আরো নদীর গল্প-—– পাহাড়ের কান্না-মেঘনা নদী ,পদ্মানদীর গল্প , দুরন্ত মেয়ে সুরমা , নদীর গল্প-ব্রহ্মপুত্রের পৃথিবী ভ্রমণ
কর্ণফুলীর দিনরাত্রি
মীম নোশিন নাওয়াল খান
অনেক-অনেকদিন আগের কথা। মেঘের উপরে একপাশে ছিল দৈত্যদের রাজ্য, অন্যপাশে পরির রাজ্য। একবার দৈত্যদের রাজ্যে যুদ্ধ লাগল। সে কী ভয়ংকর যুদ্ধ! দৈত্যরা এক দল অন্য দলের দিকে ইয়া বড়ো বড়ো ধারালো তির ছুড়তে লাগল। সেই তিরগুলো ছিল অনেক অনেক বড়ো।
তির ছোড়াছুড়ির সময় একটা তির আকাশ থেকে পড়ে গেল। সেই তিরটা সাঁই করে এসে বিঁধে গেল একটা পাহাড়ের গায়ে। সেই পাহাড়টা হচ্ছে ভারতের লুসাই পাহাড়। গায়ে তির বিঁধে পাহাড়টা খুব ব্যথা পেল। যন্ত্রণায় সে চিৎকার করে কাঁদতে শুরু করল। কিন্তু ব্যথা তো আর কমে না। তিরটা ফুটেই রইল তার গায়ে।
পাহাড়ের কান্নার শব্দ পেয়ে পরিরাজ্য থেকে একজন পরি জিজ্ঞেস করল, “কী হয়েছে, লুসাই? তুমি এভাবে কাঁদছ কেন?”
লুসাই পাহাড় কাঁদতে কাঁদতে বলল, “দেখো, দৈত্যদের ছোড়া তির আমার গায়ে এসে বিঁধেছে। আমার খুব কষ্ট হচ্ছে। খুব ব্যথা করছে। তিরটা আমি ছোটাতেও পারছি না।”
পরিটার খুব কষ্ট হল পাহাড়ের জন্য। সে আরও অনেক পরিকে নিয়ে গিয়ে জাদু দিয়ে পাহাড়ের গা থেকে তিরটা ছুটিয়ে দিল। কিন্তু তির বের করে দেয়ার পরেও পাহাড়ের গায়ের যন্ত্রণা কমল না। বরং তার যেখান থেকে তিরটা ছোটানো হয়েছে সেখানে একটা বিরাট বড়ো ফুটো হয়ে গেল। নিজের এই অবস্থা দেখে পাহাড়টা চিৎকার করে কাঁদতেই লাগল। পরিরা তখন পরিরানিকে গিয়ে বলল পাহাড়ের দুঃখের কথা। রানি বললেন, “ঠিক আছে। আমি দেখছি।”
পরিরানি পাহাড়কে দেখতে এলেন। পাহাড় বলল, “দেখুন রানিমা, আমার গায়ে ফুটো হয়ে গিয়েছে। আমি দেখতে কদাকার হয়ে গিয়েছি।”
রানি বললেন, “আমি তো ফুটোটা বন্ধ করতে পারব না পাহাড়, তবে আমি তোমাকে অন্যভাবে সাহায্য করতে পারি।” এই বলে রানি পাহাড়ের গায়ের ওই ফুটো থেকে একটা নদী তৈরি করে দিলেন। পাহাড়কে বললেন, “দেখো লুসাই! তোমার গা থেকে কী সুন্দর কুলকুল করে একটা নদী বইছে! এখন আর তোমার গায়ের ফুটো দেখা যাবে না। বরং এই নদীটার জন্য তোমাকে আরও অনেক বেশি সুন্দর দেখাচ্ছে।”
লুসাই পাহাড় তখন কান্না বন্ধ করে শান্ত হয়ে নিজের দিকে তাকাল। নিজেকে দেখে সে নিজেই মুগ্ধ হয়ে গেল। আরে! নদীটা এত সুন্দর!
এই নদীটাই হচ্ছে কর্ণফুলী।
তবে তার নাম কিন্তু কর্ণফুলী ছিল না। পরিরানি বা লুসাই পাহাড় নদীটার কোনও নাম দেয়নি। নদীটা মিজোরামের মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। মিজোরামের লোকেরা ওর নাম দিয়েছিল খাওৎলাং তুইপুই। তারপর ওর নাম কীভাবে কর্ণফুলী হল জানো?
