লোককথা বাড়ি থেকে পালিয়ে শিবানী রায়চৌধুরী বসন্ত ২০১৯

শিবানী রায়চৌধুরীর আগের গল্প খোক্কসফুলঝাড়ু প্যাঁচার বুদ্ধি

বাড়ি থেকে পালিয়ে

শিবানী রায়চৌধুরী

শিউলির  সেদিন কোন কিছুই স্বাভাবিক মনে হচ্ছিল না। বিকেল  চারটের সময় আশি নম্বর বাসের পেছনের সিটে বসে বার বার মোবাইল খুলে দেখছিল কোন নতুন মেসেজ এসেছে কি না। প্রতিবারই নিরাশ হচ্ছিল । সেই সকাল সাড়ে দশটায় শিউলি মা’র কাছ থেকে মেসেজ পেয়েছিল ‘সব হোমওয়ার্ক লিখে এন। কলা আর আপেলটা খেতে ভুলে যেও না। সাবধানে বাসে ওঠানামা করবে।’ তারপর আর কিছু আসেনি। শিউলি সারাদিনের ঘটনার কথা ভাবছিল।  

সাতই সেপ্টেম্বর, বৃহস্পতিবার। প্রায় দু’মাস গরমের ছুটির পর ইস্কুলের নতুন বছর শুরু হয়েছে। নতুন ইস্কুলে প্রথম দিন। শিউলি নেলসন ম্যান্ডেলা প্রাইমারি থেকে কুইনস্ একাডেমি সেকন্ডারিতে অনেক কষ্টে জায়গা পেয়েছে। বার্মংহামের এই ইস্কুলটার ইংল্যান্ডে বেশ নাম আছে। মেরুন রঙের কড়কড়ে মাড় দেওয়া স্কুল ইউনিফর্ম পরে শিউলির একটু অস্বস্তি হচ্ছিল ঠিকই, কিন্তু সেকেন্ডারি ইস্কুলে যাওয়াটা ওর কাছে ভয়ের ব্যাপার ছিল না। শিউলি এদিনটার জন্যে চার মাস ধরে অপেক্ষা করেছিল। ও আর ওর প্রাণের বন্ধু অ্যানাবেল রোজ বাসের দোতলায় সামনের সিটে বসে ইস্কুলে যাবে। দারুণ আড্ডা জমবে।

কিন্তু প্রথম দিনই শিউলির সব প্ল্যান ভেস্তে গেল। শিউলি ক্লাশে ঢুকে চারদিকে তাকিয়ে কোথাও এ্যনাবেলকে খুঁজে পেল না। পড়ানো শুরু হওয়ার আগে মিসেস গোমেজ রেজিস্ট্রার দেখে পর পর এ্যালফাবেটিকাল অর্ডারে নাম ডাকলেন – অলিভার এমি, আলি আশিফ, বেগম শিউলি , ব্রাউন হেলেন…… কুপার অ্যানাবেল,…. ডবসন রেবেকা… । শিউলি কান খাড়া করে শুনছিল। ক্লাশের সবাই জোর গলায় ‘ইয়েস মিস, ইয়েস মিস’ বলে নিজেদের উপস্থিতি জানাচ্ছিল। অ্যানাবেলের গলা শোনা গেল না।

মিসেস গোমেজ রেজিস্টারে টিক দিতে দিতে ভুরু কুঁচকে বললেন, “প্রথম দিনই এ্যাবসেন্ট, স্কুল কামাই করার অভ্যেস আছে বোধহয়।” শিউলির কথাটা ভাল লাগেনি, তবে প্রতিবাদ করার মতো সাহস ছিল না। এরপর ছিল অঙ্কের ক্লাশ তিন তলায় তেতাল্লিশ নম্বর ঘরে।  টিচার মিস জেকব। শিউলির অঙ্কের ক্লাশে মন দেবার মতো অবস্থা ছিল না। ওর মাথায় ঘুরছিল অ্যানাবেল কেন ইস্কুলে এল না। দু’দিন আগেই অ্যানাবেল মোবাইলে মেসেজ পাঠিয়েছে “সাতই সেপ্টেম্বর, C.u@ Queens.”

শিউলিকে চুপচাপ বসে থাকতে দেখে বেকি ওকে এক ধাক্কা মেরে বলল, “কিরে অঙ্কের ক্লাশে যাবি না? মনমরা হয়ে বসে আছিস কেন? প্রথম দিন দেরি করে ঢুকলে ম্যান্ডেলা ইস্কুলের নাম খারাপ হবে। শুনলি তো অ্যানাবেল আসেনি বলে মিসেস গোমেজ কী বললেন!”

শিউলি বেকির সঙ্গে অঙ্কের ক্লাশের দিকে যেতে যেতে বলল, “অ্যানাবেল ইস্কুলে এল না কেন বুঝতে পারছি না? দ্যাখ, পরশু দিন আমাকে মেসেজ পাঠিয়েছিল।”

বেকি বলল, “হয় তো অসুখ করেছে।”

শিউলির কথাটা বিশ্বাস হল না, “তাহলে ওর মা-বাবা ইস্কুলকে জানাতেন।”

বেকি জোরে জোরে পা চালিয়ে বলল, “শুনেছি মিস জেকব খুব কড়া।”

বেকি আর শিউলি ক্লাশে ঢুকতেই মিস জেকব ওদের দিকে  তাকিয়ে বললেন, “মেয়েরা, প্লিজ, তাড়াতড়ি কর। পিছনের সারিতে দুটো জায়গা খালি আছে। চটপট বসে পড়। ভবিষ্যতে যেন দেরি না হয়।”

বসেই শিউলি মোবাইলটা দেখছিল অ্যানাবেল ওর মেসেজের উত্তর দিল কিনা। বেকি ফিসফিস করে বলল, “এই শিউলি, মোবাইল বন্ধ কর।  ইস্কুলের নিয়মকানুন পড়ে দেখিস নি?”

ইতিমধ্যে মিস জেকব হুঙ্কার দিয়ে উঠলেন, “আমার ক্লাশে সবচেয়ে প্রথমে শিখতে হবে আমি যখন কথা বলব তখন আর কেউ কথা বলবে না। আমি তোমাদের কিছু জিজ্ঞেস না করলে তোমাদের মুখ দিয়ে টুঁ শব্দটি বের হবে না।” তারপর বেকির দিকে ফিরে বললেন, “ইয়াং লেডি, উঠে দাঁড়াও দেখি, তোমার নাম কী?”

