এ সিরিজের আগের লেখা অস্ট্রেলিয়ার পেটের ভিতর
এক “টরোঙ্গা” দূরে…
পারিজাত ব্যানার্জী
একপাশে আস্ত একটা নতুন ঝাঁ চকচকে শহরের মস্ত মস্ত অট্টালিকা সমান ইমারতের ভিড় হাত বাড়িয়ে সভ্যতাকে টেনে নেয় তার আবর্তে। মধ্যিখানে সবজে নীল রঙের নিবিড় স্থিতধী সমুদ্রের হালকা হিল্লোল— প্রশান্ত মহাসাগর যার জল নাকি গভীরতা আশ্বাসে পরিপূর্ণ, তবু অন্যদের মতো ঢেউয়ের আন্দোলনের বিশেষ দেখনদারি নেই। পিঁপড়ের মতো ছোট ছোট যে-ক’টা জাহাজ ভেসে চলেছে তাতে, তাদের সাত থেকে দশতলা দেহসম্ভার নিতান্তই এক দানা বলেই ভ্রম হয় দূর থেকে। জাহাজ যখন নোঙর করে, তখনই একমাত্র তার দিগন্তস্থিত রূপের সুস্পষ্ট ধারণা খানিক ঠাহর করা যায় যদিও। তবে আমরা এখন জাহাজে উঠব না। শহর ছেড়ে প্রতি আধঘণ্টা অন্তর যে ফেরি ছাড়ে, তাতেই বারো মিনিট চুপটি করে বসলে পৌছে যাওয়া যায় ওপারে। টরোঙ্গায়।
১৮৮৪ সালে অস্ট্রেলিয়ার দক্ষিণ প্রান্তরে অবস্থিত সিডনি শহরে মুর পার্ক অঞ্চলে প্রথম কোনো চিড়িয়াখানা উদ্বোধন করা হয়। প্রধানত ইংল্যাণ্ড থেকে আসা সাহেবসুবোদের বিনোদনমূলক ব্যবস্থাপনা হিসেবেই নেওয়া হয় এই প্রকল্প। এদেশের ইতিহাস তো মোটামুটি ভাবে জানাই আমাদের। তাও একবার সবার সুবিধার জন্য ঝালিয়ে নিলে ভালোই হবে, কী বলো? ১৭৭০ সালে ক্যাপ্টেন কুকের তত্ত্বাবধানে দক্ষিণ গোলার্ধের এই বিপুল খণ্ডকে নিজেদের হস্তগত করে ব্রিটেন। মূলতঃ কনভিক্ট কলোনি বা সাজাপ্রাপ্ত আসামীদেরই প্রথম এখানে পাঠানো হয় দ্বীপান্তরে। মধ্যিখানে মরূভূমি, চারপাশে জল— এর থেকে ভালো জেলখানা আর কী-ই বা হতে পারে?
গোল বাধল কিছুদিন পরে যখন দেখা গেল চুরি ছিনতাই রাহাজানিতে ভরে যাচ্ছে আস্ত একটা দেশ। তাদের সাথে এই দেশের আদি বাসিন্দাদের সভ্যজগতে ফিরিয়ে আনার জন্যও প্রয়োজন পড়ল শিক্ষিত নাগরিকদের, যাতে গড়ে তোলা যায় প্রথম বিশ্বের তথাকথিত ‘সভ্য সমাজ’। গড়ে উঠতে থাকল নতুন বসতি। পরে সিডনি ও মেলবোর্নে সোনা আবিষ্কৃত হওয়ার পর এমনিই হু হু করে বৃদ্ধি পেল দেশবিদেশ থেকে আসা সম্ভ্রান্ত লোকজনের সংখ্যাও।
কিন্তু তখন তো আর আজকের মতো টিভি, কম্প্যুটার, ঝাঁ চকচকে শপিং মলের হিড়িক ছিল না— তাহলে বিনোদন আসবে কোথা থেকে? তাই খোলা হল চিড়িয়াখানা। তার উপর এদেশের নানাধরণের নিত্যনতুন জন্তু জানোয়ার— কোয়ালা, ক্যাঙারু, ওয়ালাবি— এতজনকে বিশ্বদরবারে মেলে ধরার অভীপ্সাও কি আর ছিল না? নিশ্চয়ই ছিল।
