মিনুর লাল ঘুড়ি আর লামিয়া
সায়ম আমান
সকালবেলা ছাদে উঠতেই মিনুর মনটা খুশিতে নেচে উঠল। এমনিতে ঘুম থেকে উঠে মায়ের কাছে একদফা বকুনি খেয়ে মনখারাপ হয়েছিল, তার ওপর পোষা বেড়ালটা কাল রাত থেকে বেপাত্তা।
বকুনি খাবার পরে কিছুক্ষণ বইতে মুখ গুঁজে বসে ছিল মিনু, কিন্তু মনে ঘুরঘুর করছিল অন্য চিন্তা। কাল স্কুলে একটা আজব ব্যাপার দেখিয়ে তাকে তাক লাগিয়ে দিয়েছে চিটু। রহস্যটা যে ঠিক কী তা মিনু এখনও ভেবে বের করতে পারেনি। আজ সকালে উঠে বাবাকে জিজ্ঞেস করবে ভেবেছিল কিন্তু তার আগেই মা এমন ধাতানি দিল যে সেটুকু আর সাহস হল না। (আপনারা হয়ত এখন জানতে চাইবেন সাত সকালে কেন মিনু মায়ের কাছে বকুনি খেল, কিন্তু মাফ করবেন, সেটা আমার পক্ষে বলা সম্ভব নয়। কাল রাতে সে ঘুমের ঘোরে বিছানায় কী করে ফেলেছিল সেটা হাটের মাঝে ছড়িয়ে দিলে তার গল্পগুলো আমাকে বলাই বন্ধ করে দেবে সে।) যাই হোক, রহস্যটা হল চিতু কাল তার দাদার ফেলে দেওয়া একটা ক্যালকুলেটার কোনমতে লুকিয়ে চুরিয়ে স্কুলে এনেছিল, এমনিতে সেটা দেখতে এমন কিছু আহামরি নয়, বরঞ্চ ভাঙাচোরাই বলা যায়, মিনু তাচ্ছিল্য করতে চিতু মিচকে হেসে বলেচিল, “ হুঁ, হুঁ, বাবা, এসব অত ফেলনা নয়। এ ক্যালকুলেটারে ইংরিজি লেখা যায়, সেটা জানিস?”
মিনু প্রথমে ব্যাপারটা বিশ্বাস করতে চায়নি, ক্যাল্কুলেটার কি মোবাইল ফোন নাকি যে তাতে লেখাও যাবে? হাতে নিয়ে দেখতে পেল তার কোথাও ইংরিজি হরফের বাটনগুলোও লেখা নেই, ধুর… চিতু ঢপ দিচ্ছে। সেটা ফেরত দিয়ে মিনু আবার নিজের বেঞ্চের দিকে ফেরার উপক্রম করেছিল, তারমধ্যেই চিতু ক্যালকুলেটারটাকে বাগিয়ে ধরে পটাপট কীসব টিপে মিনুর হাতে সেটা দিয়ে বলল, “ এই দেখ, হুঁ, হুঁ …”
মিনু দেখল ছোট্ট স্ক্রিনটার ঠিক মাঝখানে বড়োবড়ো হরফে ইংরাজিতে কী যেন লেখা আছে, ইউ এন ডি, পুরোটা সে পড়তে পারল না। চিতু ক্যালকুলেটারটা তার হাত থেকে নিতে নিতে বলল, “ বিদেশি জিনিস, এতে গেমও খেলা যায়, সে আর একদিন দেখাব।” বলে সেই মিচকে হাসিটা আর একবার হেসে বসে পড়ল। তারপর থেকে মিনুর এই এক চিন্তা, এ-বি-সি-ডির বাটন নেই কিন্তু তাও লেখা যায়! ভারি আশ্চর্য জিনিস বটে! একবার ভেবেওছিল বাবাকে এনে দিতে বলবে, কিন্তু বিদেশি জিনিস যে, এখানে কি পাওয়া যাবে?
এখন কিন্তু ছাদে উঠতেই সেই চিন্তাটা মাথা থেকে একেবারে মুছে গেল, তার কারণ অন্য কিছু নয়, ছাদের একপাশে যে ছোটো মিটারঘরটা আছে তার ঠিক মাথার কাছে আটকে আছে একটা লাল ঘুড়ি, দুপুরের ঝিরঝিরে হাওয়ায় সেটা তিরতির করে কাঁপছে, যেন হাতছানি দিয়ে ডাকছে। মিনু সেদিকে এগিয়ে গেল, হাত বাড়িয়ে ধরার চেষ্টা করল ঘুড়িটা। কিন্তু হাতের আওতার বেশ খানিকটা ওপরে আটকেছে সেটা, এমনকি লাফিয়েও ধরা গেল না। মিনু হতাশ হয়ে ছাদের পাঁচিলের একপাশে বসে পড়ল। কি সুন্দর রঙিন চাঁদিয়াল ঘুড়ি, কোথা থেকে কেটেছে কে জানে। এখন তো বিশ্বকর্মা পুজোও ঢের দেরি আছে, তাহলে এলো কোথা থেকে?
