বাঘের রাজ্যে- জিম করবেট টাইগার রিজার্ভ
অলোক গাঙ্গুলি
মহারানির মুখোমুখি
‘পায়ে পড়ি বাঘ মামা, করোনাকো রাগ মামা, তুমি যে এ পথে কে তা জানতো’
মনে পড়েছে নিশ্চয়, বাঘের সামনে পড়ে গুপি বাঘার কী অবস্থা হয়েছিল! আর ঠিক সেই মুহুর্তে গুপির গলা দিয়ে এই গান কাঁপতে কাঁপতে বেরোল। ঠিক একই পরিস্থিতির মধ্যে আমাদেরও পড়তে হয়েছিল। জিপ গাড়িতে আমরা পাঁচজন বসে আর সামনে বাঘ, তাও আবার পাঁচ মিটারের মধ্যে, একবারে থরহরিকম্প, ইশ্বর ভরসা ছাড়া উপায় নেই।
জেনেই এসেছিলাম যে জিম করবেট অভয়ারণ্যে বাঘ দেখার সু্যোগ যথেষ্ট রয়েছে কারণ এ হল গিয়ে টাইগার রিজার্ভ অর্থাৎ ব্যাঘ্র সংরক্ষণ প্রকল্পের আওতায় পড়ে। আর এ-ও জেনেছি যে এখানকার বাঘেরা মানুষখেকো নয়।
প্রথম ক্ষণ থেকেই বাঘ দেখার বিভিন্ন পরিস্থিতির অবস্থা তৈরি। রামনগর রেল স্টেশন থেকেই আমাদের জিপের চালক ও গাইড, রশিদ আমাদের সঙ্গী। আমি ওকে জানালাম যে সুন্দরবন থেকে ডুরার্সের বক্সা, জলদাপাড়া, গোরুমারা আরো অনেক জঙ্গল চষে ফেলেছি কিন্তু বাঘমামার দেখা মেলেনি। রশিদ আশ্বস্ত করল এখানে ও আমাদের বাঘ দেখিয়েই ছাড়বে।
ভোর চারটে, অন্ধকার তখন কাটেনি। স্টেশন থেকে আমাদের গন্তব্য বিজরানি গেট, মাত্র এক কিলোমিটার। রেস্ট হাউস আগেই অনলাইন বুক করা ছিল, পৌঁছাতে বেশি সময় লাগল না। রশিদ জানাল, মালপত্র রেখে এখনই বেড়িয়ে পড়তে, স্নান খাওয়া ফিরে এসে হবে। তাই আর বিলম্ব না করে ক্যামের কাঁধে নিয়ে জিপে উঠে পরে সোজা জঙ্গলের দিকে প্রস্থান।
জিপ বেশ গতিতেই এগিয়ে চলল। একটা জলের ধারা পেরিয়ে গাড়ি উঠে পড়ল একটা ছোট পাহাড়ি টিলার উপর দিয়ে। চারদিকে বেশ গভীর অরণ্য, নানা প্রকারের পাখির ডাক শুনতে পাচ্ছি। দূরে এক গাছের ডালে রশিদ দেখাল এক পাখি। অনেকটা ঈগল পাখির মতন দেখতে। ক্যামেরার লেন্সে ধরা দিল এবং চট করে বন্দি করে নিলাম।
রশিদ ইতিমধ্যে হঠাৎ করে গাড়ি ঘুরিয়ে নিল আর ফিরে গেল সেই জলের ধারার দিকে। দেখি গিয়ে এর মধ্যেই ওখানে আরো তিনটে গাড়ি জড়ো হয়ে গেছে। পাশের গাড়ির চালক আঙুলের নির্দেশে বোঝাল জলের দিকে কিছু আছে।
