কথা—ছোটো—ছোটো–”

গজগজ করতে করতে এগিয়ে গিয়ে বাবার পাশে পাশে হাঁটতে লাগল রঙ্গন। দিদি চোখ পাকালে সেখানে বেশিক্ষণ থাকা যে সুবিধের নয় সে কথা তার মতন করে কেউ জানে না।

আগে আগে সেলিম আর মুস্তাক পাশাপাশি হাঁটছিল। পেছন থেকে মুস্তাকের ওপরে মনকে সংহত করল রঞ্জা—

-সরল সাদাসিধে মন। কোন জটিলতা নেই সেখানে—কিন্তু—না। এ কোন সাধারণ পাহাড়ি মানুষ নয়— সুশিক্ষিত উঁচুস্তরের মন–রঙ্গন ভুল বলেনি-কিন্তু-এ তাদের সঙ্গে এ ভাবে–

“কী হল ম্যাডামজি? হঠাৎ করে রাস্তার মধ্যে দাঁড়িয়ে পড়লেন যে!”

মুস্তাক কখন যেন একটু পিছিয়ে পড়ে তার পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন। হঠাৎ তাঁর দিকে তাকিয়ে ঝকঝকে চোখে হাসল রঞ্জা। রহস্যটা উদ্ধার হয়েছে অবশেষে। লোকটা সরকারী কমাণ্ডো। তাদের সঙ্গে একে পাঠানো হয়েছে তাদের রক্ষক হিসেবেই। সে তাদের ভালো চায়, কিন্তু-নাঃ এ অভিযানের আসল উদ্দেশ্য সম্বন্ধে কিছু জানা নেই তার।

উঠে দাঁড়িয়ে সে বলল, “কিচ্ছু না বড়ে ভাইয়া। মাথাটায় একটু চক্কর লেগে গিয়েছিল আর কি। চলুন। সামনে অনেকটা রাস্তা বাকি আছে এখনো।”

“এখন ঠিক আছেন তো? সেলিমের হাতে ঘোড়াদুটো ছেড়ে এসেছি। আমি তবে আগে গিয়ে ঘোড়াগুলোকে ধরি।”

“সেলিম—এখনো সঙ্গে রয়েছে?”

“হ্যাঁ। বলল, পিঠুডহরেই যাবে। একসঙ্গে গেলেই হয়।”

“ঠিক আছে। আপনি এগিয়ে যান ভাইয়া। আমি পেছনে আসছি।” কথাগুলো বলে আস্তে আস্তে এগোতে শুরু করল রঞ্জা। এ মানুষটা শক্তিশালী। তার বাবাকে বাঁচিয়েছে। তাদের বন্ধু। এ অভিযানে এমন একজন বন্ধু পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার।

*******

 “পৌঁছে গেছি। সামনেই পিঠুডহরের ময়দান।” পেছনে বেশ খানিকটা উঁচু থেকে সেলিমের গলা ভেসে আসছিল। মুস্তাকের সঙ্গে কথা বলতে বলতে নেমে আসছে সে। পথ এখানে একেবারে খাড়া হয়ে নেমে গিয়েছে ছড়ানো একটা বোল্ডার জোনের দিকে।

“এখানে সিদ্দার ধারাটাকে দেখতে পাচ্ছিস রঙ্গন?” দুরবীন থেকে চোখ সরিয়ে রঞ্জা হঠাৎ প্রশ্ন করল।

“উঁহু।”

“নীচে বোল্ডার জোনটা দেখছিস? ওটাই সিদ্দা।”

“ধুস্‌! এ তো শুধু পাথর আর পাথর রে দিদিভাই?”

“দূর বোকা,” রঞ্জা হাসছিল, “ওই বোল্ডার জোনের ফাঁকফোকড় বেয়েই সিদ্দা বইছে এখান দিয়ে। ওই দ্যাখ—দূরে ঐ মাঠমতো জায়গাটা দেখছিস? নে এবার দুরবীনটা চোখে লাগা—দ্যাখ— দেখতে পাচ্ছিস? মাঠটাকে বেড় দিয়ে জল বইছে? ওইটা এগিয়ে এসে বোল্ডার জোনটার ফাঁক গলে বয়ে যাচ্ছে। সাবধানে স্টেপ ফেলবি। এইসব জায়গায় পাথর খুব পিছল হয় কিন্তু।”

দুরবীনটা চোখে লাগিয়ে কলকল করে উঠল রঙ্গন, “কী সুন্দর কী সুন্দর। ও দিদিভাই, নদীটা কেমন লালনীল রঙের রে!”

“লালনীল নদী নয় রে পাগলা,” রঞ্জা হেসে তার চুলগুলো এলোমেলো করে দিল একবার, “ওখানটা ওর জলের তলায় রাশ রাশ মিনারেল মেশা নুড়িপাথর ছড়িয়ে আছে। এইবার দুরবীনটা ওপরের দিকে ঘোরা—দূরে একটা ছুঁচলো পাহাড়ের মাথা দেখতে পাচ্ছিস? যার গা বেয়ে সিদ্দা নামছে?”

“হ্যাঁ।”

“ওটার নাম শিবটোলা। ম্যাপে যা দেখেছি তাতে কাল আমরা সিদ্দার কোর্স ছেড়ে ঘুরপথে ওইটে ক্রস করে নাগবস্তির দিকে চলে যাব।”

“আমরা এগিয়ে গিয়ে ক্যাম্পিং এর জায়গা দেখছি। আপনারা সাবধানে আসুন—” বলতে বলতে মুস্তাক সেলিমকে নিয়ে তাদের পাশ কাটিয়ে এগিয়ে গেলেন সামনের দিকে।

“এগিয়ে যা রঙ্গন। সেলিমের দিকে খেয়াল রাখ। সাবধান,”  মৃদু গলায় কথাক’টা বলে রঙ্গনকে সামনের দিকে ঠেলে দিল রঞ্জা। সে এগিয়ে গিয়ে মুস্তাকের হাত ধরেছে। পাথরে পাথরে পা ফেলে লাফিয়ে লাফিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে ওরা তিনজন।

*******

 “মুশকিল হল। কোনদিকটা দিয়ে এগোই বল তো? সবদিকেই তো দেখছি–”

একলা একলাই আনমনে হাঁটছিল রঞ্জা। গলার শব্দটা পেয়ে পেছন ফিরে দেখে জ্যোতির্ময় এগিয়ে এসেছেন কাছে।

“এটা কিন্তু খুব সহজ বাবা,” বলতে বলতে নিচু হয়ে বোল্ডারগুলোর দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে দেখে নিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বলল, “এই যে, পেয়েছি। এদিক দিয়ে সেলিমরা গেছে। এই বাঁদিকের বোল্ডারটায় পা দাও বাবা—না না, ওইটে না ওইটে না, ওর পাশে—সেলিমরা ওটার ওপর দিয়ে গেছে।”

“বুঝলি কী করে?”

“সিম্পল। পাথরের গায়ে মাকড়শারা জাল বোনে। যে পাথরগুলোর জাল ছেঁড়া সেগুলোর ওপর দিয়ে রাস্তা-” বলতেবলতেই হঠাৎ জ্যোতির্ময়ের মুখের দিকে তাকিয়ে চুপ করে গেল রঞ্জা। ভুরুদুটো গিঁট পাকিয়ে উঠেছে তাঁর।

“কিছু ভাবছ বাবা?”

“হ্যাঁ। এই সেলিম লোকটা নাগবস্তিতেই থাকে। আমরা রামবাসার দিকে যাব শুনে ভারী উৎসাহ। বলে জায়গাটা ওর হাতের তেলোর মত চেনা নাকি। দিনে শ’তিনেক টাকা আর খাওয়াদাওয়া পেলেই গাইডের কাজটা করে দিতে পারবে। কিন্তু মুস্তাক আপত্তি করছে।”

“মুস্তাকের পয়েন্টটা কী?”

“বেজায় সাবধানী ছেলে। বলছে জায়গাটা সুবিধের নয়। একেবারে উটকো একটা লোককে এভাবে দলে ভেড়ানো ঠিক না-ও হতে পারে। কে কোন মতলবে ঘোরে এ’সব এলাকায় কে জানে! তবে আমি বলি, পথে বের হয়ে অতশত ভাবলে চলে? এদিকে শেষ এসেছি তা-ও তো বেশ ক’বছর হয়ে গেল। খুঁটিনাটি ভালো করে মনেও নেই সব। জায়গাটা চেনে এমন একটা লোক সঙ্গে থাকলে-”

“না বাবা। মুস্তাকের সঙ্গে আমি একমত।”

“সে কী রে? তুই তো কাশ্মীরের কাঁহা কাঁহা মুলুকে একাএকাই ক্যাম্প করে বেড়াস। একটা লোকাল ঘোড়াওয়ালার মত তুইও ভয় পেয়ে গেলি?”

উঁহু। অন্য কারণ আছে। এই সেলিম লোকটার কিছু রহস্য আছে। আমি আর রঙ্গন দুজনেই চেষ্টা করে দেখেছি। ওর মনের ভেতর ঢোকা যায় না। একটা শক্ত ব্লক রয়েছে। উলটে আমার মনের মধ্যেই ঢুকে এসেছিল প্রায়।”

জ্যোতির্ময়ের মুখটা একটু ফ্যাকাশে হয়ে গেল। জিভার নজরদার? এ ছাড়া আর কোন ব্যাখ্যা হতে পারে না এর। জিভা কি তাঁকে সন্দেহ করছেন? রঞ্জা তাঁর মুখের দিকে তাকিয়েছিল। বাবা ঠিক কী ভাবছে এখন? প্রশ্নটা মাথায় আসতেই তাঁর চিন্তার সুতোগুলো তার চোখের সামনে ভেসে উঠছিল। প্রতিদিনই শক্তিটা একটু একটু করে বেড়ে উঠছে তার। তার আর রঙ্গন, দুজনেরই-

-হঠাৎ নিজেকে সংযত করল রঞ্জা। রঙ্গনকে যে নীতির শিক্ষা সে প্রতিমুহূর্তে দিয়ে চলেছে—একান্ত বিপদের মুহূর্ত ছাড়া অন্যের অজান্তে কারো মনের ভেতর ঢুকে পড়াটা অন্যায়—সে নিজে তাকে ভাঙবে কেমন করে?

