বিদেশী গল্প রাশিয়ান-রাজপুত্র আর উড়ুক্কু নেকড়ের গল্প দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য বর্ষা ২০১৮

জয়ঢাকের সমস্ত রাশিয়ান গল্প

রাজপুত্র আর উড়ুক্কু নেকড়ের গল্প

অনুবাদঃ দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য

অনেক দিন আগে, অনেক দূরের এক দেশে রাজত্ব করত এক জার। তার নাম এলিডারোভিচ। তার মিলিটিসা ইব্রাহিমোভনা ছিল তার জারিনা। তাদের তিন ছেলে। বড়ো আক্‌সফ জারেভিচ, মেজো হুট জারেভিচ আর ছোটো ল্যুবিম জারেভিচ।

আক্‌সফের বিশ বছর বয়স হতে সে বলল, “আমি এবার দুনিয়া দেখতে যাব বাবা। আর যাব আমার জন্য সুন্দরী রাজকন্যা খুঁজতে।”

জার আর কী বলে? আশীর্বাদ করে বলল, “যাও।”

তার কিছুদিন বাদে হুট এসে ফের একই কথা বলল। তাকেও হাসিমুখেই বিদায় দিল জার আর জারিনা।

তারপর তো অনেকদিন কেটে গেল। বিশাল দুনিয়ার কোথায় যে হারিয়ে গেল আক্‌সফ আর হুট তা কে জানে। সবাই ধরে নিল তারা মরে গেছে।

ছেলেদের শোকে জার আর জারিনার তো কেঁদে কেঁদে অন্ধ হবার জোগাড়। এমনিসময় একদিন ছোটো ছেলে ল্যুবিম এসে সেই একই আবদার করলে তার বাবা মা বলল, “তুই যে আমাদের শেষ সম্বল বাবা! তুই হারিয়ে গেলে বুড়োবয়সে আমাদের দেখবে কে? এই রাজ্যপাটই বা কাকে দিয়ে যাব বল?”

শুনে ল্যুবিম দৃঢ় গলায় বলল, “দুনিয়াটাকে যদি না দেখি তাহলে ভালো রাজা হব কী করে বলো? তোমার মুখ উজ্জ্বল করতে হবে তো!? তাছাড়া দাদাদের খুঁজে বের করাওতো দরকার!”

শুনে জার-জারিনার খুব সুখ হল। তারা বলল, “বেশ। তাই হোক। তবে শর্ত আছে। বেশিদিনের জন্যে যেতে পারবে না। পথে অচেনা লোকের সঙ্গ নেবে না আর বিপদের ঝুঁকি একেবারে নেবে না। বলো, রাজি?”

“রাজি,” মাথা নাড়ল ল্যুবিম। তারপর বাবামায়ের আশীর্বাদ নিয়ে সে-ও একবস্ত্রে নেমে পড়ল পৃথিবীর পথে।

পথে বেরিয়ে ল্যুবিমের খেয়াল হল ও হরি , তাড়াহুড়োয় সে না এনেছে ভালো একটা ঘোড়া, না এনেছে বর্মচর্ম। এবার তবে দুনিয়া দেখতে সে যায় কেমন করে?

এই ভাবতে ভাবতে রাস্তায় চলেছে সে তখন তার সঙ্গে এক বুড়ির দেখা।

“হ্যাঁ রে ল্যুবিম, মুখটা অমন শুকনো কেন রে?” বুড়ি বলল তাকে ডেকে। ল্যুবিম প্রথমে তার কোন জবাব না দিয়ে হেটে হেঁটে চলে যাচ্ছিল। তবে খানিক দূর গিয়ে তার মনে হল, বুড়ো মানুষদের মাথায় তো অনেক বেশি বুদ্ধি খেলে। দুনিয়াটাকে অনেক বেশিদিন দেখেছে কি না! যাই গিয়ে বুড়িকে আমার দুঃখের কথাটা বলেই দেখি। যদি তাতে কাজ কিছু হয়!