বেকি মৃদু স্বরে জবাব দিল, “বেকি ডবসন।”

মিস জেকব জিজ্ঞেস করলেন, “পুরো নাম?”

বেকি আমতা আমতা করে জবাব দিল, “রেবেকা ডবসন। সবাই বেকি বলে ডাকে।”

মিস জেকব বললেন, “রেবেকা, এবার বসতে পার।” শিউলিকে বললেন, “মাথা নিচু করে কী দেখছ? বোর্ডের দিকে তাকাও।”

আর একটু হলেই শিউলির মোবাইলটা হেড টিচারের ঘরে চলে যেত। বেকি বসেই খাতার মলাটে পেন্সিল দিয়ে লিখল, “খুব জোর বেঁচে গেলি।”

শিউলি লিখল, “অ্যানাবেল আমার মেসেজের উত্তর দেয়নি।”

শিউলির মাথায় অঙ্কটঙ্ক কিছুই ঢুকছিল না। ওর মন তখন ভগ্নাংশ আর শতকরা সুদের হার থেকে অনেক দূরে অ্যানাবেলার অজানা জগতে ঘুরপাক খাচ্ছিল। মিস জেকবের তীক্ষ্ণ কন্ঠস্বরে ওর দিবাস্বপ্ন ভেঙে গেল, “শিউলি, এই অঙ্কটার উত্তর তুমি বল দেখি।”

শিউলি হঠাৎ জেগে উঠে বলল “হুঁ”। বোর্ডের দিকে তাকিয়ে ও ঝাপসা দেখল। ওর মাথায় কিছুই ঢোকেনি। বোর্ডে মিস জেকবের হাতের লেখা জট পাকানো মনে হল।

বেকি ফিসফিস করে বলল, “শতকরা সাড়ে বাইশ।”

শিউলি শুনেই উত্তর দিল “শতকরা সাড়ে বাইশ।”

মিস জেকব বললেন, “থ্যাঙ্ক ইউ রেবেকা। শিউলি, উঠে দাঁড়াও। এবার বলতো অঙ্কটা কীভাবে করলে। কী করে শতকরা সাড়ে বাইশ পেলে?”

শিউলি চুপ করে আছে দেখে মিস জেকব বললেন, “আমি জানতাম তুমি বলতে পারবে না। তোমার কোন ধারনাই নেই শতকরা হার কীভাবে করতে হয়। মন দিয়ে শোন, বোঝার চেষ্টা কর। নইলে ছুটির পর আটক থেকে অঙ্ক করবে।”

বেকির দিকে তাকিয়ে বললেন, “রেবেকা, আমার ক্লাশে তুমি আর শিউলি আলাদা বসবে।” তারপর ক্লাশের সবাইকে বললেন, “আমাদের ইস্কুলে কঠিন নিয়মকানুন। এখানে প্রাইমারি ইস্কুলের মতো হেসেখেলে বেড়ালে চলবে না।”

ক্লাশের একজন ফাজিল ছেলে ফোড়ণ কাটল, “আমরা প্রাইমারি ইস্কুলে এসব অঙ্ক অনেক করেছি।”

মিস জেকব রাগে লাল হয়ে বললেন, “তোমাকে কি আমি কিছু জিজ্ঞেস করেছি? আগ বারিয়ে কথা বলছ কেন? উঠে দাঁড়াও। কী নাম তোমার? কোন ইস্কুল থেকে এসেছ?”

ছেলেটা তড়াক করে লাফিয়ে উঠে মুচকি হেসে বলল, “ডেভ, পুরো নাম ডেভিড বেনেট। ইংলিশ মার্টারস আর সি।”

মিস জেকব ছেলেটার সাহস দেখে চটে গেলেন, “মুখের বোকা হাসিটা মুছে ফেল দেখি। বল “ইংলিশ মার্টারস রোমান ক্যাথলিক স্কুল।”

ডেভিড হাত দিয়ে মুখের হাসিটা মুছে ফেলার ভান করল। তাই দেখে মিস জেকব রাগ সামলাতে পারলেন না, “ডেভিড বেনেট, লাঞ্চের সময় আমার সঙ্গে দেখা করবে।”

সেকেন্ডারি ইস্কুলের ম্যারাথন রুটিন শেষ হতে সাড়ে তিনটে বেজে গেল। সকাল থেকে প্রত্যেক বিষয়ের জন্য নির্দিষ্ট ঘর খুঁজতে খুঁজতে শিউলি হয়রান। এক দিনে ডবল ইংরিজি, ডবল অঙ্ক, ইতিহাস, কমপিউটার, ডিজাইন আর টেকনোলজি, ফ্রেঞ্চ এতগুলো বিষয় শিখতে হবে ও ভাবতে পারেনি। ওর সব সময় অ্যানাবেলের কথা মনে হচ্ছিল। ভাবছিল অ্যানাবেল ইস্কুলে এলে ওকে প্রথম দিনের কাজ বুঝিয়ে দিতে হবে।

ইস্কুলের পর কোন ক্লাব ছিল না। শিউলি বেকি, হেলেন এদের  ফেলে তাড়াতাড়ি ইস্কুল থেকে বেরিয়ে এল। তারপর সোজা আশি নম্বর  বাসে উঠেই মোবাইল খুলে বসল। এবার আর মেসেজ নয়, শিউলি অনেক আশা নিয়ে ফোন করল। যা ভেবেছিল তাই হল। মোবাইল সুইচড অফ।

বাড়ি ফিরতেই শিউলির মা ওর গোমড়া মুখ দেখে জিজ্ঞেস করলেন, “মুখে হাসি নেই কেন? নতুন ইস্কুল ভাল লাগেনি?”

