তন্ময় বিশ্বাসের আগে গল্পঃ পুটি ও ভগবান , ছায়া ফেলে যায়
এ প্রতিযোগিতা হয়েছিল রাজকুমার রায়চৌধুরিমশাইয়ের অসামান্য সাইফি “তাতিয়ানার মোবাইল“-এর একটা উপযুক্ত সিকোয়েল লেখবার চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে। সে চ্যালেঞ্জ নিয়েছিল বেশ কিছু তাজা কলম।
‘Greeting from sara breral. Indicate your posiho…’
(সব শুরুর আগে)
যেভাবে স্রোত এসে আগে আগে বন্যার খবর আনে,যেভাবে মৌমাছির ডানা ফুলের খবর পায়, ঠিক সেভাবেই গাংলু বুঝে গেল ও আর একা নেই। এই গাছপালা,পাতার ফাঁক গলে আসা সূর্য আর পায়ের নিচে নোনাধরা কাদার ওপর ছুটে পালানো বনমুরগির ছোটোখাটো দলটার বাইরেও এখানে কিছু আছে। সে আর এখানে একমাত্র নয়।
সামনের মাঝারি জঙ্গলটার দিকে একবার তাকাল গাংলু। খাপছাড়া সবুজের ঢল চলে গেছে অনেকদূর অবধি। গাংলু আস্তে আস্তে এগোল। এই মাটি ফুঁড়ে শেকড় উঠে আসা জল-কাদার জঙ্গলের একটা খুব সহজ নামতা আছে। হয় শিকার করো, নয় শিকার হও।
এখানে ভয়টাকে রাখতে হয় পায়ের তলায়। দু’পায়ের মধ্যেকার সাবধানতায়।
গাংলুর অভ্যস্ত চোখ মেপে চলেছে প্রতি ইঞ্চি অন্ধকার, আলো-ছায়া। বিপদ তোমার সামনেই থাকে, শুধু তাকে চিনে নিতে হয়।
টি টি টি…. করে একটা পাখি খুব নিচু থেকে ডেকে উঠল। কয়েকটা ঝিঁঝিঁ এখনও থামেনি। ওদের রাত বোধহয় শেষ হয় না।
গাংলুর আঙুলগুলো কুড়ুলের কাঠের হাতলে আরও একটু চেপে বসল। কানের কাছ দিয়ে কয়েক ফোঁটা ঘাম গড়িয়ে গেল পিঠের দিকে। ও আলোগুলো দেখতে পেয়েছে! একটা নয়, তিনটে। মাটি থেকে চার হাত ওপরে ভাসছে। হাতের মুঠোর চেয়ে আকারে একটুখানি বড়ো। স্নিগ্ধ, হলদেটে!
আলোগুলো এগিয়ে আসছে। তিন দিক থেকে। গাংলুর মনে হল নিচের কাদামাটি যেন গেঁথে ফেলেছে ওর পা দুটোকে। আর নড়ার ক্ষমতা নেই। ওগুলো এখন খুব কাছে। পাখির ডাক, ঝিঁঝিঁর চিৎকার ঢাকা পড়ে যাচ্ছে ওগুলোর মৃদু গুঞ্জনে। হলুদ আলোয় চাপা পড়ে যাচ্ছে জঙ্গলের সমস্ত সবুজ।
গাংলু শেষবারের মতো চেষ্টা করল। কোনওরকমে পিছনে খাঁড়ির দিকে টেনে নিয়ে গেল পা দুটোকে। আর তখনই ও ব্যাপারটা লক্ষ করল। ওর রোদে পোড়া চামড়ার ওপর রক্তের মতো গড়িয়ে পড়ছে সবুজ রঙের দাগ! কেউ যেন খুব যত্ন করে ওর সারা শরীরে দাগ কেটে চলেছে। লম্বালম্বি, আড়াআড়ি। আর দাগ বরাবর একটা পাগল করা যন্ত্রণা যেন ছড়িয়ে পড়ছে সব দিকে। চামড়া পুড়ে যাচ্ছে সবুজ আগুনে!
খাঁড়ির কাছে এসে শরীরটাকে ছেড়ে দিল গাংলু। সাঁতার জানা মানুষ সহজে ডোবে না। কিন্তু ও ডুবছে। চিৎ হওয়া শরীরটা তলিয়ে যাচ্ছে গভীরে। কিছুই যেন করার নেই। মুখের ভেতর আটকে থাকা শেষ বাতাসটুকুও বুদবুদ হয়ে বেরিয়ে এল একসময়। তারপর কাঁপতে কাঁপতে ওপরের দিকে উঠে গেল। আর কিছু দেখতে পেল না গাংলু। চোখের পাতায় নেমে এল নোনা লাগা অন্ধকার।
(১)
(২৪ ফেব্রুয়ারি, সন্ধে ৭:৫৯, নিউইয়র্ক, আমেরিকা)
ক্লাইভের যে এখানে খুব বেশি কাজের চাপ তা কিন্তু নয়। বলতে গেলে সারাদিন বসেই থাকতে হয়। বসে থাকাটাই কাজ। আর শুধু চোখ-কান সমেত বাকি তিনটে ইন্দ্রিয় খোলা রাখা। বলা তো যায় না। অঘটন তো সেই না বলেই হয়…
এই ঘরটা আগে সেটি’র স্টোররুম হিসেবে ইউজ হত। কেবল, ওয়্যার, লেন্স সব ম্যানুয়ালি সাজানো থাকত। তা জায়গা কম পড়ল, না নাপিত দেখে নখ বাড়ল সেটা ক্লাইভ জানে না। কিন্তু স্টোরটা শিফট হয়ে গেল সেকেন্ড ফ্লোরে। আর এটা হয়ে গেল প্রোজেক্ট TATS -এর অবজারভেটরি সেন্টার।
একটা মোবাইল সেট রাখার জন্য আস্ত একটা ঘর! নাসা বলেই পারে হয়তো। তবে ক’দিন পারবে সেটা হচ্ছে গিয়ে কথা। দু’মাস আগের হুজুগে যে জল ঢুকেছে, সে তো ক্লাইভের একা থাকা দেখেই বোঝা যাচ্ছে বেশ।
ফিসফাস অলরেডি শুরু হয়ে গেছে। যে কোনও দিন ক্লাইভের সুখের চাকরিটি যাবে! আবার মিশন কন্ট্রোলের সেই প্রচণ্ড টেনশনের কাজগুলো। সবদিক নজর রাখো, লঞ্চ প্যাড ঠিকঠাক আছে কিনা, ফুয়েল ট্যাঙ্ক ওপেন হয়েছে তো? আরে আয়নোস্ফিয়ার পার হয়ে গেল এখনও থার্ড সিকুয়েন্স-টা শুরু হচ্ছে না কেন? পোগ্রামিং গলদ? খোঁজ খোঁজ। একটা ভুল মানে বিলিয়ন ডলার জলে। তারপর দোষারোপ, পালটা দোষারোপ তো ফ্রি-তেই আসবে। তবু কাজটাকে ভালোবাসে ক্লাইভ। এই বসে থাকার থেকে বোধহয় ভালোই। একেকটা স্পেসক্রাফট যখন সমস্ত সিকুয়েন্স পার করে উতরে যায়, তখন সবার পিঠচাপড়ানি খেতে খেতে মনের মধ্যে পৃথিবী ছাড়ার মতো একটা আরাম টের পায় ও। সেটার তুলনা বোধহয় কিছুর সাথে হয় না। এই বোবা মোবাইলের সামনে বসে থাকার সাথে তো নয়ই।
উদাসভাবে স্ট্যান্ডে খাড়া করা মোবাইলটার দিকে তাকাল ক্লাইভ। আর তাকাবার সাথে সাথে লাফিয়ে উঠল। পাঁচ ইঞ্চির স্ক্রিনটা জ্বলে উঠেছে!
তবে কি পাওয়ার বটনে চাপ পড়েছে..
না তো! ওই তো স্লাইড লক অপশন দিচ্ছে। আর তার ওপরে একটা খামের ছবি নাচানাচি করছে।
মেসেজ এসেছে! আবার!
মোবাইলটা না ধরে পাশের মনিটরের দিকে ঝুঁকে পড়ল ক্লাইভ। মোবাইল সেটটাতে বেশ কিছু পোর্টার ইনস্টল করা হয়েছে। তার থেকে বেরিয়ে আসা জ্যাকগুলো কম্পিউটারের সাথে কানেক্ট করা। মোবাইলের সমস্ত কিছু এখান থেকে অপারেট করা যায় সহজেই।
কি বোর্ড-টায় তাড়াতাড়ি কমান্ড টাইপ করল ও। ফ্রিকোয়েন্সিটা এখনই দেখা দরকার। ওটাই আসল। ওটা পেয়ে গেলেই কেল্লা হাতের মুঠোয়। তারপর সেটা নিয়ে কী করবে, সেটা তোমার ব্যাপার।
ঠিক পাঁচ সেকেন্ডেই মনিটার আউটপুট দিয়ে দিল। স্ক্রিন জুড়ে বড়ো বড়ো করে ভেসে উঠল লেখাটা।
ফ্রিকোয়েন্সি আননোন!
ড্যাম ইট! প্রচণ্ড জোরে নিজের পায়ে একটা চাপড় মারল ক্লাইভ। এতটা সেনসিটিভ ফ্রিকোয়েন্সি! যেটা কিনা, নাসাও ধরতে পারছে না!
ও দায়সারা ভাবে এবার মেসেজটা ওপেন করল। কালো স্ক্রিনে সাদা দিয়ে ফুটে উঠল আলফা বিটার হিজিবিজি দাগগুলো। গ্রিক অ্যালফাবেট। অবশ্য এটা কোনও সমস্যাই নয়। ক্লাইভ ভালোই গ্রিক জানে। বলা যায় ওই জন্যই এখানে রাখা হয়েছে ওকে।
ক্লাইভ পাশে আরেকটা উইন্ডো খুলল। এটা এখুনি অনুবাদ করে মেল করতে হবে। অরিজিনাল সমেত।
‘Greeting from sara beral. Indicate your posiho…’
এরা বোধহয় এর বাইরে কিছু জানে না!
এতটা টাইপ করে থামল ও। এরপর কয়েকটা নানান সাইজের ডট এলোমেলোভাবে ছড়িয়ে আছে। যেন স্ক্রিনের ওপর কেউ সাদা সাদা পিঁপড়ে ছেড়ে দিয়েছে।
ক্লাইভ থামল। অবিশ্বাস নিয়ে ডটগুলোর দিকে তাকাল কিছুক্ষণ। হ্যাঁ স্পেস থেকে ইমেজ ফাইল এলে বোধহয় এরকমই হওয়া উচিৎ।
ক্লাইভ পকেট থেকে রেডমি-র সেটটা বার করল। তারপর কিউ আর স্ক্যানার অ্যাপটায় আঙুল দিয়ে চাপ দিল।
কুইক রেসপন্স কোড বা শর্টে কিউ আর কোড। নব্বই-এর দশকে সেরা আবিষ্কারগুলোর মধ্যে একটা। ১৯৯৪-তে জাপানের একটা অটোমোটিভ সংস্থা প্রথম এটা বার করে। তারপর এটা দ্রুত জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।
দোকানে জিনিস কেনার সময় প্যাকেটের পিছনে যে সাদা কালো বার কোডগুলো স্ক্যান করে বিল করা হয়, কিউ আর তারই আপডেটেড ভার্সন। এই ডটগুলোর প্যাটার্ন পালটে পালটে এর মধ্যে বিভিন্নরকম ইমেজ, ডাটা, এমনকি ভিডিও অবধি স্টোর করে রাখা যায়। শুধু মোবাইলে কিউ আর রিডার অ্যাপটা থাকলেই হবে। এরর কারেকশন পদ্ধতিতে ডটগুলো চটপট ছবি বা ডাটায় বদলে যাবে।
পাক্কা দু’সেকেন্ড। মোবাইলে ছবিটা ফুটে উঠতেই সেটাকে হাত থেকে নামিয়ে কিছুটা পিছিয়ে গেল ক্লাইভ! ও হঠাৎই একটা ধাক্কা খেয়েছে! বুকের ধুকপুকানি কি বাড়ল? ছবিটায় কিন্তু খুবই সাদামাটা, ভাঙাচোরা ঘরবাড়ি মতো কিছু একটা দেখা যাচ্ছে। তার ওপর আলফা বিটা দিয়ে লেখাগুলো তো আরও বেশি সাধারণ! শুধু লেখাগুলো এইভাবে, এখানে……। আসলে খুব সাধারণই কখন যে অসাধারণ হয়ে যায়!
ক্লাইভ রিসিভারটা হাতে তুলে নিল। ওপরের মহলে জানাতে হবে এখুনি। তবে তারা কতটা পাত্তা দেবে সেটাও একটা প্রশ্ন। নইলে TATS-এই যা করার করতে হবে।
ওরা আগুনে হাত দিয়েছে। আঁচ তো লাগবেই।
ওপারের কলার টিউনটা শুনতে শুনতে লেখাটার দিকে আরেকবার তাকাল ক্লাইভ। লাল দিয়ে লিখলেই যেন বেশি মানাত ওগুলো।
TO TATS, if you want your world for future.
ওরা আমাদের নামও জানে!
(২)
(২৪ ফেব্রুয়ারি, রাত ৯:৩৬, উইলিয়াম টাউন, আমেরিকা)
দেশ জুড়ে নাসার বারোটা সেন্টারের মধ্যে কিন্তু উইলিয়াম টাউন পড়ে না। এটাকে একটা আধা অফিসিয়াল রিল্যাক্স সেন্টার বলা চলে। মানে হালকা চালে কথাবার্তা, মিটিং, একটু মাইন্ড ফ্রেশ এইসব। আবার বাকি বারোটায় জায়গার অভাব হলেও এর ব্যবহার হয়।
লনের আশেপাশের ছাড়া ছাড়া ভিড়গুলোর দিকে তাকাতে তাকাতে এগিয়ে চললেন খাসনবীশ। এখানে একটা ঢিল ছুড়লে ৯০% চান্স থাকে যে সেটা বিশ্ববিখ্যাত কারও মাথা ফাটাবে!
দেশটা মেধা কেনে। জমিয়ে রাখে…
সামনের ‘কনফারেন্স রুম’ লেখাটার দিকে এগিয়ে যেতে যেতে ভাবলেন প্রফেসার।
‘এক্সকিউজ মি স্যার।’
দূর! বিরক্ত হলেও কিছু করার নেই। এখানে সেফটি ফার্স্ট। তাই যেখানে পেরেছে একটা করে চেকপোস্ট বসিয়ে দিয়েছে। কয়েকটা তুলে নিয়ে গেলে হয়। কলেজে যে রেটে বাইরের ছেলে ঢোকে! অবশ্য ওটা হচ্ছে গিয়ে ইন্ডিয়া। ফাঁকফোকর খোঁজার একটা দেশ।
সোনালি চুলের তরুণী সিকিউরিটি গার্ডের এগিয়ে দেওয়া কাঠিটা সিগারেটের মতো করে মুখে ধরলেন খাসনবীশ। তুলোর মিষ্টি একটা স্বাদ অল্পক্ষণের জন্য ঠেকে থাকল জিভে। তারপর চেকপোস্টের একটা ফুটো দিয়ে কাঠিটা ঢুকিয়ে দেওয়া হল টেস্টারে। বড়োজোর পাঁচ সেকেন্ড। তারপরই মাথার ওপরে একটা সবুজ আলো জ্বলে উঠল। উনি ডি এন এ টেস্টে পাশ করে গেছেন।
‘ওয়েলকাম স্যার। হ্যাভ আ নাইস ডে।’
মেয়েটা বেশ সুন্দর করে হাসল। খাসনবীশের কেন জানি মনে হল হাসিটা বানানো নয়, নিজস্ব।
আসলে কয়েকটা হাই ডেফিনিশনের হলিউডি সিনেমা দেখে আমেরিকাকে চেনা যায় না। বরং ঠকতে হয়। এখানে রেস্টুরেন্টের সস্তা টেবিলে, স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে, বড়ো রাস্তার ধারে খুচরো শর্টকাটে লেগে থাকে আরেকটা আমেরিকা, যা অন্ধকার। তারা বিভিন্ন সময়ে এসে আটকে পড়েছে অন্য একটা দেশে। সরকার তাদের স্বীকার করে না। দোকানে, পথেঘাটে তাদের বলে বলে ঠকানো যায় দিব্যি। সাত সাগরের পারে বসে এসব বোঝা দায়। সত্যি সত্যি হেঁটে দেখতে হয়। দেখা শিখতে হয়। সিনেমা, সাহিত্য, গানে ভুখা ভারত বেরিয়ে পড়ে প্রতি মুহূর্তে। ভুখা আমেরিকা শুধুই মিলিয়ে যায়।
সে তার দুর্বলতা ঢাকতে জানে। খুব ভালোভাবেই জানে।
কনফারেন্স রুমের বিশাল কাঠের দরজাটার সামনে এসে দাঁড়ালেন খাসনবীশ। দরজা জুড়ে একটা রঙিন ‘মিটবল’ খোদাই করা। অবশ্য এটা ডাকনাম। খাতায় কলমে এর নাম ‘ভিক্টির’। নাসার বেশ কয়েকটা লোগোর মধ্যে সবথেকে বেশি প্রচলিত। আর পুরোনো তো বটেই।
১৯৫৯-তে নাসার দ্বিতীয় বর্ষ উপলক্ষে James Modarelli এটা ডিজাইন করেন। ছোট্ট গোলটুকুর মধ্যে নাসার সমস্ত পরিচয় বেশ সুন্দরভাবে ফুটে ওঠে।
এখানে নীল বৃত্ত হচ্ছে গ্রহ বা প্ল্যানেট। তার ভেতরের সাদা সাদা তারাগুলো তুলে ধরে সমগ্র মহাকাশকে। তারপর আসে লাল রঙের স্ট্রিপের মতো একটা ‘V’। এর অবশ্য অনেক বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা-ট্যাখ্যা আছে। সাদা বাংলায় এটা তুলে ধরে Aeronautics, মানে ওই রকেট, বিমান-টিমানের ব্যাপার। আর NASA লেখাটাকে ঘিরে যে সাদা দাগটা হালকা করে চক্কর কাটছে। ওটা মহাকাশ অভিযানকে রিপ্রেজেন্ট করে।
দরজাটা ঠেলে ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে আগের দু’বারের মতোই ধাক্কা খেলেন খাসনবীশ।
তবে কী ভুল করে রেস্টুরেন্টে ঢুকে পড়লাম!
কনফারেন্স রুমের ‘ক’-ও এখানে নেই। মানে কনফারেন্স রুম বলতে পাতি মধ্যবিত্ত কেরানিদের যেটা মনে পড়ে। লম্বা মতো ঘর, চৌকো মতো টেবিল। বড়ো একটা প্রোজেকটর স্ক্রিন আর সাজানো চেয়ারগুলোতে গোমড়া গোমড়া সব মুখ।
এটা কনফারেন্স রুমের থেকেও অনেক বেশি কিছু। সফট ড্রিংকসের গ্লাস নিয়ে ঘুরে বেড়ান ওয়েটার, হালকা চিজের গন্ধ, একপাশে থরে থরে সাজানো লাল নীল বোতল আর ভেলভেটের ক্লথ পাতা টেবিল চেয়ার।
‘ওয়েলকাম প্রফেসার।’
TATS -এর হেড কন্ট্রোলার রিচার্ড পার্কারের শরীরটা তার পদের সাথে বেশ মাননসই। সাড়ে ছ’ফুটের হাইট, শিশুসুলভ মুখ আর একদম সাদা কদমছাঁট চুলগুলো তাকে কমিউনিকেশন এক্সপার্টের থেকেও অনেক বেশি একজন রিটায়ার্ড ওয়েটলিফটার হিসেবে তুলে ধরে। তাঁর ক্রিয়েটিভিটি, পর পর দুটো মিশনে সাফল্য, স্পেস ওয়াকের রেকর্ড তাঁকে প্রায় কিংবদন্তি করে রেখেছে।
‘হ্যালো পার্কার,’ ঘাড়টা যতটা সম্ভব ওপরে তুললেন খাসনবীশ।
‘আজ তোমার জন্য, ইভেন সবার জন্য অনেক ক’টা ভালো খবর আছে। চলো, এবার বসা যাক।’
‘ড্রিংকস?’
‘নো থ্যাংকস।’
‘ওকে গায়েজ। এবার একটু কাজ করা যাক।’
TATS -এর বয়স সবে মাত্র দু’মাস। যার মোবাইলের sms থেকে সব কিছু শুরু, সেই তাতিয়ানার নাম থেকেই গ্রুপের নাম রাখা হয়েছে TATS। যদিও মনে হয় না তাতিয়ানা এতে খুব একটা খুশি হয়েছে বলে। আসলে তাতিয়ানা নামটা বড়ো বলেই হোক, বা যে কোনও কারণেই হোক, স্কুলের খাতার বাইরে বেশিদূর ছড়ায়নি। পাড়ার চপের দোকান থেকে শুরু করে ক্লাসের স্যার ম্যাডামরা সবাই ওই ‘তানি’। তাতিয়ানা থুড়ি তানিরও বড়ো নামটা পছন্দ নয় তেমন। তাই ওর রাজু জ্যাঠা যখন সেই মিশাইল মার্কা নামটা দিয়েই গল্প লিখল, তখন তানি নাকি ভয়ানক ক্ষেপে গিয়েছিল!
‘লেটস স্টার্ট!’ সবাইকে একটা ওভাল শেপের টেবিলে জড়ো করে শুরু করেন রিচার্ড। TATS -এর কোর কমিটির সদস্য সাকুল্যে পাঁচ। এখানে সবাই সেরা। জার্নালিস্ট, হার্ডওয়্যার অ্যানালাইজার, প্রফেসর, CSNSWA (কসমিক অর সুপার ন্যাচারাল সিগন্যাল অ্যান্ড ওয়েভস অ্যানালাইজার), আর কমিউনিকেশন এক্সপার্ট।
‘প্রথমেই আসা যাক ত্যাতিয়ানের… সরি, তাতিয়ানের, কি ঠিক উচ্চারণ করছি তো?’
খাসনবীশ উত্তরে হালকা করে হাসলেন।
‘ওর রিসিভ করা sms-টা সত্যিই আমাদের মাথা ঘুরিয়ে দিয়েছিল। প্রশ্ন একটাই, মহাকাশ তরঙ্গ ধরার জন্য আমাদের কাছে এত কিছু থাকা সত্ত্বেও, সব ফেলে রেখে একটা আনকোরা নতুন কোম্পানির মোবাইল কেন?’
