জয়ঢাকের সমস্ত রাশিয়ান গল্প
অনেক অ-নেকদিন আগে এক দেশে আফ্রন আফ্রনোভিচ নামে এক রাজার রাজত্ব ছিল। তার তিন ছেলে। বড়টার নাম দিমিত্রি, মেজছেলের নাম ভ্যাসিলি আর ছোটোছেলে ছিল ইভান। তারা কত আনন্দে হেসেখেলে ঘুরে বেড়ায়। রাজার তখন ষাট বছর বয়েস। ছেলেদের দিকে দেখে তার মনটা ভারী খারাপ লাগে। কেবল ভাবে, আহা ওরা কেমন আনন্দে আছে। আর আমি দেখ কেমন বুড়ো হয়ে যাচ্ছি! কেমন করে বুড়ো হবার হাত থেকে বাঁচি?
এইসব ভাবতে ভাবতেই রাজা একদিন রাত্রে স্বপ্নে দেখে সাতাশ দেশের তিরিশ রাজ্যের পরে এক দেশ আছে। সেখানে থাকেন রাজকন্যা রূপমতী। তাঁর তিন মা, তিন দিদিমা আর নয় ভাই। রূপমতীর বালিশের নিচে থাকে কৌটোভরা নবজীবনের জল। সে জলের এক ঢোঁক কেউ খেলে সঙ্গেসঙ্গে তার তিরিশ বছর বয়স কমে যায়।
ঘুম ভেঙে উঠে পরদিন রাজসভায় রাজা তিন রাজপুত্র আর দেশের জ্ঞানীগুণীদের ডেকে স্বপ্নের কথা শোনাতে জ্ঞানীগুণীরা দাড়িতে হাত বুলিয়ে বলল, “হুঁ হুঁ। রূপমতী রাজকন্যার কথা আমরা কানাঘুষোয় শুনেছি বটে মহারাজ। তবে কোথায় যে তার দেশ সে খবর কেউ জানে না।” তাই শুনে রাজপুত্ররা উঠে দাঁড়িয়ে বলে, “আমরা দুনিয়া ঢুঁড়ে সেই রাজকন্যার খবর নিয়ে আসব।” শুনে রাজা বেজায় খুশি হয়ে অনেক আশীর্বাদ করে তিন রাজপুত্রকে বিদায় দিলেন।
রাজধানী ছেড়ে বের হয়ে বড়ো দুই ভাই চলল ডানদিকের পথ ধরে, আর ছোটোভাই ইভান ধরল বাঁদিকের পথ। বড়োভাইরা তাদের রাস্তায় শ’খানেক মাইল পেরিয়ে গেছে, তখন এক বুড়োর সঙ্গে তাদের দেখা। ভাইদের দেখে বুড়ো জিজ্ঞাসা করল, “চললে কোথা? অনেক দূর?” শুনে রাজপুত্ররা রেগেমেগে বলে, “তাতে তোর কী রে বুড়ো? পথ ছাড় বলছি!” শুনে বুড়ো আর কিছু না বলে নিজের পথে রওনা দিল।
তারপর প্রায় এক সপ্তাহ পথ চলে রাজপুত্ররা শেষে হাজির হল এক বুনো এলাকায়। সেখানে না আকাশ না মাটি, কিচ্ছু চোখে পড়ে না। যতদূর চোখ যায় প্রাণেরও কোন চিহ্ন নেই সেখানে। এইখানে ঘুরতে ঘুরতে ভাইদের সঙ্গে আর এক বুড়োর দেখা। আগের বুড়োর চেয়েও বেশি বুড়ো সে। ভাইদের দেখে এগিয়ে এসে সে বলে, “চললে কোথা? কিছু খুঁজছ বলে মনে হয়?”
ভাইরা বলল, “খুঁজছি রূপমতী রাজকন্যার দেশ। তার কাছ থেকে বুড়ো বাবার জন্য নবজীবনের জল আনতে বেরিয়েছি আমরা।”
“সে জায়গায় যেও না বাপু,” বুড়ো গম্ভীর মুখে মাথা নাড়ল।
“কেন? কেন?”