কিন্তু কিছু বছর যেতেই বোঝা গেল, জায়গা কিঞ্চিৎ ‘কম পড়িয়াছে’। তাই সিডনি শহরের দক্ষিণ প্রান্তে শহরের ঠিক উলটো পিঠে ডাইনোসরদের যুগ থেকে ইতিহাস বয়ে চলা খণ্ডটিতেই শুরু হল জন্তুদের নতুন ঠিকানার আয়োজন। জুতসই নাম ভাবতে গিয়ে মাথায় এলো এখানকার আদিবাসিদেরই এক শব্দলয় — ‘টরোঙ্গা’ যার অর্থ – সুন্দর দৃশ্য।
নতুন এই চিড়িয়াখানাটির উদ্বোধন হয় ১৯১৬ সালের ৭ই অক্টোবর মোট ৫১ একর জমির উপর। জমির বহর এখন আরও বেড়ে গিয়ে ঠেকেছে প্রায় ৭০ একরে— পাল্লা দিয়ে বেড়েছে জন্তুদের সম্ভারও। টরোঙ্গা এমনই ভাবে নাম কিনে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেছে বিশ্বের দরবারে খুব অল্প সময়কালের মধ্যেই। তবে শুধুমাত্র আরও একখানা চিড়িয়াখানাই কি টরোঙ্গা? নাকি আরও বড় কিছু সে? যাকে কখনেই পুরোটা ধরা যায় না শত হাতড়ালেও— নিশ্চল হয়েও সে রয়ে যায় অধরা! ঠিক আমাদের প্রকৃতির নিরন্তর রূপের মতো?
সেই খোঁজেই যখন ফেরি করে ঘাটে এসে ভিড়তেই, সাদর সম্ভাষণ জানাল চিড়িয়াখানার কর্মীরা যাঁরা নিজেদের ‘জু ফ্রেণ্ডস্’ বলতেই বেশি স্বচ্ছন্দ। তাদের আতিথেয়তার বহরেই মন বলে উঠল, দিনটা আদপেও মন্দ যাবে না।
ঘাটের পাশ দিয়েই পাকদণ্ডীর মতো বেয়ে বেয়ে টিলার কোল বরাবর উঠে গেছে টরোঙ্গা। কেবল কার বা গণ্ডোলায় চেপেই আশপাশের নৈসর্গিক শোভার ঝলক দেখতে দেখতে ঢুকে পড়তে হয় এই নিরিবিলি প্রাণীদের রাজ্যে। আগেই বলে রাখা ভালো, একদিনে পুরোটা পায়ে হেঁটে দেখা সম্ভব হবে না কিছুতেই। পরপর দু’দিন গিয়েও ছোটখাট তবে প্রধান বেশ কিছু অংশও বাদ পড়ে গেছে আমাদেরই । আসলে, এ তো ঠিক খাঁচার পিছনে আটকে থাকা জন্তু জানোয়ার দেখা নয়, এখানে আসা তাদের সঙ্গে কিছুটা সময় কাটিয়ে যাওয়ার জন্য— তাদের পরিবেশে, তাদের মতো করে, তাদের মর্জিমাফিক। এখানে সময় তো লাগবেই। তবে যেটুকু দেখেছি, যে কয়েকটি দূর্লভ মুহূর্ত কাটিয়েছি বন্যতার সঙ্গে, তাতেই আমি সমৃদ্ধ— একথা হলফ করে বলাই যায়।
প্রথমেই যেই বিলুপ্তপ্রায় পুঁচকে আঙুলের করের মাপের কালো হলুদ ডোরাকাটা প্রাণীটির সাথে দেখা হল, তার নাম কোরোবোরি। জাতে ব্যাঙ হলেও এমন ছোট্ট ছানা রঙবেরঙের প্রজাতি দেখাই যায়না প্রায় আর কোথাও। ছোট্ট একটা কাচের বাক্সে তাদের প্রজনন করিয়ে টরোঙ্গা কর্তৃপক্ষ আবার তাদের ছেড়ে আসে জঙ্গলে। আগেই বলেছিলাম না, এরা শুধু চিড়িয়াখানা নয়, এরা প্রাণী সংরক্ষণের দায়িত্বেও যে নিত্য ব্রতী!