পাশে রাখা তরলটা একচুমুক গলায় ঢেলে আবার শুরু করলেন, ‘ওয়েল আমি কিন্তু মোবাইল কোম্পানিটার চার্ট এনে দেখেছি। ওদের পোগ্রামিং, কোডিং একদম ওকে। আর পাঁচটা কোম্পানির মতোই। বাট শুনলে সবাই অবাক হবেন। তাতিয়ানার সেটটা তা নয়! ওর পুরো পোগ্রামিং প্রসেসটা একটা ক্রিটিক্যাল পর্যায়ে এসে আটকে আছে।’
‘কিন্তু, এটা কী করে সম্ভব!’ বাদামি চুলের হার্ডওয়্যার অ্যানালাইজার হ্যানা হাংকের গলায় স্পষ্ট উত্তেজনা।
‘আই’ম নট শিওর। বাট আই হ্যাভ আ ওয়াইল্ড গেজ। আচ্ছা থান্ডার, মানে বজ্রবিদ্যুৎ সম্পর্কে আপনাদের কী আইডিয়া আছে? আই মিন, বেসিক তো মেঘে মেঘে ঘষা লাগা আর নেগেটিভ পজিটিভের ব্যাপার। আমি ডিটেলে যাচ্ছি না। কিন্তু তারপর?’
‘বাই দ্য ওয়ে, খাসনবীশ আপনার মনে আছে? আমাকে একবার বলেছিলেন একটা ঝড়জলের রাতে তানির বাড়ির পিছনের একটা শিরিষ গাছ পুরো উড়ে গিয়েছিল?’
খাসনবীশ মাথা নাড়লেন, ‘হ্যাঁ বাজ পড়ে।’
‘আর তানির কল লিস্টে পাওয়া গেছে, প্রায় ওই সময়েই ওর বন্ধু চৈতালীর সাথে ও কথা বলেছিল। কলটা কন্টিনিউ হয়েছিল বাইশ মিনিট। অথচ, তানি জানিয়েছে সেদিন ওদের ঝগড়া হয়েছিল বলে কথা হয় মাত্র পাঁচ-ছ’মিনিট! চৈতালীও ব্যাপারটা কনফার্ম করে। অবশ্য, ঝগড়া হলেও দুটো মেয়ে মাত্র পাঁচ মিনিট কথা বলবে! এটা নেওয়া যায় না। আমার মেয়ে তো আমাকে মোবাইল রিচার্জেই ফতুর করছে।’
সবাই একসাথে হেসে উঠল।
‘কিন্তু কানেকশানটা কী?’ মিস হ্যাংক হাসতে হাসতেই জিজ্ঞেস করে।
‘আসছি। জিম তোমার ভিডিওটা এডিট করা হয়েছে? তাহলে আমার খাটুনি একটু বাঁচে আর কি!’
‘একদম রেডি।’
‘ওকে প্লে ইট।’
প্রথম দিন জিম হেক্টরের পরিচয় পেয়ে বেশ অবাক হয়েছিলেন খাসনবীশ। নাসার সিক্রেট মিশনে ‘ডিসকভারি’-র একজন জার্নালিস্টের কী কাজ!
হ্যানা হয়তো তাঁর বিস্ময়টা আন্দাজ করতে পেরেছিল।
‘আপনার বোধহয় এটা মানতে অসুবিধা হচ্ছে প্রফেসার? কিন্তু কিছু করার নেই। আমাদের সিক্রেট একটু হলেও ভাঙতে হয়। স্পনসরের জন্য নাসা এখন নরকেও যেতে পারে, একজন রিপোর্টার পোষা তো খুব ছোটো ব্যাপার। দিন দিন সরকার বাজেটের ব্যাপারে শক্ত হচ্ছে। এতদিনে নিশ্চয় বুঝেছেন কিছুটা।’
হ্যানা তার প্রায় হোয়াইট ওয়াশ করা মুখে একটা বিষণ্ণ হাসি দিয়েছিল।
হ্যাঁ, খাসনবীশ এই ক’টা দিনে ভালোই বুঝেছেন। ভারতে বসে নাসাকে যতটা মহান, অপরাজেয় ইত্যাদি প্রভৃতি মনে হোক না কেন, আমেরিকার মাটিতে নাসা কিন্তু আদৌ তা নয়। নাসার সাকসেস পয়েন্ট ফেলিওরের চেয়ে ভয়াবহভাবে কম। অনেক ক্ষেত্রেই দশটার মধ্যে ছটা প্রোজেক্টেই ব্যর্থতার নজির রেখেছে নাসা। কম্পেয়ার করতে গেলে আমাদের ISRO অনেক বেশি সফল।
আর এজন্য ট্যাক্সিওয়ালা থেকে শুরু করে ট্যাক্সের জ্বালায় হাফপাগল কেরানি অবধি সবার চোখা চোখা আমেরিকান গালিগালাজ নাসাকে কুড়োতে হয় বছরভর।
এক ভিখারি তো সুইসাইড নোটে নাসার নাম লিখে গিয়েছিল!
ঘরের আলোগুলো একটু কমে এল। জিম ওর ল্যাপটপে ভিডিওটা প্লে করে স্ক্রিনটা ঘুরিয়ে দিল বাকিদের দিকে।
ডিসকভারির লোগোটা কয়েক সেকেন্ড ভেসে থেকে মিলিয়ে গেল। স্পিকার থেকে ভেসে এল বৃষ্টির ছম ছম শব্দ। তারপর কালো স্ক্রিনে ধীরে ধীরে একটা রাতের ছবি ফুটে উঠল। মুষলধারে বৃষ্টি পড়ছে। বিদ্যুতের নীলচে আলোতে ঝলসে উঠছে আকাশের মেঘ। একটা দোতলা বাড়িতে আলো দেখা যাচ্ছে। বৃষ্টি ভেজা বাড়িটা চক চক করছে স্ট্রিট লাইটের আলোতে।
এটা কোথাকার?
ক্যামেরা এবার জুম হতে হতে জানালা ভেদ করে ঢুকে পড়ল ভেতরে। বৃষ্টির শব্দ কমে এল কিছুটা। তার জায়গায় একটা মেয়ের গলা……..
খাসনবীশের চোয়ালটা আপনা থেকেই ঝুলে পড়ল। ঈশ্বর তুমি কোথায়!
স্ক্রিনে একটা মেয়েকে দেখা যাচ্ছে। রাগী রাগী গলায় ফোনে কথা বলছে।
তানি! এরা এটারও ডকুমেন্টারি বানিয়ে বসে আছে!
মাথার পেছনে লম্বা করে বাঁধা পনিটেল, হালকা ঝুঁকে দাঁড়ানোর ভঙ্গি, এমনকি ঠোঁটের ওপরের তিলটা অবধি নিখুঁত! তবে এটা তাতিয়ানা নয়। তানির সাথে এর ফারাকটা ঠিক ধরতে পারলেন না প্রফেসর। মানুষ যে কোথায় গিয়ে আলাদা হয়!
ছবি পালটে গেল। চারদিকে ময়লা তুলোর মতো থোকা থোকা মেঘ। বিদ্যুতের হালকা হালকা ঝিলিক খেলা করছে এদিক ওদিক।
হঠাৎই, একটা বেশ হৃষ্টপুষ্ট বিদ্যুতের রেখা এঁকেবেঁকে নিচের দিকে নেমে গেল। বাড়ির পিছনে একটা গাছের ওপরে এসে পজ হল কিছুক্ষণ। আর যাই হোক এটা শিরিষ গাছ নয়।
স্লো মোশনে নীলচে রেখাটা অজগরের মতো একটা ছোবল মারল গাছটাকে। গাছটার ওপরের অংশটা একটু ফাঁক হল। তারপর পুরো গাছটা ঝলসে উঠল তীব্র নীল আলোয়। এই অবস্থায় পুরো ঘটনাটা পজ হল। রিওয়াইন্ড হয়ে গাছের ওপরে পড়ার মুহূর্তে চলে এল আবার। নীলচে জিভটা ফের স্লো মোশনে গাছটাকে ছুঁল। আর সাথে সাথেই ধোঁয়ার রিঙের মতো একটা ওয়েভ তৈরি হল (অ্যানিমেশন)। তারপর সেটা বড়ো হয়ে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ল।
স্পিকারে একটা গলা ভেসে এল, ‘বাজ মাটির কিছু স্পর্শ করার সাথে সাথেই গোটা একটা সার্কিট কমপ্লিট করে ফেলে। এটা পৃথিবীতে প্রাকৃতিক ভাবে তৈরি বৃহত্তম সার্কিটগুলোর মধ্যে একটা।
এখন সার্কিট তৈরি হওয়ার সাথে সাথেই জায়গাটাকে ঘিরে একটা তড়িৎ চুম্বকীয় বলয় বা ম্যাগনেটিক ওয়েভের সৃষ্টি হয়। আর এটুকু গ্যারান্টি দিয়েই বলা যায়, যে আপনাদের ঘরে ইলেকট্রনিক্স জিনিস থেকে থাকলে, একবার না একবার বাজের কবলে পড়ে সেগুলো খারাপ হয়েছেই………’
ধারাভাষ্যটা একটু থামল। সদ্য জন্ম নেওয়া ‘ম্যাগনেটিক ওয়েভের’ একটা কোণা দেওয়াল ভেদ করে ঘরে ঢুকে পড়ল।
টেবিলের ওপর রাখা তানির মোবাইলটা তখনও ‘ইন কল’। অদৃশ্য তরঙ্গটা খুব দ্রুত মোবাইলটাকে আঘাত করল। মোবাইলের আলোটা নিভে গিয়ে আবার জ্বলে উঠল। হালকা চিররর শব্দ। চার্জারের গর্তটা দিয়ে ক্যামেরা ঢুকে পড়ল ভেতরে। মোবাইলের ছোটো ছোটো যন্ত্রাংশগুলো দেখা যাচ্ছে। আর অ্যানিমেশনে বানানো নীল নীল কয়েকটা হিজিবিজি নাম্বার ছুটে বেড়াচ্ছে এদিক ওদিক।
এগুলো আবার কী!
‘রিসিভিং ফ্রিকোয়েন্সি,’ ধারাভাষ্যটা আবার ভেসে এল। এখন একটু যেন উত্তেজিত, ‘প্রত্যেক মোবাইলেই নির্দিষ্ট করা থাকে। এখন মোবাইলটা অন কল থাকায় সেটাও অ্যাকটিভ ছিল। এবার যদি ধরে নেওয়া যায় থান্ডারের ম্যাগনেটিক ফ্রিকোয়েন্সি বাই এনি চান্স মোবাইলের রিসিভিং ফ্রিকোয়েন্সির সাথে ম্যাচ করে যায় বা কাছাকাছি হয়ে যায়। তাহলে? তাহলে এটা হয়……’
ম্যাগনেটিক ফিল্ডের মোবাইলের সাথে ধাক্কা লাগার দৃশ্যটা আবার দেখাল। এবার মনে হচ্ছে যেন মোবাইলটা ভ্যাকুয়াম ক্লিনারের মতো ওয়েভটাকে গিলে ফেলল।
‘ইয়েস। মোবাইলটা আকাশের কল রিসিভ করে নেয়, মানে বাজের ম্যাগনেটিক ওয়েভটা। আর যেহেতু এটা রেগুলার কোনও কল নয়, তাই এটা মোবাইলের ওপর অবশ্যই প্রভাব ফেলবে।
‘না। এক্ষেত্রে মোবাইলটার হাল আমাদের টিভি-ফ্রিজের মতো হয়নি। প্রভাবটা পড়েছে পোগ্রামিং কোডে। মোবাইলের প্রত্যেকটা কাজের জন্যই পোগ্রামিং কোড থাকে। তাতিয়ানার মোবাইলের কোডিং-এ এমন একটা ক্রিটিক্যাল পরিবর্তন এসেছে যে………’
শতাব্দীর সেরা চমকটা ঘোষণা করার আগে কণ্ঠস্বরটা একটু থামল। ঘরে পিন পতনের নীরবতা। পর্দায় ভিডিও-র বিশেষ বিশেষ মুহূর্তগুলো ফিরে ফিরে আসছে। এবার তানির রিসিভ করা মেসেজটা ফুটে উঠল।
‘এটা একটা আলট্রা সেনসিটিভ ফ্রিকোয়েন্সি রিসিভারে বদলে গেছে। যেটা হেসেখেলে নাসার সব থেকে সেনসিটিভ রিসিভারকেও হার মানায়। আর তার রেজাল্ট তো আপনাদের সামনেই আছে।’
ভিডিওটা এখানেই শেষ। ঘরের আলোগুলো আবার স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে গেল।
‘ওয়েল ওয়েল ওয়েল!’ হ্যানা নীরবতা ভাঙে, ‘রিচার্ড তোমার কি মনে হয় না, তোমার এই ধারণাটা একটু বেশিই বন্য?’
‘আমি আগেই বলেছি এটা ওয়াইল্ড গেজ,’ পার্কার হাসলেন, ‘তুমি এর চেয়ে ভালো থিওরি দিতে পারলে তোমার নেক্সট বিউটি ট্রিটমেন্ট আমার পকেট থেকে।’
‘আই থিংক তার জন্য তোমার মেয়েই যথেষ্ট। কিন্তু ট্যাটিয়ান… ওকে ফাইন টানি… তানি। ইয়েস, তো ওর মোবাইল না হয় এই জন্য ওরকম বিহেভ করল। কিন্তু বাকিদেরগুলো?’
‘ওহ! কাম অন হ্যানা! তুমি সত্যিই হ্যানা মন টাইনা মার্কা কথা বলেছ। ভুলে গেলে! ওগুলো জাস্ট সস্তায় নাম কেনার জন্য ফ্রড ছিল।’
‘ওকে, আকাশ কুমার তোমার কী মত? সাইলেন্ট মোডে চলে গেছ যে।’
স্যাং কাউচ টিমের মধ্যে কনিষ্ঠতম। CSNSW স্পেশালিষ্ট। বেঁটেখাটো, এলোমেলো চুল আর খুদি খুদি চোখের এক তর্কবাজ টিন এজার।
‘আমার মতটা বোধহয় আমি অনেক আগেই দিয়ে দিয়েছি,’ স্যাং মাথাটা তুলল, ‘মহাকাশে কোথাও যদি প্রাণ থেকেও থাকে তবে সেটা ব্যাকটেরিয়া বা ওই ধরণের কিছু। এর একপাও বেশি নয়।’
‘তুমি বোধহয় ভুলে যাচ্ছ শুধু আকাশ গঙ্গাতেই কত গ্রহ আছে তার হিসেব এখনও অ্যাকিউরেট পাওয়া যায়নি। আর তার বাইরে তো ছেড়েই দিলাম,’ খাসনবীশ বলে ওঠেন।
‘আমি কিছুই ভুলছি না প্রফেসার।’
‘তবে তোমার কেন মনে হচ্ছে এই মিলিয়ন সোলার সিস্টেমের মধ্যে একটা গ্রহতেও প্রাণ থাকতে পারে না?’
‘কাকতালীয় ব্যাপারটা এক আধবারই হয়,’ কাউচ গ্লাস থেকে একটু জল খেল, ‘এটা কোরান, বাইবেল বা আপনাদের গীতা নয় যে ভয়েজ কমান্ড দিল তো আলো জ্বলল, কাঠি ঘুরাল তো ডিম ফুটল। এটা বিজ্ঞান। পৃথিবীতে প্রাণের আবির্ভাব আর সেটা টিকে থাকা গোটাটাই কাকতালীয়। সূর্য থেকে তার দূরত্ব, তার আকার, প্রতিবেশীতে বৃহস্পতির মতো একজন বডিগার্ড, যে কিনা আমাদের দিকে ধেয়ে আসা সমস্ত উটকো বিপদের মুখ ঘুরিয়ে দেয়! জেনে রাখুন বৃহস্পতি না থাকলে পৃথিবী অনেক আগেই ধ্বংস হয়ে যেত। তারপর পৃথিবীর গতি, চাঁদের অবস্থান, এমনকি অগ্ন্যুৎপাত, বিদ্যুৎ চমকান এটসেট্রা এটসেট্রা… এর মধ্যে একটাও যদি বাদ পড়ত তাহলে হয়তো পৃথিবীতে জীবন আসতই না।’
‘এখানেও কিন্তু হয়তো থেকে যাচ্ছে,’ হ্যানা ঘাড়টা একটু হেলিয়ে বলে ওঠে।
‘সায়েন্সের অনেকটাই ‘হয়তো’, ‘ধরে নেওয়া’-র ওপর দাঁড়িয়ে আছে মিস। প্রায় সব ফর্মুলা। ধরে নেওয়া হয় ফ্রিকশন নেই, ধরে নেওয়া হয় গ্রাভিটি নেই, বাতাস নেই….’
‘ওকে ওকে, এবার আমার টার্ন,’ এতক্ষণে জিম মুখ খুলল, ‘পার্কার, ধরে নিলাম তুমি ঠিক। কিন্তু ওদের দাবিটা কী? Indicate your poisho? হোয়াট’স দ্যাট? কী ধরব সেটা ইন্ডিকেট করবে! কোনও মানেই দাঁড়ায় না…….’
‘গুগলে সার্চ মারো ক্যামেরা খোকা,’ হ্যানা ফোড়ন কাটে, ‘posiho-র ১০১ টা মানে পাবে। হয়তো ওরা আসছে আমাদের অবস্থান বোঝাতে।’
‘বা তোমার চুলের ওপর খরচ কমাতে,’ কাউচ মুখ বেঁকায়।
উত্তরে হ্যানা কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল। তখনই পার্কারের ব্লু টুথ হেডফোনটা একবার বিপ করল।
‘এক্সকিউজ মি প্লিজ।’
তারপর মিনিট দুই ফোনে কথা বলার পর যখন টেবিলে ভর দিয়ে উঠে দাঁড়ালেন, তখন মুখে খেলা করছে এক রহস্যময় হাসি।
‘লেডিস অ্যান্ড জেন্টলম্যান, আজকের রাতটা লম্বা হতে চলেছে,’ চেয়ারটা নাটকীয়ভাবে একটু ঘোরালেন, ‘আমরা রাতটাকে দিন করতে চলেছি।’
(৩)
(২৫ ফেব্রুয়ারী, দুপুর ২:০৩, কলকাতা, ভারত)
এই সময়ের রাস্তাটা কেমন যেন ক্লাস ফোরের রচনা বইয়ের মতো হয়ে থাকে। একঘেয়ে রুগী রুগী। ঘুরে ফিরে সব রচনাই যেন গরুতে এসে থামে। চারটি পা, একটি লেজ, দুটি কান। এখানের রচনাটা গলি নিয়ে। যেরকম গলিতে টাটা সুমো ভুল করে ঢুকে পড়লে খবর হয়ে যায়, সেরকম।
জুসের ক্যানের বাকিটা গলায় ঢেলে, সেটাকে দোতলা ব্যালকনির বাইরে পাঠিয়ে দিল তাতিয়ানা। কিছুক্ষণ কড় কড় করে সেটা গড়াগড়ি খেল। তারপর শান্তভাবে ঢুকে গেল মুখখোলা নালির রোগাটে হাঁয়ে।
ইতিহাসের ফেলে যাওয়া শহরের মতো আবার বাতিল হয়ে যায় গলিটা। এধার ওধার অগোছালোভাবে জমা জল আর মাঝবেলার ছেঁড়া কাঁথার একটা রোদ। কেবলের তারে আটকা পড়া ঘুড়িটা আপনমনে দোল খায়। একটু একটু কাঁপে। তারপর আবার ঝুলে পড়ে।
শনিবারের দুপুরগুলো এমনিই হয়। কাটতে চায় না। বাবার অফিস, মায়ের একবেলার মামাবাড়ি আর দাদার গুলতানি সফর। হাফ ডে স্কুল ছুটির পর পড়ে থাকে শুধু তাতিয়ানা। সাথে বাংলা সিরিয়াল মার্কা একটা দুপুর।
খুব নিচু দিয়ে একটা চিল পাক খাচ্ছে। গলির একদম মাঝখানে ভয়ে ভয়ে এসে পড়া রোদটায় একবার করে ওটার ছায়া পড়ছে, আর পরক্ষণেই সেটা মিলিয়ে যাচ্ছে। আচ্ছা চিল এভাবে পাক খায় কেন? কোথাও যাওয়ার নেই বলে?
নাসা থেকে ফেরার পর ওর রাস্তাটাও কেমন যেন গন্তব্যহীন মনে হয় তানির। রাস্তাটা এগোয়। সোজা, ডানদিক, বাঁদিক। কিন্তু শেষ অবধি কোথাও যায় না…
ক্লাসে ওকে সবাই কেমন একটা নজরে দেখে এখন। যেন ওর গ্রহটা হঠাৎ করে আলাদা হয়ে গেছে। যেন ঠাকুমার দেওয়া তাতিয়ানা নামটাকে মনেপ্রাণে অপছন্দ করা আগের সেই তানি আর ও নেই। দু’দিন আগে স্কুলে, পাড়ায় যে শুধুমাত্র তানি হয়ে ছিল, সে এখন তাতিয়ানা। তাতিয়ানা বোস।
সেদিন স্কুল ছুটি হয়ে গিয়েছিল তাড়াতাড়ি। দু’পিরিয়ডে। ও আর চৈতালী গিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল মোড়ের ফুচকা স্ট্যান্ডে। রাতে বৃষ্টি পড়েছিল। পিচ রাস্তার পাঁজরে পাঁজরে জল জমেছিল বেশ। ওরা তখন সবে শালপাতা হাতে নিয়েছে। তখনি কীভাবে যেন জেব্রা ক্রসিং-এ রাস্তা পেরোনো একটা দল চিনে ফেলেছিল তাতিয়ানাকে। টানাটানা চোখ, টিকোলো নাক আর মায়ের ভাষায় কাঁচা হলুদ গায়ের রঙের সমস্যা হল, একবার দেখলে চট করে ভোলা যায় না। বিশেষ করে ঠোঁটের ওপরে আলতো করে বসে থাকা তিলটা। দেখলেই চেনা যায়। ওরাও চিনেছিল। মিনিট খানেকের একটা হুজুগে ভিড় ঘিরে ধরেছিল ওদের। তানিকে।
উড়ে আসা প্রশ্ন, সেলফি ক্লিক, তারপর একসময় রাস্তা ফাঁকা হয়েছিল। একদম খালি। চৈতালী কখন যেন চলে গেছে। তানির চোখের সামনে নেমে এসেছিল ঘষা কাঁচের পর্দা। পিঠের ব্যাগ ভারী হতে লেগেছিল হঠাৎ করেই।
শহরে বেলা গড়াচ্ছে, বাস চলে যাচ্ছে লোক নামিয়ে, ফুচকাওয়ালা এঁটো হাতে খুচরো বুঝে নিচ্ছে। রাস্তা কেটে যাচ্ছে ব্যস্ত মানুষজন। চৈতালী চলে গেছে! রাশিয়ান রূপকথায় মোড় ঘুরেছে। নতুন দিগন্তওয়ালা এক মোড়। বা দিগন্ত ছাড়া…
‘কাম উইথ মি… দ্রিং ট্যা… দ্রিং ট্যা…’
তানি চমকে পায়ের দিকে তাকাল। আর তারপরেই হেসে ফেলল। পায়ের সাথে ধাক্কা খেয়ে কাঠবিড়ালিটা থেমে আছে।
এটা ব্যাটারিতে চলে। তানির বিশাল কালেকশানের মধ্যে একটা। এখন অবশ্য আর খেলে না। ওর স্টাডি কাম বেডরুমে সাজানো থাকে। সুইচ অন করলে হালকা লাফিয়ে লাফিয়ে চলে। সাথে ‘কাম উইথ মি’ মিউজিকটা বাজে।
ও পায়ের আঙুল দিয়ে হালকা ঠ্যালা দিল। ক্যাট ক্যাট করতে করতে ওটা দরজার কাছে গেল। তারপর ডানদিকে বাঁক নিয়ে আবার চলতে থাকল।
আরে এটা তো শুধু সোজা যেতে পারে! বাঁক নিল কী করে? নিশ্চয় দাদার কীর্তি। তা এটা সাকসেসফুল কীর্তি। বেশিরভাগই বারোটা বাজায়। তবুও আগ্রহ-টাগ্রহের ঘাটতি নেই। সত্যি, দাদাটা কেন যে ইলেকট্রিক্যাল নিয়ে পড়ল না!