“পথে তিনটে নদী পড়ে যে। সে নদীরা যেমন গভীর তেমন চওড়া।”
“তাতে কী? পাড় হবার জন্য নৌকো চাপলেই হল!”
“সে তো বটেই। খেয়ানৌকোর ঘাটও আছে। তবে ভাড়া বেজায় চড়া। প্রথম নদী পেরোবার জন্য কেটে দিতে হবে তোমার ডানহাত, দু’নম্বর নদী পাড় হবার জন্য বাঁ হাত আর তিন নম্বরের জন্য মুণ্ডু। তাই বলছি—”
শুনে দুই বড়ো ভাই ভয়েই সারা। বলে, “আগে তো প্রাণ বাঁচাই, তারপর সময়সুযোগ হলে নয় সমুদ্রপথে জাহাজে করে রূপমতীর দেশের খঁজে যাওয়া যাবে।” এই বলে তারা ঘরের পথ ধরল।
রাজ্যের কাছাকাছি পৌঁছে, আর যখন একদিনের পথ বাকি তখন একটা মাঠের ভেতর তাঁবু ফেলল দুই ভাই। বলে, “এইখানে বসে বসে ছোটকুমারের জন্য অপেক্ষা করি। সে এলে একসঙ্গে ফেরা যাবে’খন।”
ওদিকে ইভানের ভাগ্যে তখন অন্য ঘটনা ঘটে চলেছে। রওনা হবার খানিক বাদে তার সঙ্গেও সেই প্রথম বুড়োর দেখা হয়েছিল। তাকে দেখে একগাল হেসে বুড়ো বলে, “চললে কোথা? অনেক দূর?” জবাবে ইভান বলল, “সে কথা আমি তোমায় বলব কেন?”
কিন্তু খানিক বাদে তার হঠাৎ মনে হল, বুড়োমানুষটার সঙ্গে অমনটা না করলেই ভালো হত। হয়ত কোন খবরটবরও দিতে পারত আমায় রূপমতীর দেশ নিয়ে। এই ভেবে সে ঘোড়া ঘুরিয়ে নিয়ে টগবগিয়ে গিয়ে বুড়োর সঙ্গ ধরল। বলল, “ভুল হয়েছে বাবা। তখন তুমি কী বললে আমি ঠিক শুনতে পাইনি কিনা!”
“আমি জানতে চাইছিলাম, অনেক দূর যাচ্ছ নাকি?”
“কাছেদূরে বলতে পারি না বাবা। আমি রূপমতী রাজকন্যার দেশ খুঁজছি। সে দেশ কোথায় আছে কে জানে? তার থেকে বাবার জন্য নবজীবনের জল চেয়ে আনব কিনা!”
“বেশ বেশ। আমার কথায় যখন ভালো করে জবাব দিয়েছিস তখন আমিও তোকে ঠিক রাস্তাটা দেখিয়ে দেব,” বুড়ো একগাল হেসে বলল, “তবে মুশকিল হল, সাধারণ ঘোড়ায় করে সেখানে পৌঁছুতে পারবি না যে!”
“অসাধারণ ঘোড়া আমি পাব কোথায় বাবা?”
