এ প্রতিযোগিতা হয়েছিল রাজকুমার রায়চৌধুরিমশাইয়ের অসামান্য সাইফি “তাতিয়ানার মোবাইল“-এর একটা উপযুক্ত সিকোয়েল লেখবার চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে। সে চ্যালেঞ্জ নিয়েছিল বেশ কিছু তাজা কলম। প্রথম ন’টি গল্প পুরস্কৃত হয়েছে বইমেলায় আমাদের অনুষ্ঠানে। প্রথম তিন আসবে পুজো সংখ্যায়। তার পরের বিজয়ীদের মধ্যে ছয় ও সাত নম্বর বের হল এ সংখ্যাতে।
জয়ঢাক গল্প প্রতিযোগিতা ২০১৬- সপ্তম স্থান
প্রকল্প ভট্টাচার্য
খুচরোটা নিয়েই শেয়ার অটোটা আর এক মুহূর্ত দাঁড়াল না।
টিউশন থেকে ফেরবার সময় স্টপেজ থেকে বাড়ি, এইটুকু রাস্তাই তাতিয়ানার অনেকটা মনে হয়। আজ আবার রাস্তার আলোগুলোও জ্বলছে না। বাড়ি গিয়ে তাকে কিছু জরুরি নোট টুকে নিতে হবে। নানান ঝামেলায় পড়াশোনা অনেকখানি পেছিয়ে গেছে। এইসব ভাবতে ভাবতে অন্যমনস্ক হয়ে হাঁটছিল সে। হঠাৎই যেন মাটি ফুঁড়ে একটা কালো স্কর্পিও এসে তার গা ঘেঁষে দাঁড়াল আর মুহূর্তের মধ্যে গাড়ির দরজা খুলে দু’জন লোক তাকে চেপে ধরল। তাতিয়ানা ভয়ে চিৎকার করতে যাবে, তার আগেই একজন তার মুখে একটা কাপড় চেপে ধরল… কেমন অদ্ভুত একটা মিষ্টি গন্ধ… তারপর তাতিয়ানার আর কিছু মনে নেই।
হুঁশ ফিরতে সে দেখল একটা অচেনা পরিবেশ… সামনে কালো পোশাক পরা কয়েকজন মুশকো লোক, একজন তার মুখ জল ছেটাচ্ছে। সে চোখ খুলতেই তারা স্বস্তির নিঃশাস ফেলল যেন। আস্তে আস্তে খেয়াল করল, ঘরের মাঝখানে একটা ইজিচেয়ারে তাকে বেঁধে রাখা হয়েছে। সামনে একটা টেবিলে একজন সুপুরুষ যুবক বসে আছেন। চোখে চোখ পড়তেই মিষ্টি হেসে তিনি পরিষ্কার ইংরাজিতে বললেন, “এইভাবে আপনাকে এখানে নিয়ে আসবার জন্য আমি সত্যিই দুঃখিত!”
তাতিয়ানা ভীষণ ভয় পেয়েছিল, কিন্তু বুঝতে পারছিল এখন তাকে মাথা ঠাণ্ডা রাখতে হবে। তাই এতক্ষণ জোর করে মুখে ভয়ের ছাপ পড়তে দিচ্ছিল না। কিন্তু যুবকের কথা শুনে ওই অবস্থাতেও তাতিয়ানার হাসি পেল। এরা কারা সে জানে না, কিন্তু ভদ্রলোক যে নয়, সেটা বিলক্ষণ বোঝা যাচ্ছে। তাদের আবার ক্ষমাপ্রার্থনা!
ধীরে ধীরে সে বলল, “কেন এনেছেন আমাকে এখানে?”
“কারণটা আপনি নিশ্চয়ই আন্দাজ করতে পারছেন।”
“আমার মোবাইলটার জন্যে কি?”