উঠে দেখামাত্র চোখে পড়ে গেলো জঙ্গলের রাজাকে। জল খেয়ে ধীরগতিতে সে বনের ভিতর প্রবেশ করে গেল। খানিক বিরক্ত তো বটেই! এরা আবার কারা এসে জড়ো হল এখানে! কপাল খারাপ, ব্যাপারটা এত দ্রুতগতিতে হল যে ক্যামের তাক করার সুযোগই পেলাম না। রশিদ জানাল যে এখানে আর অপেক্ষা করে লাভ নেই, ও এখন ওই ঝোপের মধ্যেই দিন কাটিয়ে দেবে। আমরা বরং জঙ্গল ঘুরে দেখি।
একটু হতাশ হলাম, এত কাছে এসেও কত দূরে রয়ে গেলাম। তবুও চোখ সার্থক আমাদের, মনের ক্যামেরায় বন্দি করে ফেলেছি তাকে।
রশিদ দেখিয়ে চলেছে বিজরানি বলয়ের অভয়ারণ্যের বিভিন্ন দিক, কখনো ঘন অরণ্য তো আবার কোথাও বিস্তীর্ণ ঘাসভুমি আর তার মধ্যেই বিচরণ করে বেড়াচ্ছে একদল হরিণ। আমাদের হঠাৎ উপস্থিতিতে তারা হতচকিত এবং ভিতও বটে। দেখে মনে হচ্ছে ওরা একবারে তটস্থ! যেকোন পরিস্থিতির মোকাবলার জন্য তৈরি। কিন্তু ওরা বোঝেনি যে আমরা কেবল মাত্র ওদের দর্শনপ্রার্থী।
ভীষণ ভাল লাগছিল সব কিছু। কিন্তু তবুও মনটার মধ্যে কেমন যেন একটা খচখচ করে যাচ্ছিল, কী যেন একটা পাইনি। রশিদ বুঝতে পারছিল আমার মনের ব্যথা আর মুচকি হাসছিল।
ইতিমধ্যে আমরা ফরেস্ট রেস্ট হাউসে ফিরে এসে দুপুরের স্নান আহার সেরে আবার জঙ্গলের উদ্দেশে রওনা দিয়েছি। আমি আমার প্রাণ ভরে পাখির ছবি তুলছিলাম, শীতের বেলা, কত রকমের পাখি, সবই হিমালয় অঞ্চলের, সুন্দর সুন্দর প্রজাতির।
রশিদ, আমাদের গাইড, অনেকটা এখানকার জীবজন্তুদের মতন, বোধহয় ওর একটা আলাদা রকমের ঘ্রাণশক্তি আছে। হঠাৎ বলে কিনা, “বসে পড়ুন, একটা কিছু হতে চলেছে।”
ওর কথা শুনে তো শিরদাঁড়া হিম হওয়ার মতন। কী আবার দেখে ফেলল কে জানে! আমি চারদিক তাকিয়ে দেখছি, কই কোথাও তো কিছু দেখতে পেলাম না! গাড়ি আবার ছুটে চলল। খানিকটা গিয়েই থেমে গেল। আমাদের দু’চোখ ছানাবড়া। দেখি সামনে দিয়ে মেজাজে হেঁটে আসছে বিজরানির রাজা। রশিদ আমার ভুল ভাঙালো, রাজা নয় রানি, এ যে বাঘিনী। একবার মনে হল আমাদের সরাসরি দেখল, তারপর গাড়ি থেকে মাত্র ১০ মিটার দূরত্বে এসে বসে পড়ল।
বেশ কিছুক্ষণ ওইভাবে কাটল। রশিদ বলল যা ছবি তোলার তুলে ফেলুন, এ সুযোগ আর জীবনে পাবেন না। ঠিক তাই, খোলা জঙ্গলে সামনে বাঘিনী, কে পায়! রশিদের কাছেই জানলাম যে এই বাঘিনীর বয়স আনুমানিক ১১ বছর, অর্থাৎ যথেষ্ট বয়স্কা। ওর চার সন্তান, দুটি মেয়ে আর দুটি ছেলে। তাদেরও আবার দুটি করে সন্তান। তাই একে আর কেবল রানি বলে সম্বোধন করা চলে না, ও হল গিয়ে বিজরানীর মহারানি।
ভৌগোলিক অবস্থান