কোরোবোরিকে পিছনে ফেলে আরও একটু এগোতেই পৌছে গেলাম সরিসৃপদের দুনিয়ায়। গুহায় ঢোকার মুখে বড় বাঁধানো এক চাতালে তখন বসে দুপুরের রোদ পোয়াচ্ছে কোমোডো ড্রাগন— দৈর্ঘ্যে বড়সড় কুমিরছানার মতোই হবে কি তার থেকে ছোট তো নয়ই। পৃথিবীর বৃহত্তম এই টিকটিকিগুলি কিন্তু যথেষ্ট হিংস্র। তারা এক দল মিলে খেয়ে ফেলে আস্ত একটা মোষও। এরা কিছুটা ক্যানিবালিজম বা নিজের প্রজাতির মাংস খেতেও বিশেষ তৎপর প্রয়োজনে। এদের দাঁতে এত ব্যাক্টেরিয়া থাকে, পূর্ণবয়স্ক মানুষ বাঁচানোও বিপজ্জনক হয়ে পরে সময়ের অভাবে। নাঃ, টিকটিকিকে দেখছি মোটেই আর হেলাফেলা করা যাবে না!
আরও বেশ কিছু অদ্ভুত টিকটিকি তখনও অপেক্ষা করছিল আমাদের জন্য গুহার ভিতরে। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্যটি অবশ্যই ফ্রিলড্ লিজার্ড। গলার কাছে চামড়া কুঁচকে এক কিম্ভুত ফ্রকের ফ্রিলের মতো ফুলে থাকে এদের। প্রধানত শত্রুদের তফাৎ রাখতেই সৃষ্ট এই বর্ম। জানলাম, এটি অস্ট্রেলিয়ার ঘরের ছেলে একেবারে।
এমন আরও বেশ কিছু রয়েছে অবশ্য, যেমন গুলে মাছের মতো পিচ্ছিল শরীরের ল্যাণ্ড মূলেট, মাছের মতো আঁশওয়ালা সেইলফিন লিজার্ড, রাইনোসেরস ইগুয়ানা যে কেবল রোদ পেলেই “কোই মিল গয়া” ছবির অন্য গ্রহের থেকে আসা জাদুর মতো ছেলেমানুষি খুশি, অসাধারণ ক্যামোফ্লাজ বা রঙমিলান্তি সবুজ রঙের ইগুয়ানা আরও কত কী! এদের মধ্যে গিলা মনস্টার লিজার্ড কিন্তু ভালো রকম বিষাক্ত, তাই সাবধানের মার নেই; দেখেশুনে!
ক্যামোফ্লাজের কথাই যখন উঠল, এক্ষেত্রে পিছিয়ে নেই সাপখোপ, ব্যাঙ এমনকি কচ্ছপের নানান প্রজাতিও। সত্যিই, প্রকৃতির কী অসাধারণ ধৈর্য ভাব তো! একটা একটা করে শুধু নানাধরণের প্রাণীই বানায়নি, তাদের রক্ষণাবেক্ষণের এক আশ্চর্য খেলায়ও মেতে রয়েছে সে। এই যেমন ‘মাটা মাটা’। এটি একধরণের টার্টল যার খোলসটি দেখতে জলের তলায় পড়ে থাকা ময়লার মতো। বড় জন্তুদের দিব্যি দৃষ্টি এড়ানোও যায়, ছোটদের খাওয়াও যায় অতর্কিতে আক্রমণ করে। আবার সবুজ রঙের সাথে মিশে যাওয়াটা অনেক জন্তুরই বেশ পছন্দ, যেমন পাতার রঙের একরত্তি ব্যাঙ, ‘গ্রিন অ্যাণ্ড গোল্ডেন ফ্রগবেল’,সবুজ পাইথন ‘ব্যাসিলিস্ক’ ইত্যাদি।
অন্যরা আবার শুকনো ডালপালার সাথেই এক্কেবারে যায় মিশে। যেমন অস্ট্রেলিয়ার সবচেয়ে বড় সাপ অ্যামেথিস্টাইন পাইথন, পৃথিবীর ক্ষুদ্রতম পিগমি পাইথন, চোখের উপর সাদাটে পাতাওয়ালা আইল্যাশ ভাইপার প্রজাতি। অন্যান্য রঙের খেলাতেও পিছিয়ে নেই কিন্তু এরা। রেড বার্ড ড্রাগন, নিউজিল্যাণ্ডের অধিবাসী টুয়াটারা, সবচেয়ে বিষধর সাপ – ‘ইনল্যান্ড তাইপান’, ‘কার্পেট পাইথন’, রোদ যাতে ঠিকমত ঠাণ্ডা শরীরে ঢোকে — তাই কালো মাথাওয়ালা পাইথন, চ্যামেলিয়ন — সরীসৃপ হলে কী হবে, সবাই কিন্তু বেশ রঙচঙে!
