বসন্ত স্পেশাল সেরা ২০১৭-আনন্দের ডায়েরি উমা ভট্টাচার্য বসন্ত ২০১৮

উমা ভট্টাচার্য -র সমস্ত লেখা একত্রে

গরুড়াবলোকনে লণ্ডন দর্শনঃ-

এপ্রিলের তৃতীয় সপ্তাহে লন্ডনের প্রাণকেন্দ্র ওয়েস্টমিনিস্টার এলাকায় অবস্থিত ‘লন্ডন আই’ দেখতে যখন পৌঁছুলাম তখন ভর দুপুর। মেঘমুক্ত আকাশ সূর্যের প্রখর আলোয় উদ্ভাসিত ছিল। লন্ডনের শীতল আবহাওয়ায় সেদিন সূর্যের উত্তাপ খুবই আরামদায়ক লাগছিল। আকাশ যে কত নীল হতে  পারে তা সেদিনের আকাশ দেখে বুঝেছিলাম। অবশ্য এরকমই উজ্জ্বল নীল আকাশ দেখেছিলাম আন্দামানে। সেদিন আকাশের এত নীল দেখে আর থাকতে পারেনি জলভারহীন সাদা মেঘের দল। তারা মনের আনন্দে দলে দলে বেরিয়ে পড়েছিল, ভেসে বেড়াচ্ছিল লন্ডন আই,টেমস্‌সহ সারা শহরের ওপর দিয়ে।  

ব্রিজের ওপর দিয়ে নদী পার হয়ে গাছপালায় ঘেরা এলাকাটির ডালপাতার ফাঁক দিয়ে প্রথম দেখলাম লণ্ডন আইকে। বিশাল গোলাকার চোখের মত এক দৈত্যাকার ‘ফেরি হুইল’ আকাশে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে। যেন সারা লণ্ডন শহরের ওপর নজরদারি চালাচ্ছে। লন্ডন আইয়ের পায়ের নীচে লন্ডনের আর এক ল্যান্ডমার্ক, যার নাম অজানা অতীত থেকে লন্ডনের নামের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গী হয়ে আছে, সেই টেমস্‌ নদী। টেমস্‌ নদীর  দক্ষিণ তীরে দাঁড়িয়ে আছে ‘লন্ডন আই’। গায়ে লাগানো আছে ৩২টি গন্ডোলা। লন্ডনের ৩২টি বোরো এলাকার প্রতিনিধি এগুলি। এই ক্যাপসুলগুলিতে চড়ে দর্শকেরা গরুড়াবলোকনে লন্ডন শহরের ৩৬০ ডিগ্রি  ভিউ দেখতে পান।

হুইলে উঠতে প্রথমে একটু যে ভয় হচ্ছিল না তা বলতে পারি না, কিন্তু যতই লাইনে এগোতে লাগলাম, ভয় কেটে রোমাঞ্চ এসে জুড়ে বসল মনে। দেখাই যাক না! কী আর হবে?  মজা করতে হলে একটু রিস্ক নিতেই হয়। ভয় করতে নেই রে মন। কেন না যে আমি আন্দামানের নর্থ বে-তে ৬৫ বছর বয়সে আন্ডার সি ওয়াক করেছি, মাছেদের  সঙ্গে খেলেছি, সমুদ্রের জলের তলায় প্রায় ৭০ ফিট নীচে কাটিয়ে এসেছি মিনিট কুড়ি সময়, তার পক্ষে ‘লন্ডন আই’তে চড়তে ভয় পাওয়া শোভা পায় না।  

কাঠের র‌্যাম্প বেয়ে কিছুটা ওঠার পর আমাদের একটা চওড়া জায়গায় আমাদের দাঁড় করানো হল। সামনে এসে ক্যাপসুলটি  দাঁড়ালে দর্শকেরা উঠবেন, দরজা বন্ধ করে, সেটি এগিয়ে যাবে। এবার পরেরটি আসবে।