এমনিতে কিন্তু মিনু ঘুড়ি ওড়াতে পারে না। একবার পাশের বাড়ির বিল্টুদাদারা তাকে লাটাই ধরতে দিয়েছিল, কিন্তু তখন সে এতই হালকা যে লাটাইটা প্রায় টেনে আকাশে নিয়ে যাচ্ছিল তাকে, তারপর থেকে মা বলেছে বড়ো না হলে আর লাটাই না ধরতে। মিনুর অবশ্য ঘুড়ি ওড়াতে তেমন ভালও লাগে না, কিন্তু দেখতে মজা লাগে। কিন্তু এই মুহূর্তে মনে হল ঘুড়িটা না পেলেই নয়। পড়ার বইয়ের সামনে সাজিয়ে রাখলে বেশ লাগবে দেখতে। এইসব ভেবে সে আবার উঠে দাঁড়াল, আবার লাফ দিল, কিন্তু লাফ দিলেই যেন আরও খানিকটা সরে যাচ্ছে, কী আশ্চর্য! যদি হাতেই না আসবে তাহলে ছাদে এসে লাগল কেন?
মিনুর এবার জেদ চেপে গেল। কী দুঃসাহস ঘুড়িটার! যেন বারবার তাকে বেঁটে বলে ভেংচি কাটছে, আহাহা! বাঁকা কাঠির হাসি দেখ না, গা জ্বলে যায়। মিনু উঠে দাঁড়াল। মাথায় একটা বুদ্ধি এসেছে বটে কিন্তু সেটা করতে গেলে যদি আশপাশের বাড়ি থেকে কেউ দেখে নেয় আর তারপর যদি মাকে বলে দেয় তাহলে তার পিঠের একখানা হাড়ও আর আস্ত থাকবে না।
যাই হোক জেদ যখন চেপেছে তখন না করে উপায় নেই, তাছাড়া এখন চারপাশে কেউ নেইও। ছাদের পাঁচিলের ওপর একটা পা রাখল মিনু, তারপর আর একটা পা, নিচে তাকাতেই গা টা কেমন যেন শিরশির করে উঠল। ঘুড়িটা কিন্তু হাতের কাছে এসেছে। এবার যাবে কোথায়? হাত বাড়িয়ে ঘুড়ির একটা পাশ ধরল সে, আর সাথে সাথে পাঁচিলের ওপর থেকে পা পিছলে গেল। ভয়ে চোখ বন্ধ করে নিল মিনু, হয়ত এক্ষুনি নিচে পড়বে, খুব কি ব্যথা লাগবে? পা ভেঙে যাবে? অন্তত কয়েকটা হাড়…
বেশ কিছুক্ষণ চোখ বুজে সে এইসব ভাবছিল, কিন্তু এখনও মাটিতে ধাক্কা লাগল না কেন? দুতলা থেকে পড়তে তো এতক্ষণ লাগার কথা নয়! মিনু দুরুদুরু বুকে চোখ খুলল। আর চোখ খুলতেই বিস্ময়ে মুখ হাঁ হয়ে গেল, সে নিচে পড়েনি। ঘুড়িটাই বাঁচিয়ে নিয়েছে তাকে, কিন্তু সেটা আর মিটারঘরের ছাদে আটকে নেই, হাওয়ায় দুলতে দুলতে ভেসে পরেছে ছাদের বাইরে।
মিনু একবার ভাবল চেঁচিয়ে কাউকে ডাকবে, এ কী সর্বনেশে ঘুড়ি রে বাবা! অন্তত পঁচিশ কেজির একটা মানুষকে নিয়ে দিব্যি উড়ে চলেছে, শুধু উড়ছে যে তাই নয়, আস্তে আস্তে ওপরের দিকে চলেছে! হায় ভগবান, এবার কী হবে? হাত ছেড়ে দিলে নিচে পড়ে হাত পা ভাঙবে, আবার ধরে থাকলেও কোথায় গিয়ে যে থামবে কে জানে!