হিমালয়ের শিবালিক পর্বতমালার পাদদেশে, উত্তারাখন্ডের রামনগরে, রামগঙ্গা নদীর তীরে অবস্থিত জিম করবেট টাইগার রিজার্ভ। ১৯৭৩ সালে বিখ্যাত শিকারি জিম করবেটের নাম অনুসারে জঙ্গলটার নামকরণ হয়। করবেট ছিলেন নৈনিতালেরই বাসিন্দা। আগে এটার নাম ছিল হেইলি জাতীয় উদ্যান ও পরে রামগঙ্গা রিজার্ভ ফরেস্ট। পরে তা বর্তমান নাম পেয়েছে। আয়তন আনুমানিক ৫২০ বর্গ কিমি। নৈনিতাল, আলমোড়া, পৌরিগাড়োয়াল নিয়ে তৈরি হয় জিম করবেট ন্যাশনাল পার্ক। বাঘ সংরক্ষণের জন্য বিখ্যাত। আগের শুমারির তুলনায় এ বছর বাঘের সংখ্যা বেড়েছে । জুলাই থেকে সেপ্টেমবার মাস পর্যন্ত এখানে ভারি বৃষ্টি হয়। সেই সময় জঙ্গলও বন্ধ রাখা হয়। পর্যটকের সংখ্যা এখন বছরে প্রায় ৭০০০০ উপর ছাড়িয়ে যায় বলে জানা গেলো।
বিজরানি ফরেস্ট রেস্ট হাউস
জিম করবেট টাইগার রিজার্ভে থাকতে হলে আগে থাকতেই অনলাইন বুকিং করতে হয়। জঙ্গলে প্রবেশের সময় একটা সচিত্র পরিচয়পত্র পেশ করতে হয় যার উল্লেখ অনলাইন বুকিং-এর সময় দিতে হয়। আমরা প্রথমে অবশ্য ঢিকালা অঞ্চলের জন্য চেষ্টা করেছিলাম কিন্তু ওখানে স্থান পাওয়া যায়নি তাই বিজরানিকে বেছে নিতে হল। ঢিকালা শোনা যায় বাঘ দেখার জন্য অতি উত্তম স্থান যার জন্য ওখানে পর্যটকদের সংখ্যা অনেক বেশি। ঢিকালা না পাওয়ার জন্য মনটা খারাপ ছিল আমাদের। পরে অবশ্য বিজরানি থেকে যা পাওয়া গেল তার একটা বিবরণ আগেই দিয়ে দিয়েছি। তারপর আরে কোনো খেদ নেই।
বিজরানির ফরেস্ট রেস্ট হাউসটা চমৎকার। এখানে সব কিছু প্রাকৃতিক নিয়ম মেনে করা হয়েছে। রেস্ট হাউসে কোন বিদ্যুৎ সংযোগ নেই। সব ব্যাবস্থা সৌরশক্তি দ্বারা করা হয়ে থাকে। তাই এখানে আসার আগে সঙ্গে করে অবশ্যই একটা সৌরশক্তিচালিত পাওয়ার ব্যাঙ্ক রাখা দরকার।
এখানে থাকার সুবাদে আমার পরিচয় কিছু বন্যপ্রাণী চিত্রগ্রাহকদের সঙ্গে হয়েছিল। তারা কিন্তু বিজরানিকেই উপযুক্ত বাঘ দেখার অঞ্চল বলে দাবি করে। পরে আমার অভিজ্ঞতাও তাই বলে। রেস্ট হাউস চত্বরে রয়েছে একটা ওয়াচ টাওয়ার। গাছের ওপর বানানো। কাঠের সিঁড়ি বেয়ে উঠে চার পাশের দৃশ্য ভালো করে দেখা যায়। রেস্ট হাউসের চার ধার বেড়া দিয়ে ঘেরা যেটা রাতে বিদ্যুৎ সংযোগ করে দেওয়া হয় যাতে বন্য পশু, বিশেষ করে হাতি, কোনো রকম ক্ষয় ক্ষতি না করতে পারে।
