অনুবাদ গল্প-ইংরিজি
অমিত দেবনাথ
বিকেল পাঁচটায় এড লয়েস তার হাত মুখ ধুয়ে,কোট আর টুপি পরে গাড়ি বার করে চালিয়ে দিল শহরে তার টেলিভিশন বিক্রির দোকানের উদ্দেশ্যে। খুব ক্লান্ত লাগছে। সারাটা দিন বেসমেন্টের ময়লা আর আলগা মাটি সাফ করে তার কাঁধ আর পিঠ একেবারে টনটন করছে। হাজার হোক, বয়সটা তো চল্লিশ ছুঁয়েছে। যাক, এই কাজটা লোক লাগিয়ে করালে যে টাকাটা লাগত, সেই টাকা দিয়ে জ্যানেট বরং একখানা ফুলদানি কিনতে পারবে। লয়েস এইসব ছোটখাটো কাজ নিজে করতে ভালোই বাসে।
অন্ধকার হয়ে আসছে। অস্তগামী সূর্যের আলো এসে পড়ছিল দ্রুত ধাবমান, ক্লান্ত আর বিরসবদন নিত্যযাত্রীদের ওপর। মহিলাদের হাতে আর কাঁধে নানারকম প্যাকেট আর ঝোলা। ইউনিভারসিটি ফেরত ছাত্রছাত্রীর দল মিশে যাচ্ছিল গোমড়ামুখো কেরানি, ব্যবসাদার আর অফিসফেরত সেক্রেটারিদের সঙ্গে। তার গাড়িটা থেমেছিল একটা লাল সিগনাল দেখে,সেটা সবুজ হতে আবার গাড়ি চালু করল সে। তার দোকান এতক্ষন খোলা ছিল তাকে ছাড়াই,এবার সে যাবে খানিকক্ষনের জন্য,বন্ধ করার আগে খানিকক্ষন কাজ করতে হবে,সারাদিনের হিসেবপত্তর বুঝে নিতে হবে,দরকার হলে দুয়েকটা জিনিস বিক্রিও করতে হবে বইকি। রাস্তার মাঝখানের টাউন পার্ক নামের ছোট্ট সবুজ স্কোয়ারটার পাশ দিয়ে আস্তে করে গাড়িটাকে চালিয়ে নিয়ে এল সে। তার দোকান “লয়েস টিভি সেলস অ্যান্ড সার্ভিস”-এর সামনে কোনও পার্কিং লট নেই। বিরক্তির একশেষ। বিড়বিড় করে একটা অস্ফুট মন্তব্য করে সে গাড়িটাকে ইউ-টার্ন করিয়ে আবার সেই সবুজ স্কোয়ারটার পাশে নিয়ে এল। স্কোয়ারটাতে রয়েছে একটা নিঃসঙ্গ ফোয়ারা, একটা বেঞ্চ আর একটা ল্যাম্পপোস্ট।
ল্যাম্পপোস্টটা থেকে কিছু একটা ঝুলছিল। জিনিসটা গাঢ় রঙের, আকারহীন, হাওয়ায় অল্পঅল্প দুলছিল সেটা। কোন পুতুল-টুতুল নাকি? লয়েস গাড়ির কাচটা নামিয়ে বাইরে তাকাল। এটা কী? কোন কিছুর বিজ্ঞাপন?মাঝে মাঝে চেম্বার অব কমার্স থেকে এখানে বিজ্ঞাপন ঝোলায় বটে।
আবার গাড়িটাকে একপাক ঘুরিয়ে সে স্কোয়ারের সামনে নিয়ে এল। পার্কের সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় ভাল করে গাঢ় রঙের জিনিসটাকে দেখল সে। এটা কোন পুতুল নয়। আর এটা যদি কোন কিছুর বিজ্ঞাপন হয়,তাহলে খুবই অদ্ভুত ধরনের বিজ্ঞাপন। ঘাড়ের পেছনটা শিরশির করে উঠল তার,একটা ঢোঁক গিলল সে। মুখ আর হাত দিয়ে গড়িয়ে এল ঘামের ধারা।
এটা একটা মড়া। মানুষের মড়া।
এই! কে আছ! এটা দেখে যাও! চেঁচিয়ে উঠল সে।
ডন ফারগুসন ধীরেসুস্থে দোকান থেকে বেরিয়ে এল কোটের বোতাম আটকাতে আটকাতে। খদ্দের দাঁড়িয়ে আছে, এড। বেশিক্ষণ থাকতে পারবো না।
“ওটা দেখেছো? এড আঙুল তুলে জিনিসটা দেখাল। আকাশের পটভূমিকায় দাঁড়িয়ে আছে ল্যাম্পপোস্টটা। জিনিসটা ঝুলছে পোস্ট থেকে। ওই যে! দেখেছ তো? কতক্ষণ ধরে রয়েছে এটা? এডের গলা ক্রমশ চড়ছিল। কারোর কোন হুঁশ নেই দেখছি। সবাই পাশ কাটিয়ে চলে যাচ্ছে।
ডন ফারগুসন ধীরেসুস্থে একখানা সিগারেট ধরাল। মাথা ঠান্ডা রাখ, ভাই। কোন কারণ আছে নিশ্চয়, নাহলে ওটা ওখানে থাকত না।
“কারণ? কীসের কারণ?”
ফারগুসন কাঁধ ঝাঁকাল। “ট্রাফিক সেফটি কাউন্সিল যেরকম অ্যাক্সিডেন্ট হলে ভাঙাচোরা গাড়িগুলো ওখানে সাজিয়ে রাখে লোককে দেখানোর জন্য, সেরকমই কিছু একটা হবে নিশ্চয়ই। আমি কী করে জানবো?”
জ্যাক পটার তার জুতোর দোকান থেকে বেরিয়ে এল। “কী হয়েছে বন্ধুগণ?”
“ল্যাম্প পোস্ট থেকে একটা মড়া ঝুলছে,” এড বলল, “আমি এক্ষুনি পুলিশকে ফোন করবো, “
“ওরা জানে নিশ্চয়ই,” পটার বলল, “নাহলে ওটা ওখানে থাকত না, “
“আমি দোকানে যাচ্ছি,”ফারগুসন পেছন ফিরল, “আগে ব্যাবসা,পরে মজা, “
লয়েসকে দেখে মনে হচ্ছিল তার হিস্টিরিয়া হয়েছে। “দেখতে পাচ্ছ না মূর্খ? দেখতে পাচ্ছ না ওখানে কী ঝুলছে? একটা মানুষের মড়া! একটা ডেডবডি!”
“নিশ্চয়ই,এড। আমি দেখেছি ওটা। এই তো, বিকেলে যখন কফি খেতে বেরোলাম,তখনই দেখেছি, “
“তার মানে তুমি বলতে চাইছ সারাটা বিকেল ওটা ওখানে ঝুলছে?”