তাড়াতাড়ি ফিরে গিয়ে ল্যুবিম বুড়ির সঙ্গ ধরল ফের। বলে, “বুঝলে ঠাকুমা, ভেবেছিলাম তোমায় দুঃখের কথা বলে আর লাভ কী? তারপর ভাবলাম, বুড়োমানুষদের দুনিয়াদারির জ্ঞান আমাদের চাইতে বেশি। তাই—”

“হুঁ হুঁ। বুড়োমানুষও অনেক কাজে আসে রে দাদুভাই,” বুড়ি হেসে হেসে মাথা নাড়ল। তারপর বলল, “এবার বল, কীসের এত চিন্তা তোর।”

“আমি যাচ্ছি দুনিয়া দেখতে আর দাদাদের খুঁজতে। কিন্তু মশকিল হল, আমার না আছে ঘোড়া না আছে বর্মচর্ম। তাহলে এতবড়ো দুনিয়াটা খুঁজি কেমন করে?”

“এই কথা?” বুড়ি মিটমিট করে হাসল, “শোন, তোর বাবার যে রাজবাগিচা আছে, সেখানে একটা দারুণ ঘোড়া রাখা আছে। আছে দুর্দান্ত শক্তপোক্ত এক বর্ম আর একটা ইয়া চওড়া তলোয়ার। তবে মুশকিল হল, সেখানে ঢুকতে গেলে বারোটা দরজা পেরোতে হবে। আর ঘোড়া বাঁধা আছে বারোটা শিকলি দিয়ে। সে বাঁধন না খুললে ঘোড়া পাবি না।”

শুনে ল্যুবিমের খুশি দেখে কে! বুড়িকে অনেক ধন্যবাদটাদ দিয়ে সে ছুটল রাজার বাগানের খোঁজে। সামনে তার আকাশে মাথা ছুঁইয়ে দাঁড়িয়ে আছে বিরাট এক নম্বর দরজা। দরজার গায়ে দৈত্যের মত ধাক্কা দিল সে। মড়মড় করে উঠল তার কাঠ। তারপর বারবার ল্যুবিমের ধাক্কা খেয়ে শেষমেষ দরজা পড়ল ভেঙে।

বারোদরজার আড়ালে রাজার ঘোড়া সেই শব্দ পেয়ে ডাক ছাড়ল চিঁহিহি। তারপর শরীরের পেশি ফুলিয়ে কেশর উঁচিয়ে হ্যাঁচকা টানে ছিঁড়ে ফেলল বারো শিকলের বাঁধন। তারপর তো সে সাংঘাতিক কাণ্ড। একদিক থেকে ল্যুবিম একটার পর একটা দরজা ভাঙছে আর অন্যদিক থেকে একটার পর একটা দরজা ভাঙছে ঘোড়া।

খানিকক্ষণের মধ্যে বারো দরজার বাধা শেষ। বাগানে ঢুকে ঘোড়াকে আদর করল ল্যুবিম। তারপর বর্মচর্ম তলোয়ারে সেজে ঘোড়াকে মাঠে বেঁধে রেখে চলল বাবা-মার সঙ্গে দেখা করতে। তারপর মা-বাপের আশীর্বাদ নিয়ে ঘোড়ার পিঠে চেপে ল্যুবিম চলল দুনিয়া দেখতে।

চলতে চলতে চলতে ল্যুবিম এসে পৌঁছোল এক তিনমাথার মোড়ে। মোড়ের মাঝখানে একটা পিলার। তার গায়ে তিন রাস্তার মুখে তিন খোদাই করা লেখা আছে, ডাইনে গেলে ঘোড়সওয়ারের খাবার মিলবে কিন্তু ঘোড়া না খেয়ে মরবে। সিধে গেলে ঘোড়া বাঁচবে, না খেয়ে মরবে ঘোড়সওয়ার। আর বাঁয়ে গেলে উড়ুক্কু নেকড়ের থাবায় প্রাণ যাবে।

