সোনালী ঘোষালের অন্যান্য গল্প ঃ——————-গল্প হলেও সত্যি, স্বপ্নের দেশে পঞ্চমী , চোর ধরার গল্প, তিনটে রক্ষাকবচ, এক কৃতজ্ঞ সারসের কাহিনি
জাপানের এক শান্ত, নিরুপদ্রব গ্রামে মাইকো, কিকো আর ইউরিকো নামে তিন বন্ধু বাস করত। তারা প্রায়ই একসঙ্গে চায়ের মজলিসে যোগ দিত। একদিন চা খেতে খেতে তারা তিনজনে কথাবার্তা বলছিল। আলোচনা প্রসঙ্গে মাইকো জানাল, “জানো তো, আমি পাখিদের কলকাকলি শুনতে খুব ভালবাসি।” কিকো বলল, “আমি ছোট নদীর কুলকুল রবে বয়ে যাওয়ার সুরেলাধ্বনি শুনতে পছন্দ করি।” ইউরিকো শুধোল, “তোমরা কাল রাতে বাজ পড়ার হুড়মুড় শব্দ শুনতে পেয়েছিলে কী? শব্দটা ভারী চমৎকার।”
আসলে তাদের দৃষ্টিশক্তি খুব ক্ষীণ ছিল বলে তারা কানে যা শুনত তাই ভালোবাসত।
মাঝে মাঝে তাদের দৃষ্টিশক্তি নিয়েও তারা আলোচনায় মেতে উঠত। একদিন মাইকো বলল, “ইদানিং আমার দৃষ্টিশক্তির অনেক উন্নতি হয়েছে।”
কিকোর সকৌতুক প্রশ্ন, “মাইকো তুমি একথা কী করে বুঝলে?”
“গতকাল সন্ধায় আমি আকাশে তারা দেখেছিলাম।”
“ওহো তাই নাকি? সত্যি সত্যি দেখতে পেয়েছিলে? ঐ দূরের পাইন গাছে মা পাখি কীভাবে তার ছোট্ট ছানাকে খাবার খাওয়াচ্ছে তা দেখতে পাচ্ছ?”
ইউরিকো এতক্ষণ ওদের সব কথা মনযোগ দিয়ে শুনছিল। সে বলে উঠল, কিকো! তুমি বড়াই করছ! আর মাইকো, তুমিও বড্ড বেশি বড় বড় কথা বলছ।”
“না- না কক্ষণো না!” দুজনেই একযোগে বলে উঠল।
ইউরিকো সর্বদাই তার শ্রেষ্ঠ বুদ্ধিমত্তার জন্য গর্ব অনুভব করত। তাই সে বলল, “ঠিক আছে, ঠিক আছে, এস, বাজি ধরে দেখা যাক্ কার দৃষ্টিশক্তি সবচেয়ে তীক্ষ্ণ।”
কিকো আর মাইকো দুজনেই পণ রাখতে রাজি হল। “কিন্তু বাজিটা কী হবে?” তারা জিজ্ঞাসা করল।
“আগামীকাল খুব ভোরে পুরোহিত মহাশয় মন্দিরের প্রবেশপথে একটা খোদাই করা ফলক স্থাপন করবেন। তোমাদের মধ্যে যে সেই খোদিত লিপির পাঠোদ্ধার করতে পারবে সেই সর্বশ্রেষ্ঠ দৃষ্টিশক্তি সম্পন্ন পুরুষ বলে বিবেচিত হবে।”
মাঝরাতে সহসা দরজায় করাঘাত শুনে পুরোহিত জানতে চাইলেন “এত রাত্রে মন্দিরের পুরোহিতের কাছে কার কী প্রয়োজন?”
সেখানে উপস্থিত মাইকো বলল, “শ্রদ্ধেয় পুরোহিত, কাল উষালগ্নে আপনি দরজার সামনে যে ফলকটা স্থাপন করবেন তার উপর কী লেখা থাকবে আমাকে কী সেটা অনুগ্রহ করে জানাবেন।”
যদি তোমার এরূপ অভিপ্রায় থেকে থাকে তাহলে শোন,…… “ওহে চক্ষুদ্বয়, যা তোমার গোচরে আসবে তাই তোমার দেখা উচিত, ওহে দৃষ্টিহীন, হতাশ হয়ো না…”
“অসংখ্য ধন্যবাদ।”
অদ্ভুত ব্যাপার তো! সে আমায় পুরোটা শেষ করতেই দিল না।
ঠিক সেই সময়েই-
কেউ অনুমতি প্রার্থনা করে বলল, আমি কী ভেতরে আসতে পারি?”