“বলছি। বাড়ি ফিরে যা। সেখানে গিয়ে রাজপ্রাসাদের আস্তাবলের সব ঘোড়াকে সমুদ্রের ধারে তাড়িয়ে নিয়ে যা। যে ঘড়াটা দল ভেঙে সমুদ্রে গিয়ে গলা অবধি ডুবিয়ে সমুদ্রের জল খেতে শুরু করবে, আর তাইতে সমুদ্র উথালপাথাল হয়ে ঢেউ আছড়াবে পাড়ের গায়ে, সেই ঘোড়াটার পিঠে চাপবি।”
“ধন্যবাদ বাবা,” এই বলে ইভান ঘোড়া ছুটিয়ে দিল তার দেশের পথে।
রাজপ্রাসাদে ফিরে ইভান বুড়োর কথামত কাজ করে যে ঘোড়াটাকে পেল সে হল আস্তাবলের সবচেয়ে তাগড়া ঘোড়াটা। পরদিন সকালে সে তার পিঠে চাপতে ঘোড়া মানুষের গলায় বলে, “নেমে দাঁড়াও ইভান। আমি তোমায় তিনবার ধাক্কা দেব। তাতে তুমি দুনিয়ার সবচেয়ে শক্তিশালী মানুষ হয়ে যাবে।”
ইভান নেমে দাঁড়াতে ঘোড়া তাকে একখানা ধাক্কা দিল, তারপর আরেকখানা। তারপর তিন নম্বর ধাক্কা দিতে গিয়েও কী ভেবে যেন থেমে গেল সে। বলল, “উঁহু। তিনবার ধাক্কা দিলে তোমার গায়ে এমন জোর হবে যে তাতে পৃথিবীটাই ফেটে যাবে। সে বরং থাক।”
তখন ইভান বর্মচর্ম তলোয়ারে সেজে ঘোড়ার পিঠে চেপে বসে ঘোড়া ছুটিয়ে দিল। চলতে চলতে তিনমাস বাদে তারা এসে পৌঁছোল একটা জলায়। সেখানে ঘোড়ার হাঁটু অবধি জল, ইভানের বুক অবধি ঘাস, খাবার জন্য কুটোটি মেলে না। ঘুরতে ঘুরতে যখন সে খিদেতেষ্টায় অস্থির তখন হঠাৎ দেখে দূরে একটা জরাজীর্ণ কুঁড়েঘর। ঘরটা একটা মুরগির পায়ের ওপর দাঁড়িয়ে আর তার মধ্যে শুয়ে আছে রোগাভোগা, কঙ্কালসার ডাইনি বাবা ইয়াগা। ইভান ঘরে ঢুকে হাঁক দিল, “ও ঠাকুমা।”
ডাইনি মুখ তুলে তাকে দেখে বলে, “আরে রাজপুত্র ইভান যে? কী খুঁজতে বেরিয়েছ?”
“আমি সাতাশ দেশের তিরিশ রাজ্য পেরিয়ে রাজকন্যা রূপমতীর প্রাসাদ খুঁজতে যাচ্ছি। বাবার জন্য তার কাছ থেকে নবজীবনের জল চাইতে যাব।”
“শুনেছি বটে সে দেশের কথা, “বাবা ইয়াগা মাথা নাড়ল, “কিন্তু সেখানে তুই পৌঁছুতে পারবি না যে!”
“কেন? কেন?”
“পথে তিনটে নদী পড়ে যে। সে নদীরা যেমন গভীর তেমন চওড়া।”
“তাতে কী? পাড় হবার জন্য নৌকো চাপলেই হল!”
“সে তো বটেই। খেয়ানৌকোর ঘাটও আছে। তবে ভাড়া বেজায় চড়া। প্রথম নদী পেরোবার জন্য কেটে দিতে হবে তোর ডানহাত, দু নম্বর নদী পাড় হবার জন্য বাঁ হাত আর তিন নম্বরের জন্য মুণ্ডু। তাই বলছি—”
“একখানা মুণ্ডু গেলে ক্ষতি নেই। গিয়েই দেখি।”
“আহা বাচ্চা ছেলে। কখনো বিপদের মুখ দেখিসনি যে! এখনো জীবনে কত সাধ আহ্লাদ বাকি তোর। ফিরে যা বাপ।”
“না ঠাকুমা। পথে যখন বেরিয়েছি তখন আমি যাবই যাব।” এই বলে রাজপুত্র ঘোড়া ছুটিয়ে দিল ফের। তারপর ঘুরতে ঘুরতে একদিন সে প্রথম নদীর খেয়াঘাটে এসে হাজির। এসে সে দেখে মাঝি ঘুমোচ্ছে। “আহা জোরে হাঁক দিলে বেচারাদের কানে তালা ধরে যাবে। জোরে শিস দিলে নদীতে তুফান উঠবে। আমি বরং আস্তে করে ডাকি। এই বলে ইভান খুব আস্তে শিস দিল একটা। অমনি মাঝি জেগে উঠে নৌকোয় গিয়ে বসল। তারপর ইভানকে নদী পার করে দিয়ে বলে, “এইবার ভাড়া দাও রাজপুত্তুর। তোমার ডানহাতটা কেটে দাও আমায়।”
