অমিত দেবনাথের সমস্ত গল্প একসাথে
“রবিনসন, কত্তা তোমায় ডাকছেন।”
“জ্বালিয়ে খেলে,” আমি ভাবলাম। বিরক্তিকর এই লোকটা, মিঃ ডিকসন, ভুট্টার ব্যবসায়ী, বেইলি অ্যান্ড কোম্পানির ওডেসা এজেন্ট। “কি ব্যাপারে হে? নিকোলেইফ পলায়নের ব্যাপারে নতুন কোনও আইডিয়া, নাকি অন্য কিছু?”
“জানি না,” গ্রেগরি বলল, “সাহেব বেশ ভাল মুডে আছেন মনে হল, ব্যাবসার ব্যাপারেই বোধহয়। ওঁকে বসিয়ে রেখ না।” সুতরাং দুরু দুরু বক্ষে আমাকে ঢুকতে হল সিংহের গুহায় – থুড়ি, কর্তার ঘরে।
আগুনের সামনে দাঁড়িয়েছিলেন মিঃ ডিকসন দারুন কেতা নিয়ে, আমাকে দেখে তাঁর সামনের একটা চেয়ারে বসতে বললেন। “মিঃ রবিনসন, আপনার বুদ্ধি আর বিচক্ষণতার ওপর আমার পুরো ভরসা আছে। বয়স কম হলেও ভেতরটা আপনার খাঁটি।”
আমি সামনে ঝুঁকে বুঝিয়ে দিলাম যে আমি কৃতার্থ।
“অনর্গল রাশিয়ান বলতে পারেন নিশ্চয়ই,” তিনি বললেন।
উত্তরে আমি আরেকবার সামনে ঝুঁকলাম।
“আপনাকে একটা কাজ দেব,” তিনি বললেন, “আর এই কাজের ওপর আপনার প্রোমোশন নির্ভর করছে। এ কাজের জন্য অন্য কারোর ওপর নির্ভর করা যায় না, আর আমি এখন এখানে এমনভাবে ফেঁসে আছি, বুঝতেই পারছেন, নাহলে…”
“নিশ্চিন্ত থাকুন স্যার, আমার পক্ষে যতটা সম্ভব আমি করব,” আমি বললাম।
“চমৎকার! তাহলে কাজের কথায় আসা যাক। সলটেফ-এর দিকের রেললাইনটা সবে চালু হয়েছে, আমি ওডেসা ফার্মের কাজকর্ম ওই জেলায় নিয়ে যেতে চাইছি। আমার বিশ্বাস, এর জন্য খুব বেশি খরচ আমাদের হবে না। আপনি ট্রেনে করে সলটেফে চলে যান, গিয়ে মিঃ দিমিদফ নামে একজনের সঙ্গে কথা বলবেন, লোকটার অনেক জমিজমা আছে ওখানে। ওঁর সঙ্গে যতটা সম্ভব ঠিকঠাক কথাবার্তা চালাবেন, আমি আর মিঃ দিমিদফ দুজনেই চাইছি কাজটা যথাসম্ভব গোপন রাখতে, যতদিন না ওডেসাতে নতুন ফসল ওঠে। আমি আমাদের ফার্মের খাতিরে কাজটা চাই, আর মিঃ দিমিদফ চাইছেন কুসংস্কার ভেঙে তাঁর কৃষির ফসল রপ্তানি করতে। আপনি আজ রাতেই রওনা হয়ে যান, ওখানে আপনার জন্য লোক থাকবে। আপনার খরচখরচার জন্য টাকা পেয়ে যাবেন। তাহলে সুপ্রভাত, মিঃ রবিনসন, আশা করি আমি আপনাকে যে সুযোগ দিয়েছি, তাতে আপনি সফল হয়ে ফিরবেন, কারণ এর ওপর আপনার অনেক কিছু নির্ভর করছে।”
বুক ফুলিয়ে ঘরে ঢুকে আমি বললাম, “গ্রেগরি, আমি একটা গোপন কাজে যাচ্ছি। হাজার হাজার পাউন্ডের কাজ, বুঝলে। তোমার ছোট পোর্টম্যান্টোটা দাও, আমারটাও লাগবে, আর ইভানকে বল প্যাক করে দিতে। এক জায়গায় যাচ্ছি, সেখানে একজন রাশিয়ান কোটিপতি আমার জন্য অপেক্ষা করবেন। আর শোন হে, সিমকিনসের লোকজনদের কাউকে একটি কথাও বলবে না, পুরো কাজ কেঁচে যেতে পারে, মনে থাকে যেন। সাবধান।”
আমি শুরুতে খুবই উত্তেজিত হয়ে পড়েছিলাম কাজটার গুরুত্ব বুঝতে পেরে, কাজেই আমি সারাটা দিন অফিসে ঘাপটি মেরে রইলাম, আমার হালচাল দেখেই বোঝা যাচ্ছিল তা, আর সন্ধ্যের সময় আমি যখন স্টেশনে গিয়ে পৌঁছলাম, তখন অলক্ষ্য প্রহরী নিশ্চয়ই লক্ষ্য করেছিলেন, যে আমি স্ট্রং বক্সের সব জিনিসপত্র গ্রেগরির ছোট চামড়ার হাতব্যাগটায় ভরে দিলাম। সে আবার ইংরেজি লেবেল সেঁটে দিয়েছিল এর মধ্যে, যেটা মোটেই বুদ্ধিমানের কাজ হয়নি। আমার একটাই আশা, যে এই “লন্ডন” বা “বারমিংহাম” লেখা লেবেলগুলো হয়তো কারোর দৃষ্টি আকর্ষণ করবে না, অন্ততপক্ষে কোনও প্রতিদ্বন্দ্বী শস্য ব্যবসায়ী নিশ্চয়ই বুঝতে পারবে না যে আমি কে বা আমার উদ্দেশ্য কি।