তারপর উত্তরের অপেক্ষা না করেই একরাশ প্রশ্ন শুরু করলেন, “টিচাররা সব কেমন? হোমওয়ার্ক দিয়েছেন? ক্লাশে ছেলেমেয়েদের সামলাতে পারেন? ক্লাশের বাইরে মারামারি হৈ হল্লা হয়? কড়া শাস্তি দেওয়ার ব্যবস্থা আছে?” তারপর শিউলিকে এক গেলাস দুধ দিয়ে বললেন, “লাঞ্চে ক্যান্টিনে কী খেয়েছিলে বললে না তো? হালাল মাংস দিয়েছিল? ফলগুলো  খেয়েছিলে?” একটু থেমে ফের জিজ্ঞেস করলেন, “আর ছেলেমেয়েরা আলাদা আলাদা বসেছিল না পাশাপাশি?”

শিউলির মায়ের ঘ্যানঘানানি শুনতে একটুও ভাল লাগছিল না, “তুমি আমাকে উত্তর দেওয়ার সময় দিচ্ছ না,” ও জানত মা কী জানতে চাইছেন, “ভীষণ কড়া শাসন। একগাদা অঙ্ক আর ইংরিজি হোমওয়ার্ক করতে হবে। লাঞ্চে টম্যাটো আর চিজ দেওয়া পিৎজা খেয়েছি। তুমি তো জান আজকাল ইস্কুলে হালাল মাংস দেয়।”

মা বোধহয় সব প্রশ্নের জবাব না পেয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “নতুন কোন বন্ধু হল? কার পাশে বসেছিলে?” শিউলি এবার রেগে গিয়ে বলল, “যদি বলি জো’র পাশে বসেছিলাম?”

ওর মা বললেন, “জো ছেলে না মেয়ে?”

শিউলির মার জন্যে এবার কষ্ট হল, “টিচার আমাদের যার যার বন্ধুদের পাশে বসতে বলেছিলেন।”

মা বললেন, “তুমি নিশ্চয় অ্যানাবেলের পাশে বসেছিলে?” শিউলি জলভরা চোখে বলল, “আম্মি, অ্যানাবেল আজ ইস্কুলে আসেনি। আমি বেকির পাশে বসেছিলাম।”

ওর মা অবাক হয়ে বললেন, “সে কী কথা? প্রথম দিন ইস্কুলে এল না! মন খারাপ কর না। হয়তো অসুখ বিসুখ কিছু হয়েছে।” শিউলি অ্যানাবেলের বাড়িতে ফোন করে কাউকে পেল না। কোনরকমে দুধটা খেয়ে হোমওয়ার্ক নিয়ে বসল। অঙ্কের ক্লাশে ওর কিছুই মাথায় ঢোকেনি। হোমওয়ার্ক করবে কী করে?

শিউলি চুপ করে বসে আছে দেখে ওর মা বললেন, “এত চিন্তা না করে অ্যানাবেলের মা মিসেস কুপারকে ফোন করে খবর নাও।”

ঘড়িতে ছটা বাজে দেখে শিউলি বলল, “ফোন করেছিলাম, কেউ ধরল না। মিসেস কুপার কাজ থেকে সাড়ে ছটার আগে ফেরেন না। কখনও সাতটা বেজে যায়।”

শিউলির মা নিজের মনে গজগজ করলেন, “মা যদি বাড়ি না থাকে মেয়ে তো পাড়ায় পাড়ায় টো টো কোম্পানি করে ঘুরবেই।”

শিউলি রেগে গিয়ে বলল, “আম্মি, একটু চুপ করবে? অ্যানাবেলদের টাকাপয়সার টানাটানি যাচ্ছে। শুনেছি ওর বাবার কারখানা বন্ধ হয়ে যাবে। মিসেস কুপার দু’ঘন্টা বেশি কাজ করে বাড়ি ফেরেন।”

শিউলির মা অপ্রস্তুত হয়ে বললেন, “আমি কী করে জানব?”  

সন্ধে সাড়ে সাতটার সময় শিউলিদের দরজায় কলিং বেল বেজে উঠল। শিউলি দরজা খুলতেই মিসেস কুপার জিজ্ঞেস করলেন, “অ্যানাবেল বাড়িতে নেই। ও কি ইস্কুল থেকে তোমাদের বাড়িতে এসেছে?”

শিউলি হতভম্ব হয়ে কী বলবে বুঝতে পারছিল না। শিউলির মা ওঁকে ভিতরে এনে বললেন, “অ্যানাবেল নাকি আজ ইস্কুল যায়নি। আমরা তো ভাবছি ওর অসুখবিসুখ কিছু হয়েছে।”

মিসেস কুপারের চোখমুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেল। বললেন, “এটা কী করে সম্ভব। অ্যানাবেল তো সকাল আটটায় নতুন ইউনিফর্ম পরে ব্যাগ কাঁধে বাস স্টপে গেল। আমরা তো জানি ও ইস্কুলে গেছে। মেয়েটা গেল কোথায়?”  শিউলির মা বললেন, “পথে বিপদ আপদ কিছু হলে এতক্ষণে জানা যেত।”

শিউলিকে বার বার জিজ্ঞেস করতে লাগলেন, “অ্যানাবেলকে ইস্কুলে কোথাও দেখতে পেলে না? ভাল করে খুঁজেছিলে?”  

শিউলি বলল, “ও কোন ক্লাশে আসেনি। ওকে অনেক বার ফোন করে মোবাইলেও পাইনি। মোবাইল সুইচড অফ করা আছে।”

মিসেস কুপার অ্যানাবেলের বাবাকে ফোন করলেন। মিস্টার কুপার হন্তদন্ত হয়ে কারখানা থেকে ফিরে এলেন। এসেই মিসেস কুপারের সঙ্গে রাগারাগি শুরু করলেন, “কাল রাত্তিরে এ্যানাকে অতো বকাবকি না করলেই পারতে। প্রথমদিন সেকেন্ডারি ইস্কুলে যাচ্ছে তাই একটু বেশি পকেটমানি চেয়েছে তার জন্যে অতো কথা শোনালে।”

মিসেস কুপার বললেন, “কী এমন বলেছি? শুধু বলেছি শনি রবিবার পাড়ার দোকানে একটা ছোট কাজ খুঁজে নিতে। তাতে নিজের হাতখরচটা তো চালাতে পারবে।”

শিউলির মা ওঁদের রাগারাগি থামনোর জন্যে বললেন, “প্রায় রাত আটটা বাজে। মেয়েটা এখনও ফিরল না।” মিস্টার কুপার তখন ঝগড়াঝাঁটি থামালেন, “এখন পুলিশকে জানানো ছাড়া আর কোন উপায় নেই। ওরাই সব হাসপাতালে খোঁজ নেবে।”

মিসেস কুপার কোন রকমে কান্না চেপে শিউলির মাকে বললেন, “কোন খবর পেলে আপনাদের জানাব।” শিউলির মা বললেন, “ভেঙে পড়বেন না মিসেস কুপার। আল্লার দোয়ায় আমাদের অ্যানাবেল ঠিক ঘরে ফিরে আসবে। আত্মীয়স্বজনদের খবর  দিয়েছেন?”