“বেশ। তাই হবে। ক্যাম্পে পৌঁছে আমি একে বিদেয় করবার বন্দোবস্ত করছি।” বলতেবলতে জ্যোতির্ময় এগিয়ে গেলেন। পেছন ফিরে একবার দেখল রঞ্জা। বিশ্বনাথন আংকলের চলতে একটু অসুবিধে হচ্ছে আজ। হাঁটুতে একটা পুরোনো চোট আছে ওঁর। বোল্ডার জোনের ক্রমাগত উঁচুনিচু রাস্তায় একটু অসুবিধে হচ্ছে বোধ হয়। খানিক আগে মালপত্রগুলো সমস্ত একটা ঘোড়ার পিঠে চাপিয়ে তাঁকে অন্য ঘোড়াটার বসিয়ে দিয়েছিলেন মুস্তাক। ঘোড়াদুটো শিক্ষিত। ঠিক নিয়ে আসবে।  রঞ্জা সামনে এগিয়ে গেল।

*******

ছোটো ছোটো তাঁবু তিনটের ভেতরে আলো জ্বলছে। দূর থেকে সেগুলোকে লাল ঢাকনা দেয়া তিনটে লন্ঠনের মত দেখায়। সন্ধে নেমে আসছিল দ্রুত। শিবটোলার উল্টোদিকে আলিচ আর কারতাং গিরিশিরাদুটো দিগন্ত ঢেকে দাঁড়িয়ে।  সেদিক থেকে একটা সরু ধারা এসে সিদ্দায় মিশেছে এইখানে। পশ্চিম আকাশ লাল থেকে আস্তে আস্তে ঘন বেগনি রঙ ধরছিল। ঘন মেঘের দল উড়ে এসে দ্রুত ঢেকে দিচ্ছে পাহাড়দুটোকে। সন্ধের মুখে পিঠুডহরের ময়দানে হাওয়া ছেড়েছে। তীব্র ঠান্ডা হাওয়ায় হাড়ের ভেতর কাঁপন ধরায়। গায়ের জ্যাকেটটা ভালো করে জড়িয়ে নিয়ে সামনে বসা সেলিমের দিকে একবার চাইলেন জ্যোতির্ময়। সাদাসিধে মানুষটা অনেক আশা নিয়ে তাকিয়ে আছে তাঁর দিকে।

“না সেলিম। ভেবে দেখলাম, আমাদের গাইডের দরকার হবে না রামবাসায়। চেনা জায়গা। আগেও এসেছি। তাছাড়া সঙ্গে যা রসদ আছে তাতে আমাদের পাঁচজনের টেনেটুনে কুলিয়ে যাবে বটে কিন্তু অতিরিক্ত একজনকে দলে নিলে মুশকিল হয়ে যাবে। তোমাকে আমরা সঙ্গে নিতে পারছি না।”

সেলিমের চোখদুটো ঝিকিয়ে উঠল একবার। রঞ্জা আর রঙ্গন সঙ্গেসঙ্গেই সতর্কভাবে তার দিকে এগিয়ে এল কয়েক পা। সেলিমের সেটা নজর এড়ায়নি দেখা গেল। তাদের দিকে ভাবলেশহীন চোখে একবার তাকিয়ে নিয়ে সে নিচু গলায় বিড়বিড় করে বলল, “আজকের রাতটা তাহলে যদি মুস্তাকভাইয়ের সঙ্গে তাঁবুতে থেকে যেতে দিতেন-”

হঠাৎ রঞ্জা উঠে এসে সেলিমের সামনে দাঁড়াল। তার মুখটা রাগে লাল হয়ে গেছে। অতবড়ো মানুষটার হাত ধরে একটা টান মেরে তাকে তুলে দাঁড় করিয়ে দিয়ে বলল, “না। এক্ষুণি এখান থেকে বিদেয় হবে তুমি।” প্রায় সঙ্গেসঙ্গে তার দুপাশে এসে দাঁড়িয়েছে মুস্তাক আর রঙ্গন। লোকটা তাদের মুখগুলোর দিকে একবার তাকিয়ে মাথা নিচু করে বের হয়ে গেল তাঁবু থেকে।

“কাজটা ভাল করলে না রঞ্জা,” বিশ্বনাথন মাথা নাড়ছিলেন, “একটা লোককে এইভাবে তাড়িয়ে দেয়া! অন্যায় তো কিছু বলেনি! তাছাড়া একটা লোকাল লোককে-”

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে রঞ্জা বলল, “এছাড়া আর কোন উপায় ছিল না কাকা। এখান থেকে ভালোয় ভালোয় ফিরতে পারলে আপনাকে সব কথাই খুলে বলব।”

পিঠুডহর থেকে বহুদুরে, সিদ্দা নদীর উৎস পেরিয়ে রামবাসা হিমবাহের বুকে অপেক্ষায় থাকা দীর্ঘকায় মানুষটা চিন্তিতভাবে পায়চারি করছিলেন। সামনে বাতাসে গড়ে ওঠা ত্রিমাত্রিক ছবিটিতে আলিচ আর কারতাং গিরিশিরাদুটো আবছা চোখে পড়ে। সেইদিকে হেঁটে চলেছে সেলিম এখন। কিছুদূর এগিয়ে গিয়ে একটা ফাটল আছে পাহাড়ের গায়ে। সেইখানে আজ রাতটা কাটিয়ে দেবে সে।

নীচে তাঁবুগুলোর দিকে সেলিমের দৃষ্টি ঘুরিয়ে ধরলেন তিনি। পর্দায় ছবিটা বদলে গেছে। পায়ের অনেক নীচে ছোটোছোটো তিনটে আলোজ্বলা তাঁবু। একপাশে আগুন জ্বেলে তাকে ঘিরে পাঁচজন মানুষ। এদের মধ্যে দুটো মন তাঁর পরিচিত। তৃতীয় মনটা একজন ছদ্মবেশী সৈনিকের। এদের পাহারাদার হয়ে চলেছে। ক্ষতিকর কিছু নয়।

অবশিষ্ট মনদুটোর দিকে নজর দিয়ে তীব্র রাগে দপ করে যেন জ্বলে উঠলেন তিনি। নিজেদের মনের ওপর প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে দুই ভাইবোন। সর্বশক্তি প্রয়োগ করেও সে বাধাকে পেরোতে পারেন নি তিনি আজ সকালে। দলের অন্যদের ওপরেও সতর্ক পাহারাদারি করে চলেছে এরা। বিশেষ করে জ্যোতির্ময়ের ওপর। 

কেন নিজেদের মনের ওপর দেয়াল তুলেছে এরা? জ্যোতির্ময় নামের লোকটার প্রতি তীব্র ভালোবাসাটাও একটা চিন্তার ব্যাপার। নিজেদের সম্পর্কে কিছু কিছু চেতনা ফিরে পাবার পরেও একটা সাধারণ মানুষের প্রতি সে ভালোবাসা তাদের বেড়েই চলেছে ক্রমশ। যেন দুহাতে আগলে রাখছে লোকটাকে। কী ভাবছে এরা সেটা জানা এই মুহূর্তে খুবই জরুরি। রেনি ও র‍্যাং শ্রেণীর জৈবযন্ত্রের নিজস্ব ব্যাক্তিত্ব আছে। নিজেনিজে সিদ্ধান্ত নেবার ক্ষমতাও আছে। যতক্ষণ না এরা তাঁর সরাসরি নিয়ন্ত্রণের এলাকায় এসে পৌঁছোচ্ছে ততক্ষণ প্রতিমুহূর্তে এদের নজরে রাখাও প্রয়োজন। তাঁকে এদের সঙ্গে থাকতেই হবে নাগবস্তি পৌঁছোনো পর্যন্ত। একটাই উপায় আছে তার। শিবটোলার পথটাকে-

*******

ফরফর করে তাঁবুর কানাতে হাওয়ার শব্দ উঠছিল। ঘুম ভেঙে গেল রঞ্জার। বাইরে হাওয়ার বেগ বাড়ছে। পাহাড়ে পাহাড়ে ধাক্কা খেয়ে গম্ভীর শব্দ উঠছে। তাঁবুর ফাঁকফোকর দিয়ে তীব্র ঠান্ডা হাওয়ার ছিটেফোঁটা ভেতরে ঢুকে এসে হাত পা জমিয়ে দিচ্ছে যেন। তাড়াতাড়ি হাত বাড়িয়ে ছোট্টো আলোটা জ্বালল একবার সে। হাতঘড়িতে সময় দেখাচ্ছে রাত সাড়ে এগারোটা।

পাশেই স্লিপিং ব্যাগের মধ্যে কুঁকড়ে গিয়েছে রঙ্গনের ছোট্টো শরীরটা। গ্রীষ্মের পাহাড়ের উপযোগী স্লিপিং ব্যাগ হঠাৎ বেড়ে ওঠা ঠান্ডাকে আটকাতে পারছে না। তার গায়ে ধাক্কা দিয়ে রঞ্জা ডাকল, “রঙ্গন—এই রঙ্গন-ওঠ-”

বলতেবলতেই স্যাক খুলে মোটা উইন্ডচিটারদুটো বের করে এনেছে সে। রঙ্গন হিহি করে কাঁপছিল। একটা পোশাক নিজের গায়ে জড়িয়ে নিয়ে অন্যটা তার দিকে ছুঁড়ে দিল রঞ্জা, “পরে নে। ভালো করে একেবারে থুতনি অবধি চেন আটকে মাথায় হুডটা দিয়ে বস। আমি একবার বাবাদের তাঁবুটা দেখে আসি গিয়ে-”

বলতে বলতে তাঁবুর সামনের চেনটা খুলে ফেলেই পিছিয়ে এল সে। তীব্র হাওয়ায় ভাসমান একরাশ বরফের ধারালো কুঁচি তার সারা মুখে ঝাপটা দিয়েছে এসে। চেন খোলা ডোরফ্ল্যাপের দুটো ধার হু হু করে উড়ছিল। “ওপাশটা তুই ধর ভাই—” বলতেবলতেই হাওয়া আর বরফকুঁচির ধাক্কাকে উপেক্ষা করে ফ্ল্যাপের একটা পাশ ধরে টেনে আনল রঞ্জা। রঙ্গন ততক্ষণে অন্য পাশটাকে আটকে ফেলেছে। চেনটা টেনে দিতে দিতে রঞ্জা বলল, “থার্মোমিটারটা একবার দ্যাখ তো!”