এভাবেই সবগুলি ক্যাপসুল ভর্তি  হলে চলতে শুরু করল ঘণ্টার ৯কিলোমিটার বেগে। ওপরে উঠতে ক্রমশ নজরে এল ওয়েস্টমিনিস্টার প্যালেস, বিশাল হাউস অফ পার্লামেন্টে বিল্ডিং, লণ্ডনের বিখ্যাত ঘড়ি ‘বিগ বেন’, ওয়েস্ট  মিনিস্টার অ্যাবে, টেমসের ওপরের ওয়াটার্লু ব্রিজ, ওয়েস্ট মিনিস্টার ব্রিজ, ল্যামবেথ ব্রিজ, নদীর উজানে হাঙারফোর্ড ব্রিজ, ইন্টারন্যাশনাল মেরিটাইম অর্গানাইজেশন, চেরিংক্রস রেলওয়ে স্টেশনের বিল্ডিং। দূরে দেখা যাচ্ছিল বিখ্যাত আরও অনেক স্থাপত্য। চক্র ওপরে উঠলে চোখ গেল বহুদূর। এবার নামতে লাগল। তখন দেখা গেল নদীর দক্ষিণ দিকের নানা জায়গা।  

ত্রিশ মিনিটেই দেখা হয়ে গেল লন্ডনের ৫৫টিরও বেশি বিখ্যাত জায়গা। সবচেয়ে মজার লেগেছিল একেবারে ওপরে উঠে নীচে দেখা নদীর দৃশ্য,তাতে ভাসমান নানা ধরনের জলযান। লঞ্চ, নৌকো, সব ছুটছিল যে যার গন্তব্যে।

লন্ডন আই দেখতে গিয়ে একটা ভালো অভিজ্ঞতা হল। সারা এলাকায় হাজার হাজার দর্শকের ভিড়, কিন্তু কোলাহল নেই। আমরা টিকিট পেয়েই তাড়াহুড়ো করে লাইন দিতে ছুটলাম ও ফাঁকা জায়গা পেয়ে দাঁড়িয়েও  পড়লাম, লাইনটাইন কিছুই লক্ষ করিনি। কিন্তু আমাদের আগে কিছু অল্পবয়সী ছেলেমেয়েদের লাইন ছিল, তারা একেবেঁকে দাঁড়িয়ে গল্প করছিল। আমরা না দেখেই তাদের  জায়গায় দাঁড়িয়ে পড়েছি দেখেও তারা কিছুই বলল না । আমরা বয়স্ক আর বিদেশী দেখে তারা নীরবে জায়গা ছেড়ে দিয়ে আমাদের পিছনে গিয়ে দাঁড়াল। সেই ছেলেমেয়েদের ভদ্রতা  আমাকে নাড়া দিয়েছিল, কারণ আমাদের দেশে বেশীর ভাগ ক্ষেত্রেই বয়স্ক এমনকি অসুস্থ মানুষ হলেও ট্রেনেবাসে বা লাইনে ছেলেমেয়েদের কাছে এই ব্যবহার আশা করাই যায় না। কিন্তু পরে আমাদের ব্যবহারে আমি খুবই লজ্জিত হলাম। একজন স্বেচ্ছাসেবক যুবক এসে হাতজোড় করে বিনয়ের সঙ্গে আমাদের জানাল যে আমরা অন্যদের জায়গায় দাঁড়িয়ে পড়েছি, সেটি ছেড়ে দিলে ভালো হয়। লজ্জায় আমরা সঙ্গে সঙ্গে পিছনে গিয়ে দাঁড়ালাম। ভাবলাম আমরা এত অধৈর্য কেন? এটা আমাদের শোভা পায় না।