যথাযথ রুবল দিয়ে টিকিট কেটে আমি রাশিয়ান ট্রেনের মোটামুটি ভাল একটা কামরার এক কোণায় উঠে বসে ভাবতে লাগলাম আমার অত্যাশ্চর্য ভাগ্যের কথা। ডিকসনের এখন বয়স হয়ে গেছে, যদি আমি কাজটায় সফল হই,তবে…আমার চোখের সামনে ভেসে উঠতে লাগল একটা ছবি, যেন আমি কোম্পানির পার্টনার হয়েই গেছি। গাড়ির চাকার ক্যাঁচকোঁচ আওয়াজ পালটে গেল “বেইলি, রবিনসন অ্যান্ড কোং”, “বেইলি, রবিনসন অ্যান্ড কোং”-এর একঘেয়ে আওয়াজে, গানের সুরের মত সেই আওয়াজ কখন যেন মিলিয়ে গেল, যখন আমি গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হলাম। তখন যদি আমি জানতাম যাত্রা শেষে আমার জন্য কী অভিজ্ঞতা অপেক্ষা করছে, তাহলে বোধহয় আরামের ঘুম আমার ছুটে যেত।
আচমকা আমার ঘুম ভেঙে গেল, মনে হল কেউ যেন আমায় তীক্ষ্ণভাবে নজর করছে। আমার ভুল হয়নি। আমার উল্টোদিকের সিটের লম্বা, গাঢ় রঙা কালো চোখের একটা লোক খর চোখে আমায় মাপছে, এমনভাবে, যেন আমার ভেতরটা পর্যন্ত পড়ে নিচ্ছে। তারপর দেখলাম সে আমার ট্রাংকটা দেখছে।
“সর্বনাশ!” আমি ভাবলাম, “সিমকিনসের এজেন্ট মনে হচ্ছে! ওই গাধা গ্রেগরিটার ওই লেবেলগুলো লাগানোতেই কান্ডটা হল মনে হচ্ছে।”
আমি চোখ বন্ধ করলাম, কিন্তু আবার খুলতেই সোজা লোকটার চোখে চোখ পড়ে গেল।
“ইংল্যান্ড থেকে, তাই না?” বিশ্রি দাঁত বার করে হেসে লোকটা রাশিয়ান ভাষায় বলল।
“হ্যাঁ,” আমি স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করতে করতে বললাম, যদিও বিরক্তি লাগছিল আমার ব্যর্থতায়।
“বেড়াতে নিশ্চয়ই?” আবার প্রশ্ন।
“হ্যাঁ,” ব্যস্ত হয়ে বললাম, “বেড়াতেই যাচ্ছি, অন্য কিছু না।”
“নিশ্চয়ই,” লোকটার গলায় একটা রুক্ষ সুর লক্ষ করলাম, “ইংরেজরা বেড়াতেই যায়, অন্য কিছু না। ঠিক।”
লোকটার আচরণ রহস্যজনক বললে কম বলা হয়। হয় ব্যাটা পাগল, না হলে আমার মত একইরকম কোনও ফার্মের এজেন্ট, আর ও বোঝাতে চাইছে যে আমার ব্যাপারটা ও বুঝে ফেলেছে। দুটোর কোনওটাই সুখকর নয়। যাই হোক, আমি খানিকটা হালকা বোধ করলাম, যখন ট্রেনটা একটা নড়বড়ে শেডের নিচে এসে দাঁড়াল, এটাই এখন দ্রুত বেড়ে ওঠা শহর সলটেফের স্টেশনের কাজ করছে, যে শহরে আমাকে বলা হয়েছে ব্যবসা শুরু করে তার বানিজ্যকে বাইরের পৃথিবীর সঙ্গে পরিচিত করাতে। আমি প্ল্যাটফর্মে নামার সময় প্রায় ভেবেই নিয়েছিলাম বাইরে একখানা বিজয়-তোরণ দেখতে পাব।
মিঃ ডিকসন বলেছিলেন আমার জন্য লোক থাকবে, আমি কিন্তু স্টেশনের গুটিকতক লোকের মধ্যে কোনও মিঃ দিমিদফকে দেখতে পেলাম না। হঠাৎই আমার পাশ দিয়ে একটা নোংরা, দাড়িগোঁফ না কামানো লোক হনহন করে চলে গেল, প্রথমে আমার দিকে, পরে আমার যত দুর্দশার মূল, সেই ট্রাংকের দিকে তাকাতে তাকাতে। লোকটা ভিড়ের মধ্যে মিশে গেল, কিন্তু একটু পরেই আবার ফিরে এল আমার পাশে, চলতে চলতেই ফিসফিস করে বলল : “একটু দূরত্ব রেখে আমার পেছন পেছন আসুন।” কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই প্রচণ্ড গতিতে হেঁটে স্টেশন থেকে রাস্তায় নেমে এলাম। রহস্য আরও ঘনীভূত হল, যখন আমার ব্যাগ নিয়ে লোকটার পেছনে হেঁটে বাঁক ঘুরেই দেখলাম রাস্তার এক কোণায় একখানা ড্রস্কি – মানে ঘোড়ার গাড়ি আমার জন্য অপেক্ষা করছে। নোংরা মতন লোকটা দরজা খুলে ধরতে আমি ভেতরে ঢুকে পড়লাম।
“মিঃ দিমি…” আমি বলতে যাচ্ছিলাম, কিন্তু তার আগেই লোকটা চাপা গলায় বলে উঠল, “শ্ শ্ শ্! নাম নেবেন না, দেওয়ালেরও কান আছে। রাত্রে সব কিছু জানতে পারবেন।” বলেই সে বন্ধ করে দিল দরজা, তারপর লাগাম ধরে ছুটিয়ে দিল গাড়ি দারুণ জোরে, এত জোরে, যে আমি শুধু দেখতে পেলাম বাইরে আমার ট্রেনে দেখা সেই কালো চোখের লোকটা অবাক হয়ে আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে, যতক্ষণ না আমরা চোখের আড়াল হয়ে গেলাম।