দেখে অনেক ভেবে ল্যুবিম বাঁ-দিকের রাস্তায় যাবে বলে ঠিক করল। উড়ুক্কু নেকড়েকে মেরে ও-পথের বিপদ ঘোচাবে সে এই তার ইচ্ছে।

বাঁয়ের পথে যেতে যেতে যেতে অবশেষে সে এসে পৌঁছোল এক বিরাট মাঠের ধারে। সেইখানে তাঁবু খাটিয়ে সবে ঘুমোতে যাবার তোড়জোর করছে তখন সে দেখে বেজায় হাঁকডাক ছেড়ে পশ্চিমের আকাশ বেয়ে উড়ে আসছে উড়ুক্কু নেকড়ে। ওমনি ফের ছেড়েফেলা বর্ম গায়ে চাপাল ল্যুবিম। তারপর চওড়া তলোয়ারটা টেনে নিয়ে লাফ দিয়ে চেপে বসল তার ঘোড়ার পিঠে।

ছুটোন্ত ঘড়ার দিকে উড়ে এল নেকড়ে। তারপর ডানা দিয়ে  মারল এক বিরাট ঝাপটা ল্যুবিমের গায়ে। থরথরিয়ে কেঁপে উঠল ল্যুবিম, কিন্তু ঘোড়ার পিঠ ছাড়ল না সে। লাগাম ধরে সামলে নিল। আরপর তলোয়ার উঁচিয়ে নেকড়ের ডাইনের ডানায় এমন ঘা দিল যে সে আকাশ থেকে মাটিতে পড়ে ছটফট করে অস্থির। আর উড়তেই পারে না ডানার ব্যথায়।

খানিক বাদে নেকড়ে একটু ঠাণ্ডা হয়ে মানুষের গলায় বলে, “আমায় প্রাণে মেরো না রাজপুত্তুর। আমি তোমার গোলাম হয়ে থাকব। যা বলবে তাই করব।“

“বেশ। তাহলে বলে দাও দেখি আমার দাদারা কোথায় আছে?”

“তারা অনেকদিন হল আরা গেছে গো। তবে কিনা, রূপবতী রাজকন্যাকে যদি আমরা জয় করতে পারি তাহলে তাদের প্রাণ আবার ফিরিয়ে দেয়া যাবে।“

“কিন্তু—সে কেমন করে হয়?”

“হয় হয়। আগে তোমার ঘোড়াটাকে এইখানে রাখ। তারপর চলো—“

“ঘোড়া রেখে দিলে যাব কেমন করে শুনি?”

“বলছি। যে পথে , সে কাজ করতে যাব তা তোমার ঘোড়ার সাধ্য নেই। আমি জাদু জানি। আমি সাজব তোমার ঘোড়া। রাজকন্যার দেশের সীমানায় মস্ত দেয়াল। তার  গায়ে গায়ে অনেক সুতো জড়ানো। সুতোর সঙ্গে ঘন্টা বাঁধা।  পাঁচিল  বাইতে গেলেই সুতোয় ছোঁয়া লেগে ঘন্টা বেজে উঠবে। তখন  তোমায় কেউ বাঁচাতে পারবে না। ও পাঁচিল পেরোতে হবে একটি লাফে। এমনি ঘোড়ার সাধ্য কি তেমন লাফ দেয়!“

ল্যুবিম দেখল কথাটা ভুল নয়। জাদু ঘোড়া ছাড়া অমন কাজ করা যাবেই না। তখন তার ঘোড়কে সেইখানেই বেঁধে রেখে সে নেকড়েকে বলল, “চল তাহলে।“

তারপর তো তারা যায় যায় যায়। শেষে একদিন দূরে দেখা দিল রাজকন্যার দেশের সফেদ পাথরের দেয়াল। দেয়াল দেখেই তো ল্যুবিমের বুক কাঁপতে লেগেছে। বলে, “ওরে বাবা! অত উঁচু পাঁচিল এক লাফে কেউ পেরোতে পারে নাকি?”

