বিদেশী গল্প-ইংরিজি সুমাত্রার দানব ইঁদুর অনুবাদ অমিত দেবনাথ বর্ষা ২০১৯

অমিত দেবনাথ    এর সমস্ত লেখা

১৯২৪ সালে ‘দি স্ট্র্যান্ড ম্যাগাজিন’-এ কোনান ডয়েল রচিত শার্লক হোমসের গল্প ‘দি অ্যাডভেঞ্চার অব দ্য সাসেক্স ভ্যাম্পায়ার’ (The Adventure of the Sussex Vampire) প্রকাশিত হয়। এই গল্পে ‘মাটিল্ডা ব্রিগস’ (Matilda Briggs) নামক একটি জাহাজ এবং তার সঙ্গে সম্পর্কিত ‘সুমাত্রার দানব ইঁদুর’ (Giant rat of Sumatra)-এর উল্লেখ আছে, যেটি শোনার পক্ষে, শার্লক হোমসের মতে, ‘পৃথিবীর মানুষ এখনও প্রস্তুত নয়’। এই সূত্র অবলম্বন করেই আমেরিকা অন্যতম জনপ্রিয় লেখক জন টি. লেসক্রোয়ার্ট (John T. Lescroart)(১৯৪৮-) ‘দি অ্যাডভেঞ্চার অব দ্য জায়ান্ট র‍্যাট অব সুমাত্রা’ (The Adventure of the Giant Rat of Sumatra) প্যাসটিশটি লেখেন, যেটি প্রথম প্রকাশিত হয় ‘মেরি হিগিনস ক্লার্ক মিস্ট্রি ম্যাগাজিন’ (Mary Higgins Clark Mystery Magazine)-এ,১৯৯৭ সালে।

ব্রেকফাস্ট সেরে বসেছিলাম আমরা আমাদের ২২১ বি বেকার স্ট্রিটের বাড়িতে। শার্লক হোমস সকালের কাগজটা পড়ছিল খুব মন দিয়ে, হঠাৎ শুনলাম সে বিড়বিড় করে কি যেন বলছে।

‘কিছু বললে নাকি, হোমস?’ আমি জিজ্ঞেস করলাম।

‘সুমাত্রা’, সে বলল বটে, কিন্তু সেটা যেন নিজেকে শোনানোর জন্যই, ‘বাপস্, মরিয়ার্টির পক্ষেও তো এটা সাংঘাতিক!’

‘হোমস’, আমি অবাক হয়ে বললাম, ‘কি হয়েছে?’

সে কাগজটা নামিয়ে রেখে আমার দিকে তাকাল বটে, কিন্তু আমায় দেখছে বলে মনে হল না। আমি সাবধান হলাম। ব্যাপার বেশ গুরুতর বলে মনে হচ্ছে। আজ পর্যন্ত বহু বাণী বিতরণ করেছে সে আমায়, তার মধ্যে এটা হল- যখন শার্লক হোমস তাকায়, সে দেখে। কিন্তু ১৮৮৮ সালের ডিসেম্বর মাসের কনকনে ঠান্ডা সকালে তার চাহনি দেখে মনে হচ্ছিল সে যেন আমাকে ভেদ করে ঘন কুয়াশার দিকে তাকিয়ে আছে, সারা লন্ডন শহর যে কুয়াশায় ঢাকা।

আমি তার সঙ্গে কথা বলতে চাইছিলাম, কিন্তু সে অধৈর্য্যভরে আমায় হাত নেড়ে থামিয়ে দিল। ‘প্লিজ, ওয়াটসন, বিরক্ত কোরো না। এর মধ্যেই অনেক দেরি হয়ে গেছে।’

তার এই স্বভাবের সঙ্গে আমি অবশ্য পরিচিত, তবুও তার হুল ফোটানো কথাটা শুনে আমিও কিছু বলতে যাচ্ছিলাম, কিন্তু তার আগেই সে উঠে ঘরের কোনায় চলে গেছে। সেখানে কয়লার ঝুড়ির পাশেই পুরোনো লন্ডন সংস্করণের খবরের কাগজ গাদা করে রাখা। দেখলাম খবরের কাগজগুলো আতিপাতি করে হাটকাচ্ছে সে। তারপর দরকারি কাগজগুলো হাতবোঝাই করে নিয়ে ফিরে এল আরামকেদারায়, তুলে নিল পাইপ। পরের পনেরো মিনিট ধূমপানের ফাঁকে ফাঁকে কি সব বলল বিড়বিড় করে, তারপর শিবনেত্র হয়ে বসে রইল।

তার অবস্থা দেখে অবশেষে আমাকে ডাক দিতেই হল। ‘হোমস?’

সে কয়েকটা কাগজ ছুঁড়ে দিল আমার দিকে, ‘নিজেই পড়ে দেখ ওয়াটসন, আমাদের বোধহয় হয়ে এসেছে।’

মেঝে থেকে কাগজগুলো কুড়িয়ে নিয়ে চোখ বোলাতে লাগলাম। দু বছরের পুরোনো কাগজও রয়েছে সেখানে। সত্যি বলছি, কিছুই খুঁজে পেলাম না। তবুও খুঁটিয়ে দেখতে লাগলাম, বিশেষত সেই সব নাম বা কেসের উল্লেখ থাকলে, যেগুলোতে আমি আর হোমস জড়িত। এর মধ্যেই অবশ্য হোমস হাতের কাজ সেরে বেল বাজিয়ে বাড়িওয়ালি মিসেস হাডসনকে ডেকেছে। মিসেস হাডসন এলে বলল বিলিকে ডাকতে, ব্যাপারটা খুব জরুরি।।

খুব চটপট প্যাডের কাগজে কি একটা যেন লিখে পাইপে নতুন করে তামাক ঠেসে জ্বালানোর আগে সে ফিরল আমার দিকে। ‘ওয়াটসন, আমি বলতে বাধ্য হচ্ছি, একজন ডাক্তার হিসেবে তুমি ব্যাপারটার কোন গুরুত্বই দিলে না।’

আমার ভ্যাবাচ্যাকা দৃষ্টি দেখেই বোধহয় তার গলার আওয়াজ চড়ে গেল।

প্লেগ, ওয়াটসন, প্লেগ! না দেখে রইলে কি করে?’

আমি কিছু বলার আগেই সে ধেয়ে এল আমার দিকে, একগাদা কাগজ ছিনিয়ে নিল আমার থেকে। ‘দেখ! এগুলো দেখ! এখানে দেখ! এখানে দেখ! কোন কিছুই তোমার চোখে পড়ল না? ছি ছি!’ আমি কখনো তাকে এত রেগে যেতে দেখিনি।

‘হোমস, এত রাগের কিছু নেই কিন্তু!’

এতে খানিকটা কাজ হল দেখলাম। যা নিয়ে তার গর্ব, নিজের ওপর তার সেই নিয়ন্ত্রণ সে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছে দেখলাম। সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে লম্বা একটা শ্বাস ছেড়ে বলল সে, ‘ক্ষমা কর ওয়াটসন।’

‘আরে ঠিক আছে। কিন্তু হয়েছেটা কি বলতো?’

দরজার দিকে তাকাল হোমস, মনে মনে কিছু একটা ভেবে নিল। তারপর সেদিনের টাইমসটা টেনে নিয়ে বলল, ‘বিলি আসার আগে কিছু সময় আছে বলেই মনে হয়। বলি ব্যাপারটা।’

‘ওয়াটসন- পাঁচের পাতায় দেখ। আমাদের পুরোনো বন্ধু কর্নেল সেবাস্টিয়ান মোরান একটা প্রবন্ধ লিখেছে।’

লেখাটা অবশ্য আমি পড়েছিলাম। এই বিখ্যাত শিকারীর লেখা আমার বরাবরই ভাল লাগে, কারণ এই লেখাগুলোর মধ্যে অনেক চমকপ্রদ ব্যাপার থাকে এবং সেগুলো অন্য কারোর থেকে কোনও অংশে কম নয়, তা মোরান যতই প্রফেসার মরিয়ার্টির ডানহাত হোক না কেন। মোরানের জাহাজ যখন শিকারের ট্রোফি নিয়ে ফিরছিল, তখন বুয়োর জলদস্যুরা জাহাজ আক্রমণ করে। মোরান আর তার লোকজন যুদ্ধ করে কোনও ক্রমে ক্ষতিগ্রস্থ জাহাজ জোহানেসবার্গে নিয়ে যায় এবং জাহাজ আর যুদ্ধে নিহত নাবিকদের ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষের হাতে তুলে দেয়। একটা জিনিস লক্ষ্য করার, তারা জাহাজে কোনও মাল ওঠা-নামা করায় নি এবং কাউকে জাহাজে উঠতে দেয়নি।

‘পড়লাম। মোরানের মনের মতো অ্যাডভেঞ্চারই বটে’, আমি বললাম।

‘সে হয়তো তুমি ওটা পড়ে ঠিকই বললে, ওয়াটসন, কিন্তু তাহলে এটার ব্যাপারে কি বলবে?’