যেতে যেতে আমি পুরো ব্যাপারটা ভাবার চেষ্টা করছিলাম। শুনেছিলাম রাশিয়ায় অভিজাত শ্রেণীর লোকেরা অত্যাচারী হয়, কিন্তু এখন দেখছি উলটো ব্যাপার।এই মিঃ দিমিদফ লোকটা নির্ঘাত খুন-খারাপির আশঙ্কা করছে, যদি সে ফসল রপ্তানি করে, আর তার ফলে এখানে ফসলের দাম বেড়ে যায়। নিজের সম্পত্তি বিক্রি করবে, তাতেও এত ছলচাতুরীর আশ্রয় নিতে হচ্ছে। কি অবস্থা! এদের অবস্থা তো আইরিশ জমিদারদের থেকেও খারাপ দেখছি! জঘন্য ব্যাপার! আর এঁর অবস্থাও তো খুব অভিজাত বলে মনে হচ্ছে না।নিজের মনে বিড়বিড় করতে করতেই আমি বাইরের সরু আঁকাবাঁকা রাস্তা আর আলুথালু, ময়লা পোশাকের লোকজন দেখছিলাম, ভাবছিলাম, গ্রেগরি বা আর কেউ সঙ্গে থাকলে ভাল হত, হঠাৎই খেয়াল করলাম লোকটা রাশ টেনে ধরল, তার মানে আমরা এসে গেছি।
ঠিক তাই। গাড়ি থেমে গেছে, আর সামনের ফোকর দিয়ে গাড়িওয়ালার ঝাঁকড়াচুলো মাথাটা দেখা যাচ্ছে।
“আমরা এসে গেছি, মাননীয় মহাশয়,” আমাকে গাড়ি থেকে নামতে সাহায্য করতে করতে বলল সে।
“মিঃ দিমি…” আমি বলতে যাচ্ছিলাম, কিন্তু তার আগেই আবার বাধা দিল সে, ফিসফিস করে বলল, “ বাকি সব কিছু বলতে পারেন, কিন্তু নাম বলবেন না। এদেশে মুখ খোলা বারণ। সাবধান, হে মহান মানুষ।” বলে সে আমাকে একটা পাথর বাঁধানো পথ দিয়ে নিয়ে এল, সিঁড়ি দিয়ে উঠতে হল খানিকটা, সামনে একটা ঘর, তার দরজা খুলে বলল, “এখানে বসুন একটু সময়, আপনার জন্য একটু আহারের ব্যবস্থা হচ্ছে ।” তারপর বিদায় নিল সে, আমাকে একা সেই ঘরে রেখে।
“মিঃ দিমিদফের বাড়িঘর যেমনই হোক না কেন,” আমি ভাবলাম, “তাঁর কাজের লোকগুলো কিন্তু খাসা!”
“মাননীয় মহাশয়”, “হে মহান মানুষ”! আমি মন্তব্যগুলো ভাবতে ভাবতে ভাবতে লাগলাম, আমার মত একটা পাতি কেরানীকেই যদি এমন সম্বোধন করে, তাহলে ডিকসন বুড়ো এখানে এলে না জানি ওরা কি বলত! এখন একটু পাইপ তো খাওয়া যেতেই পারে, যদিও এরকম একটা বদ্ধ ঘরে ধুমপান করা ঠিক না। আর আশ্চর্য, এত ছোট ঘর ওরা বানিয়েছেই বা কেন? একেবারে একটা খুপরির মত লাগছে।
খুপরিই বটে! লোহার দরজা, যেটা সাংঘাতিক শক্ত। জানলা আছে, তবে তাতে ঘন করে গরাদ দেওয়া। মেঝেটা কাঠের, হাঁটাচলা করলেই ফাঁপা আওয়াজ হচ্ছে সেখানে, যেন এখুনি তলাটা ধ্বসে যাবে। দেওয়াল আর মেঝের সর্বত্র কফি বা ওইধরণের কিছুর গাঢ় দাগে ভরা। মোট কথা, এরকম একটা জায়গায় কারোর পক্ষেই প্রফুল্ল থাকা সম্ভব নয়।
মনে মনে এইসব ভাবা তখনও শেষ করিনি, বাইরের করিডরে কারোর পায়ের আওয়াজ শুনতে পেলাম, পরক্ষনেই দরজা খুলে ঘরে ঢুকলো আমার চেনা গাড়ির সেই লোক, বহুবার মাথা ঝুঁকিয়ে মার্জনা চাইলো আমাকে একা এরকম একটা “বাতিল করার ঘরে” রেখে যাওয়ার জন্য। তারপর সে আমাকে নিচের একটা বড়ো আর চমৎকার সাজানো গোছানো ঘরে নিয়ে গেল। ঘরের মাঝখানে একটা টেবিল রয়েছে, যাতে মাত্র দুজন বসতে পারে, আর ফায়ারপ্লেসের সামনে দাঁড়িয়েছিল একজন মানুষ, যার বয়স আমার চেয়ে খুব সামান্যই বেশি। আমি ঢুকতেই সে ঘুরে আমার দিকে এগিয়ে এল আমার সঙ্গে আলাপ করার জন্য, তার প্রতি পদক্ষেপেই বোঝা যাচ্ছিল সে আমাকে দারুণ সম্মান করছে।
“এত কম বয়সেই এত নামকরা!” বলে উঠল সে, তারপর নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, “দয়া করে চেয়ারে বসুন, আপনিই আজকের প্রধান। খুব ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন নিশ্চয়ই, অনেক লম্বা জার্নি করতে হল তো। আমরা মুখোমুখি ডিনার সারবো, বাকিরা আসবে পরে।”
