এর আগে, অংশুমানের কলমে কেনিয়ার পাখি
অংশুমান দাশ
কেনিয়া যাওয়ার ঠিক আগে আগেই সারা দেশ জুড়ে চলছিল বিচিত্র বর্ণ বিদ্বেষী কাজ কারবার। আফ্রিকার মানুষজন নাকি সবাই অপরাধ জগতের সঙ্গে যুক্ত – এই যুক্তিহীন ধারণার উপর বিশ্বাস করে আমাদের দেশে পড়তে আসা, কাজ করতে আসা আফ্রিকানদের হেনস্তা হতে হচ্ছিল। আমি ভাবছিলাম কেনিয়া, ইথিওপিয়া, বুরকিনা ফাসোয় আমার বন্ধুদের মুখ দেখাবো কী করে।
জর্জ আমার ছাত্র আর বন্ধু। বরাবর গম্ভীর – এয়ারপোর্টে আমাদের দেখে যেরকম লাফালো মনে হল আমি যেন আমার নিজের দেশে ফিরলাম। ঠিক তেমনই আদর পেলাম জর্জের বাড়ি। জর্জের বাড়ি অনেক লোক – মা, দাদা, বৌদি, অনেকগুলো বাচ্চা – অনেক মাসিমা, মেসোমশাই।
পরে বুঝলাম, এইসব দারুণ হাসিখুশি হৈহৈ মানুষজনের কিছু পাড়াতুতো, কিছু বাড়িতুতো। সবাই নিজের। সবাই বড়সড় চেহারার – হা হা করে হাসেন আর মাথায় কোঁকড়া ঘন চুল । জর্জের মা সবাইকে ডেকেছেন – আর রান্না করেছেন এতো এতো – গরুর মাংসের সুরুয়া, ছাগলের একটা গোটা পায়ের রোস্ট – যাকে বলে ‘ন্যামাচমা’। আর বাঁধাকপির স্যালাড আর পরোটা। পরোটাটা দিব্বি এদেশীয়।
রান্নাঘরে বাসন বলতে বিশাল বিশাল ডেকচি, আর প্রচুর কাপ – ছোট বাসন নেই কিছু। বোঝা গেল, এইরকম পাড়া-খাওয়ানো লাঞ্চ-ডিনার হয় প্রায়শই। আর এই হলো জুনিয়র জর্জ। আমার ছেলে উজান যাকে ছেড়ে আর নড়ে না।
একজন ছিলেন জর্জের মাস্টারমশাই – কী চমৎকার তাঁর ইংরেজি! তিনি এবং তাঁর স্ত্রী, দুজনেই সত্তরের কোটায়। আফ্রিকায় প্রত্যন্ত গ্রামে বসে এরকম ইংরেজি শুনে তো আমি অবাক। খবর পেলাম, যেহেতু কেনিয়ায় ছিল ব্রিটিশ কলোনি, তারা জোর করে শিখিয়েছে ইংরেজি। জর্জ আদতে কৃষক, নিজের খাবার নিজেই উৎপাদন করেন। তাঁর ক্ষেতের একধারে সিনিয়র জর্জের সমাধি – সেই সমাধির উপরেই জর্জের বাড়ির বাগান। জর্জের বোন নাইরোবি থেকে এসেছে আমাদের সঙ্গ দিতে।
সকাল থেকেই জর্জের মা এর রান্নাঘরে টুকটাক খুটখাট। জর্জের মা-এর যত নাতিনাতনি, সব হাজির যেখানে যা আছে সব নিজেরাই ঘেঁটেঘুঁটে খেয়েদেয়ে যাবে সব স্কুলে। আর জর্জের মা বসাবেন একহাঁড়ি দুধ, তাতে দেবেন দু চামচ চা-পাতা, আর সেই দুধ সবাই খাবে চা ভেবে।