সে আমার সামনে মেলে ধরল সবচেয়ে পুরোনো কাগজখানা। তাতে একটা বিশেষ খবর আছে। সুমাত্রার পশ্চিমে সাইবেরাট নামে একটা ছোট্ট দ্বীপে দুবছর আগে বিউবোনিক প্লেগ ছড়িয়ে পড়েছে।

‘আর এটাও দেখ।’

সেটাও আরেকটা প্রবন্ধ – লিখেছেন জনৈক ডাঃ কালভারটন-স্মিথ। তিনি ঘোষণা করেছেন খুব শিগগিরই তিনি বিউবোনিক প্লেগ প্রতিরোধ এবং প্রতিকারের সিরাম তৈরি করে ফেলবেন। মজার ব্যাপার হল, পরে তিনি এই ঘোষণা প্রত্যাহার করেন। 

আমি সবে পড়া শেষ করেছি, দরজায় একটা করাঘাতের আওয়াজ পাওয়া গেল, পরমুহুর্তে ঘরে ঢুকল বিলি। রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়িয়ে সমস্ত অলিগলির ঘোতঘাত ওর জানা। বিলি যে হোমস আর আমার পরম বন্ধু, সেটা বহুবারই প্রমাণ হয়ে গেছে।

কথাবার্তা না বলে হোমস তার হাতে সোজা গুঁজে দিল সেই কাগজটা। ‘বিলি, এই কাগজটা এই ঠিকানায় পৌঁছে উত্তর নিয়ে ফিরবে।’

একটি কথাও না বলে বিদায় হল বিলি। আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘কি ব্যাপার হোমস? কাগজে কি লেখা?’

বিশেষ ধরণের কোনও কাজের পরেই হোমসের শরীরটা কেমন অসাড় হয়ে যায়, এ আমি বরাবর দেখে আসছি। তার চোখ দুটো কুঁচকে এত কালো হয়ে গেছে যে মনে হচ্ছে চোখের ওপরে একটা ঢাকনা পরানো রয়েছে, কিন্তু সে চোখের তারায় এমন কোনও ঝলসানি লক্ষ্য করলাম না, যেটা কোনও কেস চলাকালীন তার চোখে দেখা যায়। এখন অবশ্য কোনও কেস চলছে না।

‘কাগজটা পাঠানো হয়েছে ডাঃ কালভারটন-স্মিথকে, ওয়াটসন – লোকটা তোমাদের পেশার একজন অন্যতম বুদ্ধিমান এবং বদমাশ লোক’, পাইপে একটা লম্বা টান লাগালো সে। ‘আমি ভাবছি এটা প্রফেসার মরিয়ার্টির কাছে গেলে কি হতে পারে।’

একটা লম্বা শ্বাস ছাড়ল হোমস, দীর্ঘশ্বাস, বলল, ‘আশা করি ব্যাপারটা আটকাতে পারব, হয়তো খুব বেশি দেরি হয়নি।’

‘কাগজে কি লেখা আছে?’

‘কাগজে? কাগজে লেখা আছে, ‘ইংল্যান্ড তোমাকে মরিয়ার্টির থেকেও বেশি টাকা দেবে’।’

‘কিসের জন্য?’

‘ঐ সিরামের জন্য, আবার কি! বিউবোনিক প্লেগের ওষুধ।’

‘বল কি হোমস, এ কি সত্যি-’

‘আমি এখনও বুঝতে পারছি না। বিলি না এলে বোঝা যাবেও না। ওই বোধহয় এল সে!’

একটা লাফ মেরে হোমস এগিয়ে গেল দরজার দিকে, হাঁপাতে থাকা ছেলেটা দরজায় ধাক্কা দেওয়ার আগেই খুলে ফেলল সেটা। নিঃশব্দে বিলি একটা এনগ্রেভ করা খাম তুলে দিল হোমসের হাতে। খামটা ছিঁড়ে ভেতরের চিঠিটা পড়তে পড়তেই ওর কাঁধ দুটো ঝুলে পড়ছে খেয়াল করলাম।

অন্যমনস্কভাবেই হোমস বিলির হাতে কিছু পয়সা গুঁজে দিয়ে তাকে বিদায় করল। ব্যাপারটা চোখে লাগল আমার, হোমসকে বললামও সেটা।

‘যা ভেবেছিলাম, ওয়াটসন। মরিয়ার্টি, মোরান আর কালভারটন-স্মিথ মিলে জোট বেঁধেছে। কেউ জানলেই তো গন্ডগোল। আতঙ্ক ছড়াবে।’

‘উত্তরটা কি এল?’

হোমস হাসল। রসিকতার চিহ্নও নেই সেখানে। ‘উত্তরে লেখা ছিল- মাই ডিয়ার মিঃ হোমস, আপনার প্রস্তাবটা ভালই। দুঃখের বিষয়, ইংল্যান্ড আমাকে কি দেবে তা নিয়ে আমি ভাবছিই না, কারণ বছরখানেকের মধ্যে আমি আর আমার সঙ্গীসাথীরাই ইংল্যান্ডের দখল নেব।’

‘বল কি?’

‘হ্যাঁ। মরিয়ার্টি ফন্দী এঁটেছে আগে নিজেরা টীকা নেবে, তারপর এখানে এসে রোগ ছড়াবে।’

‘কিভাবে করবে সেটা?’

‘সম্ভবত কোন পশুর মাধ্যমে, যেটাকে মোরাম কায়দা করেছে আর ওর জাহাজে করেই পাচার করেছে।’

এবার একটু একটু ব্যাপারটা বোঝা যাচ্ছে, যদিও আমার বোঝার ক্ষমতা  হোমসের মত নয় একেবারেই। ‘কিন্তু ওরা যদি সিরামের পেটেন্ট নিত, তাহলে তো কোটিপতি হয়ে যেতে পারত’, আমি বললাম।

হোমস শুকনো একটা হাসি দিল। ‘ক্ষমতা, ওয়াটসন। ক্ষমতা যে অর্থের চেয়েও কত শক্তিশালী, সে তুমি নিশ্চয়ই বুঝবে, আর মরিয়ার্টির কাছে ক্ষমতাই শেষ কথা। ওর ইচ্ছে ইংল্যান্ডকে একেবারে জনশূন্য করে দেওয়া, শেষ করে দেওয়া, যেখানে ও ছাড়া আর কেউ থাকবে না। ও সেখানকার একচ্ছত্র অধিপতি হয়ে বসবে। এখনকার লোকজন – তার মধ্যে তুমি আর আমিও আছি – তো আর ওর হাতে নেই, কাজেই ওদের মরতেই হবে।’

‘তুমি তো ভয় পাইয়ে দিচ্ছ!’

‘কি করা যাবে বল ওয়াটসন! আমি লোক চিনি।’

‘তাহলে আমরা কি করব?’

হোমসের হাসিটা একটু মোলায়েম হল। ‘বিপদে আমি না যেন করি ভয়, ওয়াটসন। এটা অবশ্য এপিটাফ হিসেবে লেখা যেতে পারে।’

এমনভাবে হোমস কথাটা বলল যে আমি যেন তক্ষুণি আমার সমাধিটা দেখতে পেলাম, যার ফলকে কথাগুলো লেখা। ‘ঠিক করে বলতো হোমস, কি করা যায়?’

