পুজোর উপন্যাস
মৃগাঙ্ক ভট্টাচার্য
১
ভুলুর দাঁত দিয়ে নখ চিবোবার অভ্যেস আছে। আমার পাশে বসে এখন ভুলু একমনে সেই কাজটাই করছে। এইমাত্র আউট হয়ে এসে শুধু গ্লাভস আর হেলমেটটা খুলেছে। মারাত্মক টেনশনে আছে বলে প্যাড খোলেনি। নখ চিবোতে চিবোতেই আমার দিকে তাকিয়ে ফ্যাসফ্যাসে গলায় ভুলু বলল, শেষ ওভারে ছ’রান লাগে। হ্যাঁ রে চপ্পল, ম্যাচটা বেরোবে তো রে ?
আমার নাম মোটেই চপ্পল নয়, চপল। কিন্তু হতচ্ছাড়া ভুলু কিছুতেই সে নামে ডাকবে না আমাকে। মেজাজটা তিতকুটে হয়ে গেল ভুলুর কথায়। ঠোঁট উল্টে বললাম, জানি না। তুই নিজে ওভাবে আউট হয়ে এলি কেন? তোর উচিত ছিল ম্যাচটা বের করে আনা।
ভুলু খেপচুরিয়াস হয়ে বলল, তুই আমাকে উচিত-অনুচিত শেখাস না চপ্পল। আমি তো তাও হাফ সেঞ্চুরি করে এসেছি কিন্তু তুই তো ডবল ডিজিটেই যেতে পারিসনি। শূন্য করে ওই খাজা বোলারটার বলে বোল্ড হয়ে ফিরে এসেছিস। এখন আবার বড় বড় ঞ্চানের বুলি ঝাড়ছিস ?
আমি প্রতিবাদ করে বললাম, যে বলে আউট হয়েছি সেটা কী বিরাট স্যুইং করল তুই বিশ্বাস করবি না !
ভুলু বলল, স্যুইং না তোর মুন্ডু ! সোজাসাপটা ফুলটস বলে আড়াআড়ি ব্যাট চালিয়ে বোল্ড হয়ে গেলি। একটু সেট না হয়ে কেউ ওভাবে দায়িত্বজ্ঞানহীনের মতো ব্যাট চালায় কখনও ?
আমি রেগে গিয়ে বললাম, তুই তো সেট করে গিয়েছিলি। বাঁ-হাতি স্পিনারটার লাস্ট ওভার চলছিল। খামোখা বোলারটাকে স্টেপ আউট করতে গেলি কেন ?
ভুলু বলল, দোতলার সমান ফ্লাইট দিচ্ছিল বোলারটা। ওই বল স্টেপ আউট না করাটাই অপরাধ হত।
আমি বললাম, সেই দোতলা ফ্লাইটেই তো বোকার মতো স্টাম্পড হয়ে ফিরে এলি। তোর একটু ধৈর্য দেখিয়ে ম্যাচটা বের করে আনা উচিত ছিল। তাহলে শেষ ওভারে তমাল আর বাপ্পার ঘাড়ে চাপ পড়ত না। ওরা আমাদের টেলএন্ডার। ওই দৈত্যের মতো পেসারটার এক ওভারে ছ’রান তোলা কি ওদের কম্ম ?
সবুজ সংঘের প্রেসিডেন্ট সনাতন সাঁতরা টেনশানে পায়চারি করছিলেন। সনাতনকাকুর ছোটভাই খেলাপাগল লোক, আজ সকালেই মাঠে আলাপ হয়েছে। ভদ্রলোকের নাম অনিকেত সাঁতরা। তিনি আমাদের পাশে বসে ম্যাচ দেখছিলেন। অনিকেতকাকু আমাদের থামিয়ে দিয়ে বললেন, তোমরা এখন ঝগড়া করলে টিম স্পিরিট নষ্ট হবে। ভেবো না, আমার মন বলছে ওরা দুজন ঠিক ম্যাচ জিতিয়ে আনবে।
ভুলু কড়া চোখে আমাকে দেখতে দেখতে বলল, চপ্পল, আজ ম্যাচ যদি না জিততে পারি তবে আমি কিন্তু তোকে ধুইয়ে ছাড়ব বলে দিলাম।
আমার আর ভুলুর ঘাড়ের ওপর এসে পড়েছে রাসেল, বাবু, পিন্টু, টিংকু, মিঠুরা। প্রত্যেকের মুখেই ফেটে পড়ছে টেনশান। মহীতোষ মুখার্জি মেমোরিয়াল টি-টোয়েন্টি টুর্নামেন্টের ফাইনাল ডেথ ওভারে এসে পৌঁছেছে। ভুটানের রয়্যাল ওয়ারিয়রস প্রথমে ব্যাট করে করেছিল একশো পঁয়ত্রিশ। আমরা রান তাড়া করতে গিয়ে উনিশ ওভারে একশো ত্রিশে এসে দাঁড়িয়েছি। স্বভাবতই উত্তেজনায় টগবগ করে ফুটছি সকলে।
প্রথম বল গুড লেংথে পড়ে তমাল নড়ার আগেই উইকেটকিপারের হাতে পৌঁছে গেল। আমি জলের বোতল হাতে ছুট দিলাম পিচের দিকে। তমাল দেখলাম ঠোঁট চাটছে বারবার। আমি বললাম, কী রে, কিছু অসুবিধে হচ্ছে ?
তমাল নার্ভাস গলায় বলল, এত জোরে বল বেরিয়ে যাচ্ছে ব্যাট আনার সময় পর্যন্ত পাচ্ছি না। আমার চোখটাই খারাপ হয়ে গেল নাকি রিফ্লেক্সটাই নষ্ট হয়ে গেল কিছুই বুঝতে পারছি না।
আমি সাহস যোগাবার জন্য তমালকে ভোকাল টনিক দিতে যাচ্ছিলাম। দেখলাম রয়্যাল ওয়ারিয়রসের ক্যাপ্টেন কিছু বলল আম্পায়ারকে। সম্ভবত সে কারণেই আম্পায়ার এগিয়ে এসে তাড়া দিলেন আমাকে। আমি জলের বোতল হাতে প্যাভিলিয়নের দিকে ছুট দিতে দিতে বললাম, চোখ বুঁজে ঠাকুরের নাম নিয়ে ব্যাট চালা তমাল। আজ করেঙ্গে ইয়া মরেঙ্গে।
ওভারের দ্বিতীয় বল তমাল বোধ হয় ঠাকুরের নাম নিয়েই ব্যাট চালাল। ব্যাটের একদম কোনায় লেগে বল চলে গেল পিছনের সাইটস্ক্রিনের দিকে। ডিপ থার্ডম্যানের ফিল্ডারের হাত থেকে বল ফেরত আসতে আসতে দৌঁড়ে দুটো রান নিয়ে নিল বাপ্পা আর তমাল।
দর্শকদের চিৎকারে কান ঝালাপালা হয়ে যাচ্ছে। তার মধ্যেই খচর মচর শব্দ কানে এল। চোখ ফিরিয়ে দেখি রাসেল একটা গ্লুকোজের প্যাকেট খুলে মুখে ঢালছে। বিরাট হাঁ-য়ের মধ্যে সাদা সাদা গ্লুকোজের গুঁড়ো ঢুকে পড়ে মুহূর্তে মিলিয়ে যাচ্ছে। মহাভারতে শ্রীকৃষ্ণ নাকি মুখ হাঁ করে অর্জুনকে বিশ্বরূপ দেখিয়েছিলেন। রাসেলের মুখের ব্যাসও দেখলাম খুব ছোট নয়। নিমেষের মধ্যে পুরো প্যাকেটের গ্লুকোজ গলায় ঢেলে দিয়ে ফাঁকা প্যাকেটটা ছুঁড়ে ফেলে দিল রাসেল। আমি ধমকে বললাম,শুধু শুধু গ্লুকোজ খাচ্ছিস কেন ?
রাসেল বিব্রত মুখে বলল, ভীষণ টেনশান হচ্ছে রে। তুই তো জানিস টেনশান হলে আমার খিদেটা বেড়ে যায়। খেলার মাঠে গ্লুকোজ ছাড়া আর তো খাবার মতো কিছু নেই, কী খাব বল ?
আমি রেগেমেগে কিছু বলতে যাচ্ছিলাম। অনিকেতকাকু ইশারায় আমাদের চুপ করে যেতে বললেন। আসলে এখন এমন একটা পরিস্থিতি যে এই তুচ্ছ ব্যাপারে চেঁচামেচি করা শোভা পায় না। রাগটাকে বাধ্য হয়ে গিলে ফেলে মাঠের দিকে মনোসংযোগ করার চেষ্টা করতে লাগলাম।
তমাল আবার অন্ধের মতো ব্যাট হাঁকড়াল। এবার তমালের ব্যাটে বল লাগেনি। লেগেছে গ্লাভসে। ডেথ ওভারে ফিল্ডাররা একটু দূরে দূরে। বাপ্পা দৌড়ে চলে এসেছে এদিকে। তমাল হাঁচোর পাঁচোর করে ছুট লাগাল ননস্ট্রাইকিং এন্ডে। স্কোরবোর্ডে যোগ হল আরও একটা রান।
চতুর্থ বল শর্টপিচ বাউন্সার। বাপ্পা মুখ সরানর সময় পায়নি। বল এসে লেগেছে হেলমেটে। ব্যাট ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে মাটিতে শুয়ে পড়ল বাপ্পা। আমি আর পিন্টু দুজন জলের বোতল আর ব্যথা কমাবার স্প্রে নিয়ে ছুট দিলাম পিচের দিকে।
বাপ্পাকে টেনে তুললাম। হেলমেট খুলে ফেলেছে, চোখ পিটপিট করছে বাপ্পা। মাথা থেকে রক্ত বেরোচ্ছে না, ফুলেও যায় নি কোথাও। বড়সড় চোট নয় দেখে নিশ্চিন্ত হওয়া গেল। পিন্টু ওর পিঠে একটা চাপড় দিয়ে বলল, বাপ্পা, আর দুটো বল বাকি। একটা বাউন্ডারি চাই তোর ব্যাট থেকে। তুই কাপটা শুধু এনে দে আমাদের। সন্ধেবেলা ভবেশদার দোকানে তোকে পেট পুরে চিকেন কাটলেট খাওয়াব।
বাপ্পা আমাদের দিকে ভোম্বলের মতো তাকিয়ে বলল, আপনারা কারা ? আমি এখানে এলাম কীভাবে ?
পিন্টু ভুরু কুঁচকে বাপ্পাকে জরিপ করতে করতে বলল, তুই কি আমাদের সঙ্গে মজা করছিস নাকি ? এটা কি ফাজলামির সময় ?
বাপ্পা কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, মজা করব কেন ? আমি নিজের নাম, বাবার নাম কিছুই মনে করতে পারছি না যে। সত্যি বলছি।
দুজনে বেকুবের মতো বাপ্পার দিকে তাকিয়ে আছি। তমালও ঘাবড়ে গেছে কান্ড দেখে। শুকনো গলায় বলল, মাথায় বল লেগে কি বাপ্পার মাথাটাই খারাপ হয়ে গেল ?
ভুটানের প্লেয়াররা ঘিরে রেখেছে আমাদের। আমাদের কথাবার্তার কিছুই আঁচ করতে পারেনি ওরা। ওদের ক্যাপ্টেন বিরক্ত হয়ে গজগজ করতে করতে আম্পায়ারের কাছে গিয়ে আবেদন জানাল। আম্পায়ার একটু দূরে ছিলেন, এগিয়ে এসে কড়া গলায় আমাকে আর পিন্টুকে মাঠ ছাড়তে বললেন। আমরা দু’জন পায়ে পায়ে ফিরে এলাম বাউন্ডারি লাইনের এপারে।
পিন্টু নিচু গলায় বলল, কী হয়ে গেল বল দেখি ! এখন বাপ্পার বাড়িতে কী জবাব দেব আমরা ?
আমি পিন্টুকে ফিসফিস করে বললাম, আমাদের পাশের ফ্ল্যাটে একজন ভাল সাইকিয়াট্রিস্ট আছেন। বাপ্পাকে সন্ধেবেলা ওঁর কাছে নিয়ে যেতে হবে। দেখা যাক উনি কী বলেন।
আমি আর পিন্টু নিচু স্বরে কথা বলাবলি করছিলাম। স্টেডিয়ামের দর্শকদের তুমুল চিৎকারে সকলে ঘাড় ঘোরালাম মাঠের দিকে। ওভারের পঞ্চম বল করতে আসছে ভুটানের সাংঘাতিক বোলারটা। ভুলু, বাবু, রাসেলরা বাপ্পার অবস্থা জানে না। তাই ওরা চেঁচাচ্ছে, ছক্কা, ছক্কা !
পিন্টু আমার পাশে দাঁড়িয়ে আবছা গলায় বলল, এত কাছে এসেও জেতা হল না। ওদিকে বাপ্পার মাথাটাও গেল। এখন যে কী হবে !
ওভারের পঞ্চম বল আবার বাউন্সার দিয়েছে পেস বোলারটা। আবার লেগেছে বাপ্পার মাথায়। মাথা থেকে নীল হেলমেট খুলে ছিটকে গিয়েছে পিচের বাইরে। মাথা ধরে হাঁটু গেড়ে বসে পড়েছে বাপ্পা।
জলের বোতল আর পেন রিলিফ স্প্রে হাতে আমি আর পিন্টু আবার ছুটলাম পিচের দিকে। ততক্ষণে ননস্ট্রাইকার তমাল হেলমেটটা কুড়িয়ে এনে ফেরত দিয়েছে বাপ্পার হাতে। আমরা সামনে যেতেই বাপ্পা একদম স্বাভাবিক গলায় জলের বোতলের দিকে হাত বাড়িয়ে বলল, দে জলটা দে। ভয় পাস না, আমার কিচ্ছু হয়নি।
পিন্টু কী একটা বলতে যাচ্ছিল, বাপ্পা খানিকটা জল খেয়ে বোতলটা আমার হাতে ফিরিয়ে দিয়ে বলল, আগের বলটা মাথায় লেগে কেমন গুলিয়ে গিয়েছিল সব। কিন্তু এই বলটা মাথার ওই একই জায়গায় লাগায় সব আবার মনে পড়ে গিয়েছে। টেনশান করিস না, আমি একদম ঠিক আছি। শেষ বলে এসপার কি ওসপার ব্যাট চালাচ্ছি। যদি কানেক্ট করে দিতে পারি তবে কেল্লা ফতে!
আমি আর পিন্টু গুটিগুটি ফিরে এসেছি। আমি বললাম, ব্যাপারটা কী হল বল তো?
চিন্তিত মুখ করে পিন্টু বলল, হিন্দি ছবিতে দেখিস না মাথায় বড়সড় আঘাত লেগে নায়ক সবকিছু ভুলে যায়, আবার একই জায়গায় চোট পেলে সব পুরনো স্মৃতি ফিরে আসে ? এটাও মনে হচ্ছে সেরকম ব্যাপার।
আমি বললাম,যাহ্, এরকম হয় নাকি !
পিন্টু বলল, হয় রে হয়। শেক্সপিয়ার কী বলেছিল মনে নেই ? সেই যে – দেয়ার আর মোর থিংস ইন হেভেন অ্যান্ড আর্থ হোরাশিও .. । মানে এমন অনেক কিছুই ঘটে যার কোনও ব্যাখ্যা নেই।
আমি মুখটা বাংলার পাঁচ করে বললাম, খেলার মাঠে শেক্সপিয়ার কপচাচ্ছিস কেন ? ইংরেজিতে হায়েস্ট মার্কস পাস বলে কথায় কথায় ইংরেজি বুলি ফোটাস। তাই না?
পিন্টু চুপ করে গেল। ওদিকে দর্শকদের চিৎকারের পারদ বাড়ল। ঝগড়া থামিয়ে মাঠের দিকে তাকিয়ে দেখি বাপ্পা স্টান্স নিয়েছে। ওভারের শেষ বল করতে ভুটানের দীর্ঘদেহী বোলারটা এসে পড়েছে আম্পায়ারের ঘাড়ের কাছে।
প্রচন্ড গতির বল গুড লেংথে পড়েছিল। আবার মাথায় লাগতে পারত বাপ্পার। কিন্তু বলটা মাথায় লাগেনি, লেগেছে বাপ্পার ব্যাটে। বাপ্পা হাঁটু গেড়ে বসে ব্যাট চালিয়ে দিল। ব্যাটের ঠিক জায়গায় বল লাগলে একটা মিঠে শব্দ হয়। সেই মিষ্টি শব্দটা কানে এল এত দূর থেকেও। লাল বলটা স্কোয়ার লেগ বাউন্ডারির উপর দিয়ে উড়ে গিয়ে স্টেডিয়াম ছাড়িয়ে রাস্তায় গিয়ে পড়ল।
রাসেল, টিংকু, মিঠু ভুলুরা সব ছুটল মাঠের দিকে। সকলে বাপ্পাকে কাঁধে করে তুলে নিয়ে এল আমাদের টেন্টে। দর্শকরা ছুটে এসেছে আমাদের তাঁবুতে। বাপ্পাকে জড়িয়ে ধরছে সকলে। খুশিতে মাখামাখি বাপ্পার মুখচোখ। বাপ্পা পিন্টুকে জড়িয়ে ধরে বলল, সন্ধেবেলা ভবেশদার দোকানে চিকেন কাটলেট খাওয়াবি বলে কথা দিয়েছিলি, সেটা মনে আছে তো?
পিন্টু স্বস্তির শ্বাস ফেলে বলল, যত খুশি কাটলেট খা তুই। আমরা ট্রোফি জিতেছি সেটায় যতটা না আনন্দ হচ্ছে তোর যে মাথার গোলমালটা সেরে গেছে সেটায় আরও বেশি আনন্দ হচ্ছে।
পুরস্কার বিতরণ শুরু হল। ভুলু হল ম্যান অফ দ্য ম্যাচ। বাপ্পাকে একটা স্পেশাল প্রাইজ দিলেন টুর্নামেন্টের উদ্যোক্তারা। উইনার্স কাপ নেওয়ার জন্য আমাকে মঞ্চে ডাকতেই হইহই করে টিমের বাকিরা উঠে পড়ল মঞ্চে। সবুজ সংঘের বেশ কিছু হাফ প্যান্ট পরা স্কুলপড়ুয়া সমর্থক ছিল মাঠে। তুবড়ি আর রংমশাল নিয়ে এসেছিল তারা। সেসব পোড়ানো হল যথেচ্ছ। বিরাট কাপ সামনে রেখে গ্রুপ ফোটো তুললাম সকলে। সনাতনকাকু হেসে বললেন, আমার ভাই অনিকেত তোমাদের কিছু বলতে চায়।
অনিকেতকাকু স্মিতমুখে বললেন, আমি পুলিশ সার্ভিসে আছি। আমার পোস্টিং এখন রংঝুরি থানায়। সেখানে দুর্দান্ত একটা টি-টোয়েন্টি টুর্নামেন্ট শুরু হয়েছে গতবার থেকে। গতবার বাঘা বাঘা সব টিম খেলে গিয়েছে ওখানে। রংঝুরির উদ্যোক্তাদের সঙ্গে একটু আগেই মোবাইলে কথা হয়েছে আমার। সামনের মাস থেকে শুরু হচ্ছে রংঝুরি টি-টোয়েন্টি। ওরা তোমাদের আমন্ত্রণ জানিয়েছে খেলার জন্য।
পিন্টু চোখ বড়ো বড়ো করে বলল, আমাদের ডেকেছে ওরা ?
অনিকেতকাকু ঘাড় ঝাঁকিয়ে বললেন, হ্যাঁ। কী, তোমরা খেলতে আসবে তো রংঝুরিতে?
আমরা একসঙ্গে ঘাড় নেড়ে দিলাম। অনিকেতকাকু হাসলেন, গুড দেন।
সনাতনকাকু পাশ থেকে বললেন, শুধু প্লেয়াররা যেতে চাইলেই তো হবে না, কর্মকর্তাদেরও মতামত নিতে হবে। কাল একটা সাধারণ সভা ডাকতে হবে ক্লাবে। সেখানেই রংঝুরি যাওয়া নিয়ে সিদ্ধান্ত নেব আমরা।
উৎসাহে ঠান্ডা জল পড়ায় আমাদের মুখ শুকিয়ে গেল একটু। সনাতনকাকু সেটা লক্ষ করে বললেন, কালকের কথা কালকে। আজ ফাইনালে জিতেছ, আগে সেটার তো জমিয়ে সেলিব্রেশন করতে হবে। কাপ জেতার অনারে আজ সন্ধেবেলা আমার বাড়িতে তোমাদের সকলের নেমন্তন্ন। কী হল, খুশি তো তোমরা?
সনাতনকাকু ব্যায়ামের চর্চা করেন এখনও। এই বয়সেও খাজা কাঁঠালের মতো মাসল, গুলি পাকানো জবরদস্ত চেহারা। নিজে যেমন খাদ্যরসিক তেমনি খাওয়াতেও ভালবাসেন। ওঁর বাড়ির নেমন্তন্ন মানে এলাহি ব্যাপার। সেখানে চর্ব-চোষ্য-লেহ্য-পেয় কিছুই বাদ যায় না। ওদিকে রাসেলও যাকে বলে ভোজনরসিক। এক সাধুবাবার দেওয়া জড়িবুটি খেয়ে খিদে বেড়ে গেছে রাসেলের, আজকাল সব সময় পেটে ব্রহ্মা খাইখাই করছেন। আমরা কিছু বলার আগেই রাসেল চিৎকার করে উঠল, খুউউশি !
২
সনাতনকাকুর বিশাল ছাদে খেতে খেতে গল্প হচ্ছে এলেমেলো। শুধু রাসেল কথা বলছে না, একমনে খেয়ে চলেছে। পরোটা দিয়ে পাঁঠার মাংস হল ওর প্রিয় মেনু। তাই কথা বলে সময় নষ্ট না করে রাসেল লেগে পড়েছে মাংস-পরোটার সৎকারে।
আমি অনিকেতকাকুর পাশে বসেছি। ভদ্রলোকের বয়স পঞ্চাশের আশপাশ দিয়ে। বিয়ে করেননি। ছোট ছোট করে ছাঁটা চুল, ছিপছিপে মেদহীন চেহারা। ওঁকে বললাম, তখন সনাতনকাকুর মুখে শুনলাম আপনি নিজে এককালে ভাল ক্রিকেটার ছিলেন।
অনিকেতকাকু ঘাড় নেড়ে বললেন, খুব খারাপ খেলতাম না। কলকাতা ফার্স্ট ডিভিশনে খেলেছি অনেকদিন। কিন্তু পুলিশের চাকরিতে ঢুকে আমাকে ক্রিকেট ছাড়তে হল। তবে ক্রিকেটের প্রতি ভালবাসাটা কিন্তু থেকেই গিয়েছে। অফিসের একটা কাজে জলপাইগুড়ি এসেছিলাম দু’দিনের জন্য। আজ দাদার টিমের ফাইনাল ম্যাচ আছে শুনে সব কাজ ফেলে মাঠে গিয়েছিলাম খেলা দেখতে।
বাবু বলল, আমাদের খেলার স্ট্যান্ডার্ড কেমন বুঝলেন?
অনিকেতকাকু বললেন, দ্যাখো, আমি বলব যথেষ্ট ভাল করছ তোমরা। আরও একটু যদি লেগে থাকো, আমার বিশ্বাস একদিন তোমাদের এখান থেকেও দারুণ দারুণ প্লেয়ার বেরোবে।
টিংকু দুঃখ করে বলল, আমরা ডুয়ার্সের যেসব জায়গায় খেলে বেড়াই সব এলেবেলে টুর্নামেন্ট। কিন্তু সত্যিকারের উঁচু লেভেলের প্লেয়ারদের বিরুদ্ধে খেলে নিজেদের যোগ্যতা যাচাই করে নেবার সুযোগ জোটেনি কখনও।
অনিকেতকাকু হেসে বললেন, বাঘা বাঘা খেলোয়াড়দের সঙ্গে লড়তে চাইলে তোমাদের রংঝুরিতে টি-টোয়েন্টি টুর্নামেন্ট খেলতে যেতে হবে।
রাসেল পাঁঠার মাংসের হাড় চুষতে চুষতে বলল, রংঝুরি জায়গাটার নাম তো শুনেছি বলে মনে পড়ছে না।
অনিকেতকাকু বললেন, ডুয়ার্স আর ভুটান যেখানে এসে মিশেছে রংঝুরি হল সেখানে। পাহাড়ের কোলে ছোট্ট এক জনপদ। খুব কাছেই অসম সীমান্ত। ছবির মতো জায়গা। একদিকে যেমন পাহাড় আর নদী রয়েছে তেমনি রয়েছে চা-বাগান আর গভীর জঙ্গল। যে লোক জীবনে কখনও কবিতা লেখেনি সে-ও মনে হয় কবিতা লিখে ফেলবে রংঝুরিতে গেলে।
তমাল আগ্রহী হয়ে বলল, রংঝুরি টি-টোয়েন্টিতে কোন কোন টিম এসেছিল গতবার ?
অনিকেতকাকু বললেন, সিকিম, ভুটান, দার্জিলিং, অসম থেকে টিম এসেছিল। এবার পটনা থেকেও একটা টিম আসবে খেলতে। প্রাইজ মানিও বাড়িয়ে করা হয়েছে এক লক্ষ টাকা। সেজন্য বলছিলাম রংঝুরিতে খেলতে গেলে তোমাদের একটা দারুণ অভিজ্ঞতা হবে।
মিঠু জানতে চাইল, ওখানে খেলতে গেলে খরচের ব্যাপারটাও তো কম নয়, তাই না?
অনিকেতকাকু বললেন, থাকা-খাওয়ার দায়িত্ব আয়োজকদের। তবে টুর্নামেন্টের এনট্রি-ফি পাঁচ হাজার টাকা। এদিকে আবার যাতায়াত খরচটা অংশগ্রহণকারী দলকে বহন করতে হবে, সেটাই নিয়ম। রংঝুরি জায়গাটা একটু রিমোট, তাই গাড়ি ভাড়া করে যেতে হবে তোমাদের। সে খরচটাও কম হবে না।
ভুলু চওড়া হেসে বলল,ট্রোফি জিততে পারলে সেই টাকা দিয়েই সব খরচ মিটিয়ে দেওয়া যাবে। কী বলিস চপ্পল?
আমি গলায় বিরক্তি মিশিয়ে বললাম, শুনলি তো কী সব টিম খেলবে রংঝুরিতে। ওখানে চ্যাম্পিয়ন হওয়া কি মুখের কথা নাকি?
অনিকেতকাকু বললেন, চপল ঠিকই বলেছে। ব্যাপারটা অত সহজ নয়। এদিকে যেসব টিমের সঙ্গে খেলে অভ্যস্ত তোমরা তার তুলনায় অনেক রাফ অ্যান্ড টাফ টিমের সঙ্গে খেলতে হবে ওখানে।
তমাল বলল, কঠিন টিমের সঙ্গে চ্যালেঞ্জ নেবার মধ্যেই তো মজা। বড় জোর হারব। কিন্তু জানতে পারব আমরা ঠিক কতটা যোগ্য।
অনিকেতকাকু সায় দিয়ে বললেন, এটা একদম ঠিক কথা বলেছ।
সনাতনকাকু হাসলেন, এবার ভাল জায়গাতেই পোস্টিং হয়েছে তোর। ওখানে ক্রাইম-টাইম কিছু নেই, তোর কাজের চাপও নেই। খেলাধুলো নিয়ে বেশ আছিস। প্রকৃতির কাছাকাছি থাকতে থাকতে কবিতাও লিখতে শুরু করেছিস হয়তো। তাই না রে?
অনিকেতকাকু বড় একটা শ্বাস ছেড়ে বললেন, ক্রাইম নেই এরকম জায়গা ভূ-ভারতে খুঁজে পাওয়া মুশকিল। রংঝুরি এমনিতে ঠান্ডা জায়গা। চুরি-ডাকাতি নেই বললেই চলে। তবে কয়েক মাস হল কিছু কিছু গোলমেলে ব্যাপার ঘটতে শুরু করেছে শান্তশিষ্ট রংঝুরিতে।
সনাতনকাকু কৌতূহলী স্বরে বললেন, কী রকম গোলমেলে ব্যাপার শুনি?
অনিকেতকাকু বললেন, এর মধ্যে কবর খুঁড়ে একটা ডেডবডি চুরি হয়েছে। ওদিকে আবার শ্মশানে দাহ করতে আসা একটা বেওয়ারিশ লাশও গায়েব হয়ে গেছে। এগুলোর মধ্যে কিছু যোগসূত্র আছে বলেই সন্দেহ করছি আমরা। জলপাইগুড়ির পুলিশ সুপার সে ব্যাপারেই আমাকে তলব করে একটা রিপোর্ট চেয়েছিলেন। শান্তশিষ্ট রংঝুরিতে তলে তলে একটা হাড়বাজার চলছে বলে সন্দেহ করছে প্রশাসন।
সনাতনকাকুর মুখ থেকে বেরিয়ে এল, হাড়বাজার ? সে আবার কী জিনিস ?
অনিকেতকাকু বললেন, ব্যাপারটা গোড়া থেকে বলি। গত দুশো বছর ধরে দুনিয়ার ডাক্তারি বাজারে হাড় জোগানের কেন্দ্র হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় ছিল আমাদের ভারতবর্ষ। ১৯৮৫ সালে ভারত সরকার মানুষের দেহাবশেষের ব্যাবসানিষিদ্ধ বলে ঘোষণা করে। ফলে দুনিয়া জুড়ে কঙ্কালের জোগান মুখ থুবড়ে পড়ে। তখন বাধ্য হয়ে পশ্চিম পৃথিবী চিন আর পূর্ব ইওরোপের দ্বারস্থ হয়েছিল।
আমরা মন দিয়ে অনিকেতকাকুর কথা শুনছি। অনিকেতকাকু বললেন,কিন্তু ওরাও ভারতের মতো এত হাড়ের জোগান দিতে পারল না। আসলে ভাল করে কঙ্কাল পালিশ করে, জোড়গুলোকে ঠিক মতো বেঁধে জোগান দেওয়ার দক্ষতা সব দেশের নেই। তাই ওই নিষেধাজ্ঞার পরও এই ব্যবসাটা যে আমাদের দেশ থেকে পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেছে সেটা মনে করার কোনও কারণ নেই। বরং এখন চোরাপথে অনেক বেশি দামে রমরমিয়ে এই ব্যাবসা চলছে।
সনাতনকাকু বললেন, কীভাবে এই ব্যাবসা চলছে?