যুবকের মুখে হাসি ফুটল।
“আপনি বুদ্ধিমতী। হ্যাঁ, শুধুমাত্র আপনার মোবাইলটা পেলেই আপনাকে ছেড়ে দেওয়া হবে।”
“ওটা আমার ব্যাগে আছে। দয়া করে বের করে নিন আর আমায় ছেড়ে দিন।”
এবার যুবকের মুখ কঠিন হল।
“আপনি বুদ্ধিমতী ঠিকই, কিন্তু আমাদের অতটা বোকাও ভাববেন না। আপনার ব্যাগ আমরা ইতিমধ্যে তল্লাশি করেছি। মোবাইলটা সেখানে নেই।”
এবার তাতিয়ানার অবাক হওয়ার পালা। স্পষ্ট মনে আছে টিউশন থেকে বেরিয়ে সে বাড়িতে ফোন করেছিল, তারপর ব্যাগে… হ্যাঁ, ব্যাগেই রেখেছিল। ব্যাগেই রাখে সে, অনেকে বারণ করা সত্ত্বেও।
“আমি কিন্তু যতদূর মনে করতে পারছি…”
“দেখুন মিস তাতিয়ানা, আপনার সঙ্গে গল্প করবার সময় আমার নেই। আপনাকে আধঘন্টা সময় দিচ্ছি। তার মধ্যে আপনি মনে করে জানান যে মোবাইলটা কোথায় লুকিয়েছেন। আমাদের লোক আপনার বাড়িতেও নজর রাখছে। ওটা আপনি সঙ্গে নিয়ে বেরিয়েছিলেন, সে খবর আছে আমাদের কাছে। যদি ভালোয় ভালোয় ওটা আমার হাতে তুলে না দেন…”
যুবকের শীতল স্বরে হুমকির ছাপ স্পষ্ট।
“বিশ্বাস করুন, ওটা আমার ব্যাগেই ছিল! আচ্ছা, আপনি ফোন করেই দেখুন না, আমার নম্বর…”
একচিলতে হাসি ফুটল যুবকের মুখে।
“আপনার নম্বর আমি জানি। ফোনও করেছি, কিন্তু সুইচড অফ বলছে। যাই হোক, আপনি যদি সহযোগিতা না করেন, তাহলেও সেটা খুঁজে বার করবার উপায় আমাদের জানা আছে। কিন্তু তার ফল আপনার পক্ষে, আপনার পরিবারের পক্ষে ভালো হবে না। এবার আপনার যা ইচ্ছা!”
এটুকু বলেই নিমেষে যুবক উঠে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল, পেছন পেছন বাকিরা। অসহায় তাতিয়ানা তাকিয়ে দেখল শুধু, তারপর দরজাটা বাইরে থেকে চাবি দিয়ে বন্ধ করে দেওয়ার শব্দ পেল। একা হতেই তার মাথায় একরাশ দুশ্চিন্তা ভিড় করে এল। কতক্ষণ আগে এসেছে সে? বাড়িতে বাবা মা চিন্তা করছেন নিশ্চয়ই… দাদাও। দাদা তাকে বার বার বলেছিল মোবাইলটা সাবধানে রাখতে। এমনকি এটাও বলেছিল যে মোবাইলটা ব্যবহার না করতে, অন্য একটা মোবাইল কিনে নিতে আর ওটা সুরক্ষিত রাখতে। তাতিয়ানা রাজি হয়নি। সে জিনিসপত্র হারায় না, বেশ গোছানো স্বভাবের। তাছাড়া, মোবাইলটা তার খুব প্রিয়। আরও একটা কারণ আছে। তার কেবলই মনে হয়, গ্রহান্তরের ওই বার্তাগুলো তারই জন্যে, তার কোনও বন্ধু পাঠায়। একদিন না একদিন সে ঠিক বুঝতে পারবে সেই বার্তাগুলোর অর্থ। অচেনা, অজানা বন্ধুর সাহচর্য হারাতে চায় না বলেই সে কখনোই কাছছাড়া করত না মোবাইলটা। কিন্তু তার জন্যে এমন বিপদে যে পড়তে হবে…
কিন্তু মোবাইলটা গেল কোথায়! এই লোকগুলো যদি সেটা পেয়ে যেত, তাহলে তাকে ছেড়েই দিত। ব্যাগে ভরে সে অটোতে উঠল, তারপর… হঠাৎ বিদ্যুচ্চমকের মতো তাতিয়ানার মনে পড়ল, অটোতে তার পাশেই একজন বসেছিলেন, ব্যাগটা প্রায় তাঁর কোল ঘেঁষেই ছিল। নামবার সময় একটু টান দিয়েই… তাহলে কি… তাহলে কি সেই সময় মোবাইলটা পড়ে গেছিল… না, নির্ঘাত ওই লোকটা তুলে নিয়েছিল ফোনটা! মাথায় আসতেই তাতিয়ানা ভাবল লোকগুলোকে জানিয়ে দেবে। কোনওভাবে যদি ওরা লোকটাকে ধরতে পারে…
তাতিয়ানা জোরে “হ্যালো, কেউ আছেন!” বলে চেঁচিয়ে উঠল।
সঙ্গে সঙ্গে দরজাটা খুলে গেল।
সেই যুবক ঢুকে এসে বলল, “হ্যাঁ বলুন।”
“আসলে, আমার মোবাইলটা চুরি হয়ে গেছে। যে অটোতে আজ এলাম, তার মধ্যেই।”
“বাঃ! এতদিন অটোতে যাতাযাত করছেন কিছু হয়নি, আর আজই চুরি হল? তাও ঠিক আমরা আসবার আগেই!” লোকটার মুখে বিদ্রুপের হাসি।
“বিশ্বাস করুন, সেটাই হয়েছে!”
“আপনার সময় প্রায় ফুরিয়ে এসেছে মিস তাতিয়ানা। অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে জানাচ্ছি যে আমরা এখন আপনার বাড়িতে তল্লাশি নেব, তারপর আপনার বাবা, মা এবং দাদাকেও বন্দি করতে বাধ্য হব। আশা করি ওঁরা আমাদের সঙ্গে সহযোগিতা করবেন আর মোবাইলটা আমাদের হাতে তুলে দেবেন!”
