অনিরুদ্ধ সেন
মাঝে মাঝে কাজের চাপ কম থাকলে আমি পেঁচোর অফিসে চলে আসি। অফিস বলতে অবশ্য নামকরা এক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। সাধারণত আমাকে দেখে পেঁচো উচ্ছ্বাসিত হয়ে চপ বা কাটলেটের অর্ডার দেয়। আজ কিন্তু দেখলাম ও গম্ভীর মুখে কম্পিউটার স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে, আমাকে আড়চোখে দেখে শুধু একটু মৃদু হাসল। মনে হচ্ছে কিছু ‘বেপার’ আছে।
যারা ‘পেঁচোর সাত-সতেরো’ পড়নি তাদের জন্য বলি – পেঁচোর আসল নাম ডঃ জ্যোতির্ময় চক্রবর্তী আর সে অঙ্কের জাহাজ। এখন সে এই তাবড় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে প্রফেসর। তার খুব নামডাক। তবে দুঃখের বিষয়, সে ঐ ডাকনামে।
পেশা ছাড়া তার নেশা শখের গোয়েন্দাগিরি। এ ব্যাপারেও সে বেশ কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখেছে। দীর্ঘদিনের অভিন্নহৃদয় বন্ধু আমি তার সহকারী, লেজুড় বললেও ভুল হয় না। পেঁচোকে গোমড়ামুখে দেখে আমার মনে কিন্তু ক্ষীণ আশার সঞ্চার হল – তাহলে কি কোনও কেস এসেছে?
ঠিক তা নয়। পেঁচো এক উদ্ভট ই-মেল পেয়েছে। প্রেরককে সে চেনে না। এতে চমকাবার কিছু নেই, অমন মেল আকচার আসে। কখনও সেটা বিজ্ঞাপন, আবার কখনও ভুল ই-মেল আইডি টাইপ করার ফলে লক্ষ্যভ্রষ্ট মেল। এই মেলটা স্পষ্টতই বিজ্ঞাপন নয়, কাজেই কেউ ভুলই করেছে। সেটা জানিয়ে প্রেরককে একটা রিপ্লাই দিয়ে দিলেই ল্যাঠা চুকে যায়।
কিন্তু তা নয়। পেঁচোর তীক্ষ্ণ নাক নাকি এই ই-মেল থেকে কিছু বদগন্ধ পেয়েছে। আর একবার গন্ধ পেলে আর রক্ষে নেই – পেঁচোর অন্য সব কাজ শিকেয় উঠবে, রহস্যের হদ্দমুদ্দ না করে তার শান্তি নেই। এখনও তাই সে গভীর মনোযোগে ঐ ই-মেলের মর্মোদ্ধার করতে ব্যস্ত।
স্ক্রিনে উঁকি মারলাম, অনিচ্ছাসত্ত্বেও পেঁচো মেলটা দেখাল। বিচিত্র বটে মেলটা। আজকাল বাংলাতেও মেল চালাচালি হচ্ছে, এটাও তাই। মূল মেলে প্রেরক বা প্রাপকের নাম নেই, আছে শুধু একটা ছোট্ট ছড়া,
“ছবির বইয়ের ছাগশিশু মামাবাড়ি থেকে আজ সন্ধ্যায় রওনা দেবে গ্রহের সংখ্যা দেখে। পরশু ভোরে ঋতু গুণে নামলে যত্ন নিও। খোকা ঘুমোলে পুরুষে নয়, সমাসে জানিও।”
“হুঁ, মেলটা অদ্ভুত বটে, হেঁয়ালিতে লেখা। তবে তার মানেই এই নয় যে কেস উল্টোপাল্টা। বন্ধুবান্ধবরা প্রায়ই নিজেদের মধ্যে মজা করে হেঁয়ালি আর কোড ওয়ার্ডে মেল চালাচালি করে।”
“বলছিস? বেশ!” বলে পেঁচো একটা ছোট্ট মেসেজ লিখে ‘রিপ্লাই’ পাঠিয়ে দিল, “মহাশয়, আপনার অন্য কাউকে পাঠানো এই মেলটি ভুলে আমার কাছে চলে এসেছে। আপনার অসুবিধা হতে পারে ভেবে জানালাম, উপযুক্ত ব্যবস্থা নেবেন। আমি মেলটা ‘ডিলিট’ করে দিচ্ছি।”
‘ডিলিট’ না করে সে অবশ্য উল্টে গম্ভীর হয়ে বারবার মেলটা দেখতে লাগল। একটু পরে বলল, “লোকটা বেশ অভদ্র। একটা ভুল দেখিয়ে দিলাম। আবছা আভাষ পাচ্ছি, কাউকে ‘রিসিভ’ করতে বলছে। মেলটা পৌঁছোয়নি জানতে না পারলে কেলো হতে পারত। অথচ আমাকে একটু ‘থ্যাঙ্কস’ও জানাল না।”
“হয়তো অন-লাইন নেই।” বললাম।
“ছিল, নিশ্চয়ই মেল রিসিভ করেছে। তার কিছুক্ষণ পরে অফ-লাইন হয়ে গেল।”
“ও নিয়ে দুঃখু করিস না।” আমি সান্ত্বনা দিলাম, “এই হচ্ছে টিপিকাল ইন্ডিয়ান মেন্টালিটি। ই-মেলের জবাব দেওয়াটা যে একটা শিষ্টাচার, জানে না।”
“মেন্টালিটি দেখাস না, অনেক ইন্ডিয়ান দেখেছি। কিন্তু এ ব্যাটা – দাঁড়া, একটা এক্সপেরিমেন্ট করি।” বলেই পেঁচো এবার কিছুক্ষণ ভুরু কুঁচকে আবার কি-বোর্ডে কীসব খুটখুট করতে লাগল। একটু পর উদ্ভাসিত মুখে বলল, “যা ভেবেছি! মেলটা রিপিট করেছিলাম, ‘বাউন্স’ করল। অবশ্য হতে পারে ওর ‘ইনবক্স’ ফুল হয়ে গেছে। কিন্তু এও হতে পারে, মেলটা আঘাটায় গিয়ে পড়েছিল জেনে লোকটা তড়িঘড়ি অ্যাকাউন্টটাই ডি-অ্যাকটিভেট করে দিল। না রে গবু, কেসটা নেড়েচেড়ে দেখতে হচ্ছে।”
“তোর একটু বেশি বেশি ইয়ে। তাচ্চেয়ে চল ক্যান্টিনের দিকে এগোনো যাক।”
“একটু বোস, কিঞ্চিৎ লাউড থিংকিং করে নিই। ততক্ষণে লাঞ্চের সময়ও হয়ে যাবে।”
অগত্যা!
“ই-মেল পাঠাতে ভুল হয় কেন?”
পেঁচোর আচমকা প্রশ্নে থতমত খেয়ে বললাম, “অনেক কারণে। ধর টাইপে ভুল।”
“ঠিক। কিন্তু তার মানে লোকটা পুরো আই-ডিটা টাইপ করেছে। অর্থাৎ সে যদি নিতান্ত আনাড়ি না হয়, তবে এই আই-ডিতে এই প্রথম মেল পাঠাচ্ছে। আর ঝট করে অ্যাকাউন্ট বন্ধ করে দেওয়ার থেকে বোঝা যায়, সে আনাড়ি নয়।”
“তাতে আশ্চর্য হবার কী আছে?”
“এই আছে যে সে একজনকে প্রথম মেল পাঠাচ্ছে, কিন্তু পরিচিতের মতো ‘কোড’ ওয়ার্ড ব্যবহার করছে।”
“হুঁ, ব্যাপারটা যেন কেমন।” আমি নড়েচড়ে বসে বললাম, “তা, তুই কী করতে চাস?”
“কে মেলটা পাঠিয়েছে তো জানি। কিন্তু কাকে পাঠাচ্ছিল, সেটাও জানতে চাই। তারপর কেসটা একটু নেড়েচেড়ে দেখতে চাই।”
“কাকে পাঠাচ্ছিল কীভাবে জানবি?”