রঙ তো হল, তবে রঙে কি আর সবসময় ভবি ভোলে? তাই পৃথিবীর সবচেয়ে ভারী সাপ সিনেমাখ্যাত ‘অ্যানাকোণ্ডা’ এঁকেবেঁকে শুয়ে পড়ে আস্ত একটা গাছ জুড়ে। সিনেমার মতো অত লম্বা না হলেও এদের ওজন ২৫০ কেজির থেকে কম হয় না সাধারণত আর চওড়ায় প্রায় ৪০ সেমি! সাধারণত জলের ধার বরাবরই এদের বাস।
আরও আছে। সবচেয়ে লম্বা ‘রেটিকিউলেটেড’ পাইথনের মানুষ গিলে খাওয়ারও অভিজ্ঞতা কিন্তু রয়েছে, এতটাই বৃহৎ তার খাদ্যনালী – ভাবা যায়! যেন গল্পগাথার দেশ থেকে উঠে এসেছে সবাই — তাই সবার এমন আলাদা আলাদা বিচিত্র বেশ!
তবে খারাপটা কোথায় লাগে জানো, এরা নিজেরা এত পরাক্রমশালী হয়েও এদের মধ্যে বেশিরভাগই আজ বিপন্ন। ভাবছ, ভালোই তো, এত কিম্ভুতকিমাকারদের না থাকাই তো ভালো। না গো, পৃথিবীর ভারসাম্য রক্ষার দায়িত্ব এদের সবার হাতে— ঠিক আমার তোমার মতোই। মানুষ কি আর একলা বাঁচতে পারবে গো? আমাদের অবহেলায় সবাই ফুরিয়ে গেলে কি আর আমরা বাঁচব বলো? ওদের কারও কারও হয়তো শরীরে বিষ আছে, কিন্তু আমাদের তো মনে— তাই সবাইকে নির্বংশ করার দায় নিয়ে ফেলি নিজেদের মতো করে। ভাবি, আমি তো শ্রেষ্ঠ — যা ইচ্ছা করব, তা কি হয়? সময় ঠিক এর দাম নিয়ে নেয় তাই নিজের মতো করে!
যাক, অনেক দরকারি তবে ভারী ভারী কথা হয়ে গেল। এবার বলি অন্য সব গল্প। গুহা থেকে বেড়িয়ে কয়েক পা গেছি কি যাইনি, ওমা, গলা উঁচু করে দাঁড়িয়ে রয়েছে জিরাফের দল ছড়িয়েছিটিয়ে। তাদের ঠিক পিছনে সমুদ্রের জল তখন রোদ পোয়াচ্ছে— তারও পিছনে জেগে রয়েছে সিডনির গোটা শহরটার স্কাইলাইন! ঘন নীল আকাশের ব্যাকগ্রাউণ্ডে দাঁড়িয়ে নিরীহ প্রাণীগুলোর পাতা চেবানো দেখতে দেখতেই কাটিয়ে দেওয়া যায় আস্ত একটা দিন, তা এতই নির্ভেজাল, প্রাণবন্ত! মনে পড়ে গেল, ছোটবেলায় শীতের ছুটিতে যখন আলিপুরের চিড়িয়াখানায় যেতাম, মা লুচি আলুরদম করে নিত। এই জিরাফের সামনেই চলত দেদার আড্ডা আর খাওয়াদাওয়া। তোমরাও কাটাচ্ছ তো মা বাবার সাথে হইচই করে তোমাদের এই নির্ভেজাল সময়টুকু? এর চেয়ে দামি কিছুই যে হয় না গো!