“না, আপনারা এমন কাজ করতে পারেন না!” চেঁচিয়ে বলল তাতিয়ানা।
“আমরা কী পারি আর কী না পারি সে সম্পর্কে আপনার কোনও ধারণা নেই, মিস তাতিয়ানা। যদি থাকত, তাহলে এতক্ষণে জানিয়ে দিতেন কোথায় লুকিয়ে রেখেছেন আপনার মোবাইলটা। যাই হোক, আমাদের দুর্ভাগ্য যে আপনি সহযোগিতা করছেন না। বাধ্য হয়েই আমরা আপনাকে একটা ইঞ্জেকশন দেব, এর ফলে আপনি সহজে আর মিথ্যা কথা বলতে পারবেন না।”
সত্যিই একজন মুশকো লোক একটা সিরিঞ্জ নিয়ে তার দিকে এগোতে লাগল।
তাতিয়ানা এবার সত্যি ভীষণ ভয় পেয়ে গেল। মায়ের মুখটা মনে পড়ল আর সে সজোরে “ও মা বাঁচাও!” বলে চেঁচিয়ে উঠল।
আর সঙ্গে সঙ্গেই ঘরের দরজাটা সজোরে ভেঙে ফেলে কিছু পুলিশ এসে ঢুকল, বন্দুক তাক করে বলল, “সক্কলে হাত মাথার ওপর তুলুন!”
তারপর যেন স্বপ্নের মতো সব ঘটে গেল। অনিমেষবাবু দৌড়ে এসে মেয়ের বাঁধন খুলতে লাগলেন, তন্ময় আর একজন পুলিশ কনস্টেবল তাঁকে সাহায্য করতে লাগল। হতচকিত লোকগুলোর আত্মসমর্পণ করা ছাড়া উপায়ও ছিল না, কোনও অস্ত্র ব্যবহার করার সুযোগই পেল না তারা।
বাড়ি ফেরবার পথে তাতিয়ানা ঘটনাটা জানতে পারল। তার মোবাইল ফোনটা অটোতেই পড়ে গেছিল। সে নেমে যাওয়ার সাথে সাথেই একটা অ্যালার্ম বাজতে শুরু করায়, অটোওয়ালা খেয়াল করে যে তার ফোনটা অটোতেই পড়ে আছে। তাতিয়ানাকে ওই পাড়ায় সকলেই চেনে, তাই তার ফোন ফেরত দেওয়ার জন্যে অটো নিয়েই তার দিকে এগোতে থাকে, আর দূর থেকে দেখতে পায় ওকে কিছু লোক কালো গাড়িতে করে নিয়ে গেল। নিজের প্রাণের মায়া না করে সে তাতিয়ানাকে বাঁচাতে অটো নিয়ে ফলো করে, আর এদের বাড়িটা চিনে নেয়। এদিকে মেয়ের দেরি দেখে অনিমেষবাবু ওর মোবাইলে ফোন করলে অটোওয়ালা তাঁকে সব জানায়, তিনি তখনই পুলিশ নিয়ে আসেন ওকে উদ্ধার করতে! তারপর কী হল সে তো তাতিয়ানা জানে।
তন্ময় খোঁজ নিয়ে জানাল, ওই মুশকো লোকগুলো নাকি বিদেশী অপরাধী। তাতিয়ানার মোবাইলের খবর পেয়ে সেটা চুরি করতে এসেছিল। ওটা নিয়ে তারা রিসার্চ করত নাকি।
বাড়ি ফিরতে তাতিয়ানার মা আনন্দে কেঁদে ফেলে বললেন, “সত্যি, ওই অটোওয়ালা সময়মতো সাহায্য না করলে যে কী হতো! ওই তোর সত্যিকারের বন্ধু রে!”
তাতিয়ানা হাসে। অটোওয়ালা তাকে উদ্ধার করেছে, অনেক উপকার করেছে সত্যিই, কিন্তু কে যে তার আসল বন্ধু, সেটা সে বুঝতে পেরেছে।
ঠিক যে মুহূর্তে মোবাইলটা অটোতে পড়ে গেছিল, তখন সেই অ্যালার্মটা কী করে বেজেছিল! কে বাজিয়েছিল সেটা!
রাত্তিরে সবাই ঘুমিয়ে পড়লে তাতিয়ানা তার মোবাইলটা হাতে নিয়ে ভালো করে দেখে, তারপর ফিসফিস করে বলে, “ধন্যবাদ, বন্ধু!”
মোবাইল স্ক্রিনটা একবার ফ্ল্যাশ করেই আবার অফ হয়ে যায়, নিজে নিজেই। ঠিক যেন বলে ওঠে, “থ্যাঙ্কিউ! গুড নাইট!!”
গ্রাফিক্স্ ইন্দ্রশেখর