সহজ বিজ্ঞান–সব লেখা একত্রে
একটি প্যাঁচালো ব্যাপার
রবি সোম
কলেজের সময় থেকেই চিনি দর্জিলদাকে। ও ছিল আমাদের এক বছরের সিনিয়র। কলেজের সকলেই দারুণ পছন্দ করত দর্জিল দাসকে। দর্জিলদার বিপুল জনপ্রিয়তার কারণ কী ছিল সেটা জানানো দরকার। খুঁজলে দর্জিলদার মতো দিলদরিয়া, পরোপকারী ছেলে নিশ্চয়ই পাওয়া যাবে, কিন্তু মিলবে না দর্জিলদার মতো অসাধারণ জ্ঞানসম্পন্ন, বিপুল বুদ্ধিদীপ্ত ও চটজলদি সমস্যা সমাধান-পারঙ্গম ব্যক্তি।
কলেজের পাট চুকিয়ে শুরু হল চাকরি-জীবন। বেঙ্গালুরুতে একই কোম্পানিতে চাকরি পেলাম সহপাঠী সুজিত ও আমি। দর্জিলদা যে বেঙ্গালুরুতে থাকে তা জানতাম। এখানে এসে যোগাযোগ করলাম। আমি ও সুজিত বেঙ্গালুরুতে চাকরি পেয়েছি জেনে দর্জিলদা খুব খুশি হল।
দর্জিলদা থাকায় প্রবাসে আমাদের দিন ভালোই কাটতে থাকল। সাক্ষাতে বা ফোনে দর্জিলদার নির্দেশ বা উপদেশ আমাদের ভরসা যোগায়, বাধাবিঘ্নকে পাশ কাটাতেও সাহায্য করে। দর্জিলদার থেকে কত কিছু যে শিখেছি তা বলে শেষ করা যাবে না। এই প্রসঙ্গে একটা ঘটনার কথা মনে পড়ে গেল। ন্যাটা মানুষের মতো স্ক্রুর গুণা (স্ক্রু থ্রেড) যে বাঁ-হাতি হতে পারে সেটা জেনেছিলাম দর্জিলদার দৌলতেই। স্পষ্ট মনে আছে, বাঁ-হাতি গুণার হালচাল জেনে ভীষণ অবাক হয়েছিলাম। সেদিনের ঘটনাটা এবার সংক্ষেপে বলি।
বেঙ্গালুরুতে কাছেপিঠে যাতায়াতের জন্য একটা সাইকেল কেনা হয়েছে মাস কয়েক আগে। এখানকার পথঘাট ভালো। পাড়ার ভেতরের খানাখন্দবিহীন সমতল রাস্তায় সাইকেল চালানো বেশ আরামপ্রদ। নিরাপদও। সকালে অফিস যাওয়ার আগে সময় পেলেই সাইকেলে চেপে মিনিট পনেরো চক্কর কেটে আসি। বিশুদ্ধ বায়ু সেবনের পাশাপাশি হয় শরীরচর্চাও। সুজিতের সাইকেল চড়া কিন্তু নেহাতই প্রয়োজনভিত্তিক। জিনিসপত্র কেনাকাটা, চিঠি ডাকবাক্সে ফেলা, জামাকাপড় ধুতে দেওয়া এসব সাতসতেরো কাজে বাহনটি না হলে ওর চলে না।
নিয়মিত ব্যবহার করলেও দ্বিচক্রযানটির দেখভালের দিকে আমরা কখনও নজর দিইনি। আজ ছুটির দিন তাই নেই কোনও ব্যস্ততা। সাইকেল বের করতে গিয়ে হঠাৎ খেয়াল করলাম কাঠামো, হাতল, চাকা, মাডগার্ড, পেডাল – সবকিছুই ধুলো-ময়লা প্রলেপিত হওয়ায় অত্যন্ত দুর্দশাগ্রস্ত। সাইকেল চালানোর সময় মৃদু ক্যাঁচ-কোচ আওয়াজ পাচ্ছিলাম কিছুদিন থেকে। আজ বোঝা গেল বিয়ারিংয়ে পিচ্ছিলকারী তেলের স্বল্পতাই এর কারণ। এখন সাবধান না হলে ভবিষ্যতে আরও জটিল সমস্যা মাথাচাড়া দেবে।
সুজিতের সাথে জরুরি মিটিং করে সিদ্ধান্ত হল, আর দেরি না করে আজই ‘স্বচ্ছ সাইকেল’ অভিযানের সূচনা করতে হবে। ধুয়ে মুছে সাফসুতরো করা, বিয়ারিংয়ে তেল দেওয়া এসব কর্মকাণ্ড প্রথমবার সংঘটিত হবে আজ। পরবর্তীতে এই কাজ করা হবে মাসে অন্তত একবার করে।