“আরে কিকো এসো এসো এসো। আমি কীভাবে তোমায় সাহায্য করতে পারি?”
কিকো মাইকোর মতো একই অনুরোধ জানাল। তাই পুরোহিত পড়তে শুরু করলেন…… হতাশ হয়ো না। ঘুঘু পাখির মিষ্ট কলতানে মনযোগ দিয়ে শুনবে। নিজের ভেতরে দেখ, সেখানেই তার দেখা মিলবে,” নীলপাথরের উপরে সাদা অক্ষরে সেটাই খোদাই করা আছে।
পুরোহিতকে ধন্যবাদ ও শুভরাত্রি জানিয়ে কিকো বিদায় নিল।
“এই ছেলেটা অন্তত পুরো কবিতাটা শুনল। এবার আমি নিশ্চিন্তে ঘুমোতে পারি।” পুরোহিত মনে মনে ভাবল।
কিন্তু যেই সে শুতে যাবার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে ঠিক তখনই দরজায় মৃদু করাঘাত শোনা গেল।
উঃ না, না, আর পারা যায় না… আজকের রাতে কীসব নিয়মবিরূদ্ধ উল্টো পাল্টা ঘটনাই না ঘটছে?”
নিঃসন্দেহে সে ছিল ইউরিকো। কবিতাটা শোনার পর সে জিজ্ঞাসা করল, “আচ্ছা! পাথরটার ওপরে আরও কিছু খোদাই করা আছে কী?”
“হ্যাঁ হ্যাঁ ঠিক… ঠিক… শব্দগুলোর উপর একটা শ্বেতবর্ণের ঘুঘুপাখির ছবি খোদাই করা আছে।”
পরদিন খুব ভোর ভোর তিনবন্ধু মন্দিরে উপস্থিত হল। মাইকো বলল, “দেখো, দেখো ফলকটা স্থাপন করা রয়েছে।”
“হ্যাঁ, নীলরঙের পাথরটা কী সুন্দর, তাই না?” কিকো জানাল।
ইউরিকো বলল, “তোমরা কেবল রঙটাই দেখেছ। কবিতার উপরে সুন্দর শ্বেতবর্ণের ঘুঘু পাখিটার সম্বন্ধে কিছু জানতে পেরেছ?”
“কবিতাটা নিজেই খুব সুন্দর। আবার বোল না যেন যে আমি সেটা পড়তেই পারিনি,” কথাটা মাইকো জানাল।
খোদাই করা ফলকটা নিয়ে তিনবন্ধু তুমুল তর্কাতর্কি শুরু করে দিল। পুরোহিতমশাই দরজা খুলে বেরিয়ে এসে বলল, “হুঁ………… মাফ করবেন।”
মাইকো বলল, “হতাশ হয়ো না।”
কিকো বলল, “এটাই কিন্তু সবটা নয়। আমি বাকি অংশটাও পড়তে পারি।”
“কী ব্যাপার, ভদ্রমহোদয়গন?” পুরোহিত জিজ্ঞাসা করল।
“ওঃ! ফাদার!”
তারা তিনজনে পুরো ঘটনাটা বিশদে ব্যাখ্যা দেবার পরে- পুরোহিতমশাই বিনয়ের সঙ্গে জানাল, “আমি অত্যন্ত দুঃখিত। তোমরা প্রত্যেকেই একটা মারাত্মক ভুল করেছ।”
“কী কী কী?” সকলে অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করল।
“তোমরা একটু বেশি সকাল সকাল এসে পড়েছে। আমি ফলকটা এখনও স্থাপন করতে পারিনি।”
তিনবন্ধু বিষন্ন বদনে কিন্তু বিচক্ষণতার সঙ্গে বাড়ির দিকে রওনা দিল।
এখন থেকে চায়ের আসরে তারা তাদের প্রকৃত শিক্ষার পাঠ নিয়ে বলতে লাগল, “ওহে চক্ষুদ্বয়! যা দেখা উচিত তাই দেখ……”
“ওহে, দৃষ্টিহীন, হতাশায় ভুগো না…”
“পাখির কলকাকলি মনপ্রান দিয়ে শ্রবণ কর। নিজের অন্তরে দিকে তাকাও সেখানে আমাকেই প্রত্যক্ষ করবে।”