“আপনি নিশ্চয়ই মিঃ দিমিদফ?” আমি জিজ্ঞেস করলাম।
“না স্যার,” তীক্ষ্ণ ধূসর চোখে আমার দিকে তাকিয়ে বলল সে, “আমার নাম পেত্রোকিন, আপনি বোধহয় অন্য কারোর সঙ্গে গুলিয়ে ফেলছেন। কিন্তু স্যার, কাউন্সিল মিটিঙের আগে আর কোনও কথা নয়। আমাদের শেফের রান্না পরখ করে দেখুন, আমি নিশ্চিত যে আপনার দারুণ লাগবে।”
কে যে এই মিঃ পেত্রোকিন, অন্য লোকেরাই বা কে, কিছুই বুঝতে পারলাম না। দিমিদফের গোমস্তা-টোমস্তাই হবে বোধহয়, আমি ভাবলাম, যদিও এই লোকটার সঙ্গে নামের কোনও মিলই নেই দেখা যাচ্ছে। যাই হোক, এ যখন চাইছে না এই মুহূর্তে কোনও ব্যবসায়িক কথাবার্তা হোক, তখন আমারই বা কথা বলার দরকার কি? আমরা কথাবার্তা শুরু করলাম ইংল্যান্ডের সামাজিক জীবন নিয়ে, এবং দেখা গেল এ বিষয়ে লোকটার ভাল দখল আছে, সে যা যা বলছিল এ বিষয়ে, সবই নিখুঁত। মালথাসের জনসংখ্যা নীতি নিয়ে তার মন্তব্যগুলো চমৎকার, যদিও আমার কাছে খানিকটা গোঁড়া মনে হল।
“ব্যাপার কি জানেন,” পানভোজনের শেষে আমরা সিগার ধরানোর পর বলল সে, “ আমরা তো আপনাকে চিনি না, তবে জোর কপাল যে আলেকজান্ডার আপনার ব্যাগের ইংরেজি লেবেলগুলো খেয়াল করেছিল। আপনাকে দেখতেই বা কেমন, সে ব্যাপারেও আমাদের কাছে কোনও তথ্য ছিল না, তবে আমরা ভেবেছিলাম, যিনি আসবেন, তিনি বেশ বয়স্ক হবেন। হাজার হোক, এরকম একটা কাজের পক্ষে আপনার বয়সটা সত্যিই কম।”
“ওপরওয়ালা আমার ওপর ভরসা রেখেছেন,” আমি উত্তর দিলাম, “আর আমরা আমাদের কারবারের জায়গায় শিখেছি যে তরুণ আর চালাকচতুররা অনুপযুক্ত নয়।”
“সে তো ঠিকই,” প্রত্যুত্তর করল আমার নতুন বন্ধু, “তবে অবাক হচ্ছি এটা শুনে যে আপনি আমাদের এই মহৎ সংগঠনকে কারবার বললেন। কিছু মানুষ যখন একসাথে মিলে জগতকে নতুন একটা কিছু দিতে চাইছে, আর যেটা সবার চেষ্টা ছাড়া সম্ভব নয়, সেখানে এই কাজকে কারবার বলাটা খুবই বেদনাদায়ক। আধ্যাত্মিক ভ্রাতৃত্ব বরং অনেক সুন্দর কথা।”
“জয় ভগবান!” আমি ভাবলাম, “বস শুনলে খুব খুশি হবেন। এই লোকটা যেই হোক না কেন, নির্ঘাত ব্যবসার মধ্যে আছে।”
“চলুন স্যার,” বললেন মিঃ পেত্রোকিন, “আটটা বাজে, কাউন্সিলের লোকেরা সব বসে আছে। ওপরে যাওয়া যাক, আমি সবার সঙ্গে আপনার পরিচয় করিয়ে দেব। আমি নিশ্চিত করে বলছি যে আপনার পরিচয় একদম গোপন থাকবে, আর আপনার জন্যে সবাই অধীরভাবে অপেক্ষা করছে।”
আমি লোকটার পেছন পেছন যেতে যেতে ভাবতে লাগলাম যতটা সম্ভব লাভজনক শর্তে কাজটা করে ফেলতে হবে। ব্যাপারটা নিয়ে ওরাও তো আমার মতই উতলা হয়েছে দেখা যাচ্ছে, আর সম্ভবত কোনও বিরুদ্ধ পক্ষও নেই, সুতরাং সবচেয়ে ভাল কাজ হচ্ছে চুপচাপ অপেক্ষা করা আর দেখা যে ওরা কি প্রস্তাব দেয়।
মনে মনে ভাবা শেষও করিনি, দেখলাম আমরা পৌঁছে গেছি প্যাসেজের শেষ প্রান্তে। আমার সঙ্গের লোকটা একটা বড়সড় দরজা ঠেলে খুলে ফেলল, আর দেখলাম আমরা প্রবেশ করেছি একটা বেশ বড় আর দারুন ঝকঝকে সাজানো গোছানো ঘরে, এই ঘরটা আমরা যে ঘরে খাওয়া দাওয়া করেছিলাম, তার চেয়েও বড়। ঘরের মাঝখানে একটা লম্বা টেবিল, সবুজ পশমি কাপড়ের ঢাকনা দেওয়া, কিছু কাগজ ছড়ানো রয়েছে সেখানে, আর তার চারপাশে বসে আছে জনা চোদ্দ-পনেরো লোক, গভীর মনোযোগ দিয়ে কি সব যেন
আলোচনা করছিল তারা। পুরো দৃশ্যটা আমার কাছে মনে হল একটা জুয়ার আসরের মত, এরকম একটা আসরে আমি কয়েকদিন আগে গেছিলাম।
