বনের ডায়েরি সব লেখা একত্রে
মিতা সিংহ
বসে আছি একা নেতিধোপানীর ঘাটের জেটিতে। জেটিটা এখনও কংক্রিটের শক্তপোক্ত নয়। সুন্দরবনে জেটিগুলো সাধারণত গরাণকাঠ দিয়েই তৈরি হয়।
এমনসময় ওপারের জঙ্গল থেকে তীব্র হুঙ্কার ভেসে এল… ‘গাঁ ও ও ও।’ বুকের ভিতরটা ছ্যাঁৎ করে উঠল।
একে তো সন্ধ্যা প্রায় নামে নামে, তার উপর বসে আছি আমি একা। যদিও বাঘটা রয়েছে নদীর ওপারে তবুও জঙ্গলে বসে তেনার হাড় হিম করা হুঙ্কার সহ্য করতে একটু কষ্ট হয় বৈকি। যদিও আমি এখানে অবাঞ্ছিত এখন আবার দরকারে কখনও কখনও বাঞ্ছিতও বটে। কিন্তু দিনের আলোয় ভয় আমাকে খুব একটা কাবু করতে পারে না। কারণ মনের সঙ্গে চোখ কাজ করে।
যদিও আজ অবধি সুন্দরবনে বেশিরভাগ দুর্ঘটনাই সাধারনত দিনের আলোয় ঘটেছে কিন্তু তাই বলে রাত্রিটা এখানে নিরাপদ সময় তা আমি বলছি না। রাতে মানুষের হাতে কাজ কম তাই এই সময়টা মানুষ রাখে নিজের জন্য। কিন্তু সুন্দরবনহেন রহস্যে ঘেরা জায়গা সে নিজেকে কোন নিয়মের আওতায় আবদ্ধ রাখে না কখনও। অন্তত রাতে যে ঘটনাটা ঘটল তার জন্য কোনভাবেই প্রস্তুত ছিলাম না।
এতক্ষণ শ্রমিকরা কাজ করছিল এখানে। জেটি মেরামতির কাজ। কিন্তু আজ একটু তাড়াতাড়িই কাজ ছেড়ে উঠে গেছে ওরা ওদের জন্য নির্দিষ্ট করা অস্থায়ী ডেরায়। আমিও এতক্ষণ বসে বসে ওদের কাজ দেখছিলাম কিন্তু আর এভাবে অরক্ষিত জেটিতে একা বসে থাকাটা একটু বেশি বাড়াবাড়ির পর্যায়ে চলে যাচ্ছে। সবে এসেছি নেতিধোপানীতে। এখনও হয়ত ঘন্টাদুয়েকও হয়নি। মালপত্রগুলোও এখনও আমাদের রাত্রিবাসের জায়গায় ঠিকঠাক গুছিয়ে রাখা হয়নি। হাত মুখ ধুয়ে গুছিয়ে বসে এক কাপ চা চাই-ই চাই।
শুনসান এলাকায় কিছুটা অরক্ষিত কিছুটা খাঁচায় ঘেরা পথ দিয়ে এগিয়ে চললাম যেখানে অনিমেষ আছে। বনকর্মীদের সঙ্গে আলোচনায় ব্যস্ত।
এখনে খাঁচা কথাটা এই জন্যই ব্যবহার করলাম, যে বাস্তবিকই বন্যজন্তুর হাত থেকে নিরাপদ থাকার জন্য নদী থেকে বনকর্মীদের বাসস্থানের জায়গা পর্যন্ত পথটুকু জঙ্গলে লোহার তারে ঘেরা থাকে বা বনের বাঘ তাদের দেখেতে পেলেও আক্রমণ করার কোন সুযোগ পায় না। এখন আমিও চলেছি সেই খাঁচার ভিতরের পথ ধরেই কিছুটা অন্যমনস্কতায় কিছুটা বন্যপ্রেম নিয়ে।
দূরে দেখতে পেলাম আমাদের এবারে থাকার জন্য অ্যাকোমোডেশন বোট বা বাংলায় যাকে বলা হত বজরাটাকে।
এবারে আমরা সুন্দরবনে এসেছি বনবিবির পূজোর নিমন্ত্রণ পেয়ে। নিমন্ত্রণ করেছে গোবিন্দ। এখন ও এখানকার বড়বাবু, মানে ফরেস্টার। এই নেতিধোপানীর পীরখালি ব্লকের।
