বিশ্বের জানালা ইজরায়েলের ডায়েরি দ্বিতীয় পর্ব অভীক দত্ত বসন্ত ২০১৮

আগের পর্ব এই লিংকে-ইজরায়েল-১

পর্ব – ২

Untitled3

অভীক দত্ত

একবার খোলা বাজারে গিয়ে পড়লে ইন্ডিয়া আর ইজরায়েলে বিলকুল তফাত থাকে না। তেল আভিভের কারমেল মার্কেট চত্বরে সেকথা অক্ষরে অক্ষরে মালুম পড়ল। কিন্তু সে গল্প পরে।

আগের দিন রাশিয়ান কানেকশন নিয়ে কথা বলছিলুম।  ল্যাব জয়েন করে দেখি, আমার সাথে এসে জুটেছে এক রাশিয়ান ছোকরা। বায়োলজিক্যাল ফুয়েল সেল প্রজেক্টের বায়োলজির দায়িত্ব তার (ভাগ্যিস তার, বায়োলজিতে আমি বরাবরই দিগগজ। সারাদিন পড়ার পরেও খালি একখানাই  বিজ্ঞানসম্মত নাম মনে থাকত। কাতলা কাতলা। বোঝাই যাচ্ছে ব্যাপারখানা।)। ছোঁড়ার নাম শ্মুয়েল রোজ। সাবেক ইউএসএসআর-এর পতনের পর বাপ-মা মালপত্তর গুছিয়ে এসে ওঠেন ইজরায়েলে। জেনে চমৎকৃত হলুম, শ্মুয়েলের আদি বাড়ি সমরখন্দ। বাবা তার উজবেক, মা কিরঘিজ। পিরিমকুল কাদিরভের কথা শুধোলুম তাকে। ছোকরা নরেন্দ্রভাইয়ের থেকেও উমদা ইংরেজিতে বলে, “আই নো উজবেক। মাই ড্যাডি উজবেক। আই ফ্রম ইজরায়েল।” নিয়তির করুণ পরিহাস। সমরখন্দের এক সন্তানের কাছে এসে দাঁড়িয়েছিল কাদিরভের বাবর পড়ে বড়ো হয়ে ওঠা ভারতের এক ছেলে।  ইতিহাসের গ্রন্থি মহাকালের অঙ্গুলি হেলনে ছিন্ন হয়েছে বহুদিন। উজবেক পিতা আর কিরঘিজ মাতার সন্তান সোভিয়েতের ধ্বংসস্তূপ পিছনে ফেলে এসে আজ শুধুই ইজরায়েলি। ভাষা তার হিব্রু। কাদিরভ বা চিঙ্গিজ আইতমাতভ তার অচেনা। কিরঘিজিয়ার স্তেপ, সমরখন্দ-বোখারার ইতিহাস তার সন্তানদের ধরে রাখতে পারেনি। কোনও বাবা-মাই পারেন না বোধ করি।

Untitled-7.jpgইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাস পাহাড়ের উপর। রোজ এতখানি চড়াই-উৎরাইতে বাঙালি ভুঁড়ির ঝরে যাওয়ার আশঙ্কা প্রবল। মন ভালো হয়ে যায় ক্যান্টিনের লাগোয়া চওড়া টেরাসটিতে গেলে। সুপরিকল্পিত শহরনির্মিতির ৩৬০ ডিগ্রি দৃশ্যপট তার ঝকঝকে উপস্থিতি নিয়ে মুহূর্তে হাজির। ক্যান্টিনকর্মীদের ইংরেজি-জ্ঞান কিছু বেশিমাত্রায় কম। অগত্যা ইশারা-ইঙ্গিতে, অঙ্গুলি নির্দেশে খাবার বেছে নিতে হয়। একদিন এক পাটকিলে রঙের ঝোলে দেখি চৌকো চৌকো মাংসের টুকরো আর সেদ্ধ সবজি ভাসছে। জিজ্ঞেস করে জানলুম, সেটি গুলাশ। মধ্য ইউরোপের এই ডেলিকেসিটির কথা পড়েইছি অ্যাদ্দিন। খেয়ে বোঝা গেল, কিছু পরিচয় নিকট না হলেই বরং ভালো। হাসিখুশি এক ক্যান্টিন-বালকের সাথে আলাপ হল। নাম তার ড়ান (উচ্চারণ করে এভাবে, লেখে Rhan)। প্রথম আলাপে বলে, “আই লাভ ইন্দিয়া। আই ওয়ানত তু গো তু ইন্দিয়া। আই গো তু দেল্লি। তু থাজমাহেল। ইউ ফ্রম হোয়ার?”