“হ্যাঁ,নিশ্চয়ই। তাতে কী হল?” পটার ঘড়ি দেখল, “দেরি হয়ে গেল। দৌড়তে হবে দেখছি! পরে দেখা হবে, এড, “
পটার ঝটিতি পায়ে ফুটপাথ দিয়ে চলতে থাকা জনস্রোতে মিশে গেল। পার্কের পাশ দিয়ে চলেছে জনতার মিছিল। পুরুষ ও মহিলা। তাদের কেউ কেউ কৌতুহলী চোখে একঝলক তাকাচ্ছিল ঝুলন্ত বস্তুটার দিকে – তারপর আবার এগিয়ে যাচ্ছিল। কেউ থামছিল না, কেউ কোন গুরুত্বও দিচ্ছিল না।
“আমি ওখানে যাচ্ছি,বুঝলে,” ফিসফিস করে বলল লয়েস। রাস্তায় বয়ে চলা গাড়ির স্রোতের ফাঁকফোকর দিয়ে সে পার্কের দিকে এগোল। গাড়িগুলো হর্ন বাজাচ্ছিল অসহিষ্ণুভাবে। ওপারে পৌঁছে রেলিং টপকে সে পার্কের ভেতরে ঢুকে পড়ল।
লোকটা মাঝবয়সি। জামাকাপড় ছেঁড়া আর কোঁচকানো। পরনে একটা ধূসর স্যুট,যার গায়ে শুকনো কাদা লেগে আছে। ভবঘুরে বোধহয়। লয়েস একে কখনো দেখেনি। স্থানীয় কেউ নয়। মুখটা একপাশে ঘোরানো। বিকেলের হাওয়ায় শরীরটা নিঃশব্দে অল্প অল্প দুলছে। গায়ের চামড়ায় অনেক কাটাছেঁড়ার দাগ। গভীর ক্ষত। রক্ত জমে আছে। একটা চশমা ঝুলে রয়েছে একদিকের কান থেকে। চোখ ফুলে বুঁজে গেছে। মুখটা হাঁ করা,বিশ্রি নীলচে জিভ বেরিয়ে আছে সেখান থেকে।
“বাপরে!”বিড়বিড় করল লয়েস। অসুস্থ বোধ করছিল সে। গা গোলানোর ভাবটা কোনওক্রমে দমন করে সে ফিরে যাচ্ছিল নিজের জায়গায়। তার সারা শরীর কাঁপছিল থরথর করে অদ্ভুত এক অনুভূতি আর আতঙ্কে।
এই লোকটা কে? এখানে ঝুলছে কেন? এসবের মানে কী? আর সবচেয়ে বড় কথা – কেউ খেয়াল করছে না কেন?
ফুটপাথে একটা বেঁটেখাটো লোকের সঙ্গে ধাক্কা লাগল তার।
“দেখে চল হে!” বিরক্ত গলায় বলল লোকটা, “ওহ্!এড যে!”
এড মাথা ঝাঁকাল, “হ্যালো,জেনকিন্স, “
“কী হয়েছে তোমার?”স্টেশনারি দোকানের ক্লার্ক জেনকিন্স জিজ্ঞেস করল এডের হাত ধরে, “শরীর খারাপ নাকি?”
“ঐ মড়াটা। পার্কের, “
“হ্যাঁ,নিশ্চয়ই, “জেনকিন্স তার হাত ধরে তাকে লয়েস টিভি সেলস অ্যান্ড সার্ভিস-এর সামনে নিয়ে গেল, “শান্ত হও, “
মার্গারেট হেন্ডারসন তার জুয়েলারি দোকান থেকে বেরিয়ে এল, “কিছু হয়েছে নাকি?”
“এডের শরীর ভাল লাগছে না।”
লয়েস একটা ঝাঁকি মেরে সোজা হল, “কী হচ্ছেটা কী এসব? তোমরা দেখতে পাচ্ছ না? ঈশ্বরের দিব্যি-”
“ও কী বলছে বলতো?” মার্গারেট নার্ভাসভাবে বলল।
“মড়াটা!”এড চিৎকার করল, “ওখানে একটা মড়া ঝুলছে!”
বাইরে লোকজন জড়ো হয়ে গেছে, “কেউ অসুস্থ নাকি? আরে,এ তো এড লয়েস। তুমি ঠিক আছো,এড?”
“মড়াটা!”চিৎকার করছিল এড, ছটফট করছিল তাদের হাত থেকে ছাড়া পাওয়ার জন্য। কয়েকটা হাত ধরে রেখেছিল তাকে। সে এক ঝটকায় হাত ছাড়িয়ে নিল, “ছাড়ো আমাকে! আমি পুলিশের কাছে যাবো!পুলিশ ডাকতে হবে!পুলিশ!”
“এড-”
“একটা ডাক্তার ডাকা দরকার!”
“ও অসুস্থ!”
“নাহলে মদ খেয়েছে, “
লয়েস হাত পা ছুঁড়ে লোকজনের মধ্যে থেকে বেরোতে গিয়ে হোঁচট খেয়ে প্রায় পড়েই যাচ্ছিল। ঝাপসাভাবে সে দেখল সামনে সারি সারি কৌতুহলী, উদ্বিগ্ন মুখ। পুরুষ আর মহিলারা যেতে যেতে থমকে দাঁড়াচ্ছিল, দেখছিল এখানে কী গোলমাল হচ্ছে। লোকজনকে ঠেলে সে তার দোকানের দিকে যাচ্ছিল। সে দেখতে পাচ্ছিল ভেতরে ফারগুসন একজনকে একটা এমার্সন কোম্পানির টিভি সেট দেখাচ্ছে। পেট ফলি সার্ভিস কাউন্টারের পেছনে একটা নতুন ফিলকো সাজিয়ে রাখছে। পাগলের মত চিৎকার করছিল লয়েস তাদের দিকে তাকিয়ে। তার চিৎকার হারিয়ে যাচ্ছিল রাস্তার ট্রাফিক আর আশেপাশের লোকজনের কলরবে।
“কিছু কর!”সে চেঁচাচ্ছিল, “দাঁড়িয়ে থেকো না!কিছু কর!কিছু একটা গন্ডগোল ঘটেছে!বিচ্ছিরি কিছু!”
দুই বিশালদেহী পুলিশকে আসতে দেখে ভিড়টা পাতলা হয়ে গেল।
“নাম কী?”একজন পুলিশ নোটবই বার করল।
“লয়েস, “ এড ক্লান্তভাবে কপালের ঘাম মুছল, “এডওয়ার্ড সি লয়েস। শুনুন। ওদিকে -”
“ঠিকানা?” পুলিশের পরের প্রশ্ন।
পুলিশের গাড়িটা ট্রাফিকের ভিড়ের মধ্যে দিয়ে মসৃণভাবে চলছিল। লয়েস গাড়ির সিটে গা এলিয়ে দিয়েছিল ক্লান্তভাবে,হতভম্ব হয়ে। একটা লম্বা শ্বাস ছাড়ল সে। কেঁপে কেঁপে উঠছিল তার শরীরটা।
“১৩৬৮ হার্সট রোড, “
“পিকভিলের কাছাকাছি?”
“হ্যাঁ, “লয়েস একটু কষ্ট করে সোজা হয়ে বসল, “আমার কথা শুনুন। ওই ওদিকে – পার্ক স্কোয়ারের ল্যাম্প পোস্টটায় -”
“আজ সারাদিন কোথায় ছিলেন?” স্টিয়ারিং ধরা পুলিশটা জানতে চাইল।
“সারাদিন?”
“দোকানে ছিলেন না নিশ্চয়ই?”
“না,” মাথা নাড়ল সে, “আমি বাড়িতে ছিলাম। বেসমেন্টে, “
“বেসমেন্টে?”
“হ্যাঁ। নতুন তৈরি করেছি। ময়লা পরিস্কার করছিলাম। কেন,তাতে কি -”
“আর কেউ আপনার সঙ্গে ছিল?”
“না। আমার বউ শহরে গেছিল। বাচ্চারা স্কুলে,” লয়েস দুই বিশালদেহী পুলিশের দিকে পরপর তাকাল। আচমকা তার মনে একটা আশা জেগে উঠল। “ও – তার মানে – আপনারা বলছেন, আমি যখন নিচে ছিলাম, তখনই ওইসব কান্ড ঘটেছে? আমি জানতে পারিনি? সবাই পেরেছে?”
খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে নোটবই হাতে পুলিশটা বলল, “ঠিক। আপনি জানতে পারেননি।”
“তাহলে সব ঠিকই আছে? অফিসিয়াল ব্যাপার? মড়াটা ঝোলানো হয়েছিল?”
“ঝোলানো হয়েছিল। যাতে সবাই দেখতে পায়, “
এড লয়েস দুর্বলভাবে হাসল, “জয় ভগবান। আমি ভেবেছিলাম আমার মাথাটা গেছে। আমি ভেবেছিলাম বিশাল কিছু ঘটেছে। হয়তো ক্লু ক্লুক্স ক্ল্যানের মতো ব্যাপার। হয়তো কমিউনিস্ট বা ফ্যাসিস্টরা ক্ষমতা দখল করেছে,” সে বুকপকেট থেকে রুমাল বার করে কাঁপা হাতে মুখ মুছলো, “যাক,খুশির খবর, সেরকম কিছু হয়নি, “
“সেরকম কিছু হয়নি,” পুলিশের গাড়িটা হল অব জাস্টিসের কাছে এসে গেছিল। সূর্য ডুবে গেছে। ফাঁকা রাস্তায় নেমে এসেছে অন্ধকার। আলো এখনো জ্বলেনি।
“এখন অনেকটা ভাল লাগছে,” লয়েস বলল, “খানিকক্ষণের জন্য উত্তেজিত হয়ে পড়েছিলাম। ভেবেছিলাম সাংঘাতিক কোন গন্ডগোল হয়েছে। এখন সব বুঝতে পারছি। তাহলে আমাকে আর আপনাদের গাড়িতে নিয়ে যাওয়ার দরকার নেই,কি বলেন?”
পুলিশ দুজন কোন কথা বলল না।
“আমার দোকানে ফেরা দরকার, বুঝলেন। বাচ্চাদুটো খায়নি। আমি তো এখন ঠিক আছি। কোন অসুবিধে নেই। কোন দরকার থাকলে -”
“বেশিক্ষণ লাগবে না,” স্টিয়ারিঙের পেছনের পুলিশটা বলল, “সামান্য জিজ্ঞাসাবাদ। কয়েক মিনিটের ব্যাপার।”
“আশা করি তাই হবে,” বিড়বিড় করল লয়েস, “শান্তি পাচ্ছি না। শুধু শুধু উত্তেজনা হলে -”
একটা সিগনাল দেখে গাড়িটার গতি একটু কমতেই লয়েস ঝট করে গাড়ির দরজাটা খুলে রাস্তায় লাফিয়ে পড়ল, টাল সামলাতে গিয়ে খানিকটা গড়িয়ে গেল সামনে। তার চারপাশ দিয়ে বয়ে চলছিল গাড়ির স্রোত, সিগনাল সবুজ হতেই গতি বাড়ছিল তাদের। লয়েস মিশে গেল জনতার ভিড়ে। পিছনে শোনা যাচ্ছিল গাড়ির হর্ন, লোকজনের চিৎকার আর দৌড়ে আসার শব্দ।
ওরা পুলিশ নয়। সে পরিষ্কার বুঝতে পারছে। এই পিকভিলের প্রত্যেকটা পুলিশকে সে চেনে। পঁচিশ বছর ধরে কোন ছোট শহরে ব্যাবসা চালাতে গেলে সবকটা পুলিশকে না চিনলে চলে না।
ওরা পুলিশ নয় -আর বিশেষ কোন ঘটনাও ঘটেনি। পটার,ফারগুসন,জেনকিন্স – ওরা কেউ জানে না ওটা এখানে কেন। ওরা জানেও না – আর এটা নিয়ে মাথাও ঘামাচ্ছে না। এটাই সবচেয়ে আশ্চর্য ব্যাপার।
লয়েস চট করে একটা হার্ডওয়ারের দোকানে ঢুকে পড়ল। সোজা চলে গেল দোকানের পেছন দিকটায়, চমকে ওঠা কর্মচারী আর খদ্দেরদের পাশ কাটিয়ে ঢুকে পড়ল স্টোর রুমে, সেখান থেকে পেছনের দরজা দিয়ে বাইরে চলে এল। দৌড়তে গিয়ে ধাক্কা মেরে উলটে দিল একটা গারবেজ টিন,দ্রুত গতিতে পেরিয়ে গেল কয়েকটা কংক্রিটের সিঁড়ির ধাপ, একটা বেড়া ডিঙিয়ে লাফিয়ে পড়ল ওপারে। হাঁফাচ্ছিল সে,মুখ হাঁ করে বড় বড় শ্বাস নিচ্ছিল।
পেছনে কোন আওয়াজ নেই। ওদের এড়ানো গেছে বোধহয়।
সে এখন একটা গলির সামনে। গলিটা অন্ধকার – কাগজ,ভাঙাচোরা বাক্স আর বাতিল টায়ারে বোঝাই। সোজা তাকালে ওধারের রাস্তাটা দেখা যাচ্ছে। রাস্তার আলোটা দুলছে,এগিয়ে আসছে। আশেপাশে অনেক পথচারী নারী পুরুষ। দোকানপাট। নিয়ন লাইট। গাড়ি।
আর তার ডান দিকে – পুলিশ স্টেশন।
সে কিন্তু এক্কেবারে কাছেই রয়েছে। একটা মুদি দোকানের লোডিং প্ল্যাটফর্মের পাশ দিয়ে হল অব জাস্টিসের সাদা দেয়ালটা দেখা যাচ্ছে। বন্ধ জানলা। পুলিশ স্টেশনের অ্যান্টেনা। অন্ধকারের মধ্যে জেগে রয়েছে আরেকটা বিরাট কংক্রিটের দেয়াল, কীসের কে জানে। তার পক্ষে খুব খারাপ একটা জায়গা ক্রমেই কাছে এগিয়ে আসছে। সে বড্ড কাছে। তাকে দ্রুত এগিয়ে যেতে হবে,পালাতে হবে ওদের থেকে।
ওদের থেকে?