শুধু নেতিধোপানি বললে হয়ত বুঝতে একটু অসুবিধা হতে পারে। মনসামঙ্গল কাব্যে উল্লেখিত বেহুলা লখিন্দরের গল্প হয়ত অনেকেরই জানা আছে। তবুও সংক্ষেপে একটু জানিয়ে রাখছি। চাঁদ সওদাগরের পুত্র লখিন্দর। শিবের উপাসক চাঁদ- মনসা দেবীর পূজো দিতে অস্বীকার করায় মনসা প্রচন্ড রেগে যান। চাঁদের পুত্র লখিন্দরকে তার বিয়ের রাত্রে মনসা দংশন করে। অনেক চেষ্টা করেও লখিন্দরকে বাঁচানো যায় না।
তখন লখিন্দরের স্ত্রী বেহুলা তার স্বামীকে বাঁচানোর জন্য কলার ভেলায় করে লখিন্দরের মৃতদেহ নিয়ে যাত্রা করে নদীপথে স্বর্গের উদ্দেশ্যে।
এখানকার জঙ্গলাকীর্ণ নেতিধোপানীর ঘাট তখন সমৃদ্ধশালি জনপদ ছিল। সেখানে কোন বাঘ বা তার ভয়ও ছিল না। যেতে যেতে বেহুলা দেখল একজন স্ত্রীলোক ঘাটে কাপড় কাচছে। তার দুষ্টু ছেলেটা তাকে বিরক্ত করায় সে তার কাপড় কাচার পিঁড়ি দিয়ে ছেলেটিকে আঘাত করে। ছেলেটি সঙ্গে সঙ্গে মারা যায়, কিছুক্ষন পরে সব কাপড় কাঁচা শেষ করে যেই রমণী মন্ত্রপূত জল ছিটিয়ে আবার তার পুত্রকে বাঁচিয়ে তোলে। নদীপথে ভেলায় ভেসে যেতে যেতে বেহুলা তা দেখতে পায়।
বেহুলা তখন সেই রমণীকে অনুরোধ করে তাকে ঐ মন্ত্র শিখিয়ে তার স্বামীর জীবন ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য। সেই রমণী বেহুলাকে জানান, এই বিদ্যা তিনি স্বর্গ থেকে পেয়েছেন এবং শুধু এটা তিনি প্রয়োগ করতে পারেন তাঁর নিজের ক্ষেত্রেই। স্বর্গের দেবতাদের তুষ্ট করতে পারলে বেহুলাও এই বিদ্যার অধিকারী হয়ে তার স্বামীর প্রাণ ফিরে পেতে পারেন। বেহুলাকে তিনি স্বর্গে পৌঁছানোর রাস্তা বলে দিলেন। সেই রমণীর নাম নেতি ধোপানী।
এরপর বেহুলা তার মৃত স্বামী লখিন্দরকে নিয়ে স্বর্গে গেল এবং সেখানে নেচেগেয়ে দেবতাদের তুষ্ট করে তার স্বামীকে বাঁচিয়ে তুলল। সেই রমণীর নাম ছিল নেতি ধোপানী। এরপর চাঁদ সওদাগর খুশি হয়ে নেতি ধোপানীর নামে সেখানে একটা শিবমন্দির ও ঘাট নির্মাণ করে দেন।
আজ যদিও জায়গাটা ভয়াল নরখাদকের দেশ সুন্দরবন, কিন্তু আজও জঙ্গলের গভীরে মন্দিরে ভগ্নাবশেষও রাস্তার অংশবিশেষ দেখতে পাওয়া যায়।
গোবিন্দর ডাকে চিন্তাটা কেটে গেল, “কাকিমা চা এনেছি।” শুধু চা-টাই নিলাম। বিস্কুট নিলাম না। বললাম, “এই চা-টুকুর খুব দরকার ছিল। একটু আগে যা খাইয়েছ তারপর আর পেটে বিস্কুট খাবার জায়গা নেই।”
গোবিন্দ তবু দাঁড়িয়ে আছে দেখে জিজ্ঞাসা করলাম, “কিছু বলবে গোবিন্দ।”
মাথা নিচু করে আমতা আমতা করে বলল, “আপনি তো সবই জানেন, দুটো দিন কিন্তু একটু কষ্ট করে নিরাম (নিরামিষ) খেতে হবে কাকিমা। কাল অধিবাস। বনবিবির সঙ্গে বিশালাক্ষী পূজো আছে তো, তাই অধিবাস রাখতেই হয়। তবে চিন্তা করবেন না কাকিমা, অনেক ভালো ভালো নিরাম তরকারির ব্যবস্থা হবে। আর পরশু পুজোয় খিচুড়ি ভোগ সবার জন্য।”