অনিকেতকাকু বললেন, এখনও কিছু হাড় ব্যবসায়ী সেই চেনা রুটেই ব্যাবসা করে চলেছে। এরা মৃতদেহ চুরি করিয়ে কিংবা বেওয়ারিশ লাশ জোগাড় করে মাংস আর হাড় আলাদা করে কঙ্কালগুলো পাঠিয়ে দিচ্ছে ডিলারদের কাছে। তারা সেই কঙ্কালগুলোকে পালিশ করে জোড় লাগিয়ে বিদেশে পাচার করে দিচ্ছে। এভাবে চোরাপথে কিছু লোক কামিয়ে নিচ্ছে কোটি কোটি ডলার।
সনাতনকাকু বললেন, কী বলছিস তুই! রংঝুরির মতো জায়গাতেও কি এই র্যাকেট তলে তলে কাজ করতে শুরু করেছে?
অনিকেতকাকু গম্ভীর হয়ে বললেন, আঁচ করছি সেটা। কিন্তু কোনও প্রমাণ এখনও হাতে আসেনি। সেজন্য আমরা চোখ কান খোলা রাখছি। ইনফরমার লাগিয়েছি, নিজেরাও তল্লাশি করছি যেখানে সন্দেহ হচ্ছে। কিন্তু এখনও সেই অন্ধকারেই রয়েছি।
ভুলু ভয়ে ভয়ে বলল, আমরা ওখানে খেলতে গিয়ে বিপদে পড়ব না তো আবার?
অনিকেতকাকু বললেন, তোমরা ওখানে খেলতে যাবে, শুধু খেলা নিয়ে ভাববে। এসব জিনিস নিয়ে ভাবনাচিন্তা করার জন্য পুলিশ আছে। রংঝুরি টি-টোয়েন্টির মতো ঝলমলে ক্রিকেট টুর্নামেন্ট খেলার সুযোগ কিন্তু প্রতিদিন তোমাদের কাছে আসবে না। ওখানে ভাল পারফর্ম করতে পারলে তোমাদের নাম ছড়িয়ে যাবে সারা রাজ্যে। এমনকী, ভিনরাজ্যের প্লেয়াররাও তোমাদের চিনে ফেলবে একডাকে। কী, কেমন হবে সেটা?
সনাতনকাকু বললেন, ঠিক আছে, কাল তো ক্লাবের সাধারণ সভা ডাকা হয়েছে। কাল আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে এ ব্যাপারে।
৩
সন্ধেবেলা সবুজ সংঘের ক্লাবঘরে এত চিৎকার চেঁচামেচি চলছে যে কান পাতাই দায়। ক্লাবের প্রত্যেক সদস্য তো আছেই, গবাদাদু, ডাকুকাকু, হিগিনজেঠুরা সকলে আছেন মিটিংয়ে। আছেন আমাদের প্রেসিডেন্ট টলিউডের বিখ্যাত হিরো সৈনিকের বাবা সনাতন সাঁতরা। আজকের মিটিংয়ের আজেন্ডা অবশ্য একটাই। সবুজ সংঘের ফান্ড এখন ম্যালেরিয়ায় ভোগা রুগির মতো দুর্বল। এই অবস্থায় ক্লাবকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে আমরা রংঝুরিতে খেলতে যাব কিনা। সেটা নিয়েই আজকের সভা।
সনাতনকাকু আমাকে প্রথমে বলতে বললেন। আমি বললাম, গত কয়েক বছর ধরে জলপাইগুড়ির বাইরে ডুয়ার্সের এদিকে ওদিকে কিছু টুর্নামেন্ট খেলে ট্রোফি জিতেছি কিছু। কিন্তু উত্তরবঙ্গের বাইরের দলগুলোর সঙ্গে খেলে শক্তি পরীক্ষা করা হয়নি নিজেদের। আমাদের প্রত্যেকেই তাই রংঝুরিতে আন্ডার নাইনটিন টি-টোয়েন্টি টুর্নামেন্ট খেলতে যাবার জন্য মুখিয়ে আছে।
হিগিনজেঠুর ছোটবেলা থেকে সাধ ছিল জাঁদরেল ব্যারিস্টার হয়ে কথার মারপ্যাঁচ দিয়ে কোর্টে জজসাহেবকে মুগ্ধ করে দেবেন। কিন্তু বেশ কয়েকবার চেষ্টা করেও আইন পরীক্ষায় পাশ করতে পারেননি। তাই ওকালতিকে পেশা হিসাবেও নেওয়া হয়নি। সেই দুঃখ থেকেই সম্ভবত শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষা কালো কোট গায়ে দিয়ে থাকেন হিগিনজেঠু। আজও কালো প্যান্টের সঙ্গে কালো কোট পরে রয়েছেন। এমনিতেই হিগিনজেঠুর গায়ের রং বেজায় কালো। ক্লাবঘরের মৃদু আলোতে কালো কোটপ্যান্ট পরা হিগিনজেঠুকে অদ্ভুত দেখাচ্ছে।
হিগিনজেঠু গলা খাঁকারি দিয়ে বললেন, রংঝুরিতে গিয়ে নিজেদের শক্তি পরীক্ষা করে আসার যে ইচ্ছে প্লেয়ারদের হয়েছে তাতে দোষ নেই। কিন্তু একটা সমস্যা আছে। প্রথমত টুর্নামেন্টের এনট্রি ফি হল পাঁচ হাজার টাকা। রংঝুরিতে রেলস্টেশন নেই, ওই রুটে বাস-টাসও চলাচল করে না। কাজেই সেখানে যেতে গেলে একটা গাড়ি রিজার্ভ করতে হবে আমাদের। এমনিতেই এখন সবুজ সংঘের ভাঁড়ে মা ভবানী ওদিকে টুর্নামেন্ট খেলতে গেলে হাতির খরচ। কাজেই আমি এত গন্ডা টাকা খরচ করে রংঝুরিতে যাবার কোনও কারণ খুঁজে পাচ্ছি না।
দিনবাজারে ঢোকার ঠিক মুখটায় ডাকুকাকুর কবিরাজি দোকান। ডাকুকাকুর বাবা দক্ষিণারঞ্জন আয়ুর্বেদাচার্য নামী চিকিৎসক ছিলেন। তিনি আর নেই, তাঁর অবর্তমানে ডাকুকাকুই এখন রুগি দেখেন। বিভিন্ন গাছের পাতা আর শিকড় বেটে ওষুধ দেন। সেসব পাঁচন খেলে রোগ সারে কিনা জানা নেই, তবে অন্নপ্রাশনের ভাত যে উঠে আসে তাতে সন্দেহ নেই। সকাল থেকে রাত অবধি ভিড় থাকে ওঁর চেম্বারে। সেটা অবশ্য রুগির ভিড় নয়, আড্ডা মারতে আসা বয়স্ক লোকজনের ভিড়।
ডাকুকাকু বললেন, রংঝুরিতে জঙ্গল আছে যখন তখন মশার উপদ্রব আছে নিশ্চয়ই। সেখানে খেলতে গেলে ছেলেদের কালাজ্বর, ডেঙ্গু কিংবা চিকুনগুনিয়া একেবারে অবধারিত। তাছাড়া ওটা পাহাড়ি এলাকা। এই শীতের মধ্যে ওখানে গেলে ঠান্ডা লেগে হুপিং কাশিও হতে পারে। পিলেজ্বর বাধিয়ে আসাও বিচিত্র নয়। সবুজ সংঘের রংঝুরিতে খেলতে যাওয়ার ব্যাপারটা স্বাস্থ্যের দিক দিয়ে ভাবলে মোটেই সমর্থনযোগ্য নয়।
গবাদাদুর বাবা রামমাণিক্য শিরোমণি ছিলেন এই শহরের বিশিষ্ট জ্যোতিষী। গবাদাদু নিজে ছিলেন স্কুলমাস্টার। অবসর নেওয়ার পর শখে জ্যোতিষচর্চা করেন। একটা চেম্বারও খুলেছেন কদমতলার মোরে। কিন্তু ভবিষ্যদ্বাণী মেলে না বলে লোকজন বড় একট আসে না। গবাদাদু বললেন, সবুজ সংঘের সামনে এখন একটা কেমদ্রুম যোগ আছে। এখন রংঝুরিতে খেলতে গেলে প্রথম ম্যাচেই গোহারান হেরে ফিরে আসতে হবে আমাদের। তবে যজ্ঞ করে মন্দ দশাটা কাটিয়ে নিলে টিম চ্যাম্পিয়ন হয়ে ফিরবে।
সনাতনকাকু অবাক হয়ে বললেন, শব্দকল্পদ্রুম শুনেছি। কেমদ্রুম তো কখনও শুনিনি। সেটা আবার কী ?
পাশ থেকে ডাকুকাকু ঠোঁট উল্টে বললেন, গবাবাবুর বাবা রামমাণিক্য শিরোমণি ছিলেন ত্রিকালজ্ঞ জ্যোতিষী। যা বলতেন অক্ষরে অক্ষরে মিলত। কিন্তু গবাবাবু বাবার থেকে কিছুই পাননি। সেজন্য ওঁর কথায় অত গুরুত্ব দেবেন না সনাতনবাবু। ওঁর ভবিষ্যদ্বাণী আজ অবধি কখনও মেলেনি।
গবাদাদু রুষ্ট গলায় বললেন, কেন ? কোন ভবিষ্যদ্বাণীটা মেলেনি শুনি ?
ডাকুকাকু মুখের একটা ভঙ্গি করে বললেন, কোনওটাই তো মেলেনি। খালপাড়ার গদাধর ঢোলের কেসটা একটু সমরণ করে দেখুন। গতবার গদাধর ভোটে দাঁড়িয়ে আপনার কাছে কোষ্ঠীবিচার করাতে গিয়েছিলেন। আপনি ভদ্রলোককে বলেছিলেন প্রচার আর জনসভা করে সময় নষ্ট না করে বাড়ি গিয়ে নাকে তেল দিয়ে ঘুমোতে। উনি নাকি জিতেই গেছেন একরকম। কিন্তু রেজাল্ট বেরোবার পর দেখা গেল গদাধর ঢোল শুধু হেরেছেন তাই নয়, ভদ্রলোকের জামানত জব্দ হয়ে গিয়েছে !
গবাদাদু বাধা দিয়ে বললেন, উঁহু, ঘটনাটা তা নয়। আসলে গদাধর ঢোল আমাকে জন্মসময় ভুল বলেছিল। কাজেই ভবিষ্যদ্বাণী না মেলাটা আমার দোষ নয়। গদাধরের দোষ।
ডাকুকাকু খুকখুক করে হেসে বললেন, উদাহরণ নম্বর দুই, পান্ডাপাড়া কালীবাড়ির হারু সাহা। বেচারি চায়ের দোকান চালায়, গরিব মানুষ। বছর দশেক আগে আপনি তার ঠিকুজি বিচার করে বলেছিলেন লটারি পেয়ে কোটিপতি হবার নাকি প্রগাঢ় সম্ভাবনা আছে তার। আপনার কথা শুনে লটারির টিকিট কাটা শুরু করেছিল হারু। গত দশ বছর ধরে লটারির টিকিট কেটে ফতুর হয়ে গেল বেচারি। কোটি টাকা তো দূর, একশো টাকাও লটারিতে জেতেনি কখনও।
গবাদাদু পাঞ্জাবির পকেট থেকে নস্যির ডিবে বের করে নাকে দুই টিপ নস্যি নিয়ে নিরুদ্বিগ্ন স্বরে বললেন, জিতবে, জিতবে। বলেছি যখন তখন নিশ্চয়ই লটারি জিতবে। এসব কাজে অত তাড়াহুড়ো করলে চলে নাকি ? আরও দু’-দশ বছর যাক। তারপর মিলিয়ে নেবেন’খন।
ডাকুকাকু পাল্টা কিছু বলতে যাচ্ছিলেন। ক্লাবের প্রেসিডেন্ট সনাতন সাঁতরা সবাইকে হাত দিয়ে থামতে ইশারা করে বললেন, হিগিনবাবুর কথা প্রসঙ্গে বলি, আমাদের প্লেয়াররা যখন এত আগ্রহ করে রংঝুরি টি-টোয়েন্টি খেলতে যেতে চাইছে তখন ওদের ইচ্ছেটাকে আমি দাম দিতে চাই। খরচ নিয়ে আপনাদের ভাবনার কিছু নেই। ওটা আমার দায়িত্ব। আমি এই মিটিংয়ে ঘোষণা করছি আমাদের সবুজ সংঘ রংঝুরি টি-টোয়েন্টি খেলতে যাবে। চপলই থাকবে টিমের ক্যাপ্টেন। টুর্নামেন্টে খেলতে যাওয়ার যাবতীয় খরচ আমার হনুমান কনস্ট্রাকশনস বহন করবে।
রাসেল আনন্দে লাফিয়ে পড়ল ভুলুর ঘাড়ে। ভুলু কঁকিয়ে উঠেও হাততালি দিয়ে উঠল খুশিতে। আমরাও সমস্বরে হৈ হৈ করে উঠলাম। রংঝুরি যাওয়াটা যে শেষ পর্যন্ত হতে চলেছে সেটা ভেবে এখন থেকেই আত্মহারা আমরা সকলে।
গবাদাদু গলা খাঁকারি দিয়ে বললেন, একটা সমস্যা আছে সনাতনবাবু। আমি সারা রাত জেগে সবুজ সংঘের কোষ্ঠীবিচার করেছি। তাতে দেখেছি এক সর্বনাশা প্রতিকূল পরিস্থিতি আমাদের ক্লাবের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। শনি সাংঘাতিক রকম কূপিত হয়ে রয়েছেন।
সনাতনকাকু তাকিয়ে আছেন গবাদাদুর দিকে। বললেন, সেই কূপিত শনিকে শান্ত করার কোনও উপায় আছে কি?
গবাদাদু খুব উৎসাহ নিয়ে বললেন, বিলক্ষণ আছে। শনিকে সন্তুষ্ট করার জন্য সবুজ সংঘের জার্সির রং পাল্টে নীল করে দিতে হবে। আরও ভাল রেজাল্ট পেতে গেলে প্রত্যেকটা প্লেয়ার না হোক, অন্তত ক্যাপ্টেনকে নীলকান্ত মণির আংটি ধারণ করাবার ব্যবস্থা করুন।
ডাকুকাকু চোখ কপালে তুলে বললেন, নীলকান্ত মণির তো অনেক দাম !
গবাদাদু বললেন, নীলকান্ত মণির দাম একটু বেশি। তার অভাবে শ্বেত বেড়েলা বা নীল অপরাজিতার মূল দিয়েও কাজ চলতে পারে।
হিগিনজেঠু খাপ্পা হয়ে সনাতনকাকুর দিকে তাকিয়ে বললেন, কী বলছেন আপনি ! সবুজ সংঘ তাদের বরাবরের সবুজ জার্সি ছেড়ে নীল জার্সি পরবে ? ক্যাপ্টেন হাতে আংটি পরে খেলতে নামবে ? এমন প্রস্তাব যিনি দিতে পারেন তাঁর মস্তিস্কের ভারসাম্য নিয়ে আমার সন্দেহ আছে। আই অবজেক্ট মি লর্ড !
গবাদাদু বাজখাঁই গলায় চেঁচালেন, নিকুচি করেছে আপনার অবজেকশানের। এই যে মহাজাগতিক রশ্মি পৃথিবীতে ক্রমাগত এসে চলেছে তা আমাদের শরীরের ওপর প্রভাব সৃষ্টি করে চলেছে তা জানেন? সেজন্য সঠিক রশ্মির বিকিরণকে গ্রহণ আর অপ্রয়োজনীয় রশ্মিকে বর্জন করাটা মানুষের পক্ষে কতটা জরুরি সেটা বোঝেন ? আমি বিচার করে দেখেছি নীল রংয়ের জার্সিই এখন সবুজ সংঘের প্রয়োজন। পাশাপাশি ক্যাপ্টেন নীলকান্ত মণি হাতে পরে থাকলে চ্যাম্পিয়ন হওয়া একেবারে নিশ্চিত।
হিগিনকাকু মুখ ভেঙিয়ে বললেন, শুধু জার্সিতে হল না, এখন আবার আংটি নিয়ে পড়েছেন ? নীলকান্ত মণির মতো দামি আংটির জন্য কত টাকা খরচ হবে সেটা ভেবেছেন ?
সনাতন সাঁতরা দুজনকে চুপ করতে ইশারা করলেন। বললেন, ঠিক আছে, আমি কলকাতা থেকে এক্সপোর্ট কোয়ালিটির এক সেট জার্সি আনিয়ে নিচ্ছি নীল রংয়ের। আমার হনুমান কনস্ট্রাকশনসের লোগো থাকবে জার্সিতে। সব খরচ আমার কোম্পানিই দেবে। গবাবাবু, আপনি নীলকান্ত মণির আংটি বানিয়ে দিন চপলের জন্য। আর হ্যাঁ, আপনি কিন্তু যাবেন টিমের সঙ্গে।
গবাদাদু সম্মতি জানিয়ে দিলেন হাসিমুখে। সনাতনকাকু ডাকুকাকুর দিকে তাকিয়ে বললেন, আপনাকেও যেতে হবে টিমের সঙ্গে। জ্বরজারি, সান্নিপাতিক, ওলাওঠা, ডেঙ্গু, কালাজ্বর, পিলেজ্বর সবরকম রোগের প্রতিষেধক বানিয়ে নিয়ে যাবেন। প্লেয়ারদের যাতে রংঝুরিতে গিয়ে শরীর খারাপ না হয় সেটা দেখবেন আপনি। আপনার চিকিৎসার ওপর আমাদের অগাধ আস্থা।
ডাকুকাকু বেশ একটা আত্মপ্রসাদের হাসি হাসলেন। হিগিনজেঠু মুখ গোঁজ করে দাঁড়িয়ে ছিলেন। সেটা দেখে সনাতনকাকু বললেন, আপনি অভিজ্ঞ লোক, আইনকানুন সব আপনার নখদর্পনে। তাই আপনাকেও যেতে হবে টিম ম্যানেজার হয়ে।
হিগিনজেঠু খুশি হয়ে বসে পড়লেন। সনাতনকাকু বললেন, চপল, এখন কয়েকটা দিন তোমরা খুব মন দিয়ে প্র্যাকটিস কর। রংঝুরিতে আমি নিজেও যাব তোমাদের সঙ্গে। আর হ্যাঁ, আমাদের টিম যে রংঝুরিতে যাচ্ছে সেটা জানিয়ে আজ রাতেই আমি অনিকেতকে ফোন করে দিচ্ছি।
মিটিং শেষ হয়ে গেল। আমরা এখনও বসে আছি। সনাতনকাকু অর্ডার মাফিক ভবেশদার দোকান থেকে গরম গরম ঘুগনি এসেছে শালপাতার দোনায় করে। রাসেল দু’প্লেট শেষ করে বড় একটা ঢেকুর তুলে বলল, নাহ্, আমাকে ডায়েট কনট্রোল করে ওজনটা কমাতে হবে এবার। মাঠে রানিং বিটুইন দ্য উইকেটস খুব মার খাচ্ছে এই বাড়তি ওজনের জন্য।
তমাল খর চোখে রাসেলের দিকে তাকিয়ে বলল, ওজন কমানো নিয়ে যত আফশোস তোর বাড়ছে তত দেখছি তোর খাওয়াও বাড়ছে পাল্লা দিয়ে। শোন রাসেল, সাতদিনের মধ্যে যদি ডায়েট করে সাত কেজি ওজন কমাতে না পারিস তবে তুই টিম থেকে বাদ। নিজে তো রান আউট হচ্ছিস হচ্ছিস, উল্টোদিকের ব্যাটসম্যানকেও রান আউট করে দিচ্ছিস।
রাসেল আড়চোখে আমাকে দেখতে দেখতে বলল, শুধু আমাকেই বলে চলেছিস। লাস্ট দশটা ম্যাচে দু’অংকের ঘরে যেতে পারেনি আমাদের ক্যাপ্টেন। তাকে তো তোরা কিছু বলছিস না ?
রাসেলের কথায় গা জ্বলে গেল। বললাম, আমি টিমের বোঝা হয়ে থাকতে চাই না। রংঝুরি টি-টোয়েন্টিতে আমি শেষ দেখা দেখব। যদি রান করতে পারি তো ভাল, যদি না পারি তবে ক্রিকেট খেলাই ছেড়ে দেব।
বাপ্পা সিরিয়াস গলায় বলল, এই সপ্তাহ থেকেই প্র্যাকটিস শুরু করতে হবে রে চপল।
জলপাইগুড়ির মধ্যে শুধু নয়, এই শহরের বাইরের মাঠেও অনেক ভাল ইনিংস খেলেছি একসময়। কিন্তু কী যে হয়েছে বেশ কিছুদিন হল রান করতে পারছি না। আত্মবিশ্বাস পুরো দুমড়ে গিয়েছে। আমি নিজেও জানি আমাকে ভাল পারফর্ম করতে হবে রংঝুরিতে নইলে মুখ দেখানো যাবে না কারও কাছে। আমি বললাম, কাল থেকেই প্র্যাকটিস শুরু করে দেওয়া যাক। রংঝুরি টুর্নামেন্টের আর বেশিদিন বাকি নেই।
৪
হাসিমারায় গরম গরম পুরি আর মিষ্টি খেয়ে নিয়ে খিদেটা চাপা দেওয়া গিয়েছিল। হাসিমারা থেকে বেরিয়ে কিছুটা পথ এগোতেই মনে হল বাতাসের গন্ধই যেন বদলে গেল। মোবাইল ফোনের টাওয়ার চলে গেল একটুক্ষণ বাদে। সেই সঙ্গে চোখের সামনের দৃশ্যও দেখতে পেলাম বদলে যাচ্ছে একটু একটু করে। বিশাল এক অজগরের মতো এঁকেবেঁকে চলে গেছে পথ। সেই সর্পিল পথ দিয়ে ওপরেরে দিকে উঠছে আমাদের বাস। এই জায়গাটা না সমতল, না পাহাড়। একদিকে ঘন সবুজ বনজঙ্গল, অন্যদিকে হরিয়ালি। চারদিকেই আবার গা ছমছমে ধোঁয়া ধোঁয়া পাহাড় ঘিরে রেখেছে আমাদের। দেখেই মন ভাল হয়ে যায়।
রংঝুরিতে এসে পড়লাম যখন তখন আড়াইটে বেজে গেছে। শীতের দুপুর, তাই দুপুরের হলদে রঙে বিকেলের ফিকে সোনালি ছাপ পড়ে গেছে ততক্ষণে। আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিলেন টুর্নামেন্ট কমিটির কয়েকজন কর্মকর্তা। অনিকেত সাঁতরাও ছিলেন সেখানে। আমাদের দেখে হাত নেড়ে ওঁরা এগিয়ে এলেন।
বাস থেকে নামলাম আমরা সকলে। ধুতিপাঞ্জাবির ওপর শাল চাপানো গবাদাদু, জ্যাকেট পরা সনাতনকাকু আর সোয়েটার পরা ডাকুকাকুর পর সকলের শেষে নামলেন কালো কোটপ্যান্ট পরা হিগিনজেঠু। বাস থেকে আমাদের ক্রিকেট গিয়ার্সের পাশাপাশি নামানো হল ডাকুকাকুর বিশাল ট্রাঙ্ক। পাঁচন বানাবার জন্য বহুরকম গাছগাছড়ার পাতা আর শিকড় নিয়ে এসেছেন ট্রাঙ্কে করে।
অনিকেতকাকু জানতে চাইলেন, রাস্তায় আপনাদের কোনও অসুবিধে হয়নি তো ?
ডাকুকাকু বললেন, এমনিতে সব ঠিকই আছে। কিন্তু এখানে মোবাইলের টাওয়ার আসছে না যে।
অনিকেতকাকু বিব্রতমুখে বললেন, রংঝুরির এই একটাই অসুবিধে। এখানে সেলফোনের টাওয়ার পাবেন না। তবে কাছেই এসটিডি বুথ আছে। কোথাও ফোন করার থাকলে ওখান থেকে করে নিতে পারেন।
সনাতনকাকু বললেন, হ্যাঁ রে, আমাদের থাকার ব্যবস্থা করেছিস কোথায় ?
অনিকেতকাকু বললেন, চা-বাগানের গেস্ট হাউজে। তবে তুমি আমার কোয়ার্টারে থাকবে।
সনাতনকাকু একগাল হেসে ঘাড় নেড়ে বললেন, উঁহু, টিমের ছেলেরা থাকবে একখানে আর আমি থাকব অন্য জায়গায়, তা হবে না। ঠিক আছে, এরপর যদি কখনও একা আসি তবে তোর আস্তানায় কয়েকটা দিন কাটিয়ে যাব নাহয়।
অনিকেতকাকু পাশে দাঁড়ানো এক ভদ্রলোকের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিয়ে বললেন, ইনি ড্যানিয়েল ডুকপা। হি ইজ আ নাইস জেন্টেলম্যান। ইনি রংঝুরি ক্লাবের সেক্রেটারি।
ড্যানিয়েল ডুকপার মঙ্গোলয়েড ধাঁচের মুখ, বয়স ষাট-বাষট্টি হবে। বাদামি টুইডের জ্যাকেট আর কর্ডের ট্রাউজার পরে রয়েছেন। নমস্কারের একটা ভঙ্গি করে চোখ কুঁচকে হেসে বললেন, এখানে যত টিম খেলতে এসেছে তোমাদের সবুজ সংঘের গড় বয়েস সবচাইতে কম।
অনিকেতকাকু মজা করে বললেন, ওদের ছোটখাট চেহারা দেখে ভুল করবেন না মিস্টার ডুকপা। ওরা প্রত্যেকে এক একটা খুদে বাঘ। একবার মাঠে ছেড়ে দিন এদের। দেখবেন প্রত্যেকের বডি ল্যাংগুয়েজ কেমন বদলে যায়।
ড্যানিয়েল ডুকপা একটু হেসে ডানহাতের বুড়ো আঙুল তুলে আমাদের উইশ করে বললেন, অল দ্য বেস্ট।
কপালে লাল লম্বা টিপ পরা এক অবাঙালি ভদ্রলোক স্মিতমুখে দাঁড়িয়ে ছিলেন অনিকেতকাকুর একপাশে। পঁয়ষট্টি-ছেষট্টি বছর বয়স হবে। কিন্তু চেহারা একেবারে টানটান। ভদ্রলোকের গায়ের রং যাকে বলে দুধে আলতা। দাড়িগোঁফ নেই, মাথায় চুল একটু কম। সব মিলিয়ে চেহারার মধ্যে একটা আলাদা ব্যক্তিত্ব আছে মানুষটার। তাঁকে দেখিয়ে অনিকেতকাকু বললেন, ইনি হলেন গগন সিংহানিয়া, রংঝুরি ক্লাবের প্রেসিডেন্ট। কয়েক পুরুষের বনেদি ব্যবসায়ী ওঁরা। ভদ্রলোকের একটাই নেশা। সেটা হল স্পোর্টস। খেলাধুলো ভালবাসেন খুব। ক্রিকেট হোক বা ফুটবল, রংঝুরির মাঠে কোনও ম্যাচই উনি মিস করেন না।
গগন সিংহানিয়া আমার সঙ্গে হাত মিলিয়ে বললেন, তুমিই তো ক্যাপ্টেন। ভেরি গুড। শোনো, দার্জিলিং ডিনামাইট আজ সকালে এসে পড়েছে রংঝুরিতে। ওরা আগেও এখানে খেলে গেছে। বেশ ভাল টিম কিন্তু ওরা। কাজেই কালকের ম্যাচ জিততে চাইলে দারুণ খেলতে হবে তোমাদের। কাল আমিও মাঠে যাব খেলা দেখতে। গগন সিংহানিয়া সনাতনকাকুর সঙ্গে শেক হ্যান্ড করে বললেন, আজ সন্ধেবেলা কী করছেন আপনারা ?
সনাতনকাকু বললেন, তেমন কিছু নয়।
গগন সিংহানিয়া বললেন, তাহলে সন্ধেবেলা আমার গরিবখানায় আপনাদের চা খাওয়ার নেমন্তন্ন রইল। সকলের সঙ্গে আলাপ হবে তখন।
রংঝুরি চা-বাগানের গেস্ট হাউজে আমাদের নিয়ে এলেন অনিকেতকাকু। এখানেই আমাদের থাকার ব্যবস্থা। দোতলা বাংলো ধাঁচের কাঠের বিল্ডিং। বিরাট বিরাট ঘর। দোতলার কাঠের রেলিং দেওয়া বারান্দায় এসে দাঁড়ালে চোখ জুড়িয়ে যায়। দু’-চোখ যতদূর যায় ততদুর পর্যন্ত সবুজ জঙ্গল আর নীল পাহাড় যেমন আছে, তেমনি রয়েছে রুপো রংয়ের টলটলে জলের এক পাহাড়ি নদী আর ছবির মতো সবুজ একটা চা-বাগান। ব্যাগ-ট্যাগগুলো ঘরে রেখে বারান্দায় এসে দাঁড়ালাম আমরা। সনাতনকাকু উচ্ছ্বসিত হয়ে বললেন, যেদিকে তাকাই শুধু শান্তি আর শান্তিই যেন ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে চারদিকে।
অনিকেতকাকু মুখটা বাংলার পাঁচের মতো করে বললেন, আর শান্তি ! কী আর বলব, রাতের ঘুম চলে গেছে ক’দিন হল। খুব টেনশানের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি আজকাল। চাকরি বাকরি রাখাই সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
সনাতনকাকু বললেন, সে কী রে ! এই না সেদিন বলছিলি এমন নিরুপদ্রব জায়গা ভূভারতে নেই। তাহলে ?