নেকড়ে ঘোড়া হেসে বলল, “ও আমার কছে নস্যি। কিন্তু আসল বিপদ আসবে ওর পরে। রাজকন্যাকে তুমি পছন্দ করে ফেলবে যখন তখন হবে আসল বিপদ। তখন তার রূপের ফাঁদ থেকে বেঁচে বেরোতে পারলে তোমায় জীবনের জলে স্নান করতে হবে জেনে রাখো। স্নান করে তোমার দাদাদের জন্য সেই জলের খানিক সঙ্গে করে নিতে হবে। নিতে হবে খানিক মরণ জলও।“

তারপর তো তারা ভারী সহজেই বিরাট এক লাফে পেরিয়ে গেল সফেদ দেয়াল। কোন ঘন্টা বাজল না। কাকপক্ষিতেও টের পেল না। ল্যুবিম গিয়ে ঢুকল রাজকন্যার দরবারে। প্রথম মহলে গিয়ে দেখে সেখানে ঘরে ঘরে সুন্দরী মেয়েরা সব ঘুমিয়ে কাদা। কিন্তু রাজকন্যা সেখানে নেই। দ্বিতীয় মহলে গিয়ে দেখে সেখানেও দলে দলে রাজকন্যার সহচরীরা ঘুমিয়ে কাদা। কিন্তু রাজকন্যা সেখানেও নেই। তারপর তিন নম্বর মহলে গিয়ে দেখে সেখানে সোনার পালঙ্কে সোনার বরণ রাজকন্যা একলাটি ঘুমিয়ে কাদা। তার টুলটুলে মুখটির দিকে তাকিয়েই রাজপুত্র তো তাকে বেজায় ভালোবেসে ফেলল। কাছে গিয়ে তার গালে এঁকে দিল একটা চুমু।

তারপর তার দিকে চোখ রেখে অনেকক্ষণ সেখানে দাঁড়িয়ে থেকে, নেকড়ের সাবধানবাণী মনে হতে গা ঝারা দিয়ে উঠে চলল রাজকন্যার বাগান থেকে খানিক খানি জীবন জল আর মরণ জল আনতে।

তারপর জীবন জলে স্নান সেরে দুই ভিশতি ভরা জীবন জল আর মরণ জল নিয়ে সে নেকড়ে ঘোড়াকে বলল, “চল এবার ফিরে যাই।“

তখন নেকড়ে মাথা নেড়ে বলল, “ভিশতিগুলো যা ভারী তাতে অতসব নিয়ে কিন্তু আমি আর এক লাফে পাঁচিল পেরোতে পারব না।“

“তাহলে উপায়?”

নেকড়ে হেসে বলল, “সেইজন্যই তো জীবন জলে স্নান করতে বলেছি তোমায়। তোমায় আর কেউ মারতেই পারবে না। পাঁচিল পেরোতে গিয়ে তার গায়ে ধাক্কা খেলে সব্বাই জেগে গিয়ে তোমায় ধাওয়া করবে তা ঠিক, কিন্তু তুমি তাদের ঠিক কাবু করে ফেলবে দেখো। তাদের মেরে, তাদের সবচেয়ে বড়ো সাদা ঘোড়াটার পিঠে চড়বে। আমি তোমায় লড়তে সাহায্য করব। তারপর তাঁবুতে পৌঁছে  তুমি উঠবে তোমার ঘোড়ায় আর আমি নেব সাদা ঘোড়াটা। আর তারপর দেখবে রাজকন্যা ছটে ছুটে আসবে তোমার কাছে। বলবে সে তোমায় বিয়ে করতে চায়। বলবে সে তোমায় ভারী ভালোবাসবে সারা জীবন।“

