অধ্যাপক গৌতম গঙ্গোপাধ্যায়ের আগের লেখাঃ স্বর্ণযুগের কাহিনী
গৌতম গঙ্গোপাধ্যায়
জ্যোতির্বিদ্যাতে প্রাচীন ভারতীয়দের অবদানের কথা তোমরা সবাই শুনেছ। আর্যভট্ট, বরাহমিহির, রহ্মগুপ্ত, ভাস্করাচার্যদের নাম অনেকেই জানো। কিন্তু আধুনিক বিজ্ঞানের জন্ম যখন ইউরোপে হয়েছিল, তখন থেকে আমাদের দেশ বিজ্ঞান-প্রযুক্তিতে ক্রমশ পিছিয়ে পড়তে থাকে। বিদেশি বণিকরা এদেশে এসেছিল বাণিজ্য বিস্তারের জন্য, কিন্তু তারপর তারা, বিশেষ করে ইংরেজরা, দেশের বিভিন্ন অংশে ক্ষমতা দখল করে বসে। এসব কথা আমরা ইতিহাসে পড়েছি, পলাশীর যুদ্ধের কথা সকলের নিশ্চয় মনে আছে।
ভারতে আধুনিক বিজ্ঞানচর্চা শুরু করেছিল বিদেশিরা। একটা কথা মনে রাখতে হবে। প্রাচীন যুগে কোনো কোনো বিজ্ঞানী নিশ্চয় রাজরাজড়াদের আনুকূল্য পেতেন, কিন্তু তাছাড়াও কাজ করা সম্ভব ছিল। আধুনিক বিজ্ঞানের অধিকাংশ গবেষণা করতে টাকাপয়সা লাগে। তাই কোনো একটা প্রতিষ্ঠানের সহায়তা ছাড়া কাজ করা শক্ত। ভারত তখন পরাধীন, স্বাভাবিকভাবেই বিজ্ঞান গবেষণা ছিল মূলত শাসনের সুবিধা ও বিদেশি শাসকদের লাভের পরিমাণ বাড়ানোর লক্ষ্যে। সেই কারণেই জিওলজিকাল সার্ভে, বোটানিকাল গার্ডেন, গ্রেট ট্রিগোনোমেট্রিক সার্ভে ইত্যাদির প্রয়োজন হয়েছিল। আমাদের কাহিনিতে মাদ্রাজ অবজার্ভেটরি বা পর্যবেক্ষণাগারের কথা আসবে, তার মূল দায়িত্ব ছিল ভারতবর্ষের পূর্ব উপকূলে জাহাজ চলাচলের সুবিধার জন্য জ্যোতির্বিদ্যা ও ভূগোলের চর্চা। এই রকম কেজো বিষয়ের সঙ্গে সঙ্গে অনেক সময় মৌলিক জ্ঞানের চর্চাও হয়েছিল, কখনো কখনো ব্যক্তিগতভাবে কেউ কেউ উদ্যোগ নিয়েছিলেন। আবার কখনো কখনো পরিস্থিতি এমন হয়েছিল যে ভারতে এসে গবেষণা করার প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল। আজকে সেই রকম একটা বিশেষ আবিষ্কারের গল্প তোমাদের শোনাব।
সেই সময়ের কয়েকজন বিশিষ্ট জ্যোতির্বিজ্ঞানী এই কাজটার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। প্রথম যাঁর কথা বলব, তিনি কিন্তু ইংরাজ নন, ফরাসি। তাঁর নাম পিয়ের জুল জ্যানসেন। জ্যানসেন এক দুর্ঘটনার জন্য শৈশব থেকেই খোঁড়া, কিন্তু তা বলে তাঁর উৎসাহের কমতি ছিল না। পেরু থেকে ভারত পর্যন্ত নানা দেশে তিনি দৌড়ে বেরিয়েছেন। মনে রেখো আমরা যে সময়ের কথা বলছি, তখন এসব দেশে যেতে গেলে সমুদ্র যাত্রা ছাড়া কোনো উপায় ছিল না। তাতে সময় লাগতো অনেক, কষ্টও হত। সেসব মেনে নিয়েই পঙ্গু জ্যানসেন ভারতে এসেছিলেন আজ থেকে ঠিক দেড়শো বছর আগে ১৮৬৮ সালে। তার কারণ কী? একা জ্যানসেন নয়, সেই বছর কয়েকটা বৈজ্ঞানিক অভিযানের গন্তব্য ছিল ভারতবর্ষ। তার কারণ জানতে হলে আমাদের পিছিয়ে যেতে হবে আরো কয়েক বছর। জানতে হবে জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা কোন উদ্ধৃতিটাকে সবচেয়ে বেশি পছন্দ করেন।
জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের সবচেয়ে প্রিয় উদ্ধৃতিটি কোনো বিজ্ঞানী নয়, ফরাসি দার্শনিক অগুস্ত কোঁতের রচনা থেকে নেওয়া। কোঁত বিশ্বাস করতেন বিজ্ঞানের একটা সীমারেখা আছে, সেটা বোঝাতে গিয়ে তিনি বলেছিলেন সূর্য বা অন্য নক্ষত্রেরা কী দিয়ে তৈরি তা জানা অসম্ভব। ‘তারাদের রাসয়ানিক গঠন কেমন করে আবিষ্কার করা যাবে তা আমরা কোনোদিনই জানতে পারব না,‘ তিনি লিখেছিলেন। কোঁতের মৃত্যু হয় ১৮৫৭ সালে, আর ১৮৫৯ সালে জার্মানির হাইডেলবার্গে গুস্তাভ কিরশফ ও রবার্ট বুনসেন নক্ষত্রদের সম্পর্কে তাঁর এই কথাকে ভুল প্রমাণ করবেন। কেমন করে সেটা বুঝতে গেলে বিজ্ঞানটা একটু বুঝতে হবে।