তানি উঠে পড়ল। এটা হচ্ছে ওকে তলব করার জন্য। না গেলে আবার বাবুর গোঁসা হবে। জ্বালা কম নাকি। ঢ্যাং ঢ্যাং করে লম্বাই হয়েছে খালি। বয়স সেই দশ বারোতেই গোঁত্তা খাচ্ছে।
করিডরটা অন্ধকার। গলির বাড়িতে রোদ ঢোকে না তেমন। কালো সিমেন্টের পালিশ করা মেঝে দিয়ে থুপ থুপ করে এগিয়ে যাচ্ছে খেলনাটা।
‘দ্রিং ট্যা… দ্রিং ট্যা… কাম উইথ মি… কাম উইথ মি’ কানের পাতায় ফিট করা এল ই ডি দুটো হালকা লাল আলো ছড়াচ্ছে।
করিডরের একদম শেষে তানির ঘর। দরজাটা একটু ফাঁক করা। খেলনাটা ডেকে ডেকে দরজার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। আচ্ছা, একটা জলের শব্দ হচ্ছে না? কেমন একটা কল কল করে জল পড়ার শব্দ! ঘরের ভেতর থেকে আসছে। দাদা? দুটো পাখি যেন ঝগড়া করছে তার মধ্যে। ঘুলঘুলি দিয়ে চড়াই ঢুকেছে?
দরজার কাছ অবধি গিয়ে পুতুলটা থামল। পায়ে ভর দিয়ে ঘুরল তানির দিকে। তারপর দম শেষ হয়ে যাওয়া পুতুলের মতো ঝুপ করে পড়ে গেল। ব্যাটারি শেষ বোধহয়।
তানি দরজা ঠেলে ঘরে ঢুকল। ফাঁকা ঘর। জানলার ঘষা কাচের ওদিকে তিনটে-চারটের শহরতলি। ভেতরে গিঁট পেকে আছে আলোছায়া। জলের শব্দ থেমে গেছে। পাখির ঝগড়া যেন শেষ হয়ে গেছে মাঝপথেই! ঘর জুড়ে অদ্ভুত একটা কানে ঝিঁঝিঁ ধরানো নীরবতা। কেউ যেন অপেক্ষা করে ছিল এখানে। এখন আর নেই!
জানলার ঠিক সামনেই বিছানা। টান টান করে পাতা সাদা চাদর। তার ওপর একটা মথ… না মথ তো নয়। ডানা মেলে বসেছে। প্রজাপতি তবে কালোও হয়! প্রজাপতিটা নিঃশব্দে উড়ে এল। বসল তানির পায়ের পাতায়। এবার ভালো করে দেখা যাচ্ছে। কালোর ওপর নীল দিয়ে কাজ করা ডানা। নীল রেখাগুলো শিরার মতো ছড়িয়ে আছে ডানা জুড়ে।
কড়ড়ড়ড়… তানি একটু চমকে ঘাড় ঘোরাল। পাশের স্টাডি টেবিলের ওপর পেনসিলটা গড়াচ্ছে। হাওয়া দিল? গড়াতে গড়াতে টেবিলের ধার অবধি এসে যেন থামল অল্প। তারপর টুপ করে মেঝেতে পড়ল। আর ঠিক তক্ষুনি কম ভলিউমের গানটা বেজে উঠল –
‘দেড়শ বছর আগেও আমি…’
মুহূর্তের মধ্যে তানির হাতের তালু ঘেমে এল। পায়ের তলাটা কেমন যেন ঝিন ঝিন করছে।
এই একলা বাড়িটা কি তবে জেগে উঠল!
ভয়ে ভয়ে তাকের মিউজিক সিস্টেমের দিকে তাকাল তানি। অনুপম তখনও গেয়ে চলেছে। প্ল্যাটফর্ম ছেড়ে এসে গানটা যেন নরক সাজিয়ে বসেছে এই বারো বাই আট ফুটের ঘরে। দেড়’শরও অনেক বেশি সময়ের অপেক্ষা আজ শেষ হয়েছে।
আজ তারা জেগেছে!
‘ঘরে কে আছে? … হ্যাল্লো!’ নিজের কাছেই কথাগুলো খুব বেশি ফাঁপা মনে হল তানির।
‘খি খিখি খি’ সেলফে রাখা স্পিকিং ডলটা মুখ ভেঙিয়ে হেসে উঠল।
ও আর দাঁড়াল না। নিজেকে পুরোপুরি হারিয়ে ফেলার আগে, পিছনের দরজাটা একটানে খুলে ফেলল। আর এক সেকেন্ডও এখানে নয়।
কিন্তু, এ কী! দরজার বাইরেটা আর ফাঁকা নয়। দরজার ঠিক সামনে কাপড়ের ডেক চেয়ারটা পাতা! এটাতেই একটু আগে ব্যালকনিতে বসেছিল তানি। একটাই আছে ওদের বাড়িতে। আর চেয়ারের কোলের ওপর? ওটাও তো একটাই ছিল!
‘দ্রিং ট্যাং… দ্রিং ট্যাং… কাম উইথ মি… দ্রিং ট্যাং… দ্রিং ট্যাং…’ কানের এল ই ডি-গুলো থেকে যেন রক্ত ঝরছে। টকটকে লাল রক্ত।
ও দরজাটা ধড়াম করে বন্ধ করে পিঠ ঠেকাল। কাঁধদুটো দু’পাশে হাপরের মতো ওঠা-নামা করছে। হাঁপাচ্ছে।
‘ম্যানহোল আর কলেজস্ট্রিটের গলি…’
তানি স্বপ্নেও ভাবেনি অনুপমের গলাকে এতটা অসহ্য লাগবে!
মোবাইলটা? মোবাইল কোথায়? ইমিডিয়েটলি ওটা দরকার। তানি চোখ খুলল। খুলেই রাতের রাস্তায় ট্রাকের সামনে পড়া কুকুর ছানার মতো মনে হল নিজেকে। হড় হড় করে একটা ঠাণ্ডা ঢেউ নেমে এল মাথা থেকে। পায়ের দিকে।
ঘষা কাচ দিয়ে চুঁইয়ে আসা আলোতে পিঠ দিয়ে বসে আছে লোকটা। যেন পোড়া কাঠ কুঁদে বানানো। চোখে মণি বলে কিছু নেই। সাদা অংশের গোটাটাই হালকা সবুজ আলো। আর ফ্রিজ খুললে যেমন ধোঁয়া ধোঁয়া মতো একটা কুয়াশা দেখা যায়, তেমনই যেন একটা কুয়াশার মেঘ পাক খাচ্ছে চোখ দুটোর আশেপাশে।
তানি দরজা বেয়ে বসে পড়ল। সাইলেন্সর ছাড়া একটা বাইক ছুটে বেড়াচ্ছে ওর বুক জুড়ে। জলের শব্দটা আবার ফিরে এসেছে। ঝর ঝর করে ঝরে পড়ছে কোথাও একটা। স্পিকিং ডলটার হাসি এখনও থামেনি। আচ্ছা, হায়েনার হাসি বোধহয় এরকমই হয়!
‘পুকুর ধারে জলের গন্ধে, বাংলা ভাষায়…’
মিউজিক সিস্টেমের ভলিউম বাড়ছে আস্তে আস্তে। নিউমার্কেটের বিকেলের ভিড় যেন উঠে এসেছে ঘরের মধ্যে। কাউকে দেখা যাচ্ছে না। কিন্তু আছে, অনেকে আছে।
লোকটা উঠে দাঁড়াল। ক্যাট ক্যাট করে একটা ফাটল এঁকেবেঁকে ছড়িয়ে পড়ল পিছনের কাচ জুড়ে। কট… কট… কট কট। কিছুক্ষণ থামল। তারপর ঝন ঝন করে ভেঙে পড়ল। স্পিকিং পুতুলটা হেসে উঠল আরও জোরে।
হঠাৎ করে নিজেকে হাইওয়ের ওপর ওড়া প্লাস্টিকের মতো মনে হল তানির। নিচে গাড়ি, বাইকের ফেলে যাওয়া রাস্তা। ওপরে আকাশ। ও আস্তে আস্তে নেমে আসছে। মেঘ জমছে আকাশে। কালো, একদম কালো চারটে দিক। শুধু দু’টুকরো জেগে থাকা সবুজ। হালকা একটা সবুজ ধোঁয়া –
“দেড়’শ বছর আগেও আমি, তোমার খোঁজে পথের ধারে… ক্লান্ত হয়ে শুয়েছিলাম… … … এভাবেই ঠিক অন্ধকারে।”
(৪)
(২৫ ফেব্রুয়ারি, রাত ৭:১৬, পাটনা, ভারত)
মাঝে মাঝে নিজেকে বরফের মধ্যে জমে যাওয়া পিঁপড়ে বলে মনে হয় ওমপ্রকাশের। গলে না পচে না, নড়াচড়াও করতে পারে না। শুধু একভাবে শক্ত জলের সাথে চিটে থাকে।
পায়রার বাড়ির মতো একটা ঘর। ড্যাম্প ধরা দেওয়াল আর পচতে থাকা কাগজের বান্ডিলের মধ্যে পায়া নড়বড়ে টেবিলটুকু কোনও রকমে জায়গা করে নিয়েছে। আর পেরেক ওঠা চেয়ারটাতে অনেক কাঠ খড় পুড়িয়ে ঠাঁই হয়েছে ওমপ্রকাশের।
ক্ষমতার জন্য আগে কাঠ খড়ই পোড়ে। তারপর পুড়তে হয় নিজেকে।
বিহারের সি এম-এর সাথে যোগাযোগের মাঝের সুতো হিসেবে কাজ করে ওমপ্রকাশ। যেখানে বারুদ ছাড়া তেমন কথা বলা হয় না সেখানে সুতোয় টানও লাগে দু’দিক থেকেই।
এমনিতে তো সি এম-এর দর্শনার্থীরা ওর সাথে কথাই শুরু করে টেবিলের ওপর পাইপগানগুলো নামিয়ে রেখে…
ওর ভাবনায় ছেদ পড়ল –
‘স্যার স্যার।’
‘কা?’ পানে লাল হয়ে থাকা ঠোঁট নিয়ে ওর দিকে তাকালেন সি এম।
‘ও দিল্লি সে কল আয়া থা। রাত মে কুছ ফরেনার আ রহে নালন্দা মে। ও কুছ এলিয়েন বাগারা বাগারা…’
‘আরে ইয়ার, ইনলোগো কা তো কাম ধান্দা কুছ হ্যায় নেহি, ব্যাস ঝুট মুট কা তকলিফ। এ বিশ্ব ধ্বংস হোগা, আশমান টপককে এসিড গিরেগা। বড়ে আয়ে কল্কি ভগবান…’
‘স্যার তো?’
‘ও কলকাত্তা হো কর আ রহে না? সো চেকিং ফিকিং হো গিয়া হোগা। যাদা তকলিফ মত লো। নালন্দা কা চিফ কো এক ফোন ডাল দো ব্যাস।’
‘স্যার ফোন তো ডেড হ্যায়!’
‘আরে বুরবক হ্যায় তু? অনলাইন কল কর দে।’
সি এমের ফোনটা বেজে উঠল তখনি – ‘আরে বাপ রে… হ্যালো… হাঁ জি কাবাব চড়া দো। হাম ব্যস দশ মিনিট মে আয়ে।’
(৫)
(২৫ ফেব্রুয়ারি, রাত ৭:২৩, ভারতের কোথাও)
ঘরটায় আলো নেই তেমন। শুধু একটা জিরো পাওয়ারের বালব হাঁপানি রুগীর মতো টিমটিম করে জেগে আছে। ছায়াটার পিঠ আলোর দিকে। স্ক্রিনের হালকা নীলে জ্বল জ্বল করছে দুটো চোখ। একটা লম্বা নিশ্বাস নিয়ে তৈরি হল ও। মনে হল জীবনের প্রথম অন্যায়টুকু করতে যাচ্ছে। মাথার মধ্যে একটা চাপ অনুভূত হল।
আর কোনও উপায় নেই। এটা শুধুমাত্র যোগ্যদের জন্য।
ফোনটা ডেস্কটপের সাথে কানেক্ট করে ‘ভয়েজ ম্যাজিক’ সফটওয়্যারটা অন করল। রেকর্ড মোডে সেট করতেই স্ক্রিন জুড়ে একটা গ্রাফ শিটের ছবি ভেসে উঠল। বিভিন্ন মাপের ঢেউ স্থির হয়ে আছে পাতা জুড়ে।
কল
ট্রু ট্রু ট্রু…
‘হ্যালো নালন্দা কন্ট্রোল রুম।’
স্ক্রিনের গ্রাফগুলোর ওঠানামা শুরু হয়ে গেছে। ওপারের গলাটা নিজের ছাপ ফেলে যাচ্ছে টু ডি গ্রাফ শিটে।
নিচের টাইমারের দিকে তাকাল। আর ১২ সেকেন্ড…
ঠিক আছে
‘হ্যালো, is Nalanda open tomorrow, for visitors?’
‘Yes, but museum …’
এক সেকেন্ড
আর কিছু না বলে ও ফোনটা কেটে দিল। গ্রাফগুলো এ ওর সাথে গিঁট পাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। প্রসেসিং বাটনে ক্লিক করল।
লোডিং… …
রেজাল্ট – ২.৪
এই সফটওয়্যারটা ওর এক জার্মান ফেসবুক ফ্রেন্ড ওকে দিয়েছিল। একটা মিনিমাম অ্যামাউন্টের ভয়েস স্যাম্পেল ইনসার্ট করলে, ১৫ সেকেন্ডের মধ্যে সেটাকে কপি করে নেয় সফটওয়্যারটা। তারপর, একটা ফিলটারের সাহায্যে অন্য যে কোনও ভয়েস স্যাম্পেলকে ওটার মতো করে বদলে ফেলে। মানে সাদা বাংলায় এটা দিয়ে গলা নকল করা যায়। যার চাওয়া হবে তার।
অপেক্ষা…
এটা করা ছাড়া আর কোনও উপায় ছিল না।
আবার নিজেকে বোঝায় সে। নীলচে কালো ছায়াটা একটু যেন কেঁপে ওঠে।
কুল… কুল…
আশা করি ফোনটা মিস হয়ে যায়নি। স্ক্রল করে আগের দু’ঘন্টার কল লিস্টগুলো আরও একবার চেক করে নিল। নাঃ ঠিক আছে…
তখনই ল্যাপটপটা বিপ করল। অ্যাট লাস্ট!
কিছুটা বেজে যেতে দিয়ে ফিলটারটা অন করল। তারপর অবিকল একভাবে বলে উঠল, ‘হ্যালো, নালন্দা কন্ট্রোলরুম?’
‘হাঁ ইকবাল সাব। আব ডিউটি মে?’
‘ইয়েস, আব সেন্টার মেই কল কিয়া হ্যায়।’
‘হাঁ হাঁ। সরি সরি। ও কেয়া হ্যায় না, কুছ ফরেনার লোগ ইউ.এস সে আব কা ওহাঁ আ রহে। তো থোড়া খাতিরদারি… সমঝে না? সি এম কা অর্ডার…’
‘ওকে স্যার…’
‘আউর হাঁ, তুমহারা বেটা অব ক্যায়সা হ্যায়?’
‘ও… ইয়ে… হাঁ ঠিকই হ্যায়। ওকে প্রকাশজি বাদ মে বাত হোগা…’
ও কলটা শেষ করল। কপালের ঘামটুকু মুছে নিল হাতের উলটো পিঠে।
এখনই করতে হবে।
সি এমের অফিসের নাম্বারটা সেট করল। এবার এই নাম্বারটা দিয়ে যেখানে খুশি কল করা যাবে।
কলিং… …
‘হ্যালো, নালন্দা কন্ট্রোলরুম?’
ছায়াটা একটু থামল। চোখ বন্ধ করে গুছিয়ে নিল নিজেকে।
নাউ অর নেভার!
‘ইকবাল সাব, ম্যায় প্রকাশজি। আপকা লড়কা ঠিক হ্যায় না?’
(৬)
(২৫ ফেব্রুয়ারি, রাত ১০:১৯, 25°08’12″N, 85°26’38″E)
‘এই প্যারাট্রুপিং-এর আইডিয়াটা কার ছিল, একটু বলবে প্লিজ?’
ঘন্টায় এক’শ আঠারো মাইল বেগে পড়তে থাকা শরীরটাকে যতটা সম্ভব ছড়িয়ে দিতে দিতে চিৎকার করে উঠল হ্যানা হাংক।
হাতে হাতে বাঁধা ডিজিট্যাল অল্টিমিটারগুলোতে খুব দ্রুত উচ্চতা কমে আসছে।
২২০০……২১৯৩………২১৮৮..
‘দুই দেশের সরকার হ্যানা। কেউই আমাদের পাত্তা দিল না তেমন। আর তা ছাড়া এয়ারপোর্ট থেকে চপারের থেকে বেশি স্পিডে কিছুতে আসা যেত না,’ স্ক্রিন থেকে চোখ সরায় না পার্কার।
‘আমি যতদূর জানি সব থেকে ফালতু মডেলের হেলিকপ্টারটাও মাটি অবধি নামতে পারে।’
‘কাম অন। তুমি ডেফিনিটলি চাইবে না আশেপাশের গ্রাম আমাদের সার্চ টিমে জয়েন করুক।’
‘আর সার্চ!’ চুলগুলো বাগে আনার আরও একটা ব্যর্থ চেষ্টা করতে করতে গজগজ করে হ্যানা, ‘এমন চ্যাটিং এলিয়েন হলিউডও দেখাতে পারেনি।’
‘ওর এফ বি আই ডি-টা নিয়ে নিও হ্যানা। তোমার হাজার একটা বন্ধুর চেয়ে ভালোই হবে ……যত্তসব।’
অন্ধকারেও যেন কাউচের বেঁকে যাওয়া মুখটা দেখতে পেল হ্যানা।
‘আমি এখন তোমার দলে স্যাং। এস.এম.এস পাগল এলিয়েনের ব্যাপারটা একটু বেশি রকমের ওভারডোজ হয়ে যাচ্ছে।’
অন্ধকারে পাঁচটা শরীর পাক খেতে খেতে নেমে যাচ্ছে নিচের দিকে। কালো আকাশের নিচে, আরও কালো পৃথিবী। আর দুইয়ের মাঝের ফ্রি ফলে ভেসে থাকা খাসনবীশের মনে হল তাকে যেন বিশাল একটা ওয়াশিং মেশিনের মধ্যে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে। ওনার শখের প্যারাগ্লাইডিং-এর অভিজ্ঞতা মারাত্মক রকমের ফাঁকিবাজি হয়ে ফিরে আসছে প্রতি মূহুর্তে। ঘাড় ঘুরিয়ে একবার দেখার চেষ্টা করলেন। কালো জাম্পশ্যুটগুলোতে খুব আবছাভাবে চারজনকে দেখা যাচ্ছে। ডিসেকশন টেবিলে আটকে থাকা ব্যাঙের মতো হাত-পাগুলো ছড়ানো সবার।
শরীরটাকে যতটা পারো ছড়িয়ে দাও। উলটো বাতাসের ধাক্কা লাগিয়ে নিজের গতি কমিয়ে আনো। যতটা পারা যায়।
অল্টিমিটারের দিকে তাকালেন – ১০৩ MPH ২১১১ Ft।
‘ও কে গায়েজ, গেট রেডি,’ কানে লাগানো হেডসেটটায় জিমের গলা শোনা গেল, ‘এটা ম্যানুয়ালি করতে হতে পারে আমি পুল বলার সাথে সাথে। দশ নয় আট…….’
কাউন্টডাউন পুরোপুরি শেষও হল না। ঠিক ২০০৩ ফিটে এসে স্যুটের সাথে লাগানো এ.এ.ডি (অটোমেটিক অ্যাকটিভেশন ডিভাইস)-গুলো পিইইং করে একসঙ্গে শিস দিয়ে উঠল। একটা কাপড় ঝাড়ার মতো শব্দ হল। ব্যাকপ্যাক থেকে দলা পাকানো ক্যানোপিগুলো ছুটে গেল ওপরের দিকে। অল্টিমিটারগুলোতে দ্রুত স্পিড কমে আসতে লাগল।
প্যারাসুটগুলো যখন পুরোপুরি খুলল, ততক্ষণে ওরা আরও ৮০০ ফুট নেমে এসেছে।
৫৩ mph….৫২….৫১……….৪৮…
‘আর ইউ ও কে প্রফেসার?’ জিমের গলা শোনা গেল।
‘সেন্ট পার্সেন্ট!’