আমাদের ঢুকতে দেখেই সবাই উঠে দাঁড়িয়ে মাথা নুইয়ে আমাদের স্বাগত জানাল। আমি দেখে আশ্চর্য হয়ে গেলাম যে ওরা আমার সঙ্গী নয়, বরং আমাকে দেখেই ওরকম স্বাগত জানাল, আর দেখলাম প্রত্যেকটি চোখ আমার দিকে সসম্ভ্রমে চেয়ে আছে, সেই চোখের চাহনিতে অবাক বিস্ময় আর প্রায় ক্রীতদাসসুলভ মনোভাবের মিশেল। টেবিলের মাঝখানে বসেছিল একটা লোক, নীল-কালো চুল আর গোঁফ এবং অসম্ভব পাংশু মুখের জন্য অদ্ভুত লাগছিল তাকে, হাত তুলে তার পাশের চেয়ারে বসতে বলল আমাকে। আমি বসলাম।
“আমার নিশ্চয়ই আর বলার প্রয়োজন নেই যে,” বললেন মিঃ পেত্রোকিন, “ইংরেজ এজেন্ট গুস্তেভ বারজার আমাদের মাঝখানে এসে আমাদের ধন্য করেছেন। অ্যালেক্সিস, দেখতেই পাচ্ছ যে উনি বয়সে একেবারে তরুণ,” আমার পাশের পাংশু মুখের লোকটার দিকে তাকিয়ে বললেন তিনি, “তবুও গোটা ইউরোপ ওঁকে শ্রদ্ধা করে।”
“নাঃ, ব্যাপারটা হালকা করা দরকার,” আমি ভাবলাম, গলা ছেড়ে বললাম, “মশাইরা, আমি একজন ইংরেজই বটে, তবে বারজার নয়, রবিনসন, মিঃ রবিনসন।”
একটা হাসির গররা উঠল টেবিল জুড়ে।
“বটেই তো! সাবাস, সাবাস,” বলে উঠল অ্যালেক্সিস নামের সেই লোকটা, “আপনার বিচক্ষণতার প্রশংসা করতেই হয়, মাননীয় মহাশয়। সাবধানতা অবশ্যই ভাল। আপনার ডাকনামটা বাঁচিয়ে রাখুন। যাই হোক, আমি দুঃখের সঙ্গে জানাচ্ছি যে আজকের এই শুভ সন্ধ্যায় হয়ত আমাদের কিছু অপ্রিয় সিদ্ধান্ত নিতে হবে, কিন্তু আমাদের সংগঠনের তো কিছু নিয়ম আছে, সেগুলো মানতেই হবে, তাতে আমাদের যত খারাপই লাগুক না কেন, এবং আজ রাত্রে একটা বহিস্কারের সিদ্ধান্ত নেওয়া অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়েছে।”
“এরা কী সব বলছে, অ্যাঁ?” আমি ভাবলাম। “এদের কাজের লোককে ছাড়িয়ে দিলে আমার কি? এই দিমিদফ লোকটা, বা এ যেই হোক না কেন, এর বোধহয় নিজস্ব পাগলাগারদ আছে।”
“মুখ থেকে কাপড়টা বের করে নাও!” শব্দগুলো ভেসে এল চাবুকের মত। চেয়ারে বসে আমি কেঁপে উঠলাম। কথাগুলো বলেছে পেত্রোকিন। এই প্রথম আমি খেয়াল করলাম, টেবিলের অন্যদিকে একটা গাঁট্টাগোট্টা লোক বসে আছে, তার হাতদুটো চেয়ারের সঙ্গে পিছমোড়া করে বাঁধা, আর মুখে গোঁজা আছে একটা রুমাল। এক ভয়াবহ সন্দেহে আমার বুক ধড়াস করে উঠল। এ আমি কোথায় এসেছি? মিঃ দিমিদফের ডেরায় কি? এই লোকগুলো কারা? এদের এই সব কথাবার্তার মানে কি?
“মুখের কাপড়টা বের করে নাও!” আরেকবার বলল পেত্রোকিন, আর লোকটার মুখ থেকে রুমাল খুলে নেওয়া হল।
“পল ইভানোভিচ,” বলল সে, “তোমার কিছু বলার আছে?”
“জানে মারবেন না, স্যার,” মিনতি করছিল লোকটা, “জানে মারবেন না, ওটা ছাড়া বাকি যা ইচ্ছে হয় করুন। যেখানে নির্বাসন দেওয়ার দিন, আমার মুখ বরাবরের মত বন্ধ থাকবে। সংগঠন যা বলবে করব, কিন্তু দয়া করে জানে মারবেন না। দয়া করুন স্যার।”
আমার পিঠ ঠেকে গেল চেয়ারে, খাবি খাচ্ছিলাম আমি।
“নিয়ে যাও একে!” বলল পেত্রোকিন, আর ঘোড়ার গাড়ির সেই লোকটা , আরও দুজন মিলে ধাক্কা মারতে মারতে ঘর থেকে বের করে নিয়ে গেল সেই লোকটাকে। বাইরের প্যাসেজে শুনতে পেলাম পায়ের আওয়াজ, তারপর একটা দরজা খোলা আর বন্ধ করার শব্দ। তারপর একটা আওয়াজ ভেসে এল, যেন একটা ধ্বস্তাধস্তি চলছে, যার সমাপ্তি ঘটল একটা দমাস করে ভারি কিছু দিয়ে আঘাতের সঙ্গে সঙ্গে কোনও কিছু মাটিতে পড়ে যাওয়ার আওয়াজে।
“যারা বিশ্বাসঘাতক, তাদের এটাই শাস্তি,” বিষণ্ণভাবে বলল অ্যালেক্সিস। বাকি সবাই বলে উঠল, “ঠিক!”