দেখলে, খাবারের কথা বলতেই ক্ষিদে পেয়ে গেল কেমন! অগত্যা টুকটাক মুখে দিতে ঢুকে পড়লাম রেস্তোরাঁয়। মজার ব্যাপার, এখানেও কিন্তু রয়েছে বড় ঠোঁটওয়ালা সাদা কালো আইবিস পাখি, একগাদা টার্কি, পায়রা, শালিক সব। যে-খাবারগুলো ফেলে দিচ্ছে মানুষ, তার লোভেই এদের হানা। এমনকি, আমাদের প্রিয় ময়ূরও তার পেখম নিয়ে বাইরে এইসব পাখিদেরকে তাড়া করে বেড়িয়েই পাচ্ছে আনন্দ। আসলে পুরো টরোঙ্গাই বড় মজার যেন আলাদা এক দেশ। যেখানে মানুষই নগণ্য – দ্বিতীয় শ্রেণীর আবাসিক।
এরপরের গন্তব্য পাঁচ মাস বয়সী ‘জেয় ডী’ অর্থাৎ নির্মল হৃদয়ধারীর সঙ্গে আলাপচারিতা সেরে আসার। মাত্র ‘দু’ বছর মায়ের পেটে বড় হয়ে ১৩০ কেজি ওজনে ভূমিষ্ঠ হয়েছিল এই হাতির শাবক। এখনও মা বাবা আগলে আগলে বেড়াচ্ছে তাকে। তবে তার দুষ্টুমি একটুও কমেনি এসবে। দড়িতে ঝোলা টায়ারের সঙ্গে যুদ্ধ চলেইছে তার সারাদিন। ছোট্ট শুঁড়ে দড়ি ধরে টান মারার তীব্র ইচ্ছা নিঃসন্দেহে খুব তাড়াতাড়ি আরও বড় করে দেবে তাকে— এটুকুই থাক সদ্যোজাতর জন্য আশীর্বাদ।
শিশু অবশ্য রয়েছে অন্য শিবিরেও। সেখানে মায়ের কোলে ঝুলে ঝুলেই কাটছে তার এই কয়দিন। মা কলা, ভূট্টা যা পাচ্ছে, তাই তার মুখে তুলে দিয়ে তারপর নিজে খাচ্ছে— আমাদের সনাতনী মায়েদের মতোই। তার লোমশ কালো একটা হাত অবলীলায় আগলে রেখেছে নতুন সদস্যকে তার কাঁখে। এটি হল গোরিলা শিবির — যেখান থেকেই এককালে হয়তো পথচলা শুরু মানুষেরও!
এতসবের মাঝেই অনেকক্ষণ ধরে ডাক শুনছিলাম নীচের জলজ শিবির থেকে। এবার আর সেই ডাক এড়ানো গেলনা। টুকটুক করে হাজির হয়ে গেলাম ‘সি লায়ন’ বা সিলের ডেরায়। প্রজনন কালে তো বটেই, খাবার দেখলে ও আরও নানান দরকারে ডেকে ওঠে এই তিনশো চারশো কেজির কালো চকচকে নিটোল অতিকায় বাসিন্দারা। তাদের প্রতিদিন সাত কেজি করে মাছের প্রয়োজন হয়— সত্যি কথাই তো, নাহলে কি আর অমন মনোহর চেহারা ধরে রাখা যায় নাকি – তোমরাই বলো! ডাঙায় জলে দুটিতেই তারা এতটাই স্বচ্ছন্দ যে নিমেষে এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত ছুটে বেড়ায় এরা। বুদ্ধিও খুব কম ধরে না কিন্তু— তাই প্রতিদিন নতুন নতুন খেলা দেখানোর ভার পরে এদের উপরেই। গরমে জলে ঝাঁপাঝাঁপি করেই অফুরান খুশি বিলিয়ে দেওয়ার কথাটিও তাই হয়তো লেখা থাকে তাদের নোটবুকেই!