নিচের ইট-পাথরের অবয়বগুলোর দিকে তাকালেন খাসনবীশ। পৃথিবীটা দুলতে দুলতে তাদের দিকে এগিয়ে আসছে। অন্ধকারে হেলিকপ্টারটাকে আর দেখা যাচ্ছে না। শুধু তার নাক বরাবর নেমে আসা লেজারটা অন্ধকার চিরে নেমে গেছে নিচের দিকে। বুলস আই হয়ে থেমে আছে পাশের একটা ঘাসজমিতে।
পাথরের গর্তগুলোর ওপর না নামাই ভালো। ভাবলেন প্রফেসার।
‘এবার একটু দৌড়তে হবে। একবার না একবার চালু বাস-ট্রেন থেকে তোমরা নেমেছ নিশ্চয়ই! তার আগে গগলসের ডানদিকের বোতামটায় সবাই চাপ দাও।’
বোতামটা চেপে ধরতেই মনে হল যেন অন্ধকারের গায়ে কেউ এক বালতি রেডিয়াম পেইন্ট ছুঁড়ে মারল। তারপর হালকা সবুজ আভায় স্পষ্ট হয়ে উঠল সব কিছু।
ঘাসজমিটা যখন পায়ে ঠেকল তখনও অল্টিমিটার প্রায় ৩ mph-এর ঘরে। পা ছোঁয়ান মাত্র স্বতঃস্ফূর্ত ভাবেই খাসনবীশ কিছুটা দৌড়ে গেলেন। প্যারাসুটটা পুরোপুরি মাটিতে নেতিয়ে পড়লে ছোট্ট একটা লাফ দিয়ে নিজেকে থামালেন প্রফেসার।
‘অল ও কে?’ নিজের ক্যানোপিটা ঠিক করতে করতে পার্কার বললেন, ‘আপাতত এগুলো ইট চাপা দিয়েই রাখা থাক।’
‘আমাদের রিসিভ করতে কি কারও আশার কথা নয়?’ দূরে ভাঙা দেওয়ালগুলোর দিকে তাকিয়ে হ্যানা বলে উঠল।
‘সারাবেরিয়ান?’
‘না, আই মিন পৃথিবীর কেউ?’
উত্তরে পার্কার কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলেন, ঠিক তখনই সবার হেডসেটগুলো একসাথে বেজে উঠল, ‘ওয়েলকাম টু নালন্দা। দ্যা লাইট অফ নলেজ।’
(৭)
(সময় যেখানে থমকে দাঁড়ায়)
জেগে ওঠার সাথে সাথে পিঠের নিচে শক্ত পাথুরে মেঝেটা টের পেল তানি।
ঠাণ্ডা!
তারপর একটু একটু করে চোখ মেলল ও। একটা বিশাল ঘর। কেমন যেন স্যাঁতস্যাতে। প্লাস্টার ছাড়া ইটের দেওয়াল। বাতাসে জল শুকিয়ে যাওয়া আঁশটে গন্ধ।
আমি কোথায়?
ঘরের এক কোণ থেকে আসা কমলা আলোর রেখাটার দিকে তাকিয়ে মনে করার চেষ্টা করল তানি। আলোর উৎসটা এখান থেকে ঠিক দেখা যাচ্ছে না। একরকম গলির মতো বাঁকে বোধহয় আলোটা রাখা।
তানি মাথায় একটু জোর দিল। হালকা চিনচিনে একটা ব্যথা ছড়িয়ে পড়ল মাথা জুড়ে। আর তারপরই বমির মতো হড় হড় করে একটু আগের ভয়গুলো বেরিয়ে এল। একসাথে! তানি চিৎকার করে উঠল।
‘গুড ইভনিং ডিয়ার।’ একটা অদ্ভুত ধরণের ঠাণ্ডা গলা ভেসে এল। তানি চমকে উঠে এদিক ওদিক তাকাল। কেউ নেই!
‘আশা করি তুমি তোমার লম্বা ঘুমটা উপভোগ করেছ,’ কোল্ড স্টোরেজের জমা বরফের ওপর দিয়ে যেন ভেসে আসছে গলাটা। তানি আলোটার দিকে তাকাল। ওখানে?
‘ঠিক ধরেছ। আমি ওখানেই আছি। কিন্তু আমাকে দেখার সময় এখনও আসেনি ডিয়ার। সময় হলেই সব পাবে। স-ব।’
‘সরি? আমি ঠিক বুঝলাম না,’ তানি আর কিছু বলার মতো পেল না।
‘তোমার মনে এখন কিছু প্রশ্ন আসছে ডিয়ার?’
‘আপনি আমাকে নকল করছেন?’ তানি খেয়াল করে ওর ভয়টা হঠাৎ করেই কমতে লেগেছে, ‘না, মানে কথায় কথায় ডিয়ার বলা আমারই একরকম হ্যাবিট।’
‘তোমার কি সত্যিই মনে হয়, তুমি কথা বলছ?’
তানি ব্যাপারটা এতক্ষণে খেয়াল করল।
আরে তাই তো! ‘কিন্তু এটা কিভাবে হয়!…….টেলিপ্যাথি!’
‘কাছাকাছি। তোমার বোঝার জন্য এটা একটু জটিল।’
‘বাবা বলে তুমি যেটা সহজ করে বোঝাতে পারবে না, তার মানে তুমি নিজেও সেটা ঠিকঠাক বোঝ না।’
‘হুম,’ গলাটা একটু ভারি হয়, ‘তোমাদের জাতটা আর কিছু না হোক, কথা বলে দারুণ!’
‘সেটা বোধহয় আপনার না ভাবলেও চলবে।’
‘ভাবতেই আমার আসা ডিয়ার। সারাবেরা গ্যালাক্সি টু প্রোজেক্ট ২২৩, পৃথিবী। পুরো থ্রি হান্ড্রেড লাইট ইয়ারস।
‘ওয়েল, এটা ঠিক টেলিপ্যাথি নয়। আমি শুধু আমার ভাবনাটুকু পাঠিয়ে দিচ্ছি। তোমার ব্রেন সেটাকে নিজের মতো করে সাজিয়ে নিচ্ছে। নিজের ভাষায়। নিজের শব্দে। তাই তোমার কথা বলার স্টাইলের সাথে আমার কথাগুলোর মিল থাকা খুবই স্বাভাবিক। বুঝেছ?’
তানি মাথা নাড়ে। তারপরই খেয়াল হয় সেটা দেখার জন্য সামনে কেউ নেই।
‘তোমরা যেমন অনেকগুলো ভাষায় একসাথে,’ গলাটা তানির মাথার মধ্যে বেজে চলে, ‘মিলিয়ে মিশিয়ে কথা বল, তেমনি শুনছও মিলিয়ে মিশিয়ে।’
‘ওকে!’ তানির ভয়টা হঠাৎ করেই যেন মিলিয়ে গেছে। তেমন অবাকও হচ্ছে না। ওর তো এতক্ষণে আরেকবার অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার কথা।
‘ভয় খুব বাজে জিনিস ডিয়ার,’ গলাটা ওর ভাবনাটুকু সাথে সাথে ধরে নিল, ‘তোমার অ্যাড্রেনালিন আর অ্যামিগডালা দুটোই নিস্ক্রিয় করা আছে।’
টেলিপ্যাথি……… মাইন্ড কন্ট্রোল……..এলিয়েন! উয়াওও, এবার ডেফিনিটলি আমার সেন্সলেস হয়ে যাওয়া উচিত!
‘তোমাদের সব থেকে বড়ো দোষ কী জানো?’ তানিকে চমকে দিয়ে আবারও ওর চিন্তাগুলো গিলে নিল গলাটা, ‘তোমরা নিজেদের শুধুমাত্র মানুষ বলে মনে কর। জাস্ট হাজারটা উপজাতি, তস্য উপজাতিওয়ালা একটা জাত। তোমরা ভুলে যাও তোমাদের বানানো পৃথিবী, মারামারি, খাওয়াখাওয়ির বাইরেও একটা বিশাল পৃথিবী আছে। কখনও ভেবে দেখেছ? বাড়ির কুকুরটা, বেড়ালটা, জানলায় এসে বসা কাকটার কথা কেন বোঝ না? অথচ ওরাও তো কথা বলে। ওদেরও ভাষা আছে…’
তানি কোনও উত্তর দিল না। গলাটা হঠাৎ করেই যেন ক্ষেপে উঠেছে।
‘তোমাদের মস্তিষ্ক যেই একটু উন্নত হল,’ জ্যৈষ্ঠের বিনা নোটিশে আসা কালবৈশাখীর মতো আছড়ে পড়তে থাকে গলাটা, ‘ওমনি তোমরা বাকিদের থেকে বেরিয়ে এলে। তাই তো তোমাদের ব্রেনের মাত্র একভাগ কাজ করে। বাকি তিনভাগের কাজ তোমরা শেখোইনি। পুরোপুরি ঘুমন্ত ওগুলো।’
‘পুরোপুরি?’ তানি কোনওরকমে নিজেকে জড়ো করে।
‘মাঝে মাঝে দু’একটা সেল বাই চান্স অ্যাকটিভ হয়ে যায়। তারপর তোমাদের বোঝার আগেই আবার ডিঅ্যাকটিভও হয়ে যায়। তোমাকে বললে বুঝবে। কোনও দিন কি এমন হয়েছে, যে তুমি হয়তো কারোর কথা ভাবছ, আর ঠিক তখনই সে তোমাকে ফোন করল? বা ধরো আকাশ পরিষ্কার থাকা সত্ত্বেও কী মনে করে বেরোনোর আগে ছাতাটা সঙ্গে নিলে, আর সেদিনই তেড়ে বৃষ্টি এল?’
‘হ্যাঁ, অনেকবার হয়েছে,’ তানি মাথা নাড়তে গিয়েও নাড়ল না।
‘এবার দ্যাখো।’
তানি দেখল ঘরের আলোটা একটু যেন বেড়ে গেল। আর ঠিক তখনই একটা অদ্ভুত রকমের ঝাঁঝালো মিষ্টি গন্ধ পেল ও।
‘গন্ধটা পাচ্ছ? তোমার ব্রেনের একপাশের দুটো সেল শুধু অ্যাকটিভ করেছি। এটা একধরণের ব্যাকটেরিয়ার ডেডবডি পচে যাওয়ার গন্ধ। আলো বা ফোটন কণার টাচে এলেই এরা মারা যায়।’
আলোটা আবার কমে গেল। তানি আর গন্ধটা পেল না।
‘তো…’ তানির নিজেকে বাগে আনতে বেশ কষ্ট হল। ভয়টা কি আবার ফিরে আসছে? ‘তোমরা কারা? কী চাও?’
‘এর অনেকগুলো উত্তর হয়। সহজ উত্তর হচ্ছে আলো। কঠিনটা অন্ধকার।’
‘কোনওটাই বুঝলাম না…’
‘আসলে সবকিছু মার্ক করার জন্য তোমাদের একটা করে নাম দরকার….’
গলাটা থেমে গেল। নীরবতা। তানির পাঁচটা ইন্দ্রিয়ই যেন হঠাৎ করেই জেগে উঠল।
কিছু একটা হতে চলেছে!
প্রথমে মৃদু একটা কম্পন টের পেল তানি। পায়ের নিচের মেঝেটা হালকা কাঁপছে। তারপর সেটা থেমে গেল। নীরবতা। ঘরের আলোটা আবার একটু বেড়ে গেল। আর সাথে সাথেই মেঝে জুড়ে একটা ফাটল ছড়িয়ে পড়ল বিনা নোটিশে। কাঁপা হাতে কেউ যেন একটা বৃত্ত এঁকে চলেছে তানিকে ঘিরে। তানি সরে যাওয়ার চেষ্টা করল। পারল না।
মট মট শব্দটা থেমে গেল। তারপর তানিকে নিয়ে মেঝের ফাটা অংশটা পড়তে শুরু করল। ফ্রি ফল অনুভূতি চড়ে বসল সারা শরীরে।
‘আমি পৃথিবী আর নরকের মাঝে এক সেতু। আমি আলো, আমি অন্ধকার। আমি ক্যারণ।’
(৮)
(২৫ ফেব্রুয়ারি, রাত ১০:৪৩, নালন্দা, বিহার)
আমরা আসলে ইতিহাসের ওপর দাঁড়িয়ে আছি!
একটু আগে ভাবছিলেন খাসনবীশ। সত্যিই তাই। সামনের বিশাল ভাঙাচোরা ব্যাপারটা আসলে মূল নালন্দার দশ পার্সেন্ট মাত্র। বাকি নব্বই এই এখানে মাটির তলায়। ওপরে গ্রাম বসে গেছে। তাই আর খোঁড়া হয়নি। ভোটতন্ত্রের দেশে ভোট ব্যাংক ঘাঁটাতে চায় কে? বিহার সরকারও না, ভারত সরকারও না। তাই ইতিহাস চাপাই থাকে। গাইড শুধু ট্যুরের শেষে শেয়ালের কুমিরছানা দেখানোর মতো করে বলবে, ‘এ যো দিখ রহা হ্যায় সাবলোগ? উ দেখিয়ে উধর গাঁও কা নিচে অ্যাইসে হি থোড়া দাফান হ্যায়। একই হ্যায়। দেখনে যেইসা কুছ নেহি।’
‘অল ক্লিয়ার। আজকের রাতটার জন্য নালন্দা আপনাদের। নো সিকিউরিটি, নো সিসি টিভি।’ হেডসেটের ভেতর থেকে গলাটা আবার ভেসে এল।
‘এক্সকিউজ মি, হু ইজ দিস?’ পার্কার প্রথম মুখ খুললেন, ‘আর এখানেই বা কী করে?’
‘আমি নেটওয়ার্কটা কিছুক্ষণের জন্য ধার নিয়েছি। আপনাদেরই সুবিধার জন্য।’
‘হ্যাকার!’
‘আমি ধার নেওয়া বলতে বেশি পছন্দ করব। আমি নালন্দা দু’বার গেছি। তাই নাসার কন্ট্রোলারের থেকে আমি কাজটা বেশি ভালো করতে পারব। হয়তো।’
‘কিন্তু, কেন?’
‘কারণ, আপনাদের আর আমার লক্ষ্য আলাদা নয়।’
‘সরি?’
‘না আমার এলিয়েন, সারা বেরা ওসব নিয়ে এতটা ইন্টারেস্ট নেই যে তার জন্য নেটওয়ার্ক ট্যাপ করব। কিন্তু……’
গলাটা একটু থামল। তারপর একটু জোর দিয়ে বলল, ‘ওরা তানিকে নিয়ে গেছে।’
‘হোয়াট?’ সবাই প্রায় একসাথে বলে উঠল।
‘তন্ময় তুমি!’ খাসনবীশ এতক্ষণে বুঝতে পেরেছেন, ‘এসব কী বলছ!’
‘তুমি ওকে চেনো?’ কাউচ প্রশ্ন করে।
‘ডেফিনিটলি, আমার স্টুডেন্ট। আর একটা পরিচয় হল, ও তানির…’
‘দাদা,’ ওপার থেকে কথাটা শেষ করে তন্ময়, ‘এবার নিশ্চয় বুঝতে পারছেন, নাসার কন্ট্রোলারের কাছে এটা নিছক ডিউটি হলেও আমার কাছে ডু অর ডাই। এখানে একটা ছোট্ট ভুলও আমাকে সারাজীবন তাড়া করে বেড়াবে। আর, আশা করি আপনাদের ভালোই হেল্প করতে পারব।’
‘আমারও তাই মনে হয়!’ পার্কারের গলায় স্পষ্ট বিস্ময়, ‘এই বয়সে নাসার নেটওয়ার্ক হ্যাক। আই গেস তুমি নালন্দার কন্ট্রোল রুমের নেটওয়ার্কও ট্যাপ করেছ?’
‘হ্যাঁ, ওদের বলা আছে আরকিওলজি ডিপার্টমেন্টের কিছু কাজ আছে। তাই ওদের আসা বারণ…..’
‘উয়াও, সত্যি এই বয়সে……. ফ্যাবুলাস। সব মিটে গেলে তোমার সাথে বসতে হবে।’
‘এক সেকেন্ড। তন্ময় তুমি কীভাবে এতটা শিওর হচ্ছ যে কাজটা সারাবেরিয়ানদেরই? আই মিন কিডন্যাপ বা ওরকম কিছু তো আমাদের এখানে নতুন নয়?’ পোড় খাওয়া জার্নালিস্ট প্রশ্ন তোলে। ডিসকভারির অফিসিয়াল মেইলে রোজ প্রায় ২০০টা এরকম স্প্যাম মেল আসে। কেউ ফ্লাইং সসার দেখেছে, তো কেউ পড়েছে জায়েন্ট স্কুইডের খপ্পরে। এগুলোর মধ্যে সত্যি খবরগুলো বেছে নেওয়ার কাজটা জিমদেরই করতে হয়।
‘কারণ,’ তন্ময় গলাটা ঝেড়ে নিল, ‘সাধারণ গুণ্ডা-বদমাশের পক্ষে টেলিপোর্টেশন করা সম্ভব নয়।’
‘টেলিপোর্টেশান!’ জিমের মনে হল ওর পায়ের তলাটা একটু যেন কেঁপে গেল।
‘আই গেস সো। প্রথমত, বাড়িতে তানি একাই ছিল। আর দরজা ভেতর থেকে লক করা। আমাদের ভেঙে ঢুকতে হয়েছে। বিলিভ মি, ওর বেরোনোর মতো অন্য আর কোনও রাস্তা নেই এই বাড়িতে।’
তন্ময় একটু থামল। আরেকবার গলাটা ঝেড়ে নিল। খাসনবীশের কেন যেন মনে হল তন্ময় কাঁদছিল। হয়তো এখনও কাঁদছে। ছেলেটা বড্ড বেশি চাপা।
‘জানিনা কতটা বিশ্বাস করবেন। তানির ঘরের ফ্লোরের কিছুটা ক্রিস্টালাইজ হয়ে গেছে। আমার ধারণা এটা টেলিপোর্টেশন-এর একটা এফেক্ট।’
‘আনবিলিভেবল!’ ববিপিন করে চুলগুলো বাঁধতে বাঁধতে হ্যানা বলে ওঠে।
ওদিক থেকে দ্রুত কি বোর্ড টেপার আওয়াজ হল।
‘আপনাদের ট্যাবে ছবিটা সেন্ড করলাম। পুলিশ আসার একটু আগে তুলেছি।’
সবাই রিচার্ডের আট ইঞ্চি ট্যাবটার ওপর ঝুঁকে পড়ল। একটুখানি লোডিং হয়ে ছবিটা স্পষ্ট হল। কালো সিমেন্টের মেঝে। অফ ফোকাসে চেয়ার, টেবিলের পায়া, বিছানার চাদর ইত্যাদি দেখা যাচ্ছে। আর ফোকাসে সবুজ পান্নার মতো কী যেন চকচক করছে। প্রায় তিরিশ সেন্টিমিটার মতো রেডিয়াসের সিমেন্ট সবুজ ক্রিস্টালে পরিণত হয়েছে।
‘আসলে টেলিপোর্টেশনে পরমাণুগুলো,’ তন্ময় ব্রিফ দিতে থাকে, ‘ভেঙে গিয়ে যেখানে টেলিপোর্ট করা হবে সেখানে গিয়ে আবার জোড়া লাগে। এখন ভাঙার সময় পরমাণুগুলো কিছুটা হলেও শক্তি ছাড়বে। আর সেটা পাশের পরমাণু, মানে যেগুলো টেলিপোর্ট হচ্ছে না সেগুলোকেও অ্যাফেক্ট করবে। এখন ঠিক কীসে এগুলো হয়েছে আমি ব্যাখ্যা দিতে পারব না। আমি বরাবরই কেমিস্ট্রিতে টেনেটুনে পাশ করে আসছি।’
এই অবস্থাতেও সবাই হেসে উঠল।
‘চ্যাটিং এলিয়েন, প্যারাট্রুপিং, আর এখন টেলিপোর্টেশন। ফরগিভ মি। একদিনেই বড্ড বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে,’ বিড় বিড় করল হ্যানা।
‘অসম্ভব কিছু নয়,’ কোমরের হোলস্টারটা ঠিক করতে করতে পার্কার বলে উঠল, ‘কোয়ান্টাম ফিজিক্সে টেলিপোর্টেশনের কথা বার বার বলছে। নাইনটি এইটে ক্যালিফোর্নিয়ার একটা টিম একটা ফোটন কণাকে তিন ফুট মতো টেলিপোর্ট করতে পেরেছিল। সো নাথিং ইম্পসিবল।
‘ওকে, এ সব নিয়ে পরেও ভাবা যাবে। এবার কাজে নামা যাক। তন্ময়, তুমি আমাদের ডাইরেক্সান বল।’
‘ওকে,’ তন্ময় স্যাটেলাইট ম্যাপটা অন করল। জুউউম… স্টপ।
‘অ্যাটেনশন প্লিজ। একটু এগিয়ে গিয়েই একটা নিচু বাউন্ডারি দেওয়া ওয়াল পাবেন সবাই। নিচুই। আশা করি পেরোতে অসুবিধা হবে না। পেরিয়েই পর পর চারটে লম্বা পাথওয়ে মতো আছে। আমার মনে হয় চারজন চারদিক থেকে গেলে ভালো হয়।’
‘গুড। লেটস গো!’ পার্কার লম্বা লম্বা পা ফেলে এগিয়ে গেলেন, ‘আশা করি সবার কাছে শক গান আছে? সবাই বুঝেসুঝে ব্যাবহার করবেন। আর তানির যেন কিছু না হয়। আই রিপিট, উই নিড তানি উইদআউট এনি কাইন্ড অফ ডার্টি ইনজুরি। রিমেমবার, এটা আর কোনও রিসার্চ টিম নয়। নাউ ইটস আ রেস্কিউ টিম। বোধহয় পৃথিবীর ক্ষুদ্রতম।’
(৯)
(________ )
……একটা অন্ধ করে দেওয়া ব্যথা ছড়িয়ে পড়ছে মাথার কোষে কোষে। কেউ যেন চুলগুলো পেছন থেকে টেনে ধরেছে। প্রচন্ড গতিতে নেমে যাচ্ছে ও। হাত-পা আলগা হয়ে আসছে উলটো হাওয়ার ধাক্কায়।
পড়তে পড়তে শরীরটা মাঝে মাঝে আছাড় খাচ্ছে মেঝের ভাঙা অংশটার সাথে। তার পরক্ষণেই আবার ভেসে উঠছে। আবার আছাড় খাচ্ছে। তার ছেঁড়া একটা লিফটের মধ্যে ও যেন আটকা পড়ে গেছে। সমস্ত চেতনা হারিয়ে যাচ্ছে কালো ঘূর্ণিপাকে। অন্ধকারে।
হঠাৎ, পড়তে থাকা শরীরটা ভাঙা অংশসমেত একটা নরম কিছুর ওপর আছাড় খেল। অন্ধকারগুলো গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে ছড়িয়ে পড়ল। চারদিক ঝলসে উঠল সবুজ আলোয়।
নীচে কী? জল?