ভাবতে ভাবতেই সে বেশ খানিকটা ওপরে উঠে গেল। যত ওপরে উঠছে তত গতি বাড়ছে ঘুড়িটার, মিনুর কান্না পেয়ে গেল। তার ঠিক পায়ের নিচে তখন খেলার মাঠটা সরে যাচ্ছে, সব কিছু ছোটো হয়ে আসছে। ছাদে মায়ের শুকোতে দেওয়া ভেজা শাড়িগুলো, বিল্টুদাদাদের এন্টেনা। ঘুড়িটা এবার রকেটের মত শোঁশোঁ করে ওপরে উঠছে। কোথায় নিয়ে যাচ্ছে কে জানে।
মিনু বুঝল নিচে তাকিয়ে আর কোন লাভ নেই, ভাবগতিক দেখে মনে হচ্ছে ঘুড়িটা কোথাও যেন নিয়ে যাচ্ছে তাকে। আকাশের বুকে সাদা ঝকঝকে মেঘেদের দল দুপুরের রোদ মেখে নিশ্চিন্তে শুয়ে আছে। একটা দুটো পাখি ঘুড়ির ঠিক পাশ দিয়ে উড়ে যেতে যেতে মিনুকে দেখে অবাক বিস্ময়ে তার পায়ে দুটো ঠোক্কর মেরে গেল, সত্যিকারের মানুষ তো? নাকি ফানুশ?
এদিকে মিনু কিন্তু এতক্ষণে ঘুড়িটার ওপর চড়ে বসেছে, তার একটু আগের ভয়টা কেটে গেছে। এখন বরঞ্চ বেশ মজাই লাগছে। যেভাবে ঘুড়িটা বোঁবোঁ করে মেঘগুলোর দিকে ধেয়ে যাচ্ছে তাতে সেগুলোকে পার না করে থামবে বলে তো মনে হয় না। কী আছে মেঘগুলোর ওপারে? এ ভাবনাটা আগেও তার মাথায় এসেছে, আজ মনে হচ্ছে সেই রহস্যের সমাধান হবে। মিনু ঝটপট ভেবে নিল বাড়ি ফিরেই এই সমস্ত ঘটনা লিখতে বসবে, অবশ্য কেউ বিশ্বাস করতে চাইবে না – তাও সে ভাল করেই জানে। তবে যখন বড়ো হবে তখন মোটামোটা ছবিছাড়া বইতে এই সব ফলিয়ে লিখে দেবে। আর সেই বই পড়ে স্কুলের বাংলার স্যার গগনবাবু জিভ কেটে বলবেন, “ আহা গো, মৃন্ময়ী বাংলায় এত ভাল ছিল, আর আমি কিনা নম্বরই দিতুম না খালি বানান ভুল করত বলে!”
ব্যাপারটা ভেবেই মিনুর হাসি পেল। হাওয়ার টানে তার ঘাড় অবধি লম্বা চুলগুলো সোজা হয়ে দাড়িয়ে আছে, ফ্রকের একটা দিক লেপটে আর একটা দিক পিছনে ফুলে ফেপে পতপত করে উড়ছে। নিচে তাকালে এখন আর কিছুই চোখে পড়ে না, সব যেন সাদা সাদা বাক্স। খুশিতে ডগমগ হয়ে মিনু খালি গলায় গান ধরল, “বিড়াল হল বাঘের মাসি, বাঘের মেসো হুলো…”
গানটা গাইতেই তার বিড়াল প্লুটোর কথা মনে পড়ে গেল। কাল রাত থেকে কোথায় যে ভ্যানিশ হয়ে গেল কে জানে। আজ সকালে খেতেও আসেনি। প্লুটো দিনকতক হল একটা নতুন খেলা পেয়েছে। শুধু খেলা নয়, তার সাথে খাওয়াও। পাশের বাড়ির ছাদগুলোতে গম ছড়িয়ে রাখা হয় বলে সেখানে দুপুরবেলা পায়রা এসে বসে, প্লুটো তক্কে তক্কে থাকে, সুযোগ বুঝলেই বাঘের মত ঝাঁপিয়ে পায়রা ধরে নেয়। আজও হয়ত সেই লোভেই কোথাও ঘুরে বেড়াচ্ছে। প্লুটোকে আর দেখতে না পেলে খারাপ লাগবে মিনুর। যতই পায়রাখোর হোক, প্লুটোর “ম্যাও” ডাকটা ভারি সুন্দর। কাঁচুমাচু মুখ আর ওই করুণ “ম্যাও” ডাকেই তার সব দোষ মাফ করে দেয় মিনু।