উত্তর অবশ্য পেয়ে গেলাম প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই। আমি আর একবার পড়ছিলাম লেখাটা, পুরো ব্যাপারটা জোড়া লাগানোর চেষ্টা করছিলাম, আর এই ফাঁকে কখন যে হোমস ঘর থেকে বেরিয়ে গেছে, খেয়ালই করিনি। কাঁধে একটা টোকা খেয়ে মুখ তুলে দেখি, সে পুরোদস্তুর পোশাক পরে বেরোনোর জন্য তৈরি হয়ে গেছে।

‘কোট চড়াও, ওয়াটসন। আমাদের একবার ডায়োজেনেস ক্লাবে যেতে হবে।’

ডায়োজেনেস ক্লাবটা বোধহয় বিশ্বের যত অদ্ভুতুড়ে ক্লাব আছে, তাদের মধ্যে অদ্ভুততম। কারা যে এর সদস্য, শহরের কেউই তা জানে না। ক্লাবের নিয়মই হল, বাইরে সে সব ফাঁস করা যাবে না। ক্লাবের ভেতরে কারও কথা বলাও বারণ। ভিজিটার্স রুমে অবশ্য বলা যাবে, তাও ফিসফিস করে।

হ্যানসমে চড়ে বিচ্ছিরিরকমের ঠান্ডা হাওয়া খেতে খেতে আমরা চলে এলাম সেই বাড়ির সামনে। ক্লাবের জোড়া দরজার সামনের দারোয়ানকে হোমস কার্ড দেখাতেই সে আমাদের নিয়ে গিয়ে বসাল ভিজিটার্স রুমে। আমরা অপেক্ষা করতে লাগলাম হোমসের দাদা মাইক্রফটের জন্য।

মাইক্রফটের ভারি চেহারা আর কাটখোট্টা মুখ দেখে অবাকই হয়েছিলাম প্রথমে, যদিও তার সঙ্গে এর আগেও আমার দেখা হয়েছিল গ্রিক দোভাষীর অ্যাডভেঞ্চারে। সেই কেসের শেষটা সুখের হয়নি, কাজেই আমি চাইছিলাম এবারের কেসে মাইক্রফটের পরামর্শ যেন আরো কার্যকরী হয়। সে আমার দিকে তাকিয়ে কোনও ক্রমে মাথাটা একটু ঝুঁকিয়েই হোমসের দিকে ফিরল। শার্লক ওর থেকে বারো বছরের ছোট। হোমস বলে, মাইক্রফট নাকি ইংল্যান্ডের সবচেয়ে ক্ষুরধার বুদ্ধিসম্পন্ন এবং শক্তিশালী মানুষ। আমি ভাবছিলাম এ-ই হয়ত মরিয়ার্টির মোকাবিলা করতে পারবে। যদিও ভাবার বেশি সময় পেলাম না।

‘শার্লক’, মাইক্রফটের ফিসফিসে স্বরে আদরের সুর, ‘কেন এলি রে এই সাধুসন্তদের ডেরায়?’

সংক্ষেপে শার্লক ঘটনাটা বলল। যেভাবে সে যুক্তি দিয়ে ধাপে ধাপে ঘটনাটা  বলল, তাতে আমি মরিয়ার্টির শয়তানী বুদ্ধির কথা চিন্তা করে আবার শিউরে উঠলাম।

নিচু গলায় ফিসফিস করে তারা কথা বলছিল নিজেদের মধ্যে, প্ল্যান ছকে ফেলছিল পরবর্তী কার্যক্রমের। শুনতে শুনতে আমি ভাবছিলাম – পারলে শার্লক হোমসই পারবে আসন্ন বিপদের হাত থেকে আমাদের বাঁচাতে।   

এর আট দিন বাদে, আমি আর হোমস আটলান্টিক নৌবহরের আঠাশ নম্বর গান-ফ্ল্যাগশিপের এইচ এম এস বার্মিংহাম নামক জাহাজের ডেকে পায়চারী করছিলাম। আমরা আগেই ক্যানারী পেরিয়ে এসেছি, এখন আমরা পেরোচ্ছি আফ্রিকার দক্ষিণের জলধারা। হোমসের হিসেবে, আর একদিন কি দুদিন জোর গতিতে যেতে পারলে ফরাসী পশ্চিম-আফ্রিকার উপকূলে, ডাকার-এর ল্যাটিচিউটের কাছাকাছি কোনও জায়গায় আমরা কর্নেল মোরানের জাহাজকে দেখতে পাব।

বাতাসে সুন্দর একটা গন্ধ ভাসছিল। নাবিকদের মধ্যে কেউ একজন বুদ্ধি করে একটা ক্রিসমাস ট্রি নিয়ে এসেছিল – বেঁধে দিয়েছিল সামনের মাস্তুলের সঙ্গে, লাল আর সবুজ রঙে সুন্দর করে সাজিয়েছিল এবং এর নীচে সুন্দর করে মুড়ে কয়েকটা বাক্সও রেখেছিল, – বড়দিনের পুরোপুরি আমেজটা আনার জন্য। এই লোকগুলোর কথা ভাবলে সত্যিই শ্রদ্ধা হয়। মহারাণীর কিছু কিছু সাংঘাতিক কঠিন কাজও এরা কত অবলীলায় হাসিমুখে করে। এই হচ্ছে খাঁটি ইংল্যান্ডের অন্তরাত্মা – এরা লড়াই করবে, মরে যাবে, তবু হাল ছাড়বে না।

আমরা অবশ্য একা নই। ছাব্বিশখানা জাহাজ অর্ধচন্দ্রাকারে আমাদের পেছন পেছন আসছে। মাইক্রফটই অনেক বুঝিয়ে প্রধানমন্ত্রীকে এ ব্যাপারে রাজী করিয়েছে, যাতে সামনের কোনও আগুয়ান জলযানকে রুখে দেওয়া যায়। ফ্রাঙ্কো-প্রুসিয়ান যুদ্ধের পর এতবড় নৌবহর আর দেখা যায় নি, এবং আশা করি বহু বছরের মধ্যে আর দরকার হবেও না।

এত বড় একটা অভিযানের ব্যবস্থা করতে গিয়ে হোমসকে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে। স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডকে রাজি করাতে হয়েছে, যাতে কালভারটন-স্মিথকে গ্রেফতার করা হয়, কারণ তাকে জিজ্ঞাসাবাদের প্রয়োজন আছে। যেহেতু তার কাছে কোনও সিরাম পাওয়া যায় নি, তার কাগজপত্র আর ল্যাবরেটরি থেকে হয়তো কোনও হদিশ পাওয়া যেতে পারে – আর যেহেতু বিপদের সম্ভাবনাও অত্যন্তই রয়েছে, তাই প্রধানমন্ত্রীও অনিচ্ছাসত্ত্বেও নৌবহর দিতে রাজি হয়েছেন বটে, তবে এই হুঁশিয়ারিও দিয়ে রেখেছেন যে যদি হোমসের ভুল হয়, তবে হোমস আর তার দাদার কেরিয়ার চিরদিনের মতো শেষ তো হবেই, এমনকি তাদের বিরুদ্ধে ক্রিমিনাল অফেন্সও আনা যেতে পারে।

যদিও হোমস এসব পাত্তাই দিচ্ছিল না। আমরা এখন পায়চারি করছিলাম জাহাজের ডেকে, দিগন্তের দিকে চেয়ে দেখতে চাইছিলাম অভীষ্ট জাহাজের সন্ধান পাওয়া যায় কিনা।

‘ব্যাপারটা খুবই সোজা’, বলল হোমস, ‘তবে কিনা, আমরা যতই শিকারের দিকে এগোচ্ছি, ততই আমার কেমন একটা সন্দেহ হচ্ছে।’

‘কিসের জন্য, হোমস? কর্নেল মোরান নিশ্চয়ই মহারানীর উপযুক্ত নয়?’