কুপারদের নিজের লোক বলতে মিস্টার কুপারের চুরাশি বছরের মা বার্মিংহাম শহরের বাইরে একা থাকতেন। চোখে খুব কম দেখতে পেতেন। কানে শুনতেন না। মিস্টার কুপার ওঁর বৃ্দ্ধ মাকে জানাতে চাননি। উনি মিসেস কুপারকে বললেন, “পুলিশই আমাদের একমাত্র ভরসা। ওরা যা করার করবে।”

রাত বারোটায় মিসেস কুপার ফোন করে শিউলিদের জানালেন যে পুলিশ তখনও অ্যানাবেলকে খুঁজে পায়নি। শিউলি ভয়ে আর চিন্তায় সারা রাত শিউলি ঘুমাতে পারেনি। বেকি আর হেলেনকে টেক্সট মেসেজ পাঠিয়েছে “জরুরি অবস্থা। অ্যানাবেলকে এখনও পাওয়া যায়নি। কাল তাড়াতাড়ি ইস্কুলে আসিস। আমরা এ ব্যাপারে কী করব ভাবতে হবে।”

পরের দিন সকাল সাড়ে সাতটায় ইস্কুলের গেট খোলার আগেই তিন বন্ধু হাজির। ওরা নিজেদের মধ্যে বলাবলি করল, “অ্যানাবেলকে খুঁজে বের করতেই হবে। ও হারিয়ে যেতে পারে না।”

বেকি ভয়ে ভয়ে বলছিল, “কেউ যদি ওকে ধরে নিয়ে গিয়ে…।” কথাটা শেষ না করে কান্নায় ভেঙে পড়ল। হেলেন ওকে ধমকে দিয়ে বলল, “এসব কথা মনে আনবি না। আশা রাখ অ্যানাবেল ফিরে আসবে। আজ ইস্কুলের পর আর কাল শনিবার সারাদিন আমরা অ্যানাবেলকে খুঁজব।”

বেকি আর হেলেন বলতে লাগল, “মেয়েটা গেল কোথায়?”

শিউলি আর কান্না চাপতে পারল না, “শুনেছি আটচল্লিশ ঘন্টার মধ্যে কাউকে খুঁজে না পাওয়া গেলে তাকে জীবিত অবস্থায় পাওয়ার আশা খুব কম। কাল শনিবার সকালে আটচল্লিশ ঘন্টা হবে।”

বেকি বলল, “কাল সারাদিন আমরা অ্যানাবেলকে খুঁজব।”

শিউলি বলল, “আমার মনে হচ্ছে অ্যানাবেল মার সঙ্গে ঝগড়া করে চলে গেছে। কোথাও লুকিয়ে আছে। পুলিশ ওর ঘরের জিনিসপত্র তল্লাশি করে দেখছে যে ও পয়সা জমানোর কৌটো থেকে সব পয়সা নিয়ে গেছে।”

বেকি আর হেলেন এক সঙ্গে জিজ্ঞেস করল, “কত পয়সা ছিল? কত দূর যেতে পারবে? হোটেলে থাকতে পারবে?”

শিউলি উত্তর দিল, “এগারো-বারো বছরের মেয়ে হোটেলে ঘর খুঁজতে গেলে হোটেল পুলিশে খবর দেবে। শুনেছি ওর কৌটোতে যা পয়সা জমেছিল তাতে এক রাত্তিরের বেশি হোটলের ভাড়া হবে না।”

ওরা তিনজনেই বলল, “তাহলে কারো বাড়িতে লুকিয়ে আছে। তবে বন্ধুদের কারো বাড়ি গেলে এতক্ষণে জানাজানি হয়ে যেত। আর কোথায় লুকিয়ে থাকতে পারে?”

বেকি বলল, “শুনেছি পুলিশ নাকি মোবাইলে ফোন করে মোবাইলটা কোন অঞ্চলে বাজছে বলতে পারে।” শিউলি উত্তর দিল, “পুলিশ তো মনে করছে ও বেশি দূর যায়নি। পুলিশ এানাবেলের ছবি অনেক জায়গায় দেবে বলেছে, এ অঞ্চলে ওকে কেউ দেখতে পেলে ঠিক পুলিশকে জানাবে।”

ইস্কুলের ছুটির পর তিন বন্ধু শপিং সেন্টারটা ভাল করে খুঁজে দেখল। কোথাও অ্যানাবেলের চিহ্নও মিলল না। শনিবার ওরা অ্যানাবেলের ছবি নিয়ে লাইব্রেরি, সিনেমা হল খুঁজে দেখল।

শহরের বাইরে একটা লাইব্রেরিতে লাইব্রেরিয়ান বলল একজন নতুন মেয়েকে গত দু’দিন ধরে লাইব্রেরিতে আসতে দেখেছে। তবে মেয়েটা স্কার্ফে মাথা ঢেকে কম্পিউটারে কাজ করছিল বলে মুখটা ভাল করে দেখতে পায়নি। হেলেন জানতে চাইল, “কী রঙের স্কার্ফ বলতে পারেন?”

লাইব্রেরিয়ান একটু ভেবে বললেন, “মেরুন রঙের।”

শিউলি বলল, “মিসেস কুপারকে জিজ্ঞেস করতে হবে বাড়ি থেকে কোন মেরুন রঙের স্কার্ফ হারিয়েছে কি না।” বেকি শিউলিকে বলল, “অ্যানাবেলের ঠাকুমা শুনেছিলাম শহরের বাইরে এদিকে কোথায় থাকেন। অ্যানাবেল বলেছিল ও মাঝে মাঝে শনি-রবিবার ঠাকুমার জন্যে কেনাকাটা করতে আসে। একবার ওর ঠাকুমার কাছে যাবি? তুই বাড়িটা চিনিস?”

