বৈজ্ঞানিকের দপ্তর-টেকনো টুকটাক আগুন আবিষ্কার ২ কিশোর ঘোষাল শীত ২০১৬

আগের পর্ব ও টেকনো টুকটাকের সব লেখা

পাথরে ঠোকাঠুকি করলে ছোটখাটো যে আগুনের ফুলকি দেখা যায়, তা দিয়ে কিন্তু আগুন জ্বালানো যায় না। আগুন জ্বালানোর জন্য অনেক বড়ো ফুলকির দরকার হয়, আর যে দুটো পাথর ঘষে আগুন জ্বালানোর মতো ফুলকি তৈরি করা যেত তারা প্রধানতঃ হল ফ্লিন্ট (Flint) আর পাইরাইট (Pyrite) পাথর। এই পাইরাইট যদি লোহা মিশ্রিত হয়, তবে তার ফুলকি হয় সবচেয়ে জোরদার। চক বা চুণাপাথরের (Lime stone) মধ্যে কেলাসিত (crystallized)  একটি বিশেষ কোয়ার্জ (Quartz) পাথরকে ফ্লিন্ট বলে। উপরের ছবিটি প্রস্তর যুগের একটি ফ্লিন্ট পাথরের অস্ত্র।  এই ফ্লিন্ট পাথরের বিশেষত্ব হল, একটা বিশেষ দিক থেকে আঘাত করলে, বেশ পাতলা, মসৃণ অথচ শক্ত স্তরে ভেঙে যায়। তারপর একটু ঘষাঘষি করলে, পাথরের ধারালো অস্ত্র বানিয়ে তোলা যেত সহজেই। প্রস্তর যুগের মানুষেরা যখন পাথরের অস্ত্রশস্ত্রই বহুল ব্যবহার করত, তাদের কাছে ফ্লিন্ট পাথরের অস্ত্র ছিল সব থেকে কাজের জিনিস। পাইরাইট একধরনের খনিজ পাথর, প্রধানত লোহা বা তামার সালফাইড; পাললিক (sedimentary) পাথরের স্তরে মাঝে মধ্যেই পাওয়া যায়। বহুদিন পরে মানুষ যখন লোহা আবিষ্কার করতে পেরেছিল, তখনও লোহা আর এই ফ্লিন্ট পাথরের ঘর্ষণে আগুনের ফুলকি ব্যবহার করেই আগুন জ্বালাত। সত্যি বলতে আজও আমরা যে গ্যাসলাইটারে লোহার চাকায় চাপ দিয়ে আগুন জ্বালাই, তার নিচেয় থাকে ফ্লিন্ট পাথরের ছোট্ট একটা কুচি, যাকে চলতি বাংলায় আমরা চকমকি পাথর বলি।

তখনকার দিনে এই ফ্লিন্ট পাথর আর আয়রন পাইরাইট দিয়ে আগুন জ্বালানোতেও কিন্তু অনেক ঝামেলা ছিল। প্রথমত জরুরি ছিল দক্ষতা এবং ধৈর্য, দ্বিতীয়ত শুকনো ঘাসপাতা, ডালপালার যোগাড়। সারা বছরের সামান্য কয়েকটি মাস ছাড়া, বৃষ্টি বা শিশিরের প্রকোপে শুকনো ঘাসপাতা যোগাড় করা এবং সঞ্চয় রাখা কম মুশকিল ছিল না। তার থেকে আগুনকে না নিভিয়ে, স্তিমিত অবস্থায় জ্বালিয়ে রাখা অনেক সহজ ছিল এবং আগুনের নিয়ন্ত্রণ শিখে যাওয়ার পর, তখনকার মানুষ তাই করত। যদিও এতে বিপদ এবং দুর্ঘটনার সম্ভাবনা ছিল বিস্তর।