বিজরানির জঙ্গল
বিজরানির ফরেস্ট রেস্ট হাউসে প্রবেশ করতে গিয়েই প্রথম দেখা পেলাম এক শিয়ালের। একবার অচেনা অতিথিদের দেখেই ঘন ঝাড়ের মধ্যে ঢুকে গেল।
জঙ্গলে যেতে প্রথম দেখা দিল এক বার্কিং ডিয়ার। সে ফ্যাল ফ্যাল দৃষ্টিতে আমাদের দিকে চেয়ে থাকল। ভোরের জঙ্গলের এক অন্য রূপ দেখতে পেলাম এখানে এসে। এমনিতেই হিমালয় পর্বতের বন্য পরিবেশ সবসময়ের জন্য দৃষ্টি আকর্ষক, যেমন আমাদের ডুয়ার্স, সত্যিই অনবদ্য। করবেটের ঘাসভুমিতে ভোরবেলার সুর্যের যখন প্রথম আলো এসে পড়ল, সে এক অপরূপ দৃশ্য। দূরে শিবালিক পর্বতশ্রেণির দিক দিয়ে এক জলের ধারা নেমে আসছে আর সেখানে বিচরণ করে বেড়াচ্ছে কিছু চিতল হরিণ। একটু শব্দ পেলেই সজাগ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। মনে হচ্ছে সোনার জমির উপর কিছু সোনার হরিণ অবাক হয়ে দেখছে কিছু অনুপ্রবেশকারিদের তাদের বিচরণ ক্ষেত্রে।
এক গাছের ডালে দেখলাম একদল কিছু রঙিন টিয়াপাখি। এদের ইংরেজি নাম প্লাম হেডেড প্যারাকিট আর বাংলায় বলে ফুলটুসি। পুরুষ পাখিদের মাথার রঙ লাল আর স্ত্রী পাখিদের রঙ ধুসর। একদিকে দেখলাম কিছু মোহনচুড়া অথবা হুপো বলে জানি যেই পাখিকে, ঘাস থেকে পোকা বেছে খেয়ে যাচ্ছিল। এই ঘাসভুমির আবার অন্যদিকে গভীর অরণ্য, যেখানে সুর্যের আলো পর্যন্ত প্রবেশ করেতে পারে না।
অসংখ্য জলপ্রবাহ পেরোতে হয় এই জঙ্গলে। শান্ত পরিবেশে মাঝে মাঝে হঠাৎ করে চকিত করে তোলে বার্কিং ডিয়ারের ডাক। এরা কুকুরের মতন করে ঘেউ ঘেউ করে ডাক দেয়। বাঘের আসার খবর সমস্ত প্রাণিদের এরাই প্রথমে ডাক দিয়ে সজাগ করে তোলে।
অপেক্ষায় রইলাম কিছুক্ষণ তবে রশিদ জানাল যে সম্ভাবনা সেরকম নেই। জঙ্গলে অবশ্য বাঘ দেখাই সব কিছু নয়। বনের শব্দকে উপভোগ করাও এক অত্যন্ত মধুর ব্যাপার। কোনো দিকে আর কোন পর্যটক নেই, নেই অন্য মানুষের উপদ্রব আর এই চমৎকার পরিবেশে নিজেকে সম্পূর্ণরূপে সংযুক্ত করতে পেরে এক চরম আনন্দের অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করে রাখলাম সারা জীবনের জন্য।