তারপর তো নেকড়ে ঘোড়া মারল এক লাফ। কিন্তু পাঁচিল না পেরিয়ে সে গিয়ে ধাক্কা খেল পাঁচিলের গায়ে। তখন সুতোয় পড়ল টান, বেজে উঠল ঘন্টা, জেগে উঠল গোটা প্রাসাদ। তিন নম্বর মহলে সোনার খাটে আড়মোড়া ভেঙে জেগে উঠল রাজকন্যা। তারপর পদ্মপলাশের মত চোখ খুলে চারদিকে তাকিয়েই বুঝতে পারল ঘরে তার  এসেছিল কোন ভিনদেশী মানুষ। তখন সে তার নাইটদের ডাকল। নাইটরা এসে সব শুনে গোঁফ মুচড়ে, তলোয়ার পাকড়ে বলল, “কিচ্ছু ভেবো না রাজকুমারী। আমরা চললাম ডাকাতের খোঁজে। হাজার পাইকের মধ্যে লুকিয়ে থাকলেও আমরা তার মুণ্ডু এনে তোমার হাতে তুলে দেবই দেব।“

তখন নাইটদের রওনা করে দিয়ে রাজকন্যা গিয়ে উঠল প্রাসাদের অলিন্দে। সেখান থেকে সে চেয়ে চেয়ে দেখে তার নাইটোরা কেমন চলেছে ছুটে চলা ডাকাতটাকে হরতে, তাকিয়ে তাকিয়ে দেখে সেই ভিনদেশী ডাকাতকে, যে নাকি তার ঘরে এসে ঘুমের মধ্যে তাকে চুমো খাবার সাহস করেছিল।

ল্যুবিম ততক্ষণে তার নেকড়ে ঘোড়ার পিঠে চেপে অনেক দূরে চলে গিয়েছিল। কিন্তু নাইটদের ঘোড়ারা হাওয়ার মত ছুটে তাদের ধরে ফেলল এক নিমেষে। তারপর তো রাজপুত্রের তলোয়ার আর তার নেকড়ে ঘোড়ার জাদুর ক্ষুরের ঘায়ে সব নাইটরা চিৎপাত। তখন ল্যুবম দেখে, শুধু একজন নাইট বেঁচে। প্রকাণ্ড এক সাদা ঘড়ায় চেপে সে তাদ্র দিকে ধেয়ে আসছিল। কিন্তু ল্যুবিমের সঙ্গে সে পারবে কেন। তলোয়ারের এক কোপে তাকে দু-টুকরো করে ফেলে সে লাফ দিয়ে উঠে বসল সেই সাদা ঘোড়ার পিঠে। তারপর হাওয়ার মত ছুটে দেখতে দেখতে পৌঁছে গেল তাদের তাঁবুর কাছে।

ওদিকে রাজকন্যা অলিন্দ থেকে তার নাইটদের দশা দেখে করল কী, আরো বড়ো এক নাইটের দলকে পাঠিয়ে দিল রাজপুত্রকে জব্দ করতে। তারপর ফের অলিন্দে এসে দাঁড়াল কী হয় দেখতে।

কিন্তু ততক্ষণে তাঁবুর কাছে পৌঁছে রাজপুত্র নিজের ঘোড়ায় চেপেছে, আর নেকড়ে রূপ বদলে হয়ে গেছে এক জাঁদরেল লড়াকু জোয়ান। নাইটদের ধুলো উড়িয়ে ছুটে আসতে দেখে জাঁদরেল জোয়ান চেপে বসল সাদা ঘোড়ার পিঠে। তারপর কালবোশেখির ঝড়ের মত নাইটদের ডাইনে বাঁয়ে ধেয়ে গেল তারা দুজন।

যুদ্ধ চলল কতক্ষণ কে তার হিসেব রাখে। শুধু সব থেমে গেলে দেখা গেল গায়ে রক্ত মেখে সেখানে দাঁড়িয়ে আছে শুধু দুজন। রাজপুত্র ল্যুবিম আর তার জাঁদরেল জয়ান সাথী সেই জাদুকর নেকড়ে।