“অনুমানে। ধরে নিচ্ছি, লোকটা হয় একটা অক্ষর ভুল টাইপ করেছে। নয়তো নামধাম সার্চ করে ই-মেল আই-ডি জোগাড় করেছে, কিন্তু সেই নামধামে একাধিক লোক থাকায় ভুল করেছে।”
“তোর ইমেল-আইডি তো jchakraborty@gmail.com. তাহলে লোকটা –”
“চক্রবর্তী স্পেলিং ভুল করতে পারে। পাশের কী-তে হাত পড়ে যেতে পারে – যেমন ধর এইচ-এর জায়গায় জে। অথবা জ্যোতির্ময় চক্রবর্তী সার্চ করে আমাকে ‘হিট’ করে তার লোক ভাবতে পারে। দাঁড়া, একটু দেখছি।”
এই বলে পেঁচো কিছুক্ষণ কি-বোর্ডে ঝড় তোলার পর বলল, “শিওর নই, তবে এই গোটা দশেক আই-ডির একটা হবার চান্স।” বলেই চটপট একটা প্রিন্ট-আউট নিয়ে নিল।
“তাহলে আর কী!” আমি উজ্জ্বল মুখে বললাম, “এবার সাইবার পুলিশকে খবর দে। তারা সার্ভিস প্রোভাইডারের সাথে কথা বলে ঠিক লোকগুলোর নাড়িনক্ষত্র বের করে ফেলবে।”
“নট দ্যাট ইজি, ব্রো! প্রথমত, সাইবার পুলিশ আমাকে পাত্তা দেবে কেন? আমার – মানে, অঙ্কের জন্য একটু নামডাক আছে, গোয়েন্দাগিরির জন্য তো তেমন নয়।”
“জামাইবাবু মানে মোহনদাকে বলে চেষ্টা করা যেত। উনি তো এখন কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা বিভাগে খুব উঁচু পোস্টে। কিন্তু তিনি আবার একটা সিক্রেট অ্যাসাইনমেন্টে কোথায় গিয়ে যেন বসে আছেন, দিদিও তার হদিশ জানে না।”
“জানলেও কদ্দুর কাজ হতো সন্দেহ। আমাদের সাইবার পুলিশ বলল আর গুগল শুনল, এমন নয়। খুব গম্ভীর কোনও ক্রিমিন্যাল কেসে তথ্যপ্রমাণ দিতে পারলে তবে যদি কিছু হয়। নইলে ওরা কাস্টমারদের প্রাইভেসিতে হাত দিতে দেয় না।”
“তা-হলে?” হতাশ হয়ে বললাম।
পেঁচো একটুক্ষণ কী যেন চিন্তা করল। তারপর হঠাৎ উজ্জ্বল মুখে বলে উঠল, “মানসীদি!” আমি বোকার মতো তাকাচ্ছি দেখে বলল, “তুই ক্যান্টিনে যাবি বলছিলি না? চল!”
ক্যান্টিনে গিয়ে পেঁচো হঠাৎ দিলদরিয়া হয়ে উঠল, “কী কী খাবি, বল।”
“ক্-ক্-ই, ক্কি!” আমি বিষম খেলাম। খাওয়ানোর ব্যাপারে পেঁচো আদৌ উদার নয়, বড়োজোর একটা আইটেম আর চা অফার করে। আজ ওর হলটা কী?
“এখানে নন-ভেজ কাটলেটটা ভালো করে। মোচার চপটাও মন্দ নয়। আর ঐ অমৃতিটা ফ্রেশ ভেজেছে মনে হচ্ছে। এক প্লেট করে বলে দিই, কী বলিস? চা না হয় একটু পরে আসবে।”
“চলবে।” স্মিত হেসে বললাম।
“তবে তোকে ভাই একটা কাজ করে দিতে হবে।”
“ক্-কী কাজ – ঝ্-ঝামেলার নয়তো?” সন্দিগ্ধ হয়ে বললাম।
“বিশেষ কিছু নয়।” পেঁচো আমাকে নিশ্চিন্ত করে বলল, “তুই স্রেফ খেয়ে বলবি, কোনটা সবচেয়ে য়াম্মি। জানিস তো আমার টেস্ট বাডগুলি ঠিক –”
জানি। সবাই বলে, পেঁচো নাকি স্বাদের কোনও তারতম্য বোঝে না। কেউ কেউ আড়ালে বলে, ও গরুর মতো খায়। আমি খুশি হয়ে বললাম, “সে তোকে ভাবতে হবে না। তবে ফাস্ট রাউন্ডে টাই হলে কিন্তু টাই ব্রেকের জন্য –”
“আরেক রাউন্ড, নো প্রব্লেম। শুধু ব্রো, তুই ঠিকঠাক বলবি। জেনে রাখিস, তার ওপর নির্ভর করছে এই ই-মেল রহস্যের ভবিষ্যৎ।”
অ্যাঁ! ভ্যাবাচাকা খেয়ে গেলাম, একটু নার্ভাসও লাগল। তবে তা বলে চপ, কাটলেট ইত্যাদি সামনে নিয়ে তো বসে থাকা যায় না। বেশ কিছুক্ষণ হাত আর মুখের ব্যস্ততার পর আমি গম্ভীর মতামত দিলাম, “থার্ড আম্পায়ার কল করতে হল। তবে শেষ অবধি ডিসিশন – ঐ মোচার চপ।”
“আমারও তাই মনে হচ্ছিল।” এবার পেঁচো দ্রুত কাউন্টারে গিয়ে অর্ডার দিল, “এক ডজন মোচার চপ।” মালটা নিয়েই আমার হাত টেনে বলল, “চল।”
এ রাস্তা, ও রাস্তা ঘুরপাক খাবার পর আমরা হাজির হলাম ওদের কম্পিউটার সেন্টারে। সেখানে এদিক, সেদিক চলে এক টেবিলের সামনে এসে পেঁচো প্রায় জোড়হাতে দাঁড়িয়ে পড়ল। তাকিয়ে দেখি, সামনে এক ঢুলু ঢুলু, মাঝবয়েসী, থাপুস-থুপুস মহিলা। কবে যেন একটা কবিতায় পড়েছিলাম, “তন্দ্রা দাসের বাড়ি নিউ জলপাইগুড়ি, অফিসে ঢোলেন তিনি কড়িকাঠে হাই ছুঁড়ি।” মনে হল, ইনিই কবিতার সেই তন্দ্রা দাস।“মানসীদি”, ফিসফিসিয়ে বলল পেঁচো।
এ-ই পেঁচোর সেই বিখ্যাত মুস্কিল আসান? বুকটা দমে গেল। মহিলার ফ্যালফেলে মুখে আকাট বোকামোর ছাপ। ফিসফিসিয়ে বললাম, “চল, কেটে পড়ি। এটা রং ই-মেল আই-ডি!”
থাবিয়ে আমার মুখ বন্ধ করে পেঁচো বলল, “মানসীদি, এই চপগুলো একটু চেখে দেখুন। ক্যান্টিনে ভাজছিল, দারুণ গন্ধ। তাই আপনার জন্য ক’টা নিয়ে এলাম।”
তড়িৎগতিতে গোটা দুই চপ একসাথে মুখে পুরে দিয়ে মানসীদি উদ্ভাসিত বদনে বললেন, “থ্যাঙ্ক ইউ, প্ – মানে, জ্-জ্যোতির্ময় বাবু –”
আমি জানি, পেঁচোকে কেউ ডাকনামে রেফার করলে ও বেজায় বমকে যায়। আজ কিন্তু সে বিনয়ের অবতার হয়ে বলল, “ছি ছি মানসীদি, আপনি গুরুজন – আমাকে পেঁচো বলেই ডাকবেন।”
“বেশ। তা, এবার বলো কী ধান্দায় এসেছ।”
“ছিঃ, ধান্দা হবে কেন! মানে, দিদির প্রতি –”
“ভাইয়ের অন্তরের প্রগাঢ় ভালবাসা! ওসব যাত্রাপালা ছাড়ো, ঝেড়ে কাশো। মানসী চাটুজ্জের কাছে কেউ ধান্দা ছাড়া আসে না।”
অগত্যা পেঁচো মিনিমিনিয়ে বলল, “ক’টা ই-মেল আই-ডি আছে। এগুলোর মালিক কে, একটু বের করে দেবেন?”
“এরা কি ইনস্টিটিউটের মেম্বার?”
“না হওয়ারই সম্ভাবনা।”
“তাহলে ভাই আমি তাদের নাড়িনক্ষত্র তোমাদের কী করে জানাব?”
“কাম অন, মানসীদি।” পেঁচো এবার একটু বেপরোয়া হয়ে বলে ফেলল, “সারা কলকাতায় আপনি আনএথিকাল হ্যাকার বলে কুখ্যাত। এই সামান্য কাজটা আপনি –”
দেখলাম, মানসীদির ঠোঁট ফুলে উঠেছে, ফুঁপিয়ে উঠলেন বলে। বিপদ বুঝে আমি পকেট থেকে টিস্যু বের করে এগিয়ে ধরলাম।
“কী, কী বললে – আনএথিকাল?” ভদ্রমহিলা চোখ মুছতে মুছতে বললেন, “হ্যাঁ ঐ কী বলে, হ্যাকিং – এট্টু-আধটু করি বটে, তা বলে আজ অবধি কেউ আমাকে ‘আনএথিকাল’ অপবাদ দিতে সাহস করেনি। আর তুমি দু’দিনের ছোঁড়া –”
“সরি মানসীদি, আপনাকে আঘাত দিতে চাইনি।” পেঁচো আপোসের সুরে বলল, “কিন্তু বুকে হাত দিয়ে বলুন তো – আপনি কি আপনার ছেলেমেয়েদের ই-মেল, ফেসবুক অ্যাকাউন্ট হ্যাক করেননি? সেখান থেকে বন্ধুদের নামে আজেবাজে পোস্ট পাঠিয়ে তাদের সাথে বিচ্ছেদ ঘটিয়ে দেননি? আপনার ভয়ে তারা তো সোশ্যাল মিডিয়া ছেড়ে সেই ব্রিটিশ আমলের মতো চিঠি আর পথের মোড়ের ওপর নির্ভর করছে।”
“একে তুমি আনএথিকাল বল?” মানসীদি আবার ফুঁপিয়ে উঠলেন, “সন্তানের মঙ্গল কোন মা-বাপ না চায়? জানো তো, আজকাল কত ঠগ-জোচ্চোর সোশ্যাল মিডিয়ার ফাঁদ পেতে বসে আছে ভুলিয়ে-ভালিয়ে ছেলেমেয়েগুলোকে বিপথে নিয়ে যাবার জন্য। সেই বিপদ থেকে তাদের বাঁচাতে হবে না?”
