বিদেশী গল্প রাশিয়ান গল্প-ভেলরিওকা অনুবাদঃ দেবজ্যোতি বসন্ত ২০১৭

জয়ঢাকের সমস্ত রাশিয়ান গল্পের লিংক

bideshirussian-medium

            এক ছিল বুড়ো আর তার ছিল এক বুড়ি। তাদের দুই মা বাপ মরা নাতিনাতনী। ভারী সুন্দর তারা। বুড়োবুড়ি তাদের প্রাণের চেয়ে বেশি ভালোবাসত।

            একদিন বুড়ো গেছে তাদের নিয়ে মটরশুঁটির ক্ষেতে। গিয়ে দেখে ফনফনিয়ে বেড়ে অঠা গাছের মাথায় বেজায় ভালো মটরশুঁটির ঝাঁক। দেখে বুড়োর খুশি ধরে না। হেসে হেসে বলে, “দ্যাখ, দ্যাখ,  এমন ফসল আর দুনিয়ার কোন ক্ষেতে ফলবে না। ঐ দিয়ে আমরা কিসেল রাঁধব আর মটরশুঁটির পিঠে বানাব।”

            পরদিন সকালে দাদু তার বড়োনাতনীকে ক্ষেতে পাঠাল। বলে, “গিয়ে ক্ষেত থেকে চড়ুই তাড়া দিদিভাই।”

            শুনে বড়োনাতনী ক্ষেতের ধারে গিয়ে বসে একটা শুকনো ডাল হাতে নিয়ে নাড়ায় আর বলে, “এই চড়ুই, যাঃ! ভাগ! আমার দাদুর মটরশুঁটি খেয়ে পেট ভরে ফেললি যে!”

            যেই না বলা, অমনি বনের মধ্যে বেজায় শব্দ উঠল, আর তারপর সেখান থেকে বের হয়ে এল ভেলরিওকা। পাহাড়ের মত চেহারা তার।চোখ মোটে একখানা, নাকখানা বাঁকানো, মাথায় উলোঝুলো চুল, আধ হাত লম্বা ঝোলা গোঁফ, কাঠের জুতো পরা একটা পায়ে লেংচে লেংচে ক্রাচে ভর দিয়ে হাঁটে আর দাঁত কড়মড় করে হাসে।  নাতনীর কাছে এসে সে তার হাত ধরে টনতে টানতে নিয়ে চলে গেল বনের ভেতর।

            ওদিকে দাদু তার নাতনীর পথ চেয়ে বসে থাকে তো বসেই থাকে, আর সে আসে না। তখন সে তার ছোটো নাতিটকে পাঠাল দিদিকে খুঁজতে। সে-ও আর ফেরে না। অবশেষে বুড়ো বুড়িকে বলল, “এত দেরি তো ওরা কখনো করে না! বোধ হয় কোথাও খেলা জুড়েছে। গিয়ে একটু দেখে এস না!”

            শুনে বুড়ি উঠে উনুনে রান্না হতে থাকা পিঠেগুলোকে খুন্তি দিয়ে উল্টেপাটে দিয়ে গেল নাতিনাতনীর খোঁজে।

            তাকে ক্ষেতের দিকে আসতে দেখে ভেলরিওকা চিৎকার করে বলে, “এখানে কী চাই বুড়ি? মটরশুঁটি তুলতে এলি নাকি? তাই যদি হয় আমি কিন্তু তাহলে তোকে এইখানে সারাজীবন মটরক্ষেতে দাঁড় করিয়ে রেখে দেব।” এই বলে সে তাকে ক্রাচ দিয়ে এমন মারল যে বুড়ি তাতে আধমরা হয়ে পড়ে রইল ক্ষেতের ভেতর।

            ওদিকে, বুড়ি আর তার নাতিনাতনি কেউ ফেরে না দেখে বুড়ো শেষে ভারী রেগে গজগজ করতে করতে ক্ষেতের দিকে চলল তাদের খোঁজে। গিয়ে দেখে বুড়ি পড়ে আছে আধমরা হয়ে, আর তার নাতিনাতনীদের কোন চিহ্ন নেই কোথাও। বুড়ো চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে বুড়িকে তুলে নিয়ে বাড়ি গেল।

