কিশোর ঘোষাল এর সমস্ত লেখা একত্রে
কিশোর ঘোষাল
(পর্ব ৪)
৮
ব্রাহ্মীলিপির প্রাচীনতা
ব্রাহ্মীলিপির প্রাচীনতা নিয়ে পণ্ডিতেরা আরও কয়েকটা ব্যাপারে দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। যেমন বেদের “ব্রাহ্মণ” অংশ। আমরা সকলেই জানি, গুরু-শিষ্য পরম্পরায় বেদ মনে রাখা হত। মনে রাখার সহজ উপায় হল নির্দিষ্ট সুরের পদ্যছন্দ। বেদের অন্যান্য অংশগুলি সে ভাবেই রচিত হয়েছিল, কিন্তু “ব্রাহ্মণ” অংশ রচিত হয়েছিল গদ্যে। অতএব ধরে নেওয়া যায়, “ব্রাহ্মণ” অংশ যখন রচনা হয়েছে, ততদিনে পরিণত লিপি এসে গেছে, বেদগ্রন্থ লেখা হয়ে গেছে এবং মুখস্থ করে মনে রাখার আর প্রয়োজন নেই। বেদের “ব্রাহ্মণ” অংশের রচনাকাল মোটামুটি ৬০০ বি.সি.। পণ্ডিতেরা বলেন মহাকাব্য “মহাভারত” এর রচনা কাল মোটামুটি ৪০০ বি.সি.। মূল গ্রন্থ পাঠ করলেই বোঝা যায়, কোন না কোন পণ্ডিত মহর্ষি বিখ্যাত কোন রাজার সভায় কিংবা কোন যজ্ঞের অনুষ্ঠানে, সমবেত সকলের সামনে মহাভারতের কথা বর্ণনা করছেন। অর্থাৎ এতদিন যে মহাভারতের কাহিনী মুখে মুখে প্রচারিত হত, সুষ্ঠু লিপির সাহায্যে, এই সময় সেই মহাভারতই লিখে ফেলা হল, সকলের জন্যে। এই প্রসঙ্গে তাঁরা মহর্ষি পাণিনি রচিত ব্যাকরণ “মহাভাষ্য”-র কথাও উল্লেখ করেন। পাণিনির এই রচনার সময়কাল মোটামুটি ৫০০ – ৪০০ বি.সি.। পাণিনির মহাভাষ্য ব্যাকরণ পরবর্তী প্রায় দু হাজার বছর ধরে সংস্কৃত ভাষাকেও নিয়ন্ত্রণ করে চলেছে। অতএব ব্রাহ্মীলিপি এর অনেক আগে থেকেই প্রতিষ্ঠিত এবং বহুল প্রচলিত ছিল, তা না হলে ব্যাকরণ রচনার কোন মানে হয় না।
ভারতের আঞ্চলিক লিপির সূত্রপাত
দেশ জুড়ে বহুল ব্যবহারের ফলে, ব্রাহ্মীলিপির আঙ্গিকে অনেক পরিবর্তন আসতে লাগল। সম্রাট অশোক যে ভাষায় শিলালিপি লিখেছিলেন, সেটি মাগধী। মগধের প্রাকৃত ভাষা এবং সংস্কৃতের মিশ্রণের এই মাগধী ভাষাতেই তখনকার আম জনতা কথা বলতেন। যদিও রাষ্ট্রভাষা কিংবা রাজসভার ভাষা ছিল সংস্কৃত। দক্ষিণ ভারতের তামিল ব্রাহ্মীলিপি অনেক আগে থেকেই প্রচলিত ছিল। তামিল ব্রাহ্মীলিপির কিছু কিছু নিদর্শন, সম্রাট অশোকের শিলালিপির থেকেও প্রাচীন।