পেঁচোর চোখ দেখলাম হঠাৎ জ্বলজ্বল করে উঠল। বলল, “আরে সেইজন্যেই তো আপনার হেল্প চাইছি। একটা ই-মেল হঠাৎ আমার হাতে এসে পড়েছে, যার মধ্যে বেশ রহস্যের গন্ধ আছে। কেন যেন মনে হচ্ছে, এটার অর্থ সময়মতো ভেদ না করতে পারলে কোনও বাচ্চার জীবন বিপন্ন হবে।”
“তাই বলো।” মানসীদি হঠাৎ টানটান হয়ে উঠে বসলেন। মুহূর্তে তার বডি-ল্যাংগোয়েজ পাল্টে গেল, দৃষ্টি তীক্ষ্ণ হয়ে উঠল। পেঁচোর দিকে তাকিয়ে বললেন, “তাহলে ঐ অ্যাকাউন্টের ধানাই-পানাই ছেড়ে আসল সমস্যাটা বলছ না কেন? বাচ্চাদের নিরাপত্তার ব্যাপার যখন, আমি জান লড়িয়ে দেব।”
“বেশ, বলছি।” পেঁচো একটু কাষ্ঠহেসে ই-মেলের ব্যাপারটা মানসীদিকে খুলে বলল।
ভদ্রমহিলা কিছুক্ষণ নীরব। তারপর বললেন, “বেশ, কাল দুপুরের মধ্যে তুমি মেল যে পাঠিয়েছে আর যার কাছে পাঠিয়েছে, তাদের সম্বন্ধে যা যা জানার জেনে যাবে। দরকার হলে আমি সারা রাত জাগব। কিন্তু তারপর? তুমি কি পুলিশের কাছে যাবে?”
“তেমন কিছু পেলে তো যেতেই হবে। যতক্ষণ না পাই, নিজেকেই মাথা খাটিয়ে দেখতে হবে।”
মানসীদি কৌতুহলী দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন, “নিজেকে মানে? অ, তোমার তাহলে শখের গোয়েন্দাগিরির অভ্যেস আছে!”
মাথা চুলকোতে চুলকোতে পেঁচো বলল, “এই – মানে, এট্টু-আধটু। আর এ আমার অ্যাসিস্ট্যান্ট।”
পেঁচোকে কিছুক্ষণ পর্যবেক্ষণ করে মানসীদি বললেন, “হুঁ, বউ নেই তাই এসব বদখেয়াল।”
“আজ্ঞে, বদখেয়াল নয়। মানে, আমরা বেশ কয়েকটা কেসে পুলিশকে –” বলতে বলতে হঠাৎ পেঁচোর খেয়াল হল, “কিন্তু আপনি কী করে জানলেন আমার বউ নেই?”
“একটা পাটভাঙা প্যান্টের ওপর একটা ন্যাতকানো শার্ট। তার আবার বোতাম কোনওটা নেই, কোনওটা উল্টোপাল্টা লাগানো। চুলে তো কদ্দিন চিরুনি পড়েনি ঠিক নেই। এর পরেও যদি বলতে তোমার বৌ আছে তো বলতাম তাকে আপগ্রেড করার সময় হয়েছে।”
কিছুক্ষণ হাঁ করে থাকার পর পেঁচো বলল, “মানসীদি, ভুলে গেছি আপনি না আমি কে গোয়েন্দা!”
“এজ্ঞে, তুমি।” মানসীদি আবার তীব্র দৃষ্টিতে পেঁচোকে লক্ষ করতে করতে বললেন, “কিন্তু তার মানে তো তোমরা দুই মূর্তিমান এখন প্রায়ই এসে আমাকে জ্বালাবে? তাহলে আর চপের ঘুষে হবে না ভাই, একটা পাকাপাকি ব্যবস্থা করতে হবে।”
“মা-নে?”
“মানে শিগগিরই বুঝতে পারবে। যাক গে, এখন কেটে পড়ো। কাল লাঞ্চের আগে এসে একবার খোঁজ নিয়ে যেও। আর হ্যাঁ, তখন তোমার ফোটোসহ একটা রিজিউমে আমার কাছে রেখে যেও।”
“রিজিউমে দিয়ে কী হবে?”
“ঐ যে বললাম, পাকাপাকি বন্দোবস্ত।”
“আপনি কি কোনও কন্ট্রাক্টের কথা বলছেন? দেখুন দিদি, আপনার কিছু সম্মানমূল্য আমি অবশ্যই ধরে দিতে রাজি আছি। তবে তা লিখিত-পড়িত হওয়া মুশকিল। আমি-আপনি দু’জনেই তো আধা-সরকারি প্রতিষ্ঠানের চাকুরে।”
“আমার ভদ্রমহিলার এক কথা – হয় রিজিউমে ও ফোটো, নয় ফোটো। কাল এক হাতে রিজিউমে দেবে, অন্য হাতে আমার রিপোর্ট নেবে। বুঝেছ?”
অগত্যা! দুর্বলভাবে ঘাড় নেড়ে পেঁচো আর আমি বেরিয়ে এলাম।
“আজ আমার সঙ্গে যাবি? রাতটা থাকবি? একটু আলোচনার দরকার ছিল।”
আলোচনা মানে তো স্বগতোক্তি। তবু জানি, নিজের কথার প্রতিধ্বনি শোনার জন্যও পেঁচোর আমা হেন একটা দেওয়ালের দরকার হয়। তাই বললাম, “বেশ। তবে বাড়িতে কিছু কাজ আছে। সেসব সেরে রাতে থাকার জামাকাপড় নিয়ে আমি সন্ধ্যার মধ্যেই চলে আসছি।”
ডিনার প্রায় নিঃশব্দেই সারা হল। তারপর দু’জন হলে সোফায় মুখোমুখি বসলাম। এবার পেঁচো বলল, “আয়, যতক্ষণে মানসীদি মেলের প্রেরক ও প্রাপকের বৃত্তান্ত বের করে, আমরা মেলের ধাঁধার মানে বোঝার চেষ্টা করি।”
“বেশ।” দুর্বলভাবে বললাম। জানি, পেঁচো ‘আমরা’ বললেও আমি এক্ষেত্রে স্রেফ ‘ডামি’। পেঁচো কিছুক্ষণ ভুরু কুঁচকে ব্যাপারটা গুছিয়ে নিয়ে বলতে শুরু করল,
“মেলটা খুব পাকাপোক্ত কোডে লেখা নয়। ব্যবহার করা হয়েছে কিছু ‘চলতা হ্যায়’ পরিভাষা, যা লেখক-পাঠক দুজনে বোঝে। অর্থাৎ এরা ঐ কম্পিউটার অভিজ্ঞ ক্রিমিনাল হীরেন সামন্তর মতো ব্রিলিয়ান্ট নয়, অনেক পাতি। তবে বক্তব্যটা বাইরের লোকের কাছে গোপন করার চেষ্টা হয়েছে, যাতে মেল বাই চান্স বেহাত হলেও কোনও কেলো না হয়। তার থেকে আমার অনুমান, এদের মতলব ভালো নয়।”
“হ্যাঁ। আর দ্যাখ, ঘটনাচক্রে মেলটা বেহাতই হয়েছে। এটা যদি অন্য কারও হাতে পড়ত, স্রেফ ‘ডিলিট’ করে ছেড়ে দিত। তুই বলেই –”
“ছাড়, এবার হেঁয়ালিটা ভেদ করার চেষ্টা করা যাক। প্রথমে ধর ঐ ‘ছবির বইয়ের ছাগশিশু’। তার মানেটা কী?”
“সে হয়তো বাচ্চাদের কোনও বইয়ের কোনও ছাগল বাচ্চার ছবির কথা বলছে।”
“আর সেই ছাগশিশু মামাবাড়ি থেকে রওনা দিচ্ছে?”
