আগের পর্ব এই লিংকে-ইজরায়েল-১, ইজরায়েল-২, ইজরায়েল-৩
অভীক দত্ত
বৃহদাকার প্রতিবেশীরা চতুর্দিকে ঘিরে রেখেছে পুঁচকে দেশ ইজরায়েলকে। দেশের মাঝবিন্দু থেকে মোটামুটি যেদিকে খুশি ঘন্টা দুতিন গাড়িসফরেই কোনো না কোনো কাঁটাতার খুঁজে পাওয়া যায়। উত্তরে লেবানন, পূর্বে জর্ডন আর প্যালেস্টাইন, দক্ষিণে মিশর। পূর্বদিকের প্রায় গোটাটাই ভূমধ্যসাগরের বেলাভূমি।
উত্তরদিশায় এক শহর নাহারিয়া। গাতোন নামে এক ক্ষীণস্রোতা নদী তাকে দ্বিধাবিভক্ত করে সাগরে মিশেছে। হিব্রুভাষায় নদীকে বলে নাহার (নহর/ লহর এর সাথে অদ্ভূত ভাষামিতালী )। তাই শহরের নাম নাহারিয়া। শহরের ধার ঘেঁষে সাড়ে তিনহাজার বছর আগেকার এক সিটাডেল বা কেল্লা। খিরবেত কাবরাসা। প্রাচীন বন্দর শহরের প্রাচীন জনপদ আজ শুধুই ধ্বংসস্তূপ। অটোমান সাম্রাজ্যের হাতছাড়া হয়ে ইজরায়েলের ভূমিখণ্ড ব্রিটিশ অধিকারে এল যখন, শহরের ঠাঁই বদল হলো পুরোনো কেল্লা থেকে দূরে, আজকের নাহারিয়ায়।
নাহারিয়ায় যে বাসাটি ভাড়া করা ছিল আগে থেকে- সেটাকে বাসা বললে মারাত্মক রকম অতিশয়োক্তি হয়। বাসা মালিকের নাম ডেভিড। অনেক ঝঞ্ঝাটের পর তাকে এবং তার বাড়িটিকে খুঁজে পাওয়া গেলে সে অম্লানবদনে দেড়খানা সাংঘাতিক নোংরা আর অগোছালো ঘর দেখিয়ে বললো- আই গিভ ইউ ডিসকাউন্ট। রুম ভেরি গুড, নো? পরে আবার আবিষ্কার হল, বাথরুমের দরজায় ছিটকিনি নেই। প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে গেলে গান গাইতে থাকতে হবে সারাক্ষণ। হেরাফেরি সিনেমার পুনরাভিনয় একেবারে।
শহর থেকে ১০ কিলোমিটার গেলে , লেবানন বর্ডারের থেকে ঢিলছোঁড়া দূরত্বে রোশ হানিকরা। সাগরজলের গা ঘেঁষে চকপাথরের টিলা আর প্রাকৃতিক গুহা। টিলার উপর থেকে কেবল-কার করে নামতে নামতে দেখা যায় মর্মরসফেদ পাথরের গায়ে এসে আছড়ে পড়ছে অলৌকিক সব নীলরঙা ঢেউ। কেবল-কারের লাইনে দাঁড়িয়ে মোলাকাত স্ট্রিট এন্টারটেইনার এক মহিলার সঙ্গে।( উই নো বেগারস , উই স্ত্রিত এন্তারতেনার্স। ইউ ইন্দিআন্স ভেরি গুড। মোদী ভেরি গু্ড।)
সম্ভবত যৌবনে কাসৌলে গঞ্জিকাসেবনার্থ বেশ কিছুদিন কাটিয়ে, সে ভদ্রমহিলা অকালবার্ধক্য এবং অল্পবিস্তর হিন্দি জ্ঞান লাভ করেছেন। জয়দীপগৃহিনী অণিমাকে দেখে গদগদ হয়ে সে দেখি বলে- দিদি, বহুত সুন্দর। দিদি আচ্ছা হ্যায়। কিন্তু সেতো আর বাঙালী চেনে না। একটি পয়সাও যখন কারো হাত দিয়ে গলল না, সে সম্ভবত বিড়বিড় করে হিব্রুতে গাল দিতেদিতেই চলে গেলো।