বললাম, “আচ্ছা গোবিন্দ তোমার কি মনে হয় আমি আর অনিমেষ এখানে- শুধু খাওয়ার জন্য? প্রতি বছর এখানে পূজোয় যোগ দিতে দিতে এখানকার সব নিয়মকানুন আমাদের জানা হয়ে গেছে। তোমাদের সঙ্গে সঙ্গে সব নিয়ম পালন করে আমরাও ধন্য হই। তুমি কিছু চিন্তা কোর না। গোসাবা বাজার থেকে ঐ অত্ত বাজার ঘাট সেরে আমাদের ঘাট থেকে নৌকোয় তুলে নিয়ে এসে, এখন তুমিও নিশ্চয়ই খুবই ক্লান্ত। এই বেশ ঠান্ডায় ঠান্ডায় বজরার ছাদে জঙ্গলের মনোরম পরিবেশ গরম এককাপ চা পেয়েছি ব্যাস। তোমরা এত কাজের মাঝখানে আমাদের নিয়ে আর একটুও চিন্তা করতে হবে না। যাও তুমি ওদিকের কাজকর্ম দেখ।”
গোবিন্দ চলে গেল হাসিমুখে। পরমুহুর্তে অর্জুন এসে হাজির। প্রণাম সেরে বলল, “কেমন আছেন স্যার, কেমন আছেন কাকিমা?” মাথায় হাত রাখলাম ওর। “গোবিন্দদা বলেছে, আপনাদের খেয়াল রাখতে, আপনাদের যাতে কোন অসুবিধা না হয় দেখতে। যখন যা দরকার মনে হবে আমায় বলবেন। আমি আপনাদের এই বোটেই সামনের ঘরে থাকব।”
অনিমেষ বলল, “অর্জুন তোমাদের এই পুজো উপলক্ষে অনেক কাজ, তুমি তোমার কাজ কর গিয়ে, আমরা আমাদের খেয়াল রাখতে পারব।”
অর্জুন তবু বোটের ছাদে একটা আসন পেতে বসে রইল আমাদের পাশে।
কলকাতা থেকে গোসাবা হয়ে বোটে করে যখন নেতিধোপানী ঘাটে এসে পৌছলাম, তখন ঝক্ঝকে দিন। ঘাটে ওঠার নড়বড়ে গরাণকাঠের জেটিটা। নতুন করে সারানো শুরু হয়েছে। জঙ্গল থেকে বহুদূরের গ্রামের জনাদশবারো শ্রমিক এসেছে তাদের তল্পিতল্পা নিয়ে। ওরা এখানে অস্থায়ী তাঁবুতে রাত্রিবাস করবে।
নেতিধোপানীর জঙ্গলে এই বনবিবি পুজোকে কেন্দ্রে করে হিন্দু মুসলমান মায় সব ধর্মের মানুষের উৎসাহের অন্ত নেই। এখানে দেবী নাকি খুব জাগ্রত। যাঁরা জঙ্গলে কাঠ, মধু, মাছ সংগ্রহ করতে যান তারা তো বটেই। এছাড়া যাঁরা যান না তাঁরাও আসেন এখানে নৌকো বা ডিঙি নিয়ে নিজের সাধ্যমত পূজা চড়াতে। এখানে সর্বধর্মসম্মেলনে সকলের যৌথ বিশ্বাস একটাই, মা বনবিবি জঙ্গলের মানুষের রক্ষাকর্ত্রী। আসলে, যে জঙ্গল রয়েল বেঙ্গলের আস্তানা, ঘন জঙ্গলে যেখানে মানুষের তৈরি অস্ত্র দিয়ে নিজেকে রক্ষা করা যায় না, সেখানে ভরসা একমাত্র জঙ্গলের দেবদেবী।
বিশালাক্ষী, বনবিবি, দক্ষিণরায়, দুখে সবার পূজো হবে ঐ একই দিনে। আসবে গ্রাম গ্রামান্তর থেকে হাজার হাজার মানুষ। এখানে আসার জন্য কাউকে নিমন্ত্রণ করতে হয় না। সকলে নৌকো বোঝাই হয়ে আসেন পুজো বা সিন্নি চড়াতে। তারপর খিচুড়িভোগ খেয়ে আবার সেইদিনই ফিরে যান তাত্ষরা দিনের আলো থাকতে থাকতে যে যার গাঁয়ে।