আমি বললুম, “ক্যালকাটা, ইস্টার্ন পার্ট অফ ইন্ডিয়া।” (এইখানে মনে হল, আমার সিংহভাগ দক্ষিণ ভারতীয় ভ্রাতা-ভগিনীদের কাছে বাঙালিরা, মণিপুরিরা, গুজরাতিরা, অর্থাৎ বিন্ধ্যের ওপারের সব্বাই নর্থ ইন্ডিয়ান)। ড়ান দেখি বলে, “আই গো তু দেল্লি, স্তে অ্যাত ইওর হাউস।” বুঝলাম, ভারতের ভূগোল সম্পর্কে ড়ানের জ্ঞান দিল্লী-তাজমহলের মধ্যেই নিজের চরম সার্থকতা খুঁজে পেয়েছে (সেই সুকুমার রায়ের লেখায় ছিল – বুড়োর মাপার ফিতেয় লেখাটেখা সব উঠে গেছে। খালি ছাব্বিশ লেখাটা একটু একটু পড়া যায়। তাই বুড়ো যা মাপে তাই ছাব্বিশ হয়ে যায়।)

এমনিতে এখানে লোকজন কাজকর্মের ব্যাপার বুড়ো জেহোভার ম্যানুয়াল হুবহু মেনে চলে। শুক্রবার দিন বেলা তিনটের পর সাবাথ শুরু। কাজকম্ম বন্ধ। রোববার থেকে সপ্তাহ আরম্ভ। সাবাথের সময়টুকু বাস-ট্রেন-দোকানপাট সমস্ত কিছু বন্ধ। সে সময় এরা কেউ কোনও আনন্যাচারাল পাওয়ার সোর্স – কোনও ইলেকট্রিক ডিভাইসে হাত দেবে না। শুনলুম, পাশের সিনাগগে শুক্রবার এসি বন্ধ থাকলে স্টুডেন্ট অ্যাপার্টমেন্ট থেকে ইন্ডিয়ানদের ডেকে নিয়ে যায় চালানোর জন্যে। অবিশ্যি জেনারেশন ওয়াই এসব গোঁড়ামি কতখানি অনুসরণ করে তা বলা মুশকিল।

এই সাবাথ উইকএন্ডে তেল আভিভ ঘুরে আসা গেল। সক্কাল সক্কাল বেরিয়ে পড়তে হয় আরিয়েল থেকে। ঘুরে-টুরে ফিরতি বাস ধরতে হবে ৪টের মধ্যে। তারপর বাস-সার্ভিস বন্ধ। পাহাড়ি রাস্তায় আধুনিকতম হাইওয়ে ধরে বাস চলে। বাস কোম্পানি আফিকিম মুফতে ওয়াইফাই দিচ্ছে খদ্দেরদের জন্যে। শ্লথগতির ইন্টারনেটে মন না ভরলে চোখ চলে যায় বাইরের দিকে। হলদেটে টিলার গায়ে গায়ে অলিভগাছের বাহার। পাথুরে মাটিতে অযোনিসম্ভব জোশুয়ার পায়ের ছাপ। আজ দু’হাজার বছর পরেও রুক্ষ এই মাটিতে তাঁর পরিভ্রমণ স্পষ্ট মনে হয়। জোশুয়া জানতেন না, অনেক পরে পশ্চিমবঙ্গের ছায়াঘেরা নিশ্চিন্দিপুর গ্রামে দশ বছরের এক ছেলে অপূর্ব কুমার রায় তাঁর  জন্য চোখের জল ফেলবে কুবোপাখি ডেকে যাওয়া রিক্ত দুপুরবেলায়। বিভূতিভূষণ জানতেন না অপুর চোখ দিয়ে দেখতে চেয়েছিল একদিন যে ছেলে, সে গিয়ে দাঁড়াবে পবিত্রভূমির মাটিতে। দেখতে পাবে মরিয়মের কান্না কেমন এলমগাছ হয়ে জেগে রয়েছে ক্ষয়াটে জমির বুকে।

তেল আভিভ ঢোকার মুখে কড়া সিকিউরিটি চেক। অটোম্যাটিক সাবমেশিনগান কাঁধে ঝুলিয়ে পাসপোর্ট চেক করতে এল বছর বাইশের এক সুন্দরী। তার চোখের চাপল্য চিত্তচাঞ্চল্য ঘটানোর পক্ষে যথেষ্ট। সে নিজেও তা জানে বলেই বোধহয় মুখখানাকে অতিরিক্ত গম্ভীর করে রয়েছে। ইজরায়েলে নারী-পুরুষ সক্কলের দু’বছরের মিলিটারি ট্রেনিং বাধ্যতামূলক। আমরা যে বয়েসে প্রেম-কফি হাউস-কলেজস্ট্রীট-বইমেলা-নিউএম্পায়ার ইত্যাদি সাংঘাতিক গুরুত্বপূর্ণ কাজে নিজেদের ব্যস্ত রাখতাম – এরা  সে বয়েসে জলপাইরঙা পোশাক পরে কাঁধে বন্দুক ঝুলিয়ে দু’বেলা হাড়ভাঙা ট্রেনিং করে।