“উঁহু। হাতটা আমার কাজে লাগবে যে,” ইভান জবাব দিল। তারপর তলোয়ার বের করে ভীষণ যুদ্ধ করে মাঝিকে হারিয়ে দিয়ে ঘোড়ায় চেপে চলল পরের নদীর দিকে।
এইভাবে যুদ্ধ করে করে তিন নদী পার হয়ে সে তিরিশ নম্বর রাজ্যের সীমানায় এসে পৌঁছে দেখে সেখানে একটা রাক্ষস দাঁড়িয়ে আছে। তার চেহারা বনের সবচেয়ে বড়ো গাছটার চেয়েও বড়ো। হাতে একটা বিরাট বড়ো ওককাঠের মুগুর।
“কোথায় যাচ্ছিস রে ব্যাটা পোকা?” বাজের মত গলায় হাঁক দিল সে ইভানকে দেখে।
“যাচ্ছি রূপমতীর দেশে। বাবার জন্য নবজীবনের জল আনতে।” ইভান জবাব দিল।
“কী বললি ব্যাটা বামন? আমি তাঁর রাজ্য এখানে দাঁড়িয়ে শতেক বছর ধরে পাহারা দিচ্ছি। তোর চেয়ে কত বড়োবড়ো বীর এল সেই জল নিতে তার লেখাজোখা নেই! কেউ আমার হাত থেকে প্রাণ নিয়ে রাজকন্যার দেশে ঢুকতে পারেনি। তাদের হাড়গোড় সব এখানে ছড়িয়ে আছে। তাদের কাছে তুই তো একটা পোকা। বাঁচতে চাইলে প্রাণ নিয়ে পালা।”
ইভান দেখল অতবড়ো একটা রাক্ষসের সঙ্গে সে মোটে এঁটে উঠতে পারবে না। তখন সে ঘোড়া ঘুরিয়ে সীমানার ধার ঘেঁষে ঘেঁষে বনের ভেতর দিয়ে চলল। অনেক পথ পেরিয়ে সে হাজির হল বনের ভেতর একটা ছোট্ট কুঁড়েঘরে। সেখানে শুয়েছিল এক বুড়ি। ইভানকে দেখে তড়বড়িয়ে উঠে বসে সে বলে, “রাজপুত্র ইভান যে! হায় হায়, ভগবান তোমায় কেন এ দেশে পাঠালেন?”
ইভান তাকে সব কথা খুলে বলতে বুঝি এবার একটু দয়া হল বুড়ির। উনুনের ভেতর হাত ঢুকিয়ে সে বের করে আনল খানিক বিষ লতা আর একটা ছোট্ট বল।
রাক্ষসের কাছাকাছি গিয়ে আগুন জ্বেলে লতাগুলো ওতে ফেলে দিবি। সাবধান। সে ধোঁয়া যেন তোর নাকে না ঢোকে। রাক্ষস ও গন্ধ পেলেই ঘুমিয়ে পড়বে দেখিস। তারপর তার মুণ্ডু কেটে ফেলে, এই বলটাকে মাটিতে গড়িয়ে দিবি। বল যেখানে যাবে তার পিছুপিছু যাবি। তাহলেই রূপমতীর প্রাসাদের পাশে পৌঁছুবি গিয়ে। রাজকন্যা ন’দিন জেগে থেকে প্রাসাদের বাইরে ঘোরেফেরে, খেলা করে, তারপর দশ দিনের দিন সে প্রাসাদে ফিরে ঘুমোয়। গোট প্রাসাদই ঘুমিয়ে পড়ে তখন।
“সে যখন ঘুমোবে তখন এক লাফে প্রাসাদের দেয়াল টপকাবি। সাবধান দেয়ালের মাথার কাঁটাতারে যেন হাত না ঠেকে। তাহলেই সারা রাজ্য জেনে যাবে প্রাসাদে চোর ঢুকেছে। প্রাসাদে ঢুকে সটান রাজকন্যার ঘরে যাবি। আস্তে আস্তে দরজা খুলে পা টিপে টিপে ভেতরে গিয়ে তার বালিশের তলা থেকে জলের কৌটো বের করে নিবি। জল নিয়েই সোজা পালিয়ে আসবি কিন্তু। রাজকন্যার মুখের দিকে খবরদার তাকাস না। সে মুখ এমন সুন্দর যে চোখে ধাঁধা লেগে গিয়ে ধরা পড়ে যাবি।”