অনিকেতকাকু একটা শ্বাস ফেলে বললেন, এতদিন ভালই চলছিল সব। কিন্তু গত সপ্তাহে কবর খুঁড়ে আরও একটা লাশ চুরি হয়েছে। কাউকে ধরতে পারিনি। মিডিয়ায় খবরটা বেরোবার পর ওপরমহল থেকে ডিটেল রিপোর্ট চেয়ে পাঠিয়েছে। সেসব নিয়ে বড় ঝামেলায় আছি। তাছাড়া এই রংঝুরি জায়গাটা সীমান্ত এলাকা হওয়াতে ভুটানি টাকাও চোরাপথে ভারতে ঢুকিয়ে দিচ্ছে একটা অসাধু চক্র। যেহেতু ভুটানের টাকার দাম আমাদের থেকে কম, ভারতের অর্থনীতি মার খাচ্ছে সেজন্য। সব মিলিয়ে পুলিশের রাতের ঘুম নেই। শান্তি-টান্তি উবে গিয়েছে বিলকুল।
সনাতনকাকু চুপচাপ হয়ে গেলেন। আমরা কী বলব ভাবছি। প্রসঙ্গ বদলে অনিকেতকাকু আমাদের উদ্দেশে দূরের একটা সাদা বাড়ির দিকে আঙুল উঁচিয়ে বললেন, ওটা রংঝুরি চা-বাগানের ম্যানেজারের বাংলো। তার ঠিক পাশেই ছোট একটা মাঠ রয়েছে। সেখানে বক্সনেট টাঙিয়ে রাখা হয়েছে তোমাদের প্র্যাকটিসের জন্য। লা’ সেরে নিয়ে ওখানে একটু নেট-প্র্যাকটিস করে নিও তোমরা।
দুপুরের খাবার চলে এল। নিচতলায় বিরাট ডাইনিং হলে বসে খাবার ব্যবস্থা। চিনামাটির সাদা ধবধবে ডিশ, ঝকঝকে তকতকে কাচের গ্লাস। যাঁরা সার্ভ করছেন তাঁরাও সাদা অ্যাপ্রন পরে রয়েছেন। সবকিছু বেশ পরিস্কার পরিচ্ছন্ন। ডাল, আলুভাজা, গরম গরম কাতল মাছের ঝোল দিয়ে ভাত। সঙ্গে বুনো লংকার সস। এদিকের খুব জনপ্রিয় খাবার এই লংকা। টকটকে লাল রংয়ের পেটমোটা তিন-চার ইঞ্চি নাদুসনুদুস চেহারা লংকাগুলোর। তবে একেবারেই ঝাল নেই আর অত্যন্ত সুস্বাদু। খাওয়া দাওয়া সেরে আমরা বেরিয়ে পড়লাম প্র্যাকটিস করতে।
বাপ্পা, তমাল, মিঠুরা বল করল ছোট ছোট রান আপ নিয়ে। ভুলু আর রাসেল আমাদের পার্ট টাইম বোলার। ওরাও একটু হাত ঘুরিয়ে নিল। সিন্টু আর বাবু ব্যাট করে নিল প্রথমে। তারপর আমি। সোজা ব্যাটে একটুক্ষণ খেলে আত্মবিশ্বাসটা বাড়িয়ে নিলাম প্রথমে। তারপর স্কোয়ার অফ দ্য উইকেট খেলতে শুরু করলাম। বল ব্যাটের ঠিক মধ্যিখানে লাগছিল। বহুদিন বাদে নেটে খানিকক্ষণ ব্যাট করে মনে হল আমার কালো দিন চলে গিয়েছে। আমার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় আমাকে যেন বলে দিল এই টুর্নামেন্টে আমার ব্যাড প্যাচ কেটে যাবে। যাবেই।
৫
প্র্যাকটিস সেরে গেস্ট হাউজে ফিরে এলাম বিকেল থাকতে থাকতেই। ভুলু আর রাসেল বেরিয়ে পড়ল একটু চক্কর মেরে আসতে। মিঠু আর রানা ডিটেকটিভ গল্পের পোকা। ওরা দুজন নিজেদের ঘরে সিঁধিয়ে গেল গল্পের বই হাতে নিয়ে। দোতলার বারান্দায় হিগিনজেঠু আর গবাদাদু দেখি গালে হাত দিয়ে বসে ঝুঁকে পড়েছেন দাবা বোর্ডে ওপর। পৃথিবীর কোনওদিকে তাঁদের আর খেয়াল নেই।
গেস্ট হাউজের লাউঞ্জে এলাম আমি, তমাল, টিংকু, বাপ্পারা। এখানে একটা বড়সড় ক্যালেন্ডার টিভি রয়েছে। ভারত-পাকিস্তানের একটা পুরনো টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট ম্যাচ চলছিল টিভিতে। সনাতনকাকু আর ডাকুকাকু একটা বেতের সোফায় বসে ম্যাচ দেখছিলেন। আমরা ম্যাচ দেখার জন্য সেঁটে গেলাম লাউঞ্জের সোফায়।
সন্ধেবেলা গগন সিংহানিয়ার বাড়িতে আমাদের চা খাওয়ার নেমন্তন্ন। ওঁর একজন মাঝবয়েসি কর্মচারী গাড়ি নিয়ে চলে এলেন আমাদের নিয়ে যেতে। পাহাড়ি লোক যেমন হয় তেমন দেখতে ভদ্রলোক। একটু ভাঙা হলেও দিব্যি বাংলা বলতে পারেন। নাম বললেন, অজয় তামাং।
তৈরি হয়ে নিলাম ঝটপট। সনাতনকাকুর সঙ্গে আমরা কয়েকজন গেলাম গগন সিংহানিয়ার বাড়িতে। অজয় নিজেই গাড়ি ড্রাইভ করে নিয়ে গেলেন আমাদের।
গগন সিংহানিয়ার বাড়িটা দেখে তাক লেগে গেল। দোতলা গোল ধাঁচের বিরাট কাঠের বাড়ি। ধবধবে সাদা রং বাড়িটার। ওপরে মেরুন রঙের টিনের চাল। নিচতলায় প্রচুর লেবার, হৈ হৈ ব্যস্ততা। কয়েকজন লোক প্যাকিং বাক্স আনা-নেওয়া করছে আর নিজেদের মধ্যে কথা বলছে। তাদের পাশ কাটিয়ে অজয় তামাংয়ের পিছন পিছন আমরা দোতলায় উঠে পড়লাম।
দোতলায় একটা ছোটখাট মিউজিয়াম বানিয়ে রেখেছেন গগন সিংহানিয়া। প্রাচীন তিব্বতী চিত্রকলা, হালকা আঁচের চুল্লিতে পোড়ানো পোর্সেলিনের বাসনপত্র, পুরনো মুদ্রা, বস্ত্র, পশম শিল্পসামগ্রী, সিলমোহর সুন্দর করে সাজিয়ে রেখেছেন বসার ঘরে। গাঢ় আকাশি, বেগুনি, গাঢ় সবুজ রংয়ের পাত্র রয়েছে অনেকগুলো। দু’-একটা আঁচড়ে শিল্পীর তুলিতে আঁকা রয়েছে লাল-হলুদ ফুল, শালুকপাতা, জল ঝরে পড়া পাহাড়, নদী, গাছ ইত্যাদি অনেক রকম ছবি।
অনেকগুলো সোফা এই ঘরে। আমরা বসলাম ছড়িয়ে ছিটিয়ে। পাজামা-পাঞ্জাবি, তার ওপরে শাল চাপিয়ে গগন সিংহানিয়া এলেন একটু বাদে। জিঞ্চেস করলেন, অজয়, ওঁদের দেখিয়েছ আমার সংগ্রহশালা ?
সনাতনকাকু প্রশংসা করে বললেন, হ্যাঁ, এতক্ষণ তো ওসবই দেখছিলাম। আপনি তো শৌখিন লোক দেখছি।
গগন সিংহানিয়া হেসে বললেন, হ্যাঁ, সেটা বলতে পারেন।
টুকরো টাকরা কথা হল। মনে হল ভদ্রলোক বেশ মিশুকে মানুষ। আমাদের প্রত্যেকের সম্বন্ধে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জানতে চাইলেন। টলিউডের নামী হিরো সৈনিক যে সনাতনকাকুর ছেলে সেটা জেনে বেশ বিস্মিত হয়ে বললেন, দেখুন দেখি কান্ড। অনিকেতবাবু রংঝুরি থানায় এতদিন ধরে রয়েছেন, আমার বাড়িতেও এসেছেন, অথচ এই আসল ইনফরমেশনটাই আমাকে দেননি উনি !
সনাতনকাকু হাসছিলেন। গগন সিংহানিয়া বললেন, পরের বার আপনার ছেলেকে চিফ গেস্ট করে নিয়ে আসব রংঝুরিতে। বিশাল মাপের একজন সেলিব্রিটি এলে গ্ল্যামার বেড়ে যাবে টুর্নামেন্টের।
আমাদের জন্য চা এল, গাজরের হালুয়া এল, গরম গরম কচুরিও এল। শেষ বিকেলের সূর্যের মতো কমলা রং সেই চায়ের। এমন চা এর আগে কখনও খাইনি। দূর থেকেও সেই চায়ের ঘ্রাণ পাওয়া যায়। চায়ে চুমুক দিয়ে সনাতনকাকু বললেন, কীসের ব্যাবসা যেন আপনার ?
গগন সিংহানিয়া স্মিতমুখে পাশের দিকে তাকালেন। পাশ থেকে অজয় তামাং হেসে বললেন, কীসের যে ব্যাবসা ওঁদের নেই সেটা বলাই বরং মুশকিল। আসলে ওঁরা কয়েক পুরুষের বনেদি ব্যবসায়ী। ওঁদের অনেক রকম ব্যাবসা। রংঝুরিতে সকলেই একডাকে চেনেন গগনবাবুকে। এ বাড়ির নিচতলায় কাঠের ফার্নিচারের কারখানা আছে, বাড়ির পেছন দিকটায় আছে লেদ মেশিনের ফ্যাক্টরি। জনা পঞ্চাশেক লোক কাজ করে ফ্যাক্টরি শেডে। দুটো শিফটে কাজ হয়।
সনাতনকাকু সবিস্ময়ে বললেন, তাহলে তো গগনবাবু বিজনেস টাইকুন একরকম।
অজয় তামাং মুচকি হেসে বললেন, আরও আছে। এসব ছাড়াও একটা মেডিসিনের হোলসেল বিজনেস আছে। একটা বটলিফ ফ্যাক্টরিও আছে এদিকের একটা চা-বাগানে।
সনাতনকাকু বললেন, আপনিই কি গগনবাবুর ব্যাবসা দেখভাল করেন ?
অজয় তামাং লাজুক হাসলেন। গগন সিংহানিয়া অজয় তামাংয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন, ম্যানেজার বললে কম বলা হবে, অজয় আমার রাইট হ্যান্ড। একমাত্র মেয়ের বিয়ে দিয়ে দিয়েছি। মেয়ে-জামাই থাকে বিদেশে। মিসেস দেহ রেখেছেন কয়েক বছর আগে। এই বয়সে আর ব্যবসার কাজ দেখতে পারি না। কাজেই লেবাররা ফাঁকি মারছে কিনা তদারকি করা, ডেলি প্রোডাকশান রিপোর্ট ঠিক আছে কিনা দেখা, স্টক মেলানোর কাজ পরীক্ষা করা – সব অজয়ই দেখভাল করে।
চায়ের সুগন্ধ ছাপিয়ে কেমন একটা কটুগন্ধ আসছিল। সনাতনকাকু বললেন, কীসের একটা গন্ধ আসছে না ?
গগন সিংহানিয়া নিজেও নাক কুঁচকে চায়ের কাপটা সেন্টার টেবিলে রেখে বললেন, উনি তো ঠিক বলেছেন। অজয়, কেমন একটা ফাউল স্মেল আসছে। এটা কীসের গন্ধ ?
অজয় তামাং ঘ্রাণ নিলেন একবার। বললেন, কাঠের মিস্ত্রিরা মেথিলেটেড স্পিরিট নিয়ে কাজ করছে নিচে। মনে হয় সেই গন্ধ।
গগন সিংহানিয়া আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, তারপর স্কিপার ? কেমন লাগছে আমাদের রংঝুরি ?
আমি গাজরের হালুয়া খেতে খেতে বললাম, জায়গাটা ভারী সুন্দর। পাহাড়, নদী, জঙ্গল, চা-বাগান তো আছেই, তাছাড়া সুন্দর সুন্দর কাঠের দোতলা ঘরবাড়িও রয়েছে দেখলাম।
তমাল বলল, আচ্ছা, এখানকার বাসিন্দারা কি বেশিরভাগই নেপালি ?
গগন সিংহানিয়া বললেন, উঁহু, নেপালি নয়, রংঝুরিতে ডুকপাদের বসবাসই বেশি। তবে নেপালি আর বাঙালি আছে কয়েক ঘর। কিন্তু আমরা মারোয়াড়িরা এখানে মাইনরিটি।
আমি বললাম, ভুটান বর্ডার এই রংঝুরি থেকে কতটা দূরে ?
গগন সিংহানিয়া বললেন, এখান থেকে দু’পা হাঁটলেই ভুটান। ইচ্ছে করলে এক পা ভুটান আর এক পা ভারতে রেখে দাঁড়াতে পারো বর্ডারে গিয়ে। ভুটানকে বলা হয় বজ্রমানিকের দেশ, জানো তো ? রাজার শাসন চলে ভুটানে। ওখানকার কারেন্সির নাম নুগলট্রাম। ভুটানের তিনভাগের দু’ভাগই আসলে বনভূমি। স্বাধীনতার পর থেকেই তো অনুন্নত এই দেশ, তাই উন্নয়নের জন্য ওরা ভারতের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। রাস্তা তৈরি কিংবা জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের জন্য ওরা আমাদের ওপর পুরোমাত্রায় নির্ভরশীল। তবে হ্যাঁ, ভুটানের মানুষ যেমন কর্মঠ, তেমনি সৎ।
গগন সিংহানিয়ার ওখান থেকে যখন ফিরে এলাম আমাদের গেস্ট হাউজে তখন সন্ধে হয়েছে বেশ। সকলে লাউঞ্জে বসে টিভি দেখছিলেন। হিগিনজেঠু চিন্তিত গলায় বললেন, ভুলু আর রাসেল কিন্তু এখনও ফেরেনি।
সনাতনকাকু ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বললেন, আমার সব সহ্য হয়, ইনডিসপ্লিন সহ্য হয় না। আজকেই আমি ওদের দুজনকে লাস্ট ওয়ার্নিং দিয়ে দেব। তেমন বুঝলে টিম ইউথড্র করে জলপাইগুড়ি ফিরে যাব। কিন্তু এই বেয়াদবি আমি একদম বরদাস্ত করব না।
ডাকুকাকু উদ্বিগ্ন গলায় বললেন, আপনি উত্তেজিত হয়ে যাচ্ছেন কিন্তু আমি ভাবছি অন্য কথা। আচ্ছা, ওরা কোনও বিপদে পড়েনি তো ?
সনাতনকাকু থমকে গেলেন। বললেন, ওহ, এদিকটা তো ভাবিনি। কী জ্বালা বলুন তো !
হিগিনকাকু বললেন, বেশি দেরি করা যাবে না, আর কিছুক্ষণ দেখে নিয়ে বেরিয়ে পড়তে হবে। রংঝুরি বাজারে এসটিডি বুথ আছে একটা। সেই বুথ থেকে থানায় ফোন করে অনিকেতবাবুকে ব্যাপারটা জানাতে হবে। প্রয়োজন হলে থানায় মিসিং ডায়েরিও করতে হবে।
আমরা মুখ শুকনো করে বসে আছি। টেনশানে বড়রা পায়চারি করতে শুরু করেছেন। সকলের মুখেই দুশ্চিন্তার আঁচড়।
৬
ডাকুকাকু আর হিগিনজেঠু যখন থানায় ফোন করবেন বলে বেরোতে যাবেন ঠিক তখনই ফিরেছে ভুলু আর রাসেল। দুজনের হাতে বিশাল বিশাল ঠোঙায় জিলিপি। সনাতনকাকু ধমক দিতে যাবেন, রাসেল কান এঁটো করা একটা হাসি হেসে বলল, হাঁটতে হাঁটতে ভুটান বর্ডারে চলে গিয়েছিলাম। ফেরার সময় রংঝুরি হাটে গরম গরম জিলিপি ভাজছে দেখলাম। লোভ আর সামলাতে পারলাম না। আমরাও খেয়েছি, দু’কেজি নিয়েও এসেছি সকলের জন্য।
বড়রা তুলোধুনো করলেন রাসেল আর ভুলুকে। প্রচুর বকুনি খেল দুজন। শেষে অবশ্য ওদের আনা জিলিপিও খাওয়া হল সকলে মিলে। তারপর শুরু হল টিম মিটিং। হিগিনজেঠু বিরাট একটা কাগজ বার করে ছবি এঁকে দেখিয়ে বললেন, কালকের ম্যাচে আমাদের ব্যাটিং অর্ডার একইরকম থাকুক। কালও বাবু আর সিন্টু ওপেন করতে যাবে। ওয়ান ডাউনে ব্যাট করুক চপল। দু’নম্বরে নামুক ভুলু। তারপর এক এক করে যাক পিন্টু, রাজা, রাসেল, টিংকু, মিঠু, বাপ্পা আর তমাল। রানাকে টিমের বাইরে রাখছি কাল। ওকে পরে সুযোগ দেওয়া হবে।
ডাকুকাকু ট্রাঙ্ক খুলে একটা কৌটো বার করে ফেলেছেন। আমাদের দিকে তাকিয়ে রহস্য রহস্য একটা হাসি হেসে বললেন, এর ভেতরে কী জিনিস আছে জানো ?
আমরা সভয়ে একসঙ্গে বললাম, কী আছে ?
ডাকুকাকু হেসে বললেন, আশশ্যাওড়া, ঘেঁটু, ভাঁট, পুটুশ, ভুঁইওখড়া, রুদ্রজটা, আকন্দ, নিশিন্দা, রেঢ়ি, কাকমাছি, হাতিশুঁড়, কৃষ্ণতুলসী, পাথরকুচির পাতা বেটে তৈরি করেছি এই পাঁচন। আজ সন্ধেতে এক চামচ খাবে আর কাল সকালে খেলতে নামার আগে এক চামচ। জ্বরজারি-সর্দিকাশি-অম্বল-বুকজ্বলা-অগ্নিমান্দ্য-হাঁপানি-কাঁপানি কিছুই তোমাদের ছুঁতে পারবে না। নাও, লক্ষ্মী ছেলের মতো খেয়ে নাও।
রাসেল আমতা আমতা করে বলল, পাঁচনটা খেতে কি খুব বিচ্ছিরি ?
ডাকুকাকু অভয় দিয়ে বললেন, পাঁচন তো আর জিলিপির মতো মিষ্টি হবে না! তবে যতটা ভয় পাচ্ছ তেমন তিতকুটে নয়। তুমিই প্রথমে খেয়ে দ্যাখো না হয়।
রাসেল মুখ হাঁ করল। ডাকুকাকু খুব যত্ন নিয়ে রাসেলের মুখে এক চামচ পাঁচন ঢেলে দিলেন। রাসেলের চোখ বড় বড় হয়ে গেল সেই পাঁচন খেয়ে। রাসেলের পর আমি। চোখ বুঁজে এক চামচ পাঁচন খেয়ে মনে হল ভূমিকম্প হচ্ছে চারদিকে। এমন তেতো, এমন ঝাঁঝাল, এমন ভয়ংকর জিনিস আমি জীবনে খাইনি।
আমার পর এক এক করে বাকিদের খাওয়ানো হল সেই পাঁচন। রানা পালিয়ে যাবার চেষ্টা করেছিল, সনাতনকাকু ধরে ফেললেন রানাকে। এই বয়সেও সনাতনকাকুর খাজা কাঁঠালের মতো মাসল। রানা কিছুতেই সনাতনকাকুর হাত ছাড়াতে পারল না। রানার দুরবস্থা দেখার পর বাকিরা কেউ আর পালাবার সাহস করল না।
ডাকুকাকুর পাঁচনপর্ব শেষ হল। গবাদাদু হাঁক দিয়ে বললেন, আমি এখন যঞ্চে বসব। চপল যে নীলকান্ত মণির আংটি ধারণ করবে সেটা শোধন করে দিতে হবে। এখন আমার একটু গঙ্গাজল চাই যে !
টুর্নামেন্ট কমিটির একজন দাঁড়িয়ে এই বিচিত্র কান্ড দেখছিলেন। বললেন, গঙ্গার জল তো এখানে পাওয়া যাবে না। এখানকার নদীর নাম হল দোলং। যদি চান তবে দোলংয়ের জল আনিয়ে দেওয়া যেতে পারে।
গবাদাদু হতাশ মুখ করে বললেন, তাহলে সেটাই আনান। কিন্তু তাড়াতাড়ি করুন। সন্ধ্যা ছটা বাহান্ন থেকে সাতটা একুশ পর্যন্ত শুভলগ্ন আছে। তার মধ্যেই নদীর জল চাই।
ভদ্রলোক কাউকে কিছু একটা নির্দেশ দিলেন। অল্পক্ষণের মধ্যেই বড় একটা কাচের বোতলে দোলংয়ের জল এসে গেল। গবাদাদু ব্যাগ থেকে একটা নীলপাথরের আংটি বার করে পদ্মাসন করে বসে পড়লেন।
আমরা অর্ধবৃত্ত বানিয়ে বসে আছি গবাদাদুর পিছনে। আমাদের পিছনে সার দিয়ে দাঁড়ানো রংঝুরি টুর্নামেন্ট কমিটির লোকজন। সবিসময়ে আমাদের দেখছে তারা। গবাদাদু যঞ্চের আগুন জ্বেলে বিড়বিড় করে মন্ত্র পড়লেন। তারপর আমার আঙুলে আংটিটা পরিয়ে দিয়ে একগাল হেসে বললেন, নাও চপল, সবুজ সংঘের কেমদ্রুম যোগ কাটিয়ে দিলাম। রংঝুরি টি-টোয়েন্টিতে তোমাদের হারায় কারও ক্ষমতা নেই।
রাতে আমাদের ডিনার সারা হয়ে গেল ন’টার মধ্যেই। সনাতনকাকু বলে দিয়েছেন দশটার মধ্যে শুয়ে পড়তে। সাড়ে ন’টা নাগাদ আমাদের ঘরে ঢুকে গেলাম আমরা। আমি, ভুলু আর রাসেল থাকব এই ঘরে। বিশাল ডাবলবেড। তিনজন হাত পা ছড়িয়ে আরাম করে শোয়া যায়। ভুলু ওর ব্যাগ হাতড়ে একটা ছোট শিশি বার করে নিয়ে আমাকে বলল, চপ্পল, হাঁ কর, তোকে মন্ত্রপূত জল খাইয়ে দিই।
আমি অবাক হয়ে বললাম, কীসের জল ?
ভুলু ভেঙে বলল, ঘটনাটা শোন আগে। বললে বিশ্বাস করবি না, আজ বিকেলে আমি আর রাসেল হেঁটে হেঁটে ভুটান বর্ডারে চলে গিয়েছিলাম।
আমি অবাক হয়ে বললাম, বলিস কী ?
ভুলু বলল, হুঁ, তা প্রায় ঘন্টাখানেকের রাস্তা। একজন লামার কথা শুনলাম হাটে গিয়ে। ঐশ্বরিক ক্ষমতা আছে তাঁর। সেই লামার গুম্ফায় গিয়েছিলাম বলেই তো ফিরতে দেরি হল আমাদের। এই মন্ত্রপূত জল উনিই দিয়েছেন কালকের ম্যাচের জন্য।
আমি বললাম, তোরা বড়দের কাউকে বলে যাস নি কেন ?
ভুলু বলল, ওঁদের জানালে তো যেতে দিতেন না। সেজন্য বড়দের তো বলিইনি, বড়দের কানে দিয়ে দিতে পারে ভেবে টিমের বাকিদেরও বলিনি। শোন, টুর্নামেন্ট জিততেই হবে যে করে হোক। লামার দেওয়া এই মন্ত্রপূত জল আমি খেয়েছি, রাসেলও খেয়েছে। আর একটু আছে, তুইও খেয়ে নে চপ্পল।
আমি একটু ভয়ে ভয়ে বললাম, খাব বলছিস ? এটা খেয়ে মরে যাব না তো ?
ভুলু বলল, আমি আর রাসেল খেয়েছি ঘন্টাখানেক আগে, আমরা কি মরে গেছি ? আর দেরি করিস না, খেয়ে নে।
ব্যাডপ্যাচ কাটানর জন্য আমি মরিয়া। মনে মনে দুগ্গা দুগ্গা বলে হাঁ করলাম। ভুলু শিশি থেকে খানিকটা জল ঢেলে দিল আমার মুখে। সাধারণ জলের মতোই তার স্বাদ, গন্ধ।
ভুলু হেসে আমার পিঠে একটা চাপড় মেরে বলল, চপ্পল, কালকের ম্যাচে তুই বড় রান পাবি, দেখে নিস।
৭
আজ আমাদের খেলা। যে বাস রিজার্ভ করে আমরা রংঝুরিতে এসেছি সেই বাসে চেপে মাঠের দিকে যাচ্ছি আমরা। যেতে যেতে দেখলাম দোকানপাট খুলছে, মানুষজন সবে কাজে বের হয়েছে। কয়েকটা স্কুলের বাচ্চা আমাদের দেখে হেসে হাত নাড়ল। আমরাও হাত নাড়লাম। বাইরে তাকিয়ে দেখি নরম রোদ উঠেছে পাহাড়ের মাথার ওপর দিয়ে। রংঝুরির সকালটা যেন আদুরে বেড়ালছানার মতো আলসেমিতে ভরা, এখানে ওখানে থুপ্পি মেরে বসে আছে।
রংঝুরির খেলার মাঠটা এককথায় দারুণ। এত জায়গায় খেলেছি, এমন চমৎকার মাঠে কখনও খেলিনি। শক্ত মাটির ওপর সবুজ মখমলের মতো ছোট ছোট করে ছাঁটা ঘাস। বাউন্ডারি লাইনের একদিকে পাহাড়ি নদী, অন্যদিকে অর্ধবৃত্তের মতো একটা ছোট পাহাড়ের টিলা। সবুজ ঘাস দিয়ে মোড়া। ধাপ ধাপ করা বসার জায়গা, প্রকৃতিই যেন মনোরম একটা স্টেডিয়াম বানিয়ে রেখেছে। হাজার খানেক দর্শক সেখানে বসে সুর করে চিৎকার করছে আর বিভিন্ন রঙিন প্ল্যাকার্ড, ফেস্টুন, ফ্ল্যাগ নাড়াচ্ছে।
ছোট ছোট বাচ্চারা আমাদের সাদা ফ্ল্যাগ নেড়ে অভ্যর্থনা জানাল। তাকিয়ে দেখি আমাদের আগেই মাঠে পৌঁছে ওয়ার্ম আপ করতে শুরু করে দিয়েছে লাল জার্সি পরা দার্জিলিং ডিনামাইট।
আমরা গোল হয়ে হাডল বানালাম। আমি সবাইকে চাগিয়ে তোলার জন্য বললাম, আমাদের নিজেদের যতটুকু ক্ষমতা আছে তার সবটুকু উজাড় করে দেব আজ। এই ম্যাচ আমাদের জিততেই হবে।
হাডল শেষ হয়ে যাওয়ার পর সকলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে যাচ্ছিলাম মাঠে। রাসেল আমার কাছে এসে বলল, আমার বুকটা খালি খালি লাগছে রে। কী যে হবে কে জানে !