কিছুদিন আগে শ্রীলংকার অনুরাধাপুরে একটি পাত্রের গায়ে কিছু ব্রাহ্মীলিপির নিদর্শন পাওয়া গেছে। পণ্ডিতেরা অনুমান করছেন, এটি ৪৫০-৩৫০ বি.সি.র। অতএব ব্রাহ্মীলিপির শুরুর থেকেই অঞ্চলভেদে তার পরিবর্তন চালু হয়েছিল অনেক আগে থেকেই।
গুপ্ত রাজাদের আমলে যে ব্রাহ্মীলিপির নিদর্শন পাওয়া যায়, তাকে “গুপ্ত লিপি” বলা হয়। এই সময় কাল মোটামুটি পঞ্চম শতাব্দী এ.ডি.তে। মূল ব্রাহ্মীলিপি থেকে এই লিপির অনেকটাই পরিবর্তন হয়েছিল। এই গুপ্তলিপি থেকে দেবনাগরি এবং রঞ্জনা বা কুটিলা লিপির সৃষ্টি হয়েছিল। দেবনাগরি লিপি আজও আমরা হিন্দি লিপি হিসেবে দেখতে পাই। কুটিলা প্রভাবিত লিপি আজও নেপাল, তিব্বত, মঙ্গোলিয়া, জাপান, মায়ানমার, সমুদ্রতীরবর্তী চিনের বৌদ্ধ বিহারগুলিতে দেখা যায়। এমনকি আমাদের বাংলা লিপিও অনেকটাই কুটিলা লিপির অনুসারী।
এই সময় থেকেই হিন্দু এবং বিশেষ করে বৌদ্ধ ধর্মের প্রভাবে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে বড়ো বড়ো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠা শুরু হয়েছিল, যেখানে মেধাবী ছাত্ররা রাজপুত্র কিংবা ব্রাহ্মণ না হয়েও উচ্চশিক্ষার অধিকার পেতেন। এদের মধ্যে কিছু কিছু মহাবিহার দেশের বাইরেও বিখ্যাত হয়ে উঠেছিল। যেমন নালন্দা মহাবিহার, বিক্রমশীলা মহাবিহার, রক্তমৃত্তিকা মহাবিহার। এই মহাবিহারগুলি ছাড়াও অনেক বিহারের সন্ধান পাওয়া যায় নানান গ্রন্থে, কিন্তু কালের প্রভাবে সে সবই আজ ধ্বংস হয়ে গেছে। এই বিহার এবং মহাবিহারগুলিতে ছাত্রদের শিক্ষা চর্চার জন্যেই অজস্র পুঁথি রচনা করা হত। সংস্কৃত কিংবা পালি ছিল শিক্ষার প্রধান মাধ্যম। কিন্তু নানান অঞ্চল থেকে আসা মেধাবী ছাত্রদের সংস্কৃত ভাষা শিক্ষার সুবিধার জন্যেও আঞ্চলিক ভাষার পুঁথি রচনা জরুরি হয়ে উঠল।
তা ছাড়াও বদলে যেতে লাগল, ভারতবর্ষের সার্বিক রাজনৈতিক চালচিত্র। মৌর্য সাম্রাজ্যের (মোটামুটি ৩২১ বি.সি. থেকে ১৮৫ বি.সি.) পতনের পর গুপ্ত সাম্রাজ্যের (মোটামুটি ৩২০ এ.ডি. থেকে ৫৫০ এ.