আগুনকে না নিভিয়ে, তাকে নিয়ন্ত্রিতভাবে জ্বালিয়ে রাখার চিন্তাভাবনা থেকেই এসে গেল, জ্বালানি তেলের আবিষ্কার। পৃথিবীতে প্রথম জ্বালানি তেল পশুচর্বি। বড় পাথরের পাত্রে, অনেকটা চর্বিতে ভিজিয়ে রাখা শুকনো ঘাস বা শুকনো শ্যাওলায় আগুন ধরালে, দাউদাউ করে জ্বলে না উঠে, ছোট্ট শিখায় আগুন অনেকক্ষণ জ্বালিয়ে রাখা যেত। এরপর আরো অনেক ভাবনা চিন্তার হাত ধরে, এই আবিষ্কার প্রদীপ হয়ে উঠল। কারণ ততদিনে মানুষ চাষবাস শিখে গিয়ে তৈলবীজের সন্ধান পেয়ে গেছে, তারা জেনে গেছে, তিল, নারকেল, রেড়ি, সরষে এমন নানান বীজ থেকে তেল বের করা যায়, এই তেল রান্নার জন্যেও যেমন ভীষণ উপযোগী, তেমনি স্নিগ্ধ শিখার প্রদীপ জ্বালাতেও দারুণ কার্যকর। আগুনের ভয়ংকর লকলকে শিখাকে সুন্দর স্নিগ্ধ নরম আলোর শিখায় রূপান্তর করাও একটা দারুণ আবিষ্কার। এই প্রদীপ উৎসব, ধর্ম অনুষ্ঠান এবং প্রত্যেকদিনের মঙ্গল আচরণের সঙ্গেও জুড়ে গেল। সেই তেলের প্রদীপের আলোর এমনই মাহাত্ম্য, প্রায় পাঁচ হাজার বছর ধরে, আমাদের জীবনের সঙ্গে জুড়ে রয়েছে, আজ এই এত উন্নত বিদ্যুতের আলোর যুগেও!

আগুন নিয়ন্ত্রণের পর মানুষের উন্নতির প্রথম ধাপ যদি হয় রান্না আর অন্ধকার দূর করা, তাহলে তার পরের ধাপ অবশ্যই ধাতু আবিষ্কার। আগুনের ব্যবহার শিখে, প্রথম যে ধাতু তারা নিষ্কাশন করে ব্যবহার করতে শিখল, তার নাম তামা। তামা প্রধান ধাতু হলেও, তার সঙ্গে টিনের মিশ্রণে সংকর ধাতু ব্রোঞ্জেরও বহুল ব্যবহার শুরু হয়, আজ থেকে মোটামুটি হাজার ছয়েক বছর আগে। এই দুটি ধাতুই অস্ত্রশস্ত্র, চাষবাস এবং গেরস্থালির নানান উপকরণে অপরিহার্য অঙ্গ হয়ে উঠেছিল। এই কারণে মানবসভ্যতার এই পর্যায়টাকে তাম্রযুগ বলা হয়। আগুনের ব্যবহার না জানলে, এই ধাতুর ব্যবহার, খনিজ পাথর থেকে তামা ও টিন নিষ্কাশন, ব্রোঞ্জের মতো সংকর ধাতু তৈরি, কোনাটাই সম্ভব হত না। এই যুগেই মানুষের সামাজিক কাঠামোটাও দ্রুত বদলে জটিল হতে শুরু করল। দক্ষতা ও কাজ অনুযায়ী মানুষের নতুন নতুন পেশা তৈরি হয়ে উঠতে লাগল। যেমন তামা, ব্রোঞ্জের মতো ধাতু দিয়ে, যারা অস্ত্রশস্ত্র, উপকরণ কিংবা অলংকার তৈরি করত, তারা হয়ে উঠল কারিগর বা শিল্পী, তাদের চাষবাস কিংবা শিকার করতে হতো না। স্থানীয় অঞ্চলে তামার খনিজ না পাওয়া গেল, দূর দেশ থেকে যারা সেই খনিজ কিনে নিয়ে আসত, তারা হয়ে উঠল বণিক। কারিগরদের দক্ষতায় বানানো উপকরণের চাহিদা অনুযায়ি, এই বণিকরাই অঞ্চলের বাইরে, এমনকি দেশের বাইরেও এই সব উপকরণ বিক্রি করত। অর্থাৎ, মানব সভ্যতার দ্রুত উন্নতিতে আগুনের ভূমিকা অত্যন্ত ব্যাপক এবং সত্যি বলতে আমরা যত ভালোভাবে আগুনকে ব্যবহার করতে শিখেছি, ততই আমাদের সভ্যতা দ্রুত উন্নত হয়েছে।