পাউচ থেকে যন্ত্রটা বের করেই গলা দিয়ে একটা বিস্ময়ের আওয়াজ বের হয়ে এল রঙ্গনের, “মাইনাস টেন। বছরের এই সময়ের স্বাভাবিকের থেকে পনেরো ডিগ্রি কম—আরো নামছে–”

“ইমপসিবল। পুরোদস্তুর ব্লিজার্ড শুরু হয়ে গেছে একটা। জুলাই আগস্টে ব্লিজার্ড—”

পাশের তাঁবুতে ঘুম থেকে জেগে উঠে সেই একই কথা ভাবছিলেন জ্যোতির্ময়রাও। বিশ্বনাথনও ভারী অবাক হয়ে গেছেন। রাঠোরের সেই সাবধানবাণী ভাসছিল জ্যোত্যির্ময়ের কানে। অসময়ের ব্লিজার্ড এই এলাকায় নতুন নয়। কিন্তু কেন? এখনও তো তাঁরা নিষিদ্ধ এলাকার ভেতরে—

চিন্তাটাকে মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে দিলেন জ্যোতির্ময়। এই ঝড় থামা অবধি তাঁদের কিছু করবার নেই। পাশের তাঁবুতে আলো জ্বলছে। তার মানে রঞ্জা আর রঙ্গন জেগে আছে। জেগে থাকতে হবে তাঁকেও। এখান থেকে নাগবস্তির সিধে পথটা একেবারে খাড়া হয়ে উঠে গেছে পাশের পাহাড়টা বেয়ে শিবটোলা হয়ে। সেখান থেকে পাহাড়ের মাথায় মাথায় পথ চলবে আরো উত্তরে। কাল সকালে উঠে সে রাস্তার অবস্থা ঠিক কী হবে তা এখনো আন্দাজ করা যাচ্ছে না। যদি সত্যিই রাস্তা বন্ধ হয়ে যায়? ফিরে যেতে হয় তাঁদের? জিভা কি—

হাজারো এলোমেলো চিন্তা আর দ্বন্দ্বে দুলতে দুলতে কখন যে চোখ দুটো বুঁজে এসেছে তাঁর তা জ্যোতির্ময় খেয়াল করেননি।

*******

 “সার একবার বাইরে আসবেন।”

ধড়মড় করে উঠে বসলেন জ্যোতির্ময়। বাইরে একটা হইচই চলছে। রঙ্গন, রঞ্জা আর বিশ্বনাথনেরও গলা পাওয়া যাচ্ছিল।

বাইরে এসে দাঁড়াতে মুস্তাক তাঁর হাতে দুরবীনটা দিয়ে বলল, “একবার শিবটোলার দিকটা দেখুন।”

দুরবীন চোখে লাগিয়ে একটু চমকে উঠলেন জ্যোতির্ময়। কালকের দেখা সেই ধূসর পাথরের স্তূপ এক রাতে যেন কোন ম্যাজিকে ঘন বরফের আড়ালে মুখ লুকিয়েছে। সিদ্দার ধারাকে আর সেখানে আলাদা করে চেনা যায় না।

“কী করবেন?”

জ্যোতির্ময় মাথা নাড়লেন, “একবার এগিয়ে গিয়ে রেকি করে এলে হত।”

“ভোরভোর উঠে আমি সেটা সেরে এসেছি স্যার। এখান থেকে বড়োজোর মাইলটাক রাস্তা এগোনো যাবে। তারপরেই নরম থকথকে বরফ শুরু হয়ে গেছে। কম সে কম চার-পাঁচ ফুট গভীর। এখন বেশ কদিন ওখান দিয়ে ক্রসিং সম্ভব নয়।”

“কিন্তু আর কোন রাস্তা তো-”

“নাগবস্তি যাবার আরেকটা রাস্তা আছে সাহেব,” হঠাৎ পেছন থেকে একটা চেনা গলা ভেসে আসতে চমকে ঘুরে তাকাল সবাই। সেখানে সেলিম বড়ো বড়ো পায়ে হেঁটে আসছিল দলটার দিকে।

“তুমি? ফের এখানে-” জ্যোতির্ময়ের গলায় বিরক্তি চাপা থাকছিল না।

“আমার কথাটা একবার শুনে নিন স্যার,” লোকটা তাঁর কাছে এসে ধীর গলায় বলল, “রাতে আলিচের গায়ে একটা ফাটলে গিয়ে ঢুকেছিলাম। অসময়ে এমন বরফ ঝড় আমি আগে কখনো দেখিনি। সকালে আলো ফুটতে শিবটোলার রাস্তা বন্ধ দেখে মনে হল আপনাদের হয়ত এই বান্দার কোন সাহায্য দরকার হতে পারে। এদিক দিয়ে নাগবস্তি যাবার একটা অন্য পথ আছে।”

তার হাত অনুসরণ করে  শিবটোলার উল্টোদিকের গিরিশিরাদুটোর দিকে মুখ ফেরাল তারা।

“ও রাস্তা তো উলটোদিকে যাচ্ছে। ওদিকে গেলে নাগবস্তি থেকে পিছিয়ে যাব না আমরা?” বিশ্বনাথন বলে উঠলেন পেছন থেকে।

“না সাহেব। বাঁহাতে ওটা আলিচ পাহাড়। ওর গোড়ায় সিল্লাসার লেকের পাশে আজ রাতটা কাটিয়ে কাল ডাইনে হাতিডুঙ্গার খাড়া চড়াই ধরব। ওকে বেড় দিয়ে ফের সিদ্দার ওপরের দিকে পৌঁছে যাব। সেখান থেকে দুশমনী ঢালান বেয়ে উঠলে সিধা নাগবস্তির পথ।”

মুস্তাক চিন্তিতভাবে আলিচের দিকে দেখছিলেন। মাথা নেড়ে বললেন, “পথ যদি থেকেও থাকে তা হলেও কালকের কালকের ঝড়ের পর সে বোধ হয় খোলা নেই।”

“না। ওদিকের রাস্তা কখনো বন্ধ হয় না। আমরা এখানে থাকি। আমরা জানি।”

মুস্তাক দুরবীনে বেশ খানিকক্ষণ দেখলেন আলিচের দিকে। তারপর মাথা নেড়ে বললেন, “কথাটা ঠিক। বরফের ছিটেফোঁটাও তো দেখছি না ওদিকে। কিন্তু তা কী করে হয়? একটা এতবড়ো ব্লিজার্ড হয়ে গেল অথচ-”

“অত কথা জানি না। যেতে চাইলে আমার সঙ্গে আসুন।” সেলিমের গলায় অসহিষ্ণুতার ছোঁয়া ছিল।

জ্যোতির্ময় একটু ইতস্তত করে মুস্তাকের দিকে চাইলেন একবার। মুস্তাক মাথা নাড়ল, “ওকে চলে যেতেই বলে দিন স্যার। রাস্তা যদি থাকে তাহলে সেখান দিয়ে আমিই আপনাদের নিয়ে যেতে পারব।”

সেলিমের মুখে একটা মৃদু হাসি খেলে গেল, “দুশমনী ঢালানের গা বেয়ে সিদ্দা হাজার ধারা হয়ে নামছে। খাড়াই ঢালানের পিছল গায়ে ভুল ট্রেল ধরলে বেঁচে ফিরবেন না। ওর ওপর দিয়ে পথ আমরা নাগবস্তিওয়ালারা ছাড়া কেউ জানে না। চাইলে চেষ্টা করে দেখুন। আমি মিথ্যে বলিনি।”  

রঞ্জা চুপচাপ কিছু ভাবছিল। হঠাৎ জ্যোতির্ময়ের দিকে ঘুরে বাংলায় বলল, “লোকটাকে বিশ্বাস করা যায় না এটা ঠিক। কিন্তু, এই শেষ কথাটা বোধ হয় ও ভুল বলেনি বাবা। ঢালানের কথা যা বলল, এদিককার পাহড়ে সে জিনিস আমি আগেও দেখেছি। পথচেনা দক্ষ গাইড ছাড়া সেগুলো সত্যিই পার হওয়া যায় না।”

“তাহলে?”

“এই মুহূর্তে এ লোকটার ওপর ভরসা না করে উপায় নেই। তবে ভেতরে ভেতরে কোন মতলব আঁটছে কি না, সেটা আমি আর রঙ্গন খুঁজে দেখব। কতক্ষণ আটকাবে ও আমাদের?”

খানিকক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলেন জ্যোতির্ময়। তারপর বললেন, “চল তাহলে। যা করবি সাবধানে করিস। শুধু দু’মিনিট সময় দে আমায়, ডঃ চৌধুরিকে আজকের রিপোর্টটা টেলিফোনে পাঠিয়ে দিয়েই রওনা হব।”

 “বিকেলে ক্যাম্পে পৌঁছে খবরটা দিলে হত না বাবা? এখন তাড়াতাড়ি বেরিয়ে পড়তে পারলে-” রঞ্জার গলায় অসহিষ্ণুতার ছাপ ছিল।

“উঁহু,” জ্যোতির্ময় মাথা নাড়লেন, “এটা প্রতিরক্ষামন্ত্রকের নির্দেশ রঞ্জা। ওঁরা এই কলগুলোর ওপরে নজর রাখছেন।”

*******

“দুশমনী ঢালান! সার্থক নাম,” বিশ্বনাথন নিজের মনেই বলে উঠলেন একবার। সামনে, খাড়া মেঘের দিকে উঠে গেছে আকাশছোঁয়া বোল্ডার জোন। একটা বড়োসড়ো পাথরের ওপর বসেছিলেন তিনি। একটানা অনেকটা উঠে এসে বুকে চাপ লাগছে। পায়ের অনেক নীচে সিল্লাসার লেক মেঘের আড়ালে হারিয়ে গেছে। সেখান দিয়ে সিদ্দার ধারাটা শুধু আবছা চোখে পড়ে এখান থেকে।

সেলিম নামে নাগবস্তির লোকটা আগে আগে চলেছে।  ঝুলন্ত পিছল বোল্ডারের মৃত্যুফাঁদগুলোর মধ্যে পা রাখবার শক্তপোক্ত পাথরগুলোর ঠিকানা মুখস্ত তার। রঞ্জা আর রঙ্গন চলেছে তার পাশাপাশি। পেছনপেছন সামান্য দূরত্বে অন্যদু’জন সাবধানে পা ফেলে এগোচ্ছিল।

“দেরি কোরো না বিশ্বনাথন। সামনে বাঁক দেখছি একটা। আসবার সময় খেয়াল রেখো,” খানিক ওপর থেকে জ্যোতির্ময়ের গলা ভেসে এল।