সি লায়নের কথা যখন উঠলই, তখন তার প্রতিদ্বন্দ্বী পেংগুইনকে ভোলা যায় কি কিছুতেই? একশো বছরের পুরোনো ‘রাস্টিক’ ব্রিজের পাশ ঘেঁষে ইংরেজ আমলের পরিত্যক্ত হাতিশালা পেরিয়ে তাই সাঁতার কাটতে থাকা একরত্তিগুলোর সাথেও কাটিয়ে দিলাম আমরা বেশ কিছুটা সময়।
বেশীক্ষণ দাঁড়ানো হল না যদিও, বড় বড় গোল গোল চোখে বিস্ময় নিয়ে দৌড়ে বেড়ানো আফ্রিকার মিরক্যাট ইতিমধ্যেই চোখ টেনে নিল আমাদের। সবসময়ই প্রচুর তাড়া তাদের জীবনে। একজন এসে দাঁড়াতেই অন্যজন ছুটতে আরম্ভ করে দেয়— যেন ছোঁয়াছুয়ি খেলা চলছে পাড়ার মোড়ে বন্ধের দিন।
সব বেড়ালই অবশ্য এত বন্ধুবৎসল নয়। জংলি বেড়ালও তাই বাঘের মতোই নিজের এলাকা মেপে নেয় সবার আগে। গম্ভীর দৃষ্টিতে তাকায় জনতার দিকে— স্পষ্টতই বিরক্তি সেই অভিব্যক্তিতে! সত্যি তো, তার এলাকায় যে কিসের এত ‘যাতায়াত’ মানুষগুলোর!
বাঘের মাসির পর স্বয়ং বাঘমামাকেই দেখতে এবার পাড়ি সুমাত্রায়। সত্যি গো, একেবারে প্লেনের কেবিনে ঢুকে আকাশপথে কয়েক মিনিটেই পৌছে গেলাম ওদেশ! জঙ্গলের রূপই সেখানে অন্যরকম। তিন দুর্লভ প্রজাতির বাঘ বাঘিনী সেখানে ইতস্ততঃ নিজেদের মতো করে দণ্ডি কেটে আসীন। একটা জিপের মাথায় একজন দিব্যি বসে রোদ পোয়াচ্ছিলেন, টুক করে সেই জিপে ঢুকে তার ওম নিজেদের গায়েও টেনে নেওয়া কি চারটিখানি কথা নাকি! সে যে এক অনন্য অভিজ্ঞতা — এ জীবনে যা আর ভোলার নয়!
বিরল আরও অনেক কিছুই রয়েছে সেখানে। রেড পাণ্ডা, ছোট্ট পিগমি হিপোপটেমাস, সান বিয়ার, গাছে বসে থাকা ল্যাজওয়ালা ক্যাঙ্গারু আরও কত কি!
তাদের পেরিয়ে আকাশের দিকে তাকাতেই হল তবু এবার – যেখানে পরম যত্নে লালিত কাকাতুয়া,হাসিখুশি ‘কুকাবুরা’, ‘রেড লোরি’, ‘ডলারবার্ড’, দিনে জাগা পেঁচা, নানান প্রজাতির চিল, বিশাল পাখনামেলা কণ্ডোর বা শকুন, রঙবেরঙের টিয়া আরও কত নাম-না-জানাদের দল উড়ে বেড়ায় পরম নিশ্চিন্তে। এই খোলা আকাশই যে ওদের ঘর,আশ্রয়!পাখিরা কি শুধু নিজেরাই ওড়ে নাকি! ওড়ায় আমাদের বাসনাগুলোকেও বেঁচে থাকার রসদ পাওয়ার আশায়, তাই না তাদের এত তাড়া!