            মুখেচোখে জল দিতে জ্ঞান এল বুড়ির।  তখন সে বুড়োকে বলল কে তাকে অমন করে মেরেছে, আর তাদের নাতিনাতনীকে ছিনিয়ে নিয়ে গেছে। শুনে বুড়ো তো রেগে আগুন। বলে, “আজ বদমাশ ভেলরিওকার একদিন কি আমার একদিন। এই বলে সে লোহার একটা ক্রাচ নিয়ে রাগে গরগর করতে করতে চলল ভেলরিওকার সন্ধানে।

            বুড়ো তো তারপর যায় যায় যায়—যেতে যেতে শেষে সে এসে হাজির হল বনের ভেতর এক ছোট্ট ঝিলের ধারে। তার জলে সাঁতার কাটছিল এক হাঁস। বুড়োকে দেখে সে বলল, “কোয়াক কোয়াক কোয়াক—একশ বছর বাঁচবে তুমি দাদু। তোমার জন্যে হাপিত্যেশ করে এইখানে বসে বসে তোমার কথাই ভাবছিলাম আমি এতক্ষণ।”

            “আহা বেঁচে থাক তুই।কেন আমার জন্যে অপেক্ষা করছিলি রে?” জবাব দিল বুড়ো।

            “আমি তো জানতাম তুমি নাতিনাতনীর খোঁজে ভেলরিওকার তালাশে বের হবে।”

            “কিন্তু তুই সে বদমাশটার কথা জানলি কেমন করে?”

            “কোয়াক কোয়াক—কারণ আছে। আমার লেজ কেটে দিয়েছে ও। আমি বলে একটা ছোট্ট হাঁস, আর সে আমায় কি না–”

            “ওর বাড়ি কোথায় জানিস? দেখিয়ে দিবি আমায়?”

            “চল দেখিয়ে দি,” বলে জল থেকে উঠে হাঁস চলল হেলেদুলে বুড়োর পাশে পাশে।

            যেতে যেতে তারা দেখে পথের পাশে পড়ে আছে একটুকরো দড়ি। বুড়োকে দেখে দড়ি বলে “ও টেকো দাদুভাই, ভালো আছ? থাকো কোথা? যাচ্ছ কোথা?”

            “আমি থাকি বনের বাইরে ও—ই ওখানে। যাচ্ছি ভেলরিওকাকে খুঁজতে। সে আমার বুড়িকে বেজায় মেরেছে আর আমার সুন্দর নাতিনাতনীদুটোকে চুরি করে নিয়ে গেছে।”

            “হুম। তা আমায় সঙ্গে নেবে নাকি?”

            “নিয়েই যাই,” ভাবল বুড়ো, “ওকে দিয়ে বদমাশটাকে ফাঁসি দেব’খন।” এই ভেবে বুড়ো ঘাড় নড়তে দড়ি চলল সাপের মত এঁকেবেঁকে তার পেছনপেছন।

            খানিক দূরে গিয়ে এবার তাদের দেখা একটা জলে চলা গম ভানবার কলের সাথে। বুড়োকে দেখে কল বলে “ও টেকো দাদুভাই, ভালো আছ? থাকো কোথা? যাচ্ছ কোথা?”

            “আমি থাকি বনের বাইরে ও—ই ওখানে। যাচ্ছি ভেলরিওকাকে খুঁজতে। সে আমার বুড়িকে বেজায় মেরেছে আর আমার সুন্দর নাতিনাতনীদুটোকে চুরি করে নিয়ে গেছে।”

            “হুম। তা আমায় সঙ্গে নেবে নাকি?”

            “নিয়েই যাই,” ভাবল বুড়ো, “কখন কী কাজে লেগে যায় কে জানে!” এই ভেবে বুড়ো ঘাড় নড়তে কল চলল তার হাতলে ভর করে তার পেছনপেছন।

            আবার তারা যায় যায়। পথে দেখা একটা ওক-এর বীজের সাথে। বুড়োকে দেখে বীজ বলে “ও নাকলম্বা দাদুভাই, ভালো আছ? থাকো কোথা? যাচ্ছ কোথা?”