ভুলুও পাশ থেকে এসে বলল, আমার পেটের মধ্যে গুরগুর করছে রে চপ্পল। এত টেনশান কখনও হয় না আমার।
আমি ওদের দুজনের পিঠে চাপড় মেরে বললাম, টেনশান করিস না একদম, তোরা দেখে নিস আজ আমরা দাপটের সঙ্গে ম্যাচ জিতব।
টসে হেরে গেলাম। দার্জিলিং ডিনামাইটের ক্যাপ্টেন ফিল্ডিং করার সিদ্ধান্ত নিল। অর্থাৎ আমাদের ব্যাটিং। বাবু আর সিন্টু চলে গেল ওপেন করতে। দ্বিতীয় ওভারেই বাবু লেগ বিফোর উইকেট হয়ে ফিরে এল। আমি হেলমেট মাথায় চাপালাম। ব্যাট হাতে মাঠে নেমে উদীয়মান সূর্যের দিকে তাকালাম। কেন যেন মনে হল আজকের দিনটা আমার।
ওয়ান লেগ গার্ড নিয়ে নিলাম প্রথমে। ফিল্ডারদের এক ঝলক দেখে নিয়ে স্টান্স নিলাম ধীর পায়ে। উইকেটকিপার আর স্লিপ কর্ডন চিয়ার আপ করছে বোলারকে। স্লেজিংও করছে একটু আধটু। সেদিকে মন না দিয়ে সামনের দিকে তাকালাম। ছিপছিপে চেহারার বোলারটা আমাকে ঠান্ডা চোখে জরিপ করতে করতে প্যান্টে বল ঘসছে। এবার আসছে দূর থেকে। ওভারের শেষ বল। ইনস্যুইং হয়ে ভিতরে ঢুকছিল। ফ্রন্টফুটে গিয়ে বলটা ব্লক করলাম ব্যাটের একেবারে মধ্যিখান দিয়ে।
পরের ওভারের প্রথম বলেই সিন্টু একটা সিঙ্গলস নিয়ে আমাকে স্ট্রাইক দিল। আউটস্যুইং বল ছিল, জাজমেন্ট দিয়ে ছেড়ে দিলাম। পরের বল সামান্য শর্ট অফ লেংথ। ব্যাকফুট ড্রাইভ করলাম। কভারের ফিল্ডার নড়ার সুযোগ পেল না, গোলার মতো বল চলে গেল বাউন্ডারিতে। পরের বল হাফভলি। সামনের পায়ে শরীরের ওজন নিয়ে গিয়ে ব্যাটটা শুধু লাগালাম বলে। চোখের নিমেষে বল গড়াতে গড়াতে গিয়ে ধাক্কা খেল সাইটস্ক্রিনের পর্দায়।
বোলার মার খেয়ে যে একটু রেগে রয়েছে সেটা আঁচ করতে পারছিলাম। পরের বলটা অবধারিত বাউন্সার এল। হুক করলাম, স্কোয়ার লেগ আম্পায়ারের মাথার উপর দিয়ে বল উড়ে গেল স্টেডিয়ামের দর্শকদের কাছে। ক্রিকেটে ব্যাটসম্যান আর বোলার একে অন্যের মনস্তত্ত্ব বোঝার নিরন্তর চেষ্টা করে যায়। কোনও ব্যাটসম্যান হঠাৎ আক্রমণাত্মক খেলতে শুরু করলে বোলারের অমোঘ অস্ত্র হল স্লোয়ার। ওভারের শেষ বল যে তেমন হতে পারে সেটা কেন যেন মনে হচ্ছিল আমার। হলও তাই। অফস্টাম্পের লাইনে স্লোয়ার ডেলিভারি। শুধু জায়গায় দাঁড়িয়ে বলের গতিটা বুঝে নিয়ে বাঁ হাতের ঝাঁকিতে বলটা লিফট করে দিলাম একস্ট্রাকভারের মাথার উপর দিয়ে। বিশাল ছক্কা।
চোখ নামিয়ে নিয়েছে, কাঁধ ঝুলে গিয়েছে বোলারের। উইকেটকিপার চুপ। স্লিপ কর্ডন উঠে গিয়ে চলে গেল বাউন্ডারি বাঁচাতে। ওদিকে পরপর চারটে বলে চারটে বড় হিট দেখে দর্শকরা যেন পাগল হয়ে গেছে। সারা স্টেডিয়াম এখন আমার জন্য গলা ফাটাচ্ছে। বহুদিন পর কেমন একটা অদ্ভুত আনন্দ হচ্ছিল। মাঝে বেশ কয়েকটা ম্যাচ রান পাইনি। সেসব ম্যাচে টিম কখনও জিতেছে, কখনও হেরেছে। যখন হেরেছে তখন নিজে কিছু করতে পারিনি বলে কষ্ট হয়েছে। আবার যখন জিতেছে তখনও সেই জয়ে আমার অবদান নেই বলে কেমন ফাঁকা ফাঁকা লেগেছে। এতদিন পর নিজের ফর্ম ফিরে পেয়ে ভীষণ স্বস্তি এল মনের মধ্যে।
শেষ ওভারের শেষ বলে বাউন্ডারি লাইনে ক্যাচ দিয়ে যখন আউট হলাম তখন আমার রান একাত্তর। কুড়ি ওভারে একশো আটষট্টি রান হল আমাদের। রাসেল মিডল অর্ডারে নেমে একুশ করে রান আউট হয়ে গিয়েছিল। তারপর ভুলু এসে নট আউট থাকল বিয়াল্লিশ রানে।
প্যাভিলিয়নে ফিরতেই টিমের সকলে জড়িয়ে ধরল আমাকে। তারপর সনাতনকাকু, ডাকুকাকু, হিগিনজেঠু, গবাদাদুরা। অনিকেতকাকু এলেন সব শেষে। হেসে বললেন, বিজয় হাজারে ট্রোফি খেলা অসমের এক ব্যাটসম্যান এই মাঠে ছিয়ানব্বই করে গিয়েছে গতবার। রংঝুরি টুর্নামেন্ট কমিটির লোকজন বলছে সৌন্দর্যের দিক দিয়ে তোমার ব্যাটিং তাকেও ছাপিয়ে গিয়েছে।
বড় রান হাতে থাকলে বোলারদের আত্মবিশ্বাস বেড়ে যায়। সে কারণেই হয়তো বাপ্পা, মিঠু, তমালরা মোটামুটি ভালই বল করল। তমাল আর বাপ্পা দুটো করে উইকেট তুলল। চেঞ্জ বোলার হিসাবে এসে রাসেলও একটা উইকেট পেল। দার্জিলিং ডিনামাইট খুব একটা সুবিধে করতে পারল না, একশো চল্লিশ করল কুড়িয়ে বাড়িয়ে। আমার কথাই সত্যি হল। প্রথম ম্যাচ বড় মার্জিনে জিতে সেমিফাইনালে উঠে গেলাম আমরা।
ড্রেসিংরুমে ফিরতেই অনিকেতকাকু, গগন সিংহানিয়া আর ড্যানিয়েল ডুকপা আমাদের শুভেচ্ছা জানালেন। আমার পিঠে হাত রেখে অনিকেতকাকু বললেন, কাল তোমাদের কঠিন সেমিফাইনাল ম্যাচ অসম রাইনোর সঙ্গে। ওরা ভুটানের রয়্যাল ওয়ারিয়রসকে হারিয়ে সেমিফাইনালে উঠেছে। চপল, আজ তোমার ব্যাটিং দেখে মন ভরে গেল। কাল আবার একটা ভাল ইনিংস খেলা চাই।
গগন সিংহানিয়া একটা সাদা খাম আমার হাতে দিয়ে বললেন, স্কিপার, এটা আমার তরফ থেকে তোমাকে গিফট। প্লিজ অ্যাকসেপ্ট ইট।
খাম খুলে দেখি দুটো হাজার টাকার নোট। রাসেল ঝাঁপিয়ে পড়ে টাকাটা আমার হাত থেকে ছিনিয়ে নিয়ে হেসে বলল, চপল, প্রাইজমানি ভাগ করে নেওয়াটা আমাদের রেওয়াজ সেটা ভুলে যাস না। এই টাকাটা দিয়ে পরে জব্বর ফিস্ট হবে আমাদের।
আমি হেসে বললাম, তথাস্তু।
গেস্ট হাউজে ফিরে গরম জল দিয়ে স্নান সারলাম। শরীরের ক্লান্তি ধুয়ে গেল। লাঞ্চে ভুলু আমার পাশে বসল। আমার কানে কানে বলল, চপ্পল, তুই কতদিন বাদে ফর্ম ফিরে পেলি, আমার দিনটা খারাপ গেল না। রাসেলও খারাপ খেলে নি। লামার ক্ষমতাটা দেখেছিস একবার ?
আমার ঝট করে মনে পড়ে ভুলু আর রাসেল এক লামার কাছ থেকে জলপড়া এনে খাইয়েছিল কাল রাতে। আমি হাতের আঙুল উঁচিয়ে একটু হেসে ভুলুকে বললাম, এই দ্যাখ গবাদাদুর দেওয়া আংটি পরেছি। শুধু তাই নয় ডাকুকাকুুর ভয়ংকর পাঁচনও খেয়েছি। কাজেই কৃতিত্বটা তুই শুধু ওই লামাকে দিয়ে দিস না ভুলু।
ভুলু দাঁত খিঁচিয়ে বলল, চপ্পল, তুই যে এত বড় গাধা সেটা জানতাম না। ডাকুকাকুর ম্যাজিক পাঁচন খেয়েছে সকলে। আংটি পরেছিস তুই একা। কিন্তু আজকের সবচাইতে ভাল খেলেছে কারা ? তুই, আমি আর রাসেল। ভেবে দ্যাখ, আমরা তিনজনেই তো লামার দেওয়া মন্ত্র পড়া জল খেয়েছিলাম কাল রাতে। তাহলে ?
আমি একটু ভেবে বললাম, হুম, বুঝলাম। কিন্তু কালও তো ভাইটাল সেমিফাইনাল ম্যাচ আছে আমাদের। সেটাও তো জিততে হবে।
ভুলু বলল, আজ বিকেলে একবার যাব লামার গুম্ফায়। তোকেও নিয়ে যাব সেখানে। ঘাবড়াস না, সন্ধের আগেই ফিরে আসব। কাউকে কিছু বলার দরকার নেই।
৮
রংঝুরি বাজার থেকে খানিকটা হেঁটে লোকালয় ছাড়িয়ে এসেছি আমরা তিনজন। একটা মুরগির ফার্ম আর একটা শুয়োরের খোঁয়ারের পাশ কাটিয়ে সরলবর্গীয় সবুজ গাছেদের জটলার মধ্যে দিয়ে এগোচ্ছি আমরা। আমাদের সঙ্গ দিচ্ছে দোলং নদী। আমি হাঁফাচ্ছিলাম। দম নিতে নিতে বললাম, লামার গুম্ফা আর কতদূর ? আলো থাকতে থাকতে ফিরতে পারব তো?
রাসেল বলল, এই এসে পড়েছি। তুই অত তাড়াহুড়ো করছিস কেন ? পাহাড়ে ছোট ছোট করে স্টেপ নিতে হয়। একটু আস্তে আস্তে পা ফেল।
আমি একটু দাঁড়ালাম। শ্বাস নিচ্ছি বড় করে। বললাম, রংঝুরি জায়গাটা যেমন সুন্দর, এখানকার মানুষগুলোও খুব ভাল।
ভুলু বলল, শুধু ওই ড্যানিয়েল ডুকপা বাদ দিয়ে। কেমন ছোট ছোট কুতকুতে চোখ, চিবিয়ে চিবিয়ে কথা বলেন তুই যাই বলিস চপ্পল, ভদ্রলোককে দেখে আমার প্রথম থেকেই কেমন যেন সন্দেহ লাগছে। সিনেমায় যারা ভিলেনের রোল করে তারা অবিকল এমন দেখতে হয়।
আমি বললাম, সিনেমায় যাঁরা ভিলেনের রোল করেন তাঁরা কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ভাল মানুষ হন।
রাসেল বলল, গগন সিংহানিয়াকে কিন্তু আমার ভাল লেগেছে। দিব্যি লোক। সকলের সঙ্গেই হেসে হেসে কথা বলেন।
ভুলু সঙ্গে সঙ্গে সমর্থন করে বলল, ড্যানিয়েল ডুকপা বাদ দিয়ে এখানকার সব লোকই ভাল। এই যে অনিকেতকাকু বলছিলেন যে রংঝুরিতে কীসব ক্রাইম টাইম হচ্ছে ইদানিং, তার সঙ্গে এই ড্যানিয়েল ডুকপার নির্ঘাৎ কোনও যোগ আছে। পরে মিলিয়ে নিস তোরা।
অনেকটা পথ হেঁটে এসেছি। একটা গুম্ফা দেখতে পাওয়া যাচ্ছে এখান থেকে। সেদিকে তাকিয়ে আমি বললাম, গুম্ফা কাকে বলে জানিস ?
ভুলু আর রাসেল দুজনেই ঘাড় নাড়ল। আমি বললাম, গুগল ঘেঁটে জেনেছি, তিব্বতি ভাষায় গোন্-পা মানে হল নির্জন স্থান। বৌদ্ধ লামাদের বিহার বা নির্জন আবাসকে বলে গুম্ফা। লক্ষ করে দেখবি সাধারণত গুম্ফা পূর্বমুখী হয়, যাতে ভোরের প্রথম আলোর রেণু গুহার ভিতরে প্রবেশ করতে পারে।
রাসেল বলল, লামা শব্দেরও কোনও মানে আছে নিশ্চয়ই ?
আমি বললাম, লা-ম মানে পরমপুরুষ। গুরুকে বলা হয় লামা। রক্ষযক্ষ ও ভূতেদের বশীভূত করে ধর্মকে রক্ষা করেন বলে এঁরা লামা। সেজন্য মন্ত্রতন্ত্র বশীকরণ ঝাড়ফুঁক ভবিষ্যদ্বাণী এসবে অনেক লামাই সিদ্ধহস্ত হয়ে থাকেন।
ভুলু একটু ভেবে বলল, ঠিকই বলেছিস। এই লামারও ঈশ্বরিক শক্তি আছে। রংঝুরি শুধু নয়, অনেক দূর থেকে লোকজন ওঁর কাছে আসে।
আমি বললাম, এতটা পথ তোরা দুজন চিনে চিনে এসেছিলি কেমন করে ?
রাসেল বলল, কাল দুটো লোকের সঙ্গে আলাপ হয়েছিল। লোকদুটো শুনলাম মামলা মোকদ্দমায় ফেঁসে আছে, অনেক টাকা খরচ করেছে। সেই ঝামেলা থেকে উদ্ধার পাওয়ার জন্য ওরা লামার কাছে যাচ্ছিল। তাদের মুখেই শুনলাম এই লামার আসল নাম গ্যালসিন। ওরাই পথ চিনিয়ে নিয়ে এসেছিল আমাদের।
ছোট ছোট টিলার মতো সবুজ পাহাড়, মাঝখান দিয়ে খরস্রোতা দোলং নদী বয়ে চলেছে শব্দ করে। এক পাশ দিয়ে নির্জন পাকদন্ডী। তবে রাস্তা খুব চড়াই নয়। সরু পথে খাদের ধার ঘেঁষে সাবধানে পা ফেলার ঝুঁকি নেই। খুব বেশি লোকজন এই পথে চলাচল করে বলে মনে হল না।
লম্বা লম্বা পাতাওয়ালা অনেক গাছ রয়েছে পথের ধারে। ভুলু আমার দিকে তাকিয়ে চোখ নাচিয়ে বলল, এগুলোকে কী বলে জানিস ?
আমি ঘাড় নেড়ে জানালাম, জানি না।
ভুলু একগাল হেসে বিজয়ীর ভঙ্গিতে বলল, এগুলোর নাম হল উত্তিস। কাল ওই লোকগুলোর কাছে জেনেছি।
একটা গুম্ফার সামনে এসে দাঁড়ালাম আমরা। কয়েকটা পাইন গাছ রয়েছে উল্টোদিকে। তার পাশ দিয়ে ফ্ল্যাগের মতো রঙিন কিছু কাপড় উড়ছে। ভুলু একগাল হেসে বলল, মিস্টার গুগল, আপনাকে আরও একটা তথ্য দিয়ে রাখি, ওই পতাকাগুলোকে বলে টাজা।
ভাল করে তাকিয়ে দেখি গুম্ফার ঠিক গায়ে একটা কাঠের ফলকের মধ্যে খোদাই করে ইংরেজিতে লেখা আছে নো শু’জ অ্যালাওড। জনা চারেক লোক দাঁড়িয়ে আছে গুহার ঠিক মুখে। লোকগুলোর পরনে তিব্বতি ধাঁচের গলা থেকে পা পর্যন্ত ঢাকা আলখাল্লার মতো পোশাক। প্রত্যেকের হাতে জপমালা। একজনের একহাতে মালা, অন্যহাতে পেতলের একটা চোঙের মতো যন্ত্র।
আমি বললাম, ওই যে চোঙটা দেখছিস, ওটাকে বলে মণি। এর ভেতরে থাকে লাটাইয়ের মতো একটা ব্যবস্থা। এক লাখেরও বেশি মন্ত্র ছাপা একটা কাগজ ভরা আছে ওটার ভেতরে। অবলোকিতেশ্বরের মন্ত্র ‘ওঁ মণিপদ্মে হুম’ লেখা রয়েছে এই কাগজে। এই চোঙ একবার ঘোরালেই লক্ষেরও বেশি পুণ্য অর্জন করা হয় বলে এদের বিশ্বাস।
রাসেল অবাক হয়ে বলল, এটুকু চোঙে এক লক্ষ মন্ত্র ? বলিস কী ?
আমি বললাম, আরও বড় সাইজেরও মণি হয়। তখন যেহেতু অনেক বেশি পেশীশক্তির প্রয়োজন হয়, সেগুলো অনেক লোক মিলে ঘোরায়। কোথাও কোথাও জলপ্রবাহের শক্তিতে ঘোরানো হয় এই মণি। ফানুস উড়িয়েও পুণ্য অর্জনের প্রথা রয়েছে। একটা ঘেরাটোপের মধ্যে জ্বলন্ত প্রদীপ রেখে ওপরে মন্ত্রলেখা কাগজ বা কাপড় ছাতার মতো করে টাঙানো হয়। প্রদীপের আলোতে বাতাস গরম হয়ে ওপরের দিকে উঠতে থাকে। সেই বাতাসের প্রভাবে ছাতা ঘুরতে থাকে। সঙ্গে সঙ্গে মন্ত্রলেখা কাগজ বা কাপড়ও ঘুরতে থাকে।
যে লোকটার হাতে মণি সে আমাদের গলা শুনতে পেয়েছে। এগিয়ে এসে আমাদের এক পলক দেখে ভাঙা হিন্দিতে আমরা কেন এখানে এসেছি জিঞ্চেস করল। আমি বললাম সংক্ষেপে। তার পাশ থেকে অন্য একজন বলল, এখন লামার ন্যুমা চলছে। আজ প্রথম দিন। কাজেই বেশিক্ষণ সময় যেন আমরা না নিই।
ভুলু গলাটা খাদে নিয়ে গিয়ে বলল, ন্যুমা মানে কী রে ?
আমি ফিসফিস করে বললাম, ন্যুমা মানে উপোস। একদিন অনিয়মিত আহার ও পুজো, পরদিন দুপুরের পর পর্যন্ত উপোস থেকে পুজো, আর তৃতীয় দিন সম্পূর্ণ উপোস ও পুজো। এরই নাম ন্যুমা। আজ প্রথম দিন, তার মানে আজ লামার খুব সামান্যই আহার করার দিন।
গুম্ফার ভেতরে ঘিয়ের প্রদীপ জ্বলছে। আবছা আবছা আলো আর অনধকার মিলেমিশে রয়েছে। তাতেই চোখে পড়ল গুম্ফার দেয়ালে আঁকা আছে ড্রাগন, মেঘ, পাখি, সারসপাখি। গৌতম বুদ্ধের জীবনকথার কিছু ছবি আঁকা রয়েছে দেওয়ালে। শিশু অবস্থা থেকে ধ্যানমগ্ন পূর্ণবয়স্ক বুদ্ধদেবের বেশ কিছু ছবি সুন্দর করে এঁকেছে কেউ।
ধুপের গন্ধ ম-ম করছে ভেতরে। অবলোকিতেশ্বরের মূর্তির সামনে পদ্মাসনে বসে রয়েছেন লামা। আমাদের পায়ের শব্দ পেয়ে তাকালেন। ভুলুকে দেখে চিনতে পারলেন। মণি হাতে লোকটির দিকে তাকিয়ে কিছু বললেন।
সেই ভিক্ষু আমাদের জিঞ্চেস করলেন, লামা জানতে চাইছেন কাল ওঁর দেওয়া মন্ত্রপূত জল খেয়ে কাজ হয়েছিল কিনা।
ভুলু ঘাড় নাড়ল। তারপর পকেট থেকে দুটো একশো টাকার নোট বার করে পুজোর আসনের পাশে রেখে দিয়ে বলল, হামে সেমিফাইনাল ম্যাচ জিতনা হ্যায়।
ভিক্ষুটি ছোট ছোট চোখ কুঁচকে হাসলেন। তারপর লামার কাছে কানে কানে কিছু বলে এলেন। লামার সামনে একটা খোলা পুঁথি। একটা পাত্রে কাঁচা দুধ। একটা মাথার খুলিও রয়েছে পুজোর আসনে। কপালের নীচ থেকে কাটা। ওপরের খুলিটা কী রকম বাটির মতো দেখাচ্ছে। মানুষের পায়ের হাড়ও রাখা রয়েছে তার পাশে।
বুদ্ধের আসন থেকে তিনটে গাঁদাফুল নিয়ে সেই খুলিতে ছুঁইয়ে গম্ভীর গলায় অজানা ভাষায় মন্ত্র পড়লেন লামা। সেই ফুল তিনটে আমাদের তিনজনের হাতে দিয়ে দিলেন। পেতলের কমন্ডলু থেকে জল ঢেলে দিলেন আমাদের হাতে। ইশারা করলেন খেয়ে নিতে। আমরা মন্ত্র পড়া জল মুখে দিয়ে দিলাম।
ভিক্ষুটির উদ্দেশে কিছু বললেন লামা। আমাদের গুহার বাইরের দিকটায় নিয়ে গিয়ে তিনি বললেন, লামা তোমাদের চা খেয়ে যেতে বলেছেন।
মাখন দেওয়া চা দেওয়া হল কাচের গ্লাসে। দিব্যি খেতে। আমি চায়ে একটা চুমুক দিয়ে বললাম, অনেক ধন্যবাদ। আপনার নাম কী ?
ভিক্ষু বললেন, পেমা তামলং।
চা খেয়ে গুম্ফা থেকে বেরিয়ে ফিরে আসছিলাম আমরা। অন্ধকার হয়ে আসছে। পা চালিয়ে ফিরছিলাম আমরা তিনজন। পাশ দিয়ে দোলং নদী বয়ে যাচ্ছে। গোল থালার মতো বড় চাঁদ উঠে গেছে আকাশে। সূর্যাস্তের গোলাপি রং যত ফিকে হচ্ছে চাঁদের ঘন দুধের সরের মতো আলো তত ছড়িয়ে পড়ছে চরাচর জুড়ে। নদীর জলের ঝিনঝিন শব্দ কানে আসছে, দারুণ লাগছে পরিবেশটা।
ভুলু বলল, পরশুর ম্যাচটাও আবার হাসতে হাসতে জিতব দেখে নিস তোরা।
আমি বললাম, অসম রাইনোকে হারাতে পারলে বুঝব তোর এই লামার সত্যিই কিছু ঐশ্বরিক ক্ষমতা আছে।
৯
পুরনো পাঁচন আজ থেকে বন্ধ। নিম, নিশিন্দা আর বাসক মিশিয়ে নতুন একটা পাঁচন তৈরি করেছেন ডাকুকাকু। গাঢ় সবুজ চেহারা দেখেই মনে হচ্ছিল যে এর স্বাদ বিদঘুটে হবে। রাসেল ওজর আপত্তি করতে গিয়ে রামবকুনি খেল।
ডাকুকাকু বললেন, ‘নিম, নিশিন্দে, বাসক যেথা রোগ থাকে না সেথা’ – এই প্রাচীন প্রবাদটা শোনোনি তোমরা? এই তিনটে মহৌষধির সঙ্গে আমি নিজের ফরমুলা অনুযায়ী আরও কয়েকটা জিনিস মিশিয়েছি। বনতুলসী, ব্রাহ্মী, কালোমেঘ আর বাসকপাতা। এর মধ্যে অনেকটা মধুও ঢেলে দিয়েছি। ফলে গুড়ের থেকেও মিস্টি হয়েছে পাঁচনটা। নাও, সোনামুখ করে খেয়ে নাও এক চামচ।
রাসেল পাঁচন খেয়েই ওয়াক ওয়াক করতে শুরু করে দিল।
তারপর আমার পালা। সেই ভয়ংকর তেতো তরল গলা দিয়ে নামতেই নাকমুখ দিয়ে গরম ধোঁয়া বেরোতে থাকল যেন। এমন তেতো জিনিস আমি আমার জন্মে খাইনি।
সনাতনকাকু জরিপ করছেন প্রত্যেককে। তাই পালিয়ে লাভ নেই, এক এক করে প্লেয়ারদের সবাইকেই পাঁচন খেতে হল নিমতেতো মুখ করে।
স্নান করে একটু নেট-প্র্যাকটিস সেরে গেস্টহাউজে ফিরে এসেছি। গেস্ট হাউজের সামনে বিশাল হাতা। তার চারদিকে বাঁশের বেড়া, একদিকে কেয়ারটেকার সিরিংজির এক কামরার কাঠের বাড়ি। ওপরে টিনের চাল। রোমশ দুটো পাহাড়ি কুকুরছানা ইতিউতি ঘুরছে লেজ নাড়িয়ে নাড়িয়ে। সিরিংজির পোষা মোরগ আছে কয়েকটা। গ্রীবা উঁচু করে গর্বিত ভঙ্গিতে পায়চারি করে হাতার মধ্যে।
সিরিংজির সঙ্গে ওঁর বাড়ির দাওয়ায় বসে আমরা খোশগল্প করছিলাম। এমন সময় বাইরে গাড়ির হর্ন শুনতে পাওয়া গেল।
তমাল গেল দেখতে। ফিরে এসে জানাল, অনিকেতকাকু সঙ্গে আর এক ভদ্রলোককে নিয়ে এসেছেন। আজ এগারোটা থেকে পটনা পটাকা আর সিকিম রাইফেলসের জমজমাট সেমিফাইনাল ম্যাচ। সেজন্য আমাদের মাঠে নিয়ে যেতে এসেছেন।
ডাকুকাকু সকাল থেকে বিভিন্ন রকম গাছের পাতা একটা পাথরের পাত্রে হামানদিস্তা দিয়ে ছেঁচে পাঁচন তৈরিতে ব্যস্ত। গবাদাদু আর হিগিনজেঠু দাবা খেলছেন মন দিয়ে। সনাতনকাকুর প্রতিদিন পাঁচ-সাতশো ডন-বৈঠক দেওয়া অভ্যাস। সেই কাজটাই করছিলেন একাগ্র মনে।
বললাম, অনিকেতকাকু গাড়ি নিয়ে এসেছেন। সেমিফাইনাল ম্যাচ দেখতে আপনারা কেউ যাবেন ?
সনাতনকাকু বললেন, ফাইনালে আমরা যে উঠব তাতে কোনও সন্দেহ নেই। সেজন্য যাদের সঙ্গে আমাদের ফাইনালে খেলতে হবে আজ তাদের একটু দেখে নেবার প্রয়োজন আছে বইকি। অবশ্যই মাঠে যেতে হবে আমাদের।
সঙ্গী ভদ্রলোকের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন অনিকেতকাকু। বললেন, ইনি দেবরাজ বোস, রংঝুরি থানায় আমার সহকর্মী।
দুপুরের খাবার একটু তাড়াতাড়িই সেরে নেওয়া হল। অনিকেতকাকুদের দুটো গাড়িতে আমরা ভাগাভাগি হয়ে উঠে পড়লাম।
খেলার মাঠে এসে দেখি স্টেডিয়াম পুরো ভর্তি। প্ল্যাকার্ডে ফেস্টুনে ছেয়ে আছে মাঠ। সিকিমের সাপোর্টারই বেশি। দর্শকদের চিৎকারে গমগম করছে চারপাশ।
তবে খেলা বেশিক্ষণ স্থায়ী হল না। সিকিম একষট্টি রানে অল আউট হয়ে গিয়েছিল। মাত্র সাত ওভারে জেতার রান তুলে ফেলল পটনা। খেলা শুরু হতে না হতেই শেষ। সিকিমকে উড়িয়ে দিয়ে ফাইনালে চলে গেল পটনা পটাকা।
রাসেল হতাশ হয়ে বলল, সেই বিকেলে আমাদের প্র্যাকটিস। লা’ও হয়ে গিয়েছে। এতক্ষণ তাহলে কী করব আমরা ?
দেবরাজ বোস অনিকেতকাকুকে বললেন, ওদের নিয়ে রংঝুরির আশেপাশে একটা চক্কর দিয়ে এলে কেমন হয় ?
অনিকেতকাকু হেসে বললেন, বেশ, চলো তবে। ঘন্টাখানেক না হয় একটু টইটই করে আসা যাক।
বড়রা ফিরে গেলেন গেস্ট হাউজে। আমরা বেরোলাম অনিকেতকাকুর ভাষায় ‘টইটই’ করে আসতে।
আমি বসেছি অনিকেতকাকুর পাশের সিটে। রংঝুরি থেকে বেরিয়ে পাহাড়ের চড়াই বেয়ে উঠলাম কিছুটা। অনিকেতকাকু একটা জায়গা দেখিয়ে বললেন, এখানে এলাচ চাষ হয়। এদিকের লোকেরা এলাচ চাষ করে বেশ ভাল টাকা উপার্জন করে।
একটা বিরাট সমতল জায়গা দেখিয়ে বললেন, প্রত্যেক সপ্তাহে সোমবার করে এখানে হাট বসে। স্থানীয় মানুষের পাশাপাশি পাহাড়ের পর পাহাড় ডিঙিয়ে ভুটানের লোকজনও বিকিকিনি করতে আসেন রংঝুরি হাটে।
গাড়ি ঘুরিয়ে জঙ্গলের দিকে এলাম আমরা। আঙুল উঁচিয়ে অনিকেতকাকু বললেন, বাঘ, লেপার্ড, বুনো কুকুর আর শুয়োর তো আছেই, হিমালয়ের কালো ভালুকও কিন্তু আছে এই জঙ্গলে।
একটা জায়গায় স্থানীয় ডুকপা মানুষজনের ভিড় দেখলাম। অনিকেতকাকু বললেন, এদের নিমলো উৎসব আছে আজ। সেজন্য নতুন পোশাক পরেছে সকলে। এই যে ওভারকোটের মতো পোশাক পরে রয়েছে পুরুষেরা একে বলে ‘বখু’। বখুর ভাঁজের মধ্যে অনেকটা থলের মতো জায়গা থাকে, সেখানে ভ্রমণ করার সময় খাবার-দাবার আর পান-সুপারি রাখে ডুকপা পুরুষেরা।
মিঠু বলল, মেয়েরা যে অদ্ভুত কীরকম একটা পোশাক পরে রয়েছে সেটার নাম কী ?
অনিকেতকাকু বললেন, মেয়েরা পরেছে সেমিজের পোশাক ‘গুছুম’। তার ওপর ওড়নার মতো করে পরেছে রংবেরংয়ের ‘কিরা’। এক একটা ভাল কোয়ালিটির কিরার দাম জানো কত ? প্রায় এক থেকে দেড় হাজার টাকা। মেয়েদের হাতে রুপোর মোটা যে বালা দেখছ, তার নাম দোপচু। গলায় যে পুঁতির মালা পরেছে তাকে বলে ছুউ।
আমাদের গাড়ি চলছিল ধীর গতিতে। অনিকেতকাকু গিয়ার বদলে স্পিড তুলে বললেন, এবার তোমাদের নিয়ে যাব দাচারে দেখাতে।
রাসেল বলল, কী বললেন, বাঁচা রে ?