“তাই তো! তাহলে কেসটা কী?”
“স্পষ্টতই, যিনি মামাবাড়ি থেকে রওনা দিচ্ছেন তিনি ছাগ নন, মানুষ।”
“হুম!” হঠাৎ আমার খেয়াল হল, “আচ্ছা, ইয়ে – ছবির বই মানে কি অ্যালবাম, যাতে এই হবু যাত্রীর ফটো আছে? আর ছাগল, গাধা এসব তো আমরা অনেককেই বলে থাকি। যাকে লেখা হয়েছে সে হয়তো বুঝে গেছে অ্যালবামের কোন ‘ছাগল’-মানুষটি তার মামাবাড়ি থেকে রওনা দিচ্ছে।”
“হতে পারে। কিন্তু মামাবাড়ি মানে কি স্রেফ কোনও লোকের মামার বাড়ি? নাকি –”
হঠাৎ আমার মাথায় খেলে গেল, “মামা কিন্তু অনেকে চেকার বা পুলিশদেরও বলে।”
“বেঁড়ে বলেছিস, গবু – বুদ্ধি হ্যাজ!” পেঁচো আমার পিঠ চাপড়ে দিল।
হঠাৎ আমার বুকটা এক বিচ্ছিরি সম্ভাবনায় ধক করে উঠল। বললাম, “পুলিশের বাড়ি, মানে থানা। সেখান থেকে কোনও বাচ্চা ছাগল – মানে ওটা যদি ওদের কোনও এজেন্টের কোড নেম হয়? শেষে পুলিশের মেল হ্যাক করতে গিয়ে আমাদের হাতে হাতকড়া পড়বে না তো?”
“এই জন্যেই তোকে ‘গবু’ বলি – একটা স্মার্ট কথা বললি তো ব্যালান্স করতে সাথে সাথে একটা গবেটের মতো কথা। পুলিশের গোয়েন্দা জি-মেলে খবর লেনদেন করছে? ভাবতেও আমার হাসি পাচ্ছে।”
“তা-হলে?”
“ভাবছি। আজ উঠে যখন পরশু নামছে, হয়তো কোনও দূরপাল্লার ট্রেন। কিন্তু কে, কেন, কোথায় ট্রেনে চড়ছে, কোথায় নামবে সবই ধোঁয়াশা। আজ সন্ধ্যায় গ্রহের সংখ্যা দেখে চড়ছে, পরশু সকালে ঋতু গুণে নামবে মানেটাই বা কী?”
“সে, অনেকের অমন গ্রহ নক্ষত্র দেখে যাতায়াতের অভ্যেস থাকে। অবশ্য ঋতু গোণাটা জ্যোতিষশাস্ত্রে আছে বলে শুনিনি।”
“কিন্তু ট্রেন তো শাস্ত্র হিসেব করে চলে না। লোকটা মনে হচ্ছে কাউকে রিসিভ করতে বলছে। তাহলে ট্রেনের সময় বা নাম জানাবে না?”
“হুম, প্রবলেম হ্যাজ।” গম্ভীর চালে বললাম।
“তবু এ অব্দি একরকম। কিন্তু ‘ছাগশিশু’র পর ঐ ‘খোকা ঘুমোলে’র মধ্যে – আমি একটা খুব খারাপ গন্ধ পাচ্ছি।”
“কোনও ছোটো ছেলে এর মধ্যে জড়িয়ে আছে বলছিস?”
“না, আরও সর্বনেশে কোনও ইঙ্গিত লুকিয়ে আছে ঐ ‘খোকা ঘুমোলে’তে। পেটে আসছে, মুখে আসছে না।”
“তবে এবার কী করবি?”
“কিছু করার নেই, এখানেই লটকে গেছি। কাল মানসীদির কাছ থেকে কিছু ‘লিড’ পেলে যদি এগোনো যায়।” পেঁচো এরপর একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, “যাই, আবার রিজিউমে তৈরি করতে হবে। মহিলা বড্ড এঁড়ে, নইলে মাল ছাড়বে না।”
বলা বাহুল্য, পরদিনও আমি পেঁচোর সাথে পাইলন হলাম। বেলা দুটো নাগাদ যখন মানসীদির সাথে দেখা করতে গেলাম, দেখি পেঁচো স্পষ্টতঃই উত্তেজনায় ঘামছে। মানসীদির চোখদুটি আজ আরও ঢুলুঢুলু, উপরন্তু তা টকটকে লাল – মনে হয় ভদ্রমহিলা সত্যিই রাত জেগে কাজ করেছেন।
কিন্তু মাল কিছু উদ্ধার হল কি? পেঁচো জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে মানসীদির দিকে চাইছে। মানসীদিও পাল্টা তার হাতের দিকে চেয়ে চোখের ইশারা করলেন। অনিচ্ছাসত্ত্বেও পেঁচো রিজিউমেটা টেবিলে রাখল। ছোঁ মেরে সেটা নিয়ে মানসীদি একবার চোখ বুলিয়ে বললেন, “ঠিক আছে।”
কিন্তু-কিন্তু করে পেঁচো বলল, “দেখবেন মানসীদি, ঝোলাবেন না। আমি কিন্তু আধা-সরকারি চাকুরে।”
“তোমায় কে বলেছে পাশাপাশি আর কোনও দায়িত্ব নেওয়া যায় না?”
“ন্-না, মানে সার্ভিস রুল। আর আমি এখানে – মানে, একটা রিসার্চ করছি। কোনও ব্যাঘাত হলে –”
“সার্ভিস রুল না ভেঙে আর রিসার্চের ব্যাঘাত না ঘটিয়েও যে অন্য দায়িত্ব নেওয়া যায়, সেটা তুমি যথাসময়ে বুঝতে পারবে।” মানসীদির চোখে চাপা হাসি। তারপর তিনি পেঁচোর হাতে একটা প্রিন্ট-আউট ধরিয়ে দিলেন।
“মেলটা পাঠিয়েছিল মহারাষ্ট্রের থানে থেকে চন্দন রায় বলে কেউ। আর সেটা পাঠানো হয়েছিল যতীন চক্রবর্তী বলে কলকাতার হাতিবাগান এলাকার এক বাসিন্দাকে। অবশ্য নামঠিকানা সঠিকই হতে হবে এমন কোনও কথা নেই, বেনামিতেও অনেকে চালিয়ে যায়। চন্দন রায় তোমাকে যে অ্যাকাউন্ট থেকে মেল পাঠিয়েছিল, সেটা কাল সকালেই তৈরি করা হয়েছিল। তারপর তুমি যেমন বলেছিলে – আবার কালই সেটা ডিঅ্যাকটিভেট করা হয়েছে। আবার একটা নতুন অ্যাকাউন্ট খুলে সে ঐ মেলটা যতীন চক্রবর্তীকে পাঠিয়েছে।”
“কামাল, মানসীদি!” পেঁচোর সপ্রশংস দৃষ্টির সামনে লজ্জা পেয়ে মানসীদি বললেন, “না না, এ আর এমন কী! তা, তুমিও তো বাপু কম যাও না। প্রাপকের সম্ভাব্য ই-মেল আই-ডির যে লিস্ট রেখে গিয়েছিলে, তার দ্বিতীয়টা চেষ্টা করতেই তো মাল পেয়ে গেলাম। নইলে অন্ধকারে হাতড়াতে অনেক সময় লেগে যেত। তা, আর কিছু তথ্য লাগবে?”
“আগে এগুলো হজম করি। তারপর দরকারে নিশ্চয়ই আপনার কাছে আসব। তবে মানসীদি, এবার আমি নিশ্চিত যে ব্যাপারটা অস্বাভাবিক আর এতে কোনও অল্পবয়সী ছেলের নিরাপত্তা জড়িয়ে আছে।”
“বলেছি তো, জান লড়িয়ে দেব। যখন হয় আমাকে বিরক্ত করতে পারো।” মানসীদির চোখ আবার জ্বলজ্বল করছে। তাঁর ফোন নম্বর ও ঠিকানা নিয়ে পেঁচো আর আমি বেরিয়ে এলাম।
“মহারাষ্ট্রের থানে হচ্ছে মুম্বইয়ের পাশের এক জেলা কাম শহর। থানে থানে – একে লোকে থানাও বলে থাকে।” হঠাৎ পেঁচো উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “মামাবাড়ি মানে তুই কী যেন বলেছিলি?”