হাঁটাপথে নগর দর্শন

লণ্ডনের ওয়েস্ট মিনিস্টার এলাকায় সবচেয়ে বড় স্কোয়ার-বিভিন্ন উদ্দেশ্যে জনতার জমায়েতের স্থান। সেখানে অবস্থিত বিখ্যাত ন্যাশনাল গ্যালারি, সেই গ্যালারির বিস্তৃত প্রাঙ্গনে অভিযোগ লিখছে কিছু  যুবক। নীরবে নিজেদের অভিযোগ বা প্রতিবাদ সর্বসমক্ষে তুলে ধরার এই পথ তারা বেছে নিয়েছে দেখে ভালো লাগল। তাঁদের লেখা সব ভাষা আমি বুঝতে পারিনি। হয়তো তারা লন্ডনে আসা বিদেশি ছাত্র, যারা অভাবে আছে ,অসুবিধায় আছে। মনে হয়েছিল হয়ত নীরবে সাহায্য প্রার্থনা করছিল দর্শকদের কাছে। কারণ তাদের লেখার ছবি তুলতে গেলে একজন সাহায্যের জন্য হাত পাতল। সামান্য পাউণ্ড তার হাতে তুলে দিতে পারিনি ভেবে পরে খুব কষ্ট পেয়েছি মনে মনে। আমার কাছে খুচরো ছিল না।

প্রাঙ্গনের শুরুতেই আছে ‘নেলসন মনুমেণ্ট’। ১৫১ ফুট স্তম্ভের মাথায়  ১৮ফুট উঁচু ট্রাফলগারের যুদ্ধে নিহত বীর ‘নেলসন’এর স্ট্যাচু। দেখতে দেখতে মনে পড়ল ইংরেজের উপনিবেশ ভারতের সেপাইদেরও তো ইংরেজের হয়ে দেশের বাইরে  নানা যুদ্ধে যেতে হয়েছে। প্রাণ দিয়েছিল কতজন আর কতজন তার হিসাব  তো কেউ রাখেনি।

সেখান থেকে বেরিয়ে পিকাডেলি সার্কাস। সপ্তদশ শতাব্দীতে  লন্ডনে শার্টে একধরনের ফ্রিল দেওয়া কলার খুব জনপ্রিয় ছিল- যার নাম ছিল পিক্কাডেলি ।দর্জি রবার্ট বেকার সেই কলার তৈরি করত।তার বাড়িতেই এই কলার তৈরি হত বলে বাড়িটির  নাম লোকমুখে হয়ে গিয়েছিল ‘পিকাডেলি হল’ আর বাড়ির সামনের রাস্তাটির নাম হয়েছিল ‘পিকাডেলি রোড’। সেই থেকে এই রাস্তার গায়ে পিকাডেলি সার্কাস নামের এই গোল চত্বরের নাম। এখানেই আছে পিকাডেলি মনুমেন্ট।  

নস্টালজিয়ার ভূতের পাল্লায় আমিঃ-

সতেরো আঠারো বছর থেকেই ক্রিকেট ছিল আমার প্রিয় খেলা। এদেশে তখন সবে ট্রানজিস্টার এসেছে। আমি আর আমার এক জ্ঞাতি দিদি বাড়ির উঠোনে রাখা খড়ের ডাইয়ের ওপর গা এলিয়ে রোদ পোয়াতে পোয়াতে  দিদিদের ট্রানজিস্টারে শুনতাম ক্রিকেটের ধারাভাষ্য। কলকাতার ইডেন গার্ডেনের নামটুকুই শুনেছি চোখে  মাঠের ভেতরটা আজও সচক্ষে দেখিনি, সেই আমি কিনা গিয়ে হাজির হলাম এক্কেবারে লর্ডসের মাঠে। যারা ক্রিকেটের পোকা তাদের সবারই যেখানে যাবার জন্য মন চায় কিন্তু সাধ্যে কুলোয় না,তাদের কথা ভেবে আমার নিজেকে খুবই ভাগ্যবতী মনে হল।

প্রবেশ পথের প্রথমেই সামনে দেখলাম ‘ডব্লিউ জি গ্রেস’এর ব্যাট হাতে  ব্রোঞ্জমুর্তি। লর্ডসের বিভিন্ন জায়গায় ২২জন ক্রিকেটারের মূর্তি আছে। আছে এম সি সি মেম্বারদের লাউঞ্জ, লং রুম। লং রুমে রয়েছে বিখ্যাত ক্রিকেট   খেলোয়ারদের চিত্র। ওপরের ব্যালকনির চারদেওয়ালের কাঁচের শোকেসে আছে বিখ্যাত খেলোয়াড়দের ব্যবহৃত জিনিসপত্র,মেডেল,ব্যবহৃত নানা  বল,পেপার সেসব দেখতে দেখতে প্যাভেলিয়নের দর্শন লাউঞ্জে পৌছুলাম,মুখোমুখি বিপরীত দিকে প্রেস বক্স, দুপাশে ছবির মত সাজানো দর্শকাসন। মাঝে হরিৎসবুজ ক্রিকেটগ্রাউণ্ড। অবাক হয়ে দেখছিলাম খেলার মাঠের অপূর্ব সজ্জা,পরিচ্ছন্নতা।