দিন কথাটা এই জন্য ব্যবহার করলাম, এখানে প্রচন্ড বাঘের উৎপাত। নভেম্বর ডিসেম্বরে হামেশাই শোনা যায় এদের গর্জন যা শুরু হয় দুর্গাপুজোর সময় থেকে।
শ্রমিকরা আসে লোকালয় থেকে। তাদের এই ভয়ঙ্কর ডাক শোনার অনভ্যস্ত কানে তা ভয়ের সঞ্চার করে। সূর্য অস্ত যাওয়ার আগেই সকলে তাই হাত পা ধুয়ে উঠে আসে কাজ ছেড়ে ঘেরা নিরাপদ জায়গায়।
তবে ওদের কর্মকান্ড চলার সময় সারাক্ষণ ফরেস্ট স্টাফেরা কেউ না কেউ বন্দুক নিয়ে ওদের মনে সাহস যোগাতে সঙ্গে থাকেন। মন থেকে ভয় তবু যায় না- কারণ ওরা বনাঞ্চলের মানুষ। এদের প্রত্যেকের পরিবারের কেউ না কেউ জঙ্গলে মধু, কাঠ, মাছ সংগ্রহে এসে বাঘের হাতে প্রাণ দিয়েছে। এরা যতদিন জঙ্গল থেকে বাড়ি ফিরে না যায়, এদের পরিবার সিঁদুর,তেল,সাবান ব্যবহার করে না, এমনকি খাদ্যেও তেল ব্যবহার করে না। তবে কাজে এসে ভাল পারিশ্রমিক পায় বলে এখানে কাজের লোকের অভাব হয় না। যে কদিন ওরা জঙ্গলে থাকে বনকর্মীদের সঙ্গে, একে অপরকে পরম আত্মীয় বলে মনে করে।
অনিমেষ চা শেষ করে বলল, “চল একটু জেটির দিকে যাই। দেখে আসি কাজ কতদূর এগোলো।”
তড়াক করে লাফিয়ে উঠল অর্জুন, “হ্যাঁ স্যার তাই চলুন। কাজও দেখবেন আর নদীর ওপারে তেনার (বাঘ) দেখাও পেতে পারেন। এপারে আমাদের অফিসের ঘেরির বাইরে একটা বাঘিনী আছে। লেবাররা কাজ করছে তাই ও-পারের বাঘটা ইচ্ছেমত বাঘিণীর কাছে আসতে পারছে না। সে কী তার হুঙ্কার স্যার!
“আমাদের তবু জঙ্গলে থাকতে থাকতে অভ্যাস হয়ে গেছে। কিন্তু লেবারদের তো এমন ভয়ঙ্কর ডাক শোনার অভ্যাস নাই তাই বাঘের হুঙ্কার শুনলেই কাজ ছেড়ে সব কাদামাখা অবস্থায় যন্ত্রপাতি ফেলে থুয়ে ডাঙায় পালিয়ে আসে। আমরাও সতর্ক থাকি স্যার, কিন্তু বাঘের তো এখন আমাদের দিকে নজর নেই। দরকার এখন শুধু ওর বাঘিনীর।”
এ কথা বলে অর্জুন মাথা নিচু করে যেন কথাটা আমাদের শুনিয়ে ও অপরাধ করে ফেলেছে।
অল্প শিক্ষিত হলেও এই সব বনকর্মীরা জঙ্গলে থাকতে থাকতে নদী, জঙ্গল ও বন্যপ্রাণী সম্পর্কে ও তাদের আচার আচরণের উপর যা দখন তৈরি করেছে, সে-সব দেখেশুনে অবাক হতে হয়। এসব ওদের শিখতে হয় না, চাক্ষুষ প্রত্যক্ষ করতে করতে জঙ্গলের সবকিছু ওদের নখদর্পণে। এখন অর্জুন নেতিধোপানী সম্পর্কে যে সব জ্ঞান অর্জন করেছে তা আমাদের উপর বর্ষণ করতে পেরে ওর ভাল লাগছে। আমাদেরও। অনিমেষ ওর কথা শুনছে আর মুচকি মুচকি হাসছে।
