বিদেশী গল্প ইংরিজি গল্প-আগে আমার কথা শোন জন ম্যাকলে। অনু অমিত দেবনাথ বর্ষা ২০১৭

অমিত দেবনাথ এর সমস্ত গল্প একত্রে

এসো ওয়াল্টার,তোমাকে একটা গল্প শোনাই। একজন লোকের গল্প। এমন একজন লোকের গল্প,যাকে তুমি চেনো।  তার নাম হার্ভে নিউসাম,যে কদিন আগে মারা গেছে।

ওয়াল্টার,তুমি তো একজন বিচারক,জজসাহেব।  আর আমি হলাম ডাক্তার,প্রয়াত হার্ভে নিউসামের ডাক্তার।  কাজেই আজ এখানে,এই কানট্রি ক্লাবের লনে বসে পান করতে করতে তোমাকে আমি গল্পটা শোনাতেই পারি। এবং এই গল্পটা তোমাকে আমি এমনভাবে পেশ করতে পারি,যাতে তুমি শেষমেষ রায় দেবে যে লোকটা একজন খুনি।  না,এতে অমন ভুরু কুঁচকে তাকানোর কিছু নেই,আগে আমাকে গল্পটা শেষ করতে দাও।

হার্ভে নিউসামকে তুমিও চিনতে,তবে আমি যেভাবে চিনতাম,সেভাবে নিশ্চয় নয়। তোমার আমার মতই ওরও বয়স ছিল ষাটের কোঠায়। এই ক্লাবেরই মেম্বার ছিল সে,পেশাদার হিসেবে দারুন সফল,বিরাট অ্যাকাউন্টিং প্র্যাকটিস,ভাল স্কুলে পড়াশোনা,ঠিকঠাক বিয়ে। এই বয়সেও দারুন সুদর্শন,একমাথা সাদা চুল,উজ্জ্বল চোখ,দুষ্টু হাসি।

নিশ্চয় ওকে একটু একটু মনে পড়ছে।  তাহলে নিশ্চয় ওর সম্বন্ধে আরো কিছু মনে পড়ছে।ওর কথা বলার ধরনটা।  তাহলে তোমার এজলাসে আমার প্রথম কেস পেশ করছি —

প্রমাণ ক।

বছর কয়েক আগে আমার একটা নেমন্তন্ন ছিল,একটা গার্ডেন পার্টিতে।  বেশ বড় পার্টি ছিল সেটা।  সেখানেই আমি প্রথম খেয়াল করি হার্ভের কথার ফাঁদে একজনকে পা দিতে।  হ্যাঁ,আমরা সবাই অল্পবিস্তর ওর কথার মায়াজালে পড়েছি,তবে আমরা সেটা কাটিয়ে উঠতে পারতাম।  কিন্তু এক্ষেত্রে সেটা হল না।  পার্টি তখন প্রায় শেষের দিকে,দেখলাম সোনালি চুলের এক সদ্যবিবাহিত সুন্দরী মহিলার সঙ্গে হার্ভে নিউসাম কথা বলছে। কাছে ঘেঁষে বেশ ঘনিষ্ঠ হয়ে কথা বলছে,কথা বলছে,কথা বলছে। সে কি কথা বলার ধুম!আর কথাবার্তার বিষয়?এমন কোন বিষয় বাদ নেই,যা সে বলছে না,এমনকি সিরিয়াস ব্যাপারেও।

তোমার নিশ্চয় মনে পড়ছে ওর কায়দাকানুনগুলো?কিভাবে ও লোক ধরে রাখতো?যখনই দেখতো কেউ বোর হয়ে যাচ্ছে,ও সঙ্গে সঙ্গে অন্য বিষয়ে চলে যেত,এমন বিষয়ে,যা তুমি শুনতে বাধ্য হবে?অথবা যখনই তুমি ভাবছো আর কিচ্ছু শোনার নেই,তক্ষুনি ও এমন ভাব দেখাতো যেন ওর মত শ্রোতা আর দুনিয়ায় নেই?অথবা-সবচেয়ে খারাপ যেটা-যখনই তুমি বলছ এবার কিন্তু যেতে হবে, তখনই ওর তোমার দিকে সেই আশ্চর্য চাহনি দেওয়াটা?