এরপর নেমে এলাম নীচে, এবার আমরা নেমে দেখব ক্রিকেট মাঠ,দর্শকাসন থেকে। ভারতের গৌরব সেরা অলরাউণ্ডার ২৩ বছরের যুবক কপিলদেব নিখাঞ্জ ১৯৮৩তে ইংলণ্ডের মাটিতে,এই লর্ডসের মাঠেই জিতে নিয়েছিলেন ভারতের প্রথম বিশ্বকাপ। মানসচক্ষে দেখলাম কপিল খেলতে নামছেন। ভারতের স্কোর পাঁচ  উইকেটে মাত্র সতেরো। খেলতে নেমে পাল্টা মারের দুঃসাহস দেখিয়ে ৮ উইকেটে ২৬৬ স্কোর করে খেলাটা জিতে বার করে আনলেন ক্যাপ্টেন। পরের দৃশ্য ১৯৯৬ সালের ২২শে জুন। সৌরভের এক মারাত্মক ড্রাইভে বল পৌঁছে গেল ফেন্সে, অভিষেক টেস্টে সৌরভ শতরান পূর্ণ করলেন ক্রিকেটের মক্কা এই লর্ডসে। হলেন ম্যাচের সেরা।

সেদিন বিকেলে সকলে যখন নানা কথা বার্তায় ব্যস্ত তখন নস্টালজিয়ার ভূত আমাকে ভারতের খেলোয়াড়দের গৌরবময় খেলার দৃশ্যগুলি ফিরে দেখিয়ে দিল।সম্বিত ফিরল ট্যুর লিডারের ডাকে,এবার ফিরে যাবার পালা।

ম্যানিয়া কাকে বলে!—

স্ট্রাটফোর্ড-আপঅন-অ্যাভন জেলার হেনলে স্ট্রিটে ১৫৫০ সালে ইট কাঠ মিশিয়ে তৈরি একটি ‘টিউডর কটেজ’ কিনেছিলেন উইলিয়ামের বাবা। এই বাড়িতেই ১৫৬৪  সালে জন্মেছিলেন শেক্সপিয়ার। অ্যাংলো-স্যাক্সনরা সপ্তম শতাব্দীতে স্থাপন করছিল যে মধ্যযুগীয় সেই মার্কেট টাউন সে জায়গায়  আজ বিরাট শহর,  লোকসংখ্যা খুব একটা বেশী নয়। কিন্তু  ২২শে এপ্রিল শনিবার  গিয়ে দেখি সেখানে বেজায় ভিড়। কারণ, শেক্সপিয়ার ম্যানিয়া। ২৩ এপ্রিল তাঁর জন্মদিন যে! এই সপ্তাহান্তটি নানা জায়গা থেকে ছাত্রছাত্রী,অভিনেতা,সংগীতজ্ঞ,অর্কেস্ট্রা পার্টি,রাজনীতিবিদ,বিভিন্নদেশের আম্বাসাডাররা এসে জড়ো হন।