সাইকেল কেনার সময় বুদ্ধি করে তত্ত্বাবধায়ক যন্ত্রগুচ্ছ (মেইনটিনেন্স টুল কিট) নেওয়া হয়েছিল। অতএব সময় নষ্ট না করে কাজে নামা হল। পেডালগুলোর হাল শোচনীয় হওয়ায় ওগুলোকে সাইকেল থেকে খুলে ব্রাশ দিয়ে ঘষে পরিষ্কার করার পরিকল্পনা করা হল। টুল কিট ঘেঁটে পেডাল রেঞ্চ (pedal wrench) বের করে সুজিত পেডাল খোলার কাজে হাত দিল। ডানদিকের পেডালটি খোলা গেলেও বাঁদিকের পেডাল কিছুতেই খুলতে পারল না সুজিত। ও হাল ছাড়ার পর হাত লাগালাম আমি। কিন্তু অনেক চেষ্টা করেও ঠ্যাঁটা পেডালটাকে কব্জা করা গেল না। পেডালের টাকু-র (spindle) প্যাঁচগুলো দারুণভাবে সেঁটে গিয়ে যে আমাদের প্যাঁচে ফেলছে সেটা বুঝতে পারছিলাম। কিন্তু কেবল বাঁদিকের প্যাঁচগুলোই যে কেন দুর্ব্যবহার করছে, মাথায় ঢুকছিল না সেটাই।
গোলমেলে পরিস্থিতিতে পড়ে আমাদের যখন কিংকর্তব্যবিমূঢ় অবস্থা, ঠিক তখনই গুমোট গরমে একঝলক দমকা হাওয়ার মতো হাজির হল দর্জিলদা। আমরা যেন হাতে চাঁদ পেলাম! চারপাশে দৃকপাত করে অবস্থাগতিক বুঝে নিতে চৌকস দর্জিলদার অসুবিধে হল না মোটেই। মুচকি হেসে বলল, “লেফট সাইডের পেডালটা খুলছে না বলে ঘাবড়ে গেছিস, তাই তো? আসলে ওটা খুলতে শুধু গায়ের জোর নয়, লাগে কিঞ্চিৎ জ্ঞানও!”
কিছু কিছু প্যাঁচালো স্ক্রু খুলতে জ্ঞান জরুরি জেনে তাজ্জব বনে গেলাম। বিস্ময়ের ঘোর কাটার পর বিষয়টা বুঝিয়ে বলার জন্য অনুরোধ করলাম দর্জিলদাকে। উত্তরে যা শুনেছিলাম তা যেমন আশ্চর্যজনক তেমনি কৌতূহলপ্রদ। দর্জিলদা বক্তব্যের নির্যাস ছিল এইরকম।
“বস্তুদের জুড়তে হামেশাই নাট-বল্টু, স্ক্রু ইত্যাদি ব্যবহার করা হয়। এধরনের জোড়কে গুণাজ জোড় (threaded joint) বলা হয়। দরকার পড়লে এই জোড় সহজেই খুলে ফেলা যায়। মজার কথা, অধিকাংশ মানুষ ডানহাতি হওয়ার প্রভাব পড়েছে গুণার ওপরেও। বেশিরভাগ গুণা তাই ডানহাতি (right-handed)। টাইট করতে হলে ডানহাতি স্ক্রু ডানদিকে আর আলগা করতে হলে বাঁদিকে ঘোরাতে হয়। মনে রাখার জন্য ইংরেজিতে একটা মজার কথা আছে, Righty Tighty, Lefty Loosey! বাঁহাতি স্ক্রুর বেলায় ঠিক উল্টোটা করতে হবে – টাইট করতে বাঁদিকে আর আলগা করতে ডানদিকে ঘোরাতে হবে।
“সাইকেলের বাঁদিকের পেডালের টাকুর প্যাঁচগুলো বাঁহাতি বানাতেই হয়। অন্যথায় পেডাল ঘুরিয়ে সাইকেল চালানোর দরুন বাঁদিকের পেডালটা ‘লুজ’ হতে হতে অবশেষে খুলে মাটিতে পড়ে যেত।
“বুঝতেই পারছিস, বাঁহাতি প্যাঁচ হওয়ায় বাঁদিকের পেডাল খুলতে হলে রেঞ্চ ডানদিকে ঘোরানোর দরকার। কিন্তু তোরা অভ্যাসবশে বাঁদিকে ঘোরাচ্ছিলি বলে খোলার বদলে ওটা আরও সেঁটে বসছিল!”
কথা শেষ করে দর্জিলদা কাজে নামল। বাঁদিকের পেডালটা এবার সহজেই খুলে গেল।
“কী আশ্চর্য কাণ্ড! তুমি না এলে সাইকেল সারানোর দোকান খুঁজে বের করতে হত আমাদের।” বলল সুজিত।
“ঝামেলা তো চুকেছে, এবার কিছুক্ষণের জন্য নেওয়া যাক বিরতি। চা-টা খেয়ে আবার নাহয় কাজ শুরু করা যাবে।” প্রস্তাব পেশ করলাম আমি।
সর্বসম্মতিক্রমে প্রস্তাব পাশ হল নিমেষেই! ‘স্বচ্ছ সাইকেল’ অভিযানে অতঃপর পড়ল সাময়িক বিরতি।
জয়ঢাকের বৈজ্ঞানিকের দপ্তর