অরূপ ব্যানার্জির আগের লেখা দুর্লভ ইলিশ সহজ বিজ্ঞান সব পর্ব একত্রে
পৃথিবীর দুই মেরু, উত্তর ও দক্ষিণ। এই দুই মেরুর আকাশে অত্যাশ্চর্য আলোর খেলা দেখা যায়, যাকে আমরা মেরুপ্রভা বলে জানি। হাজার হাজার বছর ধরে মানুষকে বিস্মিত করেছে আলোর এই কারসাজী। উত্তর মেরুতে এই আলোর ছটাকে বলা হয় Aurora Borealis। দক্ষিণ মেরুর মেরু প্রভাকে বলা হয় Aurora Australis। Aurora কথার অর্থ ভোরের আলো।
যখন মানুষ বিজ্ঞানের আলোয় পারিপার্শ্বিক ঘটনাকে ব্যখ্যা করতে পারত না, তখন তার ধারনা ছিল, নিশ্চই এর পিছনে আছে কোনও দৈবশক্তি বা আসুরিক শক্তি। যেমন আদিম যুগে গ্রীনল্যান্ড বাসিদের ধারনা ছিল, মেরুপ্রভা আসলে মৃত সন্তানদের আত্মা। সুইডেনের মানুষেরা মনে করত দেবতা তাদের আশীর্বাদ দিচ্ছেন মেরুপ্রভার মাধ্যমে। রোমানরা মেরুপ্রভাকে আলোর দেবী বলে কল্পনা করত। শোনা যায় মেরু থেকে দূরেও এই প্রভা দেখা যেত অনেক কাল আগে। যেমন চিনা ড্রাগনের কল্পনাও নাকি এই মেরুপ্রভা থেকেই। মেরুপ্রভা দেখে তারা নাকি মনে করত ভাল ড্রাগন আর খারাপ ড্রাগনে লড়াই বাধিয়ে বেজায় আস্ফালন করছে দিগন্ত জুড়ে। সত্যি সত্যি চিন দেশে এই মেরুপ্রভা দেখা যেত, না তখনকার যাযাবর মানুষেরা উত্তর মেরুর কাছাকাছি কোথাও এই আলোর খেলা দেখে ফেলেছিল, সে সব আজ আর জানবার কোন উপায় নেই।
পৃথিবীর আকাশে এই দৈব আলোর পিছনে আছে অত্যন্ত চমকপ্রদ বিজ্ঞান। তোমরা সবাই জানো যে পৃথিবীর নিজস্ব চুম্বক শক্তি আছে। ভূপৃষ্ঠ থেকে পৃথিবীর কেন্দ্রের দিকে যেতে আমরা চারটি স্তর পাই- তৃতীয় স্তরটিতে আছে তরলীভূত লোহা আর নিকেল। তরল পরিস্থিতিতে থাকবার কারনে এরা আয়নিত অবস্থায় থাকে। পৃথিবী তার নিজের অক্ষে যখন পাক খায়, তখন এই তরল আয়নিত লোহা ও নিকেলের মিশ্রন বৃত্তাকারে ঘুরতে থাকে। কাজেই সৃষ্টি হয় বৃত্তাকার বিদ্যুৎ প্রবাহ। ঘুরতে থাকা এই বিদ্যুৎ প্রবাহের জন্য সৃষ্টি হয় চুম্বক শক্তি (রাইট হ্যান্ড থাম্ব রুল)। ফলে পৃথিবীর চুম্বক বল রেখা গুলো ভৌগলিক দক্ষিণ মেরু থেকে শুরু হয়ে ভৌগলিক উত্তর মেরুতে শেষ হয়। নিচের ছবি দেখে বোঝা যাচ্ছে দুই মেরুতেই এই চুম্বক বল রেখা গুলো সোজাসুজি ভূপৃষ্ঠে ফিরে আসে। এখানে মনে রাখতে হবে, ভৌগলিক উত্তর মেরু কিন্তু চুম্বকীয় দক্ষিণ মেরু এবং ভৌগলিক দক্ষিণ মেরু চুম্বকীয় উত্তর মেরু।
এবার দেখা যাক মেরুপ্রভাতে সূর্যের ভূমিকা। সূর্যের ভিতরে আছে হাইড্রোজেন আর হিলিয়াম গ্যাস। প্রবল তাপে সেই গ্যাসের পারমানবিক বিক্রিয়া হয়ে চলেছে ক্রমাগত। কখনো কখনো সেই বিক্রিয়ার প্রবল বিস্ফোরণে সূর্যের উপরি ভাগের গ্যাস তিব্র গতিতে চারিদিকে ছিটকে ওঠে। সূর্যের নিজস্ব চুম্বকীয় ক্ষেত্রের উপস্থিতির জন্য নির্গত ইলেকট্রন স্রোত ধাবিত হয় পৃথিবীর অভিমুখে। এই ঘটনাকে বলা হয় সৌর ঝড়। যে কোনও সময়ে এই সৌর ঝড় ঘটতে পারে, তার নির্দিষ্ট কোন নিয়ম নেই।