এদিকে ঘুড়িটার তো থামার নাম নেই। শেষ পর্যন্ত যদি আকাশে মাথা ঠুকে যায়? আচ্ছা আকাশটা কি নরম না শক্ত? দেখে তো খুব শক্ত বলে মনে হয় না। আচ্ছা জল জমেই তো নাকি মেঘ হয়, তাহলে মেঘগুলোকে কি জলের মত খাওয়া যায়? মিনুদের পাড়ায় একটা বুড়ো লোক হাওয়াই মিঠাই বেচতে আসে, কী যেন বলে কটন ক্যান্ডি না কী… সেরকমই হবে বোধ হয় মেঘগুলো।
এইসব ভাবতে ভাবতে মিনুর ঘুম পেল, ঘুড়ির ওপরেই কোনরকমে জায়গা করে শুয়ে পড়ল সে। দুএকটা লম্বা লম্বা হাই তুলল। পাশ ফিরে না শুলে ঘুম আসে না। পাশ ফিরতেই দেখতে পেল তার চোখের ঠিক সোজাসুজি সূর্যটা হালকা লাল হয়ে ওপাশে ঢলে পড়েছে। মানে এখন বিকেল, তার সব বন্ধুরা এতক্ষণে মাঠে বউবসন্ত খেলছে। মা ছাদে জামাকাপড় তুলতে এসে দেখছে মিনু নেই, সারা বাড়িতে খোঁজ খোঁজ রব পড়েছে। এত সব কিছু ভাবতে ভাবতে মিনুর চোখ বন্ধ হয়ে এলো, মেঘের বুক চিরে উড়তে থাকা আশ্চর্য ঘুড়িতে শুয়ে বিকেলের হালকা সোনালি আলো গায়ে মেখে ঘুমিয়ে পড়ল ছোট্ট মেয়েটা…
ঘুম যখন ভাঙল তখন চারিদিকে অন্ধকার নেমেছে। মিনু চোখ খুলে দেখল কোথাও একটা এসে দাঁড়িয়েছে ঘুড়িটা। শুয়ে শুয়ে মনে হল কোন খালি জায়গা, আকাশে টিমটিমে তারা দেখা যাচ্ছে। সে উঠে বসে দু’হাত মাথার ওপর তুলে আড়মোড়া ভাঙল। বেশ ঠাণ্ডা লাগছে। আকাশের একদিকে গোল মোটাসোটা চাঁদ উঠেছে। মিনু দুটো হাত মুঠো করে চোখ রগড়ে নিল, তারপর নিচে তাকিয়ে দেখল তার পায়ের ঠিক নিচেই মেঘের জমাট চাদর, তার ওপরে এসে থেমেছে ঘুড়িটা। চাঁদের চকচকে আলো চারপাশের মেঘের ওপর পড়ে মনে হচ্ছে যেন মুক্তোর সমুদ্রর ওপর ভেসে রয়েছে একটা লাল ঘুড়ি। এখন ক’টা বাজে কে জানে! মিনুর এতক্ষণে কেমন যেন ভয় লাগল। ঘুড়িটা এতদূর নিয়ে তো এল, কিন্তু এবার যদি ফিরিয়ে না নিয়ে যায়? এখানে সে খাবেই বা কী? আর কথাই বা বলবে কার সাথে?
ঘুড়ির ওপর বসে পা দোলাতে দোলাতে ঠিক নিচের মেঘটায় পা লেগে গেল। বেশ শক্ত। বোধহয় এর ওপর দিয়ে হাঁটা যায়। মিনু মেঘের ওপর নেমে পড়ল। এত শক্ত মেঘ ফুঁড়ে ঘুড়িটা কী করে এল কে জানে। যাই হোক অত শত না ভেবে মিনু হাঁটতে লাগল। মেঘগুলো কিছু দূর গিয়ে ছিঁড়ে গেছে, তারপর আবার শুরু হয়ছে অন্য মেঘ। সে একমনে চাঁদের দিকে পা চালাল। চারপাশে কোথাও কিচ্ছু নেই, এমনকি একটা আওয়াজও শোনা যাচ্ছে না।
হঠাৎ মিনুর মনে হল তার জলতেষ্টা পেয়ছে। মেঘগুলোকে কি খাওয়া যায়? এত কাছে যখন আসা গেছে তখন একবার মুখে দিয়ে দেখাই যায়। সে নিচু হয়ে বসে শক্ত মেঘের ওপর আঙুল দিয়ে চাপ দিল, আর ওমনি সেখানটা দেবে গিয়ে আঙুলটা ভিতরে ঢুকে গেল। হাতে করে খানিকটা মেঘ তুলে মিনু মুখে দিল। ওমা! এ তো জল নয়, আইসক্রিম! কিন্তু ভুগোলস্যার নীলকণ্ঠবাবু যে বলেছিল জল জমেই মেঘ হয়? মিনুর এমনিতে ভূগোল পড়তে একদম ভাল লাগে না। একবার ফিরতে পারলে সে সবাইকে বলে দেবে যে জল জমে নয়, আসলে আইসক্রিম জমেই মেঘ হয়।