ডি.) প্রতিষ্ঠা পর্যন্ত এবং গুপ্ত সাম্রাজ্যের পতনের পরে সুলতানি আমল পর্যন্ত সর্বভারতীয় প্রভাবশালী তেমন কোন সাম্রাজ্য গড়ে উঠতে পারেনি। মধ্যবর্তী সময়ে ইন্দো-গ্রীক, ইন্দো-পারস্য, কুষাণ, সাতবাহন বংশের রাজাদের এবং গুপ্তযুগের পর পাল, পূষ্যভূতি, মৌখরী, রাষ্ট্রকূট বংশের রাজাদের ক্ষমতা ও প্রভাব ছিল সীমিত। তাঁদের দৃষ্টিভঙ্গীও হয়ে উঠছিল কিছুটা আঞ্চলিক। যার ফলে বিভিন্ন রাজার সময়ে বিভিন্ন আঞ্চলিক ভাষাই হয়ে উঠছিল রাজভাষা। উপরন্তু নিজ নিজ ধর্ম বিশ্বাস অনুযায়ী তাঁরা নিজেদের সভাপণ্ডিতদের উৎসাহ দিতেন নানান শাস্ত্রগ্রন্থ রচনার। অতএব আঞ্চলিক ভাষাগুলিও নিজ নিজ রাজাদের পৃষ্ঠপোষকতায় বেড়ে উঠতে লাগল দ্রুত। গুপ্তযুগকে ভারতের ইতিহাসে স্বর্ণ যুগ বলা হয়, পণ্ডিতেরা বলেন, এই সময়েই প্রাচীন সমস্ত গ্রন্থ – বেদ থেকে শুরু করে রামায়ণ, মহাভারত দেবনাগরি লিপিতে সংকলিত হয়েছিল। মনুসংহিতা এবং বেশ কয়েকখানি পুরাণও এই সময়ে রচনা করা হয়েছিল। ব্রাহ্মীলিপি যদি হয় মা, তাহলে দেবনাগরি লিপি তার কন্যা। অতএব এই সময় থেকেই ব্রাহ্মীলিপি তার মাতৃত্বের গৌরব হারাতে লাগল, কন্যা দেবনাগরির হাতে। কিন্তু ব্রাহ্মীলিপির তুলনায় দেবনাগরির মহিমাও বেশিদিন টিকে থাকতে পারল না। পুজোপার্বণে, উচ্চশিক্ষায় সংস্কৃত চালু থাকলেও, নিত্য রাজকাজে, প্রশাসনিক কাজে এমনকি সাহিত্যেও মাথা চাড়া দিতে থাকল আঞ্চলিক ভাষাগুলি। কিছু কিছু পরিবর্তন নিয়ে এই আঞ্চলিক ভাষাগুলির নিজস্ব লিপিও তৈরি হয়ে উঠতে লাগল।
এভাবে ব্রাহ্মীলিপির দুটি প্রধান শাখাকে যদি দক্ষিণ ভারতীয় এবং উত্তর ভারতীয় হিসেবে ভাগ করে নেওয়া হয়, তাহলে উত্তর ব্রাহ্মী থেকে দেবনাগরী, অসমিয়া, বাংলা, ওড়িয়া, হিন্দি, গুরুমুখী – উত্তর ভারতের প্রায় সমস্ত লিপিরই উদ্ভব। আর দক্ষিণ ব্রাহ্মী থেকে তামিল, তেলেগু, কানাড়ি, মালয়লম লিপির সৃষ্টি হয়েছিল।
৯
বাংলা লিপি
মনে করা হয় বাংলা লিপির চর্চা জোরদার হয়ে উঠেছিল মহারাজ শশাঙ্কর আমলে – মোটামুটি ৫৯০ থেকে ৬২৫ এ.ডি.। মহারাজ শশাঙ্ক গুপ্তরাজাদের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে বঙ্গের মহাসামন্ত থেকে গৌড় রাজ্যের রাজা হয়ে ওঠেন। তাঁর সমসাময়িক কিছু তাম্রলিপিতে বাংলা লিপি নিজস্ব রূপ নিতে শুরু করে। এরপর বাংলা লিপির বহু নিদর্শন পাওয়া যায় পালবংশের রাজাদের আমলে – বিশেষ করে বিগ্রহপাল (আনুমানিক ৮৫০-৮৫৩ এ.ডি.) ও নারায়ণ পালের ( আনুমানিক ৮৫৪-৯০৮ এ.