“প্-পু-পুলিশ স্টেশন, মানে – থানা”, ঘাবড়ে গিয়ে ফ্যালফেলের মতো বলি।
“থানা – তুই তো কেল্লা মেরে দিয়েছিস! অর্থাৎ থানা শহর থেকে কোনও ছেলে কাল কিছুতে চড়েছে। সম্ভবতঃ কোনও ট্রেন। দাঁড়া, দেখছি।”
পেঁচো এবার চটপট ইন্টারনেটে indianrail.gov.in খুলে ব্যস্তহাতে সার্চ করতে লাগল। একটু পর বলল, “যতীন চক্রবর্তী কলকাতার বাসিন্দা। তাকে যখন ‘রিসিভ’ করতে বলা হচ্ছে, সেটা হাওড়াতেই হওয়া সম্ভব। মুম্বই থেকে হাওড়া অনেকগুলি ট্রেন। কিন্তু তার মধ্যে মোটে দুটো থানা দাঁড়ায়। থানা থেকে ধরতে হলে ঐ দুটোর একটাই হবে। প্রথমটা হাওড়া মেল ভায়া নাগপুর – রাত ন’টা দশে থানা এসে পরের পরদিন সকাল পাঁচটা পঞ্চান্নয় হাওড়া পৌঁছোয়। আর দ্বিতীয়টা শালিমার এক্সপ্রেস – রাত দশটা পঁচিশে থানা ছেড়ে পরের পরদিন বেলা বারোটা পঁচিশে শালিমার পৌঁছোয়। এর কোনটা?”
একটু ভেবে বললাম, “জানিস পেঁচো, ঐ গ্রহ, ঋতু এসব খুব ছোটোবেলা কী একটা বইয়ে যেন পড়েছিলাম। পঞ্জিকা, তা ছাড়া –”
পেঁচো কিছুক্ষণ জুলজুল করে আমার দিকে তাকিয়ে থেকে তারপর সবলে আমার পিঠ চাপড়ে বলল, “আবার ফাটিয়ে দিয়েছিস, গবু – ধারাপাত! ওতে একে চন্দ্র, দুয়ে পক্ষ, তিনে নেত্র এইসব দিয়ে সংখ্যা শেখানো হয়। ঐ তালিকায় ছয়ের জন্য হচ্ছে ঋতু, আর নয়ের জন্য গ্রহ! ব্যাটারা সময় বোঝাতে এগুলোই ব্যবহার করেছে। অর্থাৎ ‘গ্রহের হিসেব রেখে’ মানে ন’টা, সন্ধে ন’টায় ট্রেন ছাড়বে। আর ‘ঋতু গুণে’ মানে ছ’টা, সকাল ছ’টায় ট্রেন হাওড়া পৌঁছোবে। এটা ঐ মেলের টাইমের সাথে মোটামুটি মিলে যাচ্ছে। ছোঁড়া মুম্বই-হাওড়া মেলে হাওড়া আসছে। গতকাল রওনা দিয়েছে, আগামীকাল সকালে পৌঁছোবে।”
“বাঃ!” আমি বিমোহিত হয়েও বললাম, “কিন্তু ধারাপাতের দৌড় তো দশ দিক অবধি। তবে ওরা এগারোটা, বারোটা বোঝায় কীভাবে?”
“কে জানে, হয়তো এগারো খেলুড়ে, বারো ভূত এইসব যোগ করে নিয়েছে। তবে তোর ঐ ধারাপাতের ধাক্কায় কিন্তু আমার মাথায় বাকি সমস্যাগুলোর জটও খুলতে চলেছে। একেই বোধহয় বলে ‘ডোমিনো এফেক্ট’। ছবির বই – তুই বলছিলি না অ্যালবাম? তা, আজকাল ছেলে ছোকরাদের অ্যালবাম কোথায়?”
“ফেসবুকে! অর্থাৎ ছবির বই মানে –”
“ফেসবুক। আর ফেসবুকের ছাগশিশু মানে –”
“কোনও ছোঁড়াকে ফেসবুকে বকরা বানিয়েছে, নিশ্চয়ই নকল বন্ধুত্বের টোপ ফেলে। আর সেইভাবে তাকে থানা থেকে কলকাতা টেনে আনছে। কিন্তু কীসের জন্য?”
“সেটা রয়েছে শেষ লাইনে, অর্থাৎ ঐ ‘খোকা ঘুমোলে’তে। বল তো, ‘খোকা’র ইংরিজি কী কী হয়?”
“বয়, ল্যাড, কিড –”
“দ্যাটস ইট, কিড!” পেঁচো উত্তেজিত হয়ে বলল, “আর ঘুমের ইংরিজি?”
“স্লিপ, স্লাম্বার, সিয়েস্তা, ন্যাপ।” হঠাৎ আমার চুল খাড়া হয়ে উঠল, “পেঁচো – কিড-ন্যাপ! তাই তুই বলছিলি ঐ শব্দদুটোর থেকে –”
“ই-য়েস! খোকা ঘুমোলে মানে, কিডন্যাপ হয়ে গেলে। এবার শেষ শব্দ দুটো পুরুষে নয়, সমাসে – অর্থাৎ খবরটা পুরুষ বা মেলে নয়, সমাস বা –”
“এস-এম-এস-এ।” আমি ফিক করে হেসে বললাম, “এটা আমিও মাঝে মাঝে বলে থাকি। তাহলে পুরোটা দাঁড়াল –”
“ফেসবুকের বকরা ছোকরা থানা থেকে আজ সন্ধ্যা ন’টায় রওনা দিচ্ছে। পরশু সকাল ছ’টায় পৌঁছোলে, সম্ভবত হাওড়ায়, তাকে ‘রিসিভ’ কোরো। তারপর কিডন্যাপটা হয়ে গেলে মেলে নয়, এস-এম-এসে খবর জানিও। তিনি হয়তো এমন জায়গায় থাকবেন যে থ্রি-জি, ফোর-জি ভালো পাবেন না – তাই মেলের বদলে এস-এম-এস।”
“তাহলে চল, পেঁচো – কাল সকালে পুলিশ নিয়ে হাওড়ায় গিয়ে মালকে হাতেনাতে ক্যাচ-কট-কট।”
“নট দ্যাট ইজি, ব্রো!” পেঁচো চিন্তিতমুখে বলল, “মেলটা একটা বাইশ-তেইশ কামরার ট্রেন। তার থেকে শয়ে শয়ে লোক নামবে। তাদের মধ্যে –”
“কিন্তু চারদিকে যদি পুলিশের জাল থাকে তবে তার মধ্যে কোনও ছেলেকে কিডন্যাপ করতে গেলে ঠিক চোখে পড়ে যাবে।”
“না রে! যে আসছে, সে আশা করছে কেউ তাকে রিসিভ করবে। কোনও সন্দেহ বা শোরগোল না করেই সে তাদের সঙ্গে চলে যাবে। অমন তো কতজনই রিসিভ করতে আসে – তুই ক’জনকে চেক করবি? তার ওপর মনে রাখিস – ‘খোকা’ শব্দটার থেকে ধরে নিয়েছিলাম যে আসছে সে ছোকরা। কিন্তু ওটার মানে যখন অন্য, তাহলে সে ছুকরিও হতে পারে!”
“তবে তো খড়ের গাদায় ছুঁচ খোঁজা হবে!”
“না, আমাদের নির্দিষ্ট ইনফরমেশন চাই। ইস, মোহনদাও যদি থাকতেন!”
বলতে বলতেই আমার ফোনটা বেজে উঠল আর আমি উদ্ভাসিত মুখে পেঁচোকে বললাম, “নে, ধর – মোহনদা ফোন করেছে।”
যত তাড়াতাড়ি সম্ভব পেঁচো মোহনদাকে ব্যাপারটা বুঝিয়ে দিল। ফোনটা স্পিকারে দেওয়া, তাই আমিও শুনছি। মোহনদা বললেন, “হুঁ, কেস তো সিরিয়াস। আমি সবে আজ অপারেশন থেকে রিলিজ হয়েই ফোন করছি, এখনও কলকাতা পৌঁছোইনি। তা তুমি আমার কী সাহায্য চাও?”
“আপনার ইনফ্লুয়েন্স খাটিয়ে রেলের ঐ ট্রেনের চার্ট থেকে থানার থেকে অল্পবয়েসী ছেলেমেয়ে কে কে কোন কোন কোচে উঠেছে, তার একটা লিস্ট আমাকে দেবেন।”
“কাজটা সহজ। কিন্তু এটুকু সময়ের মধ্যে বাস্তবে অসম্ভব, পেঁচোবাবু! রেলের ডেটাবেস থেকে খবর নিতে হলে পরপর একগাদা ফোন, একগাদা পারমিশন। তারপর এতগুলো নামের লিস্ট ঝেড়েবেছে বের করা। তার আগে ট্রেন পৌঁছে যাবে।”
“ট্রেনে কাউকে যোগাযোগ করা যায় না?”
“ট্রেন এখন ছুটছে। তার এতগুলি কামরায় টি-টিকে বুঝিয়ে রাজি করিয়ে বা যে লটকানো চার্টগুলোর কিছু আছে, কিছু ছিঁড়ে পড়ে গেছে তার থেকে দেখে থানাতে ওঠা যাত্রী বের করা, এটুকু সময়ে অসম্ভব।”
“যদি খবর পেতেন ঐ ট্রেনে একজন টেররিস্ট আসছে?”