কিছু মানুষ চিরকালই থাকেন, যাঁরা যে কোন আবিষ্কারের পরেও আরো চিন্তা ভাবনা দিয়ে, মানবজাতির উন্নতির চিন্তা করে যান, আর কিছু মানুষ সেই সব আবিষ্কারকেই অন্য মানুষের ক্ষতি করার কাজে ব্যবহার করে। আগুনের ক্ষেত্রেও তাই হয়েছিল, আগুনের ব্যবহার শিখে মানুষ, অন্য দলের বা শত্রুদের সর্বনাশ করার এক অতি সহজ উপায় হাতে পেয়ে গেল। শত্রুদের বাড়িতে, গ্রামে আগুন ধরিয়ে দেওয়া, তিরের ডগায় চর্বি মাখানো কাপড়ে আগুন লাগিয়ে, দূর থেকেই গ্রামে আগুন লাগানো, এমন সব যুদ্ধের উপকরণও আবিষ্কার করে ফেলল। এমন সব তিরের কথা মহাভারতে অনেক আছে। তারপর যখন বারুদ আবিষ্কার করে ফেলল, তখন বারুদ আর আগুন দিয়ে ভয়ংকর সব যুদ্ধের অস্ত্রও বানিয়ে ফেলতে শুরু করল। এরকম অস্ত্র ব্যবহারে যে যত দক্ষ, সেই দেশ বা রাজ্য তত শক্তিশালী হয়ে উঠল।             

আগুন ব্যাপারটাকে বেশ ভালোভাবে রপ্ত করে, তাকে নানান কাজে সফল ব্যবহার শুরু হতে কিন্তু আরো অনেকদিন পার হয়ে গেল। আসলে আগুন জ্বলা, তার তাপ আর আলো দেওয়ার ক্ষমতাকে ঠিকঠাক বুঝতেই মানুষের এতদিন সময় লেগে গিয়েছিল। কাজেই আগুন ব্যাপারটা কী, সেটা অল্প কথায় একটু বুঝে নেওয়া যাক।

বিশেষ এক ধরনের রাসায়নিক প্রক্রিয়া থেকে আমরা যে তাপ আর আলো পাই, সেই তাপ আর আলোকেই আগুন বলি, আর ওই রাসায়নিক প্রক্রিয়াটিকে বলি দহন (combustion) । দহনের জন্য তিনটি বিষয় থাকতেই হবে, জ্বালানি (fuel), বাতাসের অক্সিজেন (O2), আর দহন শুরু করার জন্য প্রয়োজনীয় তাপ।

জ্বালানি বলতে এতক্ষণ আমরা কাঠ-কুটো, শুকনো পাতা, পশুচর্বি, নানান ভেষজ তেলের কথা উল্লেখ করেছি। এই সমস্ত জ্বালানির মধ্যেই অনেক পদার্থের সঙ্গে একটি মৌল পদার্থ প্রচুর পরিমাণে থাকে, তার নাম কার্বন। মোটামুটি ১৫০ সেলসিয়াস তাপমাত্রায়, কাঠের মধ্যে কার্বনের যে যৌগ থাকে, সেটি অক্সিজেনের সঙ্গে বিক্রিয়া শুরু করে এবং তার ফলে প্রচুর জলীয় বাষ্প (H2O), কার্বন ডায়ক্সাইড (CO2), কার্বন মনক্সাইড এবং আরো নানা ধরনের গ্যাস তৈরি হয়। অক্সিজেনের সঙ্গে এই বিক্রিয়াকে অক্সিডেশান (oxidation)বলে, এই বিক্রিয়া তাপদায়ী (exo-thermic), তার কারণ এই বিক্রিয়া থেকে আমরা তাপ আর আলো পাই।  দহন শুরু করার জন্যে যে জরুরি তাপমাত্রার দরকার হয় তাকে জ্বলন উত্তাপ (ignition temperature) বলা হয়, কাঠের ক্ষেত্রে এই তাপ ১৫০ সেলসিয়াস আগেই বলেছি। ভিন্ন ভিন্ন জ্বালানির জন্য এই তাপ ভিন্ন হয়ে থাকে।

একবার এই দহন প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গেলে, আগুন নিভবে না, কারণ দহনের জন্য যে তিনটি বিষয়ের কথা আগে বলেছি, তার মধ্যে জ্বালানি আর অক্সিজেন যদি থাকে, আগুন তার নিজের উত্তাপেই দহন চালিয়ে যেতে থাকে, অর্থাৎ আগুনের জ্বলতে থাকা একটি শৃঙ্খল-বিক্রিয়া (chain reaction)। এই বিক্রিয়াকে বন্ধ করার অর্থ, আগুন নেভানো; সেক্ষেত্রে ওই তিনটি বিষয়ের কোন একটি বিষয়কে সরিয়ে ফেলতে পারলেই আগুন নিভে যাবে। যেমন, যদি জ্বালানি ফুরিয়ে যায়, অথবা পাথর, বালি কিংবা বড়ো পাত্র চাপা দিয়ে যদি বাতাসের অক্সিজেন থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলা যায়। অথবা জল বা অন্য কোন অদাহ্য রাসায়নিক পদার্থ ঢেলে, আগুনের উত্তাপকে যদি শীতল করে দেওয়া যায়।

biggantechno02এই লেখার প্রথম পর্বের সেই আদিম যুবক, যে প্রথম আগুন নেভাতে এবং জ্বালাতে শিখেছিল, সে এত সব জানতই না এবং সত্যি বলতে আগুন জ্বলা ও নেভার এই রহস্য বুঝতে বুঝতে আমাদের প্রায় একলাখ পঁচিশ হাজার বছর পার হয়ে গেল!