আমরা জানি আলোর তরঙ্গ চরিত্র আছে। বর্ণালী বিশ্লেষণ পদ্ধতিতে আমরা আলোকে তার মধ্যের বিভিন্ন তরঙ্গদৈর্ঘ্যে ভেঙে ফেলতে পারি। এই পদ্ধতিটা আবিষ্কার করেছিলেন নিউটন। তোমরা রাস্তায় সোডিয়াম ভেপার আলো দেখেছ। সোডিয়াম ভেপার বা বাষ্পকে উত্তপ্ত করলে তার থেকে হলুদ আলো বেরোয়। সেই আলোর বর্ণালী বিশ্লেষণ করলে নিচের ছবির মতো একটা ছবি পাওয়া যায়। বর্ণালীতে কালো পশ্চাৎপটের উপর একটা হলুদ রঙের রেখা দেখা যাচ্ছে। আসলে এখানে খুব কাছাকাছি দুটো রেখা আছে, আমাদের বর্ণালী বিশ্লেষক বা স্পেক্ট্রোস্কোপটা আরো ভালো হলে সেই দুটো রেখাকে আলাদা করতে পারতাম। সংখ্যা যেগুলো দেখা যাচ্ছে তারা হল আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্যের মাপ, যেটা দেওয়া আছে ন্যানোমিটারে। এক ন্যানোমিটার হল এক মিটারের একশো কোটি ভাগের এক ভাগ। সোডিয়াম আলোর তরঙ্গ দৈর্ঘ্য হল ৫৮৯ ন্যানোমিটার, এটাকে বলে D-রেখা। আবার বলছি এটা আসলে খুব কাছাকাছি থাকা দুটো রেখার সমষ্টি, সেগুলোর নাম D1 ও D2। পদার্থ থেকে বেরোনো আলোকে বিশ্লেষণ করে পাওয়া বর্ণালীকে বলে নিঃসরণ বর্ণালী।
সোডিয়াম একটা মৌলিক পদার্থ, অন্যান্য মৌলিক পদার্থের বাষ্পেরও এরকম বর্ণালী পাওয়া যায়, যেমন নিচের ছবিতে হাইড্রোজেন গ্যাসকে গরম করলে যে আলো বেরোয় তার বর্ণালীর ছবি দেখানো হয়েছে। নিশ্চয় বুঝতে পারছ এই দুটো বর্ণালীর চেহারা একেবারে আলাদা। এই রকম সমস্ত মৌলিক পদার্থের গ্যাস বা বাষ্পেরই নিঃসরণ বর্ণালীর চেহারা আলাদা আলাদা হয়।
তাহলে দেখা যাচ্ছে গ্যাসীয় অবস্থায় যে কোনো মৌলিক পদার্থকে গরম করলে তার থেকে যে আলো বেরোয় তার বর্ণালী বিশ্লেষণ করলে আমরা মৌলটাকে চিনতে পারব।
১৮৫৯ সালে কিরশফ এই বিষয়েই অন্য একটা গবেষণা শুরু করলেন। যদিও তিনিই এ ব্যাপারে যে প্রথম তা নয়, কিন্তু তিনি প্রথম পুরো ব্যাপারটা পরিষ্কারভাবে বুঝেছিলেন বলে তাঁর কাজটাই আমরা আলোচনা করব। একটা উজ্জ্বল শিখা বা ইলেকট্রিক বাল্বের থেকে বেরোনো আলোর যদি আমরা বর্ণালী বিশ্লেষণ করি, তাহলে একটা উজ্জ্বল পটিতে বেগুনি থেকে লাল, টানা এই রকম রঙ দেখা যাবে, আলাদা আলাদা করে আলোর রেখা নয়। কিরশফ এইরকম একটা উজ্জ্বল শিখা ও বর্ণালী বিশ্লেষকের মাঝখানে রাখলেন সাধারণ তাপমাত্রায় সোডিয়ামের ভেপার বা বাষ্প। দেখা গেল নিঃসরণ বর্ণালীতে ঠিক যেখানে সোডিয়ামের উজ্জ্বল রেখা ছিল, উজ্জ্বল আলোর পটিতে ঠিক সেইখানে একটা অন্ধকার বা কালো রেখা দেখা যাচ্ছে। এই ধরনের বর্ণালীকে বলে শোষণ বর্ণালী। বহুবার পরীক্ষা করে কিরশফ বললেন যে কোনো মৌলকেই গ্যাসীয়রূপে উত্তপ্ত করলে সে যে তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলো বিকিরণ করে, সেই মৌলের শীতল গ্যাস ঠিক সেই তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলোকেই শোষণ করে। সেইজন্যই ওই তরঙ্গদৈর্ঘ্যের জায়গাটা শোষণ বর্ণালীতে অন্ধকার দেখায়। বিভিন্ন পদার্থের বর্ণালী বিশ্লেষণ করে কিরশফ ও তাঁর সহকর্মী বুনসেন সিজিয়াম বা রুবিডিয়ামের মতো নতুন মৌলিক পদার্থ আবিষ্কার করলেন।