সেই কুড়ি বছর বয়েস থেকে অনিমেষ জঙ্গলে আসছে। সুন্দরবনে এমন কোন দ্বীপ নেই যেখানে ও বারবার আসেনি। বাঘের ভয়কে উপেক্ষা করে নিজে পায়ে হেঁটে স্টাডি করেছে জঙ্গলে প্রতিটা ইঞ্চি মেপে। কখনও বাঘ কখনও কুমির বা লবণাম্বু উদ্ভিদের চরিত্র ও নদী খাঁড়ি।
এখন তাই ছেলেমানুষ নতুন চাকরিতে জয়েন করে অর্জুনের জঙ্গল পর্যবেক্ষণ ওকে মুগ্ধ করছে। সাহসী, চালাকচতুর সরল অর্জুনকে আমরা দুজনেই খুব পছন্দ করতে শুরু করলাম।
আজ জেটির কাজ প্রায় শেষের দিকে। ভাঁটার নদীতে জল এখন অনেক নীচে। পলির কাদায় দাঁড়িয়ে নানা কসরতে শ্রমিকরা জেটির জন্য খুঁটি পোতার কাজে ব্যস্ত। অভিজ্ঞ গোবিন্দ তাদের এ ব্যাপারে নানারকম পরামর্শ দিচ্ছে।
আমি অবাক হয়ে জেটি তৈরির ব্যাপার স্যাপার মন দিয়ে দেখছিলাম। গোবিন্দ আমাদের দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে একজন লেবারকে দুটো চেয়ার আনতে বলল। হুকুম শেষ হবার আগেই দৌড় দিল অর্জুন। গোবিন্দ হাসতে লাগল।
বললাম, “এবার দেখছি নেতিধোপানীর ছেলেগুলো খুব কাজের।”
শুনে গোবিন্দ বলল, “হ্যাঁ কাকিমা। কাজের করে নিতে হয় নইলে এই নির্বান্ধব পরিবেশে অবাধ্য লোকজন নিয়ে টিকব কী করে?”
ইতিমধ্যে অর্জুন এল তিনটে চেয়ার নিয়ে। গোবিন্দ চলে যাচ্ছিল। অর্জুন বলল, “কোথায় যাচ্ছ? চা বলেছি।”
“সবার জন্য বলেছিস?”
অর্জুন সম্মতি সূচক মাথা নাড়ল।
তারপর কর্মরত লেবারদের দিকে তাকিয়ে গোবিন্দ বলল, “এই ঠান্ডায় বড় পরিশ্রমের কাজ। কাকা তোমরা হাত পা ধুয়ে উঠে এস, চা আসছে।”
কাজের সময় কাজের পক্ষপাতী আমি। কিন্ত এখন এই নরম আলো মাখা বিকেলের সঙ্গে অপার সুন্দর প্রকৃতিকে যেন একটু একলা পেতে ইচ্ছে করছিল।
চা এসে গেছে, কর্মীরাও একে একে কাজ ছেড়ে উঠে আসছে আজকের মত। কিন্তু পাশে অনিমেষ নেই। ওর চেয়ার খালি।
গোবিন্দ বলল, “স্যার নিশ্চয়ই কোন কাঁকড়া বা পোকা-মাকড়ের ছবি নিতে গেছে।” একজন শ্রমিক বলল, “বাবু সাঁকোর নিচে তারকেলের (গোসাপ) ছবি তুলতে গেছে। আমি উনাকে চিনি, আমাদের গেরামে অনেকবার দেকিচি। উনি মান্ষের ছবি তুলেন না, সব আজিবাজি জিনিসের ফটক তুলেন।
গোবিন্দ ধমক দিল, “আজিবাজি, জানিস তুই? চা-বিস্কুট খা দিকিনি।”
দেখি এমন সময় অর্জুনকে সঙ্গে নিয়ে অনিমেষ চলে এসেছে। গোবিন্দ বলল, “এখানে তো এখন water monitor খুব বেড়ে গেছে।” একজন শ্রমিক বলল, “কী বেড়ে গেছে?” অনিমেষ বলল, “গোসাপ। যাকে তোমরা তারকেল বল।”
শ্রমিক খুশির গলায় বলল, “হ্যাঁ বাবু দুটোকে চরতি দেকিচি।”
অনিমেষ বলল, “পাঁচটা আছে, তিনটে বাচ্চা।”