একবার আরাকানের এক রাজকন্যা চট্টগ্রামের এক আদিবাসী রাজপুত্রকে ভালোবেসে ফেলে। এক জ্যোৎস্নারাতে তারা দু’জন এই নদীতে নৌকা নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছিল। রাজকন্যার কানে গোঁজা ছিল খুব সুন্দর একটা ফুল। রাজকন্যা যখন মুগ্ধ হয়ে নদীর পানিতে চাঁদের প্রতিফলন দেখছিল, তখন হঠাৎ ফুলটা পানিতে পড়ে যায়। রাজকন্যার খুব মন খারাপ হয়। সে একমুহূর্ত অপেক্ষা না করে পানিতে ঝাঁপ দেয়। কিন্তু প্রবল স্রোত রাজকন্যাকে ভাসিয়ে নিয়ে যায়। তাকে বাঁচাতে রাজপুত্রও পানিতে ঝাঁপ দিয়েছিল, কিন্তু রাজকন্যাকে খুঁজে পায়নি। তাই সে পানিতে আত্মাহুতি দেয়।
এভাবেই তাদের রূপকথার গল্পের করুণ সমাপ্তি হয়। আর তখন থেকেই এই নদীটার নাম হয় কর্ণফুলী।
কর্ণফুলী নদীটা লুসাই পাহাড়ের গা বেয়ে নেমে ভারতের মিজোরাম থেকে চলতে চলতে বাংলাদেশের রাঙামাটি জেলায় এসে ঢুকল। রাঙামাটির বরকল উপজেলার ঠেগামুখ এলাকা দিয়ে সে বাংলাদেশে ঢুকে পড়ে। কিন্তু সে আসলে বাংলাদেশে যাবে, নাকি ভারতে থাকবে, সেটা সে বুঝে উঠতে পারল না। তাই এখান থেকে বড়ো হরিণার মুখ পর্যন্ত কর্ণফুলী ভারত আর বাংলাদেশের মাঝখান দিয়ে চলতে থাকল। সেজন্য কর্ণফুলীকে বলা হয় আন্তঃসীমান্ত নদী।
কর্ণফুলী নদী রাঙামাটিতে একটা দীর্ঘ শাখা বিস্তৃত করে ধুলিয়াছড়ি এবং কাপ্তাইয়ে আরও দুটো শাখায় বিভক্ত হল। রাঙামাটি এবং ধুলিয়াছড়ির শাখাদুটো আবার একসাথে হয়ে এখন কাপ্তাই হ্রদের সঙ্গে মিলেমিশে একাকার হয়ে আছে।
কিন্তু এইটুকু ঘুরে তো কর্ণফুলীর মন ভরল না। তাই সে কাপ্তাই শাখা থেকে বেরিয়ে আরও চলতে লাগল। এবার সে সীতাপাহাড় পর্বতমালার ভেতর দিয়ে চলতে লাগল। তারপর চন্দ্রঘোনার কাছে পাহাড়ি অঞ্চল দিয়ে বেরিয়ে চট্টগ্রাম জেলার সমতল ভূমিতে এসে নামল।
কর্ণফুলী তার ইচ্ছেমতো চলছিল। কিন্তু তার কাপ্তাইয়ের অংশে বাঁধ দেয়া হল। ফলে তার মূল চলার পথটা তাকে পালটে ফেলতে হল। বাঁধের উত্তর পাশে রইল কাপ্তাই লেক, আর দক্ষিণে মূল কর্ণফুলী নদী।
কাপ্তাইয়ে কর্ণফুলী নদীর উপর বাঁধ দেয়া হয়েছিল জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র তৈরি করার জন্য। এই বিদ্যুৎ কেন্দ্রের নাম ‘কর্ণফুলী পানি বিদ্যুৎ কেন্দ্র’। রাঙামাটির কাপ্তাই উপজেলায় কর্ণফুলী নদীর উপর নির্মিত এই বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি আমাদের দেশের একমাত্র পানি বিদ্যুৎ কেন্দ্র।