তাই হল। সীমানার ধারে বিষ লতা জ্বলল, রাক্ষস ঘুমোল, তার মুণ্ডু কাটা হল। বল গড়াল, ইভান তার পিছুপিছু রওনাও হল। বেশ অনেকদূর গিয়ে যখন রাজপ্রাসাদের একেবারে কাছাকাছি পৌছেছে, ঠিক তখন দেখা গেল সেখান থেকে একদল সৈন্য বেরিয়ে অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে ইভানের দিকেই তেড়ে আসছে। বলটা অমনি রাস্তা ছেড়ে পাশের একটা গলিতে গিয়ে ঢুকল। ইভানও চলল তার পেছনপেছন। খানিকদূর গিয়ে একটা ঘাসজমিতে ঘোড়াটাকে চরবার জন্য ছেড়ে দিয়ে ইভান যেই না প্রাসাদের দিকে তাকিয়েছে, দেখে রাজকন্যা রূপমতী সৈন্যদলের সামনে ঘোড়ায় চড়ে রাস্তা ছেড়ে সেই ঘাসজমির দিকেই আসছে। তার সৈন্যদলের সবাই মেয়ে।
ঘাসজমিতে পৌঁছে তারা তাঁবু খাটিয়ে আস্তানা গেড়ে খেলায় মাতল। তাদের হাসি, গানের শব্দে বন ভরপুর। ইভানের কিন্তু তখন সব ছেড়ে রূপমতীর দিকেই চোখ। মেয়েরা সব্বাই সেরা সুন্দরী, কিন্তু রূপমতীর মত সুন্দর মানুষ ইভান কখনো দেখেনি। একবার তাকালে চোখ ফেরে না।
দশ দিনের দিন খেলাধুলো সেরে তাঁবু গুটিয়ে ফিরে গিয়ে তারা সবাই যখন ঘুমিয়েছে, ইভান তখন চুপিচুপি গিয়ে ঘোড়ার পিঠে বসে একলাফে পাঁচিল টপকে গিয়ে ঢুকল প্রাসাদের বাগানে। তারপর ঘোড়াটাকে একটা খুঁটিতে বেঁধে রেখে রাজকন্যার ঘরে গিয়ে ঢুকল চুপিচুপি। সেখানে সোনার পালঙ্কে রাজকন্যা রূপমতী ঘুমোয়। তার মাথার এলোচুল ছড়িয়ে আছে চারপাশে। তার মাঝখানে পদ্মফুলের মত সুন্দর মুখটা ফুটে আছে। সাবধানে তার বালিশের তলা থেকে নবজীবনের জলের কৌটোটা বের করে নিয়ে ঘর ছেড়ে বেরোতে গিয়ে ইভানের কী যে হয়ে গেল, সব সাবধানতা ভুলে সে ফিরে এল রাজকন্যার কাছে। তারপর রাজকন্যাকে তিনবার চুমু খেয়ে সে একছুটে বের হয়ে গিয়ে হাওয়ার চেয়েও আগে ছুটিয়ে দিল তার ঘোড়াকে।
ওদিকে রজকন্যাও ইভানের ছোঁয়া পেয়ে জেগে উঠেছে। বালিশের তলা থেকে জলের কৌটো চুরি গেছে টের পেয়ে সে ছুটে বের হয়ে এল। তারপর তার সবচেয়ে তেজি ঘোড়াটার পিঠে চেপে দড়বড়িয়ে ধাওয়া করল ইভানকে। তার চোখে আগুন, হাতে খোলা তলোয়ার।
ছুটতে ছুটতে হঠাৎ পেছনে ক্ষুরের শব্দ পেয়ে ইভান পিছু ফিরে দেখে রাজকন্যার ঘোড়া তাকে ধরে ফেলল বলে। তখন সে নিজের ঘোড়ার পিঠে চাবুক কষাতে ঘোড়া মানুষের গলায় বলল, “আমায় মেরে লাভ নেই ইভান। রূপমতীর ঘোড়ার চেয়ে আগে ছুটতে পারে এমন ঘোড়া পৃথিবীতে নেই। তার পায়ের দাপে জগত কাঁপে। এক লাফে গোটা নদী পেরিয়ে যায় সে। তার ক্ষুরের নিচে পাহাড় পর্বত বিদ্যুতের মত মিলিয়ে যায়।”
ঘোড়ার কথা শেষ হতে না হতে রূপমতীর ঘোড়া এসে তার সামনে পৌঁছেছে। ঝলসে উঠেছে রূপমতীর তলোয়ার। সটান এসে বিঁধে গেছে ইভানের বুকে। বুকে তলোয়ার নিয়ে ঘোড়ার পিঠ থেকে মাটির বুকে আছড়ে পড়ল রাজপুত্র ইভান। তার বুকের রক্তে তখন মাটি ভিজে উঠেছে।
তার যন্ত্রণায় ভরা চোখদুটোর দিকে তাকিয়ে হঠাৎ রাজকন্যার মুখটা কালো হয়ে গেল। কী সুন্দর এক রাজপুত্র! সে তাকে চুমু খেয়েছিল। তাহলে রূপমতী কেমন করে তার বুকে তলোয়ার গেঁথে দিতে পারল?