লয়েস সাবধানে গলিটা দিয়ে এগোতে লাগল। পুলিশ স্টেশন ছাড়িয়ে পুরোন আমলের সিটি হল – হলুদ রঙের,কাঠ,পিতল আর সিমেন্ট দিয়ে তৈরি। সে দেখতে পাচ্ছে সারি সারি অফিস,অন্ধকার জানলা,প্রতিটি অফিসে ঢোকার মুখে ছোট বাগান,ফুলের গাছ।
আর – অন্য একটা জিনিস।
সিটি হলের মাথা ছাড়িয়ে একটা ঘোর অন্ধকার বস্তু। রাতের চেয়েও অন্ধকার। শঙ্কু আকৃতির সেই জিনিসটা ক্রমশ ওপরে ছড়িয়ে গিয়ে মিশে গেছে আকাশে।
তার কানে একটা আওয়াজ আসছে। কিছু একটা শোনা যাচ্ছে। এমন কিছু, যার প্রভাবে সে চাইছে তার কান আর তার সঙ্গে মনটাও বন্ধ করে রাখতে,যাতে ওই শব্দ তার কানে না ঢোকে। একটা গুনগুন আওয়াজ। অনেক দূরের কোন নিঃশব্দ গুঞ্জন,যেন মনে হচ্ছে অনেকগুলো মৌমাছি গুনগুন করছে।
লয়েস তাকিয়ে রইল। ভয়ে শক্ত হয়ে গেছিল সে। গাঢ় অন্ধকার বস্তুটা সিটি হলের ওপর ঝুলে রয়েছে। সেই অন্ধকার এত ঘন যে মনে হচ্ছে জিনিসটা নিরেট কোন কিছু। জিনিসটার মধ্যে কিছু যেন নড়ছে,ঝিকমিক করছে,আকার নিচ্ছে কোন কিছুর। আকাশ থেকে কোন কিছু নামছে,সিটি হলের মাথার ওপর খানিকক্ষণ থামছে,ঝাঁক বেঁধে থাকছে,তারপর নিঃশব্দে নামছে ছাদের ওপর।
কয়েকটা অবয়ব। আকাশ থেকে নামা অদ্ভুত কিছু ঝিকমিকে আকৃতি। সে তাদের দেখতে পাচ্ছে।
একটা পুকুরের ধারের রেলিঙের পাশে গুঁড়ি মেরে বসে সে অনেকক্ষণ ধরে ব্যাপারটা লক্ষ করল।
ওরা নামছে। ঝাঁকে ঝাঁকে নামছে সিটি হলের ছাদের ওপর,তারপর ভেতরে ঢুকে পড়ছে। ওদের ডানা আছে। দৈত্যাকৃতি পতঙ্গের যেরকম ডানা থাকে। ওরা উড়ছে, ঝটপট করছে, তারপর থেমে থাকছে – তারপর কাঁকড়ার মত গুঁড়ি মেরে এগোচ্ছে ছাদের ওপর দিয়ে, ঢুকে পড়ছে বাড়ির ভেতর।
সে অসুস্থ বোধ করছে, একই সঙ্গে বিস্মিতও। রাতের ঠান্ডা হাওয়া ঝাপটা মারছে তার গায়ে, কেঁপে কেঁপে উঠছে সে সেই হাওয়ার ধাক্কায়। সে ক্লান্ত, আতঙ্কিত। সিটি হলের সামনে অনেক লোক এখানে ওখানে দাঁড়িয়ে আছে। আরো লোক বেরিয়ে আসছে ভেতর থেকে,বেরিয়ে এসে দাঁড়াচ্ছে একটুক্ষণের জন্য, তারপর চলে যাচ্ছে।
ওদের আর কতজন ভেতরে আছে?
এ অসম্ভব। সে যাদের শূন্য থেকে নামতে দেখেছে,তারা মানুষ নয়। ওরা এলিয়েন – গ্রহান্তরের প্রানী। অন্য জগতের,অন্য মাত্রার। মহাকাশ থেকে আসছে,ফাঁক দিয়ে ঢুকে পড়ছে পৃথিবীতে।
সিটি হলের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা লোকগুলোর মধ্যে কয়েকজন হলের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা গাড়িটার দিকে এগোল,একজন আবার ঘুরে ভেতরের দিকে গেল। তার মানে এটা মনস্থির করতে পারছে না,তাই আবার নিজের দলের কাছে ফিরে গেল।
লয়েস ভয়ের চোটে চোখ বন্ধ করে ফেলল। তার মাথা ঘুরছে,শরীর দুলছে। সে শক্ত করে বেড়াটা ধরে আছে। ওই মানুষটা – না,মানুষ নয়, মানুষের মত অবয়ব, হঠাৎ ডানা ঝাপটে উড়ে গিয়ে অন্যদের পাশে চলে গেল।
নকল মানুষ। ছদ্ম মানুষ। এরা পোকা, মানুষের আকার নিতে পারে। পৃথিবীর অনেক পতঙ্গ যেমন রঙ পালটাতে পারে।
লয়েস ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়াল। বেশ রাত হয়েছে। গলিটা পুরো অন্ধকার। তবে কিছুই বলা যায় না,ওরা হয়ত অন্ধকারেও দেখতে পায়। হয়ত অন্ধকার আর আলোর কোন তফাৎই নেই ওদের কাছে।
সে সাবধানে গলি থেকে রাস্তায় চলে এল। রাস্তায় এখনো লোকজন চলাচল করছে বটে,তবে সংখ্যায় অনেক কম। বাস স্টপে বেশ কিছু লোক অপেক্ষা করছে। একটা বিরাট বাস আসছে হেলতে দুলতে, তার আলোটা জ্বলছে রাতের অন্ধকারে।
ভীড় ঠেলে লয়েস এগিয়ে গেল সামনে। বাসটা স্টপেজে দাঁড়াতেই সে উঠে সামনের দিকের একটা সিটে বসে পড়ল দরজার পাশে। একটু বাদেই ছেড়ে দিল বাস।
লয়েস একটু হাঁফ ছাড়ল। সে বসে বসে দেখছিল তার আশেপাশে বসে থাকা লোকজনদের। বিষণ্ণ, ক্লান্ত সারি সারি সব মুখ। কাজ থেকে বাড়ি ফিরছে সবাই। মামুলি লোকজন। কারোর কোন বিশেষত্ব নেই। সবাই চুপচাপ সিটে বসে বাসের ঝাঁকুনি খাচ্ছে। তার সামনের লোকটা খবরের কাগজের ভাঁজ খুলে খেলার পাতাটা পড়তে শুরু করল বিড়বিড় করে। মামুলি। নীল স্যুট পরা। ব্যবসাদার,না হলে সেলসম্যান। বাড়ি ফিরছে বউ ছেলেমেয়ের কাছে।
করিডোরের ধারে একজন যুবতী বসে আছে। বয়স কুড়ি টুরি হবে। কালো চোখ,কালো চুল। কোলে একটা প্যাকেট। নাইলনের পোশাক, হিল তোলা জুতো। লাল কোট,সাদা অ্যাঙ্গোরা সোয়েটার। আনমনে সামনের দিকে তাকিয়ে আছে।
একটা হাই স্কুলের ছেলে, জিনস আর কালো জ্যাকেট পরা।
তিন থাক চিবুকের এক বিপুলাকায় মহিলা, হাতে বিশাল ব্যাগ,পার্সেল আর প্যাকেটে ভরা। মাথাভর্তি এলোমেলো চুল। ক্লান্ত।
মামুলি লোকজন। প্রত্যেক বিকেলে বাস বোঝাই করে যে সব মানুষ বাড়ি ফেরে আরকি।
বাড়ি ফিরছে সবাই – যদিও মনটা তাদের বশে নেই। তাদের শরীর, মন, তাদের শহর – এ সব কিছুরই দখল নিয়েছে অন্য জগত থেকে আসা প্রাণীরা। শুধু তারই দখল নিতে পারেনি। নিত, যদি সে সেলারে না থেকে তার স্টোরে থাকত। পারেনি, কারণ ওরা তাকে দেখতে পায়নি। সে ওদের চোখ এড়িয়ে গেছে। তার মানে ওদের অন্যের ওপর নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা পুরোপুরি নেই, কিছু ফাঁক আছে।
নড়েচড়ে বসল লয়েস। ওরা তাহলে সর্বশক্তিমান নয়। ওরা তাকে কবজা করতে পারেনি। সে সেলার থেকে স্বাভাবিক মানুষ হিসেবেই উঠে এসেছে। তার মানে – বোঝা যাচ্ছে ওদের শক্তিক্ষেত্রটা সীমিত।
কিছুটা দূরে – করিডোরের পাশের একটা সিট থেকে একটা লোক তাকে খেয়াল করছে। লয়েসের চিন্তার জাল ছিন্ন হল। লোকটা রোগা,কালো চুল,ছোট গোঁফ। পোশাক-আশাক ভালোই,বাদামি স্যুট পরা,জুতোটা চকচক করছে। হাতে একটা বই। লোকটা একভাবে লয়েসকে দেখে যাচ্ছে। লয়েস চট করে মুখ ঘুরিয়ে নিল।
লয়েস একটা চাপা উত্তেজনা বোধ করছে। ওদের কেউ? নাকি – তার মত আরেকজন – যাকে ওরা কবজা করতে পারেনি?