তেল আভিভ যেকোনও ভারতীয় বড়ো শহরের মতোই ঘিঞ্জি। তফাত বলতে স্কাইস্ক্র্যাপারগুলো অনেক বেশি উঁচু। পাঁচতলা সেন্ট্রাল বাস টার্মিনাসের ভিতরেই এক সুপার-মল। তারই একতলায় এক ভারতীয় ভ্যারাইটি স্টোর। ওম। মানে, মুদিখানা আর কী। সুদূর মাতৃভূমি থেকে এসে দুইজন মারাঠি মানুষ বাসমতি চাল, মুসুরডাল, পাঁচফোড়ন প্রভৃতির নিয়মিত যোগান দিয়ে ইজরায়েলের ভারতীয় ছাত্রদের প্রভূত শ্রদ্ধা-ভালোবাসা অর্জন করে চলেছেন। দোকানের বাইরে ক্যাটরিনা-আমি শোভিত পোস্টারে ছয়লাপ। তেল আভিভে কদাচিৎ কোনও বলিউডি জলসা হলে তার হদিস ও টিকিট এখানেই মেলে।

বাস টার্মিনাসের বাইরে গলির দু’ধারে ওয়াল গ্রাফিটির বাড়াবাড়িরকম উপস্থিতি। রাস্তার পাশে রোয়াকে বসে কিছু যুবক মদ্যপান করছে। এই অঞ্চলটা ইথিওপিয়ান ইমিগ্রান্টসদের ডেরা।  মদ-ড্রাগসের মুক্তাঞ্চল। চারদিকে হেঁটে বেড়ানো মানুষদের পায়ে ক্লান্তি, চোখের তারাতেও।

আরেকটি বাস পাকড়াও করে কারমেল মার্কেট পৌঁছানো গেল। এটি তেল আভিভের বৈঠকখানা বাজার। চাদ্দিকে খোলা বিক্রি হচ্ছে ফল-ফুলুরি, শাক-সবজি অ্যান্ড হোয়াট নট! ক্যান্ডি, মিঠাই আর রুটির রকমফের দেখে হাঁ হয়ে যেতে হয়। তুরস্কের মানুষ আসলান হরেকরকম্বা ক্যান্ডি বেচেন কারমেল মার্কেটে। অনুরোধে খুশি হয়ে দোকানের ছবি তুলতে দিলেন। মাছ-মাংসের সেকশনে দাম তুলনামূলক সস্তা। তিন কিলো মুরগির ঠ্যাং পঞ্চাশ শেকেল। যেখানে মলগুলোয় এক কিলো তিরিশ শেকেল নেয়। ব্রেস্ট পিস, লেগ পিস সব মিলিয়ে একশো শেকেল হলে সঙ্গী জয়দীপ দেখি বলে, “মেক ইট নাইন্টি।”

দোকানদার মুচকি হেসে বললে, “ইউ গাইজ আর ফ্রম ইন্ডিয়া, নো?”

বুঝলুম, ভারতীয়দের দরাদরির ক্ষমতা সম্পর্কে এরাও বেশ ওয়াকিবহাল। বেলা বাড়ার সাথে সাথে বাড়ল ভিড়। তখন আর কেউ কাউকে জায়গা দেয় না। দু’দিকে দোকানের সারি। তার মাঝের শুঁড়িপথ দিয়ে তখন দস্তুরমতো ধাক্কাধাক্কি করে রাস্তা করে নিতে হয়। এদিকে ভিড় বাড়তে দেখে দোকানদাররাও তারস্বরে হাঁকাহাঁকি শুরু করেছে। খদ্দেরকে টুপি দেওয়ার জন্য বেশিরভাগই মুখিয়ে। এদিকে গরমে ঘেমে-নেয়ে অস্থির আমরা। বলছিলাম না, একবার খোলা বাজারে গিয়ে পড়লে ইন্ডিয়া আর ইজরায়েলে বিলকুল তফাত থাকে না।

বাজার থেকে বেরোনোর মুখে টের পাচ্ছিলাম ভূমধ্যসাগরের কাছাকাছি আছি। রাস্তার স্কোয়ারের ধারে সরু রেলিঙের ব্যালকনি-বাড়িতে, তারই পাশ দিয়ে  নেমে যাওয়া ঢালু রাস্তায় তারই দু’পাশে সাজানো লতায় ইতালির গন্ধ লেগে আছে। উডি অ্যালেনের ‘টু রোম উইথ লাভ’ যারা দেখেছেন তারা বুঝবেন কেমনতরো সে সুঘ্রাণ। সেসব পেরিয়ে বোরো রাস্তার বামদিকে দৈত্যাকৃতি হোটেল আর ডানদিকে আড়ম্বরহীন মসজিদ রেখে তাকে প্রথমবার দেখলাম। ভূমধ্যসাগর। তার জল হেলেনের চোখের মতো নীল। নীরার চুলের মতো অবাধ্য বাতাস তার সারা শরীরে লেপ্টে।

(চলবে)

 বিশ্বের জানালা       সব পর্ব একত্রে

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Twitter picture

You are commenting using your Twitter account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s