কাপ্তাই লেকের অংশ থেকে স্পিলওয়ে দিয়ে পানি ছাড়া হল। তাই কর্ণফুলী একটু পূর্বদিকে গিয়ে নতুন চলার পথ তৈরি করে নিল। সেখান থেকে কাপ্তাইর ব্রিক-ফিল্ডের পাশ দিয়ে সেগুনবাগান হয়ে নতুন বাজার, চিৎমরম, শিলছড়ি, রামপাহাড়, সীতাপাহাড়, বড়ইছড়ি, ডলুছড়ি, নারাণগিরি ও চন্দ্রঘোনা কর্ণফুলী পেপার মিল পর্যন্ত ১০ কিলোমিটার গতি পথে সাত ধাপে আঁকাবাঁকাভাবে কর্ণফুলী তার গতি পরিবর্তন করেছে। বড়ইছড়ি ও নারাণগিরি খালের মুখ থেকে চন্দ্রাকৃতির বাঁক নিয়ে পশ্চিমের ভাটির দিকে সোজাসুজি ৫ কিলোমিটার গিয়ে সে গড়িয়ে পড়ে রাঙ্গুনিয়ার চন্দ্রঘোনা কদমতলীতে।
চন্দ্রঘোনায় কর্ণফুলী নদীর তীরে নির্মিত হল রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন কাগজের কারখানা ‘কর্ণফুলী পেপার মিলস লিমিটেড’। এটি দেশের সর্ববৃহৎ কাগজ উৎপাদনকারী কারখানা।
এই চন্দ্রঘোনায় এসে কর্ণফুলী নদীর দেখা হল পাহাড়ের সঙ্গে। পাহাড় আর নদী মিলে অপরূপ সুন্দর দৃশ্য তৈরি করল। নদীটা পাহাড়ের সঙ্গে গল্প করল, হাসল, খেলল। তারপর সে আবার পথ চলতে লাগল। কিন্তু ডান তীরে চন্দ্রঘোনার মধ্যম কদমতলী ও বাম তীরে কোদালা চা-বাগানের মধ্যখানে এসে জেগে ওঠা বিশাল চর তাকে আটকে দিল। তাকে আবার তার চলার পথ পাল্টাতে হল। এদিক-সেদিক দিয়ে ঘুরতে ঘুরতে নদীটা বোয়ালখালির সীমান্তবর্তী নাজির চরে এসে হাজির হল। এখান থেকে আবার কর্ণফুলী অনেক এলাকা ঘুরল। ঘুরতে ঘুরতে তার কিছু এলাকার উপর রাগ হল। সেই এলাকাগুলোকে সে তখন ভেঙে ডুবিয়ে দিল তার পানিতে। ঐতিহ্যবাহী চৌধুরীর হাটকে এভাবেই কর্ণফুলী টুপ করে ডুবিয়ে দিয়েছে।
কর্ণফুলীর চলার পথে তার সঙ্গে দেখা হল হালদা নদীর। হালদার সাথে একটু গল্পগুজব করে সে আবার চলতে লাগল।
কর্ণফুলী অনেক পথ চলেছে, অনেক এলাকা ঘুরেছে। তার বুকের উপর দিয়ে মানুষ সেতু তৈরি করেছে। এমন একটা সেতু হচ্ছে ‘শাহ আমানত সেতু’। শাহ আমানত সেতু পেরিয়ে কর্ণফুলী তৈরি করেছে তার নিজের রাজ্য। তার দুই পাড়ে কত কোলাহল, তার বুকে ভেসে বেড়াচ্ছে কত বড়ো বড়ো বড়ো নৌকা-জাহাজ-সাম্পান!
কর্ণফুলী মানুষের দুঃখ দেখেছিল। দেখেছিল কীভাবে ঠাসাঠাসি করে এই দেশে সবাই বসবাস করে। দেখেছিল এখানে ফসলি জমি নিয়ে কত কাড়াকাড়ি। তাই সে চলার পথে কোথাও কোথাও চর জাগিয়ে দিল। সেসব চরে মানুষ আবাস গড়ল, চাষাবাদ করল। এগুলোর মধ্যে আছে চর খিজিরপুর, ইমামল্লার চর, চরলক্ষ্যা, চরপাথরঘাটা, মনোহরখালি, পতেঙ্গা ইত্যাদি।
এমন করে গৌরবের সঙ্গে চলতে চলতে চট্টগ্রাম শহর থেকে ১৭ কিলোমিটার সম্মুখে কর্ণফুলীর দেখা হল বঙ্গোপসাগরের সঙ্গে। কর্ণফুলী তখন লুসাই পাহাড় থেকে ৩২০ কিলোমিটার পাড়ি দিয়ে এসে খুব ক্লান্ত। সে সোজা ঝাঁপিয়ে পড়ল সমুদ্রের বুকে। সমুদ্র তাকে পরম যত্নে নিজের কাছে টেনে নিল। আর সমুদ্রের কোলে অন্যসব নদীদের সঙ্গে আড্ডা-গল্প-গানে কাটতে লাগল কর্ণফুলীর দিনরাত্রি।
খুব সুন্দর
LikeLike