“তবে কোনও স্টেশনে আমাদের লোক ঢুকিয়ে ট্রেন ছেঁকে ফেলতাম, হাওড়া স্টেশনেও তাই। দরকার হলে কোথাও ট্রেন দাঁড় করাতাম। কিন্তু তোমার যেটুকু সন্দেহ তার ভিত্তিতে তো এতসব –”
“বুঝলাম।” পেঁচোর চোয়াল হঠাৎ শক্ত হয়ে উঠল। বলল, “ঠিক আছে, আমিই খবর বের করে নিচ্ছি। তবে তাতে যদি একটু ডানদিক-বাঁদিক হয়, আপনি পরে সামাল দিতে পারবেন?”
“আরে কী করতে যাচ্ছো, শার্লকবাবু?” মোহনদা একটু উদ্বিগ্ন হয়ে বললেন, “বেশ, আমি সামলে দেব – তবে খুন-জখম অবধি এগিও না। আর আমি আমাদের একজনকে বলে দিচ্ছি – সে নাম বলবে সুশান্ত আর কাল পৌনে ছ’টার থেকে হাওড়া স্টেশনে থাকবে। তোমার জি-মেলের প্রোফাইল পিকচার ওকে হোয়াটসঅ্যাপ করছি। আর তুমি একটা নীল রুমাল দিয়ে মাঝে মাঝে চশমার কাঁচ মুছবে। তবেই ও তোমাকে চিনে নেবে।”
“থ্যাঙ্ক ইউ, মোহনদা।” লাইনটা কেটে দিয়েই পেঁচো আবার ব্যস্ত হাতে ডায়াল করতে লাগল, এবার মানসীদিকে।
“তুমি কি আমায় জেলে পাঠাতে চাও, পেঁচো!” মানসীদি আর্তনাদ করে উঠলেন, “রেলের ডেটাবেস হ্যাক করা – আমার আধা-সরকারি চাকরি –”
“ভয় নেই, প্রোটেকশন ঠিক করেই আপনাকে বলেছি। আর এটা এমন কিছু সিক্রেটও নয়, ট্রেনের গায়েই তো প্যাসেঞ্জার লিস্ট ঝুলছে।”
“বেশ বলো, তুমি ঠিক কী চাও।”
“ঐ ট্রেনের চার্ট থেকে থানাতে হাওড়ার যাত্রী যারা উঠেছে তাদের থেকে এই ধরুন বিশের কম বয়সের মধ্যে কোনও ছেলে বা মেয়ে থাকলে তাদের একটা কামরার নম্বর ওয়ারি লিস্ট আমাদের চাই।”
“ব্যস – মাত্র এইটুকু ক্লু, তার থেকে স্রেফ ক’ঘণ্টার মধ্যে –”
পেঁচো এবার সংক্ষেপে মানসীদিকে কেসটা বুঝিয়ে দিল। তারপর ফিসফিসিয়ে বলল, “তাহলে বুঝতে পারছেন মানসীদি, আপনার ওপর একটা অল্পবয়েসী ছেলের, বা মেয়ের নিরাপত্তা নির্ভর করছে।”
“আর বলতে হবে না।” মানসীদির কণ্ঠে এবার দৃঢ়তার ছাপ, “ঘণ্টাদুয়েকের মধ্যে তোমাকে জানাচ্ছি।”
তারপর এক একটা মিনিট যেন এক একটা ঘণ্টা। পেঁচো পায়চারি করছে আর ঘন ঘন সময় দেখছে। এক সময় দু’ঘণ্টা কেটে গেল, আরও আধ ঘণ্টা। পেঁচো হতাশ হয়ে বলল, “মনে হচ্ছে, মানসীদিও ফেল! সত্যিই এইটুকু সময়ে –”
বলতে না বলতেই পেঁচোর ল্যাপটপে টুং করে ঘণ্টা – নতুন মেল এসেছে। সাথে সাথেই ওর মোবাইলও বেজে উঠল। মানসীদি!
“সরি পেঁচো, সব মিলিয়ে দেরি হয়ে গেল। তবে তোমার ‘বকরা’কে পেয়েছি – সঞ্জয় কুলকার্নি, যাচ্ছে এসি টু টায়ারের কোচ টু’তে। ও এক বড় কাপড় ব্যবসায়ীর ছেলে। ওর ফেসবুক বান্ধবী দীপিকার সঙ্গে দেখা করতে ও কলকাতা আসছে। মানে, ঐ ফাঁদ পেতে ওকে আনা হচ্ছে।”
“কামাল, মানসীদি। আপনি এত তাড়াতাড়ি – আর ওসব খবর তো রেলের চার্টে থাকে না?”
একটু আত্মতৃপ্ত ভঙ্গীতে মানসীদি বললেন, “দ্যাখো, গোটা ট্রেনের চার্ট খুঁজতে ভোর হয়ে যেত। কিন্তু কিডন্যাপ তো বড়োলোকের ছেলেরই হওয়ার কথা। তাই আপার ক্লাস থেকে দেখতে শুরু করলাম। শেষে এসি টু-টায়ারে থানা থেকে ওঠা দু’জন ছেলেমেয়েকে পেলাম। তার মধ্যে পূজা ফ্যামিলির সাথে যাচ্ছে, সুতরাং সঞ্জয়ই হবে। আর একবার যখন নাম পেয়েছি, তখন ফেসবুকে ঢোকা কী আর এমন ব্যাপার! তার ওপর ছেলেটা সিকিওরিটি সম্বন্ধেও সচেতন নয়। কাজেই ফটাফট সব ডিটেইলস পেয়ে গেলাম। তোমাকে ওর ফোটো সহ সব বিবরণ মেলে পাঠিয়ে দিয়েছি। এবার যাও, বদমাসগুলোকে ধরো।”
“শিওর মানসীদি! থ্যাঙ্ক ইউ।” পেঁচো থামস আপ সাইন দেখিয়ে আমাকে বলল, “এবার মোহনদাকে বলে স্টেশনে পুলিশ পাঠাবার বন্দোবস্ত করা যাক।” তারপর দ্রুত ডায়াল করতে লাগল।
একটু পরই কিন্তু ওর মুখ ফ্যাকাশে, “শিট, সেল আউট অফ রিচ! আবার কি কোনও অ্যাকশনে গেল?”
“হয়তো কলকাতার প্লেনে উড়ছে। তুই পুলিশ হেল্পলাইনে ফোন কর না।”
“দ্যাখ আমার তো, মানে গোয়েন্দা হিসেবে তেমন নামডাক নেই – তাই এত রাতে ওসব শুনে ওরা হেসে উড়িয়ে দেবে, বলবে কাল সকালে থানায় রিপোর্ট করতে। আর মোহনদা যে সুশান্ত মহাপ্রভুর কথা বলেছেন তিনিও তো কাল সকালের আগে কনটাক্ট করবেন না।”
“যাক গে, কাল সকালে চল আমরাই একটু আগে স্টেশনে গিয়ে ঐ কোচটা যেখানে পড়বে সেখানে অপেক্ষা করি। তাহলে সুশান্তও তোকে দেখে ওখানে আসবে।”
“হ্যাঁ, তা তো বটেই। তা, এখন ক’টা বাজে – সাড়ে এগারো? ইস, এক্ষুণি শুয়ে পড়তে হবে – নইলে কাল সকালে তাড়াতাড়ি বেরোতে পারবো না। দাঁড়া, সাড়ে চারটায় অ্যালার্ম দিই।”
“অত সকালে ট্যাক্সি পাবি?”
“এই মেইন রোডেই একটা স্ট্যান্ড আছে, ওখানে সব সময় ট্যাক্সি দাঁড়িয়ে থাকে।”
“তবে তো পাঁচটায় উঠলেই যথেষ্ট। এখান থেকে ঐ ভোরে হাওড়া যেতে বড়োজোর আধ ঘণ্টা।”
“ন্-না, মানে আমার একটু আগে উঠতে হবে। আমি সাড়ে চারেই অ্যালার্ম দিচ্ছি।”
তখন মনে পড়ল, অনেক ধীমান বাঙালির মতো পেঁচোরও একটু আমাশার দোষ আছে। সকালে বার কয়েক ছোটোঘরে না গিয়ে সে তাই বেরোতে ভরসা পায় না। সুতরাং পেঁচো সাড়ে চারেই অ্যালার্ম লাগাল। তারপর আমরা শুয়ে পড়লাম আর সারাদিনের ধকলের পর শুয়েই ঘুম।
একটা অস্বস্তি নিয়ে ঘুম ভাঙল। দেখি, বাইরে দিব্যি ভোরের আলো। সেলটা হাতে নিয়ে দেখি, সোয়া পাঁচটা। সর্বনাশ! পেঁচোকে ধাক্কা দিলাম, ও ধড়মড়িয়ে উঠল।
“অ্যালার্ম বাজল না তো!”