‘মোরানকে নিয়ে কিন্তু আমি ভয় পাচ্ছি না। আমি চিন্তা করছি মরিয়ার্টিকে নিয়ে। ওই হল আসল নাটের গুরু। ওর জাল সারা পৃথিবীতে ছড়ানো আছে, ওর যা যোগাযোগ, তা যে কোনও দেশের সরকারের প্রতিদ্বন্দ্বী। কাজেই একে ধরতে গেলে যথেষ্ট চিন্তাভাবনা করে এগোতে হবে।’

‘কিন্তু –’

‘আমার কথা মিলিয়ে নিয়ো। এরকম আগেও ঘটেছে। ওর মগজ হচ্ছে মাকড়সার জালের মতো – প্যাঁচের মধ্যে প্যাঁচ। এই জালের কেন্দ্রে আছে মরিয়ার্টি নিজেই – এতটুকু নড়াচড়া হলে বুঝতে পারে। তুমি নিশ্চিন্ত থাকতে পারো, আমরা যে সমুদ্রে ভেসে পড়েছি, সেটা ও খুব ভালই জানে – হয়তো ও-ই –’ হোমস পাইপে লম্বা একটা টান মারল, ধোঁয়াটা ছাড়ল বেশ খানিকক্ষণ ধরে। ‘হয়তো ও-ই আমাদের শিকার করতে যাচ্ছে।’

‘কি যে বল হোমস – শিকার করবে রয়্যাল নেভিকে?’

‘হেসো না ওয়াটসন। ও যে কি করতে পারে তোমার কোনও ধারণা নেই।’

সামান্য রাম মেশানো চায়ের কাপ নিয়ে এসে দাঁড়াল একজন ক্রুম্যান। তাকে ধন্যবাদ দিলাম। চমৎকার হাওয়া দিচ্ছিল, সেই নিয়ে কথা বললাম খানিকক্ষণ। তারপর আবার পায়চারি শুরু করলাম। টিনের কাপগুলো খুব গরম বলে ধরা যাচ্ছিল না, সেগুলো রাখা হল কুন্ডলি পাকানো দড়ির ওপর।

আমি শান্ত সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে ভাবছিলাম, এত টেনশনেই বোধহয় হোমস ঠিকঠাক সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না। শত্রুপক্ষকে একটু বেশিই সমীহ করে ফেলছে বোধহয়। আমার এমনও মনে হল যে সমুদ্রযাত্রা দীর্ঘ হতে পারে মনে করে ও হয়ত কিছু কোকেনও সঙ্গে করেই এনেছে, একঘেয়েমি কাটানোর জন্য ও মাঝে মাঝে যার ইঞ্জেকশন নেয়। হয়ত অতিরিক্ত কোকেনই ও নিয়ে ফেলেছে, যার জন্য এরকম আবোল তাবোল বকছে। এই সব ভাবতে ভাবতেই আমি অন্যমনস্কভাবে চায়ের কাপটা হাতে নিয়ে তাতে ফুঁ দিয়ে চুমুক দিলাম।

‘ফেলে দাও, ওয়াটসন! মুখ থেকে ফেলে দাও’, হোমস পেছন থেকে ধাক্কা মেরে কাপটা ফেলে দিয়েছে ডেকের ওপর। ‘চায়ে বিষ মেশানো আছে! তুমি ঠিক আছো তো?’

তার কথা শোনার সঙ্গে সঙ্গেই অবশ্য আমি মুখ থেকে পুরোটাই ছিটিয়ে ফেলে দিয়েছিলাম, তবুও মুখে একটা বিশ্রি স্বাদ অনুভব করছিলাম। থরথর করে কাঁপছিলাম। বিড়বিড় করে বললাম, ‘সেই লোকটা গেল কোথায়?’

কিন্তু ডেকে এখন অনেক লোক। সাধারণ পোশাকে। দূর থেকে কাউকেই চেনা যাচ্ছে না। ক্রমশ পায়ের জোর কমে আসছিল আমার, চোখ ঝাপসা হয়ে আসছিল, কাউকেই বোঝা যাচ্ছিল না। এমনকি হোমসের চেহারাটাও আঁকাবাঁকা ঠেকছিল, মনে হচ্ছিল আমি যেন জলের ভেতর দিয়ে তাকাচ্ছি। তারপর সব অন্ধকার।

কে যেন আমার কাঁধে চাপ দিচ্ছিল। আফগানিস্থানের যুদ্ধে এখানেই জিজেল বুলেট ঢুকেছিল। আমি চোখ খুললাম। একটা অপরিচিত ঘর আমার সামনে।

‘ওয়াটসন? ওয়াটসন?’ কাঁধের চাপটা একটু বাড়ল। কে যেন চাপা স্বরে ডাকছে আমায়। ‘শুনতে পাচ্ছো?’

অন্ধকার ঘরে আমার সামনে একটা মূর্তি। চেষ্টা করছিলাম দৃষ্টিটাকে কেন্দ্রীভূত করার। ‘হোমস? আমি কোথায়?’

‘তুমি বেঁচে আছো, এটাই আসল কথা। প্রায় হয়ে গেছিল আর কি!’

আমার ধীরে ধীরে মনে পড়ছিল সব – সেই ক্রুম্যান, সেই চা, অজ্ঞান হওয়ার আগের দৃশ্যগুলো। আমি কি বোকা! হোমসকে সন্দেহ করে কি ভুলই না করেছিলাম! সে আবার ঠিক প্রমাণিত হয়েছে। মরিয়ার্টির লোকজন সর্বত্র রয়েছে, এমনকি এই জাহাজেও।

‘আমরা কোথায়? আজ কি বার?’ প্রশ্নগুলো বেরিয়ে আসছিল আমার মুখ দিয়ে। ‘আমাদের বিষ দিল কেন হোমস? ওরা কি ভেবেছে আমাদের সরিয়ে দিলেই ওরা বেঁচে যাবে, যখন গোটা নৌবহর ওদের পেছনে লেগে আছে?’

হোমস জিভ দিয়ে একটা আওয়াজ করল। ‘আমার তো তা মনে হয় না।’

আমি টলমল করতে করতে উঠে বসলাম। ‘ব্যাপারটা খুবই অদ্ভুত ঠেকছে। পরে হয়তো বোঝা যাবে।’

‘চল এখন। উঠতে পারবে তো?’

হোমস আমার হাত ধরে ছোট্ট কেবিনটার বাইরে নিয়ে এল। বাইরে মনে হল সন্ধ্যে হয়ে আসছে। দেয়ালের মধ্যে দিয়ে কয়েক পাক এধার-ওধার করতে করতেই আমার অনেকটা চাঙ্গা লাগল, মাথাও পরিস্কার হতে শুরু করল। ‘আমাকে কি দিয়েছিল ওরা?’

‘মনে হচ্ছে এক ধরণের সায়ানামিড। জোর বরাত, ওয়াটসন, তুমি বেঁচে গেছ। এই বিষের অতি সুক্ষ পরিমাণও একজন মানুষকে মেরে ফেলতে পারে। আর তুমি তো ওটা গেলোও নি, তাতেই এই।’

এক মুহূর্তের জন্য বেঁচে গেলাম। আরেকবার। শার্লক হোমসের জন্যই।

‘তুমি কতক্ষণ এখানে ছিলে? তা ধর, তিরিশ ঘন্টার মতো, মোটামুটি হিসেব। দেখতেই পাচ্ছ, এখন রাত্রি নেমেছে।’ পকেটে হাত ঢুকিয়ে হোমস বার করে আনল একখন্ড পাউরুটি, খানিকটা শুকনো মাংস আর একটা কমলালেবু। ‘খিদে পেয়েছে নিশ্চয়ই। আমি এরকম কিছু হতে পারে ভেবেই পকেটে এগুলো রেখেছিলাম। খেয়ে নাও। তোমার এখন গায়ে জোর দরকার।’

মিনিট কুঁড়ি পরেই আমরা আবার ডেকে উঠে এলাম। আমার সঙ্গে সব সময়েই রিভলভার থাকে, এখন পকেটে সেটার শীতল স্পর্শ পেয়ে ভালই লাগল। আবছায়াতে দেখতে পাচ্ছিলাম লোকজন এদিক-ওদিক নানারকম কাজ করছে, জাহাজটাকে রাতের জন্য ফিটফাট করে রাখার জন্য। সঙ্গে অস্ত্র থাকতেও অস্বস্তি হচ্ছিল, মনে হচ্ছিল এদের মধ্যেই কেউ একজন মাত্র একদিন আগেই আমায় বিষ খাইয়ে মারার চেষ্টা করেছিল। ব্যাপারটা আবার ঘটতে পারে।