“ভেবো না। ঠিক চলে আসব,” বসে থেকেই জবাব দিলেন বিশ্বনাথন।

বহুদূরে, রামবাসা হিমবাহের বুকে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটার সামনে দুশমনী ঢালানের একটা ছবি ভাসছিল। সেলিমের চোখ যা দেখছে ঠিক সেইটি প্রতিফলিত হচ্ছে সেখানে। ছেলেমেয়েদুটো পিঠুডহর থেকে এক মুহূর্তের জন্য সঙ্গ ছাড়েনি সেলিমের। সতর্ক চোখে তার প্রতিটা নড়াচড়ার খেয়াল রেখে চলেছে। আর সেইসঙ্গে দু’দুটো মন ক্রমাগত তীব্র আক্রমণ শানিয়ে চলেছে সেলিমের মনের ওপর। যান্ত্রিক মন। তাদের শক্তি অনেক বেশি। আস্তে আস্তে প্রতিরোধ দুর্বল হয়ে আসছে তাঁর। কিছু একটা করা প্রয়োজন। এক্ষুনি। নয়ত দেরি হয়ে যাবে।

সামনে একটা তীক্ষ্ণ বাঁক দেখা দিল হঠাৎ। ওর অন্যপাড়টা দেখা যায় না এপাশ থেকে। সেদিকে তাকিয়ে দেখে, কী মনে হতে উল্টোদিকে ঘুরে তাকাল সে একবার। অনেকটা নীচে বিশ্বনাথন একলা বসে। হালকা একটা হাসি ফুতে উঠল তার মুখে। উপায় পাওয়া গেছে। এইবার–

-হঠাৎ গতি বাড়িয়ে দুই ভাইবোনের নাগাল ছেড়ে বাঁকের উল্টোদিকে অদৃশ্য হল সেলিম। পেছন থেকে গোটা দলটা হাঁ হাঁ করে উঠেছে। ছেলেময়েদুটো পিছল পাথর বেয়েই ছুটছে বাঁকটার দিকে—

এইখানটায় মূল পথের বাঁয়ে ছোটোছোটো নুড়ি ছড়ানো একটা এলাকা  নীচে নেমে গিয়েছে। আংরাখার কোণদুটো শক্ত করে চেপে ধরে সেই নুড়ির ওপরে বসে পড়ল সেলিম। তারপর ঢাল বেয়ে তিরবেগে ধেয়ে গেল নীচের দিকে। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে বেশ খানিকটা নেমে এসে হঠাৎ বাঁদিকে বাঁক নিয়ে সে গড়িয়ে গেল তাদের পুরোনো পথটার ওপরে—

ছেলেমেয়েদুটো ওপরে বাঁকের মুখে পৌঁছে গেছে। সেলিম কোনদিকে গেছে তা বুঝতে পারছে না। মাথার অনেকটা ওপর থেকে তাদের উত্তেজিত কথাবার্তার শব্দ আসছিল।

সামনে, খানিক দূরে পাথরের ওপর বিশ্বনাথন বসে। সেলিম গুঁড়ি মেরে তাঁর দিকে এগিয়ে গেল—

*******

মিনিট দশেক বিশ্রাম নিতে নিঃশ্বাস স্বাভাবিক হয়ে এসেছিল বিশ্বনাথনের। হাতের লাঠিটায় ভর দিয়ে উঠে দাঁড়ালেন তিনি। আর ঠিক তখনই রাস্তার ওপর গড়িয়ে এসে তাঁর উঠে দাঁড়াল সেলিম। দুটো তীক্ষ্ণ চোখের দৃষ্টি যেন ছুরির মতন এসে বিঁধছিল তাঁর চোখে।

প্রায় সঙ্গেসঙ্গেই অনেকটা ওপর থেকে একটা কিশোর গলার চিৎকার ভেসে এল, “দিদি—নীচে চেয়ে দ্যাখ-”

চিৎকারটা কানে আসতে বিশ্বনাথনের দিক থেকে চোখ ঘুরিয়ে ওপরের দিকে দেখল সেলিম। দৃষ্টিটা সরে যেতেই কেউ যেন একটা পাথর সরিয়ে নিল বিশ্বনাথনের বুকের ওপর থেকে। সেলিমের সামনে থেকে ছিটকে গেলেন তিনি, আর তারপর তাল সামলাতে না পেরে একরাশ বোল্ডারের সঙ্গে গড়িয়ে পড়লেন নীচের দিকে। মাথার ওপরে তখন শিকারী ঈগলের মত নীচের দিকে উড়াল দিয়েছে দুই ভাইবোন।

uponyasbarebare5 (Medium)

গড়িয়ে যেতে থাকা বিশ্বনাথনের দিকে ফিরে দেখল সেলিম। তারপর মুহূর্তের দ্বিধাটা কাটিয়ে উঠে ঝাঁপ দিয়ে পড়ল তাঁর ওপরে।

জড়াজড়ি করে গড়িয়ে যেতে থাকা মানুষদুজনের পাশাপাশি ভেসে চলেছিল রঞ্জা আর রঙ্গন। তারপর, ছুটন্ত পাথরের ফাঁকেফোকড়ে সতর্ক নজর রাখতেরাখতেই হঠাৎ অমানুষিক দ্রুততায় হাত বাড়িয়ে মানুষদুজনকে ধরে নিয়ে সটান উঠে গেল কিছুটা ওপরে একটা নিরাপদ এলাকায়। এখান থেকে তাদের মূল পথের দিকটা পাহাড়ের পুরোপুরি আড়ালে। সেদিক থেকে জ্যোতির্ময়ের উদ্বিগ্ন গলার ডাক ভেসে আসছিল।

একটু বাদেই পাহাড়ের বাঁক ঘেঁষে মুস্তাকের মুখটা উঁকি মারল এদিকে। অনেকটা উঁচু থেকেই তিনি দেখতে পেয়েছেন তাদের। উলটোদিকে মুখ ঘুরিয়ে জ্যোতির্ময়কে কিছু বললেন তিনি। তারপর ওস্তাদ বাজিকরের মতই বোল্ডার থেকে বোল্ডারে ঝাঁপ খেতে খেতে দ্রুত ছুটে এলেন তাদের কাছে।

বিশ্বনাথন পাথরের মত নিস্পন্দ হয়ে বসেছিলেন। পায়ের কাছে সেলিমের শরীরটা শুয়ে আছে। ঘষা কাচের মত চোখদুটো খোলা। নেমে এসে তার ঘাড়ের কাছে আঙুল নিয়ে সামান্য পরীক্ষা করে মাথা নাড়লেন মুস্তাক, “বেঁচে আছে। জ্ঞান হারিয়েছে। কী করে হল এটা স্যার?”

কথাটা বলেই বিশ্বনাথনের দিকে তাকিয়ে বুকটা একমুহূর্তের জন্য ধ্বক করে উঠল মুস্তাকের। সে চোখের দৃষ্টি বিশ্বনাথনের নয়। ব্যাঙ্গ আর হিংস্রতা মেশানো সে চোখ দেখলে অতিবড়ো সাহসীরও বুক কেঁপে উঠবে। কিন্তু সেটা একমুহূর্তের জন্যই। পরমুহূর্তেই বিশ্বনাথনের চোখে ফিরে এসেছে পরিচিত মানুষটির দৃষ্টি। মাথা নাড়লেন তিনি, “বুঝতে পারছি না মুস্তাক। হঠাৎ কোত্থেকে থেকে এসে আমার ওপর ঝাঁপ দিয়ে পড়ল। তারপর থেকেই এই অবস্থা। রঞ্জা আর রঙ্গন ঠিক সময়ে এসে হাজির না হলে-”

মুস্তাক বিস্মিত চোখে ভাইবোনের দিকে দেখতেদেখতে বিড়বিড় করছিল, “অতটা ওপর থেকে তোমরা এইখানটা এত তাড়াতাড়ি নেমে এলে কী করে?”

তার  কথার কোন জবাব না দিয়ে রঞ্জা চিন্তিতমুখে প্রশ্ন করল, “একে নিয়ে কী করবেন বড়ে ভাইয়া?”

“ভাবছি ম্যাডাম। এইখানে একে রেখে যাওয়ার প্রশ্ন নেই। নাগবস্তি সম্ভবত আর কয়েক ঘন্টার পথ। সেখানে একে পৌঁছে দিয়ে যাব একেবারে।” বলতে বলতে শরীরটাকে অবলীলায় কাঁধের ওপর তুলে নিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে বড়ো বড়ো পায়ে এগিয়ে গেলেন তিনি।

পাঁচ

জিভার মুখোমুখি

এখান থেকে নীচে ছড়িয়ে থাকা রিঙ্গান হ্রদটাকে একটা অতিকায় সাপের ফনার মতন দেখায়। তার একপাশ থেকে সিদ্দা নদীর ধারা বের হয়ে এসেছে। সাপের মতই আঁকাবাঁকা তার শরীরটা নাগবস্তির মধ্যে দিয়ে এগিয়ে গিয়ে দূরে দুশমনী ঢালানের মাথার কাছে মিলিয়ে গেছে।

নাগবস্তিতে সেলিমকে পৌঁছোতে গিয়ে বেশ একটু হইচই হয়েছিল গতকাল বিকেলে। লোকটা সম্ভবত তাদের নেতাগোছের কেউ হবে। লোকজন তাকে বেশ সম্ভ্রমের সঙ্গে কাদেজ বলে ডাকছিল। নিয়ে আসবার সঙ্গেসঙ্গেই গ্রামের বৈদ্য তার চিকিৎসায় লেগে গিয়েছেন। অনেক রাত্রে তার জ্ঞান ফিরেছে বলে খবর মিলেছে সকালবেলা। তবে এখনো সে নড়াচড়া বা কথা বলবার অবস্থায় আসেনি। কাউকে চিনতেও পারছে না নাকি।

তাকে পাহাড় থেকে অজ্ঞান অবস্থায় কুড়িয়ে আনায় জ্যোতির্ময়দের দলটারও বেশ খাতিরদারি হয়েছে গ্রামে। তবে তাতে সুবিধে কিছু হয়নি। রিঙ্গান পেরিয়ে রামবাসা টপ চড়তে যাবেন শুনে লোকজন মুখ কালো করে যে যার ঘরে গিয়ে সেঁধিয়েছে। সঙ্গে আসবার মত সাহস তাদের কারো নেই।

খাড়াই দেয়ালের গায়ে সরু বারান্দামতন জায়গাটাতে বসে রঞ্জা আর রঙ্গন একবার ওপরের দিকে চেয়ে দেখল। অল্প দূরে, একটা বিরাট পোকার মতন মুস্তাক চার হাতপায়ে এদিকওদিক নড়াচড়া করছেন। গিরিসঙ্কটের কাদা আর নুড়িভরা বিপজ্জনক ঢালের গায়ে নিরাপদ পথ খুঁজে চলেছেন তিনি তাদের জন্য।

“ছেলেটাকে সঙ্গে না পেলে আজ এই পাসটা ক্রসিং-এর কথা ভাবাও যেত না রে রঞ্জা।” হাঁফাতে হাঁফাতে তাদের কাছে উঠে আসতে আসতে জ্যোতির্ময় বললেন। বিশ্বনাথনও তাঁর পেছনপেছন উঠে এসেছেন।

খাড়াই দেয়ালের গায়ে এ জায়গাটা ছোটো একটা বারান্দামতন হয়ে রয়েছে। গুটিকয় ছোটো ছোটো ঝোপও গজিয়েছে এদিকওদিক। রঙ্গন আর রঞ্জার কাছাকাছি একটা ছোটো পাথরের চাঁইয়ের ওপর উঠে বসলেন জ্যোতির্ময়।  তারপর পিঠের স্যাকটা খুলতে খুলতে নিজের মনেই বললেন, “সকালে তো নাগবস্তি থেকে ডঃ চৌধুরীকে খবর পাঠানো গেল না। এখন আরেকবার চেষ্টা করে দেখা যাক, যদি সিগন্যাল পাই। কী বলিস?”