ডি.) রাজত্ব কালে। নিচের পাণ্ডুলিপিটি পণ্ডিত হরপ্রসাদ শাস্ত্রী ১৯০৭ সালে নেপাল রাজবাড়ির সংগ্রহশালা থেকে উদ্ধার করেছিলেন। আনুমানিক অষ্টম থেকে দ্বাদশ শতাব্দীতে লেখা “চর্যাপদ”-এর পাণ্ডুলিপি এটি। বাংলা, অসমিয়া, ওড়িয়া এবং মৈথিলি ভাষার পূর্বসূরী “অবহট্ট” ভাষাতে লেখা। তালপাতা ছেঁটে সাজিয়ে তোলা এই পুঁথিটি রাখা আছে বাংলাদেশের রাজশাহী কলেজের সংগ্রহশালায়। বৌদ্ধ তন্ত্রসাধনার গোপন রীতি নিয়ে লেখা এই পদগুলি অনেক বৌদ্ধ তান্ত্রিকের লেখার সংকলন। পণ্ডিত হরপ্রসাদ শাস্ত্রী চর্যাপদের ভাষাকে “সান্ধ্যভাষা” বলেছেন। তার কারণ আপাত দৃষ্টিতে পদগুলির নিহিত অর্থের আড়ালে অন্য কোন বক্তব্যের ইশারা পাওয়া যায়। বাংলা থেকে বৌদ্ধ তন্ত্রসাধনা অবলুপ্ত হয়ে গেছে বহুদিন, সে কারণে এই পদগুলির গূঢ় অর্থ আজও জানা যায়নি।
পালরাজাদের (আনুমানিক ৭৩০ – ১০২৩) আমলেই বাংলা ভাষা এবং লিপি প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল, তারপর সেন রাজাদের আমলেও (আনুমানিক ১০৭০ – ১২৩০ এ.ডি.) বাংলা ভাষা এবং লিপির চর্চা অব্যাহত রইল। সেন আমলেই বাংলা ভাষা তার নিজস্ব লিপিসহ এক স্বতন্ত্র সম্পূর্ণ ভাষার রূপ পেল।
বাংলা সাহিত্য
কোন ভাষা যতোই রাজকাজে কিংবা প্রশাসনিক কাজে ব্যবহার হোক না কেন, সেই ভাষা সার্থক হয়ে ওঠে সাহিত্যের ছোঁয়ায়। কারণ সাহিত্যের ভাষা পাঠকের মন স্পর্শ করে, স্পর্শ করে তার অনুভূতি। মানুষের অন্তরের অনুভব, লিখিত ভাষায় প্রকাশ করার মতো সাবলীল শক্তি যে ভাষা অর্জন করে, সে ভাষা অন্য মাত্রায় পৌঁছে যায়। অতএব বাংলা ভাষায় সাহিত্যের শুরু কবে থেকে হল, অর্থাৎ লেখকেরা কবে থেকে বাংলা ভাষাকেও মনের ভাব প্রকাশের নিজস্ব মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করতে শুরু করলেন, সেটা দেখে নেওয়া দরকার।
বাংলা ভাষায় সাহিত্যের বিকাশকে প্রধানতঃ তিনটি পর্যায়ে ভাগ করা যেতে পারে। প্রাচীন পর্যায় মোটামুটি ৯৫০ – ১৩৫০ এ.ডি., তারপর মধ্যবর্তী পর্যায় মোটামুটি ১৩৫০ থেকে ১৮০০ এ.ডি. এবং সর্বশেষে আধুনিক পর্যায় ১৮০০ থেকে আজকের দিন অব্দি।
প্রাচীন পর্যায়ে সাহিত্য বলতে তেমন উল্লেখযোগ্য কিছুই পাওয়া যায় না। একমাত্র ‘চর্যাপদ’-এর কথাই আবার বলতে হয়। বৌদ্ধতন্ত্রে পণ্ডিতদের লিখিত রহস্যময় ৪৮টি পদের সংকলন। যেগুলির রচনা করেছিলেন লুইপা, ভুসুকুপা, কাহ্নাপা, শবরপা প্রমুখ কয়েকজন বৌদ্ধ তন্ত্র পণ্ডিত।