ভাবার সাথে সাথেই চারপাশের উপচে ওঠা জল ডুবিয়ে দিল ভাঙা মেঝেটাকে। তানির চোখে মুখে জল লাগতেই ব্যথাটা যেন অনেকটা কমে গেল।
মেঝেটাকে আর দেখা যাচ্ছে না। জায়গাটা অনেকটা আলোকিত সুইমিং পুলের মতো। নিচ থেকে ঠিকরে উঠছে সবুজ আলো। তানি পা দুটো প্যাডেল করার চেষ্টা করল। জলের নিচে হাত পা নাড়ার অনুভূতিটুকু ফিরে এল অনেকদিন পর। তবে সেটা এখন আর ও তেমন এনজয় করতে পারছে না। একটু অক্সিজেনের জন্য ওর ফুসফুস দুটো মাথা ঠুকছে বুকের জেলখানায়। জোরে জোরে কিক মেরে মুখটাকে জলের ওপরে তুলল ও। তারপর পুরোপুরি নিশ্বাস নেওয়ার আগেই আবার ডুবতে শুরু করল। নিশ্বাসের সাথে জল ঢুকে গিয়ে আগুন জ্বেলে দিল মাথার মধ্যে। মাথার পিছনের দিকটা ঝিন ঝিন করে উঠল।
সুইমিং ট্রেনিং-এর পাঁচ বছরের গ্যাপ ডুবিয়ে দিচ্ছে ওকে। ছোটোবেলায় শেখা ফ্রিস্টাইল, আন্ডার ওয়াটার, বাটারফ্লাই সমস্ত কিছু যেন মনে এসেও আসছে না।
সাঁতার একবার শিখলে কেউ ভোলে না।
এই মুহূর্তে বস্তাপচা ডায়লগটাকে ঐতিহাসিক ভুল বলে মনে হচ্ছে তানির!
গায়ের সাথে লেপটে আসা জামাকাপড়গুলো আরও বেশি করে ভারি হয়ে উঠছে। দু’গালে আটকে রাখা নিঃশ্বাসটুকু ঠেলে বেরিয়ে আসতে চাইছে প্রতি মুহূর্তে। তানি দ্রুত ডুবে যাচ্ছে। ও আবারও হাত-পা ছোঁড়ার চেষ্টা করল। কিছুটা ওপরের দিকে উঠে গেল শরীরটা। কিন্তু, এটুকু যথেষ্ট না। ও অনেকটা ডুবে এসেছে।
আর তখনই তানি অন্ধকারটা দেখতে পেল। নিচ থেকে আসা আলো ঢেকে দিয়ে একটা কালো অবয়ব ওর দিকেই এগিয়ে আসছে! সেটা বড়ো হচ্ছে, আরও বড়ো, আরও….। ওর জিনিসটাকে চিনতে ভুল হল না।
সাঁতার জানা মানুষ কখনও ডোবে না। সে যেভাবেই হোক না কেন!
ও ধরে রাখা নিঃশ্বাসটুকু প্রায় পুরোটাই ছেড়ে দিল। এতে করে আরেকটু সময় পাওয়া যাবে। এক সেকেন্ড….দু সেকেন্ড….তারপরই তানি টের পেল ও ওপরের দিকে উঠছে।
ঠিক চার সেকেন্ডের মাথায় মেঝেটা তানিকে নিয়ে আবার জলের ওপরে জেগে উঠল। হাঁপানি রুগীর মতো টেনে টেনে শ্বাস নিল তানি। শীত শীত করছে। কিছুটা জল বমি করে বের করে দিল।
‘ভেরি গুড ডিয়ার।’ ক্যারণের গলাটা আবার ভেসে এল, ‘এই টেস্টটার দরকার ছিল। বিপদের সময় সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়া।’
তানি চারদিকে তাকিয়ে কিছু দেখতে পেল না। সবুজ জলের ধারাটা সরু হয়ে সামনের দিকে এগিয়ে গেছে। আর দু’পাড় জুড়ে জেগে উঠেছে অদ্ভুত এক বন। আসলে বন বললে যার কিছুই বোঝানো হয় না। তার প্রতিটা গাছে, প্রতিটা ডালে, পাতায় খেলা করছে সবুজ আলো! আলোগুলো স্থির নয়। ঢিমে তালে জ্বলা টুনি বালবের মতো কমতে কমতে প্রায় নিভে যাচ্ছে। তার পরক্ষণেই আবার ঝলসে উঠছে গোটা বন।
ভাঙা মেঝেটা জল কেটে নিজে থেকেই এগিয়ে যাচ্ছে। জল কাটার হালকা কল কল শব্দ।
ব্যস, আর কিছু নেই।
তানি ভেজা চুলগুলো মুখ থেকে সরিয়ে পিঠের দিকে ফেলতে গিয়ে অবাক হল। এর মধ্যে চুল শুকিয়ে গেছে! জামাকাপড় কোথাও এতটুকুও জল লেগে নেই। তানির মনে হল একটা জলের ফোঁটা ওর কপালের কাছ থেকে রগ পেরিয়ে নেমে যাচ্ছে। সেটা গড়িয়ে যাওয়ার শব্দও যেন শুনতে পাচ্ছে ও! ঠিক থুতনির কাছের ভাঁজটায় এসে যেন একটু থামল। তারপর তানি আর ওটাকে অনুভব করতে পারল না। শেষতম ফোঁটাটাও উবে গেল। ঠিক অন্যদের মতো!
(১০)
(২৫ ফেব্রুয়ারি, ১১:২৩, নালন্দা, বিহার)
25°08’12″N, 85°26’38″E-এর একটা মন খারাপ করা কালো আকাশের নিচে ভাঙা জিগস পাজলের মতো পড়ে আছে নালন্দা।
অশোক যখন প্রথম বিশ্ববিদ্যালয় শুরু করেন, তখন এত বিশাল ব্যাপারটা ছিল না। এই জাস্ট ছোটোখাটো, শিক্ষা-দীক্ষা নিয়ে একটু পরীক্ষা নিরীক্ষা। দেখাই যাক ছেলে–পিলে টোল ছেড়ে এখানে আসে কিনা! তা এলো। আর এতই পিলপিলিয়ে আসতে লাগল, যে অচিরেই চিঁড়ে ভেজাতে জলের দরকার হয়ে পড়ল! চলো, বাড়াও জায়গা। এক রাজা এল, একটু বড়ো হল। পরের রাজা এল, আরও বড়ো করল। তারও পরের রাজা আরও ক’টা দাগ কাটল। আশপাশের কুড়িটা গ্রাম থেকে এল ছাত্রদের নাস্তাপানি। এই করতে করতে যখন ৬৩৭ নাগাদ হিউ এন সাং এসে নক করলেন, তখন অলরেডি বিশ্বের বৃহত্তম বিদ্যালয় স্বমহিমায় দাঁড়িয়ে, অপেক্ষা করে আছে, আরও কিছুটা পরে বক্তিয়ার খিলজির হাতে ধ্বংস হওয়ার জন্য!
কাউচ খুব সাবধানে নিচের ঘরগুলো পেরিয়ে সিঁড়িটা দিয়ে ওপরে উঠে এল। ওর প্রত্যেকটা পা পড়ছে মিলিটারি ক্র্যাশ কোর্স মনে করে করে। এলোমেলো চুলগুলো প্যারাট্রুপিং-এর ধাক্কায় এখনও খাড়া হয়ে আছে। না, এলিয়েনের ব্যাপারটা এখনও মানা যাচ্ছে না। কিন্তু মেয়েটা গেল কোথায়! সামনের বিশাল ভাঙাচোরা জায়গাটার দিকে তাকাল। নাইট ভিশনে হালকা সবুজ হয়ে জেগে আছে সব কিছু।
নিচের ঘরগুলো আগের রাজাদের। পরে ওগুলো বুজিয়ে, ওর ওপরই আবার বড়ো করে ঘর করা হয়। কাউচ এখন আছে ছাদের লেভেলে। মোটা দেওয়ালগুলো রাস্তার কাজ করছে দিব্যি।
‘ঘরের ছাদগুলো গেল কোথায়?’ নিজের মনেই বিড়বিড় করল কাউচ।
‘কাঠের সাপোর্ট ছিল,’ কাউচ প্রায় লাফিয়ে উঠল। তার পরক্ষণেই কী হয়েছে বুঝতে পেরে দ্রুত সামলে নিল নিজেকে। হেডসেটে তখনও তন্ময় বলে চলেছে, ‘…….আগুন লাগার সময় কাঠ পুড়ে গিয়ে ছাদ ধ্বসিয়ে দিয়েছে।’
‘আগুন?’ কিছুটা নিজেকে সময় দিতেই প্রশ্ন করল কাউচ।
‘হ্যাঁ, বক্তিয়ার খিলজি,’ তন্ময় বলে চলে, ‘এখানে তিনটে বড়ো বড়ো লাইব্রেরি ছিল, ‘রত্নদধি’, ‘রত্নসাগর’, ‘রত্নরঞ্জক’। রত্ন মানে হচ্ছে গিয়ে…. জুয়েল ধরো। ট্রেজার। তো গাধাটা ভেবেছিল এগুলো এখানকার রত্নভাণ্ডার বোধহয়। তারপর এসে যখন কিছু পেল না, তখন আগুন জ্বেলে দিল। খবর পেয়ে অবশ্য প্রায় সব ছাত্র অধ্যাপকদেরই সরিয়ে দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু নালন্দা বাঁচল না। শোনা যায় পুরো তিনমাস ধরে নাকি আগুন জ্বলেছিল। সব শেষ।’
‘ভেরি স্যাড!’
একবার মাথা ঘুরিয়ে বাকিদের দেখবার চেষ্টা করল ও। দুটো পাঁচিল পরে খাসনবীশকে দেখা যাচ্ছে। আর কাউকে দেখতে পেল না। নখগুলো একটু চিবোল। তারপর টেনশন কাটানোর জন্যই যেন জিজ্ঞেস করল, ‘আচ্ছা, এখানে স্কলার ছাড়া এমনি নর্মাল স্টুডেন্টদের পড়তে তো নিশ্চয় প্রচুর খরচ হত?’
‘এখানে শুধু স্কলাররাই পড়ত,’ তন্ময় যেন ইতিহাস খুলে বসে আছে। সব উত্তর যেন ওর আলজিভে জমা আছে। শুধু জিভে আনার অপেক্ষা!
‘মিন?’
‘মানে এখানে আপনি রাজা না ফকির সেটা দেখা হত না। নালন্দার চারটে গেটওয়ে ছিল।’
‘ওদিকের এনট্রানস-টা?’
‘না। ওটা পরে দেওয়াল কেটে বানিয়েছে। প্রধান দরজাগুলোর একটাও পাওয়া যায়নি। হ্যাঁ, তো সেই প্রত্যেকটা গেটে একজন করে প্রফেসর থাকতেন, তাকে বলা হত দুয়ারপাল। সে আপনাকে দশটা প্রশ্ন করবে। টেন আউট অফ টেন হলে, ইউ আর ওয়েলকাম। এক কথায় আপনি লটারি পেয়ে গেছেন। থাকা, পড়া, খাওয়া সব একদম ফ্রি!’
‘উয়াও গ্রেট!’
উত্তরে তন্ময় আর কিছু বলল না। কাউচের মনে হল ছেলেটা আসলে কথা বলে হালকা হতে চাইছে। ওর জুলির কথা মনে পড়ে গেল। কতদিন সামনাসামনি দেখা হয়নি। ওর সোফার হাতলের ওপর বসে চোখ বড়ো বড়ো করে যখন নাসার গল্প শোনে, ফায়ারপ্লেস থেকে কিছু আগুন এসে যেন ধরা দেয় নীল মণির অনেক ভেতরে। কাউচের মনে হয় ওই চোখ দুটো আরেকবার দেখার জন্য ও কবর থেকেও উঠে আসতে পারে। তন্ময়ও নিশ্চয় তানিকে খুব ভালোবাসে।
আমার সাধ্যের মধ্যে থাকলে, আমি সেটা ২০০% করব। মনে মনে ঠিক করে কাউচ।
‘হেই চ্যাম ডু ইউ নো? আই জেলাস উইথ ইউ!’
‘কেন!’ তন্ময় সত্যিই অবাক।
‘আরে এই বয়সে পার্কারের মতো একজনের প্রশংসা! যে সে জিনিস নয়। আজ অবধি আমাকেই একটা ভালো কমপ্লিমেন্ট দিল না!’ নিজেই হাসল কাউচ।
তন্ময় বাকিদের কমিউনেটরগুলো অফ করে দিল। এখন শুধু কাউচই ওর কথা শুনতে পাবে। বড়ো করে একটা নিশ্বাস নিল। তারপর কথার সাথে ফিরতি নিশ্বাসটুকু মিশিয়ে দিতে দিতে বলল, ‘আসলে ওটা আমার কাছে কোনও কমপ্লিমেন্টই নয়। কিছুটা নিন্দা বলতে পারো।’
‘হোয়াট! আর ইউ ক্রেজি?’
‘বলতে পারো। আমি অন্যভাবে ভাবতে ভালোবাসি,’ ওর গলা আগের মতোই শান্ত, ‘উনি বলেছেন, এই বয়সে এত কিছু করা বা জানা সত্যিই খুব বড়ো ব্যাপার। মানে আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে বয়সটা, এগুলো করা বা জানা নয়। আমি যদি আরেকটু বড়ো হতাম তাহলে এগুলো কোনও ব্যাপারই ছিল না! তাই তো? দ্যাট মিনস আমি আমার বয়সটাকে ওভারকাম করতে পারিনি,’ তন্ময় একটু থামল। তারপর আবার বলল, ‘যেদিন লোকে বয়স না দেখে শুধু আমার কাজটুকু দেখবে, সেদিন সত্যি সত্যিই আমি সাকসেস পাব। বয়সের দোহাই দিয়ে আমার ভুলত্রুটিগুলো ইগনোর করে যাওয়া, একরকমের অপমান। লোকে তো আমার কাজটা দেখবে। ওখানে তো আর আমার বয়সটা লেখা থাকবে না।’
কাউচ কী বলবে বুঝে উঠতে পারল না।
‘না, সব মিটে গেলে আমাকেও বসতে হবে দেখছি।’
একবার ঘড়ির দিকে তাকাল।
‘ওয়েল, যতদূর মনে হচ্ছে গোটাটা চেক করতেই রাত কাবার হয়ে যাবে।’
‘হওয়ার তো কথা। শুধু ঘরই আছে ১০০০ মতো। বাকি ৯০০০ অবশ্য এখনও মাটির নিচে। তারপর আছে ক্লাসরুম, মন্দির, স্নানাগার। তুমি…ইয়ে তুমি করেই বলছি। এখন আছ হোস্টেলে।’
‘ইটস অল রাইট। বাট তুমি কি আমাকে দেখতে পাচ্ছ? স্যাটেলাইট থেকে!’
‘ডেফিনিটলি নট। স্যাটেলাইট থেকে ম্যাক্সিমাম লোকেশন অবধি দেখা যায়। আরেকটু জুম করলে হয়তো তোমার মাথাটা ডটেড দেখাবে। আসলে তোমাদের কাঁধে লাগানো মিনি ক্যামেরাগুলোতে একটা করে জিপিএস ফিট করা আছে। ওটা থেকেই তোমাদের ক্যামেরার ভিউগুলোও পেয়ে যাচ্ছি।’
‘উয়াওও। এটাও হ্যাকড!’
‘রেন্টেড…’
‘ওকে ওকে। তন্ময়, আমার যতদূর মনে হয় তুমি এখন VISON 00056-এর স্যাটেলাইট-টায় আছ। তোমাকে যে কোডটা দেখাচ্ছে, সেটা ডিকোড করলে এটাই পাবে। কিন্তু এখন অত টাইম নেই। এটা নাসা আর ইসরোর একটা জয়েন্ট প্রোজেক্ট, আর আমার যতদূর মনে পড়ছে, ওতে একটা থার্মাল ভিউ সিস্টেমও ইনস্টল করা আছে। তুমি একটু ওটা অ্যাকটিভ করার চেষ্টা কর, কিছু হেল্প হলেও হতে পারে……’
***********
নালন্দা থেকে ঠিক ৪০৮ কিলোমিটার দূরে বসে তন্ময় আবার স্যাটেলাইট ভিউটা অন করল। ম্যাক্সিমাম জুম অবধি গিয়ে সাদা-কালো টপভিউটার একটা স্ক্রিনশট নিল। তারপর সেটাকে পাঠিয়ে দিল পাশের ট্যাবে। আরও কিছুটা জুম হল। না, কিছু পাওয়া যাচ্ছে না।
ঘরটা এখনও অন্ধকার। চিলেকোঠার ঘররা বেশি আলো সহ্য করতে পারে না। নিচের ঘরগুলোয় মা-বাবা জেগে আছে। থানা, পুলিস, মিসিং ডায়েরি, খবর জানতে চাওয়া ফোন……… ঘুম আজ এ বাড়িতে আসবে না।
তিন জোড়া চোখ শুধু ভিজবে। দু’জোড়া নির্মম অসহায়তায়, আর একজোড়া স্ক্রিনের নীল আলোর সতর্কতায়।
ওয়ার্ম ক্যামটা অন হতেই নালন্দার পুরো নকশাটা ঢেকে গেল লাল আর হলুদ-সবুজ ছোপ ছোপ দাগে।
যার যেমন উষ্ণতা তার তেমন রঙ। TATS-এর পাঁচজনকে দিব্যি দেখা যাচ্ছে হালকা লালে। কিন্তু সবথেকে বেশি যেটা নজরে পড়ছে সেটা হল বিশাল একটা লাল ছোপ!
‘ও মাই গড!’
তন্ময় স্পিকারটা মুখের কাছে ধরল। বাইরে কোথাও একটা কোকিল ডেকে উঠল। অসময়ে!
***********
‘অ্যাটেনশন প্লিজ,’ দূরে দূরে থাকা পাঁচটা হেডসেট একসাথে ডেকে উঠল, ‘আমি বড়ো মন্দিরটার কাছে একটা বিশাল এনার্জি সোর্স দেখতে পাচ্ছি। আই থিঙ্ক আমাদের সবাইকে ওখানেই যেতে হবে। আমি সবার ট্যাবে……’
কাউচ সামনেই অর্ধেক ভাঙা মন্দিরটা দেখতে পেল। ওখানে কিছু তো একটা হচ্ছেই।
ও হাঁটার গতি বাড়াল। তারপর দৌড়তে শুরু করল।
(১১)
সবুজ জলের ঠিক মাঝখানে ভাসতে থাকা একটুকরো মেঝের ওপর চুপচাপ বসেছিল তানি। ভেলাটা একই ভাবে এগোচ্ছে। আশেপাশের জঙ্গল জুড়ে চলছে আলো জ্বলা-নেভার খেলা। গাছের শিরা-উপশিরা দিয়ে সবুজ জলের আসাযাওয়া দেখা যাচ্ছে স্পষ্ট।
প্লিজ এবার এটা শেষ হোক। ইটস এনাফ…
হঠাৎ সমস্ত আলো নিভে গেল। অন্ধকার। তারপর যেন খুব ভয়ে ভয়ে হালকা একটা কালচে সবুজ আভায় জেগে উঠল জায়গাটা। আলোটা এখন স্থির।
এ সবের মানে কি?
মন দিয়ে ভাবার চেষ্টা করল তানি। সবথেকে মাথা ধরানো আর্ট ফিল্মটার থেকেও এগুলো কয়েক কাঠি ওপরে।
সামনে একটা ডাঙা মতো জায়গা দেখা গেল। তানি উঠে দাঁড়াল। মেঝেটা ডাঙার কাছাকাছি এসেই যেন দূরে যেতে শুরু করেছে। এক মূহুর্ত দেখে নিয়েই লাফ মারল। সেটা তখনও বেশি দূর যায়নি। তানি পাড়ে এসে নামতেই মেঝেটা ডুবে গেল!
তাহলে ওটার ডিউটি এতটুকুই ছিল!
জায়গাটা একটা ছোটোখাটো মাঠের মতো। এখানে গাছপালা-ঘাস কিছু নেই। অন্ধকারে চোখটা সয়ে যেতেই ওর কাছে সব পরিষ্কার হয়ে উঠল। এটা আসলে একটা দ্বীপ। দূরের গাছগুলো থেকে খুব অল্প একটু আলো এসে পড়ছে এদিকে।
এটা আবার কত নাম্বার নরক!
তানি এদিক-ওদিক তাকাতেই কিছু একটা টের পেল। চোখের কোণায় কিছু ধরা দিয়েই সরে গেল যেন। ও সাথে সাথে ঘুরে তাকাল। কিছু একটা এগিয়ে আসছে। অন্ধকারের থেকেও কালো, ধোঁয়ার চেয়েও ঝাপসা।
তানি নড়ল না। পিঁপড়ের একটা ছোটোখাটো দল যেন পিঠ দিয়ে নেমে যাচ্ছে। ঘাম হয়ে!
মাটি থেকে ফুটখানেক ওপরে কিছু একটা নাড়াচাড়া করছে। সবুজ আলো পিছলে পড়ছে তার শরীরে।
ওটা আরও এগিয়ে এল। একজন মানুষ। লোকটাকে ঠিক ঠিক ভাবে চিনতে পারল তানি। একটু আগেই দেখেছে, ওর নিজের ঘরে। ওর জানলার সাথে হেলান দেওয়া বিছানায়। ভয়ঙ্কর চোখদুটো এখন আর দেখা যাচ্ছে না। চোখ বন্ধ।
‘Welcome dear,’ ক্যারণ ডেকে উঠল ওর মাথার মধ্যে।
‘তুমি?…..’ সামনের লোকটার দিকে আঙুল তুলল তানি। লোক বলা বোধহয় ভুল হবে। ভালো করে দেখে বুঝল, ওর বয়সিই একটা ছেলে।
‘না ডিয়ার। ওটা আমি নই। তবে চিনে রাখো। ও আজ থেকে তোমার এবং তোমাদের ঈশ্বর হতে চলেছে। আর মাত্র কিছুক্ষণ।’
কিছুক্ষণ মানে? এটা সিনেমার ট্রেইলার নাকি? হাড্ডাহাড্ডি অ্যাকশনের শেষে একটা লেখা উঠে এসে বলে দেবে, পিকচার আভি বি বাকি হ্যায়! আর কয়েকটা দিনের অপেক্ষা। কামিং সুন! তানির মনে হল ওর মাথাটা বোধহয় ঠিকঠাক কাজ করছে না। সে জন্য ক্যারণের কথা উলটোপালটা মানে বের করছে।
‘তুমি ঠিকই শুনেছ ডিয়ার,’ গলাটা এখন অনেক বেশি জোরালো। কেউ যেন বড়ো হলঘরে দাঁড়িয়ে গলা ছেড়ে চিৎকার করছে।
‘তোমাদের ওই চার হাত, দশ হাতের বা হাতে পেরেক লাগিয়ে ঝুলে পড়া নকল ভগবানের এক্সপায়ার ডেট পেরিয়ে গেছে। এবার তারা শেষ।
‘আরেকটা বিশ্বযুদ্ধ এখন আর হবে না। আমরা আগেও এসেছি। দেখেছি। ভেবেছি তোমরা নিজেদের শুধরে নেবে। হাজার বছর আগে যখন শেষ আসি, তখনও তোমরা এতটা বিগড়াওনি। ধর্মের নামে পাগলামি থাকলেও মানুষে মানুষে বিশ্বাস ছিল। আমরাও তোমাদের বিশ্বাস করেছিলাম। তোমাদের মতো করে থাকতে দিয়েছিলাম।
‘রেজাল্ট? দু’দুটো বিশ্বযুদ্ধ। ওজন স্তরে ফুটো….স্রেফ লোভে পড়ে নিজেদের গ্রহেরই কত কত জীবজগৎ মুছে দিলে! কী, না তোমাদের মস্তিষ্ক একটু উন্নত! তাও যদি পুরোটা হত। ‘মাত্র ৩০০০ বছর আগের একটা ভাষায় বার্তা পাঠিয়েছিলাম। সেটা উদ্ধার করতেই কয়লা হয়ে গেলে!’