আধুনিক বিজ্ঞানের ভাষায় ব্যাখ্যাটা খুব সহজ। ধরা যাক সোডিয়াম পরমাণুর কথা। পরমাণুর ভিতর অনেকগুলি শক্তিস্তর আছে। সাধারণ তাপমাত্রায় পরমাণু সবচেয়ে নিচের স্তরে থাকে। সোডিয়ামের বাষ্পকে উত্তপ্ত করলে তার কিছু সংখ্যক পরমাণু উপরের শক্তিস্তরে চলে যায়। সেখান থেকে পরমাণু যখন নিচের শক্তিস্তরে নামে, তখন সে একটা আলোর কণা অর্থাৎ ফোটন বিকিরণ করে। শক্তির সংরক্ষণসূত্র থেকে আমরা সহজেই বুঝি আলোর ফোটনের শক্তিটা হলে ওই দুই শক্তিস্তরের পার্থক্যের সমান। মনে রেখো ফোটনের শক্তির সঙ্গে তরঙ্গদৈর্ঘ্যের সম্পর্ক আছে। অন্যদিকে আগেই বলেছি শীতল সোডিয়ামের পরমাণু নিচের শক্তিস্তরে থাকে। উজ্জ্বল শিখার আলোর যে ফোটনগুলোর শক্তি সোডিয়ামের ওই দুই শক্তিস্তরের পার্থক্যের সমান, সোডিয়াম পরমাণু সেই ফোটনগুলোকেই শোষণ করবে এবং সেই ফোটনের শক্তি নিয়ে উপরের স্তরে চলে যাবে। ফলে ওই শক্তির বা তরঙ্গদৈর্ঘ্যের ফোটনের সংখ্যা যাবে কমে। সেজন্য বর্ণালীতে ওই তরঙ্গদৈর্ঘ্যের জায়গাটা অন্ধকার দেখায়। তবে আমরা যে সময়ের কথা বলেছি তখন পরমাণুর অস্তিত্ব নিয়েই বিজ্ঞানীরা সবাই নিশ্চিত ছিলেন না। তার ভিতরের শক্তিস্তর বা আলোর কণা ফোটনের কথা কেউ কল্পনাও করতে পারেননি। পরমাণুর ভিতরে শক্তিস্তর সম্পর্কে প্রথম সঠিক ব্যাখ্যা দেবেন ১৯১১ সালে নিলস বোর, আর ফোটনের কথা বলবেন আলবার্ট আইনস্টাইন ১৯০৫ সালে।
সে না হয় বোঝা গেল, কিন্তু এর সঙ্গে কোঁতের কথার সম্পর্ক কী? আমরা আরো কিছুটা পিছিয়ে যাই। ১৮১৪ সালে জার্মান বিজ্ঞানী ফ্রনহফার সূর্য থেকে আসা আলোর বর্ণালী বিশ্লেষণ করেছিলেন। তিনি দেখেছিলেন উজ্জ্বল পটির উপরে অনেকগুলো এইরকম কালো রেখা দেখা যায়। তিনি এর মধ্যে সোডিয়ামের রেখাও দেখেছিলেন, কিন্তু ব্যাপারটা ভালো বুঝতে পারেননি। বিজ্ঞানীরা বুঝলেন এর মধ্যে কিছু কিছু রেখার উৎস পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের সূর্যালোক শোষণ। কেমন করে? উঁচু পর্বতের উপর উঠে সূর্যের আলোর বর্ণালী বিশ্লেষণ করে বিজ্ঞানীরা দেখলেন কিছু কিছু ফ্রনহফার রেখা খুব দুর্বল হয়ে যায়, কিন্তু বাকিদের কোনো পরিবর্তন হয় না। পাহাড়ের উপরে উঠলে বায়ুমণ্ডলের অনেকটা ছাড়িয়ে যাচ্ছি। তার মানে যে রেখাগুলো দুর্বল হয়ে যাচ্ছে, সেগুলোর জন্য পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের শোষণ দায়ী, কিন্তু বাকিদের উৎস নিঃসন্দেহে সূর্য।
কিরশফ এবং বুনসেন তাঁদের গবেষণার থেকে ফ্রনহফারের বর্ণালীর ব্যাখ্যা দিলেন। বললেন সূর্যের ভিতরটা সাংঘাতিক গরম, বাইরেটা অপেক্ষাকৃত ঠাণ্ডা। ভিতর থেকে যে আলো আসছে, বাইরের গ্যাস সেই আলো শোষণ করছে। যেমন সূর্যের বাইরের দিকে আছে সোডিয়াম। সে আলো শোষণ করে বলে ফ্রনহফার বর্ণালীতে সোডিয়ামের D-রেখাদুটোর জায়গাটা অন্ধকার দেখায়। ঠিক সেইভাবে আমরা তাহলে ফ্রনহফার বর্ণালীর অন্ধকার রেখার সঙ্গে বিভিন্ন মৌলের নিঃসরণ বর্ণালীর তুলনা করে কোন কোন মৌল সূর্যের বাইরের অপেক্ষাকৃত শীতল অংশে আছে তা জানতে পারব। তাহলে এভাবেই সূর্য বা অন্য জ্যোতিষ্ক কী কী মৌলিক পদার্থ দিয়ে তৈরি তা আমরা বুঝতে পারব। তাঁরা দেখালেন সূর্যে লোহা, ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম, নিকেল, তামা, বেরিয়াম, সোডিয়াম ইত্যাদি মৌল আছে। বুঝতে পারছ, কোঁত তাঁর কথার যুক্তি হিসাবে একটা ভুল উদাহরণ বেছেছিলেন।