অন্য আরো এক চক্রবালে ঠিক সেই সময়ই হুপ হুপ লাফ দেয় ক্যাঙ্গারু বিকেলের পড়ন্ত আলোয়,ওয়ালাবি ঝিমিয়ে নেয় খানিক, ইউক্যালিপটাস গাছের গুঁড়িতে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়ে ধূসর রঙের কোয়ালা বিয়ার।
সুবিশাল এমুপাখিও গোলগোল চোখ পাকায় অবিশ্বাসে, বিস্ময়ে। জানো তো, কী বিচিত্র এই দেশ! এখানে ১৯৩০ সাল নাগাদ মানুষ আর এমুদের যুদ্ধ বেঁধে গিয়েছিল! ভাবছ রসিকতা! বেশ— গুগল সার্চ কোরো ‘গ্রেট এমু ওয়ার’ বলে তাহলেই দেখতে পাবে! শুধু যে যুদ্ধই হয়েছিল তাই নয়, একেবারে গোহারা হেরে গিয়েছিল অস্ট্রেলিয়ান আর্মি এমুদের দলের কাছে! হয়েছিল কী, এমুরা দল বেঁধে এসে চাষীদের সব ধান নষ্ট করে চলে যেত। তখন প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর এসেছে ‘গ্রেট ডিপ্রেশন’, সব জিনিসের দাম আকাশছোঁয়া — তার মধ্যে আবার এই বিপদ! অগত্যা আর্মি নামতে বাধ্য হল। কিন্তু এতটাই জোড়ে দৌড়তে পারে এই প্রাণী আর এতটাই সঙ্ঘবদ্ধও, শেষমেশ পিছিয়ে যেতে হল মানুষদেরই। নিজেদের জমির পাশে অ্যালুমিনিয়ামের বেড়া তুলে তবে গিয়ে শান্তি! এ যেন সেই জুতা আবিষ্কার – পুরো পৃথিবী ঢাকার বদলে পা ঢাকার গল্প।
এমনই হাজার গল্প বলা হয়তো বাকি ছিল নীল মাথাওয়ালা আরও এক লুপ্তপ্রায় রেইনফরেস্টের বৃহদাকার পাখি ‘ক্যাসোওয়ারি’র, যার পুরুষেরা রক্ষণাবেক্ষণ করে সন্তানের— বা ‘অ্যালড্যাবরা জায়েণ্ট’ কচ্ছপদ্বয়ের, যারা নিজেদের বুকে বয়ে চলেছে দেড়শো বছরেরও বেশি ইতিহাস—বা সাদা ছোপছোপ কালোমুখো ‘গিবন’বানরের, যে শুধু অসহায় ভাবে তাকিয়েই থাকে মুখের দিকে হয়তো কিছু খুঁজে পাওয়ার আশায় —কিংবা জংলী লাল মোরগের, যে বসে তা দিতে থাকে ডিম ফোটার অপেক্ষায়।
শোনা হল না কিছুই ফেরার তাড়ায়। শেষবারের মতো রোপওয়েতে যখন চেপে বসলাম ফেরিঘাটের উদ্দেশ্যে, আকাশের কোনায় জমে ওঠা একটুকরো কালো মেঘ দেখে পেখম মেলে দিয়েছে রেস্তোরাঁর বাইরে ঘুরে বেড়ানো সেই ময়ূর, একনাগারে ডেকেই চলেছে সিলমাছেরা, আর ছোট্ট ‘জেয় ডী’ হাতির ছানা নিশ্চিন্তে খেলে বেড়াচ্ছে জলের ধারে সাঁঝবেলার অপেক্ষায়।
একেই কি বলে ‘বেশ থাকা!’ তাই হবে! কে জানে! বারো মিনিটের যাত্রাপথে আবার যে ফিরে চললাম যান্তব দুনিয়ার হাতছানিতে। পেছনে সবুজ পাহাড়িয়া জঙ্গলেই আঁকা রয়ে গেল সেই ‘সুন্দর দৃশ্য’ আরও একবার নিঃসঙ্গ কোনো তুলির টানে!