এককথায়,মেয়েটার ওপর ও এর সবকটাই প্রয়োগ করল। মেয়েটার ততক্ষনে পাঁচবার না ছ’বার গুডবাই জানানো হয়ে গেছে,ওর স্বামীও সেটা বলেছে ওর পাশে দাঁড়িয়ে। কিন্তু সেসব বেকার হয়ে গেল। আর তখনই দেখলাম ওর স্বামীর ধৈর্যের বাঁধ ভাঙতে শুরু করেছে। ওর স্বামী তখন স্ত্রীর চোখে দেখতে পাচ্ছে হার্ভের প্রতি ওর স্ত্রীর আকর্ষণ-হার্ভের ব্যক্তিত্ব,অভিঞ্চতা-সব কিছুর প্রতি ঈর্ষা জেগে উঠছে ধীরে ধীরে ওর স্বামীর মনের গভীরে।

শেষ পর্যন্ত,সেই তরুণ সেই কাজটা করল,যা তখন একমাত্র করার ছিল। আমি যদি তখন ওকে থামাতে পারতাম!

সেই তরুণ সোজা হার্ভের স্ত্রীর কাছে চলে গেল-নিশ্চয়ই তোমার তাকে মনে আছে,সুন্দরী,সাদা চুল,সপ্রতিভ-গিয়ে সটান বলল, “আপনার স্বামীকে বাড়ি নিয়ে যেতে পারছেন না?”

একজন সদ্য বিবাহিত যুবকের পক্ষে এটা একটা মারাত্মক ভুল। কারণ ওরা যখন চলে যাচ্ছে,আমি শুনতে পেলাম,ওর স্ত্রী ফোঁপাতে ফোঁপাতে স্বামীকে বলছে, “তুমি এরকম একটা কথা বলতে পারলে? অত ভাল একজন বয়স্ক মানুষ? আমি তো জানিই আমাদের যেতে হবে,কিন্তু আমি তো শুনছিলাম,আমার তো বিরক্ত লাগছিল না? তুমি-”

সংক্ষেপে,কয়েকমাসের মধ্যেই ওদের ডিভোর্স হয়ে যায়।

আমি বলব,হার্ভে নিউসাম একটা বিবাহিত জীবনকে খুন করল।

কিন্তু এটাকে তো সত্যিকারের খুন বলা যায় না! তাই আমি পেশ করছি –

 প্রমাণ খ।

এটাও ছিল আরেকটা পার্টি,এই ঘটনার কয়েক বছর পরে। সেটাও ছিল বোধহয় এই ক্লাবেই,যদ্দুর মনে পড়ছে আমার। হার্ভে এটাতেও ছিল,এবং ওর সঙ্গে ছিল একটা লোক,বছর চল্লিশ বয়সের। লম্বা চেহারা,নম্র স্বভাব। আমি বসে বসে দেখছিলাম ব্যাপারটা। একধরণের লোক থাকে দেখবে,যারা একেবারে স্বভাব-শ্রোতা এবং এ ধরণের লোকদের সবাই পছন্দ করে। প্রথম প্রথম আমার ভালই লাগছিল দেখতে- শেষ পর্যন্ত সেই জুটি- বক্তা এবং শ্রোতা।