শিউলি উত্তর দিল, “একবার গিয়েছিলাম। তবে বুড়োনুষকে বিরক্ত করলে মিস্টার কুপার চটে যাবেন। আর ঠাকুমা কিছু জানলে মিস্টার কুপারকে ঠিক জানাতেন।”

বেকি বলল, “আজ বাড়ি ফিরে যাই। মিসেস কুপারের কাছ থেকে মেরুন স্কার্ফের রহস্যটা জেনে কাল আবার আসব।”  

পরের দিন সকালে শিউলি বেকি আর হেলেনকে জানাল মিসেস কুপার বলেছেন অ্যানাবেলের কোন মেরুন স্কার্ফ ছিল না। বেকি আর হেলেন একসঙ্গে বলে উঠল, “চ্যারিটির দোকান থেকে সস্তায় একটা স্কার্ফ কিনে ছদ্মবেশ নিয়েছে বোধহয়। লাইব্রেরির মেরুন স্কার্ফবাঁধা মেয়েটাকে তাহলে একবার দেখতেই হবে।”

শিউলি বলল, “আজ রবিবার লাইব্রেরি বন্ধ। মেয়েটা আসবে না। এ্যনাবেলের ঠাকুমার বাড়িতে একবার ঘুরে আসি। বলব আমরা এদিকে বেড়াতে এসেছিলাম। ভাবলাম অ্যানাবেল আজ আপনার কাছে এসেছে কি না দেখতে এলাম।”   

তিন বন্ধু বেলা সাড়ে বারোটা নাগাদ অ্যানাবেলের ঠাকুমার বাড়ি হাজির হল। দু-তিন বার বেল বাজানোর পর কেউ দরজা খুলল না দেখে ওরা ফিরে যাবে কি না ভাবছিল, এমন সময় এক মহিলা এসে দরজার পাশে একটা বাক্সের গায়ে নম্বর টিপতেই বাক্সটা খুলে গেল। বাক্স থেকে চাবি বের করে দরজা খুললেন। হেলেন ফিসফিস করে শিউলিকে বলল, “এই চাবির বাক্সটাকে বলে ‘কি সেফ’। সেফের নম্বরটা জানা থাকলে তবেই ওটা খোলা যায়। আমার দিদুর বাড়িতেও  আছে। দিদু একা থাকেন। যদি শরীর খারাপ হলে দরজা খুলতে না পারেন তাই মা এই ব্যবস্থা করেছেন।” 

মহিলা ওদের দাঁড়িয়ে থাকতে থেকে জিজ্ঞেস করলেন, “তোমরা এখানে কী করছ?”

বেকি এগিয়ে গিয়ে বলল, “আমরা অ্যানাবেলের বন্ধু। এ-পাড়ায় এসেছিলাম, ভাবলাম ঠাকুমার সঙ্গে দেখা করে যাই।”

মহিলা বললেন, “অ্যানাবেল তো এই শনিবার আসেনি। বেলা সাড়ে বারোটা বেজেছে, আজ আর ও আসবে না।”

মহিলা বাড়িতে  ঢুকে বললেন, “তোমরা ভিতরে এসে ঠাকুমার কাছে বস। বুড়ো মানুষ, চোখে ভাল দেখেন না, কানে শোনেন না। সারাদিন একা একা বসে থাকেন। লোকজন এলে খুশি হন।”

শিউলি বেকি আর হেলেনকে নিয়ে ঠাকুমার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। খুব জোরে জোরে ঠাকুমাকে বলল, “ঠাকুমা, আমি অ্যানাবেলের বন্ধু শিউলি। একবার অ্যানাবেলের সঙ্গে এসে আপনার কাছে সারাদিন ছিলাম। আপনার মনে আছে? আমরা দোকান থেকে চিনে খাবার এনে খেয়েছিলাম।”

উনি বললেন, “কাছে এস। মুখটা দেখি। খুব মনে আছে। চোখে দেখি না, কানে শুনি না বলে আমার মাথাটাও কি গেছে?”

শিউলি বেকি আর হেলেনের সঙ্গে ঠাকুমার আলাপ করিয়ে দিল। ঠাকুমা খুশি হয়ে বললেন, “একা একা বসে থাকি। কেউ এলে বড্ড ভাল লাগে। অ্যানাবেল কেন এল না জানি না।”

ইতিমধ্যে সেই মহিলা ঠাকুমার দুপুরের খাবার গরম করে এনে টেবিলে রেখে বললেন, “আপনি এদের সঙ্গে গল্প করতে করতে খান। আমি আবার ওবেলা আসব।”  তারপর শিউলিদের বললেন, “ওঁর খাওয়া হয়ে গেলে এঁটো বাসন রান্নাঘরে রেখে এস। আমি ও-বেলা পাঁচটায় এসে ধুয়ে দেব। রান্নাঘরের পিছনের দরজা খুলে বাগানে যেতে পারবে। এ-বছর গাছে অনেক আপেল আর ভিক্টোরিয়া প্লাম হয়েছে। প্লামগুলো খুব মিষ্টি। পাখি আর কাঠবিড়ালিতে খাচ্ছে। কিছু তুলে নিয়ে যেও।”

ঠাকুমা বললেন, “মিসেস ফার্নান্ডেজ দু’বেলা খাবারের ব্যবস্থা করেন বলেই এখানে আছি। নইলে বৃদ্ধাশ্রমে গিয়ে থাকতে হত। প্রাণ থাকতে আমি নিজের বাড়ি ছেড়ে কোথাও যাব না।”

শিউলি বলল, “ঠাকুমা আমরা বাগানটা ঘুরে দেখব।”

ঠাকুমা বললেন, “বাগানে ফলপাকড় কিছু পেলে বাড়ি নিয়ে যেও। আর রান্নাঘরের দেওয়াল আলমারিতে অ্যানাবেল আগের সপ্তাহে চকোলেট বিস্কুট, আলুভাজা আরো কীসব কিনে রেখে গেছে। আমি তো ওসব খাই না। ও এলে খায়। তোমরা আলমারি খুলে যা পার খেও।”