রশিদ আমার পাখি দেখার শখের কথা জেনে আমাদের গাড়ি এনে দাঁড় করাল এক রাস্তার ধারে, যার এক পাশে বিশাল ঘাসভুমি আর অন্য দিকে ঘন জঙ্গল। রশিদ অঙ্গুলিনির্দেশ করে এক বিরাট বটগাছ দেখাল। অবাক চোখে দেখলাম গাছে ভর্তি কেবল ধনেশ পাখি, রাজ ধনেশ (Great Hornbill) যাকে বলে। সত্যিই পাখিদের মধ্যে এরাই হল রাজকীয়। সেদিন দুপুরেই সাক্ষাৎ হয়েছিল বিজরানির মহারানির সঙ্গে। আমরা দু’রাত কাটিয়েছিলাম বিজরানির রেস্ট হাউসে। এখার থেকে আমাদের প্রস্থান গৈরালে, যা ঢিকালা বনাঞ্চলের মধ্যে পড়ে।
গৈরাল
গৈরালকে করবেট জাতীয় উদ্যানের পাখিদের স্বর্গ রাজ্য বলা হয়। এখানে পৌঁছানোমাত্র অনেক প্রকার পাখির ডাক শোনা গেলো। স্থানটি অবশ্যই নৈসর্গিক স্বর্গ। একপাশ দিয়ে বয়ে চলেছে রামগঙ্গা নদী, অন্যদিকে শিবালিক পর্বতমালা আর পাশেই ঘন সবুজ বন। এই মনোরম দৃশ্য দেখে মন এখানেই থেকে যেতে চায়। সময়মতন জলখাবার, দুপুরের খাবার, রাতের খাবার আর চাইলেই চা কফি হাজির। তবে খাওয়াদাওয়া আগে থাকতে বলে না রাখলে হবে না। কী খাবার হবে আর কতজন খাবে সেটা আগে থাকতেই কর্তৃপক্ষকে জানিয়ে রাখতে হবে। এখানকার রেস্ট হাউসেও একই নিয়ম, বিদ্যুৎ সংযোগের ব্যাবস্থা সৌরশক্তি দ্বারা আর রেস্ট হাউসের চার পাশের বেড়া বিজরানির মতনই।
আমরা বিজরানি থেকেই সকালের জলখাবার খেয়ে বেরিয়েছিলাম তাই গৈরালে কেবল দুপুর আর রাতের খাওয়ার কথা জানিয়ে আমরা বেরিয়ে পড়লাম। গৈরালের রেস্ট হাউসের মধ্যেই আমি পেয়ে গেলাম অনেক প্রজাতির কাঠঠোকরা পাখি। পেলাম মিনিভেট অথবা বাংলায় বলে থাকি আলতাপরি। ভারি মিষ্টি নাম, দেখতেও খুব মিষ্টি, ডাকও ভীষণ সুরেলা।
গৈরালে নানা পাখিদের ডাক শুনেই মন ভরে যায়। রশিদের ডাকে আমরা আবার রওনা হলাম গৈরাল বনাঞ্চল ভ্রমণের উদ্দেশে। পুরো রাস্তা রামগঙ্গা নদীর তীর ধরে। এক জায়গায় দেখলাম পাঁচিল দিয়ে ঘেরা আর রশিদ সেখানে গিয়ে গাড়ি দাঁড় করাল। আগে নিজে নেমে গিয়ে চার পাশ দেখা আমাদের নামতে বলল। পাঁচিলের গা ঘেষে দাঁড়িয়ে নিচে তাকাতেই দেখলাম নদীর এক পাশে মুখ খুলে পড়ে আছে এক বিশালদেহী কুমির। দূরে একটা কালো বক আপন মনে ঘুরে বেড়াচ্ছে।
খানিকটা এগোতেই উলটো দিক দিয়ে একটা জিপ এসে আমাদের পাশে থামল। ওরা জানাল একটু দূরেই বাঘ দেখা গেছে। রশিদ আর দেরি না করে গাড়ি ছুটিয়ে চলল সেদিকে। একটা হাউসের মধ্যে পড়তেই সেখানকার সব রক্ষীরা ছুটে এসে জানাল যে সামনেই বাঘ আছে।