“একমাত্র মৃত্যুই পারে আদেশ থেকে আমাদের বিচ্ছিন্ন করতে,” বলল আরেকটা লোক, “ কিন্তু মিঃ বারজা- থুড়ি, মিঃ রবিনসন একেবারে পাংশু হয়ে গেছেন। ইংল্যান্ড থেকে এতদূর আসার পরই এ দৃশ্য দেখাটা একটু বাড়াবাড়ি হয়ে গেছে।”
“যদি কোনওক্রমে একবার এখান থেকে বেরোতে পারি, তবে নতুন জীবন পাবো।” ভাবলাম আমি। এখন আমি পরিষ্কার বুঝতে পারছি যে বিরাট কোনও ভুলের জন্য আমি একদল ভয়ংকর সন্ত্রাসবাদীদের ডেরায় এসে পড়েছি, ওরা ভুল করে ওদের দলের অন্য কাউকে আমার সঙ্গে গুলিয়ে ফেলেছে। আর আমি যা দেখে ফেললাম, তারপর আমার বাঁচার একমাত্র রাস্তা হল অভিনয় চালিয়ে যাওয়া, যতক্ষণ কোনও সুযোগ না আসে। সুতরাং আমি একটু ঝাড়াপাড়া দিয়ে উঠে হারানো আত্মবিশ্বাস ফিরে পাওয়ার চেষ্টা করলাম।
“শরীরটা একটু খারাপ লাগছিল ঠিকই,” আমি উত্তর দিলাম, “তবে এখন অনেক ভাল লাগছে। আমায় মার্জনা করবেন।”
“না না, এ তো হতেই পারে,” আমার ডানপাশের দাড়িওয়ালা একজন বলল, “মাননীয় মহাশয়, এখন বলুন, ইংল্যান্ডের খবর কি?”
“খুব ভাল,” আমি বললাম।
“মাননীয় কমিশনার মহোদয় কি সলটেফ ব্রাঞ্চের জন্য কোনও বার্তা পাঠিয়েছেন?”
“লিখিত কিছু দেননি,” আমি বললাম।
“কিন্তু তিনি এ ব্যাপারে কিছু বলেছিলেন নিশ্চয়ই?”
“হ্যাঁ, তিনি বলেছেন এ ব্যাপারটা তাঁর মাথায় আছে ,” আমি উত্তর দিলাম।
“দারুণ! দারুণ! এই তো চাই!” উল্লাসে ফেটে পড়ল গোটা টেবিল।
এই শোচনীয় পরিস্থিতির কথা ভেবে আমার ক্রমেই অস্থির আর অসুস্থ লাগছিল। যে কোনও মুহূর্তে প্রশ্নের উত্তরে আমি ধরা পড়ে যাব। সামলে নেওয়ার জন্য পাশের টেবিলে রাখা একটা ব্র্যান্ডির বোতল তুলে নিলাম আমি, গলায় ঢাললাম খানিকটা তার থেকে। কড়া পানীয়টায় কাজ হল, চাঙ্গা হয়ে উঠলাম খানিকটা, বসে পড়লাম আমার চেয়ারে। তখন আমার মজাই লাগছিল, ভাবলাম এই খেলাটা চালিয়ে যাব, কারণ তখনও পর্যন্ত রসবোধটা আমার মধ্যে রয়েছে পুরো মাত্রায়।
“আপনি বারমিংহামে গেছিলেন?” দাড়িওয়ালা লোকটা জিজ্ঞেস করল।
“অনেকবার,” আমি বললাম।
“তাহলে তো নিশ্চয়ই আপনি গোপন কারখানা আর অস্ত্রাগারও দেখেছেন?”
“দুটোই দেখেছি একাধিকবার।”
“পুলিশ এখনো কিছু সন্দেহ করেনি তো?”
“কিচ্ছু না।”
“আচ্ছা, এত বড় একখানা ব্যাপার কি করে সম্পূর্ণ গোপন রয়েছে, বলতে পারবেন?”
এ প্রশ্নের উত্তরেই হয়ত লাট খেয়ে পড়তাম, কিন্তু আমার স্বভাবসুলভ চাপল্য আর ব্র্যান্ডির ধাক্কায় আমি তখন চনমনে।
“এটা তো বলা যাবে না,” আমি বললাম, “ চিফ কমিশনারের নির্দেশ আছে।”
“ঠিক বলেছেন, একদম ঠিক,” বলল আমার আসল বন্ধু পেত্রোকিন। “আপনাকে তো আগে মস্কোর সেন্ট্রাল অফিসে সব রিপোর্ট দিতে হবে, তারপর এইসব খুঁটিনাটি।”
“বিলক্ষণ,” হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম।
“আমরা শুনেছি,” বলল অ্যালেক্সিস, “যে আপনাকে লিভাডিয়া পরিদর্শনে পাঠানো হয়েছিল। এর কোনও বিবরণ দিতে পারবেন?”
“যা জিজ্ঞেস করবেন, চেষ্টা করব,” আমার সাহস বাড়ছিল।
“এ ব্যাপারে বারমিংহাম থেকে কি কোনও আদেশ জারি হয়েছে?”
“আমার ইংল্যান্ড ছাড়ার আগে পর্যন্ত কিছু বেরোয়নি।”
“ভাল, ভাল, এখনও অনেক সময় আছে,” দেড়েল লোকটা বলল, “অনেক মাস। আচ্ছা, তলাটা কাঠের হবে, না লোহার?”
“কাঠের,” দুমদাম করে বলে যাচ্ছিলাম আমি।
“ভাল,” আরেকটা গলা শোনা গেল, “আচ্ছা, এর তলাটা কতখানি চওড়া হবে?”
“সঠিক বলা যাবে না,” আমি বললাম, “তবে মোটামুটি আশি গজ ধরে রাখুন।”
“কতজন এতে চড়তে পারবে?” জিজ্ঞেস করল একজন রক্তশূন্য চেহারার লোক টেবিলের পাশ থেকে। এ লোকটাকে এ রকম একটা খুনির আখড়ায় থাকার বদলে কোনও পাবলিক স্কুলে মানাত বেশি।
“তা, শ”তিনেক তো বটেই,” আমি বললাম।
“ভাসমান কফিন একটা!” বলল সেই লোকটা। গলা শুনে মনে হল যেন সে এক্ষুনি কাউকে কবর দিতে যাচ্ছে।
“এর স্টোর-রুমগুলো কি ওপরে থাকবে, না স্টেট-কেবিনের নিচে?” জিজ্ঞেস করল পেত্রোকিন।
“নিচে,” অবলীলায় বলে গেলাম আমি, যদিও ওরা যে কি নিয়ে বলছিল, সে ব্যাপারে আমার বিন্দুমাত্র ধারণা নেই।
“মাননীয় মহাশয়, এবারে বলুন,” বলল অ্যালেক্সিস, “র্যাভিনস্কির ইস্তাহার নিয়ে জার্মান সমাজতান্ত্রিক বয়ের কি উত্তর দিয়েছেন?”