লোকটা আবার তার দিকে তাকাল। ছোট ছোট কালো চোখ,সজাগ এবং ধূর্ত। চালাক। বুদ্ধিমান। ওদের পক্ষে বেশি বুদ্ধিমান – আর না হলে ওদেরই একজন।
বাসটা থামল। একজন বয়স্ক মানুষ বাসে উঠল ধীরে সুস্থে,তার টোকেনটা বাক্সে ফেলল। তারপর এগিয়ে এল করিডোরের দিকে, বসে পড়ল লয়েসের উল্টোদিকের সিটটায়।
বয়স্ক লোকটা এবার সোজা তাকিয়েছে ওই লোকটার দিকে। মুহুর্তের ভগ্নাংশে কিছু যেন আদানপ্রদান হল তাদের মধ্যে। চাহনি দেখে সেইরকমই মনে হচ্ছে।
লয়েস উঠে দাঁড়াল। বাসটা চলছে। সে দৌড় লাগাল। একটা পা নিচের পাদানিতে। সে হ্যাঁচকা টান মারল এমারজেন্সি গেটটায়। খুলে গেল দরজাটা।
“এই!” চিৎকার করে উঠল ড্রাইভার,ব্রেক কষে, “কী হচ্ছে কী?”
লয়েস লাফিয়ে পড়ল। বাসটার গতি কমে আসছে। চারধারে বাড়িঘর। লোকালয় বোধহয়। চারপাশে বাগান,উঁচু উঁচু অ্যাপার্টমেন্ট বিল্ডিং। তার পেছনে,সেই ধূর্ত-চোখো লোকটা লাফিয়ে পড়েছে। সেই বয়স্ক লোকটাও। ওরা দুজন দৌড়ে আসছে তার দিকে। লয়েস লাফ মারতেই প্রচন্ড জোরে হোঁচট খেল পেভমেন্টে,গড়িয়ে গেল রেলিঙের দিকে। অসহ্য যন্ত্রণা ছড়িয়ে পড়ছে সারা শরীরে,অন্ধকার হয়ে আসছে চোখমুখ। প্রবল মনের জোরে সে উঠে দাঁড়াল, গড়িয়ে পড়ল পরক্ষণেই। বাসটা থেমে গেছে। লোকজন নেমে আসছে সেখান থেকে।
লয়েস হাতড়াচ্ছে চারধার। তার আঙুলে কিছু একটা ঠেকল। একটা পাথর। নর্দমার মুখে চাপা দেওয়া। কোনওক্রমে উঠে দাঁড়াল সে,যন্ত্রনায় গোঙাতে গোঙাতে। তার সামনে একটা ছায়া। একটা লোক। সেই লোকটা,ধূর্ত চোখের,হাতে বই।
লয়েস একটা লাথি কষালো। লোকটা পড়ে গেল মাটিতে, দম আটকে। লয়েস ফেলে দিল পাথরটা তার ওপর। চিৎকার করে উঠল লোকটা, চেষ্টা করল গড়িয়ে অন্য দিকে চলে যাওয়ার, “থামো! ভগবানের দোহাই!শোন -”
লয়েস আরেকটা লাথি হাঁকড়ালো। মড়মড় করে একটা আওয়াজ হল হাড় ভেঙে যাওয়ার। লোকটার গলা দিয়ে একটা বিকট আওয়াজ বেরোল শুধু, তারপর স্তব্ধ হয়ে গেল সবকিছু। লয়েস টলতে টলতে উঠে দাঁড়াল,তারপর পিছিয়ে এল। ওরা এখনো আছে, তার চারপাশেই দাঁড়িয়ে আছে। তাকে ঘিরে ধরে দাঁড়িয়ে আছে। সে দৌড়লো পাগলের মত, দিকপাশ না তাকিয়েই। ওরা কেউ তাড়া করে এল না। ওরা এখন সবাই ঝুঁকে পড়েছে সেই উজ্জ্বল চোখের,অসাড় হয়ে যাওয়া লোকটার শরীরের ওপর।
সে কি কোন ভুল করল?
এখন অবশ্য আর কিছু করা যাবে না। অনেক দেরি হয়ে গেছে। এখন তাকে পালাতে হবে – পিকভিল থেকে অনেক দূরে, যেখানে ওরা থাকবে না।
“এড,” জ্যানেট লয়েস পিছিয়ে গেল খানিকটা চমকে উঠে, “কী হয়েছে? কী -”
এড লয়েস দরজাটা বন্ধ করে দিল দড়াম করে তার পেছনে, চলে এল বসার ঘরে, “জানালার পর্দাগুলো নামিয়ে দাও! এক্ষুনি!”
জ্যানেট জানলার দিকে গেল, “কিন্তু-”
“যা বলছি কর। এখানে আর কে আছে?”
“কই? যমজ বাচ্চারা আছে শুধু। তাও তো ওরা ওপরে,ওদের ঘরে। কী হয়েছে? তোমাকে এরকম লাগছে কেন? তুমি এখন বাড়ি ফিরলে কেন?”
এড সামনের দরজাটা বন্ধ করে দিল। তারপর খানিকক্ষণ ঘুরে বেরাল সারা বাড়িতে। রান্নাঘরে গেল। সিঙ্কের নিচের ড্রয়ার থেকে বার করে আনল বড় মাংসকাটা ছুরিটা, আঙুল দিয়ে পরীক্ষা করল তার ধার। তীক্ষ্ণ। অত্যন্ত ধারালো। সে আবার ফিরে এল বসার ঘরে।
“শোন,” এড বলল, “হাতে বেশি সময় নেই। আমি যে পালিয়েছি, সেটা ওরা জানে। ওরা আমাকে খুঁজছে।”
“পালিয়েছে?” হতবুদ্ধি হয়ে গেল জ্যানেট, মুখে দেখা দিল একটা ভয়ের ছাপ, “কে?”
“শহর দখল করে নিয়েছে ওরা। আমি ব্যাপারটা ধরে ফেলেছি। ওরা একেবারে ওপরতলা থেকে শুরু করেছে। সিটি হল আর পুলিশ ডিপার্টমেন্ট ওদের নিয়ন্ত্রণে। ওরা আমাদের – আসল মানুষদের নিয়ে যে কী করবে -”
“এসব কী বলছ?”
“আমরা আক্রান্ত। অন্য জগতের প্রাণীদের হাতে। ওরা একধরনের পোকা। ওরা আমাদের রূপ ধারণ করতে পারে। করেছেও। সবচেয়ে সাংঘাতিক ব্যাপার, ওরা আমাদের মনের দখল নিতে পারে। আমার। তোমার-”
“আমার?”