গোবিন্দ বলল, “আমরা চারটেকে দেখেছি। কিন্তু পাঁচটা তো চোখে পড়েনি!” এরপর অর্জুনের দিকে চেয়ে বলল, “দেখেছিস? এই হল আমাদের স্যার।”
শ্রমিকরা অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে দেখে গোবিন্দ হয়ত আরও কিছু বলার জন্য উৎসাহ পেল, “আমরা স্যারকে কি আর এমন খাতির করি? যখন টাকা তুলতে কলিকাতায় উনার ব্যাঙ্কে যাই, উনি আমাদের কোনদিন না খাইয়ে ছাড়েন না। আমি তো উনাকে বড় ভাই (দাদা) ছাড়া আর কিছু ভাবতে পারি না।”
ক্লান্ত কুলিরা বনের পাড়ে বসে অবাক বিস্ময়ে কিছু বুঝে কিছু না বুঝে হাঁ করে তাকিয়ে আছে গোবিন্দর দিকে। গোবিন্দ আর অর্জুনের মুখে যেন কিছুটা গর্বের ছোঁয়া।
অনিমেষ বলল, “তুমি ওকে চেন না, একা একা সুন্দরবনে ডিঙি নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। ভয় পায়নি, আসলে নদীর পাড় ছেড়ে এখন উঠতে চাইছে না।
অগত্যা উঠতে হল। গোবিন্দ বলল, “জানি স্যার। কাকিমাকে আমি চিনি না? সেবার বাগনায় আরবেসীতে যখন ঝড় উঠল, তখন আমরা কজন বনকর্মী আর আপনারা দুজন স্পিডবোটে। নদীতে প্রবল তুফান। আমি তখন বাগনার অফিসের বোটম্যান(মাঝি)। বোট যত এগিয়ে নিয়ে যেতে চাই, তত ঝড়ের ধাক্কায় বোটের মুখ লাফিয়ে উঠে পিছনে ঘুরে যায়। ভাবলাম যাঃ! এবার হয়ত গাঙেই সমাধি হবে আমাদের। হাত পা ঠক ঠক করে কাঁপছে আমার। বোট আমার সঙ্গে বেইমানি না করলেও ভয়ের কারণ স্টিয়ারিং ঠিক ভাবে না ধরতে পারার কারণে বিপদ একটা কিছু হবেই হবে। ওরে বাব্বা! তখন সামনে তাকিয়ে দেখি, মাথায় ওড়না জড়িয়ে স্পিডবোটের সামনে চেয়ারে কাকিমা চুপ করে বসে আছে। ব্যাস! সাহস পেলাম মনে। কথায় আছে না, একজন চালকের পাশে বসে যেমন ঘুমোতে নেই তেমনি ভয়ও পেতে নেই। ভয় পেলে চালকও বেসামাল হয়ে যেতে পারে।
“আমাদের বড় বড় কর্তারা তো ঝড় উঠলে নদীতে খুব ভয় পান। আমি তখন বোটম্যানের চাকরি বাঁচাব না বড়কর্তা সামলাব? আবার সেই সময় উনারা আমাকে ধমক ধামক ও দেন, যেন নদীকে খেপিয়েছি আমি। যত দোষ সব আমার।
“তা যা বলছিলাম। সেদিন বুঝলাম কাকিমা কেমন সাহসী মেয়ে। এদিকে আমরা তো তখন তুফানের দাপটে আর গাঙের বড় বড় ফুলে ওঠা ঢেউয়ের ঠেলায় পড়ে সবাই ভিজে একশা! সেদিনের জোয়ারে গাঙের জলও খুব বেড়েছিল। নদীতে জল তখন কত বাঁও তা বলতে পারব না।” এই বলে সে অনিমেষের মুখের দিকে ও তাকাল জিজ্ঞাসু দৃষ্টি নিয়ে।
অনিমেষ বলল, “সেদিন ষাঁড়াষাড়ির গন ছিল।”
“হ্যাঁ স্যার মনে পড়েছে, আমি পঞ্জিকা না দেখেই বোট নিয়ে বেরিয়েছিলাম। ওঃ স্যার কত্ত কিছু মনে পড়ছে আস্তে আস্তে! সে কী আজকের কথা, স্যার বলুন না প্রথম থেকে সেদিনের ঘটনাটা!”
