সুজিত কুমার নাহার আগের লেখা সহজ বিজ্ঞান-হাতির চেয়ে বড়ো স্থলচর প্রাণী নেই কেন
হদিশ প্রথমে দিয়েছিলেন বরেণ্য বিজ্ঞানী মাইকেল ফ্যারাডে। আজ থেকে প্রায় দুশো বছর আগে বিদ্যুৎ নিয়ে তাঁর বিচিত্র পরীক্ষা-গবেষণা-তত্ত্বানুসন্ধানের বিবরণ লিখতে বসে চুম্বকের দোসরের অস্তিত্বের আভাস দিয়েছিলেন তিনি। মজার বিষয় হল, চুম্বকের ইংরেজি নামে মাত্র ছটি অক্ষর থাকলেও ফ্যারাডের দেওয়া দোসরের নামটিতে ছিল পাক্কা উনিশটি অক্ষর ! বিষয়টি নিয়ে এরপর আলোচনা করেন বিজ্ঞানী অলিভার হেভিসাইড। ফ্যারাডের রাখা উনিশ অক্ষরের দাঁতভাঙা নাম সুবিধাজনক মনে না হওয়ায় পালটে রাখেন আট অক্ষরের ছোটো নাম ‘ELECTRET‘। আসলে, ELECTRicity ও magnET-এর অংশ সহযোগেই তিনি ELECTRET শব্দটি গঠন করেছিলেন।
চুম্বকের এই দোসরের সাহায্য আমরা নিয়ে থাকি হামেশাই। হয়তো অজান্তেই। এমন বহু বহনযোগ্য (পোর্টেবল) বৈদ্যুতিন (electronic) উপকরণ আমরা ব্যবহার করি যেগুলো হয়ত বানানোই যেত না এটির উদ্ভাবন ছাড়া।
ইলেকট্রেট-এর বাংলা পরিভাষা কী হবে ? হেভিসাইডের অনুকরণে ‘বিদ্যুৎ’ ও ‘চুম্বক’ শব্দদ্বয়ের টুকরো জুড়ে তৈরি করতে পারি ইলেকট্রেট-এর বাংলা রূপভেদ ‘বিম্বক’।
ফ্যারাডে কিংবা হেভিসাইড কিন্তু বিম্বক বানাননি। তাঁদের কাজ তাত্ত্বিক আলোচনাতেই থেমে ছিল। সেই সময়ের প্রযুক্তিগত সীমাবদ্ধতার কারণেই তাঁরা হাতে নিতে পারেননি বিম্বক তৈরির কাজ। এরপর কেটে যায় অনেকগুলো বছর। এখন (2017) থেকে ঠিক 92 বছর আগে জাপানি অধ্যাপক মোতোতারো ইগুচি বিম্বক তৈরির কথা সর্বপ্রথম ঘোষণা করেন। তাই ইগুচির বানানো নমুনাটিকেই বিশ্বের প্রথম বিম্বক বলে গণ্য করা হয়।
এবার জেনে নেওয়া যাক বিম্বক ঠিক কী জিনিস।
বিম্বককে মনে করা যেতে পারে চুম্বকের বৈদ্যুতিক প্রতিরূপ (electrical counterpart)। আসলে বিম্বক হচ্ছে মৌচাকের মোম (beeswax), অ্যাক্রিলিক (এক ধরনের প্লাস্টিক),ইথাইল সেলুলোজ,পলিস্টাইরিন, সিরামিক ইত্যাদি স্বমেরু অণু (polar molecule)-সমন্বিত অন্তরকের (insulator) বিশেষ প্রক্রিয়ায় তৈরি এমন একটি টুকরো যার একদিকে পজিটিভ চার্জ ও অন্যদিকে নেগেটিভ চার্জ অবস্থান করে স্থায়ীভাবে। চুম্বকের দুই প্রান্তে ভিন্নধর্মী মেরুর অবস্থানের সাথে এটা বেশ মিলে যায়। মিল আরও আছে। চুম্বককে যেমন ঘিরে থাকে চৌম্বক ক্ষেত্র, ঠিক তেমনি বিম্বকের চারপাশেও থাকে স্থিরবৈদ্যুৎ ক্ষেত্র।
বিম্বক সম্পর্কে অবগত হওয়ার পর জানা যাক বিম্বক কীভাবে তৈরি করা হয় আর এটির ব্যবহারের ক্ষেত্র কী কী। এই বিষয়ে মোটামুটি ধারণা করা যাবে পরের আলোচনা থেকে।