বলতে বলতেই স্যাক থেকে স্যাটেলাইট ফোনের হ্যান্ডসেটটা বের করে এনে সেটাকে চালু করে দিলেন জ্যোতির্ময়। তারপর  ভুরু কুঁচকে যন্ত্রটার দিকে তাকিয়ে রইলেন খানিকক্ষণ। বিশ্বনাথন চুপ করে দাঁড়িয়েছিলেন একপাশে। শয়তানি ঢালানের ঘটনাটার পর থেকেই আশ্চর্যরকম চুপচাপ হয়ে গেছেন মানুষটা।

“একটু দেখবে বিশ্বনাথন? নাগবস্তি পৌঁছোবার পর থেকেই ওতে কোন সিগন্যাল আসছে না।” বলতেবলতে যন্ত্রটা তাঁর দিকে বাড়িয়ে ধরলেন জ্যোতির্ময়।

যন্ত্রটা হাতে নিয়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে অনেকক্ষণ ধরে দেখলেন বিশ্বনাথন। যেন জীবনে প্রথমবার এমন কোন যন্ত্র দেখছেন। তারপর হঠাৎ উঠে দাঁড়িয়ে ফিসফিস করে বললেন, “এখান থেকে ওর সিগন্যাল আর কারো কাছে পৌঁছোবে না জ্যোতির্ময়।”

বলতেবলতেই সেটাকে তিনি ছুঁড়ে মারলেন নীচের দিকে।

“কী করলে তুমি বিশ্বনাথন?” বলে তাঁর দিকে ঘুরেই চমকে উঠলেন জ্যোতির্ময়। বিশ্বনাথনের চোখের দৃষ্টি হঠাৎ একেবারে বদলে গেছে। শীতল, কুটিল চোখে জ্যোতির্ময়ের দিকে তাকিয়ে বললেন, “নিরাপত্তাবেষ্টনীর মধ্যে পৌঁছে গেছি আমরা। আর চিন্তা নেই। এসো। তোমার কাজ শেষ।” বলতেবলতে একটুকরো পালকের মতই জ্যোতির্ময়ের শরীরটা মাথার ওপর তুলে ধরলেন তিনি।

“স্টপ অর আই শ্যুট,” তীক্ষ্ণ গলায় পরিষ্কার ইংরিজি উচ্চারণে কথাগুলো ভেসে আসতে ওপর দিকে ফিরে চাইল তারা সবাই। মাথার ওপরে ঢাল বেয়ে দ্রুত নেমে আসছিল ঘোড়াওয়ালা মুস্তাক। তার এক হাতে ঝিকিয়ে উঠছে আর্মি সাপ্লাইয়ের গ্লক ১৭-র ধূসর ব্যারেল। অন্যহাতে কোমর থেকে খুলে আনা লিকলিকে দড়িটার ফাঁস নিখুঁত লক্ষ্যে সে ছুঁড়ে দিল মানুষদুজনের দিকে।

বিশ্বনাথনের শরীরে তখন অসুরের শক্তি ভর করেছে যেন। এক হাতে জ্যোতির্ময়কে উঁচুতে তুলে ধরে অন্য হাতে অবিশ্বাস্য ক্ষিপ্রতায় ছুটে আসা ফাঁসটাকে চেপে ধরেছেন তিনি। তীক্ষ্ণ, খনখনে গলার হাসিতে ফেটে পড়ছে নির্জন পাহাড়।  চোখের পলকে ফাঁসটাতে হাত গলিয়ে ধরে একটা হ্যাঁচকা টানে মুস্তাককে টেনে নিয়ে অন্যহাতে জ্যোতির্ময়কে জড়িয়ে ধরে তিনি ঝাঁপ দিলেন পাহাড়ের দেয়াল ছেড়ে নিচে ছড়িয়ে থাকা রিঙ্গানের ওপরে।

প্রায় সঙ্গেসঙ্গেই বাতাসে ভেসে উঠল রঞ্জা আর রঙ্গনও। শিকারী পাখির মত ঝাঁপ দিল পাক খেয়ে নীচের দিকে ধেয়ে যাওয়া শরীরতিনটের দিকে। হ্রদের জল ছোঁবার মুহূর্তে তাঁদের পাশে গিয়ে পৌঁছোল তারা। তারপর, শক্ত হাতের বাঁধনে তিনজনকে ধরে নিয়ে হাউইয়ের মতন ফের উঠে আসতে লাগল খানিক আগের সেই বারান্দামতো জায়গাটার দিকে।

*******

জড়াজড়ি করে পড়ে থাকা অজ্ঞান শরীরগুলোর দিকে একনজর দেখে নিয়ে নীচু গলায় রঞ্জা বলল, “বাবা আর মুস্তাকের জ্ঞান ফেরা রঙ্গন, আমি একবার বিশ্বনাথনকাকাকে দেখছি।”

বলতে বলতে বিশ্বনাথনের অজ্ঞান শরীরটাকে দুহাতে তুলে নিয়ে একপাশে সরে গেল রঞ্জা। হাঁটু গেড়ে বসে তাঁর মাথার দুপাশে হাত ছুঁইয়ে ধ্যানস্থ হল সে।

মুস্তাক আর জ্যোতির্ময়ের জ্ঞান ফিরেছে ততক্ষণে। তাড়াতাড়ি করে উঠে বসতে যাচ্ছিলেন তাঁরা। রঙ্গন তাঁদের কাঁধ ধরে ফের শুইয়ে দিল মাটিতে, “একটু অপেক্ষা করতে হবে। দিদি আসুক। তোর দেরি হবে দিদি?”

চোখ খুলে তার দিকে ফিরে তাকাল রঞ্জা। মুখে হাসি, “চিন্তা নেই। সিচ্যুয়েশান আন্ডার কন্ট্রোল।”

বিশ্বনাথনের জ্ঞান ফিরে এসেছে। রঞ্জার কোল থেকে মাথা উঁচিয়ে তিনি দুর্বল গলায় বললেন, “এটা কোন জায়গা? আমি-আমার কী হয়েছিল? দুশমনী ঢালানে-”

তাঁর কপালে হাত বুলিয়ে দিয়ে রঞ্জা হাসল, “আর ভয় নেই কাকা। দুশমনী ঢালানে যে আপনার মনকে দখল করেছিল, পাহাড় থেকে ঝাঁপ খাবার পর সে বিদেয় হয়েছে। হয়ত আর তার থাকবার প্রয়োজন নেই মনে করেছিল। আপনি এখন আমার আশ্রয়ে আছেন। আর সে আপনাদের কারো কোন ক্ষতি করতে পারবে না—”

তারপর মুস্তাকের জিজ্ঞাসু চোখের দিকে তাকিয়ে সে বলল, “মিস্টার আহমেদ, আপনার আসল পরিচয় আমরা জানি। আপনি আমাদের বন্ধু। আপনার মনে অনেক প্রশ্ন জাগছে বুঝতে পারছি। কিন্তু এখন তার সময় নয়। বিশ্বনাথনকাকাকে আমি সঙ্গে করে নিয়ে যাচ্ছি। আপনি বাবাকে নিয়ে গিরিসংকট পাড় হয়ে যত তাড়াতাড়ি পারবেন উল্টোদিকের রামবাসা গ্লেসিয়ারের ওপর নেমে আসুন। রঙ্গন আপনাদের সাহায্য করবে। আমি এগিয়ে যাব। দেরি করবেন না।”

বলতেবলতেই রঞ্জার হাতের আঙুলগুলো দ্রুত নড়াচড়া করছিল বিশ্বনাথনের কপালে। ধীরে ধীরে স্থির হয়ে এল মানুষটার শরীর। গভীর ঘুমে ঢলে পড়ছিলেন তিনি। শয়তানি ঢালানে সেলিমকে ছেড়ে জিভা তাঁর মনকে দখল করেছিল। সেই থেকে বড়ো যন্ত্রণা পেয়েছেন তিনি। সেইসব স্মৃতি এইবার মুছে যাবে তাঁর মন থেকে।

মুস্তাক কোন কথা বললেন না। খানিক আগে ঘটে যাওয়া ঘটনাটা তাঁকে গভীরভাবে নাড়া দিয়েছে। এই ছেলেমেয়েদুটো আসলে কারা তিনি তা জানেন না। মানুষ নয় সম্ভবত। এইখানে একটা গোপন যুদ্ধ চলেছে। তার রীতিনীতি তাঁর পরিচিত কোন লড়াইয়ের সঙ্গে মেলে না, যেমন মেলে না তার যোদ্ধাদের অতিমানবিক ক্ষমতাগুলো। খবরগুলো তাড়াতাড়ি আর্মি বেস-এ পাঠানো প্রয়োজন। সাহায্য দরকার হবে। কিন্তু–সম্ভবত এই এলাকাটা থেকে কোন বেতার সংকেত বাইরে বের হয় না। ডঃ সেনের স্যাটফোন তো নাগবস্তির পর থেকেই সিগন্যাল পাচ্ছিল না। জ্যামার? এমন কোন পরিস্থিতির আন্দাজ করেই কি তাহলে—