সূর্যের বাইরের অংশ অপেক্ষাকৃত ঠাণ্ডা, তাই যে তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলো শোষণ হচ্ছে বর্ণালীর সেই রেখাগুলো ভিতর থেকে যে আলো বেরোচ্ছে তার তুলনায় কালো লাগে। কিন্তু তা তো যথেষ্টই গরম। আমরা এখন জানি সূর্যের বাইরের তলের তাপমাত্রা সাড়ে পাঁচহাজার ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডেরও বেশি। তাহলে তার থেকেও তো আলো নিশ্চয় বেরোয়। কিন্তু সূর্যের কেন্দ্রের জোরালো আলোর কাছে তাকে দেখা সম্ভব নয়। যদি কোনোভাবে সূর্যের আলোটাকে আড়াল করে দেওয়া যায়, তাহলে সূর্যের বাইরের শীতলতর গ্যাস থেকে বেরোনো আলোর নিঃসরণ বর্ণালী বিশ্লেষণ করা সম্ভব হতে পারে। পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের শোষণ যে সমস্ত ফ্রনহোফার রেখার জন্য দায়ী, তাদের এই বর্ণালীতে খুঁজে পাওয়া যাবে না। তাহলে নিশ্চিতভাবে বলা যায় সূর্যে কোন কোন মৌলিক পদার্থ আছে।
পিয়ের জুল জ্যানসেন এই নিয়ে অনেকদিন ধরে চিন্তাভাবনা করছিলেন। তিনি ইতিমধ্যে সূর্য ছাড়া অন্য নক্ষত্রেরও বর্ণালী বিশ্লেষণ করেছিলেন, তাঁর নিজের তৈরি স্পেক্ট্রোস্কোপ তখন পৃথিবীতে সবচেয়ে সেরা। জ্যানসেন ইতিমধ্যে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডল কোন কোন ফ্রনহফার রেখার সৃষ্টি করছে তা নিয়ে নানারকম পরীক্ষানিরীক্ষা করছেন। কিন্তু গবেষণার ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অনেক কাজ সত্ত্বেও ফ্রান্সে তিনি বিশেষ গুরুত্ব পাচ্ছিলেন না। তাতে অবশ্য তিনি দমে যাননি। ১৮৬৩ সালেই জ্যানসেন ভাবলেন পূর্ণগ্রাস সূর্যগ্রহণের সময় সূর্যের কেন্দ্রীয় অংশ ঢাকা পড়ে যায়, তখন বাইরের অংশের বর্ণালী বিশ্লেষণ করা সম্ভব। পরের পূর্ণগ্রাস সূর্যগ্রহণ পাঁচ বছর পরে ১৮৬৮ সালের ১৮ আগস্ট। নিচের ছবিতে মাঝখানের দুটি নীল রেখার মধ্যের অঞ্চলে সেবার পূর্ণগ্রাস দেখা গিয়েছিল। দেখতে পাচ্ছ দক্ষিণ ভারত থেকে সেবার পূর্ণগ্রাস সূর্যগ্রহণ দেখা গিয়েছিল। সেই কারণেই ১৮৬৮ সালে ইউরোপ থেকে ভারতে একাধিক বিজ্ঞান অভিযান পাঠানো হয়। ফ্রান্সের অভিযানের একমাত্র সদস্য ছিলেন জ্যানসেন।
তবে ছবি থেকেই দেখা যাচ্ছে পূর্ণগ্রাস যে শুধু ভারত থেকেই দৃশ্যমান হওয়ার কথা তা নয়। থাইল্যান্ডের তখন নাম ছিল শ্যামদেশ, সেখানকার রাজা ইংরেজ ও ফরাসি বিজ্ঞানীদের সূর্যগ্রহণ দেখতে আমন্ত্রণ জানান। ফ্রান্সের মূল অভিযান যায় শ্যামদেশে। জ্যানসেন মূল অভিযানের অন্য বিজ্ঞানীদের কাছে খুব একটা গ্রহণযোগ্য ছিলেন না, তিনি ভারতের উদ্দেশ্যে রওনা হলেন।
শুধু যে ফরাসিরাই সূর্যগ্রহণের সময়ে বৈজ্ঞানিক পর্যবেক্ষণের কথা ভাবছিলেন তা নয়। ব্রিটিশ বিজ্ঞানীরাও উৎসাহী ছিলেন। ইংল্যান্ডে নর্মান লকিয়ার গোড়াতে ছিলেন এক শখের জ্যোতির্বিদ, কিন্তু নিজের চেষ্টাতে তিনি বিজ্ঞানী মহলে সম্মান আদায় করে নিয়েছিলেন। কখনো কখনো সূর্য থেকে বাইরের দিকে উত্তপ্ত গ্যাস থামের আকার নিয়ে বেরিয়ে আসে, একে বলে সৌরশিখা (Solar prominece)। লকিয়ার এই লাল রঙের সৌরশিখার ছবি তুলতে চাইছিলেন। পূর্ণগ্রাস সূর্যগ্রহণের সময়েই একে ভালোভাবে দেখা যায়। কিন্তু তার জন্য পূর্ণ সূর্যগ্রহণ যেখানে যখন হয় সেখানে যন্ত্রপাতি নিয়ে দৌড়োতে হবে, সে সময় তা মোটেই সহজ কাজ নয়। সূর্যের বুকে যে কালো দাগ দেখা যায়, তার নাম সৌরকলঙ্ক। এর তাপমাত্রা সূর্যের বাইরের তলের অন্য জায়গার থেকে বেশি না কম সেই নিয়েও বিজ্ঞানীদের মধ্যে বিতর্ক চলছিল। বর্ণালী বিশ্লেষণের মাধ্যমে এই তর্কের নিরসন করা সম্ভব। যদি সৌরকলঙ্কের তাপমাত্রা বেশি হয়, তাহলে সেখানকার বর্ণালীর চরিত্র শোষণ নয়, নিঃসরণ বর্ণালীর মতো হবে। সৌরকলঙ্ক তো আর গ্রহণের সময় দেখা যাবে না। এইসব কারণে লকিয়ার সূর্যগ্রহণ ছাড়া অন্য সময়েও সূর্যের বর্ণালী বিশ্লেষণেরও চেষ্টা করছিলেন।