পেঁচো দেখি মাথা চুলকোচ্ছে। তাবড় তাবড় সমস্যার সমাধানে ওর দুর্ধর্ষ মাথা। কিন্তু ছোটোখাটো, সাধারণ ব্যাপারে কেলো করে প্রায়ই তার সুফল জলাঞ্জলি দেওয়ার উপক্রম করে। ওর মুখের দিকে চেয়ে সন্দেহ হওয়ায় বললাম, “অ্যালার্ম দিসনি?”
“দিয়েছি, বোধহয় ভুল করে এ-এম-এর বদলে পি-এম –”
কী বলবে বলো! বললাম, “নে, এবার চল – এখনও ট্রেন ধরা যাবে।”
“শিওর।” পেঁচোর হাতেপায়ে এখন যেন বিদ্যুৎ। ছোটোঘর-ফর মাথায় রইল – পাঁচ মিনিটের মধ্যে তৈরি হয়ে দু’জন রাস্তায়।
ট্যাক্সি স্ট্যান্ডে তাকিয়ে কিন্তু বিপদ সঙ্কেত পেলাম। ভোর হয়ে গেছে দেখেই বোধহয় গাড়িগুলো একে একে বেরিয়ে গেছে। শেষ ট্যাক্সিটিকে হাত দেখিয়ে একজন ঘাড়ে-গর্দানে প্রৌঢ় ধীরেসুস্থে এগোচ্ছেন। হঠাৎ একটা কালো বিদ্যুৎ খেলে গেল। প্রায় একশো মিটার স্প্রিন্ট করে পেঁচো মোটাবাবুর আগেই ট্যাক্সিতে পৌঁছে তার লিকলিকে পেঁচো-গতর সামনের দরজা দিয়ে ট্যাক্সির ভেতরে ঠেলে দিয়েছে। অমন পান্তোভূতের মতো এক স্পিশিস কাকভোরে হাওয়ায় উড়ে হাজির হওয়ায় ট্যাক্সি ড্রাইভারের এমনিতেই বাক্রোধ হবার জোগাড়। তারপর পেঁচো যখন তর্জন করে বলল, “জলদি চলো, ডাকু, ভাগ যায়েগা”, সে কেঁদেই ফেলল। ততক্ষণে আমি হাঁফাতে হাঁফাতে হাজির হয়েছি। শুনতে পেলাম লোকটা কাঁদোকাঁদো গলায় বলছে, “ডাকু সাব, আপ ট্যাক্সি লেকর ভাগ যাইয়ে। লেকিন মুঝে ছোড় দিজিয়ে, গরিব আদমি।” অনেক কষ্টে তাকে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে আমরা রওনা দিলাম।
ভূত না ডাকু কীসের ভয়ে জানি না, লোকটা আমাদের প্রায় উড়িয়েই হাওড়া হাজির করল। ছ’টা বাজতে দশ। নেমেই ছুটেছি ভেতরে, প্ল্যাটফর্ম টিকিট কাটার শিষ্টাচারের সময় নেই। গেটে পেঁচো চেকারকে জিজ্ঞেস করল, “মুম্বই মেল ক’নম্বরে আসছে?”
“আঠেরো নম্বরে এসে গেছে।” চেকারটি আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলেন।
“সে কী, এখনও তো দু’মিনিট বাকি!”
“কুড়ি মিনিট বিফোর টাইমে ঢুকেছে।” চেকারটি দয়ালু কণ্ঠে বললেন, “কাউকে রিসিভ করবেন বুঝি? যান, তাঁরা হয়তো প্ল্যাটফর্মে অপেক্ষা করছেন।”
“এদের কোনও পাংচুয়ালিটি নেই!” বিড়বিড় করতে করতে পেঁচো দৌড়োল। এসি টু টায়ারের কাছে গিয়ে দেখি, ভোঁ-ভাঁ। প্যাসেঞ্জাররা নেমে চলে গেছে।
“পাখি উড়ে গেছে।” বলল হতাশ পেঁচো।
“অন্তত ঐ সুশান্তকে তো ধর, নীল রুমালটা দিয়ে চশমার কাঁচ মোছ।”
“তাড়াহুড়োয় রুমালটা আনতে ভুলে গেছি।” বলে এক মুহূর্ত ভেবে পেঁচো বলল, “চটপট চল। এখন একমাত্র আশা হাতিবাগানের যতীন রায়ের ঠিকানাটা। যদি ভুয়ো না হয়, ওখানে গেলে কিছু সূত্র মিলবে।”
আবার ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়। যখন বেরোচ্ছি, হঠাৎ একজন গাঁট্টাগোট্টা লোক একবার নিজের স্মার্টফোনে, একবার পেঁচোর মুখের দিকে তাকিয়ে ইতস্তত করে বললেন, “আপনি কি –”
“কেউ না, কিছু না!” বলতে বলতে পেঁচো আমার হাত টেনে বেরিয়ে এল।
বললাম, “এই বোধহয় সেই সুশান্ত?”
“গুলি মার!” পেঁচো দৌড়োতে দৌড়োতে বাইরে এসে আবার একটা ট্যাক্সি বলতে গেলে ছিনতাই করে তার ভেতরে ঢুকেই “হাতিবাগান” বলে হাঁফাতে লাগল।
কী সৌভাগ্য, ঠিকানাটা পেঁচোর সেলে নোট করা ছিল। কিন্তু হাতিবাগানের অলিগলি ঘুরে তা খুঁজে পাওয়া কি সোজা? শেষে ট্যাক্সি ছেড়ে আমরা পয়দলে চললাম। এমন সময় হঠাৎ দেখি, পেঁচো মুখ বিকৃত করছে।
“পেটটা মোচড়াচ্ছে। ইয়ে, মানে, সকালে ঐটা ক্লিয়ার করে বেরনো হয়নি কিনা।”
সর্বনাশ! বললাম, “ব্রাহ্মমুহূর্তে – ডোবাস নে, পেঁচো। এখানে এখন সুলভ শৌচালয় কোথায় পাবি!”
পেঁচোও আপ্রাণ লড়ছে, তবে সে যেন এক অপ্রতিরোধ্য শক্তির বিরুদ্ধে। কিন্তু সঙ্কট মানুষকে বেপরোয়া করে তোলে। রাস্তার বাঁপাশে এক পুরনো আমলের দোতলা বাড়ি, পেঁচো সোজা দরজায় গিয়ে বেল মারল।
“কাকে চাই? কী চাই?” ঘুমজড়ানো চোখে দরজা খুলতে খুলতে বললেন এক মাঝবয়েসি ভদ্রলোক।
“কাউকে চাই না, বিশেষ কিছু চাই না।” পেঁচো ফস করে তার আই-কার্ড বের করে বলল, “আমি এক সজ্জন ব্যক্তি। রাস্তায় বেরিয়ে খুব বিপদে পড়ে শুধু আপনার টয়লেটটা মিনিট পাঁচেকের জন্য চাইছি।”
“আরে, আসুন, আসুন!” ভদ্রলোক দ্রুতপায়ে পেঁচোকে ভেতরে নিয়ে গেলেন। আর আমি বাইরে দাঁড়িয়ে এদিক-ওদিক তাকাতে লাগলাম, কাউকে জিজ্ঞেস করে যদি যতীনের ঠিকানাটার হদিস মেলে।
এই বাড়ির পিঠোপিঠি পাশের গলির ওপর যে বাড়ি চোখে পড়ে, সেটাও দোতলা। তার বাইরে কিছুটা গাছপালা সহ কম্পাউন্ড। সেদিকে চেয়ে আছি, হঠাৎ আমার চক্ষু চড়কগাছ। দোতলার ঘরের একটা জানালা, সেখান দিয়ে একটা ছেলে ভীত মুখে উঁকি মেরে কী যেন বলতে চাইছে। কোথায় দেখেছি না একে? ভাবতে ভাবতেই মনে পড়ে গেল এ সেই ফেসবুক বকরা সঞ্জয়, যার ছবি মানসীদি পাঠিয়েছে!