–ধীরে ধীরে কবজিতে বাঁধা রিস্টব্যান্ডের প্যানিক বাটনটায় কয়েক সেকেন্ড বাদ দিয়ে দুবার মৃদু চাপ দিলেন তিনি। তারপর জ্যোতির্ময়কে নিজের পিঠের সঙ্গে বেঁধে নিয়ে নিঃশব্দে উঠে দাঁড়ালেন। রঙ্গন এগিয়ে এসে তাঁর হাতটা ধরল। সঙ্গেসঙ্গেই নিজের শরীরের ওজনটা কমে এল মুস্তাকের। পা দুটো মাটিকে ছুঁয়ে আছে শুধু। চাপ দিচ্ছে না। পিঠের ওপর ঝুলন্ত মানুষটাও একেবারেই ভারহীন যেন। কাদা আর নুড়িপাথরে ঢাকা ঢালের খাঁজে খাঁজে পা রেখে অবিশ্বাস্য ক্ষিপ্রতায় উঠে যাচ্ছিলেন তাঁরা গিরিসংকটের চূড়ার দিকে। ভরহীন পায়ের হালকা ছাপ পড়ছিল শুধু নরম কাদামাটির বুকে।

সেইদিকে একনজর দেখে নিল রঞ্জা। রঙ্গন দক্ষভাবে সাহায্য করে চলেছে মুস্তাককে। অতটুকু ভাইটা তার—এখনও দুষ্টুমি আর তার সঙ্গে খুনশুটির শেষ নেই। বকুনি চড়চাপড়ও কম খায়না তার কাছে। সে আজ কেমন দিব্যি বড়োদের মত—

-একটা ঝাঁকুনি দিয়ে নিজের মনটাকে তাদের ওপর থেকে সরিয়ে আনল সে। পাহাড়ের ওপাশে এই মুহূর্তে কী ঘটে চলেছে তার একটা পরিষ্কার আন্দাজ রয়েছে তার। চার হাজার বছর অন্তর, তাদের জেগে ওঠবার দিনটায় আরো তিনবার তা দেখেছে সে। অথচ সে দিনগুলোর সঙ্গে আজকের দিনটার কত তফাৎ!

আর দেরি করা যায় না। ঘুমন্ত বিশ্বনাথনকে পিঠের সঙ্গে বেঁধে নিয়ে হাতদুটো দুপাশে ছড়িয়ে দিয়ে বাতাসে ভেসে উঠল সে। তারপর ছিলেছাড়া তিরের মতই বাতাস বেয়ে ধেয়ে গেল গিরিসংকটের চূড়া ছাড়িয়ে তার উল্টোদিকে।

*******

সেনাবাহিনীর বিশেষ বিমান শ্রীনগর এয়ারপোর্টের মাটি ছুঁয়ে স্থির হতেই তার কাছে দুটো জিপ ছুটে এল। বিমানের সিঁড়ির মুখে মানুষটি দেখা দিতেই সার বেঁধে দাঁড়ানো সৈনিকেরা অভিবাদন জানাতে শুরু করেছে। তাদের দিকে ভ্রুক্ষেপ না করে সিঁড়ি থেকে নেমে জিপের দিকে যেতে যেতে শীতল মহাজন তাঁর দিকে এগিয়ে আসা মানুষদুজনের দিকে ফিরে বললেন, “আর কোন খবর?”

রাঠোরের কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমছিল, “না ম্যাডাম। আজ সকালে ডঃ চৌধুরির ফোনে ডঃ জ্যোতির্ময়ের দৈনিক রিপোর্ট না পৌঁছোবার খবর পেয়ে আমি পরিকল্পনা অনুযায়ী গরুড় কম্যান্ডো ফোর্সের দফতরে জরুরি সতর্কতা সংকেত পাঠিয়ে দিয়েছি। কিন্তু আপনি নিজে-এইভাবে দিল্লি ছেড়ে এত কম সময়ের মধ্যে এখানে ছুটে আসবেন-”

তাঁর কাঁধে হাত রেখে শীতল মহাজন বললেন, “ওয়েল ডান রাঠোর। বাকি কাজটা গরুড় কমান্ডো ফোর্স সামলাবে। আপনার কাজ শেষ। আপনি ফিরে যেতে পারেন।”

অভিবাদন করে নিজের জিপের দিকে ফিরে যেতে থাকা রাঠোরের দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে অন্য মানুষটির সঙ্গে তাঁর জিপে উঠে বসলেন শীতল মহাজন। একটা তীক্ষ্ণ বাঁক নিয়ে জিপটা  লাফ দিয়ে এগিয়ে গেল কংক্রিটের টারম্যাক ধরে।

“রিপোর্ট উইং কমান্ডার মেহতা।”

ছুটন্ত গাড়ির মধ্যে হাতের ট্যাবটা চালু করতে করতে বয়স্ক মানুষটি বলে উঠলেন, “হ্যালের চারটে ‘ধ্রুব’ ক্লাস হাই অলটিচুড অ্যাটাক হেলিকপটার সশস্ত্র অবস্থায় লেহ্‌ বিমানবন্দরে ওড়বার জন্য তৈরি। আজ সকালে জ্যোতির্ময়ের রিপোর্ট আসা বন্ধ হবার সঙ্গেসঙ্গেই কুড়িজন প্যারাট্রুপার কমান্ডোর একটা টিমকে এয়ারফিল্ডে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে। উড়াণপথে রামবাসা দ্রুততম গতিতে আধ ঘন্টার পথ। লেফটেন্যান্ট আহমেদের কাছ থেকে কোন প্যানিক সিগন্যাল এলে ঠিক দু মিনিটের মধ্যে টিম এয়ারবোর্ন হবে ম্যাডাম। এই যে ম্যাপটা দেখুন-”

“ধন্যবাদ উইং কমান্ডার” হাতে ধরা ট্যাবের পর্দার দিকে দেখতে দেখতে শীতল মহাজন অন্যমনস্কভাবে বলে উঠলেন। আর ঠিক তক্ষুণি ঝনঝন করে বেজে উঠল মেহতার হাতে ধরে থাকা  টেলিফোনটা। সেটা কানে লাগিয়ে একটু শুনলেন তিনি। তারপর চাপা গলায় কিছু নির্দেশ দিয়ে এদিকে ফিরলেন আবার, “লেফটেন্যান্ট মুস্তাক আহমেদের এসওএস সিগন্যাল রিসিভ করেছে শ্রীনগরের মিলিটারি টেলিকম নেটওয়ার্ক।। চপারগুলো একে একে এয়ারফিল্ড ছাড়ছে এখন। উইশ দেম ওয়েল ম্যা’ম।”

*******

 “প্ল্যানটা ঠিকমত বুঝেছিস তো রঙ্গন?”

“বুঝেছি, বুঝেছি। এত বারবার বলতে হবে না তোকে।” রঙ্গনের হাসি হাসি চিন্তাটা ভেসে এল রঞ্জার মাথায়। সংকেতগুলো দুর্বল। মাঝে বিরাট উঁচু গিরিসংকটটা বাধা সৃষ্টি করছে কিছুটা। এখনো গিরিসংকটের ও’পিঠেই রয়েছে রঙ্গনরা।

“গুড। এবার তাড়াতাড়ি আয়।”

“হচ্ছে দাঁড়া। যতটুকু তাড়তাড়ি হয়।”

যোগাযোগ বন্ধ করল রঞ্জা। রামবাসার এপাশের আইসফলের গা ঘেঁষে সে এখন উড়ে চলেছে হিমবাহের বুকের দিকে। সেখানে, বরফের বুকে মাথা জাগিয়ে থাকা গোল পাথরের চাঁইটার পাশে দীর্ঘকায় মানুষটা দাঁড়িয়ে। গভীর মনোযোগ দিয়ে তার ফাটলের গায়ে হাতের মুদ্রার সংকেত করে চলেছেন। রঞ্জা এসে নামতে কাজটা করতেকরতেই বললেন, “স্বাগতম রেনি।”

“অভিবাদন হে জিভা।”

“এই মানুষটিকে সঙ্গে করে এনেছ কেন? তোমার মানুষ সঙ্গীদের তো গিরিসংকটের ওপারে মৃত্যু হবার কথা।”

রঞ্জা সতর্ক হল। জ্যোতির্ময় ও মুস্তাককে নিয়ে বিশ্বনাথন খাদে ঝাঁপ দেবার সঙ্গেসঙ্গেই বিশ্বনাথনের সঙ্গে মানসিক সংযোগ ছিন্ন করেছিলেন জিভা। তার পরের ঘটনাবলীর ওপর নজর না রেখে তিনি নিজের কাজে ডুবে গিয়েছেন।

“কারণ ইনি এবং অন্যেরা আপনার কাজে আসবে বলে আমার মনে হয়েছে। আমি এঁদের বাঁচিয়েছি। অন্য দুজনকে সঙ্গে নিয়ে র‍্যাং এখন এইদিকে আসছে।”

“কেন? কী কাজে আসবেন এঁরা আমার?”

“এঁদের মধ্যে দু’জন বিশিষ্ট বৈজ্ঞানিক এবং তৃতীয়জন এই উপমহাদেশের সেনাবাহিনীর গুরুত্বপূর্ণ অধিনায়ক। আমাদের দুজনের স্মৃতির সঙ্গেসঙ্গে এদের স্মৃতি নিষ্কাশন করলে তা, মানুষের সভ্যতার অগ্রগতির পূর্ণাঙ্গ মূল্যায়নের পক্ষে সহায়ক হবে বলে আমি মনে করি।”

একটুক্ষণ চুপ করে থাকলেন জিভা। রঞ্জা তার মনের ভেতর গড়ে ওঠা আতংকের শিরশিরানিটাকে কোনমতে আড়াল করছিল। রামবাসা গিরিসংকটের মাথায় নড়াচড়া করা বিন্দুতিনটের দিকে তার নজর আটকে রয়েছে। দ্রুতবেগে এদিকে নেমে আসতে আসতে বড়ো হয়ে উঠছিল বিন্দুগুলো। সেইদিকে ফিরে হাতদুটি ওপরের দিকে তুললেন জিভা। সঙ্গেসঙ্গেই মানুষ তিনজন মাটি ছেড়ে বাতাসে ভেসে উঠেছে। তিরবেগে তাদের দিকে এগিয়ে আসছিল তারা।

দেখতে দেখতে জ্যোতির্ময় ও মুস্তাককে নিয়ে এসে তাদের কাছে বরফ ছুঁল রঙ্গন। গোল পাথরের দিকে ফিরে ফের একবার আঙুলের ইশারা করলেন জিভা। শিসের মত শব্দ উঠছে পাথরের ফাটলটা থেকে। উজ্জ্বল আলোর একটা ধারা সেখান থেকে বের হয়ে অনেকটা জায়গা জুড়ে ঝরে পড়ছিল। তাদের ঘিরে গড়ে তুলছিল একটা অস্বচ্ছ শক্তির দেয়াল। সূর্যের আলো মৃদু হয়ে আসছিল।