বেশ খানিকটা খেয়েও অবশ্য সে বুঝতে পারল না স্বাদটা ঠিক কীসের। পেট ভরে আইসক্রিম খেয়ে মিনু আবার চলতে লাগল, এ জায়গাটা খারাপ লাগছে না। কয়েকদিন থেকে গেলেও বেশ হয়, খালি প্লুটোটা যদি থাকত, খানিকটা গল্প করা যেত। প্লুটো অবশ্য ম্যাও ছাড়া কিছু বলতে জানে না, কিন্তু হলেই বা, সব “ম্যাও” একরকম নয়। এতদিন তার সাথে মিশে মিনু বেশ বুঝতে পারে কোন ম্যাও দিয়ে প্লুটো কী বোঝাতে চায়।
আর একটু এগোতেই কিন্তু সে থেমে গেল। সামনে আর এগোনোর পথ নেই, এই মেঘটা এখানেই শেষ। তারপর অন্য একটা মেঘ শুরু হয়ছে বটে কিন্তু দুটো মেঘের মাঝখানে একটা বড়োসড় ফাঁক। মিনুর পক্ষে অতটা লাফ দেওয়া সম্ভব নয়। সে ঝুঁকে দেখার চেষ্টা করল, নিচে প্রায় কিছুই দেখা যায় না, বাড়িঘর, গাছপালা সব একসাথে মিশে ড্রয়িং বইতে ওয়াটার কালারে আঁকা ছবিগুলোর মত দেখাচ্ছে। এবার কী হবে? চারদিক থেকেই
তো রাস্তা বন্ধ, আবার কি ঘুড়িটায় ফিরে যাবে? কিন্তু সেটা তো আর নড়বে বলে মনে হচ্ছে না। মিনুর এতো দুঃখ হল যে আইসক্রিম খেতেও ইচ্ছা করল না, সে ছেঁড়া মেঘের একটা সুতোর ওপর বসে পড়ল।
আর সাথে সাথে একটা আশ্চর্য ব্যাপার ঘটে গেল। ওপাশে দূরে থাকা মেঘটা ধীরে ধীরে এই মেঘটার কাছে চলে এল, কাছে আসতে আসতে দুটো মেঘ জুড়ে গেল। মিনুও এতক্ষণে উঠে দাঁড়িয়েছে। তার মনটা আবার খুশিতে নেচে উঠল। এইভাবে মেঘের ওপর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতেই সে চাঁদে পৌঁছে যাবে, আচ্ছা চাঁদে কী আছে? নীলকণ্ঠবাবু অবশ্য বলেছিল চাঁদের গোটা গা জুড়ে শুধু বড়োবড়ো ফুটো, কিন্তু একটু আগে মেঘের গা থেকে আইসক্রিম খাবার পর মিনুর ধারণা হয়ছে যে আসলে ভূগোলের মাস্টাররা কিছুই জানে না। শুধু যে জানে না তাই নয়, পরীক্ষার খাতায় নিজের মত কিছু লিখতে গেলে রীতিমত গোল্লা দিয়ে দেয়। মিনু গম্ভীর গলায় বলল, “দাঁড়াও, একবার ঘুড়িটা আমায় ফিরিয়ে নিয়ে যাক, গোল্লা দেওয়া কাকে বলে আমিও দেখিয়ে দেব।”
এইরকম করে বেশ কিছুক্ষণ চলল, মিনু খানিকদূর চলে, আইসক্রিম খায়, জিরিয়ে নেয়, গান গায়, আবার চলতে থাকে। যত এগোয় তত মনে হয় চাঁদটা যেন বড়ো হচ্ছে। বেশ খানিকটা হেঁটে আসার পর কিন্তু মিনুর মনে হল সে আর চলতে পারবে না, পায়ে ব্যথা করছে, এদিকে ঘুমও পাচ্ছে না, শুয়ে থাকতেও ভাল লাগছে না, চলতেও ইচ্ছা করছে না, অগত্যা সে বসে পড়ল। মেঘের ওপর কয়েকবার গড়িয়ে নিল। বাড়িতে এখন কী হচ্ছে কে জানে! বাবা বোধহয় পুলিশে খবর দিয়েছে। মা কি কান্নাকাটি করছে? মিনু মাকে কোনোদিন কাঁদতে দেখেনি। পিসতুতো ভাই গল্লুর একবার হাত পুড়ে গেছিল বলে পিসি একটা গোটা দিন হাপুস হয়ে কেঁদেছিল। অথচ মিনুর কোথাও কেটে গেলে মা কোনোদিন কাঁদেনি।