বিম্বক বানানোর কৌশল
বিভিন্ন পদ্ধতিতে বিম্বক তৈরি করা যায়। প্রথমদিকে কায়দাটা ছিল অত্যন্ত বিপজ্জনক। প্রতি মিটারে প্রায় এক লক্ষ ভোল্ট বা তার কাছাকাছি উচ্চ মাত্রার বিভব ক্ষেত্র সৃষ্টি করে তার ভেতর তরল অবস্থায় বিম্বকের উপাদানটি রেখে জমতে দেওয়া হত। উপাদানের স্বমেরু অণুগুলো সাধারণত এলোমেলোভাবে বিভিন্ন দিকে মুখ করে বিন্যস্ত থাকে। হাই ভোল্ট ফিল্ডের পাল্লায় পড়ে কিন্তু স্বমেরু অণুগুলো ফিল্ডের অভিমুখ অনুসারে ঠিক দিকে মুখ করে নিজেদের সাজিয়ে ফেলতে বাধ্য হয়। ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বিশ্রামরত সেনারা কমান্ডারের নির্দেশে যেমন চটজলদি সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে পড়ে, ব্যাপারটা যেন তেমনই ! ঠান্ডা হয়ে জমাট বাধার পরে ইলেকট্রিক ফিল্ড অফ্ করলেও বজায় থাকে অণুদের এই সুশৃঙ্খল বিন্যাস । এই ব্যবস্থাপনার নিট ফল হিসেবে দুই প্রান্তে বিপরীতধর্মী চার্জ পাকাপাকিভাবে আস্তানা গাড়ে। একদিকে পজিটিভ চার্জ ও অন্যদিকে নেগেটিভ চার্জের স্থায়ী উপস্থিতির কারণে জন্ম হয় বিম্বকের।
বিম্বক প্রস্তুতিতে বিপজ্জনক অত্যুচ্চ ভোল্টের বিদ্যুৎ এখন আর দরকার পড়ে না। বিম্বকের উপাদানের ভেতর অতিরিক্ত চার্জ বাইরে থেকে ঢোকানোর উপায় উদ্ভাবনের পর অনেক সহজে ও কম খরচে বিম্বক বানানো সম্ভব হয়েছে।
বিম্বকের ব্যবহার
বিম্বকের উদ্ভাবনে পালটে গেছে মাইক্রোফোনের দুনিয়া। বিম্বক ব্যবহার করে গোলমরিচের চেয়েও ছোটো কিন্তু অত্যন্ত উন্নত ধরনের ‘ইলেকট্রেট মাইক্রোফোন’ তৈরি করা সম্ভব হয়েছে । মাইক্রোফোন বাজারের প্রায় নব্বই শতাংশই এখন বিম্বকের দখলে। সংখ্যার হিসেবে বছরে ইলেকট্রেট মাইক্রোফোনের উৎপাদন 200 কোটি ছাড়িয়ে গেছে।
প্রত্যেক ল্যাপটপ, ট্যাব, মোবাইল ফোন, ডিজিটাল অডিও রেকর্ডার, হিয়ারিং এইড এসবের ভেতরে ইলেকট্রেট মাইক্রোফোনের দেখা অবশ্যই মিলবে। এমনকী রেকর্ডিং স্টুডিওতে ব্যবহৃত বেশির ভাগ মাইক্রোফোনই এখন ইলেকট্রেট পরিবারভুক্ত।
বিম্বক যে কেবল মাইক্রোফোন বানাতেই কাজে লাগে তা নয়। ফোটোকপি মেশিন, এয়ার ফিল্টার, রেডিয়েশন মিটার, কম্পনশীল বস্তু থেকে শক্তি সংগ্রহ, বিভিন্ন ধরনের বৈদ্যুতিক মাপন যন্ত্র — এসব নানা উপকরণ বানাতে এখন বিম্বক ব্যবহৃত হচ্ছে।
উন্নত মানের বৈদ্যুতিন সামগ্রীর আকারগত ক্ষুদ্রায়নের (miniaturisation) স্বপ্ন বাস্তবায়িত হওয়ার পেছনে চুম্বকের দোসর বিম্বকের যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে, সেকথা মানতেই হবে !