তানির মাথা যন্ত্রণাটা আবার শুরু হয়েছে। কথাগুলো এসে ধাক্কা দিচ্ছে ওর সারা শরীরে। ও খুব কষ্ট করেই মুখ খুলল, ‘আমরা মরি, ধ্বংস হই তাতে তোমাদের কী?’ এইটুকু বলেই যেন হাঁপিয়ে গেল তানি। ক্রি ক্রি করে একটা উদঘট শব্দ হল। ক্যারণ হাসছে!
‘ডিয়ার তানি, বল দেখি, একটা বনে ২০টা বাঘ আছে,’ ক্লাস টু-এর বাচ্চাকে অঙ্ক শেখানোর মতো করে শুরু করল ক্যারণ, ‘হরিণ আছে ১০০টা। বাঘ হরিণ খায়, হরিণ পাতা, ঘাস এসব খায়। এখন আমি সব ক’টা বাঘকে সরিয়ে দিলাম। তাহলে কী হবে?’
তানির একটু অস্বস্তি হল। আমি লজিকের ফাঁদে পড়ে গেছি! কোনও রকমে বলল, ‘হরিণগুলো সংখ্যায় বাড়বে। আর ক’দিনেই পুরো জঙ্গলটা খেয়ে ফেলবে।’
‘কারেক্ট!’ ক্যারণের গলায় জ্যাকপট জেতার আনন্দ, ‘ইকোসিস্টেম। বাস্তুতন্ত্র। এবার জঙ্গলটার জায়গায় পুরো ইউনিভার্সটাকে ধরো। মহাকাশেও বিলিয়ন বছরের পুরোনো একটা ইকোসিস্টেম টিঁকে আছে। তোমার আই কিউ এই কনসেপ্ট ধরতে পারবে না। এটুকু বুঝে নাও, একটা চেন অনেক ঘুরে ঘুরে সবকিছুকে লিংক আপ করে আছে। একটা ধ্বসে গেলেই পুরো চেনটাই নড়বড়ে হয়ে যাবে।’
গলাটা থামল। তানি দেখল ছেলেটার পিছনের দিকে আলো জ্বলে উঠল। আলোটা ওপরে উঠছে। ছেলেটার আঁকাবাঁকা ছায়াটা বড়ো হতে হতে যখন তানির পা পর্যন্ত এসে থামল, তখন ও আলোর উৎসটা দেখতে পেল।
একটা মিনি সূর্য যেন। মডেল। ছেলেটার মাথার একটু ওপরে এসে সেটা থামল।
‘আমাদের শরীর নেই। আমরা শক্তি। আমরা আলো, আমরা অন্ধকার। ক্যারণ।’
ভাঙা রেকর্ডের মতো কথাগুলো আবার বেজে উঠল তানির মাথায়।
ক্যারণ। তানি ভাবার চেষ্টা করল। সন্দেহ নেই শব্দটা ওর মেমরি থেকেই এসেছে। ক্যারণের পাঠানো ভাবনাগুলোর হয়তো খুব দুর্বল একটা অনুবাদ। হ্যাঁ, মনে পড়েছে। দাদার কাছে শোনা। দাদার হাজারটা হবির মধ্যে একটা হচ্ছে গ্রিক মাইথলজি। ওই বলেছিল স্টিক্স নদীর মাঝি হল ক্যারণ। গ্রিক মতে স্টিক্স নদী আলাদা করে রেখেছে পৃথিবীর উপরিভাগ আর অন্তরভাগ। পাতাল এবং নরক। আলো ও অন্ধকার।
চমৎকার অনুবাদ! এর চেয়ে ভালো কিছু নাম হতেই পারে না। এই বডিলেস আর একেবারেই লজিকলেস জিনিসটার।
ক্যারণ এতক্ষণ চুপ করে ছিল। এবার যেন হেসে উঠল, ‘লজিকলেস বলে কিছু হয় না ডিয়ার। যুক্তি ছাড়া আমরা কিছু বুঝি না। আমাদের সিস্টেমেও নেয় না। অনেক অনেক আগে আমাদের পূর্বপুরুষরা এই তোমাদের মতো নানান যুক্তিহীন জিনিস নিয়ে ভাবনাচিন্তা করে সময় নষ্ট করত। পরে আমরা নিজেরাই এর পরিবর্তন আনি। এখন আমরা চাইলেও যুক্তিহীন কিছু করতে পারব না। সিস্টেম বিট্রে করে বসবে। আমরা লজিক থেকে শক্তি পাই। সে নিজের হোক কি অন্যের। এখন যেমন তোমার চিন্তাভাবনা থেকে পাচ্ছি।’
তানির সারা গা শিরশির করে উঠল। অর্ধেক বোঝা কথাগুলো যেন চারদিক থেকে ছেঁকে ধরল ওকে। আলোটা যেন আরও বেড়ে গেছে।
‘এই শরীর না থাকাটাও একটা সমস্যা এখানে। এভাবে তোমাদের মতো শরীরসর্বস্ব জীবের ভগবান হওয়া মুস্কিল। তোমাদেরও মাটি পাথরের হাত-পাওয়ালা ঈশ্বর দেখে দেখে অভ্যাস। তাই একটা শরীরের দরকার। এ হবে আমার ছায়া, আমার রেখে যাওয়া জ্যান্ত ভগবান।’
তানি ছেলেটার দিকে তাকাল। সেই থেকে একই ভাবে দাঁড়িয়ে আছে। কোনও সাড় নেই। বুকের ওঠানামা নেই। শুধু পোড়া কাঠের একটা ছায়া।
‘কিন্তু এখানেও আরেকটা সমস্যা আছে। ওর সব আছে। শরীরে যথেষ্ট শক্তি, প্রকৃতিকে চেনার ক্ষমতা, ষষ্ঠেন্দ্রিয়। আমাকে শুধু ওর মাথার চারটে অংশই অ্যাকটিভ করতে হবে। বললাম না, তোমরা নিজেরাও জানো না তোমাদের ব্রেন একেকটা ম্যাজিক বক্স। টেলিপোর্টেশান, টেলিকাইনেসিস, টেলিপ্যাথি, হিপনোটিজম…. কী হয় না! জানলে খুশি হবে তোমাকে এখানে আনার সময় প্রায় কিছুই করতে হয়নি। জাস্ট তোমার ঘুমন্ত কয়েকটা সেল-কে দু’সেকেন্ডের জন্য জাগিয়েছিলাম। বলা যায় তুমিই আমাকে লিফট দিয়েছ!’
ক্যারণ একটু থামল। তানি আপ্রাণ চেষ্টা করছে মাথায় যেন কোনওরকম চিন্তা না আসে। ওর ভাবনাচিন্তা সবকিছু চলে যাচ্ছে ক্যারণের দখলে। শক্তি হয়ে!
‘কিন্তু ওর যেটা নেই, সেটা হল আই কিউ! সারা পৃথিবীর ডাটা ধরার মতো ব্রেন স্ট্রাকচার ওর নেই,’ ক্যারণ আবার শুরু করে, ‘ব্রেন স্ট্রাকচার ডেভেলপমেন্টের জন্য ছোটো থেকে অনুশীলন দরকার। অঙ্ক প্র্যাকটিস, এমনকি আঁকা গান যে কোনও ধরনের ক্রিয়েটিভ এক্সারসাইজ। ওর সেটা নেই। তোমাদেরই বানানো সমাজ। একদল পড়তে বিদেশ ছুটছে। আরেকদল পাঠশালা অবধিও পৌঁছচ্ছে না। অকাট মূর্খ। সো আই নিড ইওর আই কিউ। জন্ম থেকে এখন অবধি হয়ে আসা সমস্ত স্মৃতি, লজিক সব। এটা একধরনের মেমরি চার্জার সিস্টেম বলতে পারো।’
তানি আর নিজেকে ধরে রাখতে পারল না। ওর সমস্ত কিছু দিয়ে চিৎকার করে উঠল। আর সাথে সাথেই মনে হল, সামনের দৃশ্যগুলো যেন ছিঁড়ে দু’ফাঁক হয়ে যাচ্ছে। আগের সেই গুহা মতো ঘরটা দেখতে পেল এক ঝলক। এখন আর ঘরটার ছাদ নেই। ও ভাসতে ভাসতে ওপরের দিকে উঠে যাচ্ছে।
‘তানি…..’ বালিশ চাপা দেওয়া একটা গলা যেন ডেকে উঠল দূর থেকে। ও সাড়া দিতে চাইল। পারল না।
কয়েক মুহূর্ত মাত্র। পরক্ষণেই ছেঁড়া অংশটা আবার জুড়ে গেল। আবার দূরের কালচে সবুজ বন, হবু ঈশ্বরের মাথায় জ্বলতে থাকা ক্যারণ!
আমি আসলে এখানে নেই। এর কোনওটাই সত্যি নয়। চিন্তাটা যেন গিলে খেল তানিকে। ওর হাতের তালুগুলো ঘেমে উঠল। মাথার শিরা ফেটে পড়বে যেন।
‘দৃশ্যগুলো শুধু মিথ্যে ডিয়ার,’ ক্যারণ বলে উঠল, ‘কারণ তোমার শরীর তোমারই কাছের কয়েকজনকে সরিয়ে দেবে। ওসব তোমার না দেখাই ভালো। মৃত্যুর অভিজ্ঞতা অনেকসময় আই কিউ-তে এফেক্ট করে। ইমোশন খুবই বাজে জিনিস। তোমার আই কিউ-র তো কিছু হতে দিতে পারি না।’
‘ওরা কারা?’
‘যারা আমার সম্বন্ধে জানতে চায় আর আমার পথে বাধা হলেও হতে পারে।’
‘TATS!’
‘রাইট। ওরা তোমার হাতেই ফুরিয়ে যাবে। তুমি টেলিকাইনেসিস করতে চলেছ প্রথম ও শেষবারের মতো। তুমি হবে ঈশ্বরের প্রথম সেবক। আর ওরা নতুন পৃথিবীর অল্প কিছু শহিদ….’
(১২)
(২৫ ফেব্রুয়ারি, ১১:৩১, নালন্দা)
গতকালের দিনটাই ছিল সহজতম দিন।
নেভি শিলের পুরনো ফ্রেজটা মনে পড়ে গেল কাউচের। একটা ইটের গম্বুজ মতো কিছুর গার্ড নিয়ে শুয়ে আছে ও। এটা আসলে একটা কবরস্থান। দূর থেকে পড়তে আসা বা পড়াতে আসা ছাত্র অধ্যাপকদের মধ্যে কেউ মারা গেলে এখানেই কবর দেওয়া হত। যার যা সম্মান সেই অনুযায়ী জ্যামিতি পেত তার ওপরের ফলক। গোল, চৌকো, লম্বা…
কাউচ হালকা করে মাথা তুলল। দূরের ভেসে থাকা অবয়বটা এক ঝলক দেখা গেল। আর ঠিক তখনই একটা আস্ত ইট ছুটে গেল ওর কান ছুঁয়ে। ও মাথা নামিয়ে নিল।
সহজ সময় সত্যিই পেরিয়ে গেছে। আমরা অতীতে বাঁচি না। ভবিষ্যৎ তো আরওই কিছু না। আমরা বাঁচি বর্তমানে। বর্তমানে হাসি, বাস্তবে কাঁদি। লড়িও সেই বর্তমানে।
কট্টর বর্তমান এখন ইট হয়ে উড়ে বেড়াচ্ছে। এই ভাঙা ইতিহাসের প্রতি ইঞ্চি আকাশে। প্রত্যেক নোনা ধরা বাস্তবে। শিকারের খোঁজে। শিকারি হয়ে।
যখন কাউচ প্রথম এসে পৌঁছল, তখনও এই সব কিছুই শুরু হয়নি। বড়ো মন্দিরের একপাশের ইট সরতে লেগেছিল সবে। যেন অ্যাটেনশন ভঙ্গিতে সরে গিয়ে পোড়ামাটির ঢেলাগুলো জায়গা করে দিচ্ছিল ভেতরের আলোটাকে।
তারপরই, ইট সরে যাওয়া গর্তটা দিয়ে ভেসে উঠল তানি। হ্যাঁ তানি। কাউচের ওকে চিনতে অসুবিধা হয়নি। ওদের কোর ফাইলে ছবিটা দেখেছে অনেকবার। ওর পা দুটো মাটি থেকে প্রায় ১০ ফুট ওপরে। ভাসছিল। ভাসছিল ওর তিনদিক ঘিরে থাকা আলোর বলগুলো।
বাকি চারজনও জড়ো হয়েছিল একে একে। স্পিকারের ওপার থেকে তানির নাম ধরে চিৎকার করছিল তন্ময়। ও আর নিজেকে ধরে রাখতে পারেনি। পাঁচটা ক্যামেরা দেখাচ্ছে ওর বোন বাতাসে ভেসে আছে। আশেপাশে খেলা করছে মিনি সূর্যের মতো দেখতে তিনটে আলো।
হঠাৎ তানি হাত দুটো ওপরে তুলল। আর তারপরই ব্যাপারটা শুরু হল। ধ্বংসস্তূপ থেকে শ’য়ে শ’য়ে ইট উঠে আসতে লাগল শূন্যে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই সেগুলো ওদের লক্ষ করে ছুটে এল।
সবাই একেকটা করে গার্ড জুটিয়ে নিয়ে পজিশন নিয়েছে। কিছুক্ষণ আগে পার্কারের কয়েকটা সাবধানবাণী এসেছে। এখন সবাই শান্ত। একা। কেউ জানে না এরপর কী করতে হবে….
করতে তো হবেই…
কাউচ দ্রুত চিন্তা করে নিল। প্রথমে একটু কিন্তু কিন্তু হল। তারপর সেটাকে পায়ের তলায় রেখে হেডসেটটা অন করল।
‘তন্ময়, আর ইউ ওকে?’
‘হ্যাঁ ঠিক আছি,’ ওদিকের আওয়াজটা যেন ভাঙা ভাঙা।
‘লিসেন, এভাবে বসে থাকলে কিছু হবে না,’ কাউচ ওর ডান কাঁধ থেকে ক্যামেরার ক্লিপটা খুলে নিল, ‘আমি মাথা তুলতে পারছি না। তোমাকে এবার আমার চোখ হতে হবে।’
‘আমি তোমার ট্যাবে ফুটেজ পাঠাব?’ তন্ময় খেয়ালও করল না যে কখন যেন ও কাউচ কে তুমি বলতে লেগেছে।
‘না অত সময় নেই। যা করার এক্ষুনি করতে হবে,’ কাউচ ক্যামেরা ধরা হাতটা পেরিস্কোপের মতো করে উপরে তুলল।
৪০৮ কিলোমিটার দূরে বাকি ক্যামেরাগুলো মিনিমাইজ করে তিন নম্বরটাই ফোকাস করল তন্ময়। এখন ও নিজেকে অনেকটাই সামলে নিয়েছে। তানি ভেসে আছে এখনও। হাত দুটো ব্রাজিলের যিশুর মতো করে দু’দিকে তোলা।
‘হ্যাঁ, দেখতে পাচ্ছি। তানি এদিকে পিঠ করে আছে।’
‘ওকে, ডিস্ট্যান্স?’
‘২০ মিটার মতো। ত্রিশও হতে পারে।’
‘শিট। এখান থেকে হবে না।’
‘কী?’
‘সামথিং শকিং।’
কাউচ কোমরের ডুয়েল হোলস্টার থেকে রাইসম এক্স 1 -এর শর্ট গানটা বার করে আনল। এটা একটা ভোঁতা মুখের মাল্টি ফাংশনাল স্টান গান। ওটার মুখে একটা কালো প্রবস লাগানো আছে। এইরকম পিঙ্ক, হোয়াইট নানারঙের প্রবস হয়। একেকটার ফাংশন, শক রেঞ্জ একেক রকম। ও কালো প্রবসটা খুলে নিল। এটা ক্ষতিকর হতে পারে। তারপর তার জায়গায় একটা ইয়েলো প্রবস সেট করল।
গান চেকড!
ও বুকে ভর দিয়ে কিছুটা পিছিয়ে এল। গম্বুজটা এখনও ওকে আড়াল করে রেখেছে। আরেকটু। এবার তানিয়ার মাথাটা দেখা গেল। কাউচ থামল কিছুক্ষণ।
‘তুমি কী করতে চাইছ?’ তন্ময়ের গলায় স্পষ্ট বিস্ময়।
‘তেমন কিছু না। হাজার হাজার স্কলাররা যে পথে হেঁটেছে সেটা দিয়ে একটু হাঁটব ভাবছি।’
ঠিক বাঁ পাশের নিচের দিকে একটা ঘর দেখতে পেল কাউচ। ডান পা’টায় চাপ দিয়ে শরীরটাকে একটা ভল্ট দিয়ে ঘরের কিনারার কাছে নিয়ে গেল। তারপর পাঁচিল থেকে লাফিয়ে পড়ল ঘরের ভেতরে।
ঘরটা ছোটোই। একটা বেদি, প্রদীপ রাখার জায়গা আর ছাদ থেকে ঢালু হয়ে নেমে আসা ভেন্টিলেটর। সামনে বাইরে যাওয়ার দরজা। তারপর একটা ছাদ ছাড়া লন টানেলের মতো সামনের দিকে চলে গেছে।
কাউচ লন ধরে এগোতে লাগল। মাথার অনেকটা ওপরে তারার মতো ভেসে আছে টুকরো টুকরো ইট। একবার পড়তে লাগলে স্যাং কাউচের ইতিহাস হতে এক সেকেন্ডও লাগবে না।
‘তন্ময় আমাকে পজিশন বল। তুমি কি ওকে দেখতে পাচ্ছ?’
‘হ্যাঁ, থার্মাল সাইটটায় ওকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। ওই লাইট বলগুলো হিউজ পরিমাণের হিট রিলিজ করছে। তুমি ওখান থেকে লেফট নাও…’
বাঁকটা ঘুরতেই তানিকে দেখতে পেল কাউচ। একইভাবে বাতাসে ভেসে আছে। চোখ দুটো বন্ধ। এক মুহূর্তের জন্য জুলির বড়ো বড়ো চোখগুলো ভেসে উঠল। ওর গল্প চাই, যে গল্প বইতে থাকে না।
এই গল্পটা তোর জন্য জুলি।
কাউচ স্টানগানটা তুলল। ট্রিগার টিপতেই হিসসস করে তার সমেত ইয়েলো প্রবসটা ছুটে গেল তানির দিকে। পেন হয়ে, একটা নতুন গল্প লিখতে…….
(১৩)
তানির মনে হল কেউ যেন ওকে ধরে প্রচণ্ড জোরে একটা ঝাঁকুনি দিল। একটা ঝিনঝিনে ব্যথা পিঠ থেকে ছড়িয়ে পড়ল সারা শরীরে। বাজে পিকচার টিউবওয়ালা টিভির মতো সমস্ত দৃশ্যটা যেন কেঁপে উঠল। তারপর সমস্ত কিছু অন্ধকারে মিলিয়ে গেল।
নিকষ কালো অন্ধকার…
হঠাৎ তানি টের পেল ও চোখ বন্ধ করে আছে। আরে ঠিকই তো! ও সাথে সাথে চোখ মেলল। প্রথমটায় কিছু বুঝতে পারল না। একটা ভাঙা মতন জায়গা। কয়েকজন ছায়া ছায়া মানুষ। ওরা অনেকটা নিচে। আর ঠিক তখনই খেয়াল করল ওর পায়ের অনেকটা নিচে মাটি দেখা যাচ্ছে। আমি ভেসে আছি! আর তিনটে আলো তিনদিক থেকে ঘিরে আছে ওকে। তিনজন ক্যারণ!
‘তানিইই…’
নিচ থেকে একটা গলা উঠে এল।
‘দাদা!’
‘তানি, ভয় পেও না। আমরা…’ খাসনবীশ স্যার!
এটা TATS-এর টিম! তানি কিছু একটা বলার জন্য মুখ খুলল। পারল না। মাথার যন্ত্রণাটা আবার ফিরে এসেছে। লক্ষ লক্ষ ছারপোকা যেন চেটেপুটে সাফ করে দিতে চাইছে মাথার সমস্ত ঘিলু। চুলগুলো গোড়া থেকে উপড়ে আসতে চাইছে যেন।
চোখের পাতায় প্রচণ্ড জ্বালা অনুভব করল তানি। মাথার রগ দুটো চেপে ধরে চিৎকার করে উঠলো ও।
কেউ যেন জোর করে ওর চোখ দুটো বন্ধ করে দিতে চাইছে। তানি আর কিছু দেখতে পাচ্ছে না। ও দেখল না, ওর চিৎকারের সাথে সাথে হাওয়ায় ভেসে থাকা সমস্ত ইট পড়তে শুরু করেছে। ও জানল না শেষ মুহূর্তে সরে গেলেও একটা ইট প্রচণ্ড জোরে আঘাত করেছে একজনের বাঁ কাঁধে। আর ও জানল না একটু আগে কাউচের স্পিকার থেকে চিৎকার করে ওঠা ওর দাদা চারদিক থেকে এখনও ওর দিকে তাকিয়ে আছে। অসহায় ভাবে।
মাটি থেকে দশ ফুট ওপরে ভেসে থেকে আবার চোখ বন্ধ করল তানি।
অন্ধকারে পুরোনো দৃশ্যগুলো ফিরে এল। ছেলেটার মাথার ওপর দ্বিগুণ তেজে জ্বলে উঠেছে ক্যারণ। তার তেজ বাড়ছে। ওদিকে আর তাকানো যাচ্ছে না। বাতাস ভরে উঠছে মৃত ব্যাকটেরিয়ার ঝাঁঝালো গন্ধে।
হাত দিয়ে চোখ দুটোকে আড়াল করল ও।
‘এবার এটা শেষ করার সময় হয়েছে,’ ক্যারণ চিৎকার করে উঠল মাথার মধ্যে।
হুট করে কোথা থেকে সাদা আলোর ঝাঁক ভেসে এল। কেউ যেন একটা বিশাল ইরেজার দিয়ে মুছে ফেলল সব কিছু।
একেই কি হোয়াইট আউট বলে?