শিউলি আর হেলেন বলল, “বেকি, তুই ঠাকুমার কাছে বস। আমরা রান্নাঘর থেকে কিছু খাবার নিয়ে আসি।” রান্নাঘরের আলমারি খুলে ওরা দেখল বিস্কুটের প্যাকেট প্রায় খালি। আলুভাজার ছোট একটা প্যাকেট ছাড়া বিশেষ কিছু নেই। ওরা একদিকে যেমন হতাশ হল, অন্যদিকে ওদের কৌতূহল বেড়ে গেল। হেলেন বলল, “ব্যাপার সন্দেহজনক মনে হচ্ছে। খাবারদাবার কিছু নেই একথা ঠাকুমাকে না বলাই ভাল।”

ওরা পেছনের দরজা খুলে বাগানে গেল। গাছ ভর্তি আপেল আর প্লাম। গাছের তলায় ফল গড়াগড়ি যাচ্ছে। শিউলি কিছু ফল নিয়ে বাড়ির ভিতরে গিয়ে বেকিকে ডেকে আনল। বেকি ঠাকুমার এঁটো বাসন রান্নাঘরে রেখে বাগানে ময়লা ফেলার ডাস্টবিনে ঠাকুমার ফেলে দেওয়া খাবার, ফলের খোসা ফেলতে গেল। ডাস্টবিনের ঢাকনা খুলে দেখল সাংহাই কিচেন চিনে দোকানের কয়েকটা খালি প্যাকেট।

বেকির গোয়েন্দাগিরি শুরু হয়ে গেল। ও হেলেন আর শিউলিকে ডাকল, “ডাস্টবিনটা দেখে যা।”

ওরা দৌড়ে এসে ডাস্টবিনের ভিতরটা দেখে বেকিকে জিজ্ঞেস করল, “কী ব্যাপার?”

বেকি বলল, “কিছুই বুঝতে পারছিস না? চিনে খাবার কার প্রিয় খাদ্য?”

হেলেন লাফিয়ে উঠে বলল, “বুঝতে পেরেছি, বুঝতে পেরেছি। আমারা এদিকে চিন্তা করে মরছি আর একজন ঠাকুমার বাড়িতে লুকিয়ে লুকিয়ে চাওমিন আর সুইট অ্যান্ড সাওয়ার চিকেন খাচ্ছেন।”

বেকি বলল, “শুধু কি তাই? আমরা সন্ধেবেলা ডিম আর আলু ভাজা গিলে একগাদা হোমওয়ার্ক করছি। উনি গল্পের বই পড়ছেন।”

শিউলি বলল, “ওসব বাজে কথা ছাড়। আমার মনে হচ্ছে অ্যানাবেল রাত্তিরে এ বাড়িতেই থাকে। ও পিছনের দরজা দিয়ে আসে। ও তো জানে কী করে দরজা খুলতে হয়।”

হেলেন বলে উঠল, “এবার বুঝতে পরেছি। ঠাকুমা তো শুধু সামনের দুটো ঘরে থাকেন। সিঁড়ি ভাঙতে পারেন না বলে দোতলায় ওঠেন না। রান্নাঘরেও বিশেষ আসেন না। অ্যানাবেল যদি চুপিচুপি ভোরবেলা উঠে বেরিয়ে যায় আর সন্ধে সাতটার পর ফিরে ওপরে উঠে যায়, ঠাকুমা কিছুই জানতে পারেন না।”

শিউলি আরো যোগ দিল, “মিসেস ফার্নানডেজ ছটার মধ্যে খাইয়ে দিয়ে চলে যান। ঠাকুমাতো সারাদিন টেলিভিশন খুলে বসে থাকেন।” হেলেন বলল, “আর অ্যানাবেল দোতলায় বসে মুখোরোচক চিনে খাবার খায়।”

বেকি বলল, “এভাবে তো বেশিদিন চলবে না! পয়সা ফুরিয়ে গেলে কী করবে?”

হেলেন টিপ্পনী কাটল, “ঘরের মেয়ে গুটি গুটি ঘরে ফিরে আসবে। তারপর মিসেস কুপারের হাতে মজাটা টের পাবে।”

শিউলি বলল, “এসব আমরা সন্দেহ করছি। অ্যানাবেলকে হাতেনাতে ধরতে না পারলে এ-সব সন্দেহের কোন মানে হয় না।”

একটু ভেবে শিউলি বলল, “তোরা দুজন ভিতরে গিয়ে ঠাকুমার সঙ্গে গল্প করবি। ঠাকুমাকে বলবি যে আমি বাগানে আছি। আমি সেই সুযোগে দোতলাটা দেখে আসব। সেখানে অ্যানাবেলের কোন চিহ্ন মেলে কি না। জামা-কাপড় কি বইপত্তর?”

দোতলায় তিনটে শোবার ঘর আর একটা বাথরুম। ঠাকুমা সিঁড়ি ভেঙে ওপরে উঠতে পারেন না বলে ওঁর সব ব্যবস্থা এখন নীচেই। শিউলি সব ঘর খুঁজে দেখল। দেয়ালে টাঙানো অ্যানাবেলের ছোটবেলার কয়েকটা ফটো ছাড়া কোন চিহ্নই পেল না। শিউলি কাঠের সরু সিঁড়ি বেয়ে দেখল এাটিকের ছোট ঘরের দরজায় তালা দেওয়া। ঘরের ভিতর কি আছে জানার জন্যে শিউলির খুব কৌতূহল হচ্ছিল। কিন্তু ও ঠাকুমাকেই বা কী করে জিজ্ঞেস করবে ভেবে পেল না। তারপর ওর মনে হল বাথরুমটা ভাল করে দেখা হয়নি। বাথরুমে তো অ্যানাবেলের যেতেই হবে। বাথরুমেও শিউলি কিছু পেল না।

সিঁড়ি দিয়ে ও যখন নামছিল, হঠাৎ ওর চোখে পড়ল সিঁড়ির সবচেয়ে নীচের ধাপে সরু রূপোলি রঙের কী যেন চকচক করছে। শিউলি সেটা কুড়িয়ে নিয়ে দেখল একটা চুলের ক্লিপ। তাতে একটা হালকা বাদামি রঙের ছোট চুল আটকে আছে।

ক্লিপটা হাতে নিয়ে উত্তেজনায় শিউলির বুক ধুকধুক করছিল। অ্যানাবেলের চুলও তো বাদামি। ক্লিপটা তাহলে অ্যানাবেলেরই। ও তখন নিশ্চিত যে অ্যানাবেল এ বাড়িতেই আছে। এখনি বেকি আর হেলেনকে ব্যাপারটা বলা দরকার।

শিউলি দৌড়ে ঠাকুমার ঘরে এসে বলল, “ঠাকুমা, অনেক দেরি হয়ে গেল। মা চিন্তা করবেন। বেকি, হেলেন, চটপট উঠে পড়্।”

ঠাকুমা বললেন, “আবার এস। বড় ভাল লাগল। সাবধানে যেও।”

বাড়ির বাইরে এসে বেকি আর হেলেন বলল, “কিছু পেলি?”