তাড়াতাড়ি ঘোড়া থেকে নেমে এসে ইভানের বুকে হাত রাখল রূপমতি। তারপর চুরি যাওয়া নবজীবনের জলের কৌটো ইভানের ঘোড়ার জিন থেকে বের করে এনে তার বুকের তলোয়ারের ক্ষতে ছড়িয়ে দিতেই, মিলিয়ে গেল তলোয়ারের দাগ। ইভান চোখ খুলে উঠে বসল, যেন কিছুই হয়নি তার।
“আমায় বিয়ে করবে রাজপুত্র?” রূপমতীর চোখে চিকমিক করছিল হাসি।
“করব।”
“বেশ। তাহলে ফিরে যাও তোমার দেশে। তিন বছর অপেক্ষা করবে তুমি। তারপরেও আমায় যদি তোমার মনে থাকে তাহলে ফিরে এসে আমার রাজ্যে। আমি অপেক্ষা করব তোমার জন্য।”
তারপর দুটো ঘোড়া তাদের সওয়ারদের নিয়ে দুটো রাস্তা ধরে যার যার দেশে ফিরে গেল। অনেক নদী পাহাড়পর্বত পেরিয়ে ইভান যখন তার দেশের কাছে এল, তখন দেখে সেখানে পাহাড়ের ধারে এক মাঠের ওপর দুটো তাঁবু গেড়ে তার দুই দাদা বসে আছে।
“কী রে ইভান, নবজীবনের জলের খোঁজ পেলি?” ইভানকে আসতে দেখে দাদারা জিজ্ঞাসা করল। ইভান তো ভারী ভালো ছেলে। তাই সে দাদাদের সব কথা বলে দিল। শুনে দাদারা করল কী, রাতের বেলা খেয়েদেয়ে ইভান যখন ঘুমোচ্ছে, তখন তার কাছ থেকে সেই জলের কৌটো চুরি করে নিয়ে তাকে ছুঁড়ে ফেলল একটা গভীর খাদের ভেতর।
খাদের ভেতর পড়তে পড়তে পড়তে—ইভান শেষে হাজির হল একেবারে পাতালপুরীতে। সে তখন কপাল চাপড়ায় আর বলে, “সব শেষ। আর কখনো এখান থেকে আমি ফিরতে পারব না। হায় হায়—”
পাতালপুরীর ভেতর ঘুরতে ঘুরতে ইভান দেখে ক্রমেই দিনগুলো ছোটো হয়ে আসছে। অবশেষে সে এমন এক জায়গায় এসে পৌঁছোল যেখানে শুধুই রাত। সেখানে সমুদ্রের ধারে একটা দুর্গ, যেটা আসলে একটা গোটা শহর, আর একটা কুঁড়েঘর যেটা আসলে একটা প্রাসাদ।
ইভান সেই কুঁড়েঘরের সামনে গিয়ে বলল, “আমায় একটু থাকতে দেবে?”