বিশেষ কিছু না ভেবেই সামনের বাড়ির গেট টপকে ঢুকে গলি দিয়ে পেছনের পাঁচিলের দিকে এগিয়েছি, হঠাৎ দেখি সঞ্জয়ের মুখের ওপর একটা হাত। আর একটা হাত তাকে টেনে ভেতরে নিয়ে গেল।
“পেঁ-চো-ও-ও!” চিৎকার করে ডাকলাম।
“দে-খে-ছি-ই-ই!” বাঁশির মতো তীক্ষ্ণ গলায় জবাব এল। সাথে সাথে দোতলার টয়লেটের হাফ-জানালা দিয়ে একটা লিকলিকে বিদ্যুৎ ঝাঁ করে বেরিয়ে পাশের বাড়ির দেয়ালে ঝাঁপিয়ে পড়ল। তারপর পাইপ ধরে হাঁচড়ে পাঁচড়ে উঠে এক লাথিতে ওই জানালাটা খুলে বাড়ির ভেতর ঢুকে পড়ল।
পেঁচো ওর পান্তোভূতের মতো নমনীয় চেহারা নিয়ে ঝাড়পিটের সমস্ত ব্যাকরণের বাইরে গিয়ে একটা গ্যাংকে একাই কেলিয়ে লাট করতে পারে, এটা আমরা ছোটোবেলার থেকেই জানি। কিন্তু এই কিডন্যাপারের দল সশস্ত্র থাকতে পারে ভেবে ভয়ে আমার বুক শুকিয়ে গেল। বিপদে আমার বুদ্ধি গুলিয়ে গেল। মোহনদাকে ফোন করলে হয়, এটা মাথায় এল না। পাঁচিল ডিঙোবার চেষ্টা করলাম। না পেরে শেষে পেছিয়ে এসে ঘুরপথে ঐ বাড়ির সামনের দিকে রওনা দিলাম। আসার আগে শুনতে পেলাম গৃহস্বামী আকূলভাবে টয়লেটের দরজা ধাক্কাতে ধাক্কাতে বলছেন, “ও মশাই, আপনার হল? টেঁপি আর থাকতে পারছে না।”
ওখানে পৌঁছে অবশ্য দেখলাম, অবস্থা তত খারাপ নয়। ‘পেঁচোর পাঁচন’ যথারীতি জনাতিনেককে ধরাশায়ী করে দিয়েছে। কিন্তু একজন স্যুট-বুট পড়া লোক তার মধ্যেই এক ফাঁকে সঞ্জয় ছোকরাকে টানতে টানতে এসে একটা গাড়িতে উঠল আর পেঁচো ভিড় ঠেলে নিচে নেমে আসার আগেই স্টার্ট দিল। সামনে দাঁড়িয়ে আটকাবার চেষ্টা করেছিলাম, কিন্তু গাড়িকে ভয়ঙ্কর স্পিডে ছুটে আসতে দেখে সরে দাঁড়াতে হল।
“গেল, গেল!” পেঁচো হাহাকার করে উঠল। তখনই দুম-দুম দুটো পিস্তলের শব্দ, তারপর ফটাস-স-স করে টায়ার ফাটার আওয়াজ। ফেরারি গাড়ি কেতরে কেতরে কাত হয়ে শেষে দাঁড়িয়ে গেল।
“হ্যান্ডস আপ!” কয়েকজন সাদা পোশাক গাড়ি ঘিরে ধরেছে। তাদের মধ্যে স্টেশনে দেখা সেই বলিষ্ঠ ব্যক্তিকেও চোখে পড়ল। একটু পর অবশ্য কাঁধে এক দশাসই থাপ্পড়ে আর আশ্বাসভরা স্বরে “সব ঠিক আছে, শালাবাবু” শুনে সব সংশয় দূর হয়ে গেল – মোহনদা!
“আপনারা – এখানে – কী করে?” পেঁচোও অবাক।
“সুশান্ত তোমাকে ঠিক স্পট করেছিল। তুমি বোকার মতো ওকে এড়িয়ে গেলেও ও তোমাকে ফলো করে এখানে পৌঁছেছিল আর আমাদেরও খবর দিয়েছিল। যাকগে, খেল খতম। এবার আমার সঙ্গে চলো – ব্রেকফাস্ট করতে করতে পুরো গপ্পোটা শোনা যাবে।”
তারপর আর কী? সব ভালো যার শেষ ভালো। কিডন্যাপাররা সব ধরা পড়ল। তাদের গ্যাংয়ের অন্য অনেকেও টানে টানে পুলিশের জালে এল। সোশ্যাল মিডিয়ার সুযোগ নিয়ে এর আগেও তারা বেশ কিছু ছেলেমেয়েকে কিডন্যাপ করে মুক্তিপণ আদায় করেছে বলে জানা গেল। এদের মধ্যে চন্দন রায় নাকি ছিল এক ব্যর্থ কবি। তার সঙ্কেতের দুর্বোধ্যতা কেউ ভেদ করতে পারত না দেখে সে হতাশ হয়ে কবিতা ছাড়ে। কিন্তু তার এক অনুরাগী পাঠক যতীন চক্রবর্তী চন্দনের এই প্রতিভাকে কাজে লাগায় তাদের দলের মেসেজ নিরাপদে পাঠাবার জন্য। কোনও চিহ্ন যাতে না থাকে তাই তারা অনবরত নতুন অ্যাকাউন্ট তৈরি করে খবর পাঠাত, আবার পুরনোটা ডি-অ্যাকটিভেট করে দিত। সবই ঠিকঠাক চলছিল, শুধু চন্দন ভুলে যতীন চক্রবর্তীর মেল জ্যোতির্ময় চক্রবর্তীকে পাঠিয়ে কেলোটা করল।
সঞ্জয় নিরাপদে বাড়ি ফিরে গেল। কৃতজ্ঞ সঞ্জয়ের বাবা পেঁচোর সাথে দেখা করে তার আপত্তি সত্ত্বেও এক মূল্যবান স্যুটপিস প্রেজেন্ট করে গেলেন। পেঁচোর নাম বড় করে কাগজে বেরোল। অবশ্য ঘটনার হ্যাকিং প্রভৃতি চিত্তাকর্ষক অংশ গোপন রেখে গপ্পোটা মিডিয়াকে নতুন করে পরিবেশন করা হয়েছিল। মানসীদির নাম তাই গোপনই থাকল। তবে কিছু কাগজে এক অসমর্থিত সংবাদে ইন্ডিয়ান রেলের ডেটা বেস হ্যাক হবার কথা বেরিয়েছিল। সেটা ক্রিকেট খেলায় হেরে ক্ষুব্ধ প্রতিবেশী দেশের কোনও ফ্যানদের কাজ বলে সন্দেহ প্রকাশ করা হল। তবে রেলওয়ে জানাল কোনও গোপন তথ্য নয়, শুধু ইতিমধ্যে প্রকাশ হওয়া কিছু তথ্যই হ্যাকারদের হাতে পড়েছে।
মানসীদিকে পেঁচো যখন কৃতজ্ঞতা জানাতে গিয়েছিল, তিনি উল্টে ধরা গলায় ওকেই অনেক ধন্যবাদ জানালেন গ্যাংকে ধরে অনেক ছেলেমেয়েকে বাঁচানোর জন্য। তবে তারপর তিনি বললেন, “তাহলে তো বুঝলে আমি যে আপ্রাণ চেষ্টায় ছেলেমেয়েদের আগলে রাখি সেটা ওদের নিরাপত্তার জন্যই করি?”
“আসলে আপনাদের গার্জেনদের দোষ কী, জানেন?” পেঁচো হঠাৎ গম্ভীর হয়ে বলেছিল, “ছেলেমেয়েদের সঙ্গে আপনারা বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ার চেষ্টা করেন না। তাই ওরা আপনাদের কাছে কিছু খুলে বলে না আর তারপর হয়তো একদিন বিপদে পড়ে।”
কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে মানসীদি ফোঁস করে একটা নিশ্বাস ফেলে বলেছিলেন, “তুমিই বোধহয় ঠিক।”
কিছুদিন পর পেঁচোকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, “মানসীদির সেই রিজিউমে নেওয়া, কীসব পাকাপাকি বন্দোবস্ত – সেটা শেষ অব্দি কী দাঁড়াল রে?”
“ন্-না, তেমন কিছু নয়।” পেঁচো বলেছিল। আমার কিন্তু মনে হল, ওর এই নীরবতার পেছনে কোনও রহস্য আছে।
কিছুদিন পর অবশ্য সেই রহস্য ভেদ হয়েছিল, যেদিন পেঁচো একটা বিয়ের চিঠি নিয়ে আমার দিকে এগিয়ে দিয়েছিল। “কার রে?” না তাকিয়েই জিজ্ঞেস করেছিলাম। তারপর ওর লজ্জায় বেগুনি মুখটা দেখে চটপট খুলে দেখলাম – জ্যোতির্ময় চক্রবর্তীর সাথে কুহেলি সান্যালের বিয়ে।
“ডুবে ডুবে জল খাওয়া!” ওর পিঠ চাপড়ে বলেছিলাম, “তা, তিনি কে? চিনি?”
“মানসীদির মাসতুতো বোন। মানে, হঠাৎই ঠিক হয়ে গেল।”
কিছুক্ষণ হাঁ করে থাকার পর বলেছিলাম, “চোরে চোরে কী যেন হয় – তা ইনিও কি –”
“অন্তত ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টগুলো তো হ্যাক হবেই।” পেঁচো হতাশ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল।
ছবিঃ মৌসুমী