আমাদের সঙ্গে ঘুরলেন আর কেনিয়া ঘোরালেন মাচারিয়া। সঙ্গে তার ছাদ খোলা গাড়ি, ব্যারিটোন গলা, শক্তপোক্ত শরীর, আর অসম্ভব ভালোবাসা জন্তুজানোয়ারদের উপর আর প্রবল দায়িত্ববোধ। কিছুতেই ৬০ কিমি প্ৰতিঘন্টার উপর গাড়ি চালাবেন না কারণ তা নিয়মবিরুদ্ধ। হাতের তালুর মত জঙ্গল চেনেন মাচারিয়া। বড়দার মত উনি ছিলেন বলে কেনিয়ার প্রতিটি মুহূর্ত আমরা চেটেপুটে নিয়েছি। অতি যত্নের সঙ্গে বুঝিয়েছেন কেনিয়ার সাধারণ মানুষজনের জীবনযাত্রা, হেঁশেলের খবর ও খাবার। ভীষণ দাম সাধারণ জিনিসের। হিসাব করে দেখা গেল, বাড়িতে রান্না করে খেলে একেকবারের খাবারে একজনের খরচ প্রায় ২০০ ভারতীয় টাকা।
মাসাইমারা জাতিটাই একটি জীবন্ত রূপকথা । সিংহের মুখের উপর দিয়ে এই লম্বা লাল চাদর পড়া মানুষগুলি গরু নিয়ে নিয়ে ঘুরে বেড়ান। কি সুন্দর স্প্রিংয়ের মত লাফিয়ে লাফিয়ে নাচেন, চাদ-সিংহ-সূর্যের গান করেন বিচিত্র আওয়াজে। আলাপ হলো ডেভিডের সঙ্গে – এদের সবারির একটা কঠিন নাম আছে অবশ্য। ডেভিডের সঙ্গে গেলাম মাসাইমারা মেয়েদের একটা স্কুলে। সেখানে মালিনী শোনালো গুপী গাইন বাঘা বাইন-এর গল্প – ভীষণ খুশি তারা, গান শোনালো আমাদের। ভীষণ সপ্রতিভ বাচ্চা সব, অন্যতম আদিম জাতির সদস্য হলেও সেই ঐতিহ্যের সঙ্গে সঙ্গে দেশ বিদেশের আধুনিকতম ঘটনার সঙ্গে সমান পরিচিত তারা। মাসাইদের লাল চাদর জড়িয়ে তাদের আঁকা ছবির সামনে ছবি তুললাম আমরাও। যতদূর দেখা গেল, তারা হাত নাড়তেই থাকল। গল্পেরও দেশ নেই, গানেরও।
কেনিয়ার সবাই খুব বন্ধুবৎসল, বিশেষত ছোটদের সঙ্গে। সে নৌকা নিয়ে ঘোরানোই হোক,কিংবা ছিপে মাংসের টুকরো গেঁথে মাছ ধরা – সব কাজে তারা একগাল হাসি নিয়ে প্রস্তুত, বিরক্তি নেই একটুও। মধ্যরাতে ক্যামেরা চার্জার কাজ করছেনা, ভগবানের মতো হাজির কেউ – বাড়ি থেকে চার্জার এনে বলে – ‘রেখে দাও, আমার কোনো কাজে লাগছেনা’। কোথাও মনে পড়েনা হোটেল আর তাঁবুর দরজায় তালা দিয়েছি।
ছদিনের জন্য সফর সেরে যখন জর্জের বাড়ি ফিরে এলাম, উজান বললো – ‘বাপি, অনেকদিন পর যখন বাড়ি ফিরে আসি, যেমন ভালো লাগে – এখন তেমন লাগছে’।
কোথায় দেশ, কোথায় বাড়ি – বাড়িতো সেটাই, যেখানে আমার ভালো লাগে। যেখানে ক্লান্ত হয়ে ফিরলে দেশি মুরগির রোস্ট অপেক্ষা করে। আর জর্জ জড়িয়ে ধরে এয়ারপোর্টে ফেরার আগে, আমাদের গলা বুজে আসে। গায়ের রং দেশের সীমানা – এসব তো মানুষের বানানো দেয়াল। কবে যে এসব মুছে যাবে আমাদের দেশ থেকে, আমাদের পৃথিবী থেকে!
চমৎকার।
LikeLike