হঠাৎ মিনু হিহি করে হেসে উঠল। আর সাথে সাথে তার মনে হল তার পিঠের তলার মেঘটা যেন কেঁপে উঠল। ব্যাপার কী? উঠে দাঁড়াতেই সে অবাক হয়ে গেল, মেঘটা আর স্থির নেই, লাল ঘুড়িটার মতই সেটা হন্তদন্ত হয়ে চাঁদের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, অন্য সব মেঘগুলোকে পাশ কাটিয়ে। বাসের সামনের সিটে বসলেও অনেকটা এরকম দেখায় বটে।
আর একটা ব্যাপার চোখে পড়তেই বিস্ময়ে মিনুর মুখটা হাঁ হয়ে গেল। চারপাশের মেঘগুলো এতক্ষণ সে ফাঁকা ভেবেছিল, এখন দেখা যাচ্ছে তার প্রত্যেকটার ওপর বসে আছে তারই বয়সি ছেলেমেয়েরা। তাদেরকে নিয়ে চাঁদের দিকে ছুটে চলেছে মেঘগুলো। কিন্তু কেন? এতক্ষণে মিনুর সত্যিকারের ভয় লাগল, কী আছে চাঁদে যে এতগুলো ছেলেমেয়েকে ধরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে? মিনু চিৎকার করে বাকিদের ডাকার চেষ্টা করল, কিন্তু কেউ শুনতে পেল না। কানের পাশ দিয়ে শনশন করে ঠাণ্ডা হাওয়া বইছে, তাতে কীরকম একটা আওয়াজ হচ্ছে যেন, হয়ত যতটা সম্ভব আর্তনাদ করে তারা কিছু বলতে চাইছে মিনুকে, কিন্তু কী? হাওয়ার ভাষা তো সে বোঝে না। আর বুঝেই বা কী লাভ, এখান থেকে পালানোর উপায় নেই।
শেষপর্যন্ত মেঘটা যখন চাঁদের ওপর গিয়ে থামল তখন চারপাশে বেশ একটা হইহট্টগোল পড়ে গেছে। বাকি মেঘগুলো থেকেও নেমে এসেছে ছেলেমেয়ের দল। তাদের কেউ ভয়ে কাঁপছে, আবার কেউ দিব্যি আনন্দে লাফচ্ছে।
মিনু নিচে নেমে দেখল চাঁদের মাটিটা বেশ নরম। ঠিক যেন স্পঞ্জের মত, মনে হয় নিচে স্প্রিং লাগানো আছে, একটু লাফালেই অনেকটা ওপরে ওঠা যায়। এতক্ষণে সে বুঝল যে নীলকণ্ঠবাবু লোকটা ভারি মুখ্যু। এখানে ফুটো তো নেইই বরঞ্চ প্রায় মানুষের সমান উঁচু বেশ কয়েকটা টিলা দেখা যাচ্ছে। মাটিটা একদম সমান, শ্বেতপাথরের মেঝের মত। হাঁটতে ভারি আরাম লাগে। মিনু হাঁটতে হাঁটতে বেশ খানিকটা দূরে চলে এল। হঠাৎ চোখে পড়ল তারই বয়সি একটা মেয়ে পাথরের আড়ালে দাঁড়িয়ে চারিদিকে নজর রাখছে, ভাবখানা এমন যেন এক্ষুনি কেউ এসে ধরে নিয়ে যাবে। মিনু সাতপাঁচ না ভেবে তার পাশে গিয়ে বসে পড়ল। মেয়েটা আচমকা কারো উপস্থিতি বুঝতে পেরে চমকে উঠে পালাতে যাচ্ছিল তারপর মিনুকে দেখে একটু আশ্বস্ত হল। সমস্ত ব্যাপারটা মিনুর কাছেও গুলিয়ে গেছিল, তাও সে কিছু জিজ্ঞাসা করল না। মেয়েটা চারপাশ ভাল করে দেখে নিয়ে মনে মনে কী যেন হিসেব করতে লাগল, তারপর হঠাৎ করে মিনুর কাঁধ চেপে ধরল, মুখের একদম সামনে মুখ নিয়ে এসে বলল, “তোকেও নিয়ে এসেছে, ঘুড়ি ধরতে গেছিলি নিশ্চই?”
মিনু মাথা নাড়ল। তারপর ঢোঁক গিলে বলল, “ হ্যাঁ, লাল ঘুড়ি।”
মেয়েটা দুঃখে জোরে জোরে মাথা নেড়ে বলল, “ওই লোভেই আমারও এই হাল হয়েছে।”
“কী হাল?” মিনু সভয়ে জিজ্ঞেস করল।
মেয়েটা আবার কীসব ভাবতে লাগল, বোধহয় মিনুকে সব কিছু বলা উচিত হবে কিনা সেটাই হিসেব করে দেখার চেষ্টা করছে। বেশ কিছুক্ষণ পর হতাশ মুখে বলল, “ লামিয়ার নাম শুনেছিস?”
“ লামিয়া! সেটা কে?”