শিউলি চুলের ক্লিপটা দেখাল। ওরা দুজনে উত্তেজিত হয়ে বলল, “এতো এানাবলের ক্লিপ।”     

শিউলি বলল, “আমি মনে করি এই বাদামি চুলটাও অ্যানাবেলের। পুলিশ চুল থেকে ‘ডি এন এ’ টেস্ট করে বলে দিতে পারবে এটা কার চুল। টেলিভিশনে দেখিসনি পুলিশরা ‘ডি এন এ’ দেখে চোর, খুনী এদের খুঁজে বের করে। প্রত্যেক লোকের  ‘ডি এন এ’ আলাদা। এটা আমাদের শরীরের জন্মগত বিশেষত্ব।”

বেকি বলল, “আমরা কি থানায় গিয়ে এই ক্লিপটা জমা দেব?”

শিউলি বলল, “দাঁড়া, একটু ভেবে দেখি। আমরা কষ্ট করে অ্যানাবেলকে খুঁজে বের করব আর পুলিশ এসে তাতে ভাগ বসাবে।”        

তিন বন্ধু জল্পনা করতে করতে বাড়ি ফিরল। হেলেন বলল, “অ্যানাবেলকে হাতেনাতে ধরতে হলে আমাদের ঠাকুমার বাড়িতে খুব ভোরে বা রাত্তিরে যেতে হবে।”

শিউলি বলল, “সেখানেই তো আমাদের অসুবিধে। বাড়িতে না জানিয়ে খুব ভোরে বা রাত্তিরে আমরা কী করে যাব? তবে যা করার খুব তাড়াতাড়ি করতে হবে, নইলে মিসেস কুপারের মাথা খারাপ হয়ে যাবে।”

বেকি বলল, “আমার মাথায় একটা বুদ্ধি খেলছে।”

হেলেন বলল, “হেঁয়ালি না করে খুলে বল।”

বেকি বলল, “সাংহাই কিচেনের মালিক বুড়ি চিনে মহিলাকে কাজে লাগাতে হবে। ওঁকে পুরো ব্যাপারটা খুলে বলব। অ্যানাবেলের ছবিও নিয়ে যাব। ও তো মনে হয় রোজই ওখান থেকে খাবার কিনে খাচ্ছে।”

শিউলি যোগ দিল, “আমি আগের বার যখন এসেছিলাম ওখান থেকেই আমরা চিনে খাবার কিনেছিলাম। আর বুড়োমানুষ হয়তো জানেনই না যে মেয়েটা বাড়ি থেকে পালিয়ে এসে রোজ চাইনিজ ভোজ খাচ্ছে।”

পরের দিন সোমবার। ইস্কুলের পর ড্রামা ক্লাব কেটে তিন বন্ধু সাংহাই কিচেনে গেল। ওরা বাড়িতে বলে গেল যে ওরা একটা লাইব্রেরিতে বইমেলা দেখতে যাবে। ফিরতে সন্ধে হবে। তিনজনে যাচ্ছে জেনে বাড়ির লোক নিশ্চিন্ত হলেন।

বিকেল পাঁচটা। সাংহাই কিচেনের মালিক মিসেস চিউ কাউন্টারে বসে ঝিমোচ্ছিলেন। সন্ধের আগে দোকানে খদ্দের বিশেষ আসে না। তার ওপর সেদিন সোমবার। সপ্তাহের প্রথম  দিন, লোকের ফুর্তি করার মতো মেজাজ থাকে না। মিসেস চিউ তিনজন ইস্কুলের মেয়েকে দেখে অবাক হলেন।

শিউলি এগিয়ে গিয়ে মিসেস চিউকে ওদের আসার কারণটা জানাল আর অ্যানাবেলের হারিয়ে যাওয়া ও পুলিশের তদন্ত করা সবই খুলে বলল। মিসেস চিউ অ্যানাবেলের ছবিটা দেখে বলে উঠলেন, “একে তো চিনি। এ আমার বাঁধা খদ্দের। শনি-রবিবার এসে খাবার কেনে। গত দু-দিন রোজই আসছে। খুব চুপচাপ ভদ্র মেয়ে।”

বেকি জিজ্ঞেস করল, “কখন আসে?”

উনি উত্তর দিলেন, “এই ছ’টা নাগাদ।”

ওরা তিনজনেই অনুরোধ করল, “আপনার সাহায্য চাই। আমরা এখানে লুকিয়ে থেকে ওকে ধরতে চাই। তারপর ওকে বাড়ি ফিরয়ে নিয়ে যাব। ওর মা খুব কান্নাকাটি করছেন। খাওয়াদাওয়া ছেড়ে দিয়েছেন।”

মিসেস চিউ বললেন, “নিশ্চয়ই সাহায্য করব। তবে মেয়েটা যদি আজ না আসে? অন্য কোথায় মুখ বদলাতে যায়?”