খানিক বাদে মানুষবেশী নেকড়ে বলল, “ওই দেখ, রাজকন্যা আসছে তোমার কাছ। এইবার সে তোমায় আর কোন কষ্ট দেবে না। আর ভয় নেই। এবার তবে আমায় ছুটি দাও ল্যুবিম, আমি আমার দেশে ফিরে যাই।“

শুনে ল্যুবিম হাসিমুখে তাকে ছুটি দিতেই সে অদৃশ্য হয়ে গেল। তারপর তো রাজকন্যা এসে বলল, “আমায় তোমার সঙ্গে নিয়ে চলো রাজপুত্র। ল্যুবিম হাসিমুখে বলল, “চলো।“

তারপর তারা খানিক খেয়েদেয়ে ঘুমিয়ে ঘোড়ায় চেপে চলল রাজপুত্রের দেশের দিকে। পথে যেতে যেতে রাজপুত্র বলে, “রাজকন্যা শোনো। এইখানেই কাছাকাছি কোথাও আমার দুই ভাই মরে রয়েছে। তাদের বাঁচাবার জন্য আমি জীবনের আর মরণের জল নিয়ে এসেছি তোমার বাগান থেকে। এইবার তাদের শরীর খুঁজে বের করে বাঁচিয়ে তুললেই আমার কাজ শেষ। তুমি ততক্ষণ খানিক এগিয়ে যাও। এগিয়ে গিয়ে যে তেমাথার মোড় পাবে সেখানে আছে এক পিলার। তার তলায় আমার জন্য অপেক্ষা কোরো।“

তারপর রাজকন্যাকে রওনা করিয়ে দিয়ে ল্যুবিম চলল তার দাদাদের শরীরের খোঁজে। খুঁজতে হুঁজতে অবশেষে এক ঝোপের ভেতর দাদাদের কঙ্কাল খুঁজে পেয়ে তাদের গায়ে সঙ্গে আনা মরণ জল ছিটিয়ে দিতেই কঙ্কালের মাংস লাগল, চামড়া লাগল। তারপর তাদের গায়ে জীবন জল ছিটিয়ে দিতেই তারা ফের প্রাণ ফিরে পেয়ে উঠে বসল, যেন কিচ্ছুটি হয়নি। চোখ খুলে সামনে ল্যুবিমকে দেখে হুট আর আক্‌সফ বলে “আরে ল্যুবিম, তুই এলি কোত্থেকে? আমরা এখানে কতক্ষণ ধরে ঘুমিয়েছি বল দেখি?”

তখন ল্যুবিম তাদের সব গল্প খুলে বলল। রাজকন্যা তেমাথার মোড়ে তার অপেক্ষায় বসে আছে সে-কথাও বলতে ভুলল না।

সেদিন রাত্রে খাওয়াদাওয়্র পর ল্যুবিম ঘুমোলে আক্‌সফ হুটকে ফিসফিসিয়ে বলল,“ এখন ফিরে গিয়ে বাবা-মার কাছে মুখ দেখাব কেমন করে বল দেখি? সবাই মিলে ল্যুবিমের নামে জয়ধ্বনি দেবে সে কি আর আমাদের সইবে? তার চাইতে চল ওকে এইখানেই মেরে পুঁতে দিয়ে যাই।“

যেমন ভাবা তেমনই কাজ । রাতারাই ল্যুবিমকে  টুকরো টুকরো করে কেটে তার শরীরটা তারা ছড়িয়ে দিল চারপাশে। তারপর তেমাথার মোড়ে গিয়ে রাজকন্যাকে বেজায় ভয় দেখিয়ে বশ করে ফেলল।

দুভাই মিলে এবার লটারি করল। তাতে রাজকন্যা পড়ল আক্‌সফের ভাগে আর হুট পেল জীবনমরণের জল।