ক্যাপ্টেন জন ওয়াগনারকে দেখা গেল। ঝাঁকড়া চুল আর গোঁফের শক্তপোক্ত চেহারার নাবিক, যিনি পুরোন ধাঁচের একজন প্রাণখোলা মানুষ। আমার এরকম একটা দুর্ঘটনা ঘটে গেলেও মনে হল এই মানুষটার কাছে আমি নিরাপদ। জাহাজ কড়া হাতে পরিচালনা করতে তিনি খুবই দক্ষ।

‘গুড ইভনিং, মিঃ হোমস। আর ডাঃ ওয়াটসন’, হুংকার ছাড়লেন তিনি, ‘আমার জাহাজে যে এরকম কাণ্ড ঘটতে পারে, এ আমার ধারণাতেও ছিল না। আমি কথা দিচ্ছি, শয়তানটাকে খুঁজে বার করবোই, তারপর দেখবেন ওর কি হাল করি! আমার সেরা লোকেরা রয়েছে এতে।’ তাঁর গলা একটু নরম হল। ‘বিরাট চিন্তা ছিল আপনাকে নিয়ে। সুস্থ হয়ে উঠেছেন দেখে খুব ভাল লাগছে।’

তাঁর শুভেচ্ছার জন্য ধন্যবাদ জানিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কালকেই বোধহয় সেই দিন, তাই না ক্যাপ্টেন?’

ক্যাপ্টেন হাসলেন। ‘আপনার বন্ধু তো সেই রকমই বলছেন, ডাক্তার। কিন্তু এত বড় বিশাল সমুদ্রে সেরকম নির্দিষ্ট করে কিছু বলা যায় না। যখন তখন যে কোনও কিছু ঘটতে পারে।’

‘ওকে ধরতে পারব তো?’

ক্যাপ্টেনের মুখ কঠিন হল। ‘অবশ্যই। একবার দেখতে পেলেই হয়। আমার মানসম্মান নির্ভর করছে এর ওপর।’

‘হুইলে কে আছে এখন, ক্যাপ্টেন?’ আমাদের কাছে এসে হোমস জিজ্ঞেস করল বিনীতভাবে। আমরা যতক্ষণ কথা বলছিলাম, ও জাহাজের রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে অন্ধকারের দিকে তাকিয়েছিল।

‘আমার ফার্স্ট মেট, জেফার্স।’

‘আর পাহারায়?’

ক্যাপ্টেনের কপালে ভাঁজ পড়ল স্বাভাবিকভাবেই। ‘কি ব্যাপার, মিঃ হোমস?’

হোমস ঘুরে জাহাজের সামনের দিকটা দেখাল। ‘আমার যদি খুব ভুল না হয়, ক্যাপ্টেন, তাহলে দেখুন, স্টারবোর্ডের দিকে একটা জাহাজ অন্ধকারে ভেসে যাচ্ছে।’

ওয়াগনার এবং আমি দৌড়ে গেলাম সে দিকে, হোমসের বলা জাহাজটা দেখার আশায়। আমি কিছু দেখার আগেই ক্যাপ্টেন ঘুরে গেলেন, তাঁর মুখ দিয়ে বেরিয়ে এল কয়েকটা বিশ্রী শব্দ। তিনি যখন দৌড়ে যাচ্ছিলেন ব্রিজের দিকে, সারা জাহাজ কাঁপছিল তাঁর গলার আওয়াজে। ‘সাবধান! সামনে বিপদ!’

আর্মাডায় আমরাই ছিলাম প্রধান, কাজেই কয়েক মিনিটের মধ্যেই মশাল জ্বালিয়ে বহরের অন্যান্য জাহাজগুলোকে সতর্ক করে দেওয়া হল যে কোনও কিছু দেখা গেছে। এটাই যে কর্নেল মোরানের জাহাজ, সেটা অবশ্য নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না, কিন্তু জাহাজের আলোগুলো যখন ঢাকা রয়েছে, তখন অন্য আর কি হতে পারে।।

হোমস আমার পাশেই রেলিং ধরে দাঁড়িয়েছিল, এবার বলল, ‘মনে রেখো ওয়াটসন, ওই জাহাজ থেকে কেউ বাইরে আসবে না। ওই জাহাজের সমস্ত কর্মচারীর প্লেগের টিকা নেওয়া আছে, কিন্তু ওদের গায়ে পোকামাকড় কিম্বা উকুন আছে কিনা বলা যাচ্ছে না। ও থেকে রোগ ছড়াবেই।’

‘আমরা কি ওদের সবাইকেই মারতে যাচ্ছি?’ লোকগুলো যতই ভয়ংকর হোক না কেন, হোমসের মাথা বরফের মতো ঠান্ডা।

‘না না, আমরা শুধু ওদের আর ওদের মরণজাহাজটাকে ডাকার বন্দরের কাছে গোরে নামের একটা ছোট্ট দ্বীপের দিকে নিয়ে যাব। ওখানে বিভিন্ন জায়গায় পাঠানোর আগে ক্রীতদাসদের রাখা হয়। ক্যাপ্টেন ওয়াগনার সব জানেন।’

‘তারপর -?’

‘তারপর ওদের জাহাজকে গোলা মেরে জলে ডুবিয়ে দিতে হবে। মোরান আর ওর লোকজন পারলে দ্বীপের দিকে সাঁতরে আসতে পারে। নোনা জলে ওদের গায়ের পোকামাকড়গুলোও ধুয়ে যাবে। আর লোকগুলো তো সব নাবিক, কাজ খুঁজে নিতে অসুবিধে হবে না –’

সে আরও কি সব বলতে যাচ্ছিল, হঠাৎ আমাদের পেছনে একটা গুলির শব্দ শুনলাম। রিভলভার হাতে দৌড়োলাম সেদিকে, হোমস আমার পাশে পাশে।

‘এই যে! এখানে! ওপরে!’

ওপরে ব্রিজের ওপরে টলমল করছে ফার্স্ট মেট জেফার্স, একটা হাত মাথায়, রক্ত গড়াচ্ছে সেখান থেকে। তার পায়ের কাছে উপুড় হয়ে পড়ে আছেন ক্যাপ্টেন ওয়াগনার।

‘ক্যাপ্টেন –’ জেফার্সের গলা দিয়ে আওয়াজ বেরোচ্ছে না। আমি তার পাশে পৌঁছে গেছি, কিন্তু তখন আর কিছু করার ছিল না। পেছন থেকে গুলি করে ক্যাপ্টেনের মাথা ফুটো করে দেওয়া হয়েছে। এই বলিষ্ঠ, নির্ভীক মানুষটি তাঁর যাত্রা শেষ করেছেন।

‘কি হল?’ আমি জিজ্ঞেস করলাম।

মেট যে সাংঘাতিক ধাক্কা খেয়েছে, সেটা তাকে দেখেই বোঝা যাচ্ছিল। ‘জানি না। আমাকে পেছন থেকে কে মারল, তারপর –’

তক্ষুনি ওপর থেকে পাহারাদারের চিৎকার শোনা গেল, ‘শত্রু জাহাজ আক্রমণ করতে আসছে।’

আমরা তাকিয়ে দেখলাম একটা জাহাজ – এখন এর আলোগুলো সব জ্বালানো – এত কাছে চলে এসেছে যে মনে হচ্ছে যে কোনও মুহূর্তে ধাক্কা লাগবে। ব্যাটল স্টেশনের কর্মীরা নির্দেশের জন্য অপেক্ষা করছে, কিন্তু জেফার্স ভয়ে নড়াচড়া করার ক্ষমতাও হারিয়েছে, আতঙ্কিত চোখে দেখছে জাহাজটার দ্রুত এগিয়ে আসা।

‘ওদের আর এগিয়ে আসতে দেওয়া যাবে না’, হোমস বলল জেফার্সকে। তার গলা শান্ত, কিন্তু ছুরির মত ধারালো। ‘কি করবে ঠিক করে ওদের বলে দাও।’

শত্রু জাহাজের ডেকে দেখতে পাচ্ছিলাম ওরা তৈরি হয়ে রয়েছে ছোট ছোট অস্ত্র আর বাঁকানো আঁকশি নিয়ে। এরাই সেই লোক, যারা মাত্র দু সপ্তাহ আগেই ভয়ংকর বুয়োর জলদস্যুদের মোকাবিলা করেছে। জেফার্স দিশেহারা হয়ে গেছে, কি করবে ভেবে পাচ্ছে না। তারপর আচমকা তার দলবলের দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে উঠল, ‘গুলি চালাও! সব কটা কামান থেকে গুলি চালাও!’