লকিয়ারের মনে হল একটা খুব ভালো বর্ণালী বিশ্লেষক থাকলে এই কাজ করা সম্ভব। বর্ণালী বিশ্লেষকের ক্ষমতা যত বেশি হবে, সৌরবর্ণালীর পটি তত ছড়িয়ে পড়বে। মোট ঔজ্জ্বল্য যদি অনেকটা জায়গায় ভাগ হয়ে যায়, তাহলে পড়ে তাহলে পটির কোনো একটা জায়গায় ঔজ্জ্বল্য হবে কম। তখন হয়তো নিঃসরণ বর্ণালীর অপেক্ষাকৃত দুর্বল রেখাগুলো দেখা সম্ভব হবে, কারণ রেখা বর্ণালী ছড়িয়ে পড়ে না। জ্যানসেনও একই কথা ভাবছিলেন।
ভারতে ব্রিটিশ সৈন্যবাহিনীর অফিসার ফ্রান্সিস টেন্যান্ট গ্রেট ট্রিগোনোমেট্রিক সার্ভেতে অংশ নিয়েছিলেন। তিনি জ্যোতির্বিদ্যাতে উৎসাহী হয়ে পড়েন এবং মাদ্রাজ অবজার্ভেটরির অস্থায়ীভাবে দায়িত্ব নেন। তিনিই এক প্রবন্ধ লিখে ১৮৬৮ সালের সূর্যগ্রহণের প্রতি ইউরোপের বিজ্ঞানীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। বিশেষ করে সেবারের পূর্ণগ্রাসের স্থায়িত্ব ছিল ছয় মিনিট, যা সূর্যের বাইরের অংশের কয়েকটা ছবি তোলার জন্য যথেষ্ট। ইংল্যান্ডের রয়্যাল সোসাইটি টেন্যান্টেরই নেতৃত্বে ব্রিটিশ বিজ্ঞানীর দলকে গ্রহণ পর্যবেক্ষণের জন্য পাঠায়। পর্যবেক্ষণের জায়গা হিসাবে টেন্যান্ট বেছে নেন মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সির, এখনকার তামিলনাড়ুর শহর গুন্টুরকে। সেই দলে ছিলেন সেই সময় পূর্ব উপকূলে বৃষ্টির সম্ভাবনা কম, পশ্চিম উপকূলে তা অনেক বেশি। এছাড়া আরো একটা দল গিয়েছিল জামখান্দি। তার নেতৃত্বে ছিলেন লেফটেন্যান্ট জন হার্শেল। জনের ঠাকুর্দা ছিলেন বিখ্যাত জ্যোতির্বিদ উইলিয়াম হার্শেল, ইউরেনাস গ্রহের আবিষ্কর্তা। হার্শেলের বাবার নামও জন, তিনিও ছিলেন জ্যোতির্বিদ। তিনিই ছেলেকে সূর্যগ্রহণের সময় পর্যবেক্ষণে উৎসাহী করেন। আরো এক ব্রিটিশ দল ছিল বিজাপুরে, তার নেতৃত্বে ছিলেন ক্যাপ্টেন হেইগ। জামখন্দি ও বিজাপুর আধুনিক কর্ণাটক রাজ্যে অবস্থিত।
জ্যানসেনও পছন্দ করলেন গুন্টুরকে, সেখানে এক ফরাসি ব্যবসায়ীর বাড়ি ছিল গুন্টুরের সবচেয়ে উঁচু জায়গায়, সেখানেই তিনি তাঁর যন্ত্রপাতি বসালেন। টেন্যান্ট বেছেছিলেন গুন্টুরের কালেক্টরের বাড়ি। দুই জায়গার মধ্যে দূরত্ব ছিল এক কিলোমিটারেরও কম।
আমাদের গল্পে আর একজন জ্যোতির্বিজ্ঞানী আছেন, তাঁর নাম নর্মান রবার্ট পগসন। তিনি টেন্যান্টের জায়গায় মাদ্রাজ অবজার্ভেটরির দায়িত্ব নিয়েছিলেন। পগসন জ্যোতির্বিদ হিসাবে ছিলেন যথেষ্টই সফল, তিনি জ্যোতিষ্কদের উজ্জ্বলতা মাপার যে স্কেল চালু করেছিলেন, তা আজও আমরা ব্যবহার করি। ভারতে এসেই তিনি দূরবিন দিয়ে পাঁচটা গ্রহাণু আবিষ্কার করেছেন। কিন্তু রয়্যাল অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল সোসাইটির সভাপতি ও অ্যাস্ট্রোনমার রয়্যাল জর্জ এইরির সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক ভালো ছিল না। খুব সাধারণ অবস্থা থেকে নিজের চেষ্টায় লেখাপড়া শিখেছিলেন বলে বিজ্ঞানী সমাজে তিনি খুব একটা পাত্তা পেতেন না। এদিক দিয়ে জ্যানসেনের সঙ্গে তাঁর অনেক মিল আছে।