ঘরের ভেতরে এক বুড়ি বসে ছিল। একেবারে থুত্থুরি বুড়ি সে। ইভানকে দেখে বলে, “সে তুমি নয় আমার ঘরে খেলে ঘুমোলে! কিন্তু কথা হল, এই পাতালপুরীতে তুমি এলে কেমন করে?”
“আগে আমায় কিছু খেতে দাও বুড়িমা, তারপর একটু ঘুমোতে দাও, তারপর সব বলছি।” ইভান জবাব দিল।
শুনে বুড়ি তাড়াতাড়ি ইভানের সামনে খানিক খাবার ধরে দিল। তারপর বিছানা পেতে দিল তার ঘুমোবার জন্য। অবশেষে তার ঘুম ভাঙলে সে ফের জিজ্ঞাসা করল, “এখানে তুমি এলে কেমন করে?”
ইভান বলল, “আমি রাজা আফ্রনের ছেলে। রূপমতীর প্রাসাদে গিয়েছিলাম তার অতিথি হয়ে। দেশে ফেরার পথে পথ হারিয়ে এইখানে এসে পৌঁছেছি। তুমি কী আমায় আমার দেশের রাস্তা বলে দেবে?”
“সে আমি জানি না। এইখানে জীবনের প্রায় সবটাই কাটিয়ে দিলাম, কিন্তু আফ্রন নামে কোন রাজার নামই তো শুনিনি বাপু,” বুড়ি জবাব দিল, “আজকের দিনটা এখানেই বিশ্রাম করে নাও, কাল আমি আমার দূতদের খবর দেব’খন। তাদের কেউ যদি তোমার দেশের খবর দিতে পারে!”
পরদিন সকালে স্নানটান সেরে ইভান বারান্দায় বুড়ির কাছে যেতে বুড়ি আকাশের দিকে মুখ করে চড়া গলায় হাঁক দিয়ে উঠল, “জলের যত মাছ, মাটির তলায় গর্তে যত সাপ, বনের যত জন্তু, আকাশের যত পাখি সবাই এস আমার কাছে।”
অমনি কুঁড়ের পাশের সমুদ্রে এসে জড়ো হল সাগরজোড়া মাছের দল, আর সাগরের পাড় ভরে উঠল হাজারো জীবজন্তু আর সাপের ভিড়ে।
“তোমরা কি কেউ রাজা আফ্রনের নাম শুনেছ?”
অমনি তারা সবাই একসঙ্গে মাথা নাড়ল, “অমন নাম আমরা কক্ষণো শুনিনি। কোথায় তার দেশ আমরা কেউ জানি না।”
“নাঃ রাজপুত্র। সবাইকেই তো জিজ্ঞাসা করলাম। কেউ কিছু জানে না।” এই বলে মাথা নাড়তে নাড়তে বুড়ি ঘরের ভেতর ঢুকতে যাবে ঠিক তক্ষুণি বাতাসে ডানার সাঁইসাঁই শব্দ তুলে উড়ে এল বিরাট বড়ো মোগল পাখি।
“তুমি এত দেরিতে এলে যে? আমি ডেকেছি শুনতে পাওনি?” বুড়ি রেগে উঠে তাকে বলল।
“অনেক দূর থেকে আসছি যে মা,” মোগল জবাব দিল, “ডাক আমি ঠিকই শুনেছি। কিন্তু আমি গিয়েছিলাম সে-ই রাজা আফ্রনের দেশে। সে একেবারে পৃথিবীর অন্যপাড়ে। তাই দেরি হয়ে গেল।”
অমনি বুড়ির মুখে হাসি ফুটল, “আহা বেশ বেশ। এই খবরটাই তো জানতে চাইছিলাম সবার কাছে এতক্ষণ। এখন যাও তো, এই রাজপুত্র ইভানকে আফ্রনের দেশে পৌঁছে দিয়ে এস।”
“আগে পেট ভরে খাবার দাও। তারপর যেতে পারি,” মোগল পাখি জবাব দিল, “সে বেজায় দূরের পথ। তিনতিনটে বছর লাগবে উড়ে উড়ে সেইখানে পৌঁছোতে।”