আমরা তখন উত্তেজনায় রীতিমত কাঁপছি। কিছুটা এগোতেই স্পষ্ট বাঘের গর্জন শোনা গেল। আমরা সেদিকে আরো একটু এগোলাম। আওয়াজ শোনা যায় কিন্তু পশুরাজকে দেখা যায় না। পুরো এলাকা ঘুরলাম। তখনো আমরা ছাড়া আর কেউ নেই। গর্জনের খুব কাছাকাছি এসে থামলাম। কিন্তু সে এক ঝোপের মধ্যে গা-ঢাকা দিয়ে বসে আছে।
কয়েকমিনিটের মধ্যে ডজনখানেক গাড়ি এসে উপস্থিত হল। বাঘ দেখার আশা ছেড়ে আমরা ওখান থেকে বিদায় নিলাম কারণ আমরা জানি এত ভিড়ের মধ্যে সে আর দর্শন দেবে না।
রামগঙ্গা নদীর ধার দিয়ে রাস্তা ধরে এগোচ্ছি, এই রাস্তার নাম হল গিয়ে সাম্বার রোড অর্থাৎ সাম্বার হরিণের পথ। রাস্তার এক ধারে গাড়ি থামিয়ে রশিদ দেখাল বাঘের পায়ের টাটকা ছাপ, ইংরেজিতে বলা হয় পাগ মার্ক, চারটে আঙুল আর পাঞ্জা। এরকম আগে কেবল ছবিতেই দেখেছি আর এবার স্বচক্ষে, নিজের ক্যামেরার লেন্সবন্দি করেও রেখেছি, মহারানির সঙ্গে মহারাজেরও যখন ইচ্ছে হবে ছবি দেখে নেব।
সাম্বার রোডের কিন্তু নাম সার্থক, বেশ ভাল রকম সাম্বার দেখে নিয়েছি এই রাস্তায়। তাছাড়া চিতল হরিণের সংখ্যাও প্রচুর। দুপুরে রেস্ট হাউসে ফিরে এসে লাঞ্চ সেরে আবার এক প্রস্ত বনভ্রমণের জন্য প্রস্তুত হয়ে নিলাম। দুপুরের ভ্রমণে সেরকম উত্তেজনাপুর্বক কোন ঘটনা ঘটেনি তবে গৈরাল অঞ্চলের নৈসর্গিক দৃশ্য সত্যিই মুগ্ধ করে রাখে। রামগঙ্গা নদীকে পাশে রেখে পাহাড়ের ঢাল দিয়ে সুর্য যখন ঢলে যাচ্ছে সেই দৃশ্য ছেড়ে আসতে মন চায় না। এবার গৈরাল ছেড়ে যাওয়ার পালা, পরের গন্তব্য ঢিকালা, জিম করবেট টাইগার রিজার্ভের সব থেকে প্রসিদ্ধ বনাঞ্চল।
ঢিকালা
ঢিকালা অবশ্যই জিম করবেট অভয়ারণ্যের সব থেকে জনপ্রিয় এবং সব থেকে বড় বনাঞ্চল। রামগঙ্গা নদীর তীরে অবস্থিত এই স্থানটি অত্যন্ত মনোরম আর এখানকার ওয়াচ টাওয়ার থেকে সমস্ত জীবজন্তুর দেখা পাওয়া জীবনের একটা বড় অভিজ্ঞতা। এখানকার রেস্ট হাউস অনেক বড় অন্যান্য বনাঞ্চলের রেস্ট হাউসের তুলনায়।
ঢিকালা বন্য প্রাণী আলোকচিত্রকরদের কাছে এক অতি আকর্ষণীয় স্থান। পশুপাখি ছাড়াও এখানকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য অবশ্যই উল্লেখ করার মত। বেলা এগারোটা নাগাদ পৌঁছে এখানকার ওয়াচ টাওয়ার থেকে রামগঙ্গার তীরে বেশ কিছু প্রজাতির পাখি ছাড়াও দেখলাম বুনো শুয়োর, হরিণ, নদীর জলের খুব কাছে পড়ে আছে একটি ঘড়িয়াল আর পরে দেখতে পেলাম দুটো হাতি। মন ভরে গেল। জঙ্গল ভ্রমণ সার্থক হয়েছে আমাদের।