‘না’, চেঁচিয়ে বলল হোমস, তার গলার আওয়াজ চাপা পড়ে গেল চোদ্দখানা কামানের গর্জনে। মোরান নির্ঘাৎ ডেকের নিচেও গোলাবারুদ রেখেছিল, কারণ আমরা কামান চালানোর প্রথম ধাক্কাটা সামলে নিতে না নিতেই রাতের আকাশ পাল্টে গেল দিনের আলোয়, আর জাহাজ প্রলয়ংকার এক বিস্ফোরণে পরিণত হল এক আগুনের গোলায়। বিস্ফোরণের ধাক্কায় উল্টে পড়েছিলাম আমরা, নিঃশব্দে মড়ার মত পড়েছিলাম কয়েক মুহূর্তের জন্য। তারপর জলন্ত কাঠ আর মাংস বৃষ্টির মত ঝরে মত ঝরে পড়তে লাগল আমাদের চারপাশ আর ডেকের ওপরে।

কয়েকটা জায়গায় আগুন ধরে গিয়েছিল। জেফার্স হারানো মনের জোর ফিরে পেয়েছিল খানিকটা, কর্মীদের নানারকম নির্দেশ দিচ্ছিল। আমি আর হোমস ক্যাপ্টেন ওয়াগনরার দেহের পাশে বসেছিলাম। লক্ষ্য করছিলাম মোরানের জাহাজের ধ্বংসাবশেষ কিভাবে দাউদাউ করে জ্বলতে জ্বলতে চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ছে, ধোঁয়া ছাড়ছে, তারপর ধীরে ধীরে ডুবে যাচ্ছে সমুদ্রের জলে।

হোমসের চোখ চকচক করছিল। কনুইয়ের ভর হাটুঁর ওপর দিয়ে সে হাতদুটো ছড়িয়ে দিয়েছিল সামনে। আমার দিকে তাকাল একবার, তারপর ক্যাপ্টেনের দিকে, তারপর বড় করে একটা শ্বাস ছাড়ল। ‘ভুল’, বিড়বিড় করে বলল সে নিজের মনেই। বোঝাই যাচ্ছিল যথেষ্ট কষ্ট হচ্ছে তার। ‘ভুল হয়ে গেল বিলকুল, এতবড় ভুল কিভাবে হল!’

সে রাতে ঘুমানোর প্রশ্নই ছিল না। তিনবার পাহারাদার বদল হল, কিন্তু তখনও জাহাজ পরিষ্কারের কাজ শেষ হয় নি। জেফার্স হুকুম জারি করেছিল, ক্যাপ্টেনের খুন হওয়ার সময়ে জাহাজের প্রত্যেকটি লোকের কে কোথায় ছিল, তার খুঁটিনাটি জানাতে হবে। একের পর এক কর্মচারীরা ঢুকছিল কেবিনে, বিরক্ত আর রুক্ষ মুখে, নথিভুক্ত করছিল নিজেদের কাজকর্মের ব্যাপারে। হোমস চুপচাপ রেলিং-এর ধারে দাঁড়িয়ে ধূমপান করছিল। তার ঝুলে পড়া কাঁধ দেখে মনে হচ্ছিল যেন মোরানের নয়, তার জাহাজের লোকজনেরই সলিল সমাধি হয়েছে।

আমি তার কাছে গেলাম। ‘এ জিনিস রোখা যেত না।’ আমি বললাম।

সে ঠান্ডা চোখে আমার দিকে তাকাল।

‘হোমস’, আমি বোঝাতে গেলাম, ‘এতে তোমার কোন দোষ নেই।’

সে মাথা নাড়ল। ‘এভাবে তো হওয়ার কথা ছিল না। কারোর মারা যাওয়ার কথা নয়। আমাদের হাতে প্রমাণ আর কোনও দিনও আসবে না।’

‘কিন্তু ওরা তো আমাদের আক্রমণ করতে আসছিল -?’

‘তাতে প্রমাণ হয় না – এই!’ বলে উঠল হোমস, ‘ওটা কি?’

আমি সমুদ্রের দিকে তাকালাম। কালো সমুদ্র। তারপর ফসফরাসের চকচকানিতে মনে হল জলে কি যেন ভাসছে। ‘ওটা কি?’ আমি বলে উঠলাম।

হোমসের পাইপের আগুনে দেখলাম ওর চোখ জ্বলে উঠল। একটা অদ্ভুত হাসি লক্ষ্য করলাম ওর চোখের কোণে। এ হাসির অর্থ – ও কোনও কিছুর গন্ধ পেয়েছে। পর মুহূর্তেই হাসি মিলিয়ে গিয়ে মুখটা এমন ভয়ানক হয়ে উঠল, যা আমি আগে কখনোও দেখিনি।

‘সেই রাক্ষস’, বলল সে দম চেপে, ‘সেই দানব।’

‘হোমস’, আমি বললাম, ‘কি –’

‘আমার পেছন পেছন এস আর বন্দুকটা তৈরি রাখ!’ সে ব্রিজের দিকে মুখ ফেরাল।

‘মেট জেফার্স’, হাঁক পাড়ল হোমস ডেক থেকে, ‘জলে একটা নৌকো ভাসছে।’

ফার্স্ট মেট জেফার্স কাজের ভারে আরও শুকিয়ে গেছে দেখলাম এর মধ্যেই। সে হোমসের দিকে এমনভাবে তাকাল, যেন এই ভয়ংকর রাতে আরও ভয়ংকর কিছু এসে হাজির হয়েছে।

‘কি বললেন স্যার?’ সে মুখ নামিয়ে চেঁচিয়ে বলল।

‘জলে একটা নৌকো’, বলল হোমস, ‘পোর্টের দিকে পঁয়তাল্লিশ ডিগ্রি করে।’

আমাদের জাহাজ থেকে আলো ফেলা হয়েছিল জলে। সেই আলোকচক্রের প্রান্তসীমায় দেখা গেল ছোট্ট একটা নৌকো। ‘জয় ভগবান!’ হঠাৎই জেফার্সের গলার আওয়াজ চাঙ্গা হয়ে উঠেছে দেখলাম। ব্রিজ থেকে বড় বড় পায়ে নামছিল সে, বলল, ‘কেউ বেঁচে গেছে নাকি?’

‘সেই রকমই মনে হচ্ছে’, বলল শার্লক হোমস। তার চোখের দৃষ্টি দেখে – যে আমি তাকে এতবছর ধরে চিনি – শিউরে উঠলাম। কি হচ্ছিল কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। মনে অনেক প্রশ্ন জাগলেও তার মুখের চেহারা দেখে চুপ করে থাকাই শ্রেয় মনে করলাম।

জেফার্স কয়েকজনকে ডেকে উদ্ধারের নির্দেশ দিল। রাতের অন্ধকারে আমি শুধু লাইফবোটটাই দেখতে পাচ্ছিলাম। একটাই লোক সেখানে দাঁড়িয়ে হাত নাড়ছিল। তার ক্ষীণ ‘অ্যাহয়’ বলে ডাক মিলিয়ে যাচ্ছিল জলের আওয়াজে। নৌকোতে তার সঙ্গেই ছিল একটা বড়সড় বাক্স – সম্ভবত ওই জাহাজে জাহাজে বিস্ফোরণের আগেই সে কোনও ভাবে এটা নৌকোয় তুলতে পেরেছিল।

নৌকোটা কাছে আসতেই জেফার্স জলের ওপর আরও ঝুঁকে লোকজনকে নির্দেশ দিচ্ছিল। ঠিক সেই মুহূর্তেই হোমস হঠাৎ এগিয়ে গিয়ে জেফার্সকে এক ঝটকায় খামচে ধরে তুলে রেলিং-এর ওপাশে ছুঁড়ে ফেলে দিল। পরমুহূর্তেই দেখলাম জেফার্সের হাত ঝাপটানো, শুনলাম তার আর্তনাদ এবং প্রবল শব্দ করে জলের ওপর আছড়ে পড়া।

‘হোমস!’ আমি চিৎকার করে উঠলাম।

‘কিছু বলার সময় নেই! ওয়াটসন, বন্দুক তৈরি রাখো!’