নিজের ছায়াটুকুও দেখতে পেল না তানি। তারপর কোত্থেকে যেন গুঁড়ো গুঁড়ো অন্ধকার এসে সামনে জমাট বাঁধল। ওগুলো একটা আকার নিচ্ছে। থ্রিডি পাজল যেন খাপে খাপে লেগে দ্রুত তৈরি হচ্ছে। সেই ছেলেটা। সে আর স্থির নেই। এগিয়ে আসছে তানির দিকে।
‘সময় হয়ে গেছে,’ আবার গমগম করে উঠল ক্যারণের গলা, ‘মহান কাজের জন্য সামান্য কিছু ক্ষতি।’
তানি বেশ বুঝতে পারছে আসলে সব শেষ। ছেলেটা অনেকটা এগিয়ে এসেছে। ওর গায়ের বন্য গন্ধ নাকে যেন আগুন ধরিয়ে দিচ্ছে। তানি পিছিয়ে যেতে চাইল। কিন্তু তার আগেই শক্তপোক্ত একজোড়া হাত দু’পাশ থেকে এসে চেপে ধরল মাথাটা। হৃৎপিন্ড যেন গলার কাছে উঠে এল।
‘এক….দুই….তিন…..’ একটা ঘড়ি যেন টিক টিক করে কোথাও এগিয়ে চলেছে। কিছু হবে। এক্ষুনি হবে….
ছেলেটা চোখ মেলল। চোখের জলে কেউ যেন দু’ফোঁটা সবুজ গুলে রেখেছে। পুরোনো ভয়গুলো দ্বিগুণ হয়ে ফিরে আসছে তানির মধ্যে। অ্যাড্রেনালিন বমি করে ভরিয়ে তুলছে সারা শরীর।
চোখদুটো বড়ো হচ্ছে। তানির সমস্ত সত্তা ঢেকে যাচ্ছে সবুজ অন্ধকারে।
বন্দি অবস্থাতেই প্রচণ্ড একটা ঝাঁকুনি খেল তানির শরীর। তারপর তুলোভরা পুতুলের মতো নেতিয়ে পড়ল, এক পৃথিবীরই অন্য দুই হাতের মাঝে…….
(১৪)
(১১:৪৭ ভারত, কলকাতা)
পাশের বোতলটা থেকে একটু জল নিয়ে চোখে ছেটাল তন্ময়। জ্বালাটা একটু যেন কমল। ও ঘণ্টা দু’য়েকের বেশি কখনওই ল্যাপটপের সামনে বসতে পারে না। তাই আবার অন্ধকারে!
একবার ভাবল টিউবটা জ্বালবে। পরক্ষণেই সেটা বাতিল করল। অন্ধকার অনেক কিছু ঢেকে দেয়। পাওয়া না পাওয়া সব কিছু।
ট্যাবের ওপরের শাটার নামিয়ে ব্লু লাইট ফিল্টারটা অন করে দিল। এক ঝটকায় স্ক্রিনের ব্রাইটনেস কমে গেল অনেকটা।
কাউচের ক্যামেরার ফুটেজ দেখা যাচ্ছে। হ্যানা ঝুঁকে পড়ে ওর হাতটা দেখছে এখন। আর বিড়বিড় করে কী সব যেন বলছে। আমি ঠিক আছি মার্কা কিছু একটা বলল কাউচ। উত্তরে চোখ বড়ো বড়ো করে হ্যানা ধমক দিল। পার্কারও মেডিকেল কিট বের করতে করতে কিছু একটা বললেন….
কানে কিছুই যাচ্ছে না তেমন। নিজেকে হঠাৎ করে হেরে যাওয়া মানুষ বলে মনে হচ্ছে তন্ময়ের। যারা শুধু অজুহাত তৈরি করে। সেই সময় বাড়ি না থাকার অজুহাত, নিজের বোনকে বাঁচাতে না পারার অজুহাত…..
হ্যানার কাঁধের ওপর দিয়ে তানিকে দেখা যাচ্ছে। সুতোয় বাঁধা গ্যাসবেলুন যেন। হাওয়া দিলেই উড়তে চাইবে। হয়তো যাবেও। ওড়ার জন্য বোধহয় অজুহাত লাগে না।
আচ্ছা, ঠোঁট দুটো কি নড়ল?
তন্ময় ট্যাবের ওপর ঝুঁকে এল। জুম…….১০ ইঞ্চির স্ক্রিন জুড়ে তানির মুখটা ভেসে উঠল। প্রচণ্ড যন্ত্রণায় যেন সেটা কুঁচকে গেছে। হ্যাঁ, ঠোঁট নড়ছে। কথা বলার জন্য রীতিমত লড়াই করতে হচ্ছে তানিকে।
কথাগুলো বুঝতে তেমন বেগ পেতে হল না। এই খেলাটায় তানি তন্ময়কে ১০০১ বার হারিয়েছে। লিপ রিডিং করে গেস করতে হবে কী বলা হচ্ছে।
তন্ময় এবার জিতে গেল। ঠিক ঠিক ধরে ফেলল কথাগুলো। ছায়াবাজি! এই সময় ল্যাপটপের দিকে চোখ গেল ওর। বিশাল লালচে বিন্দুটা ছোটো হতে লেগেছে আচমকাই!
তানি লড়ছে! ওদের বিরুদ্ধে তানি লড়ছে।
তন্ময় এটুকু বুঝল এটা আসলে একটা মানসিক যুদ্ধ। ওকে নিজেকেই লড়তে হবে।
কিন্তু যুদ্ধটা কি সত্যিই ওর একার? বাকিদের কিছুই কী করার নেই! একটু মেন্টাল সাপোর্ট?
ও ওর মোবাইলে চৈতালীর নাম্বারটা খুঁজতে খুঁজতে প্রায় চেঁচিয়ে উঠল, ‘কেউ নিজের স্পিকারটা লাউডে দেবেন? প্লিজ?’
(১৫)
‘বলছি তো আমার ভাত খেতে ভালো লাগে না। পচা খাবার।’
বিছানার ওপর তানি কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। মাঝবেলার ছাপোষা রোদটুকু এসে পড়ে ওর ঝুঁটি বাঁধা চুলে। আলোর ফুল হয়ে ফুটে থাকে ফোলা ফোলা দুই গালে, দুই চোখের মাঝে নাকের শর্টকাটে।
‘ও দিদিভাই। রোজ রোজ ভালো লাগে না কিন্তু,’ ঠাম্মা এগিয়ে আসে। অল্প কিছু সাদা চুল কাশ ফুলের মতো দোল খায় ফ্যানের হাওয়ায়, ‘এই বয়সে এত দৌড়াদৌড়ি কি পারি! লক্ষ্মী সোনা আমার খেয়ে নাও। নইলে দাদাই খেয়ে নেবে কিন্তু।’
‘দাদাই তো ইচকুলে।’
‘ও বাবা! আচ্ছা গল্প শোনাব না কিন্তু তাহলে।’
‘শুনিও না যাও,’ তানি ঠোঁট ফোলায়। গালের কাছে লেগে থাকা ভাতটুকু টুপ করে খসে পড়ে। তারপর থালায় এসে মিশে যায় অন্য ভাতদের দঙ্গলে।
‘আচ্ছা ঠিক আছে,’ ঠাম্মা আরও এগিয়ে আসে। তারপর তানির নাকে নাক ঠেকিয়ে ফিস ফিস করে বলে, ‘আইসক্রিম খাওয়াব।’
‘প্রমিচ?’
‘প্রমিস প্রমিস প্রমিস,’ ঠাম্মা নাকটা আদর করে ঘষে দেয়। তানি ঠাম্মাকে জাপটে ধরে।
‘ওরে ছাড় ছাড়। পড়ে যাব তো।’
তানি ছাড়ে না। আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরে। সাদা থানে মিশে থাকে ঠাকুমা ঠাকুমা গন্ধ। আর গন্ধের সাথে মিশে থাকা এক মেয়েবেলার গল্প। যেখানে দু’সেট খেলনাবাটি থাকলেও নিজেকে বিশাল বড়োলোক ভাবা যেত। মার্বেল কমিক্সের সাথে দু’প্যাকেট স্বপ্ন ফ্রি পাওয়া যেত এমনিই!
ঠাকুমা আরও কত কী যেন বলে যায়। হো হো করে হাসে। ঘরের রোদটা যেন বড়ো হয়। উজির প্রোমোশন পায় রাজার সিংহাসনে।
তখনই একটা টান অনুভব করে তানি। ঠাম্মা পিছিয়ে যাচ্ছে। ও আরও জোরে ঠাম্মাকে ধরতে যায়। পারে না। বছর তিনের ছোট্ট হাত আলগা হয়ে পিছলে যায় এক সময়। একটা কালো ছায়া টেনে নিয়ে যায় ঠাম্মাকে। ও ছায়াটাকে চেনে। খুব ভালোভাবে চেনে।
পুরো ঘরটা যেন সস্তা দামের কর্পূর হয়ে উবে গেল। আগের চারবারের মতো টুকরো টুকরো হয়ে হারিয়ে গেল পাঁচ নম্বর স্মৃতিটাও। নিমেষেই। তারপর প্রচণ্ড গতি নিয়ে শরীরটা ছুটতে শুরু করল। একটা লম্বা টানেলের মধ্যে দিয়ে কেউ যেন টেনে নিয়ে যাচ্ছে। দু’দিকে ছুটে চলা অন্ধকার। মাঝে মাঝে ফুটপাতের জংলি ফুলের মতো ফুটে থাকা টুকরো টুকরো স্মৃতি। মস্ত বই-এর মাঝে বুক মার্ক হয়ে ফুটে উঠছে মনের পর্দায়। পরক্ষণেই আবার মিলিয়ে যাচ্ছে। সবই ক্ষণিকের জন্য।
ক্লাসের লাস্ট বেঞ্চের ডেস্কের নিচে লুকিয়ে শুকতারা পড়া। কিছু একটা সন্দেহ করে চটি ফটফটিয়ে অনি ম্যাডাম ছুটে আসে। তাড়াহুড়ো করে লুকোতে গিয়ে শুকতারাটা পড়ে যায়। মাটিতে পড়ার আগেই একটা কালো হাত এসে লুফে নেয় সেটা। তারপর হাতটা ধেয়ে আসে তানির দিকে। হিড় হিড় করে টেনে নিয়ে যায় অন্ধকার টানেলে।
আরও একবার। আরও একটা স্মৃতি চলে গেল অন্য কারোর দখলে।
আবার অন্ধকার। ছুটে চলা। ষোল বছরের ধুলো সরে গিয়ে ভেসে উঠতে থাকে টুকরো টুকরো আলোছায়া। সাদা-কালোয়, হলুদে-সবুজে। হিপ্পোক্যাম্পাস ভুলে বেরিয়ে আসে একেকটা মূহুর্ত।
বৃষ্টি ভিজতে ভিজতে এগিয়ে আসা চৈতালীর মুখ। হাত ছুট উড়ে যাওয়া হলুদ ছাতা, গলির ক্রিকেটে কাচ ভেঙে দাদার পালিয়ে যাওয়া….
তানি বোঝে, সব এখন অন্য কারোর। হয়তো অন্ধ পৃথিবীর অদরকারী কিছু ব্লু প্রিন্ট। সব কিছু হারিয়ে যাচ্ছে। ক্লাস টেন অবধি হয়ে আসা হাসিকান্না, মনের মধ্যে লুকিয়ে রাখা অভিমান। সব। ও বোঝে এই অন্ধকার, এই ছুটে চলা টানেলের জন্ম ওরই মনের গভীরে। হাওয়ায় আজ খাতা খুলে গেছে। পেনটা শুধু অন্য কারোর হাতে।
চারদিক থেকে একটা চাপ অনুভব করল তানি। আমাকে কি কেও ধরে রেখেছে?
ঠিক তখনই অন্ধকার আবার আকার নিতে লাগল। তানি একটা টেবিলে বসে আছে। সামনে কী একটা বই খোলা। তানির সেটা পড়তে ইচ্ছে করল না। গুন গুন করে গান ভেসে আসছে পিছন থেকে, ‘তারার পানে চেয়ে চেয়ে…নাই বা আমায় ডাকলে…’
মা! তানির হঠাৎ করে খুব কান্না পেল। এটাও হারিয়ে যাবে!
মা অন্য একটা গাও না, নিজের মনেই ভাবল তানি।
‘একদিন যারা মেরেছিল তারে গিয়ে
রাজার দোহাই দিয়ে…….’
তানি সত্যিই অবাক হল। স্মৃতি তবে পালটানোও যায়!
হালকা হালকা হাওয়া দিচ্ছে। জানলার কাছে রাখা রজনীগন্ধার স্টিকদুটো গান হয়ে ভেসে বেড়াচ্ছে সারা ঘরে।
একটা সময় পর গান থেমে গেল। ঘাসের ওপর বৃষ্টি পড়ার মতো একটা গলা ভেসে এল বাতাসে, ‘কি তানি ম্যাডাম, ছড়া মুখস্থ হল? বিকেলে ফাংশনে যেতে হবে তো নাকি?’
তানি মায়ের দিকে তাকাল। আচ্ছা, সব মায়েদেরই কি এত সুন্দর দেখতে হয়? পানপাতার মতো মুখ? পিঠের ওদিকে ঝাঁপিয়ে পড়া ভেজা চুল? ঘামতেলে রঙ করা গায়ের রঙ, কিম্বা টানা টানা ভুরুর মাঝখানে টিপ হয়ে আটকে থাকা সূর্য! সবার থাকে? বোধহয় হ্যাঁ, হয়তো না। এরকম মায়ের জন্য বোধহয় একজনকে তানি হয়ে জন্মাতে হয়। পৃথিবীতে।
‘দুর, দাদা বলল এই ছড়াগুলোর কোনও মাথামুণ্ডু নেই। এক্কেবারে আনলজিক্যাল।’
‘ব্যস, আর আপনিও হাত-পা গুটিয়ে বসে আছেন। এক্সপার্ট ওপিনিয়ন বলে কথা।’
‘চাঁদের আলোয় পেঁপের ছায়া ধরতে যদি পারো,
শুঁকলে পরে সর্দিকাশি থাকবে না আর কারও…
তুমিই বল, এগুলোর কোনও মানে হয়?’
মা হাসল। তারপর আড়াই ফুটের তানিকে কোলে তুলে নেয়, ‘সব কিছুর মানে হয় না সোনা। সবকিছুর মানে খুঁজতে নেই। মজাটাই নষ্ট হয়ে যায়।’ তারপর তানির গালটা একটু টিপে দিয়ে বলে, ‘বড়ো হ, বুঝবি। মানুষই একমাত্র লজিক ছাড়া, নিজের ভালোলাগা নিয়ে কাজ করতে পারে। আর কেউ পারে না।’
লজিক! আনলজিক! আরে তাই তো। ১৪০ ভোল্টের একটা শকওয়েভ যেন তানিকে ছুঁয়ে গেল। একটু আগে শোনা ক্যারণের কথাগুলো ফিরে এল আরেকবার,
…..যুক্তি ছাড়া আমরা কিছু বুঝি না…..সিস্টেমে নেয় না…..সিস্টেম বিট্রে করে বসবে। আমরা লজিক থেকে শক্তি পাই। সে নিজের হোক কি অন্যের…..
ঠিক, আমরা পারি। শুধুমাত্র আমরাই পারি। হোমো সেপিয়েন্স সেপিয়েন্স। তানি আর কিছু ভাবতে চাইল না। ওর ভাবনাগুলো আর নিজস্ব নয়। যা করার না ভেবেই করতে হবে। অন দ্য স্পট!
ওদিকে তখন দুলে দুলে ছড়া মুখস্থ চলছে। বারো বছর আগের সিনটা যেন কেউ প্লে করে দিয়েছে। চেনা ছক, চেনা স্ক্রিপ্ট। তানি জানে এর পর কী হবে। একটু পরেই নিশ্বাস ভারি হয়ে আসবে। গা গরম করে জ্বর আসবে প্রচণ্ড। এক সপ্তাহ আর বিছানা ছাড়বে না ও। বিছানা ওকে ছাড়বে না।
‘মা, আমার মুখস্থ হয়ে গেছে। চলো ক্লাবে যাই,’ তানি প্রায় চিৎকার করে উঠল।
মা চোখ বড়ো বড়ো করে ফ্যালে, ‘ও মা! সে তো সেই সন্ধে বেলায়। এখন গিয়ে ঝাঁট দিবি নাকি?’
‘প্লিজ মা, বিকেল অবধি পৃথিবীও বাঁচবে না, আমিও বাঁচব না।’
‘হুম বুঝেছি। দাদার থেকে পাকা পাকা কথা আমদানি হচ্ছে। আসুক আজ বাঁদরটা।’
তানি চেয়ারটা ফেলে মায়ের দিকে এগিয়ে গেল। প্রত্যেক পায়ের সাথে সাথে সব কিছু কেমন যেন ছোটো হয়ে আসছে। আড়াই ফুটের শরীরটা লম্বা হতে লেগেছে নিজে নিজেই। মায়ের সামনে গিয়ে যখন দাঁড়াল, তখন মায়ের চেয়েও দু’আঙুল ছাড়িয়ে গেছে। ও মায়ের হাত দুটো জড়িয়ে ধরল।
মা অবাক হয়ে ওর দিকে তাকায়, ‘তানি!’
‘হ্যাঁ মা, আমিও তানি। তবে ভবিষ্যৎ-এর। আসলে এটাই বর্তমান। মানে….যাক গে তোমাকে বোঝাতে পারব না। শুধু জেনে রাখো, আমার তোমাকে দরকার। আজকের বারো বছর পরের পৃথিবীকে বাঁচাতে তোমার সাপোর্টটুকু দরকার। আমাকে কি বিশ্বাস করা যায় না মা?’
মায়ের চোখটা চিকচিক করে উঠল। তানির হাতের ওপর চাপ বাড়ল অল্প। ঘরটা বড়ো হচ্ছে। তানি অনুভব করল সময় খুব দ্রুত বইতে লেগেছে। ও আর মা ছাড়া ঘরের সব কিছু পালটে যাচ্ছে। একটু পরেই রাত নামবে।
ও চোখ বন্ধ করল। এখন শক্তি দরকার। অনেক অনেকটা শক্তি। শক্তি সময়কে পালটে দেওয়ার। নিজের ইচ্ছেমতো! ক্যারণ এখনও চুপচাপ আছে। তানিকে ভাবতে দিচ্ছে নিজের মতো করে। গলার কাছে দাঁতগুলো গেঁথে রাখা পিশাচও চায় শিকার আরও একটু খেলুক। ফাতনা মাছকে খেলিয়ে নিতে চায় গোটা একটা পুকুর। আরও আরও বেশি পাবার লোভ!
ও কি সত্যিই কিছু বুঝছে না। নাকি.. আবারও নিজের ভাবনাগুলো গিলে নিল ও।
একটা পাড়ে এসে আছড়ে পড়া ঢেউয়ের শব্দ শুনে চোখ খুলল তানি। পাড়ার মাঠ। ৩৬৪ দিনের চেনা আকাশটা যেমন করে দেওয়ালির রাতে বদলে যায়, ঠিক তেমনি করে ফেস্টুন, বাঁশ আর হ্যালোজেন এসে আজ মাঠটাকে বদলে দিয়েছে। মা ওর হাতে আরও একটু চাপ দিল, তারপর চুলগুলো ঘেঁটে দিয়ে বলল, ‘ভয় লাগলে চোখ দুটো বন্ধ করে নিস, কেমন?’
তানি গাল দুটো ফুলিয়ে বলে, ‘আমি ভিতু নাকি?’
‘দূর বোকা। তুই তো আমার ব্রেভ গার্ল। তাতিয়ানা মানে জানিস তো?’
পিইইইইইই করে মাইকগুলো গর্জে উঠল। তারপর কেউ স্টেজের ওপর থেকে অ্যানাউন্স করল, ‘এবার আবৃত্তি পরিবেশন করবে, আমাদের খুদে শিল্পী তাতিয়ানা বসু।’
কয়েকটা হাততালির শব্দ শোনা গেল। তানি এগিয়ে গেল স্টেজের দিকে।
এসব কিছুই সেদিন হয়নি। আজ হচ্ছে। মস্তিষ্কের অজানা কোনও অংশ জাগিয়ে তুলেছে ক্যারণ। যেখানে কল্পনাগুলো সত্যি হয়। অন্তত দেখতে লাগে সত্যির মতো।
সামনে লাইন দিয়ে চেয়ার পাতা। অনেক অনেক মুখ তাকিয়ে আছে ওর দিকে। ওই তো লাল ফ্রক পরে চৈতালি বসে আছে। তার সামনের চেয়ারে দাদা খালি এদিক ওদিক তাকাচ্ছে। আরও অনেককে দেখতে পেল ও। দূরে হ্যালোজেন বাল্বটার সাথে মিশে থাকা আলোটাও ওর নজর এড়াল না। ক্যারণ! নিচে পোড়া কাঠের হাত-পাওয়ালা মূর্তি। এত দূর থেকে অবশ্য চোখগুলো দেখা যাচ্ছে না।
‘তানি শুরু করো, ভয় পেও না,’ উইংসের দিক থেকে ব্যাজ পড়া একজন মেম্বার তাড়া দিল। তানি লোকটাকে চিনতে পারল না। শুধু বুঝতে পারল ওর হাইট আবারও কমে আসছে। তিন বছরের পুতুল পুতুল শরীরটা ফিরে আসছে আরও একবার। একটু পরেই নিচু করে সেট করা মাউথপিসটা নাগালের মধ্যে চলে এল।
এবার সময় এসেছে।
তানি বুক ভরে একটা নিশ্বাস নিল। দূরে ক্যারণকে এখন স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। এটা তোমার জন্য ডিয়ার। দ্যাখো নেওয়া যায় কিনা।
‘নমস্কার। সুকুমার রায়ের লেখা ছায়াবাজি,’ আধো আধো গলা ভেসে যেতে লাগল দু’গুণ চারগুণ হয়ে। চারিদিকে।
‘আজগুবি নয় আজগুবি নয় সত্যিকারের কথা –
ছায়ার সাথে কুস্তি করে গাত্রে হল ব্যথা…’
তানি বলে চলে। ছায়ার গল্প। ছায়া ধরার এক ব্যবসার গল্প, মেঘের ছায়া চেখে দেখার গল্প। গল্প শিশির ভেজা সাদা ছায়ার। যা ধরতে হলে একজনকে সুকুমার রায় হতে হয়। প্রত্যেক লাইনের সাথে সাথে যেন নরক উঠে আসছে মাঠ জুড়ে। হাওয়ার তোড় বাড়ছে। সামনের চেয়ারগুলো অদৃশ্য হতে লেগেছে একে একে। শুধু হ্যালোজেন কাঁপা কাঁপা রোদ্দুরে জন্ম নিচ্ছিল এক নতুন নাটক। বাতাসের গায়ে ধাক্কা খেয়ে ফিরছিল তানির গলার স্বর। অন্ধকার দেওয়ালে প্রতিধ্বনি তুলছিল আপাত আনলজিক্যাল কিছু শব্দ।
‘কেউ যবে তার রয় না কাছে, দেখতে নাহি পায়…..’ এখন কথা বলতে বেশ কষ্ট করতে হচ্ছে তানিকে। ভেতর থেকে কিছু একটা উঠে এসে ওকে থামিয়ে দিতে চাইছে, ‘….গাছের ছায়া ফুটফুটিয়ে এদিক ওদিক চায়।’
তানি থামে না। একবার বাঁচার আলো দেখতে পেলে বাঘের থাবায় পড়া হরিণও মরিয়া হয়ে ওঠে। শেষ দেখার জন্য! পুরো পৃথিবী যেন চেপে বসেছে ওর বুকের ওপর। মাথার শিরা ছেঁড়া যন্ত্রণাগুলো ফিরে এসেছে আরও একবার।
ক্যারণ তার ভুল বুঝতে পেরেছে। বুঝতে পেরেছে স্ট্র ডোবানো তরলটা আর অমৃত নেই। ফাতনায় খেলিয়ে বেড়ানো মাছটা হাঙর হয়ে ফিরে এসেছে হঠাৎই। এগুলো কী? কোনও মানেই তো হয় না! একটার সাথে আরেকটার কোনও লিংক আপই তো নেই। সমস্ত সিস্টেম অকেজো হয়ে যাচ্ছে নিমেষেই।
শিকার শিকারি হয়ে উঠলে আর ফেরার পথ থাকে না….