হঠাৎ কোথা থেকে রশিদ হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এসে বলল গাড়িতে উঠতে, কিছু দূরেই নাকি একটা হাতির পাল দেখা গেছে। পড়িমরি দৌড় লাগালাম সকলে মিলে। গাড়িও ছুটল তিরবেগে আর জায়গা মতন পৌঁছাতেই দেখি ঠিক তাই। দুই কি তিন মানুষ সমান উঁচু ঘাসের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে দুটি হাতি আর সমানে মাথা দুলিয়ে যাচ্ছে।
রশিদ আবার দেখাল দূরে দাঁড়িয়ে পুরো হস্তি পরিবার, বাবা, মা, সন্তান সমেত। কী অপুর্ব দৃশ্য! বেশ কিছুক্ষণ ওখানে থেকে উপভোগ করলাম হস্তিদের পাড়া। আচমকা উঁচু ঘাসের ভীতর থেকে এক হাতির ডাক আর তাই শুনে বোধহয় পুরো দলটাই ধীরে ধীরে বাকি দুটোর দিকে এগিয়ে চলল। আমাদের দেখে হয়ত বাচ্চাদের বিপদ বুঝে এই সংকেত।
আমরাও ব্যাপার ভাল না বুঝতে পেরে আসতে আসতে পেছন দিকে গাড়ি ঘুরে রওনা দিলাম রেস্ট হাউসের দিকে। দুপুরের খাওয়া দাওয়া সেরে ফেলে আবার রামনগর রেলস্টশনের দিকে রওনা দেবার পালা।
কথায় বলে যার শেষ ভাল তার সব ভাল। জিম করবেট জাতীয় উদ্যানের শেষ বেলার সফর আমাদের চরম আনন্দে ভরিয়ে দিল। আর কী চাই! আগের দু’বার জঙ্গল সাফারিতে গিয়ে সে-রকম সাফল্য পাইনি আমরা। কিন্তু এবার আমি ঝোলা ভর্তি করে নিয়ে যাচ্ছি। সমস্ত উপাদান পেয়ে গেছি এবারকার সাফারিতে। আর তার জন্য আমি সারা জীবন কৃতজ্ঞ থাকব আমাদের গাইড রশিদের কাছে। ও যেভাবে আমাদের জঙ্গল দেখিয়েছে তাতে যে সাফল্য আসবেই তা জানা ছিল।
বন সংরক্ষণ
বাড়ি ফেরার পালা এবার, মন ভারাক্রান্ত এই সবুজ প্রান্তর ছেড়ে যাওয়ার জন্য। জানি না আবার কোনোদিন এই জাতীয় উদ্যানে ফিরে আসতে পারব কি না, তবে সুযোগ পেলে অবশ্য এসে আবার রশিদের খোঁজ করে ওকে নিয়েই ঘুরব।
কাছের মানুষদের জন্য বেশ কিছু করবেট উদ্যানের স্মারকচিহ্ন সঙ্গে করে নিয়ে যাচ্ছি আর সঙ্গে আছে আমার লেন্সবন্দি কিছু অভিজ্ঞতা ও স্মারক। শেষে শ্রদ্ধা জানাই সেই মানুষটা কে যার নামে এই জাতীয় উদ্যান উৎসর্গীকৃত, এডওয়ার্ড জিম করবেট, যাঁর কাহিনী এখনও গাড়োয়াল ও কুমায়নের মানুষের হৃদয়ের মধ্যে বিদ্যমান। বিশ্বব্যাপী মানুষ জিম করবেটকে বিখ্যাত কাহিনীকার এবং একজন অসাধারণ শিকারি হিসেবে চেনে, যিনি পরবর্তীকালে অনেক