রঙ্গন এসে রঞ্জার পাশে দাঁড়াল। একপাশে বরফের ওপরে শুয়ে থাকা ঘুমন্ত বিশ্বনাথনের পাশে  বসে পড়েছেন জ্যোতির্ময় আর মুস্তাক। জিভা জ্যোতির্ময়ের দিকে এগিয়ে গিয়ে তার চোখে চোখ রাখলেন, আর তারপরেই একটা বিস্ময়ের শব্দ করে উঠে ফিরে তাকালেন রঞ্জাদের দিকে। তাঁর হাতের আঙুলের ইশারায়  পাথরের গায়ের ফাটলটা থেকে উজ্জ্বল কয়েকটা আলোকরশ্মি এসে রঙ্গন আর রঞ্জাকে ঘিরে ধরেছে তখন।

সেদিকে তাকিয়ে মুখে একটুকরো হাসি ফুটে উঠল জিভার। এগিয়ে এসে তাদের কপালে দুটো আঙুল ঠেকিয়ে একমুহূর্ত চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলেন তিনি। আশ্চর্য একটা পরিবর্তন আসছিল দুই ভাইবোনের মুখে। আলোকতন্তুর বাঁধনে তারা নড়াচড়া করতে পারছে না তখন। স্থির হয়ে থাকা পাথরের মূর্তির মত মুখদুটোতে আলো নিভে গেছে। তাদের চোখ উপচে জলের ধারা বয়ে যাচ্ছিল গাল বেয়ে।

“তোমাদের সম্পূর্ণ চেতনা ফিরিয়ে দিলাম র‍্যাং ও রেনি। নিজেদের পরিচয় এইবার পুরোপুরি জানতে পেরেছ তোমরা। মানুষের সন্তান, হাঃ। আমাদের কারখানায় তৈরি দুটো যন্ত্রমস্তিষ্ক। এর বেশি কোন পরিচয় নেই তোমাদের।”

র‍্যাং নামের ছোট্ট ছেলেটার ঠোঁটদুটো নড়ে উঠল একবার। কান্নাভেজা গলাটা তার প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল চারপাশে-“বাবা- না, ওর কথায় তুমি বিশ্বাস করবে না কিছুতে। আমি আর দিদিভাই তোমাদের ছেলেমেয়ে বাবা। আমরা তোমার-”

হা হা করে হেসে উঠলেন জিভা। যন্ত্রমস্তিষ্কের এই বিচিত্র আচরণ তাঁকে ভারী আনন্দ দিচ্ছে বোঝা যাচ্ছিল। খানিক পরে তিনি বললেন, “কষ্ট হচ্ছে, তাই না? এইটুকু শাস্তি তোমাদের প্রাপ্য ছিল। আমার কাছ থেকে কিছু গোপন করে চলেছ তোমরা। নিজেদের মনের ওপরে সুরক্ষাবর্ম তৈরি করে রেখেছ এখনও।”

“না জিভা না। আমরা কিছুই গোপন করিনি। আমরা আপনার সৃষ্টি। আমরা-”

“গোপন করোনি? জ্যোতির্ময়ের স্মৃতি তাহলে মিথ্যে বলছে আমায়?  তাছাড়া–ওরা কারা?”

বলতেবলতেই ঘরের দেয়ালে ভেসে উঠেছে বাইরের আকাশের ছবি। সেখানে পাথরটাকে ঘিরে পাক খেয়ে চলেছে ভারতীর সেনাবাহিনীর চারটে সশস্ত্র হেলিকপটার।

“কী করে ওরা এই জায়গার সন্ধান পেল? কী করে তোমাদের  সঙ্গেসঙ্গেই এখানে এসে হাজির হল তার জবাব দাও। কী ভেবেছিলে তোমরা? এই গ্রহের কয়েকটা আদিম যন্ত্র দিয়ে আমার মহড়া নেবে? এই পরিকল্পনাকেই তাহলে লুকিয়ে রেখেছিলে তোমরা তোমাদের মস্তিষ্কে? রেনি ও র‍্যাং শ্রেণীর যন্ত্রমস্তিষ্কেরা এতটা মূর্খ হতে পারে তা আমার ধারণায় ছিল না। তবে হ্যাঁ। এই তিনজন মানুষকে আমার কাছে জীবিত অবস্থায় পৌঁছে দিয়ে তোমরা আমার সুবিধেই করে দিয়েছ। প্রাথমিক যেটুকু আভাস পেয়েছি তাতে এদের পূর্ণাঙ্গ স্মৃতি আমার কাজে আসবে। বিপজ্জনকভাবে প্রযুক্তির উন্নতি ঘটিয়ে চলেছে এরা। আমাদের হিসেবের চেয়ে বহুগুণ বেশি গতিতে। এদের স্মৃতি এইবার মন্ত্রীমণ্ডলীকে আমার প্রস্তাব মেনে নিতে বাধ্য করবে।”

খানিক বাদে রঞ্জা যখন কথা বলল, তখন আশ্চর্য শান্ত শোনাচ্ছিল তার গলা, “আপনি আমাদের ভুল সন্দেহ করেছেন জিভা। মুস্তাক নামে লোকটাকে একটু পরীক্ষা করে দেখুন। এর কাছে একটা যন্ত্র আছে। সে যন্ত্রটা আপনার সুরক্ষাবলয়ের প্রতিরোধ ভেঙে বেতার সংকেত পাঠাতে সক্ষম। এদের সেনাবাহিনীর কাছে খবর আমি পাঠাইনি জিভা। পাঠিয়েছে ওই লোকটা।”

একটু থমকে গেলেন জিভা। তারপর এগিয়ে এসে মুস্তাকের বাহু থেকে তার রিস্টব্যান্ডটা খুলে নিয়ে ঘুরিয়েফিরিয়ে দেখলেন একবার। তারপর মৃদু হেসে বললেন, “একে দিয়েই শুরু হোক তবে—”

 প্রায় সঙ্গেসঙ্গেই মুস্তাক গিয়ে আছড়ে পড়ল গোল পাথরটার গায়ে। পাথরের ফাটল থেকে বের হয়ে আসা স্মৃতিনিষ্কাশকের ধাতব নল একটা সাপের মত হিলহিল করে এগিয়ে যাচ্ছিল তার মাথা লক্ষ করে–

“রঙ্গন—ধর—”

তীব্র মানসিক চিৎকারটা রঙ্গনের সাথে সাথে জিভার মাথাতেও প্রতিধ্বনিত হয়েছিল বুঝি। চমকে ঘুরে তাকাতে গিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু ততক্ষণে দেরি হয়ে গেছে। সদ্য জেগে ওঠা দুটো পূর্ণশক্তির যন্ত্রমনের অপ্রত্যাশিত আক্রমণের সামনে তাঁর একলা প্রতিরোধ ভেঙে পড়তে সময় নিল না বেশি।

মুস্তাকের পাশে তাঁর শরীরটা আছড়ে পড়বার সঙ্গেসঙ্গেই রঞ্জার হাতের ইশারায় ধাতব নলটার মুখ ঘুরে গিয়ে জিভার মাথার সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করেছে। একজটা তীক্ষ্ণ চিৎকার করেই শরীরটা এলিয়ে পড়ল তাঁর–

ধ্যানস্থ ভাইবোনের সমস্ত মনোযোগ তখন কেন্দ্রীভূত হয়েছে স্মৃতিনিষ্কাশক যন্ত্রের দিকে। বহু সহস্রাব্দি ধরে সঞ্চিত জিভার জ্ঞানভান্ডার হাতড়ে চলেছিল তারা কিছু নির্দিষ্ট তথ্যের সন্ধানে–

“দিদিভাই, আমাদের বাঁধন কেমন করে খুলতে হবে আমি তা এখন জানি। এই দ্যাখ–”

পাথরের গোলকের দিকে মুখ ফিরিয়ে আঙুলের কয়েকটা সংকেত করল রঙ্গন। সঙ্গেসঙ্গে অদৃশ্য হল তাদের ঘিরে রাখা আলোর জাল।

“বেশ। হাতে সময় নেই বেশি আর। জিভার চেতনা ফিরে আসবার আগে আমাদের কাজ শেষ করে নিতে হবে। তুই ওর দিকে খেয়াল রাখবি। আমি কয়েকটা দরকারি কাজ সেরে নিই প্রথমে।”

বলতে বলতেই রঞ্জার আঙুলের ইশারায় জেগে উঠল গোলকের শরীরের ফাটল। একটা তীক্ষ্ণ শিসের শব্দ জানিয়ে দিল, নতুন মালিকের আদেশ পালন করতে সে তৈরি।  অবোধ্য যান্ত্রিক ভাষায় দ্রুত কথা বলে চলেছিল রঞ্জার হাতের আঙুল। গোলকের সম্প্রচার ব্যবস্থা তখন তার প্রতিবেদনকে ছুঁড়ে দিচ্ছে দেশকালের সীমা পেরিয়ে গ্যালাক্সির কেন্দ্রীয় অঞ্চলে সম্মিলিত গ্রহমণ্ডলের প্রধান কার্যালয়ের উদ্দেশ্যে।

কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই ফের সাড়া জাগল তার মস্তিষ্কে। জবাব আসছে। মাথা ঠান্ডা করে জবাবি সংকেতটা শুনছিল রঞ্জা। তার ঠোঁটে তখন বিচিত্র একটা হাসি ফুটে উঠেছে।  

ঠিক তখনই একটা তীব্র যন্ত্রণায় তার মস্তিষ্ক অবশ হয়ে এল যেন। ঢলে পড়তে পড়তে সে তাকিয়ে দেখল, মাটিতে পড়ে যন্ত্রণায় ছটফট করছে রঙ্গনও। আর তার পেছন থেকে ধীরে ধীরে চোখ খুলে উঠে বসছেন জিভা।

নড়াচড়ার ক্ষমতা চলে গিয়েছিল তার। উঠে তার সামনে এসে দাঁড়ালেন জিভা, “আমার স্মৃতিকে জেনেছ তোমরা, কিন্তু আমার শক্তি তোমরা কেড়ে নিতে পারোনি। এইবারে এর জন্য শুধু তোমরা নও, শাস্তি পাবে ওই উড়ুক্কু আক্রমণকারীরাও। শাস্তি পাবে এই গোটা গ্রহটাই। তবে তার আগে প্রথমে কয়েকটা কাজ সেরে নিতে হবে।