হেনলে স্ট্রিটে গিয়ে পৌঁছেছিলাম বেলা ১০টা নাগাদ। প্রথমে গেলাম কবির বাড়ি দেখতে। বিস্তৃত জমির ওপরে অফুরন্ত নানা রঙের ফুলের বাগানের পাশ দিয়ে চললাম মূল বাসগৃহের দিকে। কত রঙের যে টিউলিপ ফুটে আছে,সুন্দর রৌদ্রকরোজ্জ্বল সকালে ফুলে ফুলে মৌমাছি,প্রজাপতি মধুসংগ্রহে ব্যস্ত। আগে এখানে ছোট ছোট ১৩টি কাঠের ঘর ছিল। কাঠের মেঝে, কাঠের গুঁড়ির খাট,তাতে শোবার বিছানা,(যদিও সেগুলি রেপ্লিকা তবুও কেমন ছিল সেদিনের আসবাব তা বোঝাতেই এই আয়োজন)কাঠের ছোট্ট টেবিল,বাচ্চা ছেলেদের খেলার বল, শিশুর প্রসূতিঘর, মায় কৃত্রিম ফায়ারপ্লেসও বানিয়ে রাখা হয়েছে। গাইড মেয়েরা কলকল করে কথা বলে বোঝাচ্ছিল একসময় কবির পরিবার কত ছোট ঘরে বাস করতেন, কত সামান্য সাধারন আসবাব ব্যবহার করতেন। দোতলার জানালা থেকে দেখলাম  নীচে বাগানের দিকের বাঁধানো চত্ত্বরে চলছে অ্যামেচার ছাত্রছাত্রীদের ‘ওপেন এয়ার’ নাটক। 

একের পর একজন উঠে আসছে কল্পিত স্টেজে, আর কবির লেখা নানা নাটকের অংশ অভিনয় করে চলেছে। অভিনয়ের স্বতঃস্ফূর্ততা দেখেই বোঝা যাচ্ছে কবি তাদের কত আপনার, তাদের জীবন জুড়ে মিশে আছেন কবি শেক্সপীয়ার। অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে দেখলাম সেই শেক্সপিয়ারক্ষ্যাপা মানুষদের কার্যকলাপ।  

সেদিনই দু-তিনটি বাসে বিভিন্ন জায়গা থেকে এসে নেমেছে অর্কেষ্ট্রা পার্টি,নাটকের দল।পরদিন ২৩ সে জন্মদিনে অনুষ্ঠান হবে,বাজনাদের দল নিয়ে রাস্তায় বেড়োবে  শোভাযাত্রা।তাঁরা এই উৎসবে যোগ দিতেই এসেছে। রাস্তায় ছেলেমেয়েদের হাতে হাতে উড়ছে নানা রঙের বেলুন। মানুষে মানুষে ছয়লাপ।

ঘুরতে ঘুরতে একজায়গায় দেখি একটি সাদা রঙের স্ট্যাচু একটি উঁচু টুলের উপরে দাঁড় করানো,হাতে এক লাঠি। দেখে মনে হচ্ছে অসম্ভব লম্বা একটি শ্বেত পাথরের মূর্তি।ভাবলাম এটা এখানে কেন?কাছে গিয়ে দেখি তার পায়ের  কাছে একটা বোর্ডে লেখা, ‘আমার সাথে দাঁড়িয়ে ছবি তুলুন,মজা নিন,এস বাচ্চারা ভয় পেয়োনা। এসো আমার হাত ধরে ছবি তোল।এর বিনিময়ে কিছু অর্থ সাহায্য করুন আমাকে’।দেখলাম দুএকটি বাচ্চা এমনকি বড়োরা ও পর্যটকেরাও এগিয়ে এসে ফটো তুলছেন তাঁর সাথে,কিছু পয়সা রেখে যাচ্ছেন তাঁর সামনে রাখা হেল্প বক্সে।

আসলে এরা  দরিদ্র মানুষ,অনেকের ঘরবাড়িও নেই।নির্দিষ্ট আয় নেই,সরাসরি ভিক্ষেও এঁরা করে না,এইভাবে মানুষকে মজা দেখিয়ে অর্থ উপার্জন করেন। কোনো দাবি নেই,যে যা দেয় তাই আনন্দে গ্রহন করেন।সামান্য উপার্জনের জন্য এত কষ্ট করেন। কিছুদূরেই দেখলাম এরকমই আর একজন দরিদ্র  কালো মানুষকে, মলিন চেহারা,মলিন পোশাক। রাস্তায় একফালি কাপড় বিছিয়ে বসে আছেন-সামনে  একটি ছোট্ট বোর্ডে লেখা ‘স্টোরি টেলার’-তাঁর পেশা গল্প বলে অর্থ রোজগার করা। স্বাভিমানী মানুষ, ভিক্ষা চাইবে না। বিনা শ্রমে কিছু নেবেন না। তাঁর যেটুকু ক্ষমতা আছে তাই দিয়েই – অর্থাৎ গল্প শুনিয়েই রোজগার করবেন। সামনেই রাখা হেল্প বক্স। গল্প শুনতে আসছে কচিকাঁচার দল, সঙ্গে বড়রাও, আর যার  যেটুকু দেবার ফেলে দিচ্ছে হেল্প বক্সে।