দ্বিতীয় পর্যায়ে সাহিত্যচর্চার অবস্থা যথেষ্ট ভাল। এই সময়ের সাহিত্য সৃষ্টিকে তিন ভাগে ভাগ করা যায়- বৈষ্ণব সাহিত্য, মঙ্গলকাব্য সাহিত্য এবং অনুবাদ সাহিত্য। দ্বাদশ শতাব্দীতে বড়ু চণ্ডীদাস বৈষ্ণব পদাবলীর বহু পদ লিখে জনপ্রিয়তার শীর্ষে ছিলেন। তাঁর পরবর্তী সময়ে আরো অনেক চণ্ডীদাস, যেমন আদি চণ্ডীদাস, কবি চণ্ডীদাস, দ্বিজ চণ্ডীদাস এবং দীন চণ্ডীদাস বৈষ্ণব পদাবলী রচনা করে বাংলা সাহিত্যকে ঋদ্ধ করেছেন সন্দেহ নেই। তবে বড়ু চণ্ডীদাসের তুল্য কেউই হতে পারেননি। এরপর নাম করতে হয় মঙ্গলকাব্যগুলির। পঞ্চদশ শতাব্দীতে বিজয় গুপ্তের প্রথম মঙ্গলকাব্য “মনসামঙ্গল”, বিপ্রদাস পিপলাইয়ের “মনসাবিজয়” বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এই মঙ্গলকাব্যে দেবতাদের মহিমার কথা থাকলেও সাধারণ মানুষের আবেগ, মায়া, মমতা, ভাব, ভালবাসা, অহংকার, ঈর্ষা, দ্বেষ নিয়ে অনবদ্য মানসিক টানাপোড়েনের ছবি পাওয়া যায়। একই কথা বলা যায় মানিক দত্ত, মাধবাচার্য, দ্বিজমাধব কিংবা মুকুন্দরাম চক্রবর্তীর “চণ্ডীমঙ্গল” কাব্য নিয়েও।
অনুবাদ সাহিত্যে প্রথমেই নাম করতে হয় কৃত্তিবাস ওঝার বাংলা রামায়ণের অনুবাদ এবং কাশীরাম দাসের বাংলা মহাভারত। এই সেদিনও আমাদের ছোটবেলায়, পঞ্চদশ শতাব্দীর রচনা কৃত্তিবাসী রামায়ণের দেখা মিলত বাঙালীর ঘরে ঘরে। পাঁচশো বছর ধরে এমন জনপ্রিয়তা যথেষ্ট ঈর্ষার বিষয় সন্দেহ নেই! কৃত্তিবাসী রামায়ণ, মূল রামায়ণের আক্ষরিক অনুবাদ নয়, অনেক ঘটনাই কৃত্তিবাসী কল্পনা, অনেক আচার-আচরণই মমতাময় বাঙালী পারিবারিক সম্পর্কমাখা। সেই কারণেই হয়তো মূল রামায়ণের থেকেও কৃত্তিবাসী রামায়ণ বাংলার ঘরে ঘরে এত জনপ্রিয় হয়েছিল। সুলতানী আমলে আরবী এবং পারসিয়ান সাহিত্যের অনুবাদ বাংলা ভাষাকে আরও ঋদ্ধ করে তুলেছিল। মধ্যযুগে শা মুহম্মদ সাগির, জৈনুদ্দিন, মুজাম্মিন, সৈয়দ সুলতান, শেখ ফইজুল্লা প্রমুখ ছিলেন বাংলার বিখ্যাত মুসলিম কবি। মুহম্মদ সাগিরের “ইউসুফ-জুলেখা”, সৈয়দ সুলতানের “নবিবংশ” অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়েছিল।