বুড়ি তখন মোগলকে ভালো করে খাওয়াল প্রথমে। তারপর তার পিঠে একঝুড়ি মাংসের পিঠে, বেশ খানিক জল আর একটা লম্বা লোহার লাঠি রেখে ইভানকে বলল, “উড়তে উড়তে যখনই মোগল তোমার দিকে ফিরে চাইবে, এই লাঠিতে গেঁথে একটা মাংসের পিঠে তার মুখে গুঁজে দেবে।”
“তুমি খুব ভালো, বুড়িমা,” এই বলে একগাল হেসে ইভান মোগলের পিঠে চড়ে বসল। মোগলও অমনি তার বিরাট দুটো ডানা মেলে বাতাসে ভেসে উঠে ঝড়ের মত ধেয়ে গেল আফ্রনের দেশের দিকে।
মোগল যায় আর খায়, খায় আর যায়—তারপর একদিন ইভান দেখল পিঠের ঝুড়ি খালি হয়ে আসছে। সে তখন মোগলকে ডেকে বলল, “তোমার খাবার প্রায় শেষ। একবার মাটিতে নামলে আমি ফের ঝুড়িভরা খাবার জোগাড় করে নিতে পারি।”
“পাগল নাকি?” পাখি জবাব দিল, “আমাদের পায়ের নিচে ঘন জঙ্গল। অন্ধকার। সেখানে কোন খাবার মিলবে না।” এই বলে সে আরো জোরে জোরে ডানা ঝাপটে উড়ে চলল।
তারপর উড়তে উড়তে একদিন খাবার যখন সব শেষ, তখন ফের মোগল মুখ ঘুরিয়ে চাইল ইভানের ইকে। ইভান তখন কী আর করে? নিজের পায়ের পাতাদুটো কেটে লাঠির আগায় গেঁথে সে মোগলের মুখের কাছে বাড়িয়ে ধরল। পাখি সেগুলোকে গিলে ফেলে উড়তে উড়তে অবশেষে আফ্রনের রাজ্যের এক মাঠের ভেতর এসে নামল তাকে নিয়ে। নেমে এসেই পাখি ইভানের পায়ের পাতাদুটো উগরে দিয়ে সেগুলো ইভানের পায়ে জুড়ে দিয়ে তাতে একটু থুতু দিতেই পাতাগুলো জুড়ে গেল ফের।
রাজ্যে পৌঁছে ইভান দেখে সেখানে ভারী হইচই বেধেছে। সেনারা কুচ করছে। লোকজন ভয়ে এদিকসেদিক ছুটছে। একটা লোককে ডেকে কী হয়েছে জিজ্ঞাসা করতে সে ইভানকে বলল, “সর্বনাশ হয়েছে। রূপমতী রাজকন্যা আমাদের দেশে হানা দিতে এসেছে সমুদ্র বেয়ে। বন্দরে তার চল্লিশটা যুদ্ধজাহাজ ভর্তি লক্ষ সেনার দল। তার দাবি, একদিন তাকে ঘুমের মধ্যে চুমু খেয়েছিল যে রাজপুত্র ইভান তাকে তুলে দিতে হবে তার হাতে। নইলে আমাদের গোটা দেশ জ্বালিয়েপুড়িয়ে ধ্বংস করে দিয়ে যাবে সে।”
“হুম। ঠিক সময়েই এসেছি তাহলে,” ইভান মুচকি হাসল, “তিন বছর অনেকদিন হল পেরিয়ে গেছে যে! আমিও তো তার কাছেই যেতে চাই এখন!” এই বলে তাড়াতাড়ি বন্দরে পৌঁছে সটান রূপমতীর জাহাজে গিয়ে উঠল ইভান। তারপর গির্জায় গিয়ে বিয়ে সেরে দুজন মিলে হাত ধরাধরি করে আফ্রনের দরবারে গিয়ে সব কথা খুলে বলল। আফ্রন তখন রেগে আগুন হয়ে দুই বড়ো রাজপুত্রকে দূরদূর করে তাড়িয়ে দিলেন। তারপর ইভান আর রূপমতীকে নিয়ে সুখেশান্তিতে ঘর করতে লাগলেন রাজা আফ্রন।
নবজীবনের জলের কৌটোর কথা আর তাঁর মনেই ছিল না।
darun
LikeLike
darun
LikeLike