এ-শহরে এখনো গল্পকথকের দাম আছে। হেনলে স্ট্রিটে ঢোকার মুখেই দেখলাম  এক রিংওয়ালা বিরাট একটা রিংয়ের মত যন্ত্র নিয়ে  জোকারের মত পোশাকে নানারকম খেলা দেখাচ্ছে। তার অঙ্গভঙ্গী,মুখভঙ্গী,আর কথাবার্তা শুনে দর্শক আর শিশুরা হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ছে। তারপর খেলা  দেখে নির্দিষ্ট হেল্প বক্সে দর্শনী রেখে চলে যাচ্ছে।  

ওদিকে, বেশ কয়েকটি দল আবার বেরিয়েছে শেক্সপিয়রের নাটকের নানা বিখ্যাত চরিত্রের সাজ-পোশাকে। রাস্তায় নানা দোকানের সামনে পেতে রাখা গোল টেবিল ঘিরে গল্পগাছা করছেন মধ্যযুগের নাইট বা তাদের রাজারানির দল। অনুষ্ঠান শুরু হবে দুপুরে। পথনাটিকার মধ্য দিয়ে তাঁরা স্মরণ করবেন তাঁদের প্রিয় কবিকে।

একটি ঘটনা আমাকে খুব নাড়া দিয়েছিল। এত ভীড়ের মধ্যে একটি রাস্তার মোড়ে এক বৃদ্ধা দাঁড়িয়ে আছেন,পরণে মধ্যবিত্তের পোশাক, সঙ্গে একটি সাত আট বছরের ফুটফুটে ছেলে। চলার পথে দেশিয় মানুষজন তাদের  কিছু পয়সা দিয়ে যাচ্ছে বাচ্চাটি প্রতিবার নীচু হয়ে সেগুলি গুনে রাখছে। আমিও একটু ভিক্ষে দিলাম তাদের। একসময় দেখি বৃদ্ধা একটি বাড়ির বন্ধ দরজার সামনে বসে পড়লেন।ভদ্রলোক দূর থেকে নজর রাখছেন তাদের ওপর। খানিক পরে বেশ কিছু পয়সা  জমলে বাচ্চাটি সেগুলি কুড়িয়ে নিল,বৃদ্ধ এগিয়ে এলেন, মনে হল বাচ্চাটির দাদু হবেন। সে পয়সাগুলি দাদুর হাতে দিল। এবার  তিনজনে চললো বাড়ির দিকে।

রোমাঞ্চকর ভয়ঙ্কর সুন্দরের কাছে-

সেই ভয়ঙ্কর সুন্দরের কাছাকাছি হয়েছিলাম উত্তর আয়ারল্যান্ডের অ্যানট্রিম কাউন্টিতে আটলান্টিক মহাসাগরের ওপর ক্যারিক-এ-রিড নামে ছোট্ট এক দ্বীপে পৌঁছতে গিয়ে।  মূল ভূখন্ড থেকে ২০মিটার (৬৬ফুট) দূরে এই ক্যারিক-আ-রীড,আইরিশ ভাষায় যার নাম ‘রক অফ দ্য কাস্টিং’।দুই ভূখন্ডের মাঝখানে মাত্র ৩০ মিটার(৯৮ফুট) নীচে দিয়ে বইছে গভীর উত্তর আটলান্টিক ক্যারিক-এ-রীডে পৌঁছুতে পার হতে হবে ২০ মিটার দীর্ঘ, কাঠের তক্তা লাগানো দড়ির সেতু। প্রবল উত্তুরে বাতাস অনবরত দোলাচ্ছে সেতুকে,ঠিক দোলনার মত।তীব্র দোলনের জন্য কিছুক্ষণ পর্যটকেরা পারাপার করতে পারেনি,ওপারে যারা পৌঁছেছিল তারা তীব্র বাতাসে কাঁপছিল আর দোদুল্যমান সেতুতে উঠতে সাহস পাচ্ছিল না। এপারেও অনেকে দাঁড়িয়েছিল কিন্তু সেতুতে উঠতে সাহস পাচ্ছিল না।