দুজনের মধ্যে আরো অনেক মিল ছিল। ফরাসি বিজ্ঞানীদের দলে জ্যানসেন ছিলেন অপাংক্তেয়। রয়্যাল সোসাইটির দলেও পগসনকে নেওয়া হয়নি। কিন্তু পগসন দমে যাননি। তিনি ইংল্যান্ড থেকে একটা ভালো স্পেক্ট্রোস্কোপ জোগাড় করলেন। এবার একটা জায়গা বাছতে হবে। যেখানেই হোক, সেখানে গ্রহণ পর্যবেক্ষণের খরচ আছে, পগসন গ্রহণ পর্যবেক্ষণের জন্য কোনো অর্থ পাননি। মাদ্রাজ পূর্ণগ্রাসের আওতায় পড়ছে না, কিন্তু মসুলিপত্তনম বলে আর একটা সমুদ্রতীরের শহর পড়ছে। আজ তার নাম মছলিপত্তনম। পগসন জানেন কয়েকবছর আগে শহরটা এক সাইক্লোনে এবং সমুদ্রের জলোচ্ছ্বাসে ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল, তাই তারপর থেকে সেখানে একটা আবহাওয়া অফিস বানানোর কথা চলছিল। পগসন ঠিক করলেন একসঙ্গে দুটো কাজ করবেন। মসুলিপত্তনমে আবহাওয়া পর্যবেক্ষণের জন্য যন্ত্র বসাতে যাবেন, একই সঙ্গে সূর্যগ্রহণও দেখা যাবে। সঙ্গে নিলেন মাদ্রাজ সিভিল সার্ভিসের অফিসার সি জি ওয়াকার ও রেলের ইঞ্জিনিয়ার জি কে উইন্টারকে। গুন্টুর থেকে মসুলিপত্তনম পঁচাত্তর কিলোমিটার দূরে।
মাদ্রাজে পর্যবেক্ষণাগারের পরিবেশ ছিল অত্যন্ত অস্বাস্থ্যকর। পগসনের স্ত্রী সেইসময়েই কলেরাতে আক্রান্ত হয়েছিলেন, তাঁকে রেখেই পগসন রওনা হয়েছিলেন। বছর খানেক অসুখে ভোগার পরে তিনি মারা যান। তাঁর এই অসুস্থতার প্রভাব পগসনের কাজের উপর পড়েছিল।
গ্রহণের দিন কয়েক আগে থেকেই সবাই প্রস্তুত, কিন্তু সকলেরই মনে ভয়। আগস্ট মাস ভারতে ভরা বর্ষাকাল। আকাশে মেঘ আছে, তা গ্রহণ দেখতে দেবে তো? কিন্তু সকাল থেকেই গুন্টুর বা মসুলিপত্তনমের আকাশ পরিষ্কার হয়ে গেল। জামখন্দি বা বিজাপুরের আকাশের মেঘও পূর্ণগ্রাসের সময় কেটে গিয়েছিল। সকলেরই যন্ত্রপাতি সূর্যের কিনারার দিকে তাক করে রাখা।
জ্যানসেন এবং টেন্যান্ট গুন্টুরে দেখতে পেলেন দুটি লাল রঙের সৌরশিখা। তার থেকে বেরোনো আলোর বিশ্লেষণ করে দেখলেন তাঁদের ধারণাই ঠিক, বাইরের দিকের বর্ণালীতে উজ্জ্বল পশ্চাৎপটের উপর কালো দাগের বদলে দেখা দিয়েছে কালো পশ্চাৎপটের উপর উজ্জ্বল রেখা। অর্থাৎ তাঁরা সূর্যের বাইরের দিকের উত্তপ্ত গ্যাস থেকে বেরোনো আলো দেখতে পেয়েছেন। হাইড্রোজেনের রেখা দেখেছেন, আর দেখতে পাচ্ছেন সোডিয়ামের রেখা। জামখান্দিতে জন হার্শেলও একই রেখা দেখতে পেলেন। একমাত্র পগসনের সন্দেহ হল, তিনি লিখলেন হলুদ রেখাটা ঠিক সোডিয়ামের রেখার অবস্থানে নাও থাকতে পারে। যদি সেটা D-রেখা না হয়, তাহলে তা অন্য কোনো মৌলিক পদার্থের রেখাও হতে পারে। হেইগও বিজাপুরে সৌরশিখা দেখতে পেলেন। তবে হেইগের স্পেক্ট্রোস্কোপ ছিল কম শক্তির, সেখানে হলুদ রেখা দেখা দিলো না।
পূর্ণ সূর্যগ্রহণের স্থায়িত্ব ছ মিনিট, তারপরেই আবার সূর্যের তীব্র আলো বেরিয়ে এলো। টেন্যান্ট বা পগসন যন্ত্রপাতি গুটিয়ে রওনা দিলেন। জ্যানসেন আরো কয়েকদিন গুন্টুরে ছিলেন। তিনি নিঃসরণ রেখার তীব্রতা দেখে অবাক হয়ে গিয়েছিলেন। তাঁর মনে হলো যদি তাঁর দেখা সৌরশিখাদুটো যদি পরের দিনও থাকে, তাহলে সূর্যের ঠিক বাইরে স্পেক্ট্রোস্কোপ তাক করে হয়তো তাদের নিঃসরণ বর্ণালী দেখা সম্ভব। এমনিতে সূর্যের আলোর তীব্রতা খুব বেশি, কিন্তু আগেই তিনি ভেবেছিলেন যে বর্ণালী বিশ্লেষক ব্যবহার করে সেটাকে অনেকটা জায়গায় ছড়িয়ে দেওয়া যায়। শিখাদুটো কোন জায়গায় দেখা গেছে সেটা তিনি ভালো করেই মেপে রেখেছেন। সে সময় সৌরশিখার স্থায়িত্ব নিয়ে কারোরই কোনো ধারণা ছিল না, কারণ একমাত্র পূর্ণগ্রাস গ্রহণের সময়েই তাঁদের দেখা যেত।