অনিমেষ আমার দিকে তাকাল। জঙ্গলের আবছা অন্ধকারে আমরা তখন রাতের আস্তানার দিকে পায়ে পায়ে এগিয়ে চলেছি।
“গল্প বলাটা আমার আসে না। মনেও থাকেনা সবসময় সবকিছু। তোমার কাকিমাকে বল। ঘটনাটা তো ওর উপস্থিতিতেই ঘটেছিল, ও বেশ ভালো বলতে পারবে।”
অন্ধকার ক্রমে ঘনিয়ে এসেছে। ভয় নামক জিনিসটা মাঝে মাঝে যে কত সুখকর তা জঙ্গল প্রকৃতির মধ্যে ডুবে না যেতে পারলে অনুভব করা সম্ভব নয়। তবে সেটা অবশ্য বিপদমুক্ত হওয়ার পর অনুভূত হয়।
বোটের ছাদে তখন গরম গরম বেগুনির উৎসব। আগেই বলেছি এবারে এখানে পুজো উপলক্ষে নিরামিষ আয়োজন।
বেগুনি এত গরম যে থালার উপরেও যেন ফুটছে। অর্জুন থালাটা আমার সামনে ধরে বলল, “গল্প পরে হবে কাকিমা, বেগুনিগুলো সব ঠান্ডা হয়ে যাবে। আপনার পাত্রে তো মশলা মুড়িও প্রায় শেষ।”
আপত্তি না শুনে থালায় কিছুটা মুড়িও ঢেলে দিল। বললাম, “এতো দেখছি ভারী বিপদ! এখানে বাঘকে ভয় পাব না তোমাকে? এতসব রান্নার গন্ধ পাচ্ছি! রাতে খাব তো? নাকি মুড়ি-বেগুনি খেয়েই শুয়ে পড়ব?”
“রাত এখনো অনেক বাকি কাকিমা। থাকবেন তো মাত্র দুটো তিনটে রাত। ঘুমুলে হবে? আমরা ছাড়ব কেন? ঘটনাটা শুনব না? যেটা স্যার আপনাকে বলতে বললেন? আচ্ছা কাকিমা ষাঁড়াষাড়ির গন না কী যেন বললেন স্যার, সেটা আবার কী গন?”
রাত এখনও নিশুতি নয়। শীতের সন্ধে সাড়ে সাতটা মত হবে। এই আড্ডা যেমন আকর্ষণীয় তেমনি অনাবিল এই জঙ্গুলে নিস্তব্ধতা। বেড়া ঘেরার ফাঁক দিয়ে কে যেন বার বার দেখে যাচ্ছে আমাদের। আমি আনমনা হয়ে মাঝেমাঝে কোথায় হারিয়ে যাচ্ছি।
“তখন বর্ষাকাল,” শুরু করলাম। ষাঁড়াষাড়ির বান আসার গল্প এটাকে গল্প না বলে লোকগাথাও বলা যায়।
গল্প শুরুর আগে দেখি একতলা অফিস ঘরটার নীচে যেখানে অপ্রয়জনীয় প্রচুর কাঠ জমে আছে। অন্ধকারে কাঠের আগুনে রান্না করছে জেটি তৈরির শ্রমিকরা। কালো কালো আস্পষ্ট তাদের অবয়বগুলো দেখে বেশ বোঝা যাচ্ছে, ভয় পেয়ে রয়েছে ওরা। বারবার তাকাচ্ছে মাত্র হাতদুয়েক উঁচু জঙ্গলের দিকে গরাণের বেড়াটার দিকে। অভিজ্ঞতা ওদের ভয় পাওয়াচ্ছে।
ওদের ভয় কিছুটা ভাঙানোর জন্য বোটের ছাদ থেকে গলা চড়িয়ে ডাকলাম, “কাকা গল্প শুনবে তো এস।”
একমুখ হেসে উঠে দাঁড়াল চেহারায় পোড় খাওয়া বয়স্ক দৃঢ় মানুষটা, “মাগো বড্ড খিদা নেগেচে, দিনমান ধরি কাজ সেরি ঘুমও ধরিচে খুব গো মা, তোমরা অনেক দিনের পরে গে এয়েচ গল্পসল্প কর। আমরা চাড্ডি খেনিয়ে এট্টু ঘুমুই। কাল মাত্তর ঘন্টা দুয়েকের কাজ বাকি আচে। আজ তেনার হুঙ্কার শুনি তো উঠি পড়তি হল। কাল আবার আমরা ঘরে যাব। অনেকদিন হল মা ঘরছাড়া। কিছু মনে করনি মা।” অনুনয়ের সুরে বলল কাকা।