“ওরা পিকভিল দিয়ে ঢুকেছে। ওরা সবাইকে নিজেদের দখলে এনেছে – আমি বাদে। ওরা আমাদের শত্রু – আর সাংঘাতিক শক্তিশালী, যদিও ওদের একজায়গায় খুঁত আছে,আর সেটাই আমাদের ভরসা। ওরা ভুল করতেও পারে।”
জ্যানেট মাথা নাড়ল, “কিছুই বুঝতে পারছি না। তুমি পাগল হয়ে গেছ।”
“পাগল হয়ে গেছি? না। কপালজোরে বেঁচেছি। আমি যদি বেসমেন্টে না যেতাম,তাহলে আমার অবস্থাও তোমাদের মত হত,” লয়েস জানলা দিয়ে উঁকি মারল বাইরে, “অত কথা বলার দরকার নেই। কোট পরে নাও।”
“কোট?”
“হ্যাঁ হ্যাঁ – কোট। আমাদের এক্ষুনি বেরিয়ে পড়তে হবে। পিকভিল ছেড়ে। আমাদের সাহায্য চাই। লড়তে হবে। ওদের মারা যায় নিশ্চয়ই। অব্যর্থ নয় ওরা। আর দেরি করা যাবে না। তাড়াতাড়ি কর,” সে জ্যানেটের হাত চেপে ধরল রুক্ষভাবে, “কোট পরে নাও। বাচ্চাদের ডাকো। এক্ষুনি বেরোব। না না, জামাকাপড় গোছানোর সময় নেই। তাড়াতাড়ি।”
ফ্যাকাশে মুখে তার স্ত্রী আলমারি থেকে কোটটা বের করল, “আমরা কোথায় যাচ্ছি?”
এড এর মধ্যেই ডেস্কের ড্রয়ারটা উপুড় করে ভেতর থেকে সব জিনিস ছড়িয়ে ফেলেছে। সেখান থেকে সে তুলে নিল একটা রোড-ম্যাপ, মেলে ধরল সামনে, “ওরা নিশ্চয়ই হাইওয়ে আটকাবে। তার মানে ওখান দিয়ে যাওয়া যাবে না। পেছন দিকে একটা রাস্তা আছে, যেটা ওক গ্রোভের দিকে যায়। একবার আমি ওই রাস্তা দিয়ে গেছিলাম। ওই রাস্তায় কেউ যায় না। পরিত্যক্ত রাস্তা। ওরা বোধহয় ওই রাস্তার খোঁজ রাখবে না।”
“ওই র্যানচ রোডটা? তুমি কি পাগল হয়েছ? ওটা তো ভাঙা। ওখান দিয়ে কেউ গাড়ি চালায় না।”
“জানি, “এড ম্যাপটা দুমড়ে কোটের পকেটে ঢুকিয়ে নিল, “ওটাই আমাদের সুুবিধে। বাচ্চাদের ডেকে এবার চল। তোমার গাড়িতে তেল ভরা আছে তো?”
জ্যানেট হতবুদ্ধি হয়ে তাকিয়ে রইল।
“শেভ্রলে গাড়িটা? ওটাতে তো কাল বিকেলেই তেল ভরেছি,” জ্যানেট সিঁড়ির দিকে এগোল, “এড,আমি বুঝতে পারছি না -”
“বাচ্চাদের ডাকো!”এড দরজা খুলে বাইরে উঁকি মারল। কেউ নেই। সব শান্ত।
“এই,তোমরা নীচে নেমে এস,” জ্যানেট ডাকল কাঁপা কাঁপা গলায়, “আমরা এখনই বেরোব।”
“এখন?” টমের গলা শোনা গেল।
“তাড়াতাড়ি,” হুংকার দিয়ে উঠেছে এড,”নীচে নামো এক্ষুনি,দুজনেই।”
টম এসে দাঁড়িয়েছে সিঁড়ির একেবারে মাথায়, “আমি হোম ওয়ার্ক করছিলাম,বাবা। স্কুলে ভগ্নাংশ শেখাচ্ছে তো,মিস পার্কার বলেছে ভাল করে প্র্যাকটিশ না করলে -”
“চুলোয় যাক ভগ্নাংশ,” এড ছেলের হাত ধরে এক হ্যাঁচকা টান মারল,দাঁড় করিয়ে দিল দরজার সামনে, “জিম কোথায়?”
“আসছে।”
জিম ধীরে ধীরে নামছিল সিঁড়ি দিয়ে, “কি হয়েছে বাবা?”
“আমরা বেড়াতে যাচ্ছি।”
“বেড়াতে যাচ্ছি?কোথায়?”
এড জ্যানেটের দিকে ঘুরল, “আমরা বেরোব, তবে ঘরের আলোগুলো জ্বালানো থাকবে। টিভি চলবে। চালিয়ে দাও টিভি।” সে একটা ধাক্কা মরল জ্যানেটকে টিভির দিকে, “তাহলে ওরা ভাববে আমরা ঘরেই আছি -”
একটা গুনগুন আওয়াজ পাওয়ার সঙ্গেসঙ্গেই সে লম্বা ধারালো মাংসকাটা ছুরিটা বার করল। ঝিমঝিম করতে লাগল গা হাত পা,সে দেখতে পেল আওয়াজটা নেমে আসছে সিঁড়ি দিয়ে, দ্রুতগতিতে নড়ে চলা ডানার ঝাপটানি দেখা যাচ্ছে অস্পষ্টভাবে। অবয়বটা জিমির আকার ধারণ করেছে। অবয়বটা ছোট,বাচ্চাদের মত। ওদেরই ছোট কেউ। চোখদুটো একঝলক জ্বলে উঠল না? ঠান্ডা চোখ। পুঞ্জাক্ষি। অমানুষিক। ডানা আছে। শরীরটা এখনও হলুদ টি শার্ট আর জিনস পরে আছে, ঠিক জিমের মত। অবয়বটা অদ্ভুতভাবে ঘুরে গেল তার কাছে এসে। কী করতে চাইছে এটা? হুল ফোটাবে।
এড উন্মাদের মত ছুরি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল শরীরটার ওপর। এটা পিছিয়ে গেছে, গুঞ্জন করছে প্রচন্ডভাবে। লয়েস একটা পাক খেয়ে দরজার দিকে চলে গেল। টমি আর জ্যানেট দাঁড়িয়ে আছে পাথরের মত, দেখছে দৃশ্যটা অভিব্যক্তিহীন মুখে। লয়েস ছুরি চালাল আবার। এবার ছুরিটা লেগেছে। তীক্ষ্ণ এক চিৎকার পিছিয়ে গেল বস্তুটা, ধাক্কা খেল দেয়ালের গায়ে, তারপর কাঁপতে কাঁপতে পড়ে গেল।
তার মনের মধ্যে একটা আলোড়ন হচ্ছে। একটা অন্যরকম অনুভূতি। তীক্ষ্ণ। আচমকা অসাড় হয়ে গেল সে। ওরা এবার তার মনের দখল নিতে চাইছে। বস্তুটা তালগোল পাকিয়ে পড়ে যেতেই সেই অনুভূতি জোরদার হয়ে উঠছে।
ওটা এখন মৃত। সে পা দিয়ে জিনিসটা উলটে দিল। জিনিসটা একধরনের পোকাই বটে,কোন ভুল নেই। হলুদ টি-শার্ট আর জিনস পরা। তার ছেলে জিম – লয়েস জোর করে চিন্তাটাকে অন্যদিকে ঘুরিয়ে দিল। ওটা ভাবার পক্ষে বড্ড দেরি হয়ে গেছে। হিংস্রভাবে লয়েস ছুরি থেকে রক্তটা মুছে নিয়েই দরজার দিকে ঘুরল। জ্যানেট আর টমি এখনো দাঁড়িয়ে আছে পাথরের মত স্থির হয়ে।