“ হুম… না শোনাই ভালো। আয় আমার সাথে।”
মিনুর হাত ধরে সে টান দিল। দুজনে উঠে পড়ল। মনে হচ্ছে মেয়েটা অনেকদিন আছে এখানে, হয়ত কিছু জানে, কিন্তু লামিয়া কে? তাকে এতো ভয় পাবারই বা কী আছে। যাই হোক মিনু বেশি না ভেবে এগিয়ে গেল। এইদিকের মাটি আর সমান নেই, কয়েকবার হোঁচট খেল। সামনেই একটা বড়ো পাথর, মেয়েটা সেদিকেই টেনে নিয়ে চলেছে তাকে, দূর থেকে কীসের যেন একটা আওয়াজ আসছে, ভাল করে শুনলে মনে হয় খুব মিনমিনে সুরে কে যেন বাঁশি বাজাচ্ছে। মেয়েটা তারই বয়সি হলে কি হবে, হাতে বেশ জোর। কেমন যেন রুক্ষ বালিমাখা হাত।
খানিকটা এগোতে মিনুর চোখের সামনে থেকে পাথরটা সরে গেল আর সাথে সাথে ভয়ে তার হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে গেল, পা আর এগোতে চাইল না। মেয়েটা ধরে না নিলে সে হয়ত পড়েই যেত। সামনে এবড়োখেবড়ো মাটির ওপর পড়ে আছে কয়েকটা হাড়! গোটা নয়, ভাঙাভাঙা। যেন একটা বিশাল দৈত্য কামড়ে কামড়ে খেয়েছে তাদের, হাড়গুলো ফেলে দিয়েছে মাটির ওপরে। ভাল করে লক্ষ করলে বোঝা সেগুলো বাচ্চাদের হাড়। এক মুহূর্তে মিনুর মাথায় সমস্ত ব্যাপারটা পরিষ্কার হয়ে গেল। তাহলে এই কারণেই এতগুলো বাচ্চাকে ডেকে আনা হয়ছে এখানে! কিন্তু তাই যদি হয় তাহলে এই মেয়েটা এখানে বেঁচে থাকল কী করে? মিনু পাথরের আড়ালে লুকিয়ে বসে পড়ল। এবার কী হবে? এখান থেকে তো আর পালানোর পথ নেই, একটু পরেই হয়ত আকাশ জুড়ে দেখা যাবে দৈত্যটাকে। মিনুর কান্না পেল। মেয়েটা তার কাঁধে হাত রেখে নরম গলায় বলল, “ ভয় পেলি?”
মিনু উত্তর দিল না। তার চোখ ফেটে জল আসছে। প্লুটোকে আর দেখতে পাবে না হয়ত। একটু পরে তার হাড়গুলোও পড়ে থাকবে মাটির ওপর। মেয়েটা তার পাশে বসে পড়ল। তারপর মাটির ওপর হাত বুলাতে বুলাতে বলল, “ লামিয়া কোন দৈত্য নয়, অনেকটা মানুষের মতই দেখতে। কিন্তু দৈত্যের থেকেও ভয়ানক।”
এই কথাটা শুনে মিনু খানিকটা ভরসা পেল। মানুষের মতই যখন তখন তাকে দেখে অন্তত ভয় লাগবে না। উৎসাহিত হয়ে জিজ্ঞেস করল, “ তুই দেখেছিস?”
“হ্যাঁ, দুবার, পাথরের আড়ালে লুকিয়ে। মাথা থেকে কোমর পর্যন্ত মানুষের, তার নিচটা সাপের মত। একটা সাপের খোলস জড়ানো থাকে কোমরে। একবার দেখলেই হাত পা অবশ হয়ে আসে, আমি কোনরকমে পালিয়ে বেঁচেছি। তারপর থেকে এই পাথরের আড়ালেই লুকিয়ে থাকি।”
মিনু দেখল তারও খানিকটা আশা আছে, কিন্তু এভাবে লুকিয়েই বা কতদিন থাকা যায়, একসময় তো লামিয়া খুঁজে নেবেই তাকে। তখন? কথাটা মেয়েটাকে জিজ্ঞেস করতেই তার মুখে কেমন একটা ঝিলিক খেলে গেল, মিনুর দিকে আর খানিকটা সরে এলো সে, তারপর ফিসফিসে গলায় বলল, “ জানিস, এই ক’দিনে আমি একটা জিনিস বুঝতে পেরেছি।”
“কী?”
“ এখানে লামিয়া ছাড়াও আরও কিছু আছে।”
“কী আছে?” মিনু আশার আলো দেখল।
“ তা ঠিক জানি না, তবে লামিয়া ভয় পায় তাকে।”
“কী করে বুঝলি?”