পরের দিন সকালবেলা জ্যানসেন সত্যি সত্যিই সৌরশিখার বর্ণালী দেখতে পেলেন। শুধু সেদিন নয়, দশই সেপ্টেম্বরে গুন্টুর ছাড়ার আগে পর্যন্ত তিনি এভাবে বারবার নিঃসরণ বর্ণালী দেখতে পেয়েছিলেন। তিনি এক চিঠিতে প্যারির বিজ্ঞান অ্যাকাডেমিকে সূর্যগ্রহণ ছাড়াও নিঃসরণ বর্ণালী দেখার কথা জানালেন। চিঠিটা লিখেছিলেন ১৯ সেপ্টেম্বর, আর প্যারিতে তা পৌঁছল ২৪ অক্টোবর। এরপর তিনি এলেন কলকাতায়, এসে দেখলেন ফরাসি সরকার তাঁকে লিজিয়ন অফ অনার সম্মানে ভূষিত করেছেন। অন্য ফরাসি বিজ্ঞানীরা তাঁকে পছন্দ করতেন না বলে তিনি একাই ভারতে এসেছিলেন, তা তাঁর কাছে শাপে বর হয়ে দাঁড়াল। এত স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ থাইল্যান্ডে হয়তো পেতেন না জ্যানসেন।
২৪ অক্টোবর আরো একটা খবর প্যারির অ্যাকাডেমিতে পৌঁছেছিল। অসুস্থতার জন্য লকিয়ার সূর্যগ্রহণ দেখতে যাননি কোথাও। তিনি একটা খুব শক্তিশালী স্পেক্ট্রোস্কোপ বানাতে দিয়েছিলেন। সেটা হাতে আসে সেই বছরের ১৬ অক্টোবর। তা দিয়ে তিনি সূর্যের দিকে তাক করে জ্যানসেনের মতোই সৌরশিখার নিঃসরণ বর্ণালী দেখতে পেয়েছিলেন। তিনি রয়্যাল সোসাইটিকে লিখলেন তাঁর পর্যবেক্ষণের কথা, প্যারির অ্যাকাডেমিকেও জানালেন। ২৬ অক্টোবর ফরাসি অ্যাকাডেমির সভায় পরপর দুজনের বক্তব্যই পড়া হল। দুজনকেই যৌথ ভাবে সৌরশিখা পর্যবেক্ষণের এই নতুন পদ্ধতির উদ্ভাবক বলে স্বীকৃতি দেওয়া হল।
সে বছরের সূর্যগ্রহণ কিন্তু অন্য এক কারণে অনেক বেশি স্মরণীয়, কিন্তু তার উল্লেখ জ্যানসেন বা লকিয়ারের ফরাসি অ্যাকাডেমির কাছে পাঠানো রিপোর্টে পাওয়া যাবে না। তার প্রথম সঙ্কেত ছিল পগসনের রিপোর্টে যেখানে তিনি বলেছিলেন যে হলুদ রেখাটা সোডিয়ামের জন্য নাও হতে পারে। পগসন তাঁর স্ত্রীর অসুস্থতা নিয়ে খুবই বিব্রত ছিলেন, সে কারণেই সম্ভবত তাঁর সূর্যগ্রহণ পর্যবেক্ষণের রিপোর্ট লিখতেও দেরি হয়েছিল। সেই রিপোর্ট কোনো গবেষণা পত্রিকাতে কখনোই ছাপা হয়নি, তিনি নিজের খরচে মাদ্রাজ অবজার্ভেটরি থেকে সেটি ছাপিয়েছিলেন।
পগসনের রিপোর্ট লকিয়ার পড়েছিলেন, তাঁর মনে হলুদ রেখার বিষয়টা দাগ কেটেছিল। কিন্তু তাঁর স্মৃতিতে বিষয়টা গুলিয়ে যায়, তিনি মনে করেছিলেন জ্যানসেনের রিপোর্টেই সেই কথাটা পেয়েছিলেন। অনেক বছর পরে তিনি নিজের ভুল সংশোধন করেছিলেন। লকিয়ার পর্যবেক্ষণ চালিয়ে যান এবং সেই বছরই নভেম্বর মাসের ১৫ তারিখে নিশ্চিত হলেন যে সৌরবর্ণালীতে যে হলুদ রেখা দেখা যাচ্ছে তা সোডিয়ামের জন্য নয়। জ্যানসেন তখন সিমলাতে, তিনি তাঁর বর্ণালী বিশ্লেষককে সামান্য পরিবর্তনের মাধ্যমে সৌরশিখা দেখার আরো উপযোগী করেছেন। তিনিও ডিসেম্বর নাগাদ বুঝতে পারলেন যে আগে তিনি ভুল করেছিলেন, হলুদ রেখা সোডিয়ামের D রেখার সঙ্গে মিলছে না।