অনিকেতকাকু হো হো করে হেসে বললেন, তিরন্দাজী খেলাকে ডুকপা ভাষায় বলে দাচারে। আজ এক জায়গায় দাচারে কম্পিটিশন হচ্ছে শুনেছি। চলো গিয়ে দেখে আসি একটু।
আমাদের গাড়ি এবার একটা বড় মাঠের ধারে এসে দাঁড়াল। কয়েকজন ডুকপা যুবক তিরধনুক নিয়ে দাঁড়িয়ে দাচারে খেলছিল। প্রায় একশো মিটার দূরের একটা কাঠের বোর্ডের মধ্যে তির গাঁথতে হবে। ছেলেগুলো দূর থেকে তির ছুঁড়ে প্র্যয় প্রত্যেকেটা তির বোর্ডের মধ্যে গেঁথে দিচ্ছে অবলীলায়।
ভুলু উৎসাহ নিয়ে বলল, আমাদের কি একটু তির ছুঁড়তে দেবে ওরা ?
দেবরাজ বোস বললেন, সে দেবে। কিন্তু ব্যাপারটা যত সহজ বলে তোমার মনে হচ্ছে তত সহজ নয়।
দেবরাজ বোস ইশারা করায় একজন যুবক এগিয়ে এল। রাসেলের হাতে তার নিজের তির ধনুক ধরিয়ে দিয়ে তির ছুঁড়তে বলল নিজেদের ভাষায়। ভুলু আনাড়িভাবে ধনুকা ধরেছিল। সেই ছেলেটি এগিয়ে এসে ইশারা করে ধনুকের ছিলায় টান দেবার কায়দাটা বুঝিয়ে দিল। সেই কায়দা অনুযায়ী তির ছুঁড়ল ভুলু। অর্ধেক পথ গিয়ে সেই তির মুখ থুবড়ে পড়ল। হেসে গড়িয়ে পড়ল ছেলেগুলো।
ভুলুর পর আমরা সকলেই এক এক করে তির ছুঁড়লাম ধনুকে ছিলা টেনে। কাঠের বোর্ডের টার্গেটে লাগার তো প্রশ্নই নেই, আমাদের কারও তির একশো মিটার পার করতে পারল না। দেবরাজ বোস আর অনিকেতকাকুর ছোঁড়া তির টার্গেটের কাছাকাছি গেল, কিন্তু লাগল না।
দাচারে থেকে বেরিয়ে এলাম আমরা। কিছুটা গিয়ে গাড়ি দাঁড়ালো আবার।
একটু ঝোপ জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে পথ হেঁটে একটা ফাঁকা মতো জায়গায় নিয়ে এলেন অনিকেতকাকু। মাঠের মধ্যে ঘন ঘন কয়েকটা শুকনো বাঁশ মাটিতে গাঁথা। বাঁশের মাথায় পতাকার মতো করে কাপড় টাঙানো। কয়েকটা জায়গায় মাটি খোঁড়া রয়েছে। গর্ত হয়ে রয়েছে অনেকটা করে। তার মধ্যে একটা গর্ত একদম টাটকা।
অনিকেতকাকু বললেন, এটা ডুকপাদের গোরস্থান। ডুকপারা সাধারণত শব দাহ করে। তারপর শ্মশানে, বাড়ির পাশে উঁচু জায়গায় বুদ্ধের বাণী লিখে পতাকার মতো করে টাঙিয়ে রাখে। এখান থেকেই মাটি খুঁড়ে মৃতদেহ চুরি গিয়েছে।
আমি কৌতূহলী হয়ে বললাম, ডুকপারা তো মৃতদেহ দাহ করে। তাহলে মৃতদেহ কবর দেয় কারা ?
দেবরাজ বোস বুঝিয়ে বললেন, স্বাভাবিক মৃত্যুতে ডুকপারা মৃতদেহ ছ’মাস পর্যন্ত মাটির নীচে পুঁতে রাখে। পরে তা উঠিয়ে নিয়ে দাহ করা হয়। মৃত্যুর পর একুশ দিন পর্যন্ত বিভিন্ন পূজা-অর্চনা, ধর্মগ্রন্থপাঠের মতো পারলৌকিক আচার মেনে চলে এরা। একুশতম দিনে সকলকে পানভোজন করান হয়। মৃতের আত্মার শান্তির জন্য এরা রাস্তার পাশে পথিকদের বিশ্রামের জন্য কাঠের বেঞ্চ বানিয়ে মৃত মানুষটির নামে উৎসর্গ করে।
বাপ্পা বলল, তার মানে মৃত্যুর পর যখন ছ’মাসের জন্য সাময়িকভাবে কবর দেওয়া হয়েছিল তখনই কি দুষ্কৃতীরা এই কান্ড ঘটিয়েছে ?
রানা বলল, কিন্তু লাশগুলো নিয়ে কী করেছে লোকগুলো ? কোথায়ই বা রেখেছে বডিগুলোকে ?
অনিকেতকাকু অস্ফূটে বললেন, সেটাই তো লাখ টাকার প্রশ্ন।
১০
আড়াইটে বেজে গেছে। সূর্য হেলে পড়ছে পশ্চিমদিকে। কাজেই আর দেরি করা চলে না। গাড়িতে চেপে বাড়ি ফিরছি আমরা।
আমি অনিকেতকাকুর পাশেই বসেছি। ওঁর স্টিয়ারিং ধরা, ক্লাচে পা রেখে গিয়ার বদলানো দেখতে বেশ লাগছিল। পোক্ত হাতে গাড়ি চালাচ্ছেন অনিকেতকাকু। সেদিকে চোখ রেখে বললাম, সেদিন সনাতনকাকুর বাড়ির ছাদে আপনার কাছে হাড়বাজারের গল্প শোনার পর আমি বাড়ি ফিরে ইন্টারনেট ঘেঁটেছিলাম।
অনিকেতকাকু আমার দিকে তাকিয়ে কৌতূহলী হয়ে বললেন, তা কী দেখলে ?
আমি বললাম, দেখলাম মানুষের হাড় নিয়ে পড়াশোনা শুরু হয়েছিল সেই লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চির স্কেচ থেকে।
অনিকেতকাকু সায় দিয়ে বললেন, ঠিক বলেছ। আসলে আমাদের চিকিৎসাবিজ্ঞান যত উন্নতি করতে থাকল ডাক্তারদের মানুষের শরীর নিয়ে ধারণাকে আরও গভীর করে তোলার জন্য কঙ্কালের প্রয়োজন সেই হারে বেড়েই চলল। সে কারণে ঊনবিংশ শতকের গোড়ায় ইউরোপে কঙ্কালের চাহিদা বহুগুণ বেড়ে গিয়েছিল। ইংল্যান্ড যেহেতু চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানের জন্মভূমি তাই সেখানে দেহচুরির ঘটনা ছিল নিত্যনৈমিত্তিক।
সামনে একটা খাদ। হেয়ার পিন বেন্ড। অনিকেতকাকু গাড়ির স্পিড কমিয়ে দিলেন। তারপর স্টিয়ারিংয়ে একটা মোচড় দিয়ে চুলের কাঁটার মতো বাঁকটা পার করে এসে বললেন, তবে আমেরিকার গল্পটা আরও সাংঘাতিক।
ভুলু কৌতূহলী হয়ে বলল, কেন ? কী হয়েছিল আমেরিকায় ?
অনিকেতকাকু বললেন, আড়াইশো বছর আগের আমেরিকায় অসুখ বিসুখ লেগেই থাকত। সে কারণে বেকার যুবক-যুবতীদের ডাক্তারিতে রোজগারের সম্ভাবনা ছিল ষোলোআনা। স্বাভাবিকভাবেই ছাত্র সংখ্যা হু-হু করে বাড়তে থাকল। সঙ্গে সঙ্গে ডাক্তারি শেখার জিনিসপত্রে টান পড়তে শুরু হল। বিশেষ করে কঙ্কালে। ফলে কবর থেকে চুরি হতে শুরু করল মৃতদেহ। বেশির ভাগ মৃতদেহই চুরি হত কালো মানুষ বা আইরিশদের কবর থেকে। যেহেতু এঁরা ছিলেন সমাজের নীচুতলার লোকজন।
আমি কৌতূহলী স্বরে বললাম, কিন্তু আমাদের দেশের দিকে কী করে চোখ পড়ল ওদের ?
অনিকেতকাকু বললেন, ঐতিহাসিক মাইকেল স্যাপলের ‘আ ট্র্যাফিক ইন ডেড বডিজ’ বইটা পড়ো। এ বিষয়ে অনেক কিছু জানতে পারবে। আসলে সে সময় যথেষ্ট পরিমান কালো লোকেদের কঙ্কাল পাওয়া যাচ্ছিল না। তখন ওদের চোখ পড়ল আমাদের উপনিবেশগুলোর ওপর। স্বাভাবিকভাবেই আমাদের দেশও বাদ পড়ল না।
ভুলু বলল, এখানে কীভাবে হাড়ের জোগানদার খুঁজে পেল ওরা ?
অনিকেতকাকু বললেন, এ দেশে ডোম জাতির লোকজনকে হাড় জোগানের কাজে লাগিয়েছিল ওরা। বললে বিশ্বাস করবে না, কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ তখন বছরে একশোটা কঙ্কালের জোগান দিচ্ছিল। তারপর বহুদিন সেই ধারা চলেছে। ১৯৮৫ সালে ‘শিকাগো ট্রিবিউন’-এ একটা খবর বেরিয়েছিল যে ভারত তার আগের বছর ষাট হাজার খুলি আর কঙ্কাল রফতানি করেছিল।
রাসেল বিস্মিত হয়ে বলল, এত ?
অনিকেতকাকু বললেন, সে সময় কলকাতার হাড় কারখানার মোট বাৎসরিক ব্যবসার মূল্য কত ছিল জানো ? দশ লক্ষ ডলার। তখন আমাদের প্রশাসন হাড় কারখানাগুলোকে প্রয়োজনীয় লাইসেন্স দিত সহজেই। বেওয়ারিশ লাশের যে গতি হত শুধু তাই নয়, একটা ব্যবসার দিকও ছিল। কিন্তু শুধু বেওয়ারিশ লাশ দিয়ে এই প্রবল চাহিদা মেটানো যাচ্ছিল না। কিছু কিছু ক্ষেত্রে মরলে কঙ্কাল দান করবে এই ভরসায় জীবিতদের আগাম দাদন দেওয়া হচ্ছিল।
আমি বললাম, কিন্তু কোন জীবিত মানুষ কবে মরবে সেই ভরসায় তো আর নিয়মিত জোগান চালিয়ে যাওয়া যায় না। তাহলে ?
অনিকেতকাকু বললেন, সেটাই তো বলছি। তখন বড় ধরনের মড়া চুরিতে জড়াতেই হল অসাধু ব্যবসায়ীদের। এদিকে পনেরোশো শিশুর কঙ্কাল আবিস্কার হল ভারতে। শুরু হল আলোড়ন। খবরের কাগজগুলো দাবি করল ওই শিশুদের আসলে হত্যা করা হয়েছে। তুমুল হ-গোলের মধ্যে সুপ্রিম কোর্ট মানব শরীরের রফতানি বেআইনি বলে ঘোষণা করল। কঙ্কালের ব্যাবসা প্রকাশ্য ভাবে বন্ধ হয়ে গেল সেই থেকে।
তমাল বলল, এবার বুঝলাম। তার মানে তখন থেকেই তলে তলে হাড়বাজারের চক্র ছড়িয়ে পড়তে শুরু করেছিল সারা দেশ জুড়ে। যার একটা চক্র এই শান্তশিষ্ট রংঝুরিতেও আছে বলে সন্দেহ করছেন আপনারা। এই যে কবর থেকে মৃতদেহ চুরি হচ্ছে সেটা সেই হাড় জোগানের উদ্দেশ্যেই। তাই না ?
কথা বলতে বলতেই আমাদের গেস্টহাউজ এসে গিয়েছে। অনিকেতকাকু ঘ্যাঁস্স করে গাড়ি দাঁড় করালেন। পিছন পিছন দেবরাজ বোসের গাড়িও চলে এসেছে। অনিকেতকাকু বললেন, কাল তো অসম রাইনোর সঙ্গে হাড্ডাহাড্ডি সেমিফাইনাল খেলা ! সেজন্য তোমাদের প্রত্যেককে শুভেচ্ছা জানিয়ে রাখলাম আগে থেকে।
টিংকু মিঠুরা সকলে দ্রুতপায়ে ঢুকে পড়ল গেস্টহাউজে। রাসেল হাতে বরাভয় মুদ্রা ফুটিয়ে গলাটা খাটো করে বলল, অসম রাইনোর ম্যাচ নিয়ে চিন্তা করবেন না। কাল বিকেলে বড়দের না জানিয়ে পাহাড়ের ওপর এক লামার গুম্ফায় গিয়েছিলাম আমরা তিনজন। কালকের ম্যাচ ধরে নিন আমরা একরকম জিতেই গিয়েছি।
অনিকেতকাকু অবাক হয়ে বললেন, গ্যালসিন লামার গুম্ফায় গিয়েছিলে ? সে তো বেশ দূর !
আমি সবিস্তারে সব জানালাম। আমাদের পাহাড়ি পাকদন্ডী পথ দিয়ে ওঠা, লামার গুম্ফায় পৌঁছনো, সেখানে মণি হাতে লোকটি, সবশেষে গ্যালসিন লামার গল্প।
অনিকেতকাকু হেসে ফেললেন, এই যে বিশ্বকাপ ফুটবলে আফ্রিকান টিমগুলো খেলতে যায়, ওরা সঙ্গে ওঝা আর তান্ত্রিকদের নিয়ে যায়। তারা আবার মানুষের হাড়গোড় নিয়ে ঝাড়ফুঁক-তুকতাক করে। কিন্তু লাভ কী ? আফ্রিকার টিমগুলো কি আজ অবধি চ্যাম্পিয়ন হতে পেরেছে একবারও ?
রাসেল বলল, নাহ্, তা অবশ্য পারেনি।
অনিকেতকাকু বললেন, ওসব প্রসঙ্গ থাক। এবার বলো গ্যালসিন লামার গুম্ফাটা কেমন লাগল তোমাদের ?
আমরা সমস্বরে বললাম, এর আগে কোনও ধারণা ছিল না। এই প্রথম কোনও গুম্ফার ভেতরে গেলাম। দারুণ লাগল।
অনিকেতকাকু একটুক্ষণ চুপ করে থাকলেন। তারপর আচমকা আমার কাঁধ খামচে ধরে বললেন, তখন কী বলছিলে যেন ? ওখানে অবলোকিতেশ্বরের মূর্তির সামনে মাথার খুলি আর মানুষের পায়ের হাড় দেখেছ ? আর ইউ শিওর?
রাসেল বলল, হ্যাঁ, মাথার খুলি রাখা আছে লামার পুজোর আসনে। খুলিগুলো কপালের নীচ থেকে কাটা, ওলটানো বাটির মতো দেখতে। মানুষের পায়ের হাড়ও আছে। মনে হল যেন পালিশ করা, মোমের আলো লেগে চকচক করছিল সেগুলো।
দেবরাজ বোসের ভুরুদুটো ধনুক হয়ে গেল। অনিকেতকাকুর দিকে তাকিয়ে বললেন, কিছুদিন আগেই তো লোক পাঠিয়েছিলাম ওখানে। কেউ তো কিছু বলেনি ?
রাসেল দুম করে বলে বসল, তখন হাড়বাজারের কথা বলছিলেন, ওই খুলিগুলো কি হাড়বাজার থেকে কেনা বলে মনে হয় ?
অনিকেতকাকু গম্ভীর হয়ে বললেন, হতেই পারে। হাড়বাজারের খদ্দের শুধু ডাক্তারি ছাত্ররাই কিন্তু নয়, সন্ন্যাসীরাও প্রচুর দাম দিয়ে এ জিনিস কেনে। ভুটানি বৌদ্ধদের কোনও কোনও গোষ্ঠীর মধ্যে বিশ্বাস আছে যে, নশ্বরতাকে বোঝার জন্যে মৃতদেহের কাছে সময় কাটাতে হয়। তাই এই বিশ্বাসীরা মানুষের হাড় দিয়ে বানানো নানান রকম পাত্র আর অন্যান্য জিনিস ব্যবহার করে থাকে। যেমন খুলি দিয়ে প্রার্থনা পাত্র, পায়ের হাড় দিয়ে বাঁশি – এমন সব।
দেবরাজ বোস ব্যস্ত হয়ে বললেন, কাল সকালেই একবার ওই গুম্ফায় যেতে হবে।
অনিকেতকাকু ভুরু জড়ো করে বললেন, কাল নয় দেবরাজ। বেশি দেরি করাটা ঠিক হবে না। আজই একবার ঢুঁ মারতে হবে দেবরাজ। লেটস মুভ।
১১
সকালে তৈরি হয়ে মাঠে এসে অসম রাইনোর প্লেয়ারদের প্র্যাকটিস করতে দেখে আমাদের সকলের বুক ধুকধুক করতে শুরু করে দিল। রানা ভয় পেয়ে গিয়ে বলল, চপল, চেহারা দেখেছিস এক এক জনের ? কী ফিগার রে ছেলেগুলোর, কাউকেই তো আন্ডার নাইনটিন বলে মনে হচ্ছে না। প্রত্যেকেরই ম্যাচিওর চেহারা। এরা ক্রিকেটার তো নয় যেন যুদ্ধক্ষেত্রের সৈনিক !
আমিও ঢোঁক গিললাম। ওদের প্রত্যেকটা প্লেয়ার ছ’ফিটের ওপর লম্বা। প্রত্যেকের ছিপছিপে চেহারা, ছোট ছোট করে ছাঁটা চুল। জলপাই রঙের জার্সি পরে যখন ওরা শরীরের নানা রকম কসরত করছিল তখন মনে হচ্ছিল যে ফৌজির দল বোধ হয় যুদ্ধে নামার প্রস্তুতি নিচ্ছে।
গগন সিংহানিয়া আর ড্যানিয়েল ডুকপা এসেছিলেন মাঠে। আমাকে দেখে বললেন, কী ব্যাপার ? মুখটা শুকনো শুকনো লাগছে যে। একটু টেনশনে আছো বলে মনে হচ্ছে যেন ?
যদিও টেনশনে পেট গোলাচ্ছে তবুও আমি একটু হেসে সমার্টনেস দেখাবার চেষ্টা করে বললাম, না না, টেনশনের কী আছে।
গগন সিংহানিয়া আমার পাশে এসে দাঁড়ালেন। আমার কাঁধে হাত রেখে বললেন, ডোন্ট বি অ্যাফ্রেড স্কিপার। নিজেদের ক্ষমতার ওপর আস্থা রাখো। যাও, মাঠে নেমে বুলডোজার চালিয়ে দাও অসম রাইনোর ওপর দিয়ে। ম্যাচ কিন্তু জিতেই আসতে হবে তোমাদের।
ড্যানিয়েল ডুকপা আমাদের চাগিয়ে দেবার জন্য বললেন, খেলা তো একরকম যুদ্ধই। ধরো তুমি ব্যাটের এজ লাগিয়ে আউট হয়ে গেলে অথচ আম্পায়ার বুঝতে না পেরে আউট দিলেন না। তাহলে কিন্তু ফিরে আসবে না। গেমসম্যানশিপ তো এখন একটা আর্ট। মনে রেখো, তোমাদের জিততেই হবে আজ। বাই হুক অর বাই ক্রুক।
আমি ঘাড় নেড়ে বললাম, চেষ্টা করব আমরা।
ভুলু আমার কানে কানে ফিসফিস করে বলল, ভদ্রলোকের কথাটা শুনলি ? আমি সেদিন তোদের কী বলেছিলাম মনে আছে ? এখনও বলছি যে এই ড্যানিয়েল ডুকপাই রংঝুরির যাবতীয় কুকর্মের মূল পান্ডা ! লোকটার কথাবার্তাতেই পরিস্কার বোঝা যাচ্ছে ব্যাপারটা। আরে, যে লোক সামান্য ক্রিকেট ম্যাচ জেতার জন্যেই এমন আদেখলাপনা করতে পারে সে টাকাপয়সার বখরা থাকলে তো মানুষ অবধি খুন করে ফেলবে রে চপ্পল !
আমি ধমক দিয়ে বললাম, প্লিজ, এখন চুপ কর। ক্রিকেটে কনসেনট্রেট কর। ভাল করে খেলতে হবে আজ। জিততেই হবে আমাদের।
আমরা মাঠে নেমে ওয়ার্ম আপ করতে শুরু করলাম। ভুলু নখ কামড়াতে শুরু করেছে টেনশানে। আমার সামনে এসে ফ্যাসফ্যাসে গলায় বলল, চপ্পল, আমার পেটটা কেমন যেন করছে রে। খেলা শুরু হতে তো এখনও একটু সময় আছে। একবার টয়লেট থেকে ঘুরে আসব নাকি ?
আমি স্ট্রেচিং করতে করতে ভুলুকে সাহস দেবার জন্য বললাম, অত ভয় পাচ্ছিস কেন ? ক্রিকেট তো স্কিলের খেলা, চেহারার খেলা তো নয়। তুইও কি কিছু কম নাকি কারও চেয়ে ! তোর নিজের ওপর কনফিডেন্স নেই ?
ভুলু অম্লানবদনে বলল, একটু আগেও ছিল। এদের চেহারা দেখার পর এখন আর নেই।
রাসেল আমার পাশে এসে বলল, আমারও কেমন ভয় ভয় করছিল একটু আগে। কিন্তু সেই টেনশানটা এখন কেটে গেছে। পকেট থেকে লামার দেওয়া ফুল বার করে কপালে ছুঁইয়ে রাসেল বলল, এটা যখন পকেটে আছে আমাদের হারায় কার সাধ্য ! আমার মন বলছে আজকের ম্যাচও জিতব আমরা।
ভুলুও পকেট থেকে সন্তর্পণে ফুল বার করে কপালে ছোঁয়াল। কান এঁটো করা হাসি হেসে বলল, বুঝলি চপ্পল, শরীরের রক্ত এতক্ষণ হিমঠান্ডা হয়ে ছিল। এবার একেবারে ফুটতে শুরু করেছে। আজ একেবারে জান দিয়ে খেলব। আজ ডু অর ডাই, কোনও উপায় নাই।
আমি ভরসা দেবার জন্য বললাম, নিজের ক্ষমতার ওপর আস্থা রাখ। বাকিটা ওপরঅলার ওপর ছেড়ে দে। দেখা যাক কী হয়।
টসে জিতে প্রথমে ব্যাট করতে গেলাম আমরা। বাবুর সঙ্গে ভুল বোঝাবুঝিতে সিন্টু রান আউট হয়ে ফিরে এল প্রথম ওভারেই। দর্শকদের তুমুল উচ্ছ্বাসের মধ্যে আমি নামলাম ব্যাট হাতে। আগের দিনই ভাল রান পেয়েছি তবুও প্রথম রান করা পর্যন্ত একটা টেনশান ছিল।
প্রথম বলটাই এল খুব জোরে কিন্তু একেবারে ব্যাটের ওপর হাফভলি। সামনের পায়ে শরীরের ওজন নিয়ে গিয়ে বলটাকে একটু জোরে পুশ করলাম। উল্টোদিকের উইকেটের পাশ দিয়ে বল সোজা গিয়ে লাগল সাইটস্ক্রিনে। প্রথম বলেই চার দিয়ে শুরু।
আর ফিরে তাকাতে হল না। দশ বল খেলার আগেই দুটো বাউন্ডারি মেরে ডাবল ফিগারে পৌঁছে গেলাম। সাতাশ বলে এল আমার পঞ্চাশ। একচল্লিশ বলে সাতাত্তর করে যখন আউট হলাম তখন বিরাট ব্ল্যাকবোর্ডের দিকে তাকিয়ে দেখি আমাদের টিমের রান পৌঁছে গেছে চোদ্দ ওভারে একশো এগারোতে।
বাবু আউট হয়েছিল বাইশ রানে। টিংকু আর মিঠু রান পেল না তেমন। তবে ভুলু আর রাসেল শেষদিকে ভাল খেলে রানটাকে বাড়িয়ে নিয়ে গেল একশো বিরাশিতে। দুজনেই চল্লিশের কাছাকাছি রান করল নট আউট থেকে।
লা’ ব্রেকের সময় গগন সিংহানিয়া এসে হাত মিলিয়ে গেলেন আমার সঙ্গে। বললেন, আমার একটা জরুরি কাজ পড়ে গেছে। তাই চলে যেতে হচ্ছে। ওদের হেমেন নামে একজন আছে। ভাল ব্যাট। তাকে আউট করতে পারলেই জিতে যাবে তোমরা।
অসম রাইনো শুরু করল জব্বর। হেমেন নেমেই প্রলয় বাধিয়ে দিল। ওরা দশ ওভারে একশো করে ফেলেছিল দুই উইকেটে। তমাল আর বাপ্পা আমাদের সেরা বোলার। ওদের দুজনকে প্রায় প্রত্যেক বলেই বাউন্ডারি মারছিল অসমের হেমেন ফুকন। এই হেমেন নাকি এবার অসমের হয়ে বিজয় হাজারে ট্রোফিতে সুযোগ পেয়েছে। দুরন্ত ব্যাট করে ছেলেটা। আমাদের জেতা ম্যাচ একা হাতে নিয়ে চলে যাচ্ছিল হেমেন। বাপ্পা, তমাল তো মার খেলই, মিঠু, টিংকুও ছাড় পেল না। আমি নিজে পার্ট টাইম বল করি। আমিও এক ওভারে তেরো রান দিয়ে বসে থাকলাম।
আমাদের সকলের মাথার চুল ছেঁড়ার জোগাড়। সবরকম চেষ্টা করেও লাভ হয়নি, হেমেনের উইকেট আসছে না কিছুতেই। এমনকী, উল্টোদিকের ব্যাটসম্যানটাও দেখতে দেখতে ত্রিশ করে ফেলল কিছু বোঝার আগে।
ড্রিংকস হল দশ ওভারের সময়। ভুলুকে ডেকে বললাম, কী রে, এক ওভার তোর লেগস্পিন ট্রাই করে দেখবি নাকি ? কনফিডেন্স আছে বল করার ?
ভুলুও আমার মতোই পার্ট টাইম বোলার। এমনিতে অনেকটা করে লেগস্পিন করে। কিন্তু মুশকিল হল একটু নার্ভাস হয়ে গেলেই শর্ট বল করে ফেলে। আর স্পিনারের শর্ট বল খুব ঝুঁকির। মার খাবার সম্ভাবনা থাকে যথেষ্ট।
ভুলু টেনশানে নখ কামড়াতে কামড়াতে ফ্যাসফ্যাসে গলায় বলল, বাপ্পা, তমালরাই পারল না কিছু করতে। আমি কী করে পারব ?
আমি বললাম, ছেড়ে দে। আমি রাসেলকে দিয়ে একবার চেষ্টা করে দেখি।
ভুলু ঢকঢক করে পুরোটা জল খেয়ে নিল। মাথা নীচু করে কিছু ভাবল একটু। তারপর আমার জার্সির পিঠের জায়গাটা ধরে টান দিয়ে বলল, ঠিক আছে চপ্পল, সকলেই তো মার খেয়েছে, আমিও না হয় খাব। এর বেশি আর কীই বা হবে। তুই বলটা দে আমাকে।
ভুলু প্রথম বল ফেলল একেবারে মাঝ পিচে। মিড উইকেট বাউন্ডারির ওপর দিয়ে স্টেডিয়ামের ওপরের সারির দর্শকদের কাছে বল পাঠিয়ে দিল হেমেন ফুকন। পরের বল হাফভলি। সজোরে ড্রাইভ করেছিল হেমেন। মিঠু আমাদের বেস্ট ফিল্ডার। কভারে দাঁড়িয়ে ওই গোলার মতো বল আটকেই হাত ঝাঁকাতে শুরু করল মিঠু। রান হল না, কিন্তু রক্ত বেরোতে শুরু করল মিঠুর হাত ফেটে গিয়ে।
মিঠুকে বসিয়ে দিলাম। রানা এল বদলি ফিল্ডার হিসাবে। ভুলুর পরের বল গুডলেংথেই ছিল। জায়গায় দাঁড়িয়ে হেমেন সোজা পাঠিয়ে দিল সাইটস্ক্রিনের অনেকটা ওপর দিয়ে। বিরাট ছক্কা।
ভুলু নার্ভাস হয়ে ঠোঁট চাটছে বারবার। নখ কামড়াতে কামড়াতে পুরোটাই খেয়ে ফেলেছে প্রায়। আমি গালিতে ফিল্ডিং করছিলাম। সেখান থেকে দৌড়ে চলে এলাম ভুলুর কাছে। সিন্টু কিপিং গ্লাভস খুলে চলে এসেছে। ভুলুর পিঠে চাপড় মেরে সিন্টু বলল, কী হল রে, তোর বল তো ঘুরছে না একটুও !