এর উত্তরে আমি যে কি বলব ভেবে পেলাম না। আমার উপস্থিত বুদ্ধি আমাকে এবারেও বাঁচিয়ে দেবে কি না, তার পরীক্ষা হওয়ার আগেই এমন একটা ব্যাপার ঘটল, যা অভাবিত, বস্তুতপক্ষে আরও খারাপ। নিচে একটা দরজা দড়াম করে খোলার আওয়াজ হল, শুনতে পেলাম সিঁড়ি দিয়ে কেউ দ্রুত উঠে আসছে। তারপর বাইরে একটা জোরালো টোকা, সঙ্গে পরপর আরও দুটো মৃদু টোকা।
“সংগঠনের সঙ্কেত!” বলে উঠল পেত্রোকিন, “কিন্তু আমরা তো সবাই এখানে উপস্থিত! তাহলে কে?”
একটা ধাক্কার চোটে খুলে গেল দরজা, ভেতরে ঢুকল একটা লোক, সারা গা ভর্তি ধুলো , মনে হল বহুদূর থেকে আসছে, কিন্তু তার রুক্ষ মুখে কর্তৃত্বের ছাপ সুস্পষ্ট। টেবিলের প্রত্যেকটি লোককে কড়া চোখে নজর করতে লাগল সে। চমকে উঠল ঘরের সবাই। মনেই হল এ লোকটাকে কেউ চেনে না।
“এভাবে অনধিকার প্রবেশের মানে কি মশাই?” জিজ্ঞেস করল দাড়িওয়ালা লোকটা।
“অনধিকার প্রবেশ!” বলে উঠল আগন্তুক। “আমি জানতে চাই এর মানে কি! আমাকে বলা হয়েছিল এখানে আমার সহকর্মীরা থাকবে, আর তারা আমাকে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানাবে। আমি ব্যক্তিগতভাবে আপনাদের কাছে অপরিচিত বটে, কিন্তু আশাকরি আমার নামটা আপনাদের কাছে কিছু সম্মান পাবে। আমার নাম গুস্তেভ বারজার, ইংল্যান্ডের এজেন্ট, আর আমার কাছে চিফ কমিশনারের চিঠিটাও রয়েছে, যে চিঠিটা তিনি তাঁর সলটেফের ভাইদের জন্য লিখেছেন।”
ওদের নিজেদের তৈরি বোমাও যদি ঘরের মধ্যে ফাটতো, তাহলেও বোধহয় ওরা এত অবাক হত না। ঘরের প্রত্যেকটি চোখ তখন পর্যায়ক্রমে আমার এবং নতুন আসা এজেন্টের দিকে নিবদ্ধ।
“যদি আপনিই গুস্তেভ বারজার হন,” বলল পেত্রোকিন, “তাহলে ইনি কে?”
“আমিই যে গুস্তেভ বারজার, এই কাগজপত্রগুলোই তার প্রমাণ দেবে,” বলে আগন্তুক একটা প্যাকেট ছুঁড়ে দিল টেবিলের ওপর। “এই লোকটা কে আমি জানি না, তবে এ যদি কোনও বদ উদ্দেশ্যে এখানে ঢোকে, তবে এখানকার সব কিছু জেনে ফেলার পর এখান থেকে জ্যান্ত বেরোবে না। বলুন তো মশাই,” সে বলল আমাকে, “আপনি কে আর কি উদ্দেশ্যে এখানে ঢুকেছেন?”
আমার সময় ঘনিয়ে এসেছে বুঝতে পারলাম। পেছনের পকেটে রয়েছে আমার রিভলভার, কিন্তু সেটা দিয়ে এতগুলো লোকের বিরুদ্ধে আমি কি করব? আমি হাতড়াচ্ছিলাম সেটা, একই সঙ্গে মাথা ঠান্ডা রাখার চেষ্টা করছিলাম ঘরের সবকটা ঠান্ডা চোখে আমার দিকে তাকিয়ে থাকা প্রতিহিংসাপরায়ণ লোকের দিকে তাকিয়ে।
“ভদ্রমহোদয়গণ,” আমি বললাম, “এতক্ষণ এখানে যা হল, তাতে আমার কোনও হাত নেই। আমি কোনওভাবেই পুলিশের চর নই, যেটা আপনারা ভাবছেন, এবং একই সঙ্গে এটাও বলছি যে আমি আপনাদের এই মহান সংগঠনের সদস্যও নই। আমি একজন সামান্য শস্য–ব্যবসায়ী, নেহাতই পাকেচক্রে এখানে এসে পড়েছি।”
আমি একটুক্ষণের জন্য থামলাম। বাইরে কোনও আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে কি? মনে হল যেন অনেকগুলো পায়ের আওয়াজ আস্তে আস্তে এদিকেই আসছে? না, পুরোটাই বোধহয় আমার মনের ভুল, কারণ আওয়াজটা মিলিয়ে গেল। কিন্তু আমার বুক ধড়াস ধড়াস করছে।
“একটা কথা বলতে পারি,” আমি বললাম, “আজকে এখানে আমি যা শুনেছি, তার পুরোটাই গোপন থাকবে। আমি একজন ভদ্রলোক, আমি এ ব্যাপারে কথা দিচ্ছি আপনাদের।”
ওদের দেখে মনে হল ওরা কোনও মতলব ভাঁজছে। আমার পেছনেই দরজা, আর আমি শপথ করে বলতে পারি, আমি কারোর বড়বড় নিঃশ্বাসের শব্দ পাচ্ছিলাম। এরা কি সেই তিনজন, যারা একটু আগেই বাইরে গিয়ে তাদের সেই নৃশংস কাজটা করেছে, আর এখন শকুনের মত গন্ধ শুঁকে আরেকটা শিকার খুঁজছে?