তারপর তারা সবাই মিলে দেশে ফিরে রাজার বাগানে তাঁবু ফেলল। তারপর রাজবাড়ীতে খবর পাঠাল, রাজপুত্র আক্‌সফ আর রাজপুতে হুট ফিরে এসেছে রূপবতী রাজকন্যা র জীবনমরণের জল নিয়ে।

তারপর তো রাজ্য জুড়ে উৎসব লাগল। কত খাওয়াদাওয়া, কত নাচগান। সেইসবের পালা চুকতে এবার শুরু হল বড়োকুমারের বিয়ের তৈয়ারি। নিমন্ত্রণপত্র গেল দেশের সব রাজা আর নাইটের দরবারে।

ওদিকে সেই যে উড়ুক্কু নেকড়ে, সে কিন্তু ততদিনে জেনে গেছে কী হয়েছে তার বন্ধু ল্যুবিমের। ডানা মেলে সে তখন প্রথমে উড়ে গেছে রাজকন্যার দেশে। তারপর সেখান থেকে জীবনমরণের জল ফের নিয়ে এসে ল্যুবিমকে আবার বাঁচিয়ে তুলেছে সে। তারপর তাকে তার দাদাদের কীর্তির কথা জানিএ, খবর দিয়েছে, “আগামীকাল রাজকন্যার সঙ্গে বড়োকুমারের বিয়ে।“

তখন তো ল্যুবিম রেগে দশখানা হয়েছে। নেকড়ে বন্ধু ফের ঘোড়া হয়ে এসে দাঁড়িয়েছে তার সামনে। তার পিঠে উঠে হাওয়ার আগে সে ছুটেছে তার নিজের দেশের দিকে।

পরদিন রাজধানীতে পৌঁছে ল্যুবিম  প্রথমে গেল এক বাজনার দোকানে। সেখান থেকে সে কিনল একটা সাত তারের গুসলি। তারপর রাজকন্যার বিয়ের মিছিল যে পথ দিয়ে যাবে সেই পথের একধারে গিয়ে দাঁড়াল সে সেই গুসলি হাতে নিয়ে।

তারপর রাজকন্যার মিছিল যখন মন্দিরের পথে চলেছে প্রাসাদ থেকে বের হয়ে, তখন গুসলির তার সুর ছরিয়ে সে গান ধরেছে। সে গান ল্যুবিমের দুঃসাহসী যাত্রার গান, রাজকন্যার ভালোবাসার গান, দাদাদের হাতে তার মৃত্যুর গান আর বন্ধুর ভালোবাসায় তার ফের বেঁচে ওঠবার গান।

গান শুনে রাজকন্যার চোখের জল তো বাঁধ মানে না। চাকরবাকরদের ডেকে বলে, “ কে আমায় এমন গান শোনায়? যাও দেখি, ডেকে আনো তাকে।“

ডাক শুনে ল্যুবিম এসে দাঁড়াল রাজকন্যার সামনে। তাকে দেখে রাজকন্যার খুশি আর বাঁধ মানে না। জুড়িগাড়ির মুখ ঘুরিয়ে তখন রাজকন্যা ল্যুবিমের পাশে বসে গাড়িী ছুটিয়ে দিল ফের রাজপ্রাসাদের দিকে।

তারপর তাদের মুখে আসুল কথা শুনে রাজা রেগে দশখানা হয়ে আক্‌সফ আর হুট-এর মৃত্যুদণ্ড দিলেন। তারপর রাজকন্যাকে বিয়ে করে ল্যুবিম তার বাপ-মাকে নিয়ে চিরকাল সুখে থাকতে লাগল।

জয়ঢাকের গল্প ঘর

1 thought on “বিদেশী গল্প রাশিয়ান-রাজপুত্র আর উড়ুক্কু নেকড়ের গল্প দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য বর্ষা ২০১৮

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Twitter picture

You are commenting using your Twitter account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s