তাঁর হাতের ইশারায় তখন সরে গেছে চারপাশের শক্তির ঘেরাটোপ। হঠাৎ করেই চঞ্চল হয়ে উঠল চারটে হেলিকপটার। রোটরের গর্জন তুলে অতিকায় প্রাগৈতিহাসিক পোকাদের মত তারা ছুটে আসছিল পাথর ঘিরে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষগুলোর দিকে। তাদের শরীরের নীচে রকেট লঞ্চার জেগে উঠেছে। গাঢ় কমলা রঙের আগুনে ধোঁয়া উগড়ে গোলাকার পাথরটার দিকে ছুটে আসছিল একাধিক উড়ুক্কু বোমা।

জবাবে পাথরের দিকে ঘুরে কয়েকটা সংকেত করলেন জিভা। হেলিকপটার চারটে শূন্যে স্থির হয়ে গেছে। শক্তিশালী রোটরগুলোর তীব্র ঘুর্ণনও তাদের একচুল নড়াতে পারছে না আর। নীল আকাশের পটভূমিতে স্থিরচিত্রের মত ভেসে রয়েছে চারপাশ থেকে ছুটে আসা ক্ষেপণাস্ত্রগুলোও।

“পার্থিব মানুষ, মৃত্যুর আগে জিভার প্রতিশোধের দৃশ্য দেখাব আমি তোমাদের। আমার দুই যন্ত্রদাস যাকে বাঁচাতে চেয়ে আমার হুকুম অমান্য করেছিল প্রথমে তার শাস্তির পালা-” বলতেবলতেই জিভার একটা হাত ঘুরে এসে জ্যোতির্ময়ের দিকে নির্দেশ করল। আস্তে আস্তে বাতাসে ভেসে উঠল জ্যোতির্ময়ের শরীরটা। তীব্র যন্ত্রণায় বেঁকেচূরে যাচ্ছিলেন তিনি।

uponyasbarebare6 (Medium)

তাঁকে সেই অবস্থাতেই রেখে জিভা এইবার মুখ ফেরালেন রঞ্জার দিকে। আর তারপরেই ভ্রুদুটো একটু কুঁচকে উঠল তার। ধীরে ধীরে উঠে বসেছে রঞ্জা। তার যন্ত্রণাকাতর মুখে একটুকরো হাসি ফুটে উঠেছে। এইবার নিঃশব্দে আকাশের দিকে ইশারা করল সে। সেখানে তখন ধীরে ধীরে ফুটে উঠছে একটা অতিকায় মহাকাশযানের শরীর। তার গায়ে সম্মিলিত গ্রহপুঞ্জের নিশানা ঝলমল করছিল পড়ন্ত রৌদ্রের আলোয়—

*******

হেলিকপটারগুলো ফিরে গেছে অনেকক্ষণ আগেই। গত দু ঘন্টা সময়ের কোন স্মৃতিই আর অবশিষ্ট নেই তাদের আরোহীদের মস্তিষ্কে। হয়ত কেউ কেউ তাদের মধ্যে অবাক হবে হারিয়ে যাওয়া খানিকটা সময়কে নিয়ে। তবে এ গ্রহের বিজ্ঞান এখনো তাকে প্রশ্ন করবার মত জায়গায় পৌঁছোয়নি। একটা হিমবাহের ধূ ধূ বুকে গোলাকার একটা নিরীহ পাথরের ছবি ছাড়া আর কিছুই তারা পৌঁছে দিতে পারবে না তাদের সামরিক প্রভুদের কাছে।

বাতাসে স্থির হয়ে ভেসে থাকা আসনটিতে বসা বৃদ্ধ মানুষটি তাদের দিকে ইশারা করলেন, “রেনি ও র‍্যাং, তোমরা আমার কাছে এস।”

তাঁর সামনে এসে হাঁটু গেড়ে বসল দুই ভাইবোন। তারপর মাথা তুলে বলল, “রেনি আর র‍্যাং নয়, আমরা রঞ্জা আর রঙ্গন নামেই পরিচিত হতে চাই মহামান্য।”

“অদ্ভুত অনুরোধ,” মৃদু হাসলেন বৃদ্ধ। তবে জারাফা গ্রহের ধাতুতস্করদের সমস্ত অপরাধের প্রমাণ আমাদের কাছে পৌঁছে দিয়ে তোমরা সম্মিলিত গ্রহপুঞ্জকে যে সাহায্য করেছ তার বিনিময়ে এই অনুরোধটুকু মেনে নিতে আমার আপত্তি নেই। জারাফা গ্রহ যথাসময়ে এই গ্রহকে উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ দেবে। তবে তা ছাড়াও, তোমরা দুজন এই সেবার জন্য কিছু পুরস্কারের দাবিদার হয়েছ। কী চাও বল।”

জবাবে তারা দুজন উঠে গিয়ে ঘুমন্ত জ্যোতির্ময়কে ঘিরে বসল। সেদিকে এক মুহূর্ত তাকিয়ে দেখে বৃদ্ধ বললেন, “একটা আদিম গ্রহের আদিম জীবের সঙ্গে বেঁচে থাকতে চাও তোমরা। বেশ, তাই হবে। তবে তার জন্য একটা মূল্য দিতে হবে যে! তোমাদের মস্তিষ্কে সঞ্চিত নক্ষত্র সভ্যতার সমস্ত স্মৃতি মুছে দেয়া হবে। এই গ্রহের দুজন সাধারণ আদিম মানুষ হয়ে এরপর থেকে বেঁচে থাকতে হবে তোমাদের। ভেবে দেখ। তোমাদের মত দুটি দক্ষ যন্ত্রমস্তিষ্ককে হারানো আমাদের কছে বিরাট ক্ষতি।

জ্যোতির্ময়ের জ্ঞান ফিরে এসেছে ততক্ষণে। দু’হাত বাড়িয়ে তিনি জড়িয়ে ধরেছেন তাঁর দুই ছেলেমেয়েকে। রেনি আর র‍্যাং নামের যন্ত্রদুটি এইবার ফের নতুন করে জড়িয়ে ধরল তাদের বাবাকে। তারপর নিচু গলায় বলল, “আমরাও ঠিক তাই চাই মহামান্য।”

একটুক্ষণ চুপ করে থেকে মাথা নাড়লেন বৃদ্ধ। পাশে দাঁড়িয়ে থাকা একজন সৈনিককে উদ্দেশ্য করে ইশারায় কিছু নির্দেশ দিলেন। তারপর, একটা আলোর ধারা নেমে এসে তাঁকে ভাসিয়ে নিয়ে গেল মাথার ওপরে অপেক্ষায় থাকা সেই বিরাট যানের খোলা দরজার দিকে। তিনজন মানুষ আর দুই জৈবযন্ত্রের চোখে তখন ঘুম নেমে এসেছে। সৈনিকটির হাতে ধরা ছোট্ট একটা যন্ত্র তাদের মস্তিষ্ক থেকে মুছে দিচ্ছিল সমস্ত অপ্রয়োজনীয় স্মৃতিকে। তার বদলে সেখানে গড়ে উঠছে কিছু কৃত্রিম স্মৃতি। কয়েকটা দিনের পাহাড়ভ্রমণের নকল একটা গল্প। নক্ষত্রমণ্ডলের সভ্যতার খবর পাবার সময় এখনো হয়নি এ গ্রহের বুদ্ধিমান জাতির। কিছুকালের মধ্যে তারা নিজেরাই উপযুক্ত হয়ে নিজেদের ক্ষমতায় সদস্য হয়ে উঠবে গ্যালাক্সিজোড়া সেই সভ্যতার—

সম্মিলিত গ্রহপুঞ্জের মহাকাশযান থেকে নেমে আসা তীব্র আলোকধারার আঘাতে তখন চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যাচ্ছিল বিরাট পাথরের গোলক। এ গ্রহের গভীরে গড়ে ওঠা মূল্যবান খনিজ নিষ্কাশণের স্বয়ংক্রিয় কারখানাগুলোও নিঃশব্দে নিশ্চিহ্ন হচ্ছে তখন।

*******

 “বাবা।”

“কে, রঞ্জা? ক’টা বাজে বল তো?”

“সাড়ে সাতটা বাজে। কিন্তু বাইরে এসে দ্যাখো একবার! কী সুন্দর, কী সুন্দর—”

জ্যোতির্ময় বাইরে এসে দাঁড়ালেন। সূর্যের সোনালী আলো ধুইয়ে নিচ্ছে আদিগন্ত ছড়ানো সেই বিশাল হিমবাহকে। দূরে রামবাসা গিরিসংকটের গায়ের আইসফলটা রক্তের রঙ ধরেছে প্রথম সূর্যের আলোয়।

খানিক দূরে বিশ্বনাথন তখন মুস্তাককে ধরে বিজ্ঞানের কিছু একটা জটিল তত্ত্ব বোঝাবার চেষ্টা করছিলেন। তার মুখে অসহায় হাসি লেগে আছে একটা। জ্যোতির্ময় এগিয়ে গেলেন সেদিকে, “কী হে মুস্তাক? আজ পড়াশোনা কতটা এগোলো?”

মুস্তাক করুণ মুখে ঘাড় নাড়ল শুধু একবার।

“আর বেশিদিন এর হাতে কষ্ট সহ্য করতে হবে না তোমায়। ডেরাডান্ডা গোটাও। এবার ফিরতে হবে। বুনো হাঁসের পেছনে ছুটে এতদূর এসে পাওয়া গেল শুধু ফাঁকা একটা হিমবাহ।”

মুস্তাক হেসে মাথা নাড়ল, “না স্যার। এই রামবাসা হিমবাহে আমরাই প্রথম এসে পৌঁছেছি। সেইটা একটা ভালো কৃতিত্ব। তাছাড়া আপনাদের মতন বন্ধু পেলাম—”

রঞ্জা আর রঙ্গন জ্যোতির্ময়ের পেছনে এসে দাঁড়িয়েছিল। তাঁর হাত ধরে টানাটানি লাগিয়েছে দুজন, “ও বাবা, মাকে একটা খবর দিয়ে দাও না যে আমরা এবার ফিরছি!  দুদিন ফোন করা হয়নি। জানোই তো কীরকম টেনশানে থাকে।”

জ্যোতির্ময়ের কাছে স্যাটেলাইট ফোনটা ফিরে এসেছে ফের। সেইটা খুলে নিয়ে তিনি তাতে বাড়ির নম্বরটা টাইপ করতে শুরু করলেন।

uponyasbarebare7 (Medium)

অলংকরণঃ দেবজ্যোতি, মৌসুমী

এই লেখকের আগের উপন্যাস-নরসের

3 thoughts on “পুজোর উপন্যাস বারে বারে আসে দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য শরৎ ২০১৬

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Twitter picture

You are commenting using your Twitter account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s