আমার কিছুতেই অপেক্ষা করা পোষায় না। আমি সেতুতে ওঠবার জন্য এগোলাম। ট্যুর লিডার আমাকে যেতে  দিলেন, কিন্তু আমার হাতে ক্যামেরা দিলেন না ,পাছে দড়ির হাত ছেড়ে ছবি তুলতে ব্যস্ত হই আর দোলায়মান সেতুতে পড়ে যাই। আমি নামলাম সেতুতে, বাতাসের তীব্রতায় প্রচণ্ড দুলছিল সেতু। আমি সমুদ্রের জলের নীচে নেমেছি, আগেই বলেছি, এবার মজা লাগল আরও বেশি এই ভেবে যে  আমি পায়ের নীচে আটলান্টিক সাগরের উত্তাল ঢেউ দেখতে দেখতে চলছি। দোলনের মজা নেবার জন্য মিনিট দুয়েক আমি সেতুর মাঝখানে দাঁড়ালাম। কিন্তু তারপর সঙ্গীদের চিৎকারে আমি সেতু পার হয়ে ওপারে চলে যেতে বাধ্য হলাম। অনেকে সেতু পার হল না, তারা ফিরে গেল।

ক্রিক-এ–রিডে পৌঁছে এবড়ো খেবড়ো পথে খানিকটা ওপরে উঠলাম। অতি দূরে সমুদ্র আর দিগন্ত মিলেমিশে গেছে, সূর্য প্রায় অস্তাচলে, পশ্চিমে পাহারের আড়ালে অস্তগামী সূর্যের লালিমা ছড়িয়ে পড়েছে আকাশে। দূরে দেখা যাচ্ছে দুটি স্থলভাগ,স্কটল্যান্ড আর রূথলীন দ্বীপ। বিশাল নীল সাগরের বুকে এক আগ্নেয় টিলার ওপরে দাঁড়িয়ে আমি, মাথার ওপরে গাঢ় নীল আকাশ, মনে হল আমি স্বর্গের খুব কাছকাছি দাঁড়িয়ে। এক অবর্ণনীয় অনুভূতির বশ হয়ে গেলাম আমি। হঠাৎ নীচের দিকে চেয়ে দেখি ঢেউয়ের তান্ডবে অনেক নীচে মাঝিদের বেঁধে রাখা নৌকোগুলি উলটে যাচ্ছে আবার সোজা হয়ে যাচ্ছে।

এবার ফেরার পালা। আমি ভিড় এড়াতে তাড়াতাড়ি এগোতে লাগলাম। সেতুর কাছাকাছি এসে লাইনে দাঁড়াতে হল কারণ আমার আগে আরও জনা পনেরো মানুষ লাইনে দাঁড়িয়ে, ওপারেও জনা দশেক দাঁড়িয়ে। সেতুর ওপর একসঙ্গে ৮ জনের বেশি উঠতে দেবে না। তাই  সেতু পার হয়ে এপারে আসতে একটু সময় লাগল। লোহার খাড়া সিঁড়ি বেয়ে প্রবেশ পথে পৌঁছে বেড়িয়ে গেলাম মূল ভূখন্ডে। এবার ফিরতে হবে। যেতে হবে অনেকটা চড়াই  আর সমতল ঘাসজমি পেরিয়ে, কারণ বাস যে অনেক দূরে দাঁড়িয়ে।                       

          

            

                                          

                            

     

     

    

                         

1 thought on “বসন্ত স্পেশাল সেরা ২০১৭-আনন্দের ডায়েরি উমা ভট্টাচার্য বসন্ত ২০১৮

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Twitter picture

You are commenting using your Twitter account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s