অষ্টাদশ শতকের প্রধান কবি ছিলেন ভারতচন্দ্র রায় গুণাকর (১৭১২-১৭৬০)। তাঁর লেখা “অন্নদামঙ্গল” কাব্য বহুদিন অত্যন্ত জনপ্রিয় ছিল। কৃষ্ণনগরের রাজা মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের সভাকবি ভারতচন্দ্রের লেখা অন্নদামঙ্গলের প্রকাশকাল ১৭৫২ সাল। এই গ্রন্থের তিনটি অংশ। প্রথম অংশ- অন্নদামঙ্গলে দেবী অন্নপূর্ণার মহিমা বর্ণনা করেছেন। দ্বিতীয় অংশে বিদ্যা ও সুন্দরের কাহিনী, এই অংশের নাম কালিকামঙ্গল। তৃতীয় অংশে মোগল সম্রাট আকবরের বিশ্বস্ত সেনাপতি মান সিং এবং ভবানন্দ মজুমদারের কাহিনী – এই অংশের নাম অন্নপূর্ণামঙ্গল। ভারতচন্দ্র শুধু যে কাব্যচর্চাতেই প্রতিভাধর ছিলেন তা নয়, সঙ্গীতেও অত্যন্ত দক্ষ ছিলেন। শ্রীরাধা-কৃষ্ণ বিষয়ে লেখা এবং নিজের সুরে গাওয়া পদাবলী গান, যাকে শ্রীকৃষ্ণকীর্তন বলা হত, বাংলার সঙ্গীতজগতে নতুন এক ধারার সৃষ্টি করেছিল। যে ধারা অনুসরণ করে রামপ্রসাদ সেন (১৭২১-১৭৮১)-এর শাক্তপদাবলী এবং শ্যামাসঙ্গীত, তিনশবছর ধরে, আজও সমান সজীব!
১৭৫৭-র পলাশীর যুদ্ধে, ইষ্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানীর ব্রিটিশ সৈন্যের হাতে বাংলার নবাব সিরাজদ্দৌলার বীভৎস পরাজয়ের পর, বাংলা এবং ভারতের রাজনৈতিক, সামাজিক এবং শিক্ষাদীক্ষার প্রেক্ষাপটই দ্রুত বদলে যেতে লাগল। ব্রিটিশ রাজত্বের রাজধানী হয়ে নতুন শহরের পত্তন হল কলকাতায়। ভারতের রাজনৈতিক ক্ষমতার প্রাচীন ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু দিল্লি থেকে কলকাতায় সরে এল। বদ্ধ জলাশয়ের মতো মধ্যযুগের পিছিয়ে থাকা ভারতীয় সমাজে এসে ধাক্কা দিল, ইওরোপের- বিশেষ করে ইংল্যাণ্ডের আধুনিক শিল্পবিপ্লবের ছোঁয়া এবং রেনেশাঁ যুগের নতুন নতুন চিন্তাভাবনা। কলকাতা রাজধানী হওয়াতে দেশের অন্য প্রান্তের থেকে বাংলার বুদ্ধিজীবিরা পশ্চিমের এই চমক লাগানো আধুনিকতায় ডুবে যাওয়ার সুযোগ পেয়ে গেল খুব সহজেই। একই সঙ্গে সদ্য কৈশোর পার হওয়া বাংলা ভাষা এবং বাংলা লিপি ইওরোপের আলোর স্পর্শে হঠাৎ যেন যুবক হয়ে উঠল। বাংলা ভাষা ও বাংলা লিপি পা রাখল আধুনিক বিশ্ব-দরবারের অঙ্গনে। সে কথা বলবো, পরের সংখ্যায়।
পরের সংখ্যায় শেষ পর্ব