ভুলু বলল, এমন চোরের মার কখনও খাইনি। মার খেয়ে সব গুলিয়ে গেছে। আমি নিজেই ঘুরে যাচ্ছি কিন্তু বল ঘোরাতে পারছি না।
আমি ভুলুকে ভরসা দেওয়ার জন্য বললাম, পকেট থেকে লামার দেওয়া ফুলটা বার করে ওটা বলে একবার ছুঁইয়ে নে।
কিছু মনে পড়েছে এমন একটা ভাব করে ভুলু পকেট থেকে গাঁদাফুলটা বার করল। বিড়বিড় করে কিছু বলতে বলতে সেটা ছোঁয়াল বলে। তারপর ঘাড় গুঁজে ফিরে গেল রান আপে। আমরাও চলে এলাম যার যার জায়গায়।
পরের বলেই ম্যাজিকের মতো কাজ হল। হাফভলি বল সপাটে ব্যাট চালিয়ে ছিল হেমেন। গোলার মতো বলটা এত জোরে চলে এসেছিল যে নড়তে পারেনি উল্টোদিকের ব্যাটসম্যান। তার কাঁধে লেগে বল উঠে গেল সোজা ওপরে। ভুলু নিজেই সেই লোপ্পা ক্যাচ লুফে নিল। হেমেন তো অদ্ভুতভাবে আউট হলই, নন স্ট্রাইকার ছেলেটাও আহত হয়ে বসে গেল কোঁকাতে কোঁকাতে।
দু’দুটো সেট ব্যাটসম্যান চলে গিয়ে ব্যাট করতে এল আনকোরা দুজন। উজ্জীবিত হয়ে আমরা আবার গোল হয়ে নিজেদের মধ্যে হাডল করলাম। ভুলু আমার পাশেই ছিল। আমার পেটে একটা কনুই দিয়ে একটা গুঁতো দিয়ে চোখ মটকে বলল, বুঝলি চপ্পল, আমি তো নিমিত্ত মাত্র, এ সবই আসলে গ্যালসিন লামার কেরামতি।
ওরা আর বেশিক্ষণ টানতে পারল না। একশো আটষট্টিতে শেষ করল অসম রাইনো। আমরা ম্যাচ জিতে পৌঁছে গেলাম রংঝুরি টি-টোয়েন্টির ফাইনালে। কালকের দিনটা বিশ্রাম। পরশু পটনা পটাকার সঙ্গে ফাইনাল ম্যাচ আমাদের।
ড্রেসিংরুম থেকে গেস্ট হাউজে রওনা দেবার সময় আমি দলের প্রত্যেককে বললাম, এখনও আনন্দ করার কিছু হয়নি। সব আনন্দ এখন তোলা থাক। ফাইনাল জিততে পারলে তবেই জমিয়ে সেলিব্রেশন করব আমরা। নইলে নয়।
১২
দুপুরে প্র্যাকটিস চলছিল। আমি ব্যাট করছিলাম নেটে। এমন সময় এলেন রংঝুরি ক্লাবের বেশ কয়েকজন উদ্যোক্তা।
প্র্যাকটিস সাময়িকভাবে স্থগিত হয়ে গেল। মাঠের এক ধারে এসে গোল হয়ে দাঁড়ালাম সকলে। টুর্নামেন্ট কমিটির কর্মকর্তারা আমাদের আগামীকাল জেতার জন্য শুভেচ্ছা জানালেন।
একটা কালো ওভারকোট পরে এসেছেন গগন সিংহানিয়া। স্মিতমুখে বললেন, তোমাদের টিমটা আমাদের খুব পছন্দ হয়েছে। তোমাদের সকলের বয়স কম। তোমাদের জেলার বাইরে কেউ তোমাদের নাম জানে না সেভাবে। উল্টোদিকে পটনার টিমে বেশ কিছু নামি প্লেয়ার আছে। খবরের কাগজে তাদের মাঝেমধ্যেই নাম ওঠে। টিভিতেও দেখা যায় অনেককে। কিন্তু তোমরা প্রমাণ করে দিয়েছ যে তোমরাও কিছু কম যাও না।
ড্যানিয়েল ডুকপা বললেন, দারুণ খেলছ তোমরা। তোমরাই সত্যিকারের ডার্ক হর্স। আমরা যদিও কমিটি, তবুও কাল তোমাদের দিকেই আমাদের মরাল সাপোর্ট থাকবে।
অজয় বললেন, তোমাদের সবুজ সংঘের জন্য আমি পুজো দিয়ে এসেছি। মন্দির থেকে প্রসাদী ফুল আর লাড্ডু নিয়ে এসেছি তোমাদের জন্য। নাও, খেয়ে নাও।
প্যাকেট থেকে একটা করে লাড্ডু নিয়ে নিয়ে খেলাম সকলে। শুধু রাসেল একাই খেল চারটে লাড্ডু।
এদিকে ড্যানিয়েল ডুকপা সামনে এসে দাঁড়িয়েছেন। ভুলুর সঙ্গে করমর্দন করে বললেন, সকলেই চপলের কথা বলছে। কিন্তু ক্রিকেট তো আর একার খেলা নয়। সকলেই ভাল খেলছে রংঝুরিতে। বিশেষ করে তুমি। ব্যাটে, বলে, ফিল্ডিংয়ে তুমি খুব ইউটিলিটি প্লেয়ার।
ভুলু আড়চোখে আমার দিকে তাকাচ্ছে। চোখে চাপা হাসি। ড্যানিয়েল ডুকপা বললেন, তোমার ওপরেও অনেক দায়িত্ব। ফাইনালে আরও ভাল খেলা চাই।
ভুলু বলল, আপনাকে কথা দিলাম, কাল আমরাই কাপ জিতব।
ড্যানিয়েল ভুলুর পিঠ চাপড়ে দিয়ে বললেন, দ্যাটস দ্য স্পিরিট। আই লাইক ইট।
ওঁরা হাঁটতে শুরু করলেন নিজের নিজের গাড়ির দিকে। ভুলু আমার কাছে এসে ফিসফিস করে বলল, ড্যানিয়েল ডুকপা লোকটাকে যতটা খারাপ ভেবেছিলাম ততটা খারাপ নয় রে চপ্পল। কী বলিস ?
আমি হো হো করে হেসে ফেলে বললাম, আচমকা মত বদলে ফেললি কেন, ভদ্রলোক তোর প্রশংসা করলেন বলে ?
ভুলু লাজুক হেসে বলল, তা নয়। আসলে ভদ্রলোকের জেতার জন্য একটু বেশিই খিদে। সেটাকে ঠিক দোষ বলা যায় না।
সবগুলো গাড়ি বেরিয়ে গেল এক এক করে। ড্যানিয়েল ডুকপা তখনও যান নি। গুটি গুটি দেখি ফিরে এসেছেন আমাদের দিকে। আমাকে ডাকলেন ইশারা করে।
আমি এগিয়ে গেলাম ড্যানিয়েলের দিকে। ভদ্রলোক আমার দু’কাঁধে দুটো হাত রাখলেন। নিচু স্বরে বললেন, আচ্ছা একটা কথা বলো তো চপল, গ্যালসিন লামার গুম্ফায় তোমরা গিয়েছিলে কী করতে ?
আমি অবাক হয়ে বলল, জেতার জন্য পুজো দিতে। আপনি সেটা কী করে জানলেন ?
ড্যানিয়েল আমার চোখের দিকে তাকিয়ে কেমন একটু হেসে বললেন, রংঝুরি জায়গাটা আমার হাতের তালুর মতো। এখানে একটা গাছের পাতা নড়লেও আমি ঠিক খবর পেয়ে যাই।
আমি চুপ। ড্যানিয়েল একটু যেন বিরক্ত হয়ে বললেন, সন্ধেবেলা পাহাড়ি পাকদন্ডী বেয়ে অতটা পথ গিয়েছিলে যখন তাহলে বড়দের বলে যাও নি কেন ? বিপদ আপদ হলে কী করতে তোমরা ? অ্যাট লিস্ট অনিকেতবাবুকে বলে গেলেও তো পারতে।
আমি বললাম, হ্যাঁ। আমাদের ভুল হয়ে গেছে।
ড্যানিয়েল বললেন, জায়গাটা সুবিধের নয়। শুধু ভক্তরাই শুধু নয়, অনেক উল্টোপাল্টা লোকও কিন্তু যেতে শুরু করেছে ওই গুম্ফায়। কাজেই আর কিন্তু যেও না ওখানে। কী থেকে কী হয়ে যাবে, বড়সড় বিপদে পড়ে যাবে।
আর কথা না বাড়িয়ে চলে গেলেন ড্যানিয়েল। ওঁর গাড়ি থেকে বেরোনো ধূসর ধোঁয়ার দিকে তাকিয়ে থাকলাম আমি। ভুলু আর রাসেল পাশে এসে দাঁড়িয়েছে আমার।
আমি ভুরু কুঁচকে বললাম, আমরা যে গ্যালসিন লামার গুম্ফায় গিয়েছিলাম সেটা দেখলাম জানেন ভদ্রলোক। আর যাতে না যাই সেই হুঁশিয়ারিও যেন অস্পষ্টভাবে দিয়ে গেলেন বলে মনে হল।
ভুলু বলল, তাহলে তো দেখছি আমার প্রথম ধারণাই ঠিক। লোকটা সত্যি সত্যিই ক্রিমিনাল টাইপ।
রাসেল বলল, কিন্তু আমাদের আজ বিকেলেও তো যাবার কথা ওই গুম্ফায়। মন্ত্রপূত জলপড়া খেয়ে বের করতে হবে ফাইনাল ম্যাচটা। এত দূর এসেছি। ফাইনালটা জিততে হবে না ? তাহলে কী করবি চপল ? গ্যালসিন লামার গুম্ফায় যাবি?
আমি বললাম, আলবাত যাব।
১৩
আঁকাবাঁকা সরু পাহাড়ি সরু পথ দিয়ে হাঁটছি। পথের দুপাশে জংলি চোরকাটার গাছ। জামাকাপড়ে লেগে চিমটে ধরে এঁটে যাচ্ছে আমাদের। যতটা পারছি ছাড়িয়ে নিচ্ছি। তারপর আবার হাঁটছি। গ্যালসিন লামার গুম্ফায় গিয়ে ফিরে আসতে হবে সন্ধের আগে। পা চালিয়ে হাঁটছি আমি, ভুলু আর রাসেল।
পাহাড়ি পথ। তার একদিকে চেনা অচেনা গাছের জঙ্গল। অন্যদিকে পাহাড়ের আড়াল শেষে, খাদের ধারে দাঁড়িয়ে একটা দুটো কাঠের বাড়ি। মাঝে সদ্যোজাত দামাল শিশুর মতো হাত-পা ছুঁড়তে ছুঁড়তে বয়ে চলেছে খরস্রোতা দোলং। লোকালয় ছাড়িয়ে অনেকটা উঠে এসেছি। পথে দেখা হল স্থানীয় দু’-চারজনের সঙ্গে। এদিকের মানুষজন বড় আলাপি। কথা নেই, বার্তা নেই, দু’কান জোড়া হাসি লেগেই আছে।
মজে যাওয়া ছোটো একটা পুকুর তার তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা একটা ট্রেকার্স হাট ছাড়ালাম। হঠাৎ ভুলু বলল, উরিব্বাস, ওই দ্যাখ .. কত্ত প্রজাপতি রে চপ্পল !
চপ্পল নামে ডাকায় মেজাজ তিরিক্ষি হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু পাশের দিকে তাকিয়ে সব ভুলে গেলাম। শয়ে শয়ে রঙিন প্রজাপতি উড়ে বেড়াচ্ছে আমাদের চোখের সামনে। মুগ্ধ হয়ে দেখছিলাম তাদের। রাসেল চোখ বড় বড় করে বলল, কী সুন্দর !
ভুলু বলল, এত সুন্দর সুন্দর প্রজাপতিগুলো, অথচ এদের আয়ু মাত্র মাসখানেক। এটা ভাবলেই মনটা কেমন খারাপ হয়ে যায়।
আমি বললাম, এদের জীবনে তিনটে ফেজ। ডিম, শূককীট আর মূককীট। সজনে বা শিউলি গাছে যে রোমশ শুঁয়োপোকা দেখা যায় সেগুলোই মথের শূককীট। তিন অবস্থা পেরিয়ে আসতে প্রজাপতির তিন থেকে ছয় সপ্তাহ লাগে।
গুম্ফার বাইরেটায় ভিক্ষুরা নিজেদের মধ্যে কথা বলছিল। তাদের সকলের হাতে জপের মালা। এই শ্রমণদের জটলার মধ্যে থেকে একজনকে দেখে একটু অবাক হলাম। গগন সিংহানিয়ার ম্যানেজার অজয় তামাং। গলা অবধি ঢাকা তিব্বতি ঢঙের কালচে মেরুন পোশাক পরে রয়েছেন। পায়ে হাঁটু পর্যন্ত জুতো। পেমা তামলংয়ের সঙ্গে চাপা স্বরে কথা বলছিলেন। আমাকে দেখে একট অবাক হয়ে গিয়ে বললেন, তোমরা এখানে ? কী ব্যাপার ?
তামলং অজয়ের দিকে তাকিয়ে কিছু বললেন নিজেদের পাহাড়ি ভাষায়। অজয় হেসে বললেন, এবার বুঝলাম। টি-টোয়েন্টি টুর্নামেন্ট জেতার জন্য এসেছ এখানে ?
আমি ঘাড় নেড়ে বললাম, হ্যাঁ, ওই আর কি।
অজয় হেসে বললেন, একেবারে ঠিক জায়গাতেই এসেছ। ওঁর কাছে যখন এসেছ তখন মনের ইচ্ছে পূর্ণ হবেই। এই লামার অনেক ক্ষমতা।
তামলংয়ের মুখ থেকেই শুনলাম লামার আজ ন্যুমার তৃতীয় দিন। অর্থাৎ সারাদিন উপাস করে রয়েছেন তিনি। পুজোর আসনে বসে রয়েছেন এখন। অবলোকিতেশ্বরের আরাধনা চলছে। আমরা পায়ে পায়ে এগিয়ে গেলাম যেখানে পুজো হচ্ছে সেখানে।
শান্ত সৌম্য বুদ্ধমূর্তি। মাটির মূর্তি কিন্তু সোনার পাত দিয়ে মোড়া মনে হল। নানা রঙের পতাকা রয়েছে ভেতরে। বিরাট রুপোর কাজ করা বেশ কিছু ঘিয়ের প্রদীপ জ্বলছে। অনেকগুলো ছোট ছোট পেতলের মূর্তি আছে একদিকে। তামলং নীচুস্বরে বললেন, এই মূর্তিগুলোর মধ্যে রয়েছেন বিভিন্ন বৌদ্ধ সিদ্ধপুরুষ আর শাস্ত্রবিদ।
আমি, ভুলু আর রাসেল আমরা প্রত্যেকে একশো টাকার দুটো করে নোট রেখে এলাম মূর্তির সামনে প্রণামী হিসাবে। লামা স্মিতমুখে কিছু বললেন। তামলং বললেন, উনি জানতে চাইছেন ওঁর দেওয়া আশীর্বাদী ফুলে কাজ হয়েছিল কিনা।
আমিা ঘাড় নেড়ে জানালাম, হ্যাঁ, হয়েছিল। তারপর বললাম, কাল বাদে পরশু ফাইনাল ম্যাচ আমাদের। সেজন্য আবার ওঁর কাছে এসেছি।
লামা আমাদের এক ঝলক দেখলেন। কিছু বললেন না। তিনটে ফুল পুজোর আসন থেকে তুলে মন্ত্র পড়ে আমাদর তিনজনের হাতে দিলেন। পেতলের কমন্ডলু থেকে মন্ত্রপূত জল আমাদের হাতে ঢেলে দিয়ে খেয়ে নিতে ইশারা করলেন। আমরা খেয়ে নিলাম সঙ্গে সঙ্গে। সাধারণ জলের মতোই তার স্বাদ আর গন্ধ।
তামলংয়ের উদ্দেশে মৃদু স্বরে কিছু বললেন লামা। তামলং আমার পিঠে হাত রেখে একটু হেসে বললেন, তোমরা তিনজন আমাদের অতিথি। তাই উনি আমাকে নির্দেশ দিয়েছেন থুকপা আর চা খাইয়ে তোমাদের বিদায় জানাতে।
খাবারের কথা শুনে রাসেলের জিভ লকলক করে উঠেছে। সাগ্রহে বলল, থুকপার কথা অনেক শুনেছি, কিন্তু এমন পোড়া কপাল, কখনও থুকপা খাইনি। আচ্ছা, কেমন করে আপনারা থুকপা বানান ?
তামলং হেসে বললেন, এটা তো আমাদের প্রতিদিনের খাবার। মকাই, জোয়ার কিংবা যবের ছাতু গরম জলে সেদ্ধ করে তৈরি করা হয়। কখনও স্থানীয় জঙ্গলের শাকসবজিও মেশানো হয়। তার মধ্যে একটু নুন ছিটিয়ে দিলেই হল, গরম গরম থুকপা তৈরি।
যে অল্পবয়েসি ভিক্ষুটি তিনটে কাচের পাত্রে থুকপা নিয়ে এল তার মুখের দিকে তাকাতেই চমকে গিয়েছি। একচোখ নেই লোকটির। দেখে গা ছমছম করে। আমাদের হাতে পাত্রগুলো ধরিয়ে দিয়েই উধাও হয়ে গেল লোকটি।
মকাইয়ের লেই লেই থুকপা চেটেপুটে গেল রাসেল। আমি আর ভুলুও খেলাম। দিব্যি খেতে। সবশেষে মাখন দেওয়া চা খেয়ে গুম্ফা থেকে বেরোলাম আমরা।
১৪
যখন উৎরাই দিয়ে নামতে শুরু করেছিলাম তখনও আলো ছিল। হঠাৎ করে আকাশ কালো মেঘে ছেয়ে গেল। হাজার হাজার কালো ঘোড়া যেন দাপাদাপি শুরু করল আকাশ জুড়ে। নিকষ কালো আঁধারের মধ্যে লকলকে চেরা জিভ দেখা যেতে লাগল। বেজে উঠল বজ্রের রণদামামা। ভুটানকে বলে বজ্রড্রাগনের দেশ। কালো অন্ধকারের মধ্যে আগুনের শিখা দেখে মনে হল হাজার হাজার ড্রাগন যেন রাগে ফুঁসছে। সব লন্ডভন্ড করে দেবে এখনই। ঠিক তখনই ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টি শুরু হল। মিনিট দুয়েকের মধ্যেই বেড়ে গেল বৃষ্টির বেগ। বেগতিক দেখে আমরা একটা বড় ওভারহ্যাংয়ের নীচে দাঁড়িয়ে পড়লাম।
একটু বাদে অদৃশ্য কোনও শক্তির নির্দেশে সব স্তব্ধ হয়ে গেল। তুমুল বৃষ্টি থেমে গেল কিছুক্ষণের মধ্যেই। আকাশ পরিষ্কার হয়ে গেল রাতারাতি। রংঝুরির দিকে নামছিলাম আমরা। ভুলু চিৎকার করে বলল, রাসেল, দাঁড়া তো একটু।
রাসেল দাঁড়াল। ভুলুর চোখ অনুসরণ করে তাকিয়ে দেখি রাসেলের কানের পিছনে একটা পুরুষ্টু জোঁক রক্ত খেয়ে লেপটে রয়েছে। আমি আর ভুলু মিলে টেনে ছাড়ালাম জোঁকটাকে। জোঁকটাকে ছাড়ানো মাত্রই চুঁইয়ে চুঁইয়ে রক্ত গড়াতে থাকল রাসেলের ক্ষতস্থান থেকে। রক্ত দেখে রাসেল ভয়ে আধমরা। ঢোক গিলে বলল, সব রক্ত তো বেরিয়ে যাবে এভাবে। তাহলে বাঁচব কেমন করে ?
উল্টোদিক থেকে উঠে আসছিল কয়েকটি অল্পবয়েসি ডুকপা তরুণ-তরুণী। রাসেলকে ভয়ে জুবুথুবু হয়ে যেতে দেখে তারা হেসে কুটিপাটি। হাসি থামিয়ে একটি মেয়ে ভাঙা হিন্দিতে বলল, ভয় পাবার কিছু নেই। একটু পরেই সব ঠিক হয়ে যাবে। জোঁকের লালায় এমন একটা জিনিস লাগানো থাকে যা রক্তকে জমাট বাঁধতে দেয় না। সে কারণে রক্ত খাওয়ার জন্য জোঁক ফুটো করলে সেখান থেকে বেরোনো রক্ত সহজে বন্ধ হয়না। একজন হেসে বলল, এর পর থেকে ভেজানো তামাকপাতা সঙ্গে রাখবে। তাহলে জোঁক ধরবে না।
আমরা ওদের ধন্যবাদ জানিয়ে নীচের দিকে নামছিলাম। ভুলু বলল, লামার গুম্ফায় অজয় তামাং আমাদের দেখে কেমন একটু চমকে গেলেন। মনে হল যেন আমাদের ওখানে এক্সপেক্ট করেননি। তাই না রে চপ্পল ?
পাশ থেকে রাসেল বলল, ওই ভিক্ষুকেও তো আমার সুবিধের লাগল না। একচোখ নেই, কী ভয়ংকর মুখটা। আজ রাতে নির্ঘাৎ খুব খারাপ কিছু স্বপ্ন দেখব।
আমি একটু চুপ করে থাকলাম। তারপর ওদের দুজনের দিকে তাকিয়ে বললাম, আমি অন্য একটা কথা ভাবছি।
রাসেল বলল, কী কথা ?
আমি বললাম, যতদূর জানি বৌদ্ধ অনুশাসন অনুযায়ী কোনও প্রতিবন্ধী ভিক্ষু হিসাবে দীক্ষিত হতে পারে না। তাহলে ?
ভুলু দাঁড়িয়ে পড়েছে। উত্তেজিত হয়ে বলল, বলিস কী রে চপ্পল ? তাই যদি হয়, তবে ওই লোকটা কী করছে এই গুম্ফায়?
আমি বললাম, আরও একটা ব্যাপারে খটকা লাগছে আমার। সেদিন তোরা দুজন যখন লামার গুম্ফায় এসেছিলি আমরা গিয়েছিলাম গগন সিংহানিয়ার বাড়িতে। সেখানে নিচতলা থেকে একটা কটুগন্ধ দোতলায় উঠে আসছিল। এত ঝাঁঝালো গন্ধ, যে নাক অল্প অল্প জ্বালা করছিল। আমরা জিঞ্চেস করাতে অজয় তামাং বললেন, ওটা মেথিলেটেড স্পিরিটের গন্ধ।
রাসেল বলল, তাতে কী হল ?
আমি বললাম, আমাদের ক্লাবঘরের ঠিক পাশে পল্টনদার কাঠের ফার্নিচারের দোকান আছে। সেখান থেকে কেমন একটা গন্ধ নাকে ভেসে আসে খেয়াল আছে ?
ভুলু বলল, হ্যাঁ। ওটা তো কী একটা স্পিরিটের গন্ধ।
আমি বললাম, ওটাই মেথিলেটেড স্পিরিট। কিন্তু সেই গন্ধে কি নাক জ্বালা করে আমাদের ?
রাসেল আর ভুলু সমস্বরে বলল, না তো !
আমি বললাম, সেখানেই তো খটকা লাগছে। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, সেদিন গগন সিংহানিয়ার নীচতলা থেকে যে ঝাঁঝালো গন্ধ ভেসে আসছিল তা আসলে অন্য কোনও কেমিক্যালের গন্ধ।
রাসেল চিন্তিত মুখে বলল, তাহলে অজয় তামাং সেদিন আমাদের মিথ্যে কথা বললেন কেন ?
ভুলু বলল, সব কেমন যেন গুলিয়ে যাচ্ছে রে চপ্পল।
আমি বললাম, আর একটা কথা আছে। এই গুম্ফায় যে আমরা আগে এসেছি সে কথা ড্যানিয়েল ডুকপা জানলেন কী করে ? কে খবরটা দিল ওঁকে ? এখানে যাতে না আসি সেজন্য আজ প্র্যাকটিসের সময় এসে ভদ্রলোক সতর্ক করলেন বারবার। সেটা কি আমাদের ভালর জন্যে নাকি ওঁর নিজের ভালর জন্য সেটাই ভাবছি।
রাসেল বলল, কী সুন্দর ছবির মতো জায়গা এই রংঝুরি। কিন্তু সেখানে এমন ঘোর রহস্য দানা বেঁধেছে কী করে কে জানে !
১৫
সকালে প্র্যাকটিস করে ফিরতেই দেখি ডাকুকাকু ভয়ানক হৈ চৈ শুরু করে দিয়েছেন। হিগিনজেঠু, গবাদাদু আর সনাতনকাকু ছুটে এসেছেন যে যেখানে ছিলেন। হ-গোল শুনে গবাদাদু একটিপ নস্যি নিয়ে জিঞ্চেস করলেন, কী হল, এত চেঁচামেচি করছেন কেন ? কিছু চুরি গেছে নাকি ?
ডাকুকাকু বললেন, দুর মশাই, চুরি যাবে কেন ? আজ ভোররাতে স্বপ্নে অনবদ্য একটা পাঁচনের ফরমুলা পয়েছি।
হিগিনজেঠু ভুরুদুটো বাঁকিয়ে বললেন, স্বপ্নে পাওয়া মাদুলির কথা শুনেছি, কিন্তু পাঁচনের রেসিপির ব্যাপারটা শুনিনি কখনও। ভেরি স্ট্রেঞ্জ !
ডাকুকাকু গম্ভীর হয়ে বললেন, রান্নার রেসিপি হয়, কিন্তু পাঁচনের ক্ষেত্রে রেসিপি না বলে ফরমুলা বলাটাই যুক্তিযুক্ত।
হিগিনজেঠু ঠোঁট উল্টে বললেন, ওই হল।
সনাতনকাকু বললেন, কী হয়েছে ব্যাপারটা একটু খুলে বলুন তো।
ডাকুকাকু বললেন, আজ ভোররাতে স্বপ্নে দেখেছি এক আউন্স ইপিকাকের মধ্যে একটু পাতিলেবুর রস আর দু’ফোঁটা তাড়ি মেশালে একটা শক্তিবর্ধক পাঁচন তৈরি হবে। সেই পাঁচন আমাদের ছেলেদের এক চামচ করে যদি খাওয়ানো যায় তবে দুরন্ত কাজ হবে।
গবাদাদু ঠোঁট উল্টে বললেন, যত্ত সব !
সনাতনকাকু গবাদাদুকে ইশারায় থামতে বলে ডাকুকাকুকে আশ্বস্ত করে বললেন, তাহলে বানিয়ে ফেলুন সেই পাঁচন। অসুবিধে কোথায় ?
ডাকুকাকু বিপন্ন মুখ করে বললেন, অসুবিধে আছে। আমার ট্রাঙ্কে বহু রকম গাছগাছরা নিয়ে এসেছিলাম। কিন্তু এই তিনটে জিনিস তো সঙ্গে আনিনি। এগুলো এখন জোগাড় করতে বেরোতে হবে। কাল ফাইনাল ম্যাচ, হাতে আর সময় নেই যে।
গবাদাদু চোখ গোলগোল করে বললেন, তাড়ি আর পাতিলেবু তো বুঝলাম, ইপিকাকটা কী জিনিস ? দাঁড়কাক টাইপ কিছু?
হিগিনজেঠু গবাদাদুকে বুঝিয়ে বললেন, না না, ইপিকাক সম্ভবত একজন চৈনিক পরিব্রাজক, যিনি ফা হিয়েনের সঙ্গে ভারতে এসেছিলেন।
ডাকুকাকু মুখে বিরক্তি ফুটিয়ে বললেন, আপনার মুন্ডু। ইপিকাক এক রকমের ভেষজ উদ্ভিদ। অনেক রোগের অব্যর্থ ওষধি।
সনাতনকাকু খালি গায়ে ডনবৈঠক দিচ্ছিলেন। রোদ পড়ে চকচক করছিল তাঁর খাজা কাঁঠালের মতো মাসলগুলো। সনাতনকাকু কুস্তির একটা ভঙ্গি দেখিয়ে বললেন, কাল পটনা পটাকাকে এরকম ধোবিপাট দিয়ে পটকে দিতে হবে আমাদের ছেলেদের। সেজন্য যদি বাঘের দুধ এনে দিতে বলেন তো তাইই এনে দেব। আপনি চিন্তা করবেন না।
ডাকুকাকু বললেন, বাঘের দুধ চাই না। আমার চাই ইপিকাক, পাতিলেবু আর দু’ফোঁটা তাড়ি।
সনাতনকাকু বললেন, লেবুর অভাব নেই। বাজার থেকে আনিয়ে নিচ্ছি যত খুশি। এদিকে তো ইপিকাকের চাষ হয়। কেয়ারটেকার সিরিংজিকে বললে সেটার ব্যবস্থাও হয়ে যাবে। কিন্তু তাড়ি কোথায় পাব ? খেজুর গাছের রস পচিয়ে তাড়ি তৈরি হয় বলে জানি। সে তো হল গিয়ে নেশার জিনিস। সনাতনকাকু বিস্মিত হয়ে বললেন, কিন্তু এই বাচ্চা ছেলেগুলোকে আপনি তাড়ি খাওয়াবেন কোন আক্কেলে ?
ডাকুকাকু আশ্বাস দিলেন, ভয়ের কিছু নেই। দু’ফোঁটা তাড়ি এতগুলো প্লেয়ারের পেটে গেলে প্রত্যেকের ভাগে কতটুকু আর পড়বে ? তাছাড়া ইপিকাক আর লেবুর সঙ্গে দু’ফোঁটা তাড়ি মিশে যাবার পর তো তার চরিত্রই তো পালটে যাবে। সেই ম্যাজিক পাঁচন একচামচ খেলে প্লেয়াররা কাল মাঠে একেবারে পাট পাট করে দেবে পটনা পটাকাকে।
হিগিনজেঠু বললেন, রংঝুরিতে খেজুর গাছ নেই, এখানে তাড়ি পাওয়া যাবে না। এখানে পাবেন ছাং। কিন্তু সে তো আর হাটে পাওয়া যাবে না। স্থানীয় লোকজনকে জিঞ্চেস করে মদের দোকান খুঁজে বের করতে হবে। তারপর সেখান থেকে সেই জিনিস আনতে হবে।
ডাকুকাকু একটু ইতস্তত করে বললেন, কেউ আমার সঙ্গে গেলে ভাল হয়। মানে মদের দোকানে একা একা যাওয়া .. ইয়ে মানে একটু ভয় ভয় করছে আর কী।
হিগিনজেঠু বললেন, ঠিক আছে। চলুন, আমি যাচ্ছি আপনার সঙ্গে।
ডাকুকাকু কবজি উল্টে ঘড়ি দেখলেন। ব্যস্ত হয়ে বললেন, চলুন চলুন। হাতে সময় খুব কম।
হিগিনজেঠু আর ডাকুকাকু যেভাবে ছিলেন সেভাবেই হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে গেলেন।
গবাদাদু একটিপ নস্যি নিয়ে বললেন, কাল ফাইনাল ম্যাচের আগে আমাদের ছেলেদের আংটিগুলো আর একবার শোধন করে নিতে হবে। যঞ্চের যা যা লাগবে সেসব আমি নিয়ে আসছি রংঝুরি বাজার থেকে। আর হ্যাঁ, গঙ্গাজল তো পাওয়া যাবে না এখানে। আপনি এক কাজ করুন। ওই দোলং নদীর জলই না হয় আনাবার ব্যবস্থা করুন একটু।
সনাতনকাকু বললেন, বেশ। আমি এক চক্কর হেঁটেও আসি, ফেরার সময় আপনার জন্য দোলং নদীর জল নিয়ে আসি। আপনি যঞ্চের বাকি জিনিসগুলো কিনে নিয়ে আসুন গিয়ে। আমি জল নিয়ে একটু বাদেই ফিরে আসছি। সনাতনকাকু গুনগুন করে গানের কলি ভাঁজতে ভাঁজতে বেরিয়ে পড়লেন।
মাংকি টুপি আর আলোয়ান চাপিয়ে গবাদাদুও বাজারে রওনা দিয়ে দিলেন। ঘন্টাখানেক বাদে এক ব্যাগ ভর্তি যঞ্চের জিনিসপত্র নিয়ে ফিরে এলেন গবাদাদু। কিছুক্ষণ বাদে সনাতনকাকুও ফিরলেন একটা ছোট শিশির মধ্যে নদীর জল নিয়ে।
ইট বালি কাঁচা কাঠ দিয়ে হোমযজ্ঞ বানিয়ে জামবাটিতে মধুপর্ক, প’গব্য, আম্রপল্লব, গাঁদার মালা, কুচো ফুলের স্তুপ সাজিয়ে যঞ্চে বসলেন গবাদাদু। একটা ব্যাট আর একটা বলও সাজিয়ে রেখেছেন সামনে। ধুপধুনো দিয়ে পুজো শুরু হল। শিশি থেকে জল হাতে নিয়ে দু’এক ফোঁটা ছিটিয়ে দিলেন এদিকে ওদিকে। সনাতনকাকুর দিকে মুখ ঘুরিয়ে গবাদাদু বললেন, এত বিচ্ছিরি রকম দুর্গন্ধ কেন এই জলে ? বলি, এটা কি নদীর জল নাকি নর্দমার জল ?