আমি টেবিলের চারদিকে আবার তাকালাম। মুখগুলো এখনও আগের মতই কঠোর। কারোর মুখে করুণার চিহ্নমাত্র নেই। আমি পকেটে রিভলভারটা চেপে ধরলাম। নৈঃশব্দ ভাঙল পেত্রোকিনের কর্কশ কন্ঠস্বরে।
“কথা যখন খুশি দেওয়া যায়, যখন খুশি ভাঙাও যায়, কাজেই ওর কোনও দাম নেই,” বলল সে। “এখন একটাই রাস্তা। হয় আমাদের জীবন থাকবে, নাহলে ওর জীবন। আমাদের মধ্যে যিনি সর্বোচ্চ, তিনি বিধান দিন।”
“ঠিক বলেছেন,” বলল ইংরেজ এজেন্ট, “একটা রাস্তাই খোলা আছে। বহিষ্কার।”
এর মানে কি বুঝতে পেরে আমি লাফিয়ে উঠলাম।
“না!” দরজায় পিঠ দিয়ে দাঁড়িয়ে আমি বললাম, “আপনারা একজন স্বাধীন ইংরেজকে এভাবে ভেড়ার মত জবাই করতে পারেন না!”
একটা লোক তেড়ে এল আমার দিকে। আমি বন্দুক টেনে বার করতে না করতে দেখতে পেলাম ঝিকিয়ে ওঠা ছুরির ফলা আর গুস্তেভ বারজারের ভয়ংকর মুখ। তারপর আমি ট্রিগার টেনে দিলাম, আমার কানে বেজে উঠল গুস্তেভের কর্কশ চিৎকার, আর আমি মেঝেতে পড়ে গেলাম পেছন থেকে একটা দারুণ আঘাত পেয়ে। অর্ধচেতনভাবে, ভারী ওজনের ধাক্কায় মাটিতে পিষে যেতে যেতে আমি শুনতে পেলাম আমার ওপরে চিৎকার আর মারামারির আওয়াজ, তারপর আমার আর কিছু মনে নেই।
যখন জ্ঞান ফিরল, দেখলাম আমি দরজার সামনে ধ্বংসাবশেষের মধ্যে শুয়ে আছি, যে দরজাটা ভেঙে ফেলা হয়েছে। আমার সামনে সেই লোকগুলো, যারা খানিকক্ষণ আগেই আমার গর্দান নেবে বলে তৈরি হয়ে গেছিল। তাদের প্রত্যেককে দুজন দুজন করে বেঁধে ফেলা হয়েছে, আর পাহারা দিচ্ছে রাশিয়ান সৈন্যরা। আমার পাশে পড়ে আছে সেই ইংরেজ এজেন্টের মৃতদেহ, যার গোটা মুখই উড়ে গেছে বিস্ফোরণে। অ্যালেক্সিস আর পেত্রোকিন আমার মতই পড়ে আছে মেঝেতে, প্রচুর রক্ত পড়ছে দুজনেরই সারা গা থেকে।
“কী ভাই, জোর বাঁচা বেঁচে গেছেন,” কানের পাশে একটা উৎফুল্ল গলা শুনলাম।
তাকিয়ে দেখি ট্রেনের সেই কালো চোখের লোকটা।
“উঠে পড়ুন,” বলল সে, “আপনি অজ্ঞান হয়ে গেছিলেন শুধু, হাড়গোড় কিছু ভাঙেনি। আমিও প্রথমে এখানে ঢুকে আপনাকে সন্ত্রাসবাদী বলে ভুল করেছিলাম। যাই হোক, আপনিই প্রথম কেউ, যে এই গুহা থেকে জ্যান্ত বেরোতে পারল। আমার সঙ্গে নিচে চলুন, আমি জানতে পেরেছি আপনি কে, আর আপনি কোথায় যেতে চান। আমি আপনাকে মিঃ দিমিদফের কাছে নিয়ে যাব। না, না, ওখানে যাবেন না,” বলে উঠল সে, আমি প্রথম যেই ঘরে উঠেছিলাম, সে ঘরের দিকে পা বাড়াতে যেতেই। “ওখানে পা-ই দেবেন না, এক দিনে আপনি অনেক খারাপ দৃশ্য দেখেছেন। নিচে আসুন, এক গ্লাস পান করে একটু চাঙ্গা হয়ে নিন।”
হোটেলে যেতে যেতে সে আমাকে সবটাই বুঝিয়ে দিয়েছিল। সলটেফের পুলিশ বাহিনী, সে যার প্রধান, আগেই সতর্কবার্তা পেয়েছিল এবং বেশ কিছুদিন ধরেই এই সন্ত্রাসবাদীদের খোঁজ চালাচ্ছিল। আমার এরকম একটা জায়গায় আসা, সব কিছুর মধ্যেই একটা গোপনীয়তা বজায় রাখার চেষ্টা, আর গ্রেগরির দেওয়া সেই সব্বনেশে পোর্টম্যান্টোর ওপর ইংরেজি লেবেল বাকি কাজটা করে দিয়েছিল।
আর বিশেষ কিছু বলার নেই। আমার সেই বন্ধুদের সবাই হয় সাইবেরিয়ায় চালান হয়েছিল, নাহয় তাদের কোতল করা হয়েছিল। আমার কাজে খুশি হয়েছিল আমার ওপরওয়ালারা। আমার প্রোমোশন হয়েছিল তারপরেই। আমার জীবনধারা পালটে গেছিল সেই ভয়ঙ্কর রাতের পর থেকেই, যে রাতের কথা ভাবলে আমি আজও কেঁপে উঠি।
[স্যার আর্থার কোনান ডয়েল রচিত “আ নাইট অ্যামঙ দ্য নিহিলিস্টস” অবলম্বনে। গল্পটি প্রথম প্রকাশিত হয় “লন্ডন সোসাইটি” ম্যাগাজিনে ১৮৮১ সালে।]
জয়ঢাকের গল্পঘর এই লিংকে