গাড়িটা বাইরেই আছে বটে,তবে সে গাড়িতে যাবে না। ওরা অপেক্ষা করছে। মাইল দশেক রাস্তা হাঁটতে হবে পরের শহরে যাওয়ার জন্য। অনেকটা পথ। খারাপ রাস্তা,খোলা মাঠ,খানাখন্দ,টিলা,বনবাদাড়। তাকে একাই যেতে হবে।
দরজা খুলে সে ঘুরে দাঁড়াল,কয়েক সেকেন্ডের জন্য তাকিয়ে রইল নিস্পন্দ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা তার স্ত্রী আর ছেলের দিকে,তারপর দড়াম করে বন্ধ করে দিল দরজা,দৌড়ে বেরিয়ে এল বাইরে।
কয়েক মুহুর্তের মধ্যেই সে চলে এসেছিল রাস্তায়, দ্রুত হাঁটছিল অন্ধকারের মধ্যে,পরের শহরে যাওয়ার জন্য।
ভোরের আলো ফুটে উঠছিল ধীরে ধীরে। লয়েস টলছিল,হাঁফাচ্ছিল,ঘাম গড়িয়ে নামছিল তার সারা শরীর বেয়ে। তার জামাকাপড় ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে কাঁটাঝোপের খোঁচায় – যে দশ মাইল রাস্তা সে এখন প্রায় হামাগুড়ি দিয়ে,বুকে হেঁটে পেরিয়ে এল সারারাত ধরে। তার জুতো কাদামাখা। সারা শরীর ক্ষতবিক্ষত। বিদ্ধস্ত। কিন্তু সামনেই আছে ওক গ্রোভ শহর।
সে একটা গভীর শ্বাস ফেলে টিলা থেকে নামতে শুরু করল। দুবার হোঁচট খেয়ে পড়ল,দুবারই উঠে দাঁড়াল,টেনে নিয়ে চলল শরীরটা। তার কান ভোঁভোঁ করছে,চোখের সামনে সবকিছু দুলছে। যদিও শেষ পর্যন্ত সে এসে উঠতে পেরেছে। পালাতে পেরেছে পিকহিল থেকে।
চাষের ক্ষেত থেকে একটা চাষি তার দিকে তাকাল। একটা বাড়ি থেকে এক তরুণী তার দিকে তাকাল অবাক হয়ে। সামনেই একটা পাকা রাস্তা। লয়েস ধরল সেটা। সামনে একটা গ্যাস স্টেশন। কয়েকটা ট্রাক দাঁড়িয়ে আছে। কয়েকটা মুরগি খাবার খাচ্ছে খুঁটে খুঁটে। একটা কুকুর বাঁধা আছে চেন দিয়ে।
লয়েস টলতে টলতে সেখানে ঢুকতেই একজন সাদা পোশাকের কর্মচারী ভুরু কুঁচকে তাকাল তার দিকে। দেয়াল ধরে কোনওক্রমে দাঁড়াল লয়েস,বিড়বিড় করে বলল, “ঈশ্বর সহায়,শেষ পর্যন্ত এখানে পৌঁছতে পারলাম। ভেবেছিলাম আর বোধহয় হল না। ওরা প্রায় সারা রাস্তা আমাকে অনুসরণ করেছে। আমি গুনগুন আওয়াজ পেয়েছি। ওরা আমার চারধারে উড়ছিল গুনগুন করতে করতে।”
“কী হয়েছে?” কর্মচারীটি জানতে চাইল, “কেউ মারধোর করেছে নাকি? ডাকাতি হয়েছে?”
লয়েস ক্লান্তভাবে মাথা নাড়ল, “আরো বড় বিপদ। ওরা শহর দখল করেছে। সিটি হল,পুলিশ স্টেশন – সব। ওরা একটা লোককে ল্যাম্পপোস্ট থেকে ঝুলিয়ে দিয়েছে। ওটাই আমি প্রথম দেখেছি। ওরা সব রাস্তা আটকে দিয়েছে। আমি ওদের গাড়ির ওপর ভাসতে দেখেছি। আজ ভোর চারটে নাগাদ বুঝতে পারলাম আমি ওদের কাছ থেকে পালিয়ে আসতে পেরেছি। আমি বুঝতে পারছিলাম ওরা আর আসছে না। তারপরই সূর্য উঠল।”
কর্মচারী লোকটা ঠোঁট চাটল নার্ভাসভাবে, “তোমার মাথা খারাপ হয়ে গেছে। আমি বরং একটা ডাক্তার ডাকি।”
“আমাকে ওক গ্রোভে নিয়ে চল,” লয়েস হাঁফাচ্ছিল। তারপর বসে পড়ল নিচের নুড়িপাথরের ওপর, “আমাদের এখনই কাজ শুরু করতে হবে – ওদের তাড়ানোর কাজ। এখনই।”
যতক্ষণ সে কথা বলছিল,ততক্ষনই ওরা টেপ রেকর্ডারটা চালিয়ে রেখেছিল। তারপর কথা শেষ হল তার। কমিশনার টেপটা বন্ধ করে দিয়ে উঠে দাঁড়ালেন। খানিকক্ষন চিন্তা করলেন,তারপর ধীরে ধীরে একটা সিগারেট ধরালেন,মুখে একটা চিন্তার ছাপ।
“আপনারা আমাকে বিশ্বাস করছেন না,” লয়েস বলল।
কমিশনার তাকে একটা সিগারেট দিতে সে ঠেলে সরিয়ে দিল সেটা।
“শান্ত হোন,” কমিশনার জানলার ধারে চলে গেলেন,তাকিয়ে রইলেন খানিকক্ষণ ওক গ্রোভ শহরের দিকে। তারপর আচমকা বললেন, “আপনাকে বিশ্বাস করছি।”
লয়েস বিনীত হল, “ধন্যবাদ।”
“তাহলে যা দাঁড়াচ্ছে,”কমিশনার মাথা নেড়ে বললেন, “আপনি ওই সময়টায় কাজ করার বদলে সেলারে ছিলেন বলেই বেঁচে গেছেন। জোর কপাল। এরকম লাখে একটা হয়।”
লয়েস কালো কফিতে চুমুক দিচ্ছিল, যে কফি ওরা তাকে দিয়েছিল পান করার জন্য। এবার সে বলল বিড়বিড় করে, “আমার একটা মত আছে।”
“তাই?”
“সেটা ওদের সম্পর্কে। ওরা কারা – সেই সম্পর্কে। ওরা একবারে একটা বিশাল এলাকার দখল নিয়েছে। একেবারে উঁচু মহল থেকে। সেখান থেকে আস্তে আস্তে বাকি সব লোকের। যখন ওরা দেখেছে সবাই ওদের কবজায় চলে এসেছে,ওরা তখন পরের শহরটায় যাচ্ছে। ওরা ছড়িয়ে পড়ছে,তবে ধীরে ধীরে। খুব আস্তে আস্তে। আমার মনে হয় ওরা অনেক সময় নেবে।”
“অনেক সময়?”
“কয়েক হাজার বছরও লাগতে পারে। এটা নতুন কিছু নয়।”
“কেন বলছেন এ কথা?”
“আমি যখন ছোট ছিলাম – সেই সময় বাইবেল লিগে আমরা একটা ছবি দেখেছিলাম। পুরোন প্রিন্ট। জিহোবার ছবি। মোলোক,শয়তান,বালিন,আশটারথ -”
“তাতে কী হল?”
“ওদের প্রত্যেককেই ছবি দিয়ে বোঝান হয়েছিল,” লয়েস কমিশনারের দিকে তাকাল, “তাতে শয়তানকে বোঝান হয়েছিল একটা বিরাট মাছি দিয়ে -”
কমিশনার গম্ভীর মুখে শুনছেন, “তো?”