সঙ্গে সঙ্গেই আমি রিভলভার বার করে তাক করলাম আমাদের চারধারে ভিড় করে আসা ক্রুম্যানদের দিকে। হোমস এখন শান্ত। ‘অসুবিধের জন্য দুঃখিত, ভদ্রমহোদয়গণ’, বলল সে, ‘একটু পরে হলে অবশ্য এর দরকারও হত না। তবে জানিয়ে দিচ্ছি, কেউ যেন মিঃ জেফার্সকে বাঁচানোর চেষ্টা না করেন!’

খাবি খেতে খেতে জলের ওপর ভেসে উঠল মেট। ‘হোমস!’ চিৎকার করছিল সে। ‘এর মানে কি? বিদ্রোহ নাকি? ওয়াটসন! আমি তোমাদের দুটোকেই ফাঁসিতে লটকাবো বলে রাখছি!’

‘তাই নাকি? আমাদের ঝোলাবে না তুমি ঝুলবে?’ হোমস চেঁচিয়ে উঠল পাল্টা। ‘অবশ্য তার আগে জলে ডুবে গেলে আলাদা কথা।’

‘আমাকে ফাঁসিতে ঝোলাবে কেন?’

‘প্রথমত, ক্যাপ্টেন ওয়াগনারকে খুনের জন্য, দ্বিতীয়ত মোরানের জাহাজ উড়িয়ে দেওয়ার জন্য, আমাকে আর ওয়াটসনকে বিষ খাওয়ানোর চেষ্টার কথাটা আর নাই বা বললাম।’

‘তোমার মাথা খারাপ হয়ে গেছে। ওরা আমাদের ডুবিয়ে দিতে আসছিল।’

‘না’, বলল হোমস, ‘তবে সে রকমই মনে হচ্ছিল বটে, কাজেই তোমার নির্দেশ পালন না করাটা তখন মনে হচ্ছিল ঠিকঠাক।’

‘কি বলছ?’

‘এই কনভয়ের কাজ ছিল ওই জাহাজটাকে গোরি-তে নিয়ে যাওয়া, ধ্বংস করে ফেলা নয়। এবং একটি লোককেও পাড়ে উঠতে না দেওয়া।’

জেফার্স জলে পা ঝাপটাচ্ছিল পাগলের মতো। তার পুরোদস্তুর পোশাক জলে ভিজে এমন ভারি হয়ে গেছে যে মনে হচ্ছিল সে ডুবে যাবে যে কোনও মুহূর্তে। তার পেছনে ভাসছিল সেই লাইফবোটটা, যেটার কথা আমরা সবাই প্রায় ভুলেই গেছিলাম।

জেফার্স জলে ডুবে গেল একবার, আবার ভেসে উঠল। লাইফবোটটা দেখে সেদিকে যাওয়ার চেষ্টা করল হাত-পা ছুঁড়ে, কিন্তু কাজটা বড়ই কঠিন তার পক্ষে। হাঁ করে বড় বড় নিঃশ্বাস ফেলতে ফেলতে সে আমাদের দিকে ঘুরল। ‘বাঁচাও ওয়াটসন! একটু সাহায্য কর! আমি দেখব যাতে তোমাদের শাস্তি না হয়।’

‘আমার বন্ধুর ফাঁসি হলে আমি আনন্দের সঙ্গে তার সঙ্গে ফাঁসিতে ঝুলতে যাব’, আমি বললাম তাকে, তারপর হোমসকে বললাম নিচু গলায়, ‘তুমি নিশ্চয়ই ওকে ডুবতে দেবে না?’

‘ও বেঁচে যাবে।’

কথা বলতে বলতে দেখলাম জেফার্স তলিয়ে গেছে আবার। আমি ভাবলাম গেল বোধহয় এবার, কিন্তু জেফার্স আবার ভেসে উঠল জলের ওপরে। তার চোখে মুখে এখন ফুটে উঠেছে আতঙ্ক। সে হোমসের দিকে তাকাল একবার, তারপর লাইফবোটের দিকে তাকিয়ে চেঁচিয়ে উঠল, ‘মোরান! বাঁচাও! আমি ডুবে যাচ্ছি।’

‘তুমি মূর্খ, জেফার্স! চুপ কর!’

শার্লক হোমস ডাকল আমাকে। এতক্ষণে তার মুখে একটা হাসির আভাস দেখতে পেলাম। ‘যা ভেবেছিলাম, ওয়াটসন, ওরা দুজন দুজনকে নামে চেনে। দরকারী প্রমাণ তো পেয়েই গেলাম।’ সে জোর গলায় চেঁচিয়ে বলল, ‘জেফার্সকে দেখ, মোরান! খেলা শেষ।’

‘কার সঙ্গে কথা বলছি জানতে পারি কি?’

হোমস দুঃখের সঙ্গে মাথা নাড়ল। ‘সে কি কর্নেল, চিনতে পারলে না? এর আগে তো আমাদের দেখা হয়েছে।’ সে ঝুঁকে পড়ল রেলিং-এর ওপর। ‘অধমের নাম শার্লক হোমস।’

‘হোমস? তার মানে?’

‘তুমি ভেবেছিলে আমি মরে গেছি, তাই না? বিষ খেয়ে?’

‘এসব কি বলছ?’

‘তোমার দোসরকে আগে বাঁচাও, পরে কথা হবে।’

মোরান অবশ্য তখনই বৈঠা বেয়ে পৌঁছে গেল জেফার্সের কাছে, দেরি হয়ে যাওয়ার আগেই তাকে তুলে নিল লাইফবোটের ওপর।

‘তোমার কথা শুনলাম, এবার আমার কথাটা রাখো, হোমস, আমাদের তুলে নাও!’ বলে উঠল মোরান।

‘দিব্যি মিষ্টি মিষ্টি কথা বলতে শিখেছ কর্নেল। তোমার পেছনের বাক্সটায় ওটা কি?’

মোরান বাক্সটার ডালা খুলে ফেলল। তার ভেতরে বেশ বড় কালো মতো কি যেন একটা রয়েছে, ডেক থেকে মনে হচ্ছে যেন একটা ছোটখাটো ভালুক। ‘এটা সেরকম কিছু না, হোমস, এটা সুমাত্রার গেছো ধাড়ি ইঁদুর। আমি এটা নিয়ে যাচ্ছি লন্ডনের চিড়িয়াখানায় দেব বলে। জাহাজ থেকে এটাই শুধু বাঁচাতে পেরেছি হোমস।’

‘জাহাজটা উড়িয়ে দেওয়ার আগে?’

‘কি বলছ?’

‘আমি বলতে চাই যে তুমি তোমার সব লোকজন সমেত জাহাজটা উড়িয়ে দিয়েছ, যাতে আমরা দয়ার সাগর হয়ে তোমাকে আর তোমার ওই সুমাত্রার দানব ইঁদুরকে লাইফবোট থেকে আমাদের জাহাজে তুলে নিই। তার আগে তুমি ভেবে নিয়েছিলে যে ওয়াটসন, ক্যাপ্টেন ওয়াগনার আর আমি অক্কা পেয়েছি, কাজেই তোমার পালিয়ে বাঁচার কথা আর কেউ ভাবতে যাবে না।’

‘না!’