শিউলি বলল, “এখানে সাংহাই কিচেন ছাড়া ওর আর কোন খাবার জায়গা নেই। আর আছে মশলা কাফে। আমাদের অ্যানাবেল পাক্কা মেমসাহেব। ঝালমশলা খায় না।”

মিসেস চিউ সব কথা শুনে বললেন, “ঠিক আছে, তোমরা কাউন্টারের পিছনে মাটিতে বসে থাক। অ্যানাবেল দোকানে ঢুকে তোমাদের দেখতে পাবে না। তারপর খাবারের অর্ডার দিয়ে ও যখন অপেক্ষা করবে তোমরা তখন বেরিয়ে আসবে। ও আর পালাবার পথ পাবে না।”

তিন বন্ধু গাদাগাদি করে কাউন্টারের পিছনে মাটিতে বসে পড়ল। সেখান থেকে দোকানের দেয়াল ঘড়িটা দেখা যায়। ঘড়িতে পাঁচটা চল্লিশ। তিনজন উত্তেজিত অবস্থায় অ্যানাবেলের অপেক্ষায় বসেছিল। ঘড়িতে পাঁচটা পঁয়তাল্লিশ… পাঁচটা পঞ্চাশ বাজল। অ্যানাবেলের পাত্তা নেই।

ছ’টা বাজতে পাঁচ। ক্যাঁচ করে দরজা খোলার শব্দ হল। অ্যানাবেলের গলা শুনবে বলে ওরা দম বন্ধ করে বসেছিল। এক হেঁড়ে গলা শোনা গেল, “গুড ইভনিং! দুটো এগ ফ্রায়েড রাইস, একটা চিকেন আর মাশরুম, একটা পর্ক আর পাইনএ্যাপেল আর চারটে ভেজিটেবল স্প্রিং রোল। আটটার সময় নিয়ে যাব।”

মিসেস চিউ জিজ্ঞেস করলেন, “প্রন ক্র্যাকার লাগবে না?”

“লাগবে লাগবে। থ্যাংকিউ, থ্যাংকিউ।” বলে হেঁড়ে গলা ঝড়ের বেগে বেরিয়ে গেল।

বেকি হতাশ হয়ে বলল, “অ্যানাবেল তো এখনও এল না। মাঝখান থেকে লোকটার খাবারের লিস্ট আমার খিদে পাইয়ে দিল। সেই দুপুর একটায় দুটো স্যান্ডউইচ খেয়েছি।”

এরপর আরো দু’বার ওরা হতাশ হল। একটা ছোট ছেলে এক প্যাকেট চাউমিন কিনতে এল। এক স্টাইলিশ মহিলা খাবারের মেনু নিতে এলেন। বলে গেলেন, “টেলিফোনে অর্ডার দেব। হোম ডেলিভারি।”

শিউলি হতাশ হয়ে বলল, “আজ তাহলে অ্যানাবেল  এল না।”

 ঘড়িতে ততক্ষণে ছ’টা কুড়ি বাজল। এমন সময় কে যেন ধাক্কা দিয়ে দরজাটা খুলে হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, “গুড ইভনিং, মিসেস চিউ।”

এবার অ্যানাবেলের গলা, “এক প্যাকেট চিকেন চাউমেন। আজকে আর কিছু না। আমি অপক্ষা করছি।” মিসেস চিউ বললেন, “দাঁড়িয়ে আছ কেন? বস। মিনিট পনেরো লাগবে।”

তারপর নীচের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলেন। সঙ্গে সঙ্গে তিন মূর্তি কাউন্টারের পিছনে উঠে দাঁড়াল। এক সঙ্গে কোরাসে বলে উঠল, “গুড ইভনিং মিস কুপার।”

অ্যানাবেল হতভম্ব। ও বুঝতেই পারছিল না এটা কী করে সম্ভব হল। তিনজন দৌড়ে এসে অ্যানাবেলকে ঘিরে দাঁড়িয়ে বলল, “এখন কোথায় যাবি? পালাবার পথ পাবি না। ঠাকুমার বাড়িতে লুকিয়ে থেকে মা-বাবাকে যা দুশ্চিন্তায় ফেলেছিস। সবাই ভাবছে তোকে কেউ কিডন্যাপ করেছে।”  

বেকি ফোড়ণ কাটল, “এমন দুষ্টু মেয়েকে কিডন্যাপার ফেরত দিয়ে যেত।”

মিসেস চিউ বললেন, “অ্যানাবেল, সময় নষ্ট না করে মাকে এক্ষুনি ফোন কর।”

অ্যানাবেল মোবাইলটা খুলে মিউ মিউ করে বলল, “মাম, আমি বাড়ি যাব।”

ওদিক থেকে মাম কী বললেন শোনা গেল না। আধঘন্টা পর মিস্টার আর মিসেস কুপার গাড়ি নিয়ে সাংহাই কিচেনে এলেন। অ্যানাবেলকে ফিরে পেয়ে ওঁরা মেয়ের ওপর সব রাগ ভুলে গেলেন। মিস্টার কুপার শিউলিদের বললেন, “তোমরা ইস্কুল থেকে সোজা এসেছ মনে হচ্ছে। খিদে পেয়ছে নিশ্চয়ই।”

খাবারের মেনুটা দেখে অর্ডার দিলেন, “ডিনার ফর সিক্স। ভাল করে প্যাক করে দেবেন।” সবাইকে বললেন, “বাড়ি চল। খাওয়াদাওয়ার পর আর সব কথা হবে। এই তিন মেয়ে গোয়েন্দা না থাকলে অ্যানাবেল আমাদের আরো কিছুদিন ঘোল খাওয়াত।”

মিসেস কুপার পুলিশকে ফোন করে জানালেন। পুলিশের বড়কর্তা বললেন, “আজ রাত্তিরেই আমরা আপনাদের সঙ্গে দেখা করে সব জানব।”

মিস্টার কুপার বললেন, “আমি পুলিশকে বলব তিন মেয়ে গোয়েন্দার কাগজে একটা ছবি দিতে। এবার তাড়াতাড়ি বাড়ি চল।”

সবাই মিলে মিস্টার কুপারের পিপল ক্যারিয়ার গাড়িতে উঠল। অ্যানাবেল মিউ মিউ করতে লাগল, “ঠাকুমার বাড়ির এ্যাটিকে আমার জিনিসপত্র পড়ে রইল।”

মিস্টার কুপার চটে গেলেন, “বুড়োমানুষকে আর রাত্তিরে বিরক্ত করতে হবে না। মা যখন কিছু জানেন না, ওঁর না জানাই ভাল।”

মিসেস কুপার উত্তর দিলেন, “ওঁকে আগে বিরক্ত করলে অ্যানাবেলকে আর কোথাও খুঁজতে হত না।”      

অলঙ্করণঃ রাহুল মজুমদার

জয়ঢাকের সমস্ত গল্প ও উপন্যাস একত্রে এই লিংকে

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Twitter picture

You are commenting using your Twitter account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s