‘থামো…..এক্ষুনি….থামো,’ ক্যারণের গলাটুকু যেন ঝড়ের মুখে খড়কুটো হয়ে উড়ে যাচ্ছে। ভেসে যাওয়া মানুষের চিৎকার হয়ে হারিয়ে যাচ্ছে, অন্ধকারে। তার জায়গায় চেনা কয়েকটা গলা যেন এগিয়ে এগিয়ে আসছে, ‘তানি লড়ে যা। ইউ ক্যান ডু ইট….চিয়ার আপ মাই গার্ল….. দু’দিনের ফুচকা ট্রিট রইল তানি….’
লাস্টের কথাটা শুনে এর মধ্যেও হাসি পেল তানির। চৈতালী! পাগলী কোথাকার।
মট মট করে একটা শব্দ হল। মাঠের একপাশে দাঁড়িয়ে থাকা কৃষ্ণচূড়াটা পা-ভাঙা মূর্তির মতো খসে পড়ল। গোটা জায়গাটা যেন একটু কাঁপল। রাতের কৃষ্ণচূড়াগুলো রক্ত হয়ে ছড়িয়ে পড়ল মাঠ জুড়ে।
এই সময় তানির আবৃত্তি করা শেষ হল। চোদ্দ আনায় বিক্রি হয়ে গেল স্বপ্নের শিশি। শিশির ওষুধের জাদুতে ঝাপসা পর্দা নেমে আসছে সব কিছুর ওপরে।
তানি দেখল ছেলেটা কিছুটা এগিয়ে এল। এক পা…..দু পা…….। তারপর লুটিয়ে পড়ল। ধুলোর আরামে।
(১৬)
(১১:৫৫, কলকাতা)
আমরা জিতছি। হয়তো…
তন্ময় উঠে গিয়ে চিলেকোঠার দরজাটা দড়াম করে বন্ধ করে দিল। যা চেঁচামেচি হচ্ছে! মায়েরা আবার উঠে না আসে।
ওরা তানিকে এই অবস্থায় দেখলে….
তন্ময় ট্যাবটার দিকে তাকাল। তানিকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে এখন। চেহারার ভাঁজগুলো এখন সমান হয়ে গেছে। অনেকদিন পর এত ভালো করে মুখটা দেখল তন্ময়। এত বড়ো হয়ে গেছে! কবে হল! তারপর নিজেই হেসে ফেলল।
ভয়েস ফিল্টারটা অন করে আরও একবার চৈতালীর গলায় চিৎকার করে উঠল ও, ‘কাম অন তানি…..ফাইট…..ফুচকার দিব্যি কিন্তু।’
পাগলীটা এখানে থাকলে এগুলোই বলত হয়তো। তারপর ফিল্টারটা অফ করে নিজের গলায় চিৎকার করল। তারপর মা….. তারপর বাবা……
‘কী মনে হয় তন্ময়, কাজ হবে?’ হ্যানা আর চুপ থাকতে পারল না।
‘আই থিংক সো।’
তন্ময় ল্যাপটপের দিকে তাকাল। বিশাল লাল স্পটটা অনেক অনেক কমে এসেছে। এখন তানির শরীরের উষ্ণতা আলাদাভাবে ধরা পড়ছে থার্মাল সাইটে। আর দেখা যাচ্ছে খুব ছোটো ছোটো তিনটে ডট। আরও ছোটো হচ্ছে। আরও ছোটো….
আমরা সত্যিই জিতছি!
(১৭)
খুব ছোটোবেলায় একবার একটা স্বপ্ন দেখেছিল তানি। কার একটা বাড়িতে বেড়াতে গেছে। সেখানে আছে একটা কুয়ো। ও কী ভাবে যেন সেটার মধ্যে পড়ে গেছে। পড়ছে পড়ছে পড়ছে। অনেক নিচে কালো জলে টলমল করছে নীল আকাশের ছায়া। ও প্রাণপণ চাইছে চোখ বন্ধ করতে। কিন্তু পারছে না। স্বপ্নে বোধহয় চোখ বন্ধ করা যায় না! তারপর জল যখন ঠিক দু’আঙুল দূরে, তখনই সব কিছু থেমে গেল। রিমোটের পজ বটনে আঙুল চলে গেল আচমকাই। তারপর রিওয়াইন্ড। তানি আবার ওপরে উঠতে লেগেছিল। কালোর ওপর নীল দিয়ে কাজ করা আকাশটা দূরে চলে যাচ্ছিল আরও একবার।
হঠাৎ তানির মন কেমন করছিল। ওই অতটুকুনি জায়গার মধ্যে আটকে পড়া আকাশটার জন্য স্বপ্নের মধ্যেও কেমন যেন কষ্ট হচ্ছিল ওর। কেন কে জানে!
সেই কুয়ো থেকে উঠে আসার অনুভূতিটা যেন ফিরে এসেছে তানির মধ্যে।
গলি, তস্য গলি, কুটুদার চায়ের দোকানের পিছনের নালিপথ দিয়ে, পূরণ ভাড়াটেদের মেলে রাখা জামা, ক’দিন আগে পৃথিবী ছেড়ে যাওয়া শাঙ্কু মাসির হাসি হাসি মুখ, আরও আরও হাজারখানেক ফেলে আসা হারিয়ে যাওয়া সময়ের মধ্যে দিয়ে এঁকেবেঁকে ছুটে চলেছে টানেলটা। এখন আর তানিকে কেউ টানছে না। ঝড়ে দিক ঠিক রাখা চিলের মতো উড়ে চলেছে নিজে নিজেই। অন্ধকার টানেলটা স্বচ্ছ হয়ে গিয়ে সরে সরে যাওয়া স্মৃতিগুলো স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। যেন উলটোদিকে ঘুরিয়ে দেওয়া একটা সিনেমার রিল! তানি সেদিকে তাকাচ্ছে না। ছুটতে হলে পিছনে তাকাতে নেই। শুধুই ছুটে চলা। সে ফিনিশিং লাইনে আলো থাক বা না থাক।
খেলে আসার পর ছুঁড়ে ফেলা ব্যাডমিন্টন র্যাকেটটা যেমন ঘরের এক কোণে পরেরদিন বিকেল অবধি ওমনিটিই থেকে যায়, টানেলটাও ঠিক সেই একই রকম আছে। যেমনটা যাওয়ার সময় ছিল। এই টানেলটার জন্যও যেন একটু কষ্ট হল তানির, যার পাঁজরে পাঁজরে মিউজিয়ামের মতো করে থরে থরে সাজানো ইতিহাস। কত ভালো লাগা, অভিমানে ভিজে আসা বালিশ। এর জন্ম হয়তো ওরই মাথায়। কোনও এক অসতর্ক কল্পনায়। আজকের পর আর থাকবে না। কোনও দিন না।
‘তোমরা নিজেদের ধ্বংসের পথ নিজেরাই বেছে নিলে।’
ক্যারণের গলাটা কেমন যেন অন্যরকম লাগছে এখন। অনেক দূর থেকে ভেসে আসছে যেন। তানি ওপরের দিকে তাকাল। মাথার ওপর ক্যারণও ছুটে চলেছে সঙ্গে সঙ্গে। তবে এখন আর সেই তেজ নেই। আলোটা কমে ফ্যাকাসে মতো হয়ে গেছে। মাঝে মাঝে কয়েক ঝলক ধোঁয়া বেরিয়ে এসে, হারিয়ে যাচ্ছে বাতাসে।
তানি হাসল, ‘আমার তো মনে হয় না।’
‘তাহলে তোমার কী মনে হয়? তোমাদের ওই ভগবানরা তোমাদের বাঁচাবে?’
তানি আরও একবার হাসল, ‘আমাদের কোনও ভগবান নেই ডিয়ার। জীবনে চলতে চলতে কয়েকটা সাপোর্টের দরকার হয়। হলে পরীক্ষা দিতে দিতে, প্রথমবার সাইকেল শিখতে গিয়ে, অন্ধকার গলিতে একা ঢোকার আগে, একটা সান্ত্বনার দরকার হয়। না আমি একা নই, ওপরে কেউ আছে। সে ঠিক বাঁচিয়ে নেবে।’ তানি বলে চলে। বহুদিন ধরে মনের আনাচে কানাচে জমে থাকা কথাগুলো যেন বেরিয়ে আসে নিজে নিজেই। যেগুলো কোনওদিন কাউকে বলা হয়নি। সত্যি কথা বলতে কি সাহস পায়নি। যদি লোকে পাকা বলে!
‘এটা আসলে একটা শক্তি। আমাদের মধ্যেই থাকে। শুধু সেটা বের করে আনতে একটা চার হাত, দশ হাতওয়ালা পুতুলের দরকার হয়ে পড়ে। অনেকেই জানে ওগুলো মাটি-পাথরের বেশি কিছু নয়, যারা নিজেরাই বাঁচে মানুষের দয়ায়। কিন্তু তবু ওরা আছে আর থাকবেও। ওই যে বললাম না, শক্তি। যখন পুরো পৃথিবী তোমার বিপরীতে চলে যাবে, তখন কাঁদার জন্য একটা তো কোল দরকার। হোক না সেটা মাটির, ঠাণ্ডা পাথরের,’ তারপর আবার হেসে বলল, ‘কিছু ব্যাপারে সান্ত্বনা প্রাইজ নিয়েই বাঁচতে হয় ডিয়ার। সারা বছর ফাঁকি মেরে চলা ছেলেটা হঠাৎ করে ফার্স্ট হয়ে গেলে চলবে কেন? তার নিজেরই সহ্য হবে না যে।’
তানি সামনের দিকে একটা তীব্র আলো দেখতে পেল। বুকের ভেতর দিয়ে ক’টা সাদা কালো প্রজাপতি উড়ে গেল যেন। টানেলটার জন্য আবার মন কেমন করল। ক্যারণের জন্যও করল। কেন কে জানে!
মানুষ নিজের মনকে যেদিন পুরোপুরি বুঝে ফেলবে সেদিন বোধহয় মানুষ সত্যি সত্যিই ঈশ্বর হয়ে বসবে।
তানি আবার ক্যারণের দিকে তাকাল। ওটা কি আরও আবছা হয়ে গেছে? নাকি তানির চোখটা…..
‘জানি তোমরা আমাদের ভালোই চেয়েছিলে। তবে আমাদের ভালোটা একটু অন্যরকম, এই হল মুশকিল! তবে চিন্তা করো না। যতদিন মানুষ কারণ ছাড়াও কাজ করবে, আউটপুটের কথা না ভাবলেও ইনপুট দিয়ে যাবে, ততদিন মানুষ থাকবে। পৃথিবী থাকবে….’
(১৮)
(১২:১৫, নালন্দা)
বারোটা পেরিয়ে গিয়ে ঘণ্টা-মিনিটের কাঁটাগুলোর ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে অনেকক্ষণ। এখন আর কেউ কথা বলছে না। ঝড় ওঠার আগে যেমন সব কিছু চুপচাপ হয়ে যায়। তেমনি ঝড় থেমে যাওয়ার পরও যেন সবকিছু থমকে থাকে। কেউ কোনও শব্দ করে না। সত্যি কথা বলতে কি, কেউ সেই অবস্থাতেই থাকে না।
ওরা পাঁচজন ওপরের দিকে তাকিয়ে ছিল। হাজার মাইল দূরে ট্যাবের জানলা দিয়ে তাকিয়ে ছিল তন্ময়ও।
তবে কি সবই বৃথা! কিছুই হবে না!
ঠিক তখনই বোধহয়, তানির শরীর ভেসে থাকা অবস্থাতেই একটু কাঁপল। তারপর কেমন যেন পালকের মতো নেমে এল আস্তে আস্তে। কেউ যেন খুব যত্ন করে ওকে নামিয়ে রাখল। ব্যথা ভুলে কাউচ ছুটে গিয়ে তানিকে ধরল। একটা দেওয়ালে হেলান দিয়ে বসিয়ে দিল। ওর চোখ দুটো এখনও বন্ধ। মেঘলা রাতের বাদামি আলো খেলা করছে সারা মুখে। আচ্ছা জুলিকে কি ঘুমোলে এরকমই লাগে?
সবাই তানির জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়ল। যুদ্ধ জেতা মানুষদের তো এটুকু প্রাপ্য! হ্যানা আঁজলা করে জল ছিটিয়ে দিচ্ছে চোখে। কাউচ পালস চেক করতে বসল সাথে সাথেই।
সবাই তানিকে নিয়ে ব্যস্ত। কেউ খেয়াল করল না আলোর বলগুলো ওপরের দিকে উঠে যাচ্ছে। ছোটো হয়ে আসছে ক্রমশ। উঠতে উঠতে একসময় ঢাকা পড়ে গেল কালো মেঘে।
ওপরে যেন একটা বিস্ফোরণ হল। মেঘের বিছানায় রাতের পরের সূর্যটা যেন গড়াগড়ি খেল একটু। একমুহূর্ত। তারপর সব আবার আগের মতো। আকাশ, পৃথিবী, মানুষ সব…………
মেঘ সরে গিয়ে রোগামতো একটা চাঁদ বেরিয়ে আসে এইসময়। জিরো পাওয়ারের জোছনা এসে দখল নেয় নালন্দার।
এইসব কিছুই ওরা দেখল না। ওরা ব্যস্ত। শুধু ট্যাবটা শাট ডাউন করার আগে তন্ময় দেখল চোখ বন্ধ অবস্থাতেই তানি যেন হাসছে। ঠোঁট নাড়ছে অল্প অল্প।
তন্ময়ের মাথায় কিছুটা নিজে নিজেই অনুবাদ হয়ে গেল ঠোঁটের ভাষা। তন্ময়ের কাছে যার কোনও মানেই দাঁড়ায় না। পাগলী একটা!
‘গুড বাই ডিয়ার। রেন রেন গো অ্যাওয়ে, কাম এগেন অ্যানাদার ডে। তোমরা বৃষ্টির সাথে কথা বলতে পারো? আমরা পারি!’
(সব শেষের পরে)
আজ গাছটা সেজেছে নিজের মতো করে। যেন পাতায় পাতায় বরফ পড়েছে। যেন কাঞ্চনজঙ্ঘা ছুঁয়ে গেছে দিনের প্রথম আলো। আর না সাজলেই বা চলবে কেন? পাতায় পাতায় গোলাপি রঙে আগুন ধরাতে না পারলে, মৌমাছিদের কাছে টেনে না নিলে আর এমন নাম কেন! শরীর দিয়ে শিকড় বের করে বেঁচে থাকা কেন? ফুল ফোটানোর জন্যই তো! আশপাশটুকু ঝলসে দিতে না পারলে সুন্দরী নামখানাই যে বৃথা। বৃথা আস্ত একটা জঙ্গল! মাটি ফুঁড়ে শিখর উঠে আসার দেশ। পাখিদের হলিডে প্যাকেজ!
এই জঙ্গলেরই বোধহয় আস্তে আস্তে ডুবে যাওয়া মানায়। রাজারই তো মৃত্যু হয় ফকিরের মতো করে। আর বড়ো জোর একশোটা বছর কিংবা তাও না। তার আগেই সুন্দরবন হারিয়ে যাবে। চিরদিনের মতো।
তবু তো ফুল ফোটে, বসন্ত এসে হাওয়া ছোটায়। ঘাড়ের কাছে মৃত্যু নিয়েও লাল নীল কাঁকড়ারা ছুটে যাচ্ছে পাশের দিকে। ছোটো ছোটো মাছ গর্ত বদলায় প্রতিক্ষণে। পৃথিবী বিখ্যাত ‘মাড ফ্ল্যাটস’ – কাদার ওপর দিয়ে একটা ভোঁদড় নদী পেরোয়।
একটু দূরে পড়ে থাকা ছেলেটাকে নিয়ে কারোরই তেমন কৌতূহল নেই। ও তো কতই পড়ে থাকে। রাজার খাবার! শুধু মাঝে একটা দুটো ঢেউ এসে ছুঁয়ে যায় কালো শরীরটাকে। একটু পরেই হয়তো সে উঠে বসবে। এদিক সেদিক তাকাবে। দেখবে সূর্যটা অনেকটা উঠে এসেছে। ছায়া ছোটো হয়ে আটকেছে পায়ের নিচে। ‘কি হয়েছিল’ ভুলে বাড়ির দিকে ছুট লাগাবে। যেখানে অপেক্ষার পালা চলে রোজ রোজ। কেউ না কেউ ঠিকই বসে থাকে। জঙ্গলের মানুষদের তো অপেক্ষাটুকুই সম্বল। পিছটানটুকুই শক্তি লড়ে যাওয়ার। ভয়ঙ্কর সুন্দরকে হারিয়ে দেওয়ার।
বন অবশ্য ওদের দিকে তাকায় না। মানুষ তো আশ্রিত মাত্র।
দিন বড়ো হয়। মাটির সোঁদা গন্ধ গিয়ে মেশে বাতাসে। চারপাশ শিউরে দিয়ে ধবল পাখিটা উড়ে যায়। সব নিজের নিয়মে চলে, নিজের নিয়মে ভাঙে।
আসলে, প্রকৃতির সব রহস্যই বড্ড বেশি সরল। শুধু তার সমাধানগুলোই একটু যা জটিল!
______
(অ্যাটেনশন প্লিজ,
এই শেষ বেলায় কয়েকটা কথা বলে নেওয়া যাক। গল্পে ব্যবহৃত সব রকমের আধুনিক ডিভাইস, টেকনোলজি, জায়গা কিন্তু একদম সত্যি। X1 শক গান, ক্লিপ ক্যামেরা সবই পাওয়া যায়। কিউ আর স্ক্যানার প্লে স্টোর থেকে সহজেই ইনস্টল করা যায়, আর অন্য গ্রহে এভাবে ডাটা পাঠানোর কথা সত্যিই ভাবা হচ্ছে। নাসার মেইন সেন্টার বারোটা। তেরো নম্বরটা আমার কল্পনা, এর অস্তিত্ব থাকলেও আমার জানা নেই। আসলে এই তেরো সংখ্যাটার ওপর পৃথিবীর সব থেকে উন্নত দেশটিরও কিছু কুসংস্কার জড়িয়ে আছে। অনেক সময় তো তারা বারোর পর চোদ্দতে চলে যায়! তাই কিছুটা মজা করেই তেরো নাম্বারটা ব্যবহার করলাম।
স্টেট টেলিপোর্টেশন, এনার্জি টেলিপোর্টেশন আর পার্টিকেল টেলিপোর্টেশন – এই তিন ধরণের টেলিপোর্টেশনের কথা ভাবা হচ্ছে। ভিডিও কলও কিন্তু এক ধরনের টেলিপোর্টেশন। আবার টেলিপোর্টেশন ক্লোনিং-কেও ব্যবহার করার কথা ভাবা হচ্ছে। আর ১৯৯৬-এর সাফল্যের কথা তো আগেই বলেছি। আমাদের থেকে উন্নত কোনও পৃথিবী হয়তো আরও কিছু সাফল্য পেয়েছে! এখন কারও মনে হ্যাকিং নিয়ে প্রশ্ন জাগতে পারে। তাহলে ৭ বছরের Betsy Davies-এর কথা বলতে হয়। ২০১৫-র জানুয়ারি ভার্চুয়াল প্রাইভেট নেটওয়ার্ক (VPN)-এর তরফ থেকে একটা পরীক্ষামূলক হ্যাকিং কম্পিটিশন করা হয়। সেখানে বেটসি মাত্র দশ মিনিট চুয়ান্ন সেকেন্ডের মধ্যে ওয়াই ফাই হট স্পট হ্যাক করে বসে। অতদূরও যাওয়ার দরকার নেই। আমাদেরই দেশের ছেলে রুবেন পাল, বাঙালী! ন’বছরের একজন এথিকাল হ্যাকার, অ্যাপ ডেভলপার, সাইবার সিকিউরিটি এক্সপার্ট! ২০১৪-র শিশুদিবসের দিন রুবেনের উদ্যোগে বিশ্বের বৃহত্তম হ্যাকিং সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়।
এবার আসা যাক ক্যারণের কথায়। সুন্দরবনের গভীরে কিন্তু এরকম আলো সত্যিই দেখা যায়। আজ্ঞে না, আলেয়া নয়। এর ধরণ একদম অন্যরকম। দেখতে চান? Ghost light of sundarban লিখে একটু সার্চ মারুন দেখি। হয়তো তারা এই পৃথিবীর কেউ নয়। তারা মাঝে মাঝে নেমে আসে। অনেক অনেক দূর থেকে। ওই আকাশটা থেকে যে পৃথিবীর সবথেকে বড়ো ব–দ্বীপ এলাকাটা স্পষ্ট দেখা যায়! ল্যান্ডিং-এর জন্য এর চেয়ে ভালো জায়গা আর কোথায়?)
ছবিঃ তন্ময়, ইন্দ্রশেখর
জয়ঢাকের গল্পঘর