‘ওই ইঁদুরের মধ্যে বিউবোনিক প্লেগের জীবাণু আছে আর তুমি নিজে ওই প্রাণঘাতী রোগের বাহক পোকার ধারক। তোমার আর জেফার্সের টিকা নেওয়া আছে। একবার কোনও রকমে এই জাহাজে ওই ইঁদুর নিয়ে উঠতে পারলে আমাদের সাধের ইংল্যান্ডের দফারফা করে দিতে।’

প্লেগ কথাটা শুনেই আমাদের পেছনে দাঁড়ানো লোকজনের মধ্যে একটা গুঞ্জন শুরু হয়ে গেল। হোমস ঘুরে দাঁড়াল তাদের দিকে। ‘ঠিকই শুনেছেন ভাইসব। সমস্ত অফিসারই আপনাদের বলেছেন – আর তার মধ্যে এই জেফার্সও আছে – যে মোরানের জাহাজ থেকে একটি লোকও এই ব্রিটিশ লাইনারের জাহাজে উঠবে না। আপনাদের মধ্যে কি কেউ মোরান আর জেফার্সকে এই জাহাজে তুলতে চান?’

‘আমরা তাহলে কি করব স্যার?’ একজন জিজ্ঞেস করল।

‘এখনই কেবিনে গিয়ে র‍্যাংকিং অফিসারকে জাহাজের ভার নিতে বলুন। আমরা এখনই রওনা হবো।’ হোমস লাইফবোটের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘খাঁচাটা জলে ফেলে দাও, মোরান। এখনই!’

আমরা খাঁচায় আটকানো জন্তুটার ঘোঁতঘোঁতানি আর নড়াচড়ার আওয়াজ শুনতে পাচ্ছিলাম। ক্রমাগত ছটফট করছিল সেটা, দানার মতো চোখদুটো জাহাজের আলোর দিকে নির্দিষ্ট করে।

‘হোমস, দয়া কর –’ কাতরোক্তি করল মোরান।

‘ওয়াটসন, ওই বোটে একটা গুলি করতো।’

আমি তাই করলাম।

‘কর্নেল, তোমার নৌকোয় কিন্তু একটা ছ্যাঁদা হয়েছে। এরপর আরও হবে। ভেসে থাকতে পারবে তো?’

‘প্লিজ –’

‘ওয়াটসন, আরেকটা চালাও।’

দ্বিতীয় গুলিটা করার পর আর দ্বিধা না করে মোরান খাঁচাটা তুলে সমুদ্রের কালো জলে ফেলে দিল। একখন্ড পাথরের মতোই সেটা তলিয়ে গেল জলে, কোনও চিহ্ন না রেখে।

একজন অফিসার দৌড়তে দৌড়তে এল। ‘কি হচ্ছে এখানে, মিঃ হোমস? মিঃ জেফার্স কোথায়?’

হোমস অল্প কথায় পুরো ব্যাপারটা তাকে বুঝিয়ে দিল।

‘কিন্তু এই দুটো লোককে নিয়ে আমরা কি করব?’

হোমস হাসল। ‘আমার মনে হয়, এই লাইফবোটটা যদি একটা বড় দড়ি দিয়ে নিরাপদ দূরত্বে আমাদের জাহাজের সঙ্গে বেঁধে নেওয়া হয়, তাহলে ইংল্যান্ড অবধি ওদের একটা দুর্দান্ত যাত্রাও হবে, আর এর মধ্যে নোনা জলের ঝাপটা খেয়ে ওদের গায়ের পোকা-টোকা সব মরেও যাবে।’

আমরা বেকার স্ট্রিটের ঘরে বসে আছি, হোমস পা দুটো ছড়িয়ে দিয়েছে আগুনের দিকে। আমরা ফিরেছি প্রায় সপ্তাহ তিনেক আগে। মোরান আর জেফার্সের বিচার শিগগিরই শুরু হবে, কিন্তু এখনও অনেক কিছুই আমার কাছে পরিস্কার নয়। ‘তুমি কখন ঠিকঠাক বুঝতে পারলে?’ আমি জিজ্ঞেস করলাম।

হোমস একমুখ ধোঁয়া ছাড়ল ক্যাভেনডিশ তামাকের। ‘তোমাকে আগেই বলেছিলাম ওয়াটসন, যখন অন্যান্য সম্ভাবনাগুলোকে সরিয়ে দেওয়া হয়, তখন যা পড়ে থাকে, অসম্ভব মনে হলেও সেটাই সত্যি। যখনই দেখলাম লাইফবোটটা জলে ভাসছে, তখনই একটা চিন্তা মাথায় এল যে অত বড় বিস্ফোরণের পর কোনও লাইফবোটেরই টিকে থাকার কথা নয়। তাহলে নিশ্চয়ই এটা আগেই জলে ভাসানো হয়েছে। তার মানে পুরো ব্যাপারটাই পূর্ব পরিকল্পিত। তারপর যখন দেখলাম জেফার্স ওকে দেখেই কোনও চিন্তা না করে জাহাজে তোলার চেষ্টা করছে, তখনই বুঝলাম ও-ও এই চক্রে যুক্ত। অবশ্য এর জন্য আমাকে ঝুঁকি নিতে হয়েছে, জাহাজে বিদ্রোহের আশঙ্কা ছিল, কিন্তু জেফার্সের যুক্ত থাকার ব্যাপারটাই সমস্ত কিছুর সঙ্গে খাপ খেয়ে যায়।’

‘কিন্তু আমরা যখন ওর আর ক্যাপ্টেন ওয়াগনারের কাছে যাই, তখন তো ওর গা দিয়ে রক্ত গড়াচ্ছিল।’

‘ও নিজেই নিজের মাথাটা ফাটিয়েছে, বুঝেছো। পুরোটাই সাজানো।’

‘কিন্তু – তাহলে আমাকে বিষ দিল কে?’

‘হ্যাঁ, ওই ক্রুম্যান বলেছে চা-টা এসেছিল ব্রিজ থেকে। আমরা ভেবেছিলাম ও ক্যাপ্টেনকে বোঝাচ্ছে। কিন্তু ক্যাপ্টেন ওয়াগনারের মতো ব্যক্তিত্বসম্পন্ন একজন মানুষের ছাপ খানিকটা তাঁর লোকেদের মধ্যেও পড়বে, আর যদি তিনিই চা পাঠাতেন, তাহলে ক্রুম্যান বলত, ‘ক্যাপ্টেন তাঁর শুভেচ্ছা জানাচ্ছেন’ বা ওই ধরণের কিছু। কাজেই বুঝতেই পারছো।’

‘আসলে কি জানো হোমস, তুমি যখন বুঝিয়ে দাও, তখন মনে হয় কত সোজা। না বোঝালে তো কিছুই বুঝতে পারি না।’

‘মন খারাপের কিছু নেই, বন্ধু। ঠিক সময়ে কোনওটাই আমরা বুঝতে পারিনি। পুরো ব্যাপারটা আমার কাছে পরিস্কার হল, যখন আমি মোরানকে লাইফবোটে দেখলাম।’

ফায়ারপ্লেসের আগুন ধিকিধিকি জ্বলছিল।

‘আর প্রফেসর মরিয়ার্টির কি হল?’ আমি জিজ্ঞেস করলাম।

হোমস একটা শ্বাস ছাড়ল। ‘ওকে বেঁধে রাখতে পারে, এমন কাউকেই তো দেখতে পাচ্ছি না। মোরান পারল না, জেফার্স পারল না, কালভার্টন-স্মিথও না। তবে আমার মনে হচ্ছে খুব শিগগিরই ওর সঙ্গে আমার আবার মোলাকাত হবে।’

‘তখন কি হবে?’ আমি জিজ্ঞেস করলাম হোমসের দিকে তাকিয়ে, যে মুখে চিন্তার ছাপ।

শার্লক হোমস একদৃষ্টে তাকিয়ে ছিল আগুনের দিকে। ‘সেদিন ওয়াটসন, আমাদের দুজনের মধ্যে একজন নির্ঘাত মরবে।’

জয়ঢাকের সমস্ত গল্পের লাইব্রেরি এই লিংকে

1 thought on “বিদেশী গল্প-ইংরিজি সুমাত্রার দানব ইঁদুর অনুবাদ অমিত দেবনাথ বর্ষা ২০১৯

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Twitter picture

You are commenting using your Twitter account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s