যদিও,অন্যরা যখন বিভিন্ন দিকে যাচ্ছে,একজনকে ছেড়ে আরেকজনের সঙ্গে গল্প করছে,তখনও এই দুজন একই জায়গায় দাঁড়িয়ে রয়েছে দেখে আমার একটু অস্বস্তি লাগছিল। কারণ আমি দেখছিলাম সেই লোকটার মুখ-তার সারা শরীর-ধীরে ধীরে শক্ত হয়ে উঠছে,একটা অস্বস্তির ছাপ ফুটে উঠছে সেখানে,যা দেখে মনে হচ্ছিল যে সমস্ত কিছুরই,এমনকি এই লোকটার,যে জন্ম-শ্রোতা,তারও শোনার একটা সীমা আছে। আমি সেদিকে এগোতে যাচ্ছিলাম,কিন্তু তার আগেই যা হওয়ার হয়ে গেল।

লোকটা এই ধাক্কা আর সামলাতে পারল না-পড়ে গেল মেঝেয়-হার্ট অ্যাটাক।

আমি তো ডাক্তার,আমার যা করার আমি করেছিলাম,ওয়াল্টার,বিশ্বাস কর। আমার স্ত্রী দৌড়ে গাড়ি থেকে আমার ডাক্তারি ব্যাগটা নিয়ে এসেছিল-ইনজেকশন,সি পি আর-সবকিছু। কিন্তু যখন অ্যাম্বুলেন্স এল,তখন সব শেষ।

ওহ্‌,আরেকটা কথা। যখন সেই লোকটা মেঝেয় হাঁসফাস করছে,তখন ছটফট করতে করতে কিছু একটা বলার চেষ্টা করছিল,এমন কিছু,যেটা আমি আজ পর্যন্ত কাউকে বলিনি।

বাতাস-,হাঁফাচ্ছিল লোকটা, দম আটকে আসছে-বাতাস-

 তারপর সে কোনরকমে একটা হাত তুলে হার্ভে নিউম্যানকে দেখাল।

-ওর কাছে যেও না-পালাও-

কী বলবে,ওয়াল্টার? তুমি তো বিচারক। এর থেকে কি এটাই প্রমাণ হয় না যে হার্ভে কথা বলে আক্ষরিক অর্থেই মানুষ খুন করতে পারে? 

এখনো তোমার কাছে এই প্রমাণ যথেষ্ট বলে মনে হচ্ছে না? ঠিক আছে,একটু অন্যদিক দিয়ে ভাবা যাক। আমি দেখাব,কিছু কিছু ব্যাপার আছে,যা মৃত্যুর চেয়েও ভয়ঙ্কর। তুমি এটা শোনার পর নিশ্চয় স্বীকার করতে বাধ্য হবে যে ঐ শ্রোতা লোকটা তো মরে গিয়ে বেঁচে গেছে,স্বর্গে আছে সে,কিন্তু হার্ভের আরেক শিকার এখনো জীবিত-তবে নরকযন্ত্রণা ভোগ করছে।

প্রমাণ গ।

আরেকটা পার্টি। খুবই খারাপ লাগছে বলতে-হার্ভের এবারের শিকার আমারই এক রোগী। চমৎকার ছেলে,বুদ্ধিমান,সদ্য প্রিন্সটন থেকে বেরিয়েছে। এবং সবচেয়ে বড় কথা-সে একজন লেখক। তার লেখা একটা গল্পের বইও বেরিয়েছে,অনেক স্বপ্ন তার চোখে-আকাশের সীমানা ছাড়িয়ে।

এই পার্টিতে অবশ্য আমি দূরে ছিলাম না,কাছেই ছিলাম,যেখানে তরুণ প্রতিভাবান ছেলেটি ছিল আরো কয়েকজনের সঙ্গে,এবং তাদের সঙ্গে ছিল হার্ভে। ছেলেটা হার্ভের কথা শুনছিল।

তুমি যদি কখনো হার্ভের কাছাকাছি থেকে থাক,তাহলে নিশ্চয় জানবে যে কীভাবে হার্ভে প্রত্যেকটি জিনিস জানত, প্রত্যেকটি বিষয়ের আদ্যোপান্ত নিয়ে কথা বলতে পারত? তার নিজের অভিজ্ঞতা নিয়েও?