নীচে নেমে কন্দরপথে যাওয়ার বন্দোবস্ত। অনন্য সে অভিজ্ঞতা। পিচ্ছিল সুড়ঙ্গের ধার ঘেঁষে রেলিং বসানো। মাঝে মাঝে এদিকওদিক দিয়ে গুহাপথ গিয়ে নেমেছে সমুদ্রখাঁড়িতে। সেখানে শ্যাওলাধরা পাথর আর নীলবসনা সাগরজলের ঘরবসত। উপরে লাইমস্টোনের খিলান তাদের নিশ্চিন্ত আশ্রয় দিচ্ছে ইতিহাস শুরুর দিন থেকে।
চারদিকে কেবলই শিশুপাল। মানে পাল পাল শিশু। তাদের আনন্দের যোগান দেওয়ার জন্যেই বোধকরি রোশ হানিকরা ট্যুরিজম অথরিটি দুই মক্কেলকে ডেভিড আর গোলিয়াথ সাজিয়ে রেখেছে। ডেভিড আর গোলিয়াথ দুজনেরই পোশাক আর মেকাপের অবস্থা ঢিলে। ডেভিডের দাড়ি সোনালী করার চক্করে যে রং তার মুখে মাথায় মাখানো হয়েছে- তা উঠে আসে আসে। ফাঁকফোকড় দিয়ে তার রুক্ষ চামড়া আর খোঁচা খোঁচা বাদামী দাড়ি স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। পরচুলটির অবস্থাও করুণ। গোলিয়াথ আড়েবহরে গোলিয়াথ সমান হলেও গলার স্বরটি তার বিশ্বাসঘাতকতা করে বসেছে। রিনরিনে গলায় সে জানাল ইন্ডিয়ানরা খুবই ভালো, সে সমস্ত ইন্ডিয়ান বিশেষত মোদীকে বেজায় ভালোবসে।
গোলিয়াথের নাম আখেন। নিচের গ্রামে সে তার মাকে নিয়ে থাকে। সকালে ট্যুরিস্টদের মনোরঞ্জন করে আর বিকেলে নাহারিয়া বিচে পিৎজার দোকান সামলায়। একটা সিগারেট অফার করায় ভারী খুশি। চোখ বুজে আরাম করে সিগারেট খেতেখেতে মাথার হেলমেট সামলাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। হেলমেটের চুড়োটিতে পালকের বদলে যে ঝাড়ুর মাথাটি লাগানো, সেটা খুলে এসেছে।
রোশ হানিকরা তিন কিলোমিটার রাস্তা পাহাড়ে চড়লে কেশেত গুহা। গুহার অবশিষ্ট যেটুকু সেটুকুই এখানকার প্রধান আকর্ষণ। টিলাশীর্ষে একটি অর্ধচন্দ্রাকৃতি খিলান। কিংবদন্তি বলে একদিন এই গুহা ডাকাতদের ডেরা ছিল। সৎপথে ফিরে আসতে চাওয়ায় তারা এক বেরাদরকে ত্যাগ করে। তখন ঈশ্বরেচ্ছায় সে লোকটি যেখানে দাঁড়িয়েছিল সেই স্থানটি ছাড়া বাকি গুহার ছাদ হুড়মুড়িয়ে বাকিদের মাথায় ভেঙে পড়ে। ইজরায়েলি রত্নাকরটির দাঁড়ানোর জায়গাটিই এই আর্চ হয়ে রয়ে গেছে আজও। সেখান থেকে অতি উৎসাহীরা কোমরে দঁড়ি বেঁধে নিচে নামে। সেখানে দাঁড়ালে দেখা যায় অনেক নীচে পশ্চিম গ্যালিলি তার সবখানি সৌন্দর্যের ডালি নিয়ে পসরা সাজিয়ে বসেছে।
বিকেল হয়ে আসছে, আকাশে মনখারাপের রং। তীব্র তীক্ষ্ণ হাওয়ায় এলম আর অলিভ গাছগুলি কাঁপছে। এই হাওয়া পাঁচহাজার বছর ধরে এমনি তীব্র ঝাপটায় উড়িয়ে নিয়ে গেছে রুক্ষ এই মাটির ইতিহাস, তার মানুষের গল্প, তাদের শরীরের ঘ্রাণ।ভাঙা এবং গড়া। মানুষের ইতিহাস ভাঙাগড়ার গল্প। সে গল্প ইজরায়েলেই বুঝি সবথেকে বেশীবার বলা হয়েছে।
পরদিন আক্ৰ বা আক্কো। ইতিহাসের ভাঁড়ারঘর। সে গল্প পরে।