গোবিন্দ বলল, “না না কাকা। তোমরা দুটো মুখে দিয়ে শুয়ে পড়। কাল ভোর ভোর উঠে কিন্তু কাজ শেষ করতে হবে। আর হ্যাঁ জঙ্গলের পরিস্থিতি তো দেখছ, একটু সজাগ থেক। হ্যঁ কাকিমা বল-”
“আশ্বিন মাস। শিবদুর্গা বসে আছেন। বাইরে চলেছে প্রবল ঝড় আর তুফান। দেবী শিবকে বললেন, ‘আমি একটু নদীর সঙ্গে খেলা করব। স্নান করব, সাঁতার কাটব।”
শিবের অনুমতি পেয়ে দুর্গা নামলেন নদীতে। উথাল-পাথাল জলরাশিতে খেলা করার সময় দেবী দুর্গা হারিয়ে ফেললেন তাঁর নাকের সোনার নথ। কাঁদতে কাঁদতে শিবকে জানালেন তিনি। বললেন, ‘নথ হারিয়ে ফেলেছি নদীতে, এক্ষুনি তা খুঁজে এনে দাও।’ শিব জলে নেমে জল তোলপাড় করে দেবীর নথ খুঁজতে লাগলেন।
“সেই সময় তাঁর আকৃতি ও শক্তি রূপ নিল শক্তিধর ষাঁড়ের মত। নদীর জল বাঁধ ছাপিয়ে ঢুকে পড়ল ফসলের জমিতে ও গ্রামের কুঁড়েঘরগুলোর ভিতরে। মানুষ বানভাসি হল। কিন্তু অবশেষে শিব খুঁজে পেলেন দুর্গার নথ। হাসি ফুটল দুর্গার মুখে। নদী সরে গেল তার নিজের জায়গায়।কোটালের এই গনের নাম তাই ষাঁড়া-ষাঁড়ির গন।”
“ওরে বাব্বা এ গল্প তো আগে কখনও শুনিনি! এ-সব তো আমরা জানি না। শুধু জানি ঐ গনে খুব বান আসে। বড় বান।”
অর্জুনের কথার উত্তরে গোবিন্দ বলল, “এখন জেনে রাখ।”
ষাঁড়াষাঁড়ির গলকে নিয়ে এবার নিজেদের মধ্যে যে যতটুকু এই গলার বিষয় জানে তা নিয়ে তর্ক-বিতর্ক ও আলোচনা শুরু হয়ে গেল। লস্ফের টিমটিমে আলোয় শ্রমিকরা খেতে বসে এই চেঁচামেচি শুনে কিছুটা স্বস্তি পেল।
ততক্ষণে প্রায় দেড় কিলোমিটার নদী পেরিয়ে আমরা যেখানে বসে আছি নেতিধোপানীর ঘাটের পাড়ে তার বাঘিনীর খোঁজে পৌছে গেছে বিশাল এক রয়েল বেঙ্গল।
বাঘিনীর খোঁজ সে এপারে পৌছেই পেয়ে গেছে. কিন্তু পেটের ভিতর খিদেটা এতগুলো মানুষ চাক্ষুষ করার পর দ্বিগু বেড়ে তা শিরা-উপশিরা বেয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে।
কিন্তু পিছনের বেড়াটা ছোট হলেও সামনের বেড়াটা, যেখান থেকে মানুষগুলো সহজলভ্য, তা একটু বেশি উঁচু ও লোহার তৈরি। বাঘটা নিজেকে আড়ালে রেখে একবার ডানদিক একবার বাঁদিকে পায়চারি করতে লাগল। আমরা তা জানতেও পারলাম না।
সে রাতের মত শ্রমিকরাও রক্ষা পেয়েছিল এবং অক্ষত অবস্থায় ঘরে ফিরতে পেরেছিল। পরদিন বনবিবির পূজো শেষে একরোখা জেদি বাঘের হাত থেকে আমরা সবাই রক্ষা পেয়েছিলাম কি?
এরপর পরের সংখ্যায়