কুখ্যাত মানুষখেকো বাঘের সঙ্গে লড়েছেন। তাঁর চারটি জীবনীগ্রন্থ রয়েছে এবং তাঁর জীবন নিয়ে তিনটি চলচ্চিত্র হয়েছে। ইংরেজ বংশোদ্ভূত এডওয়ার্ড জেমস করবেট ১৮৭৫ সালে উত্তরাখণ্ডের নৈনিতাল জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। তিনি তার ছেলেবেলা কাটিয়েছেন চারপাশের অরণ্য ও বন্যপ্রাণীদের মাঝে। ঘন জঙ্গলের মধ্যে তার জীবন অতিবাহিত হওয়ায় জীবজন্তু এবং জঙ্গল সমন্ধে তার গভীর জ্ঞান লাভ হয়।
ক্রমশ তিনি একজন ভাল শিকারীর পাশাপাশি বিস্ময়কর প্রকৃতিবিদ হয়ে ওঠেন। তিনি চমৎকার পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা, দ্রুতগতি, অসম্ভব উপস্থিত বুদ্ধি এবং শারীরিক শক্তির অধিকারী হন। তিনি এত বুদ্ধিমান এবং সক্রিয় ছিলেন যে বনে গেলে তাঁর দৃষ্টিশক্তি, শ্রবণশক্তি এবং গন্ধসহ সমস্ত ইন্দ্রিয়গুলি সজাগ হয়ে যেত ও তিনি জঙ্গলের প্রতিটি মুভমেন্ট ধরতে পারতেন। উনিশটি বাঘ এবং চোদ্দোটি চিতা শিকার করে রেকর্ডও করেছেন জিম।
তিনি প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণের জনক ছিলেন। তিনি নিজে উপলব্ধি করেছিলেন প্রাকৃতিক ভারসাম্য রাখার জন্য সমস্ত প্রাণী কে বাঁচিয়ে রাখা জরুরি। তাই বাঘ, চিতা, প্রভৃতি জন্তু, যেগুলি মানুষের দ্বারা বেশি আক্রান্ত সেগুলিকে সংরক্ষণের জন্য রিজার্ভ ফরেস্ট বানানোর কথা প্রথম আসে জিমের মাথায়।বর্তমান ‘জিম করবেট ন্যাশনাল পার্ক’ প্রতিষ্ঠায় একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন।
পরবর্তীকালে জিম করবেট অনেক বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ সংস্থার সক্রিয় সদস্য হয়ে ওঠেন। আজ ভাবলে ভাল লাগে যে রশিদের মতন মানুষেরা এই সংরক্ষণের কাজকে দায়িত্বের সঙ্গে এগিয়ে নিয়ে চলেছে। আমি আগে বলেছি যে পৃথিবীর উপর আমাদের অধিকার যতখানি ওদেরও ঠিক ততটাই। সুতরাং, ওদের জন্য বরাদ্দ জমি আমরা কেড়ে নিতে পারি না। পশু-পাখিহীন এই জগতে আমরা বসবাস করি একবার চিন্তা করেলে কেমন লাগবে? সকাল বেলা কাক, শালিক, দোয়েল, কোয়েলদের ডাক যদি আর না পাওয়া যায় কেমন লাগবে এই পৃথিবীতে বাস করতে? আমাদের নিজেদের বেঁচে থাকার তাগিদে ওদেরকেও বাঁচিয়ে রাখা আমাদের দায়িত্ব। ওরা বাঁচলে তবেই আমরা বাঁচব।
ছবিঃ লেখক
বনের ডায়েরি সব পর্ব একত্রে