“ওরা হেরে গেছিল। বাইবেল তো ওদের হার মানারই গল্প। ওরা প্রথমে জেতে – কিন্তু শেষে পরাজিত হয়। হবেই।”
“কেন?”
“ওরা সবাইকে দখল করতে পারেনি। আমাকে পারেনি। ওরা কখনোই ইহুদিদের বিরুদ্ধে জেতেনি। ইহুদিরাই সারা পৃথিবীতে বিপদের বার্তা ছড়িয়ে দিয়েছিল। বাসের ওই লোকদুটো যেমন। আমার মনে হয় ওরাও বুঝতে পেরেছিল বিপদটা। ওরাও পালাতে চেয়েছিল,” লয়েসের মুঠো শক্ত হয়ে এল, “আমি ওদের একজনকে মেরে ফেলেছি। ভুল করেছি। বিরাট ভুল। আমি আর এরকম ভুল করতে চাই না।”
কমিশনার মাথা নাড়লেন, “হ্যাঁ,ওরা নিশ্চিতভাবেই পালাচ্ছিল, যেমন আপনি পালাতে পেরেছেন। নিতান্তই বরাতজোরে। কিন্তু শহরের বাকি সবাই নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। আপনি ঠিকই বলেছেন,” তিনি এবার জানলা থেকে মুখ ফিরিয়েছেন ভেতরে, “মিঃ লয়েস,আপনি পুরো ব্যাপারটা ধরতে পেরেছেন।”
“না,পুরো ব্যাপারটা এখনো পরিষ্কার হয়নি। ওই লোকটার লাশ ল্যাম্পপোস্ট থেকে ঝুলছিল কেন? ওরা কেন ওকে ইচ্ছে করে ওখানে ঝুলিয়ে রাখল?”
“খুব সহজ,” কমিশনার ফ্যাকাশে মুখে হাসলেন, “টোপ।”
লয়েস শক্ত হয়ে গেল। হৃৎপিন্ডটা মনে হল বন্ধ হয়ে গেছে, “টোপ? কীসের টোপ?”
“বাঃ,টোপ নয়? টোপ দিয়েই তো ওরা আপনাকে বের করে আনল। ওই টোপ দিয়েই তো আপনাকে দিয়ে স্বীকার করিয়ে নিল যে আপনি এখনও ওদের নিয়ন্ত্রণে আসেননি। ওরা জানতে পারল কারা ওদের দখলে আর কারাই বা নয়,তাই না?”
লয়েস ভয়ে সিঁটিয়ে গেল, “তার মানে ওরা ব্যর্থ হতে পারে এটাও ভেবে রেখেছিল আগে থেকেই -,”ভেঙে পড়ল লয়েস, “তাই ওরা ফাঁদ পেতেছিল।”
“আর সেই ফাঁদে আপনি পা দিলেন। আপনি নিজেকে চিনিয়ে দিলেন,” কমিশনার আচমকা ঘুরলেন দরজার দিকে, “চলে আসুন,লয়েস। আমাদের এখনই বেরোতে হবে। অনেক কাজ আছে। হাতে আর সময় নেই।”
লয়েস কমিশনারের পিছু নিল জড় পদার্থের মত, “কিন্তু লোকটা কে? আমি তো লোকটাকে কখনই দেখিনি। ও এখানকার লোক নয়। অন্য জায়গার। হাতে পায়ে কাদা মাখা,নোংরা। মুখে কাটার দাগ,ক্ষতবিক্ষত -”
একটা অদ্ভুত চাহনি দেখা গেল কমিশনারের মুখে, “হতে পারে,” নরম গলায় বললেন তিনি, “আপনিও সেটা বুঝতে পারবেন। আমার সঙ্গে আসুন,মিঃ লয়েস,” দরজা খুলে ধরলেন তিনি, তাঁর চোখ এখন অত্যন্ত উজ্জ্বল। রাস্তার সামনের পুলিশ স্টেশনটা নজরে পড়ল লয়েসের। কয়েকটা পুলিশ দাঁড়িয়ে আছে। একটা মঞ্চ। একটা টেলিফোনের খুঁটি – আর একটা দড়ি!
“ঠিক এইরকমভাবে,মিঃ লয়েস,” কমিশনার বললেন ঠান্ডা গলায়,তাঁর মুখে একটা শীতল হাসি।
ওক গ্রোভ মার্চেন্ট ব্যাঙ্কের ভাইস-প্রেসিডেন্ট যখন ভল্ট থেকে বেরোলেন,তখন সূর্য ডুবে গেছে। তালা লাগিয়ে দিলেন তিনি ভল্টে, টুপি আর কোট পরে বেরিয়ে এলেন ব্যাঙ্ক থেকে। রাস্তায় লোকজন রয়েছে,তারা বাড়ি ফিরছে সবাই ক্লান্ত পায়ে।
তাঁকে শুভরাত্রি জানাল ব্যাঙ্কের গার্ড,তালা লাগিয়ে দিল ব্যাঙ্কের দরজায় তাঁর পেছনে।
“শুভ রাত্রি,”বললেন ভাইস-প্রেসিডেন্ট ক্ল্যারেন্স মেসন,পা চালিয়ে দিলেন তাঁর গাড়ির দিকে। খুব ক্লান্ত লাগছে। আজ সারাদিনটা তাঁর ভল্টেই কেটেছে,পরীক্ষা করতে হয়েছে সব কিছু,দেখেছেন আরো কিছু সেফটি বক্স সেখানে রাখা যায় কিনা। ভাল লাগছে যে কাজটা তিনি শেষ করে উঠতে পেরেছেন।
রাস্তার শেষ মাথায় এসে তিনি থমকে গেলেন। রাস্তার আলো এখনো জ্বলেনি। আশেপাশের সবকিছুই এখন আলো আঁধারিতে ঢাকা। সেই আলো আঁধারিতে তিনি দেখলেন – পুলিশ স্টেশনের সামনের টেলিফোনের খুঁটি থেকে কী যেন একটা ঝুলছে। জিনিসটা দুলছে অল্প অল্প বাতাস লেগে।
কী এটা?
তিনি জিনিসটার দিকে খানিকক্ষণ তাকিয়ে রইলেন। তিনি এখন বাড়ি যেতে চাইছেন। তিনি ক্লান্ত,ক্ষুধার্ত। তিনি ভাবছেন বাড়ির কথা,তাঁর স্ত্রীর কথা,ছেলেমেয়েদের কথা। ডিনার টেবিল। গরম গরম খাবার। কিন্তু তাঁর সামনে, আলোআঁধারির মধ্যে ওই বিশ্রি জিনিসটা কী?
অন্ধকারে তিনি বুঝতে পারছেন না জিনিসটার অবয়ব,বুঝতে পারছেন না ওটা কি,তবুও জিনিসটা যেন তাঁকে টানছিল সামনে যাওয়ার জন্য। অদ্ভুত একটা অনুভূতি হচ্ছিল তাঁর। একটা অস্বস্তি। তিনি ভয় পাচ্ছেন। আতঙ্ক। তবুও তিনি তাকিয়ে আছেন ওটার দিকে।
এবং সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয়,আর কেউই জিনিসটাকে খেয়াল করছিল না।
[ফিলিপ কে ডিক(Philip K Dick) রচিত দি হ্যাঙ্গিং স্ট্রেঞ্জার অবলম্বনে। ]
অমিত দেবনাথ -এর আরো দু ডজন গল্প