লকিয়ার তাঁর গবেষণা থেকে নিশ্চিত হলেন যে সৌর নিঃসরণ বর্ণালীর এই হলুদ রেখা আসলে কোনো নতুন এক মৌলিক পদার্থের চিহ্ন। সূর্যের গ্রিক নাম হিলিওস, তার থেকে তিনি এই নতুন মৌলটির নাম দিলেন হিলিয়াম। অনেক বিজ্ঞানী অবশ্য এই নতুন মৌলিক পদার্থের অস্তিত্ব নিয়ে নিশ্চিত ছিলেন না। বর্ণালীবীক্ষণ থেকে নতুন মৌলিক পদার্থ আগেই আবিষ্কার হয়েছে, কিন্তু তাদের সবাইকেই পৃথিবীতে পাওয়া গেছে। হিলিয়ামের কোনো চিহ্ন পৃথিবীতে পাওয়া যাচ্ছিল না। অবশেষে ১৮৯৫ সালে ইংরেজ বিজ্ঞানী উইলিয়াম র্যামজে ক্লেভিয়াইট নামের এক খনিজ পদার্থ বিশ্লেষণ করে হিলিয়ামের চিহ্ন খুঁজে পান।
হিলিয়াম নিষ্ক্রিয় গ্যাস, তাই তা সাধারণ ভাবে যৌগ গঠন করে না। অন্যদিকে হিলিয়াম খুব হালকা, পৃথিবীর আকর্ষণ তাকে আটকে রাখতে পারে নি। তাই আমাদের বায়ুমণ্ডলে হিলিয়ামের চিহ্ন পাওয়া যায় না। তেজস্ক্রিয়ার সময় হিলিয়াম তৈরি হয়, সেটাই পৃথিবীতে হিলিয়ামের উৎস। মহাবিশ্বে কিন্তু ব্যাপারটা ঠিক উল্টো। আমরা এখন জানি যে সেখানে আমাদের জানা সাধারণ পদার্থের মধ্যে প্রায় ৭৪ শতাংশ হল হাইড্রোজেন আর ২৫ শতাংশ হল হিলিয়াম। সে কথা অবশ্য লকিয়াররা কেউ জানতেন না। আমাদের সূর্যের চারভাগের একভাগ হিলিয়াম দিয়ে তৈরি হলেও বর্ণালীতে তাকে খুঁজে পেতে এত কষ্ট কেন হয়েছিল, তা বুঝতে লেগে যাবে আরো প্রায় তিন দশক। অবশেষে মেঘনাদ সাহার আবিষ্কৃত সমীকরণ থেকে বিষয়টা পরিষ্কার হবে। সেই গল্প তোমরা বড়দের জন্য লেখা এই প্রবন্ধে পড়তে পারো। এখন আমরা জানি মহাবিশ্বের অধিকাংশ হিলিয়াম বিগ ব্যাঙের সময় তৈরি হয়েছিল। কেমন করে, সে কথা তোমরা এই লেখায় পাবে। এসব অবশ্য বিজ্ঞানীদের অনেক পরের গবেষণার ফল। সে যাই হোক, হিলিয়ামই হল আধুনিক যুগে ভারত থেকে আবিষ্কৃত একমাত্র মৌল।
তোমরা তাহলে দেখলে হিলিয়ামের চিহ্ন প্রথম দেখেছিলেন পগসন, জ্যানসেন বিষয়টা বুঝেছিলেন পরে। লকিয়ার পগসনের রিপোর্ট অনুসরণ করে নতুন মৌলের কথা প্রথম বলেছিলেন, কিন্তু তিনি ভুল করে পগসনের বদলে জ্যানসেনের কথা বলেছিলেন। লকিয়ার ১৮৯৬ সালে নেচার পত্রিকায় সঠিক ইতিহাসটা লিখলেও তা সম্ভবত কারো নজরে পড়ে নি। ইংল্যান্ডের প্রতিষ্ঠিত বিজ্ঞানীদের সঙ্গে মনোমালিন্যের জন্য পগসন তাঁর প্রাপ্য স্বীকৃতি কখনোই পান নি। পৃথিবীতে হিলিয়াম খুঁজে পাওয়ার কৃতিত্ব র্যামজের প্রাপ্য। কিন্তু আশ্চর্য হল যে সূর্যে হিলিয়াম আবিষ্কারের এই কাহিনি সবাই ভুলে গিয়েছিল। ১৯০৪ সালে উইলিয়াম র্যামজে নিষ্ক্রিয় গ্যাস আবিষ্কারে তাঁর কৃতিত্বের স্বীকৃতি হিসাবে রসায়নে নোবেল পুরষ্কার পেয়েছিলেন। তিনি নোবেল বক্তৃতায় বলেছিলেন জ্যানসেনই সূর্যে হিলিয়ামের চিহ্ন প্রথম দেখেছিলেন। উইকিপেডিয়ার মতো অনেক জায়গায় আছে যে ফরাসি অ্যাকাডেমিতে একই দিনে লকিয়ার ও জ্যানসেনের যে রিপোর্ট দুটো পোঁছোয়, তাতেই নতুন মৌলের কথাটা ছিল। নোবেলজয়ী বিজ্ঞানী সুব্রহ্মনিয়ান চন্দ্রশেখর অবশ্য ১৯৪৭ সালেই সঠিক ইতিহাসটা লিখেছিলেন। কিন্তু আজও এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকাতে হিলিয়ামের আবিষ্কর্তা হিসাবে জ্যানসেনের নামই লেখা আছে। হিলিয়ামের গুরুত্ব ও তার আবিষ্কারের এই ইতিহাস বিজ্ঞানী বিমান নাথ তাঁর The Story of Helium and the Birth of Astrophysics বইতে ভারি সুন্দরভাবে লিখেছেন। তোমরা বড় হয়ে সেই বই পড়ে দেখো, নিশ্চয় ভালো লাগবে।
অসাধারণ লেখা। বিজ্ঞানের কঠিন কঠিন তত্ত্বকে কত সহজ করে প্রাঞ্জল ভাষায় লেখা হয়েছে। বিজ্ঞানে আগ্রহী যে কেঊ প্রবন্ধটি পড়ে এর মধ্যেকার মূল বিজ্ঞানটি বুঝতে পারবেন।
LikeLike