            “আমি থাকি বনের বাইরে ও—ই ওখানে। যাচ্ছি ভেলরিওকাকে খুঁজতে। সে আমার বুড়িকে বেজায় মেরেছে আর আমার সুন্দর নাতিনাতনীদুটোকে চুরি করে নিয়ে গেছে।”

            “হুম। আমিও দুষ্টুটাকে চিনি। তা আমায় সঙ্গে নেবে নাকি? তোক্মার কাজে আসব দেখো।”

            “চল তবে। আমাদের পেছন পেছন গড়িয়ে গড়িয়ে আয়।”

            অমনি ওকের বীজ দুটো পা বের করে লাফাতে লাফাতে তাদের সঙ্গে চলল।

             তারপর তারা এসে পৌঁছুল এক ভয়ানক বনের মধ্যে। সে বনের মধ্যে একটা ছোট্ট কুঁড়েঘর। ভারী একলা সেটা। ঘরে উনুনে আগুন নেই। একপাশে রয়েছে শুধু একটা স্যুপ বানাবার হাঁড়ি। ওকের বীজ অমনি লাফ মেলে সেই হাঁড়ির ভেতর ঢুকল গিয়ে দড়ি গিয়ে হাঁড়ির গলায় জড়াল। কল গিয়ে বেঞ্চির ওপরে উঠল, হাঁস গিয়ে বসল উনুনের মাথায় আর বুড়ো ঘরের এক কোণে গিয়ে লুকোল।

            খানিক বাদেই হঠাৎ জঙ্গলে দুমদাম শব্দ উঠল। বন থেকে এক পায়ে কাঠের জুতো পরে ক্রাচে ভর দিয়ে লাফাতে লাফাতে আর হাসতে হাসতে বের হয়ে এল ভেরলিওকা। ঘরে ঢুকেই সে একবোঝা কাঠ মেঝেতে ফেলল এনে। তারপর উনোন ধরাতে বসল। ওমনি হাঁড়ির ভেতর থেকে ওকের বীজ গান ধরেছে—

            “হি হি হি

            আমরা সবাই ভেরলিওকাকে

            মারতে এসেছি”

            শুনেই ভেরলিওকা রেগে আগুন হয়ে হাঁড়িটার হাতল ধরেছে চেপে, আর ওমনি হাতল ভেঙে হাঁড়ি মাটিতে পড়ে চূরচূর। তার ভেতর থেকে ওকের বীজ লাফিয়ে উঠে ভেরলিওকার একমাত্র চোখে গুঁতো মেরে তাকে দিয়েছে অন্ধ করে। তখন তার ওপর লাফিয়ে পড়ল দড়ি। যতই হাত পা ছোঁড়ে সে ততই দড়ি তাকে আচ্ছা করে পেঁচিয়ে বাঁধে। তাইতে যেই না সে তার একখানা পা ছুঁড়েছে, তাইতে ধাক্কা খেয়ে বেঞ্চি থেকে কল এসে দমাস করে পড়েছে তার বুকের ওপর।

            বুড়ো তখন বেরিয়ে এসে তার লোহার ক্রাচ দিয়ে ভেরলিওকাকে কী মার, কী মার!তাই দেখে উনুনের মাথা তেকে হাঁস চিৎকার জুড়েছে “কোয়াক কোয়াক কোয়াক, খাক খাক বেজায় মার খাক—”

            মারতে মারতে মারতে শেষে একেবারে মেরেই ফেলল বুড়ো। তারপর তার ঘরটা ভেঙে মাটির নীচের গুপ্তঘরে গিয়ে নাতিনাতনীকে উদ্ধার করল, আর সেইসঙ্গে সেই গুপ্তঘরের সব সোনাদানা নিয়ে এসে বিরাট বড়োলোক হয়ে সুখেশান্তিতে ঘর করল অনেক দিন।

            আমার কথাটি ফুরোল।

জয়ঢাকের গল্পঘর এই লিংকে

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Twitter picture

You are commenting using your Twitter account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s