সংক্ষেপে-সপ্তাহখানেক বাদে ছেলেটি আমার কাছে এল ফ্যাকাশে মুখে। বিড়বিড় করে বলল, আমার সব গেছে। আপনি বুঝবেন ডাক্তারবাবু-আমরা,লেখকরা-নিজেদের জগত নিয়ে থাকি। লেখালেখি করার জন্যই।

তারপর ছেলেটি আমার টেবিলে প্রচন্ড চাপড় মারল-ভীষণ ক্রুদ্ধ হয়ে।

-আমি আর লিখতে পারব না-ঐ বুড়োর বুকনির চোটে আমার আত্মবিশ্বাসটাই নষ্ট হয়ে গেছে। যদি পারিও-কত বছর লাগবে কে জানে।

আমি ওকে এক সাইকোলজিস্টের কাছে পাঠিয়েছিলাম। অনেকগুলো সিটিং দিতে হয়েছিল তাকে। শুনেছিলাম সে ওকে বুঝিয়েছিল যে জগতটাকে জানার জন্য,বোঝার জন্য ওর হার্ভের বয়সে পোঁছনোর দরকার নেই। আর লেখালেখি নিয়ে ওর অত চিন্তা করারও কিছু নেই-কারণ ওর লেখার ক্ষমতা ওরই আছে।

কিন্তু তাতে লাভ কিছু হয়নি। কারণ বহুবার সিটিং-এর পর,শেষ পর্যন্ত সেই লেখক ছেলেটা বলেছিল, ওই বুড়ো সব বলে ফেলেছে-সব ধরণের গল্পই। আমার আর কিছু লেখার নেই। আমার কল্পনাশক্তিটাই কেড়ে নিয়েছে ও।

সেই একদা তরুণ লেখক এখন বিজ্ঞাপনের কপি লেখে।

এই হল ঘটনা,ওয়াল্টার। প্রয়াত হার্ভে নিউসাম নিয়ে আমার আর কিছু বলার নেই। আর আমি এ-ও জানি,আমি যদি ঐ কথা-বলিয়ের কথা বলে আরো সময় নষ্ট করি,তবে তুমিও আমায় ঐ দলেই ফেলবে। কাজেই বন্ধু, চল, এখন ওঠা যাক-যেটা হার্ভে কখনই বলত না, কিন্তু আমি বলছি। আর আমি এটাও তোমাকে ভাবতে বলছি যে তুমি ভেবে দেখ হার্ভেকে খুনি সাব্যস্ত করবে কিনা,যেটা আমি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি।

আরো একটা জিনিস বলার আছে। এমন একটা ব্যাপার-তোমাকে ছুঁয়ে বলছি,যে ব্যাপারে আমি রীতিমত শঙ্কিত,আতঙ্কিত। আতঙ্ক যে ব্যাপারে,তাকে আমি বলতে চাই-

প্রমাণ ঘ-মৃত্যুর জন্য।

তুমি জান,যখন হার্ভে মৃত্যুশয্যায়,তখন আমিই তাকে দেখছিলাম। সেই শেষ মুহূর্তটায়-যখন,কখনো কখনো রোগীরা আশ্চর্যজনকভাবে চেতনায় ফিরে আসে,অবর্ণনীয় একটা ছাপ ফুটে ওঠে মুখের ওপর,কিছু বলার চেষ্টা করে,সম্ভবত ওপারের সঙ্গে-

 আমি আতঙ্কিত,ওয়াল্টার,মহা বিপদ নেমে আসছে স্বর্গের ওপর,কারণ আমি শুনলাম ভাঙা গলায়,হার্ভে শেষবারের মত বলছে:

না, ঈশ্বর, তোমার কথা পরে শুনব-আগে তুমি আমার কথা শোন।

জন ম্যাকলে রচিত একজিবিট ডি অবলম্বনে।

জয়ঢাকের গল্প ঘর

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Twitter picture

You are commenting using your Twitter account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s