সনাতনকাকু বললেন, নর্দমার জল কেন হবে, এ তো দোলংয়ের জল ! আসলে হয়েছে কী, দোলংয়ের তীর দিয়ে হাঁটতে বড় ভাল লাগছিল। অপরূপ প্রকৃতি দেখতে দেখতে মনের মধ্যে একটা কবিতার পঙতি আসি আসি করে এসেই পড়েছিল যেন। তাই কতটা পথ এসেছি খেয়াল ছিল না। বেশ খানিকটা চলে আসার পর আপনার যঞ্চের কথা মনে পড়ে গেল। তখন তাকিয়ে দেখি দোলং এখানে এসে একেবারে ঘোড়ার খুরের মতো বেঁকে গিয়েছে। একটা বড় বাঁশঝোপ আড়াল করে দিয়েছে নদীটাকে। সেখান থেকেই জল নিয়ে এলাম এই শিশিতে করে।
গবাদাদু আর কিছু বললেন না। ব্যস্ত হয়ে পড়লেন পুজোতে। যজ্ঞ শেষ হতে হতে দুপুর গড়াল। আংটি শোধন করিয়ে নিয়ে আমার আঙুলে পরিয়ে দিলেন গবাদাদু। হেসে বললেন, ব্যস, আর চিন্তা নেই। পটনা পটাকার বাপের সাধ্য নেই কাল তোমাদের হারায় !
ডাকুকাকু আর হিগিনজেঠু এখনও ফেরেননি। সনাতনকাকু একটু ভেবে বললেন, তোমরা প্লেয়াররা লা’ সেরে প্র্যাকটিসে বেরিয়ে যাও। আমরা অপেক্ষা করি ওঁদের দুজনের জন্য। ওঁরা ফিরলে একসঙ্গে খাওয়া দাওয়া করব।
ডাল, আলুবাজা আর মুরগির ঝোল দিয়ে ভাত খেয়ে নিলাম আমরা। পোশাক পাল্টে ট্র্যাকশুট পরে আমরা যখন নেটপ্র্যাকটিসের জন্য বেরোব তখন হিগিনজেঠু আর ডাকুকাকু ফিরলেন মুখে যুদ্ধ জয়ের হাসি ঝুলিয়ে।
সনাতনকাকু জানতে চাইলেন, অভিযান সফল হল ? পেয়েছেন ছাং ?
হিগিনজেঠু ধীরে সুস্থে এসে একটা চেয়ারে গ্য্যঁট হয়ে বসলেন। হাতের শিশিটা দেখিয়ে কায়দার একটা হাসি হেসে বললেন, এই যে, নিয়ে এসেছি সেই জিনিস। কিন্তু যা হ্যাঙ্গাম হল তা আর বলার নয়।
গবাদাদু একটিপ নস্যি নিয়ে বললেন, উফ্, আপনাকে নিয়ে হয়েছে মুশকিল। যেখানে যান সেখানেই কিছু না কিছু বাধিয়েই আসেন। আবার কী হল নতুন করে ?
ডাকুকাকু বললেন, আর বলবেন না। ওখানে গিয়ে দেখি দুটো লেবার প্রচুর ছাং খেয়ে বমি টমি করে শুয়ে পড়েছে উঠোনে। এদিকের লোক নয়, চেহারা দেখে মনে হল দেহাতি শ্রমিক শ্রেণির লোক। দুটো লোকই দেখলাম নেশার ঘোরে আবোলতাবোল কথা বলছিল।
সনাতনকাকু বললেন, নেশার জিনিস খেয়ে বেহেড হয়ে যাবে, আবোলতাবোল কথা বলবে, বমি-টমি করে পড়ে থাকবে রাস্তার ধারে – সেটাই তো স্বাভাবিক। এর মধ্যে অস্বাভাবিক কিছু তো নেই।
হিগিনজেঠু বললেন, হ্যাঁ, সে তো ঠিক কথা। এই লোকগুলোর বাড়ি বিহারে। এখানে কাজ করে কোন একটা কারখানায়। এমন বকর বকর করছিল যে ওখানে আরও যারা নেশাখোর ছিল সকলে দুলে দুলে হাসছিল ওদের গাঁজাখুরি গল্প শুনে। ছাংয়ের নেশা যে এত সাংঘাতিক সেটা আজ জানলাম !
ডাকুকাকু বললেন, আমার কাঁধের ঝোলায় একটু পুনর্নবা আর বুনোআকন্দের শিকড় ছিল। এই দুটো জিনিসের সঙ্গে একটু পাতিলেবুর রস মিশিয়ে খাইয়ে দিয়েছিলাম লোকদুটোকে। ভেবেছিলাম লোকদুটোর নেশা বুঝি ছুটে যাবে। হল কিন্তু উল্টো। আমার পাঁচন খেয়ে কয়েকবার হিক্কা তুলে পুরো ফ্ল্যাট হয়ে গেল দুজন।
সনাতনকাকু উদ্বিগ্ন হয়ে বললেন, ফ্ল্যাট মানে ? মরে গেল নাকি ?
হিগিনজেঠু বললেন, ফ্ল্যাট মানে ফ্ল্যাট। তাদের এখন নট নড়ন চড়ন। তবে মরেনি। এখন তারা ওই ছাংয়ের আখরাতেই লম্বা হয়ে শুয়ে রয়েছে। যা হালচাল দেখে এলাম তাতে মনে হয় কয়েক ঘন্টা ঘুমিয়েই থাকবে।
নেটে একটু গা ঘামিয়ে নিলাম সকলে। মাথায় অনেক এলোমেলো চিন্তা ঘুরছিল। মনের মধ্যে অনেকগুলো জট পাকানো সুতো যেন আরও জট পাকিয়ে যাচ্ছিল। অনেকগুলো প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছিল মাথায়। কিন্তু কিছুতেই কোনও উত্তর খুঁজে পাচ্ছিলাম না।
নেটে ব্যাটিং করার সময় কিছুতেই মন বসাতে পারছিলাম না। কতবার যে আউট হলাম কোনও ঠিক নেই। তারপর ফিল্ডিং প্র্যাকটিসের সময় স্লিপ ক্যাচিং প্র্যাকটিস করাচ্ছিল বাবু। অন্যদিন কঠিন ক্যাচ সহজে ধরি, আজ একটা ক্যাচও তালুবন্দি করতে পারছিলাম না।
আমাদের নেট প্র্যাকটিস সবে শেষ হল। আমরা এক এক করে গেস্ট হাউজে ঢুকছি। এমন সময় জিপ নিয়ে অনিকেতকাকু এলেন। আমার পিঠে একটা মৃদু চাপড় মেরে বললেন, চপল, তোমাদের শুভেচ্ছা জানাতে এলাম। কাল ফাইনালে জমিয়ে খেলা চাই।
আমি একটু নীচু স্বরে বললাম, আপনার সঙ্গে একটু কথা আছে অনিকেতকাকু।
অনিকেতকাকু ঢুকতে যাচ্ছিলেন গেস্ট হাউজের দিকে। দাঁড়িয়ে পড়ে বললেন, কী কথা ?
লামার গুম্ফায় যাকে সেদিন দেখেছি সেই একচোখ কানা ভিক্ষুর কথাটা অনিকেতকাকুকে জানালাম।
অনিকেতকাকু হাসলেন, শুধু তোমাকে বলছি, ওর নাম নিমা ওয়াংদি। পাহাড়ে ভুট্টা, আদা, অড়হরের চাষ করে আর গরু-ছাগল চরায়। গরিব লোক, টাকা নিয়ে মাঝেমধ্যে পুলিশের কাজ করে দেয়। ওকে ওই গুম্ফায় লাগিয়ে রেখেছি যদি কিছু খোঁজখবর পাওয়া যায়। ও আমাদের ইনফরমার।
আমি অবাক হয়ে বললাম, ওর থেকে কিছু খবর পেয়েছেন ?
অনিকেতকাকু বললেন, গ্যালসিন লামা যে হাড়বাজার থেকে মাথার খুলি আর পায়ের হাড় কিনেছে সেটা নিয়ে সন্দেহ নেই। রংঝুরিতেই কোথাও শবদেহ থেকে হাড় আলাদা করার একটা গোপন কারখানা আছে। কিন্তু সেটা যে কোথায় সেটা ধরতে পারছি না।
আমি বললাম, গ্যালসিন লামাকে থানায় এনে জিঞ্চাসাবাদ করলে ব্যপারটা জানা যাবে না ?
অনিকেতকাকু ঘাড় নেড়ে বললেন, লামারা হল পুরোহিত শ্রেণির মানুষ। এদের প্রচুর ভক্ত আছে। একজন লামাকে থানায় নিয়ে এলে ভক্তের দল হৈ-হল্লা করবে বেশি, লাভ কিছু হবে না। ওটা হল আলটিমেট স্টেপ। আপাতত সেসব চাইছি না।
আমি একটু ভেবে বললাম, কাল বিকেলে গুম্ফায় গিয়েছিলাম আমরা। ওখানে কিন্তু অজয় তামাংকে দেখতে পেয়েছি। পেমা তামলং নামে একজন আছেন ওখানে। তাঁর সঙ্গে কী যেন গুজুর গুজুর করছিলেন। আমাদের দেখে একটু চমকে গেলেন মনে হল।
অনিকেতকাকু বললেন, তাই নাকি ?
একটু ইতস্তত করে বললাম, সেদিন গগন সিংহানিয়ার বাড়িতে চায়ের নেমন্তন্ন ছিল আমাদের। দোতলায় কেমন যেন নাক জ্বালা করা ঝাঁঝালো গন্ধ পাচ্ছিলাম। অজয় তামাং বলে দিলেন ওটা মেথিলেটেড স্পিরিটের গন্ধ। কিন্তু আমাদের ক্লাবের পাশেই তো পল্টনদার ফার্নিচারের দোকান। আমরা সকলেই মেথিলেটেড স্পিরিটের গন্ধ চিনি। সে গন্ধে নাক জ্বালা করেনা। তাহলে অজয় তামাং সেদিন অকারণে মিথ্যে বললেন কেন ?
অনিকেতকাকুর ভুরু দুটো জড়ো হল। বললেন, সেটাই তো ভাবছি।
আমি বললাম, এদিকে আজ কী হয়েছে শুনুন। ডাকুকাকু ভোররাতের স্বপ্নে কী একটা পাঁচনের ফরমুলা পেয়েছেন। সেই জিনিস বানাতে নাকি সামান্য ছাং প্রয়োজন। সেই ছাং আনতে ডাকুকাকু আর হিগিনজেঠু একসঙ্গে বেরিয়েছিলেন। রংঝুরি ছাংয়ের ডেরায় খুঁজে ঁখুঁজে গিয়ে দেখেন দুজন দেহাতি লেবার ছাং খেয়ে একেবারে আউট। তারা এত মাতাল হয়ে গিয়েছিল যে পুরো ভুলভাল বকতে শুরু করেছিল।
অনিকেতকাকু হো হো করে হেসে ফেলেছিলেন। তারপর হঠাৎ থমকে গিয়ে বললেন, কী বললে তুমি .? দেহাতি লেবার ?
আমি ঘাড় হেলিয়ে দিলাম। অনিকেতকাকু ভুরুতে ভাঁজ ফেলে বললেন, রংঝুরিতে তো সব স্থানীয় মানুষ। কোনও দেহাতি লেবার তো এখানে নেই ! এরা তাহলে কারা ?
আমি বললাম, সেটা জানতে হলে আপনাকে ওই ছাংয়ের আখরাতে যেতে হবে। তারা ডাকুকাকুর পাঁচন খেয়ে এখনও পুরো ফ্ল্যাট হয়ে পড়ে আছে সেখানে।
আমি বললাম, আজ আরও একটা কান্ড হয়েছে। গবাদাদুর যঞ্চের জন্য দোলং নদীর জল নিয়ে এসেছিলেন। কিন্তু সেই জল থেকে কেমন একটা পচা গন্ধ বেরোচ্ছিল।
অনিকেতকাকু দাঁড়িয়ে পড়লেন জিপের সামনে গিয়ে। বললেন, দোলং তো আর মজে যাওয়া নদী নয়। বেশ ভাল স্রোত দোলংয়ের জলে। কাজেই সেই নদীর জল থেকে পচা গন্ধ তো আসার কথা নয়। জলটা দোলংয়ের ঠিক কোন জায়গা থেকে এনেছেন জানো ?
আমি বললাম, নদীটা যেখানে ঘোড়ার খুরের মতো বাঁক নিয়েছে সেখান থেকেই তো গবাদাদু জল এনেছেন বললেন।
আর একটাও কথা না বলে অনিকেতকাকু তড়াক করে লাফ দিয়ে উঠে পড়লেন জিপে। একরাশ ধোঁয়া ছেড়ে জিপটা বেরিয়ে গেল দৃষ্টিসীমার বাইরে।
১৬
সকালে স্নান সারার পর সকলের হাতে আংটি পরিয়ে দিলেন গবাদাদু। আংটি পর্ব মিটতেই এল পাঁচন পর্ব। আমাদের মুখ শুকিয়ে আমসি হয়ে গেল দেখে ডাকুকাকু আশ্বাস দিয়ে বললেন, ইপিকাক, লেবুর রস আর ছাং মিশিয়ে বানিয়েছি এই পাঁচন। এটা খেলে শরীরে হাতির শক্তি আসবে। ব্যাটসম্যান যা বল মারবে সব বাউন্ডারির ওপারে চলে যাবে। বোলারদের বলের গতিও বেড়ে যাবে দু’গুণ।
রাসেল এক চামচ পাঁচন খেয়েই যাকে বলে স্তম্ভিত হয়ে গেল। চোখগুলো বড় বড় করে বসে থাকল কিছুক্ষণ। রাসেলের পর আমি। আমার মুখেও পাঁচন ঢেলে দিলেন ডাকুকাকু। সেই বিচিত্র জিনিস গলা দিয়ে নীচের দিকে নামতেই সারা গায়ে কাঁপুনি দিতে শুরু করল আমার। ম্যালেরিয়া রুগির জ্বর এলে যেমন হয়। মিনিট খানেক কেঁপে অবশেষে একটু ধাতস্থ হলাম। আমার পর এক এক করে প্রত্যেককে খেতে হল সেই বিচিত্র ঘন থকথকে তরল বস্তুটি।
অন্যদিন ভুলুর সঙ্গে আমার খটাখটি লাগে কথায় কথায়। আজ আমরা সকলেই চুপচাপ। প্রত্যেকেরই ভেতরে ভেতরে একটা চাপা টেনশান হচ্ছে বুঝতে পারছি। অনেক আশা নিয়ে, অনেক কষ্ট করে আমরা রংঝুরি টি-টোয়েন্টির ফাইনালে এসে পৌঁছেছি। রংঝুরি থেকে কাপ জিতে ফিরতে পারলে সেটা একটা দারুণ ব্যাপার হবে।
মাঠে এসে দেখি গ্যালারি একেবারে কানায় কানায় ভরা। আমরা মাঠে নামতেই উচ্ছ্বাস উঠল দর্শকদের মধ্যে। আমাদের সঙ্গে সঙ্গেই মাঠে ঢুকল হলদে জার্সির পটনা পটাকা। ওদের জন্যও চিৎকার ভেসে এল স্টেডিয়ামের একটা দিক থেকে। প্রেস থেকেও লোক এসেছে অনেক। খেলা শুরুর আগে আমাদের দুটো টিমের ফোটো তুলল কয়েকজন। এর আগে প্রতিদিন মাঠে থাকেন, আজ রংঝুরি ক্লাবের প্রেসিডেন্ট গগন সিংহানিয়া মাঠে নেই। তবে ভুটানের রাজপরিবারের একজন সভ্য মাঠে এসেছেন। তিনিই ম্যাচের বিশেষ অতিথি। তাঁর সঙ্গে পরিচয়পর্ব শেষে শুরু হল খেলা।
ভাগ্য সঙ্গ দিল না, হেরে গেলাম টসে। ওদের ক্যাপ্টেন আগে ব্যাট করবে বলে জানাল। আমরা সকলে মাঠের ধারে চলে এসে হাডল করলাম একবার। পকেট থেকে লামার দেওয়া ফুল বার করে প্রত্যেকের কপালে ছুঁইয়ে নিলাম প্রথমে। বললাম, কাল এক লামার গুম্ফায় গিয়ে পুজো দিয়ে এসেছি। এটা সেই আশীর্বাদী ফুল। এতদূরে এসে আর ফিরে যাওয়ার কোনও মানে হয় না। এই ম্যাচ জিততেই হবে আমাদের।
হিগিনজেঠু, সনাতনকাকু, ডাকুকাকু, গবাদাদু সকলে টেনশানে পায়চারি করছেন মাঠের বাইরে। আমাদের উৎসাহ যোগাচ্ছেন মাঠের বাইরে থেকে। ভুলু আঙুলের নখ কামড়াতে কামড়াতে ফ্যাসফ্যাসে গলায় বলল, ভয়ংকর টেনশান হচ্ছে রে চপ্পল। ফাইনাল বলে কথা। অনিকেতকাকুকেও তো মাঠের বাইরে দেখতে পাচ্ছি না।
আমি ভুলুকে ধমক দিয়ে বললাম, পুলিশের চাকরি বলে কথা, হয়তো জরুরি কোনও কাজে ব্যস্ত আছেন উনি। মাঠের বাইরে কে আছে না আছে সেসব নিয়ে অযথা চিন্তা করিস না। তুই খেলার মধ্যে থাক।
পটনা পটাকা শুরু করল ভাল। প্রথম দশ ওভারে এক উইকেটে একশো আট তুলে ফেলল ওরা। ন্যাশনাল প্রিমিয়ার লিগ খেলা ওদের অজয় কামাথ নামে ছেলেটা ওপেন করতে নেমে আটষট্টি করে ফেলল একাই। ড্রিংকসের সময় লামার দেওয়া ফুল আবার প্রত্যেক প্লেয়ারের কপালে ছোঁয়াল ভুলু। সেই মন্ত্রপূত ফুলের জন্যই কিনা কে জানে, খেলা শুরু হতে না হতেই রান আউট হয়ে গেল অজয়। মিড উইকেট থেকে রাজা সরাসরি বল ছুঁড়ে লাগাল স্টাম্পে।
অজয় আউট হবার পর রানও যেমন উঠতে লাগল, উইকেটও পড়তে লাগল সেই সঙ্গে। প্রদীপ মাহাতো নামে একজন বিহারের হয়ে রঞ্জি খেলে। সে ঝড়ের মতো একটা হাফ সেঞ্চুরি করে গেল আমরা কিছু বোঝার আগেই। কুড়ি ওভারে আট উইকেটে একশো ছিয়ানব্বই রান তুলল পটনা পটাকা। দর্শকরা তুমুল করতালিতে স্বাগত জানালেন ওদের। মাঠের বাইরে আসার সঙ্গে সঙ্গে জানতে পারলাম এই মাঠে এটাই সবচাইতে বেশি রান। কিন্তু ওদের যেমন দুর্ধর্ষ বোলিং লাইন আপ তাতে কুড়ি ওভারে দুশোর মতো রান তোলা এককথায় অসম্ভব।
কালো কোটপ্যান্ট পরা হিগিনজেঠু ঘুরে এলেন পটনা পটাকার ক্যাম্প থেকে। গম্ভীর মুখ করে বললেন, কী অপমান কী অপমান ! পটনা পটাকার বাচ্চা বাচ্চা ছেলেগুলো রীতিমত উপহাস করছে আমাদের নিয়ে। বলছে আমাদের নাকি একশো রানও তুলতে দেবে না ওরা।
সনাতনকাকু সাহস যুগিয়ে বললেন, তোমরা ম্যাচ জেতা হারা নিয়ে ভেবো না। মাঠে গিয়ে নিজের একশো ভাগ দাও। তারপর যা আছে কপালে।
সিন্টু আর বাবু ভালই শুরু করেছিল। বাবু আউট হল পাঁচ ওভারে। তখন আমাদের রান ত্রিশ। এই টুর্নামেন্টে আগের দুদিনই রান পেয়েছি। একজন ব্যাটসম্যানের যখন ব্যাডপ্যাচ চলতে থাকে তখন সব খারাপ খারাপ জিনিসগুলো ঘটতে থাকে। সবচাইতে ভাল বলটা তার বেলাতেই হয়। ওদিকে যখন একজন ব্যাটসম্যানের ভাল সময় চলতে থাকে তখন তার ভাগ্যও সঙ্গে থাকে। আমারও হল তাই।
প্রথমদিকে ওদের আউটসুইং বোলারটার বলে ড্রাইভ করতে গিয়ে ব্যাটের কোনায় লাগিয়ে সহজ ক্যাচ দিয়েছিলাম গালিতে। গালি ফিল্ডার সেটা হাতে জমাতে পারল না। ক্যাচটা পড়ে যাওয়ার পরও বিশ্বাস করতে পারছিলাম না যে একটা দ্বিতীয় সুযোগ পেয়ে গিয়েছি।
ওই একটাই সুযোগ, ব্যাস। তারপর থেকে যা করতে চাইলাম তাইই যেন হতে শুরু করল। ইনসাইড আউট করে বেরিয়ে এসে দুটো ওভার বাউন্ডারি মারলাম এক্সট্রা কভারের ওপর দিয়ে। আত্মবিশ্বাস যেন একধাপে অনেকটা বেড়ে গেল। খুব তাড়াতাড়ি মাত্র ত্রিশ বলে পঞ্চাশ করে ফেললাম আমি।
উল্টোদিকে সিন্টু আউট হয়ে গিয়েছিল। ভুলু এসে কিছুক্ষণ থেকে ত্রিশের মতো রান করে ফিরে গেল। রাসেল নিজের উইকেট ছুঁড়ে এল বিচ্ছিরি ভাবে। খেয়ে খেয়ে এমন মোটকু হয়েছে যে একটা সহজ দু’রান নিতে গিয়ে পিচের মধ্যে হুমড়ি খেয়ে পড়ে গিয়ে রান আউট হয়ে গেল রাসেল। টিংকুও বেশিক্ষণ ক্রিজে টিঁকল না। তবে ওই কঠিন সময়ে মিঠু কিছুক্ষণ সঙ্গ দিল আমাকে। পনের ওভারের সময় মিঠু যখন আউট হল তখন আমাদের রান ছ’উইকেটে একশো চল্লিশ। তার মধ্যে আমার নিজের রানই একাশি। এদিকে বাকি পাঁচ ওভারে ষাট রান চাই আমাদের। হাতে চার উইকেট। বাপ্পা এল পিচে।
আউটসুইং বোলারটা এসেছে আবার। একটা বল গুডলেংথ থেকে লাফিয়ে উঠল। ক্রসব্যাট চালিয়ে মিস করেছিল বাপ্পা। বলটা সরাসরি লাগল ওর হেলমেটে। ব্যাট ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে বসে পড়ল বাপ্পা।
আমি নন স্ট্রাইকিং এন্ড থেকে ছুটে গেলাম বাপ্পার দিকে। উদ্বিগ্ন স্বরে বললাম, ঠিক আছিস তো রে ? খুব লেগেছে?
একহাতে জলের বোতল অন্যহাতে ব্যথা কমাবার স্প্রে নিয়ে ভুলু দৌড়ে দৌড়ে ঢুকল মাঠে। বাপা ঢকঢক করে পুরো বোতলের জল একাই খেয়ে নিয়ে চোখদুটো পিটপিট করে বলল, ওরেব্বাস, চারদিকে কেমন টলমল করছে সব। যা দেখছি দুটো করে দেখছি।
ভুলু ঘাবড়ে গিয়ে বলল, তাহলে তো ব্যাট করতে গিয়ে দুটো করে বল দেখবি তুই। এক কাজ করিস। বাইরের বলটা খেলিস না। যে বলটা উইকেটে থাকবে সেটাই খেলিস। তাহলে আউট হবার চান্স কম থাকবে।
ভুলুর পরামর্শ শুনে বাপ্পা আরও নার্ভাস হয়ে গেল। আমি ওর ভয় কাটাবার জন্য বললাম, তুই অতকিছু ভাবিস না। কোনওরকমে ব্যাট ছুঁইয়ে আমাকে স্ট্রাইক দে। তারপর আমি দেখছি।
ভুলু আমাকে বলল, অ্যাই চপ্পল, তুই তো সেট হয়ে গিয়েছিস, এখন একটু দেখে দেখে চালিয়ে খেল।
আমি বিরক্ত হয়ে বললাম, দেখবই যদি তবে চালাব কেমন করে ?
ভুলু জিভ কেটে বলল, হ্যাঁ, তাও তো ঠিক। তারপর পকেট থেকে লামার দেওয়া সেই গাঁদাফুল বার করে আমার ব্যাটে ছোঁয়াল একবার। এসব দেখে পটনা পটাকার ক্যাপ্টেন কিছু বলল আম্পায়ারকে। মুখে একরাশ বিরক্তি নিয়ে আম্পায়ার ভুলুকে বাইরে যেতে বললেন। ভুলু দৌড়তে শুরু করল প্যাভিলিয়নের দিকে।
বোলারের পরের বলটা আবার শর্টপিচ বাউন্সার। আবার বল গিয়ে লেগেছে বাপ্পার হেলমেটে। হেলমেট খুলে শুয়ে পড়েছে বাপ্পা। ওর দিকে ছুটে গেলাম আমি। আমি ওদিকে যেতেই বাপ্পা বলল, শাপে বর হয়েছে। মাথাটা লখ্নউয়ের ভুলভুলাইয়া হয়ে ছিল। সেই ধাঁধাটা কেটে গেছে পুরোপুরি। এখন আবার একটা করে দেখছি সবকিছু। আর কোনও চিন্তা নেই।
আমরা যে যার জায়গায় ফিরে গেলাম। নন স্ট্রাইকিং এন্ড থেকে দেখি পেস বোলারটার ভাল জায়গায় পিচ আপ হওয়া পরের তিনটে বল এলোপাথারি ব্যাট চালিয়ে পরপর তিনটে বিরাট বিরাট ছয় মেরে দিল বাপ্পা। আমি গিয়ে উৎসাহ দিয়ে ওর পিঠ চাপড়ে এলাম। কিন্তু পরের ওভারে আবার ক্রসব্যাট চালিয়ে আউট হয়ে ফিরে গেল বাপ্পা।
শেষ তিন ওভারে দরকার বাইশ। পরের দু’ওভারে এগারো রান উঠল। এদিকে আরও দুটো উইকেট পড়ে গেল আমাদের। পিন্টু আউট হয়ে গেল খাতা খোলার আগেই। আমাদের শেষ ব্যাটসম্যান তমাল এল পিচে। এসেই নার্ভাস গলায় আমাকে বলল, চপল, আমার হাত পা কাঁপছে টেনশানে। ওদের সবচাইতে জোরে বোলারটা এবার আসবে বল করতে। আমাকে স্ট্রাইক দিস না প্লিজ। যা করার তুইই কর।
শেষ ওভারে এগারো রান চাই। প্রথম বলে দু’রান নিলাম পয়েন্ট বাউন্ডারিতে খেলে। তমাল এত টেনশানে ছিল যে হোঁচট খেয়ে কোনওমতে পৌঁছল ওদিকের ক্রিজে। আমার ব্যক্তিগত স্কোর দাঁড়াল তিরানব্বই। ওদিকে জিততে চাই নয় রান। সমস্ত স্টেডিয়ামের দর্শক দাঁড়িয়ে উঠেছে রুদ্ধশ্বাস উত্তেজনায়। দ্বিতীয় বলটা জায়গায় দাঁড়িয়ে তুলে দিলাম লং অনের ওপর দিয়ে। বিশাল ছক্কা। আমার রান গিয়ে দাঁড়াল নিরানব্বইতে। সমস্ত দর্শক উঠে দাঁড়িয়েছে এবার। আমার সেঞ্চুরির জন্য তালে তালে হাততালি দিচ্ছে সকলে।
রাসেল এল গ্লুকোজ মেশানো জলের বোতল নিয়ে। আমাদের জল না দিয়ে নিজেই পুরো বোতল জল খেয়ে ফেলল ঢকঢক করে। তারপর একহাত জিভ কেটে বলল, যাহ্, কী যে বলতে পাঠিয়েছিল আমাকে সেটা তো পুরো ভুলে গেলাম রে চপল !