সূর্য থেকে আগত ইলেকট্রন স্রোত এবার ভূপৃষ্ঠে কি খেলা করে দেখা যাক। ফ্লেমিঙ্গের বিখ্যাত বাম হস্ত নিয়ম (লেফট হ্যান্ড রুল) স্কুলে পড়েছ অনেকে। মনে করার জন্য নিচের ছবিতে দেখ। এই নিয়ম অনুযায়ী, যদি তর্জনীর দিকে হয় চৌম্বক ক্ষেত্র, মধ্যমার দিকে হয় তড়িৎ প্রবাহ, তাহলে একটি বিদ্যুৎ বাহী তার অঙ্গুষ্ঠের দিকে বেঁকে যায়। সূর্যের থেকে ধেয়ে আসা ইলেকট্রন স্রোত বিদ্যুৎ বাহী তারের মত ব্যবহার করে, কারণ ইলেকট্রনে আছে নেগেটিভ চার্জ। আর পৃথিবীর চুম্বক ক্ষেত্রের সাথে সামান্য আনত অবস্থায় এই ইলেকট্রন স্রোত যখন বায়ুমণ্ডলে প্রবেশ করে, তার গতি বেঁকে যায় এবং ইলেকট্রন স্রোত স্প্রিঙের মত পাক খায়। পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে উপস্থিত অক্সিজেন আর নাইট্রোজেনের সাথে ধাক্কা খায় এই ইলেকট্রন স্রোত। ধরা যাক, অক্সিজেনের একটা পরমাণুর সাথে ধাক্কা খেল একটা তীব্র গতিতে ধেয়ে আসা এক ইলেকট্রন। ইলেকট্রনের গতিশক্তি অক্সিজেন পরমাণুর বাইরের খোলে ঘুরতে থাকা ইলেকট্রনে হস্তান্তরিত হল। অক্সিজেনের ইলেকট্রন উচ্চ শক্তির স্তরে চলে গেল। কিন্তু যখনি এই ইলেকট্রন আবার তার অপেক্ষাকৃত নিচের শক্তি স্তরে নেবে আসে, তখন সে শক্তি নির্গত করে এবং সেই শক্তি আলোক শক্তি। কোটি কোটি ইলেকট্রন এই ভাবে আলো বিচ্ছুরিত করে। এই যে আলোর বিকিরণের কারণ ব্যখ্যা করা হল, তার পিছনে যে নিয়ম আছে, তা হল বোরের সুত্র। ১৯১৩ সালে বিজ্ঞানী নীলস বোর তার বিখ্যাত “ Bohr’s Theory” প্রস্তাবনা করেন।
অক্সিজেন পরমাণুর থেকে যে রশ্মি নির্গত হয়, তার রঙ সবুজ। আবার নাইট্রোজেন পরমানু থেকে নির্গত হয় লাল রঙ। কারণ প্রতি পরমাণুর শক্তি স্তর আলাদা আলাদা। শক্তি স্তরের পার্থক্যের উপর নির্ভর করে সে কোন রঙের আলো নির্গত করবে।
আকাশে এই আলোর রঙিন খেলা দেখতে হলে যেতে হবে উত্তর মেরুর কাছাকাছি দেশ গুলোতে, যেমন কানাডা, আলাস্কা, আইসল্যান্ড, গ্রিনল্যান্ড বা রাশিয়া। দক্ষিন মেরুতেও ঠিক একই সময়ে মেরুপ্রভা দেখতে পাওয়া যায়। কখনও কখনও মনে হয় যেন রঙিন আলোর চাদর কেউ আকাশে মেলে দিয়েছে আর হাওয়ায় দুলছে। আলোর চাদর বা আলোর সিঁড়ি দুলতে থাকার কারণ পৃথিবীর চুম্বক ক্ষেত্রের পরিবর্তন।
এবার কথা হচ্ছে, পৃথিবীতে এই বিস্ময়কর মেরুপ্রভা যেমন দেখা যায়, অন্য গ্রহেও কী এমনটাই দেখা যেতে পারে? এতক্ষনে নিশ্চই তোমরা বুঝে গেছ যে কোনও গ্রহে বায়ুমণ্ডল থাকলে এবং তার নিজস্ব চুম্বকীয় ক্ষেত্র থাকলেই এই মেরুপ্রভা দেখা যাবে। বৃহস্পতি আর শুক্রগ্রহে গেলে আমারা মেরুপ্রভা দেখতে পাব। কিন্তু চাঁদে দেখা যাবে না, কারণ চাঁদে বায়ুমণ্ডল নেই।