আগুনের এই রহস্য বুঝে ফেলার পর মানুষ উন্নত মানের জ্বালনির সন্ধান শুরু করল। বহুদিন পর্যন্ত আগুনের জ্বালানি হিসেবে কাঠ, নানান ভেষজ তেল, পশুচর্বির ব্যবহার হত, একথা আগেই বলেছি। তার থেকে অনেক ভাল জ্বালানি হল কয়লা। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে মাটির ওপরেই পাওয়া কিছু কিছু কয়লার ব্যবহার মোটামুটি তিন হাজার বছর আগে থেকে চালু হলেও, খনির মধ্যে কয়লার সন্ধান এবং সেখান থেকে কয়লা তুলে, জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার শুরু হল মোটামুটি দ্বাদশ শতাব্দীর ইউরোপে। সেই সময় অবশ্য কয়লা প্রধানতঃ ব্যবহার হত ঘরের কাজে, চূণভাটি আর ধাতু নিষ্কাশনের ছোটখাটো কারখানায়। কিন্তু কয়লার ধোঁয়ার দূষণ থেকে বহুলোকের শ্বাসকষ্ট শুরু হওয়াতে, ১৩০৬ সালে কয়লার ব্যবহার অনেকটাই কমিয়ে দেওয়া হয়েছিল।

ইউরোপে শিল্পবিপ্লবের সময়, মোটামুটি ১৭৬০ থেকে ১৮২০ বা ১৮৪০ সাল পর্যন্ত ধরা হয়।  জলকে বাষ্প করে তার শক্তিতে নানান ইঞ্জিন চালানো, সেই ইঞ্জিন দিয়ে বড়ো বড়ো কারখানা তৈরি হতে লাগল। কারখানা ও উন্নত যন্ত্রপাতি বানাতে বেড়ে গেল লোহার ব্যবহার। লোহা ও অন্যন্য ধাতু নিষ্কাশনের জন্যেও বিশাল বিশাল কারখানার প্রতিষ্ঠা হতে লাগল। সেই সময় ইউরোপে শিল্পের এই অদ্ভূত উন্নতির জন্য সবথেকে বেশি জরুরি ছিল উচ্চ তাপমাত্রার আগুন, আর সেই আগুনের জন্যেই সারা বিশ্ব জুড়ে খনি থেকে কয়লা তোলার কাজও শুরু হয়ে গেল। আজ যে বিদ্যুৎ ছাড়া আমাদের সভ্য জীবন অচল হয়ে উঠেছে, এর পেছনেও আগুনের অবদান সব থেকে বেশি। আজ সারা বিশ্বে যত বিদ্যুৎ উৎপাদন হয় তার অধিকাংশই তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র (Thermal Power Station)। সেই তাপ বিদ্যুৎ কারখানাতেও কয়লা পুড়িয়ে আগুন জ্বালতে হয়, জলকে বাষ্প করার কাজে। আর সেই বাষ্পের তীব্র ধাক্কায় টার্বো জেনারেটর ঘুরিয়ে উৎপন্ন বিদ্যুৎ পৌঁছে যায় আমাদের ঘরে ঘরে।

অতএব, আজ আমাদের সভ্যতা যে জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে, আমরা মানুষ হিসেবে যে বিজ্ঞানের জন্যে এত গর্ব অনুভব করি, তার পিছনে সেই আদিম লোকগুলির অবদান আমরা যেন ভুলে না যাই। তাদের সেই কৌতূহল বা আগ্রহ যদি না থাকত, আমরা হয়তো কোন গুহার অন্ধকারে আজও ভয়ে মায়ের কোল ঘেঁষটে শুয়ে থাকতাম। ‘জয়ঢাক’ পড়ে মজা পাওয়াটা তোলা থাকত আরো কয়েক হাজার বছর পরে!

 বৈজ্ঞানিকের দপ্তর সব লেখা একত্রে

 

 

 

 

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Twitter picture

You are commenting using your Twitter account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s