ভ্যাবাচ্যাকা খাওয়া মুখ করে রাসেল ফিরে গেল প্যাভিলিয়নের দিকে।
এদিকে আমি যাতে সিঙ্গলস নিই সেজন্য বাউন্ডারির দিকে সব প্লেয়ার পাঠিয়ে দিয়েছে ওদের ক্যাপ্টেন। একটা সিঙ্গলস নিলেই আমার নিজের একশো রান পূর্ণ হয়ে যায়। কিন্তু ম্যাচ জেতার জন্য সবুজ সংঘের চাই আরও তিন রান। আমি যদি এক রান নিয়ে নন স্ট্রাইকিং এন্ডে চলে যাই তবে তমালের স্ট্রাইক হয়। কিন্তু টেলএন্ডার তমাল ভয়ে বলির পাঁঠার মতো কাঁপছে। বেচারি যেমন অবস্থায় রয়েছে তাতে ও স্ট্রাইক পেলে একটা রানও করতে পারবে কিনা বলা মুশকিল। সেক্ষেত্রে এত কাছে এসেও ম্যাচটা হেরে যাব আমরা। এখন কি তবে নিজের সেঞ্চুরির কথা ভাবব ? নাকি টিমের কথা ভাবব ? এমন কঠিন পরিস্থিতিতে কখনও পড়িনি আমি।
পরের তিনটে বল সজোরে ব্যাট চালালাম। বল গেল ব্যাকওয়ার্ড পয়েন্ট, লংঅফ আর ডিপ ফাইন লেগে। বল ধরে ফিল্ডার সঙ্গে সঙ্গে ফেরত পাঠাল বোলারের কাছে। বাউন্ডারিও হল না, সিঙ্গলসও নিলাম না। মাঝখান থেকে শেষ বলে এসে দাঁড়াল খেলা।
শেষ বলে এখন জিততে আমাদের চাই তিনরান। ওদের বোলারটা দেখলাম বল বল ঘসছে প্যান্টে। দাঁতে দাঁত চেপে স্টান্স নিয়ে দাঁড়ালাম আবার। সবকিছু ভুলে গিয়ে তাকিয়ে থাকলাম বোলারের হাতের বলটার দিকে।
ইনিংসের শুরুতে একবার ভাগ্য আমার সঙ্গ দিয়েছিল। ইনিংসের শেষে আর একবার ভাগ্যের আশীর্বাদ পেয়ে গেলাম। পেস বোলারটার গুড লেংথ থেকে উঠে আসা বলে হুক করেছিলাম। বল ব্যাটের ওপরের কানায় লেগে উইকেটকিপারের মাথার ওপর দিয়ে উড়ে গেল। আমি কিছু বুঝতে পারিনি। চোখ বুঁজে দৌড় শুরু করেছিলাম রান নেবার জন্য। উল্টোদিক থেকে তমাল আমার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে মাটিতে পেড়ে ফেলল। খুশিতে বুঁজে যাওয়া গলায় বলল, ওভার বাউন্ডারি হয়ে গেছে চপল। বল সোজা গিয়ে লেগেছে পিছনের সাইটস্ক্রিনে। ম্যাচ জিতে গেছি আমরা। রংঝুরি টি-টোয়েন্টি কাপ এখন আমাদের !
ভুলু, রাসেল, বাপ্পারা ছুটে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরেছে। আমার তখন একটা ঘোরের মতো অবস্থা। কে যে কী বলছে কিচ্ছু শুনতে পাচ্ছি না। ওদের কোলে চড়ে মাঠের বাইরে এলাম সেই ঘোরের মধ্যেই। সনাতনকাকু, ডাকুকাকু, গবাদাদুরা উন্মাদের মতো নাচতে শুরু করেছেন আমাদের প্যাভিলিয়নের সামনে। মাটিতে বসে পড়ে আনন্দে হাউমাউ করে কীসব বলছেন আর কাঁদছেন হিগিনজেঠু। পটকা ফাটাচ্ছে ভুলু আর সিন্টু। তুবড়ি জ্বালাতে শুরু করেছে বাবু, পিন্টু আর রানা।
প্রাইজ দেওয়া শুরু হল মঞ্চে। ফাইনালের ম্যান অফ দ্য ম্যাচ আমি। ম্যান অফ দ্য টুর্নামেন্টও আমি। মনটা খুশিতে ভরে যাচ্ছিল। ক্যাপ্টেন হয়ে টিমকে চ্যাম্পিয়ন করতে পারার মধ্যে যে আনন্দ আছে তার কোনও তুলনাই হয় না। ভিড়ের মধ্যে আমি শুধু অনিকেতকাকুকে খুঁজছিলাম।
ট্রোফি হাতে মাঠ প্রদক্ষিণ করলাম আমরা সকলে। মাঠ চক্কর মেরে আমাদের টেন্টে ফিরে এসে দেখি অনিকেতকাকু ইউনিফর্ম পরে দাঁড়িয়ে আছেন। আমাকে জড়িয়ে ধরে অভিনন্দন জানালেন প্রথমে। তারপর চওড়া হাসি হেসে বললেন, একটা জব্বর খবর আছে। চোরাই হাড়বাজার কান্ডের যবনিকা পড়েছে আজ। আজ রাতে আমার ওখানে সবুজ সংঘের সকলের ডিনারের নেমন্তন্ন রইল। সেখানেই সব খুলে বলব তোমাদের।
১৭
রাসেল বলল, মুরগির এত ভাল প্রিপারেশন জীবনে খাইনি।
সনাতনকাকু চিকেন রেজালায় একটা বড় কামড় বসিয়ে বললেন, কাকে দিয়ে এত ভাল রান্না করালি তুই ?
অনিকেতকাকু ললেন, দুর্দান্ত একজন রান্নার মাসি পেয়েছি। সেই মাসিই রেঁধেছে। ভাল হয়েছে ?
আমি বললাম, কী স্বাদ, এ তো অমৃত !
অনিকেতকাকু বললেন, তোমাদের জন্য আমিই রাঁধতাম, কিন্তু কাল এত দৌড়ঝাঁপ করতে হয়েছে যে আমার আর এনার্জি ছিল না।
সনাতনকাকু বললেন, এত ধৈর্য ধরতে পাচ্ছি না। আর দেরি না করে কাল রাতে কী কান্ড হয়েছিল সেটা বল এবার।
অনিকেতকাকু একটু হেসে বললেন, কান্ডের সূত্রপাত তোমার হাত দিয়ে। ভাগ্যিস তুমি কাল গবাবাবুর যঞ্চের জন্য দোলং নদীর জল আনতে অতদূরে চলে গিয়েছিলে !
সনাতনকাকু বললেন, গিয়েছিলামই তো। নদীর ধার দিয়ে হাঁটতে ভাল লাগছিল, বেশ একটা ফুরফুরে কবি কবি ভাবও জেগেছিল মনের মধ্যে। সেজন্যই অতটা দূরে চলে গিয়েছি বুঝতে পারিনি। কিন্তু এ কথা বলছিস কেন ?
অনিকেতকাকু বললেন, কাল চপলের মুখে তোমার আনা দোলংয়ের জলে বিটকেল গন্ধের কথাটা শোনার পর দেবরাজকে থানা থেকে তুলে নিয়ে বেরিয়ে পড়েছিলাম বিকেল থাকতে থাকতেই। আমরা দুজন খুঁজে খুঁজে পৌঁছে গিয়েছিলাম যেখানে দোলং নদী ঘোড়ার খুরের মতো বাঁক নিয়েছে। ওখানে গিয়ে একটু খোঁজাখুঁজি করতেই শাক দিয়ে ঢেকে রাখা মাছ দেখতে পেলাম বাঁশঝোপের আড়ালে।
গবাদাদু বললেন, শাক দিয়ে ঢাকা মাছ মানে ?
দেবরাজ বোস বসেছেন অনিকেতকাকুর পাশেই। তিনি একটু হেসে বললেন, ঝোপের আড়ালে একটা জালের মধ্যে দুটো লাশ কয়েকদিন ধরে চুবিয়ে রাখা হয়েছিল দোলংয়ের জলে। জলের মধ্যে নানান জীবাণু আর মাছ মৃতদেহগুলোর মাংস প্রায় পুরোটাই ক্ষয় করে ফেলেছিল। আমরা যখন জালটাকে উদ্ধার করি তখন শুধু কঙ্কালই বেরিয়ে এসেছিল জল থেকে। হাড়গুলো আলাদা হয়ে গেলেও জালের মধ্যে থাকায় হাড়গুলো আলাদা হয়ে হারিয়ে যাতে যেতে না পারে সেজন্য এই ব্যবস্থা করা হয়েছিল।
ডাকুকাকু চোখ বড় বড় করে বললেন, দুটো লাশ কয়েকদিন ধরে চুবিয়ে রাখা হয়েছিল মানে ? কার লাশ ?
অনিকেতকাকু বললেন, যে বডিদুটো সম্প্রতি রংঝুরির কবর খুঁড়ে চুরি গিয়েছিল সেগুলো।
সনাতনকাকু বললেন, লাশ চুরি করে চুবিয়ে রেখেছিল নদীর জলে ? কেন ?
অনিকেতকাকু বললেন, যাতে লাশগুলোর হাড় আর মাংস আলাদা হয়ে যায়। ফলে কঙ্কাল তৈরি করতে সুবিধে হয়, সেজন্য।
গবাদাদু বললেন, কী যে বলছেন কিছুই বুঝতে পারছি না। যাই হোক, দুস্কৃতীদের খুঁজে পাওয়া গেছে ?
অনিকেতকাকু বললেন, হ্যাঁ পেয়েছি। তবে সেই কৃতিত্বটা পুরোপুরি পুলিশের নয়। দ্য ক্রেডিট গোজ টু ডাকুবাবু অ্যান্ড হিগিনবাবু !
হিগিনজেঠু আর ডাকুকাকুর মুখ হাঁ হয়ে গেছে। হিগিনজেঠু গোলগোল চোখে অনিকেতকাকুর দিকে তাকিয়ে বললেন, দুস্কৃতীদের যে ধরতে পেরেছেন সেই কৃতিত্ব আমাদের দুজনের ?
ডাকুকাকু বললেন আপনি এই বয়স্ক লোকগুলোর সঙ্গে ঠাট্টা করছেন ?
অনিকেতকাকু বললেন, ঠাট্টা করছি না। সত্যি কথাই বলছি। ছাং আনতে গিয়ে দুটো দেহাতি লোককে মাতলামি করতে দেখেছিলেন না ? ওই দুটো লোক কিন্তু নেশার ঘোরে সত্যি কথাই বলেছিল। ওরাই কবর থেকে বডি চুরি করে দোলংয়ের জলে চুবিয়ে রাখত।
হিগিনজেঠু হাঁ হয়ে গিয়ে বললেন, বলেন কী ? আমরা তো ভেবেছিলাম নেশার ঘোরে লোকদুটো আবোল তাবোল বকছে।
অনিকেতকাকু বললেন, পুলিশ দাগী অপরাধীদের পেট থেকে গোপন কথা বার করার জন্য অনেক সময় নারকো-অ্যানালিসিস টেস্ট করে জানেন তো ? তার কারণ প্রবল নেশার ঘোরে আমাদের মস্তিস্ক ঠিক ঠিক কাজ করে না। গোপন কথা আর গোপন রাখতে পারে না। উগরে ফেলে। কাল ছাংয়ের আখরায় গিয়ে আমরা পেয়ে যাই ওই দুজনকে। ডাকুবাবুর পাঁচন খেয়ে দুটোই ফ্ল্যাট হয়ে পড়ে ছিল। আমরা যখন ওখানে গেলাম তখনও তাদের নেশার ঘোর কাটেনি। থানায় নিয়ে এসে ওদের একটু আদর করতেই সব বলে দিল আমাদের। তবে এরা নেহাতই চুনোপুটি। এই চক্রের ছোট ছোট নাটবল্টু, তার বেশি কিছু নয়। এদের পালের গোদা অন্য লোক।
ডাকুকাকু কৌতূহলী গলায় বললেন, কে সেই পালের গোদা ? তাকে কি ধরতে পেরেছেন ?
দেবরাজ বোস বললেন, ধরেছি বইকি। ওই লোকদুটোই তো নিয়ে গেল পালের গোদার কাছে।
সনাতনকাকু বললেন, আমি তো তোর কথার মাথামুন্ডু বুঝতে পারছি না। একটু বুঝিয়ে বলবি ?
অনিকেতকাকু বললেন, একটা র্যাকেট রংঝুরিতে হাড়বাজারের কাজ শুরু করে দিয়েছিল গোপনে। কবর থেকে বেওয়ারিশ লাশ উঠিয়ে আনত এই লোকগুলো। শ্মশানের যে কেয়ারটেকার, তার সঙ্গেও সাঁট ছিল এদের। সেই কেয়ারটেকার লোকটাকে আমরা গ্রেফতার করেছি কাল মাঝরাতে। থানায় এনে থার্ড ডিগ্রির ভয় দেখাতেই বলে দিয়েছে সব।
গবাদাদু বললেন, বলিস কী রে ! তা কী বলেছে সেই কেয়ারটেকার ?
দেবরাজ বোস বললেন, অনেক সময় মৃতদেহ সৎকার করার জন্য কেয়ারটেকারের হাতে যা হোক কিছু টাকা গুঁজে দিয়ে চলে যায় অনেকে। সেই লাশগুলোকে না পুড়িয়ে কেয়ারটেকার বিক্রি করে দিত এই লোকদুটোকে। এরা আবার ডেডবডিগুলো নিয়ে গিয়ে চুবিয়ে রাখত দোলংয়ের জলে। সেখানে কিছুদিন থাকার পর মৃতদেহগুলো থেকে হাড় আর মাংস আলাদা হয়ে যেত। তখন কঙ্কালটাকে তারা পালের গোদার কাছে এনে আবার চুবিয়ে দিত বিশাল এক চৌবাচ্চায়।
হিগিনজেঠু বললেন, কেন ? চৌবাচ্চায় লাশ ডুবিয়ে রাখত কেন ?
অনিকেতকাকু বললেন, সেখানে কঙ্কালের হাড়গুলোকে পরিস্কার করে কস্টিক সোডা আর জল মেশানো পাত্রে সেদ্ধ করা হত। সেদ্ধ করার ফলে আবার হাড়গুলোর মধ্যে একটা হলদেটে ভাব চলে আসত। তখন সেই হলদেটে ভাব কাটিয়ে সেগুলোতে ‘মেডিক্যালি হোয়াইট’ রং আনতে এক সপ্তাহ রোদে রেখে হাইড্রোক্লোরিক অ্যাসিডে ডুবিয়ে রাখা হত। তারপর সেগুলো চলে যেত গোপন কারখানায়। সেখানে ভাড়া করা কিছু লোক সেই হাড়গুলোকে জোড়া লাগিয়ে পাচার করে দিত বাইরে।
আমি বললাম, কিন্তু এই কঙ্কালকান্ডের আসল কিংপিন কে ? ড্যানিয়েল ডুকপা নয়তো ?
অনিকেতকাকু বললেন, না, গগন সিংহানিয়া।
বাজ পড়লেও আমরা হয়তো এতটা চমকাতাম না। বড়রা বিহ্বল হয়ে মুখ তাকাতাকি করছেন। ভুলুর চোখ ছানাবড়ার মতো লাগছে। রাসেল এত বড় হাঁ করেছে যে একশো মাছি ঢুকে যাবে সেই গহ্বরে। আমাদের সকলের দশাই মোটামুটি একরকম।
আমাদের এক পলক দেখে অনিকেতকাকু বললেন, ওই দেহাতি লোকদুটো আর শ্মশানের কেয়ারটেকারটাকে নিয়ে কাল মাঝরাতে আমরা রেড করেছিলাম গগন সিংহানিয়ার বাড়িতে। ওঁর লেদ মেশিনের ফ্যাক্টরি শেডের একদিকে পার্টিশান দেওয়া ছিল। সেখানে ছিল বিরাট এক চৌবাচ্চা। যাতে বাইরে থেকে কিছু বোঝা না যায় সেজন্য ত্রিপাল দিয়ে ঘেরা দেওয়া ছিল জায়গাটা। ওখান থেকে উদ্ধার করা হয়েছে প্রচুর হাড়, দুই পিপে ভর্তি কস্টিক কেমিক্যাল আর একটা হাইড্রোক্লোরিক অ্যাসিডের বিরাট ড্রাম। মাঝরাতে রেড করে বামাল সমেত ধরা গিয়েছে গগন সিংহানিয়া আর অজয় তামাংকে।
দেবরাজ বোস বললেন, আরও আছে। গগন সিংহানিয়ার ডেরা থেকে উদ্ধার করা হয়েছে ভুটানি টাকা ছাপাবার যন্ত্র আর কয়েক লক্ষ টাকার জাল নুগলট্রাম। বেশ কয়েক বছর ধরে বেআইনিভাবে ভারতে এই জাল টাকাগুলো ঢুকিয়ে দিচ্ছিলেন গগন সিংহানিয়া আর অজয় তামাং। এবার আমরা হাতেনাতে ধরেছি সবকিছু।
হিগিনজেঠু বললেন, তার মানে অজয় তামাংও এর সঙ্গে জড়িত ?
দেবরাজ বোস বললেন, গগন সিংহানিয়ার হয়ে অজয়ই দেখভাল করত পুরো ব্যপারটা। গ্যালসিন লামার গুম্ফায় গিয়ে মাথার খুলি আর পায়ের হাড় বিক্রি করে এসেছিল অজয়ই। আমাদের ইনফরমার নিমা ওয়াংদির কাছ থেকেই আমরা জানতে পেরেছি সব। নাইট শিফটে যে লেবাররা ফ্যাক্টরিতে কাজ করত তারাই গোপনে এই দু’নম্বরি কাজকর্মগুলো করত।
অনিকেতকাকু বললেন, বুঝলে চপল, সেদিন গগন সিংহানিয়ার বাড়িতে নীচ থেকে একটা ঝাঁঝালো গন্ধ আসছিল বলেছিলে না? আসলে নীচতলায় হাইড্রোক্লোরিক অ্যাসিড স্টোর করা ছিল কোথাও, সেই গন্ধ চলে আসছিল দোতলাতেও। অজয় তামাং বোকার মতো মেথিলেটেড স্পিরিটের কথাটা না বললেই পারত। ও ভাবতে পারেনি মেথিলেটেড স্পিরিটের গন্ধ তোমাদের কারও চেনা হতে পারে।
সনাতনকাকু বললেন, গগন সিংহানিয়া আর অজয় তামাং এখন কোথায় ?
অনিকেতকাকু বললেন, আলিপুরদুয়ার থেকে এসডিপিও ফোর্স নিয়ে এসে দুজনকে অ্যারেস্ট করে নিয়ে গেছেন। দেহাতি লোকদুটো ছাড়াও আরও জনা বিশেক লেবারদের যথাস্থানে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। আমরা চার্জশিট তৈরি করে ফেলেছি। এদের প্রত্যেকের লম্বা হাজতবাস নিশ্চিত। এর পাশাপাশি একটা ভাল খবরও আছে। জলপাইগুড়ি থেকে পুলিশ সুপার ফোন করেছিলেন। উনি খুব খুশি। আমার প্রোমোশনের জন্য ওপরমহলে সুপারিশ করবেন বলে জানিয়েছেন।
আমরা খুশি হয়ে বললাম, বাহ্, এ তো দারুণ খবর।
সনাতনকাকু এঁটো হাতেই অনিকেতকাকুর পিঠে একটা চাপড় মেরে উচ্ছ্বসিত হয়ে বলে উঠলেন, জিতে রহো ! আমার দ্বারা তো হল না, তুই আমাদের বংশের নাম রাখলি !
১৮
সনাতনকাকুর কাছে আমি, ভুলু আর রাসেল বেশ বকুনি খেয়েছি ওঁদের না জানিয়ে গ্যালসিন লামার গুম্ফায় গিয়েছিলাম বলে। তবে সব শুনে উনি আবার ভীষণ কৌতূহলীও হয়েছেন ফেরার আগে লামার গুম্ফাটা একবার দেখে যাবার জন্য। মূলত সনাতনকাকুর উৎসাহেই ব্রেকফাস্ট সেরে আমরা সকলে মিলে হাঁটতে হাঁটতে এসেছি গ্যালসিন লামার গুম্ফায়।
এসে দেখি গুম্ফায় পেমা তামলং আছেন, জপযন্ত্র আর মণি হাতে অন্য ভিক্ষুরা আছেন। তবে নিমা ওয়াংদিকে দেখা গেল না।
তামলং আমাদের দেখতে পেয়ে এগিয়ে এসে ভিতরে নিয়ে গেলেন।
লামা তখন সবে পুজোয় বসেছেন। অবলোকিতেশ্বের মূর্তির সামনে খোলা পুঁথি, ঘিয়ের প্রদীপ জ্বলছে সারি সারি, ধুপের ধোঁয়ায় ঘর ভর্তি। কাচা দুধ রয়েছে একটা পাত্রে, সাদা ফুল রয়েছে অগুনতি। আড়চোখে এদিক ওদিক দেখলাম, আজ অবশ্য মাথার খুলি বা হাড় পুজোর আসনে দেখতে পেলাম না।
সনাতনকাকু পুজো দিলেন গুম্ফায়। পুজোর পর কলা আর লাড্ডু প্রসাদ নিয়ে এলেন তামলং। লামার নির্দেশে মাখন দেওয়া চা আর লেই লেই থুকপা এল সকলের জন্য। শুধু তাই নয়, আমাদের প্রত্যেককে একটা করে ধাতুর বুদ্ধমূর্তি আর ‘ওম মণিপদ্মে হুম’ লেখা জপযন্ত্র উপহার দিলেন গ্যালসিন লামা।
তামলং একগাল হেসে বললেন, এগুলো বাড়িতে যত্ন করে রেখে দেবেন, দেখবেন বাড়ির মঙ্গল হবে।
গুম্ফা থেকে গেস্ট হাউজে ফিরতেই দেখি ড্যানিয়াল ডুকপা আমাদের জন্য অপেক্ষা করছেন। আমাদের প্রত্যেকের জন্য ডুকপাদের ঝলমলে পোশাক ‘বখু’ নিয়ে এসেছেন ভদ্রলোক। ওভারকোটের মতো দেখতে রংবেরংয়ের সেই পোশাক পরে ছবি তোলা হল গেস্ট হাউজের সামনে দাঁড়িয়ে। কলেজের ডিগ্রি পেলে যেমন ছাত্রছাত্রীরা গ্রুপফোটো তোলে, তেমন করে। হিগিনজেঠুকে কালো কোটপ্যান্ট ছাড়া অন্য পোশাকে এই প্রথম দেখলাম আমরা সকলে।
অনিকেতকাকর জিপ এসে দাঁড়াল। গাড়ি থেকে নেমে এসে সনাতনকাকুর দিকে তাকিয়ে স্মিতমুখে বললেন, দাদা, একটা ভাল খরব আছে। এই একটু আগে থানায় ফোন এসেছিল কলকাতা থেকে। এই সপ্তাহেই নাকি অর্ডার বেরোচ্ছে, ডিএসপি হেডকোয়ার্টার পদে প্রোমোশন হতে চলেছে আমার। রংঝুরিতে তো ডিএসপি পোস্ট নেই, তাই যেতে হবে অন্য কোনও জেলায়।
সনাতনকাকু বুকে জড়িয়ে ধরলেন ভাইকে। বললেন, তোর জন্য আমার গর্বে বুক ভরে যাচ্ছে।অনিকেতকাকু গলায় বিষাদ মিশিয়ে বললেন, চাকরিতে পদোন্নতির জন্য যেমন খুব খুশি খুশি লাগছে, পাশাপাশি রংঝুরি ছেড়ে চলে যেতে হবে ভেবে খারাপও লাগছে। খুব মায়া জড়িয়ে গেছে এই ছবির মতো জায়গাটার সঙ্গে।
নিজেদের লাগেজ নিয়ে আমরা বাসে উঠছি। ডাকুকাকুর বিশাল ট্রাংকটা ওঠানো হল বাসের মাথায়। গবাদাদু সেদিকে তাকিয়ে একটিপ নস্যি নিয়ে বললেন, এই গন্ধমাদন যে কী করতে বয়ে নিয়ে এসেছিলেন কে জানে !
ডাকুকাকু আগুনে চোখে তাকালেন গবাদাদুর দিকে। সেদিকে ভ্রূক্ষেপ না করে গবাদাদু কপালে দুটো হাত ঠেকিয়ে বললেন, তবে হ্যাঁ, সত্যিকারের কবিরাজ ছিলেন আপনার বাবা আয়ুর্বেদাচার্য দক্ষিণারঞ্জনবাবু। ধন্বন্তরী লোক ছিলেন উনি। আমিও ওঁর পাঁচন খেয়েছি ছোটবেলায়। খেতেও ভাল, কাজও করত ম্যাজিকের মতো। নাহ মশাই, আপনি আপনার বাবার কাছ থেকে কিছুই পাননি।
ডাকুকাকু মুখ ভেংচে বললেন, বললেই হল ! এই যে রংঝুরি টি-টোয়েন্টিতে সবুজ সংঘের ছেলেরা বাঘের বাচ্চার মতো খেলে ট্রোফি জিতল সেটা কি এমনি এমনি হল ? আমার পাঁচন না খেলে সেটা সম্ভব হত ?
গবাদাদু একগাল হেসে বললেন, সবুজ সংঘ ট্রোফি জিতে নিয়ে যাচ্ছে তার আসল কারণ মোটেই আপনার পাঁচন নয়। আসল কারণ হল এই শর্মার মোক্ষম পরামর্শ। টিমের কোষ্ঠীবিচার করে জার্সির রং সবুজ থেকে পাল্টে নীল করে দিয়েছিলাম আর টিমের ক্যাপ্টেনের হাতে নীলকান্ত মণির আংটি পরিয়ে দিয়েছিলাম বলেই না টিমটা চ্যাম্পিয়ন হল !
ডাকুকাকু রেগে গিয়ে কিছু বলতে যাচ্ছিলেন, হিগিনজেঠু জজসাহেবের মতো করে চেঁচালেন, অর্ডার, অর্ডার। আপনারা এবার দয়া করে চুপ করুন। রংঝুরি কাপ জেতার কৃতিত্ব নেবার জন্য আপনারা আসল জিনিসটাই ভুলে যাচ্ছেন যে।
ডাকুকাকু আর গবাদাদু একসঙ্গে বললেন, কী জিনিস ?
হিগিনজেঠু বললেন, রংঝুরি টি-টোয়েন্টি জেতার আসল কারণ আপনারা নন, প্লেয়াররা। ওরা দুর্ধর্ষ খেলেছে বলেই আমাদের টিম চ্যম্পিয়ন হয়েছে। নিন ঝগড়াঝাঁটি বন্ধ করে এবার চলুন। ওই দেখুন রংঝুরি টুর্নামেন্ট কমিটির লোকজন এক এক করে জড়ো হচ্ছে বাইরে। ওদের কাছে আর নিজেদের হাস্যাস্পদ করে তুলবেন না।
ধন্ধুমার লড়াইটা মাঝপথে বন্ধ হয়ে গেল। ডাকুকাকু আর গবাদাদু চুপ করে গেলেন।
ড্যানিয়েল ডুকপা সমেত রংঝুরি টুর্নামেন্ট কমিটির বাকি সদস্যরা এসেছেন আমাদের বিদায় জানাতে। ঢাউস ফুলের বুকে ওঁরা উপহার দিলেন সনাতনকাকুর হাতে। ক্রিস্টালের বিশাল সাইজের চ্যাম্পিয়নস ট্রোফি আর এক লক্ষ টাকার চেক তো পেয়ে গিয়েছি কাল বিকেলেই। ড্যানিয়েল ডুকপা আমাদের প্রত্যেকের সঙ্গে হাত মিলিয়ে আন্তরিক গলায় বললেন, পরের বছর আরও বড় টুর্নামেন্ট হবে রংঝুরিতে। সবুজ সংঘ যেন অবশ্যই অংশগ্রহণ করে সেখানে।
সবাইকে বিদায় জানিয়ে আমরা বাসে উঠে পড়লাম। রংঝুরি ছেড়ে বেরিয়ে এল আমাদের বাস। জানলা দিয়ে তাকিয়ে দেখি শীতের দুপুরের হলদে রং বদলে যাচ্ছে বিকেলের মেহগিনি রংয়ে। রংঝুরি চা-বাগানের পাশ দিয়ে আমরা একটু একটু করে নীচের সমতলের দিকে নামছি। আবার সেই ধোঁয়া ধোঁয়া পাহাড়, আবার সেই শুয়ে থাকা সাপের মতো নির্জন আঁকা বাঁকা সড়ক। আবার ঘন সবুজ জঙ্গল আর ছটফটে দোলং নদী পথের দু’দিকে। আবার খাদের ওদিকের পাইনবনে মেঘ আর রোদের লুকোচুরি। সবকিছু পিছনে ফেলে আমাদের বাস নেমে আসছে ধীরে ধীরে।
এই ছবির মতো সুন্দর জায়গাটা, এই সহজসরল মানুষজনকে ছেড়ে যেতে ইচ্ছে করছে না একটুও। কিন্তু এটাই তো নিয়ম, একটা সময় আসে যখন সব প্রিয় কিছুই আমাদের ছেড়ে যেতে হয়। তাই যতক্ষণ আলো আছে বাসের জানলায় তৃষ্ণার্ত চোখ রেখে বসে আছি বিভোর হয়ে। রংঝুরি ছেড়ে যেতে হচ্ছে বলে মনটা ভার ভার, গলার কাছে কেমন একটা অচেনা অনুভূতি হচ্ছে। আর কয়েক ঘন্টা মাত্র, রাতের মধ্যেই আমরা পৌঁছে যাব জলপাইগুড়িতে।
অলংকরণঃ অংশুমান
খুব ভাল লাগল, মন ভরে গেল পড়ে, খুব সহজ সাবলীল ভাষায় জীবনত হয়ে ওঠে উত্তরবঙ্গ, আমার খুব প্রিয় জায়গা.
LikeLike
ব্যাপক
LikeLike