মেয়েটা আঙুল দিয়ে একদিকে দেখিয়ে বলল, “ ওই যে উঁচু পাহাড়টা দেখছিস, ওটাতে উঠে মাঝে মাঝে চারদিক নজর রাখে লামিয়া। আমি একদিন ওর নিচেই লুকিয়ে ছিলাম। অন্য কোথাও থাকলেই আমায় ধরে ফেলত। লামিয়া পাহাড়ের ওপরে থাকলে পাহাড়ের নিচটাই বাঁচার জায়গা। আমি নিঃশ্বাস বন্ধ করে বসে আছি। এমন সময় হঠাৎ কীসের একটা ডাক শোনা গেল। আমি মনে মনে ভাবলাম এখানে তো আর কেউ থাকে না? তবে এতো জোরে ডাকল কে? হঠাৎ ঠিক সামনেই কিছু একটা দেখতে পেলাম। প্রথমে মনে হয়েছিল সেটা একটা বড়ো পাথর। পরে বুঝলাম কারো পা সেটা। আমি তো অবাক! এতো বড়ো পা তো কোন জন্তুর হয় না! অথচ নখ আছে। পুরো জন্তুটাকে দেখতে পাইনি বটে, কিন্তু কিছুক্ষণ পরেই দেখেলাম লামিয়া ভয়ঙ্কর চিৎকার করতে করতে পাহাড় থেকে নেমে গেল। বুঝলাম সেও কাউকে ভয় পায়।”
এতগুলো কথা বলে মেয়েটা দম নিতে একটু থামল। মিনু ব্যাপারটা ভালো করে ভেবে দেখার চেষ্টা করল। সেই অজানা জন্তুটা যদি লামিয়াকে মেরে ফেলতে পারে তাহলে তার বাঁচার আশা আছে বটে, কিন্তু ততদিন পালিয়ে পালিয়ে বাঁচাও তো মুখের কথা নয়। তার আগেই যদি লামিয়া দেখতে পেয়ে যায় তাকে? সে যা হোক, মিনুর ভয়টা এতক্ষণে কেটে গেছে। সে মেয়েটার কাঁধে একটা হাত রেখে জিজ্ঞেস করল, “নাম কী রে তোর?”
“অন্তি। তোর?”
“মৃন্ময়ী মিত্র।” অচেনা লোকের কাছে নিজের ডাকনামটা বলতে একদম ইচ্ছা করে না।
“ভালই হল তোকে পেয়ে। শোন, একটা কাজ করতে পারবি?”
“কী কাজ?”
“যদি লামিয়াকে দেখে আমি অবশ হয়ে যাই তাহলে তুই আমাকে টেনে নিয়ে পালাবি, আমি যেতে না চাইলেও নিয়ে যাবি, বুঝেছিস?”
মিনু মাথা নেড়ে দিল। অবশ্য ততটা জোর তার গায়ে আছে কিনা সেটাই সন্দেহের। যেকোনো একজনকেই যদি লামিয়া দেখে ফেলে তবে দুজনকেই তার পেটে যেতে হবে, পিছনে পড়ে থাকা মানুষের হাড়গুলোর কথা ভেবে মিনুর গা শিউরে উঠল।
“চ, এবার উঠি,” অন্তি উঠে পড়ল।
“কোথায়?”
“ওই পাহাড়ের কাছে, লামিয়াও হয়ত ওদিকেই গেছে।”
মিনুও উঠে পড়ল। তারপর কী যেন ভেবে জিজ্ঞেস করল, “আচ্ছা, আমার সাথে তো আরও অনেকে এল এখানে। তাদের কী হবে?”
“আস্তে আস্তে সবাইকেই খাবে। এখানে তো পালানোর উপায় নেই! তুই ভাল লুকোচুরি খেলতে পারিস তো?”
“হ্যাঁ।”
“তাহলে ভয় নেই।”
“কিন্তু শুধু বাচ্চাদেরই এখানে আনে কেন?”
“আমিও ঠিক জানি না, তবে শুনেছি লামিয়া একসময় এতটা খারাপ ছিল না। খুব সুন্দর এক রানি ছিল তখন, ছেলেমেয়েও ছিল, তো একদিন হেরা বলে আরেক রানি তার সব কটা ছেলেমেয়েকে খেয়ে নেয়, তারপর থেকে রাগে দুঃখে লামিয়া মানুষের ছেলেমেয়েকে খেতে শুরু করে।”
“কিন্তু হেরাই বা ওর ছেলেমেয়েকে খেয়ে ফেলল কেন?” মিনু অধৈর্য হয়ে জিজ্ঞেস করল।
“তা আমি বলতে পারব না। তাড়াতাড়ি আয়, দেরি করলে আমাদের দেখতে পেয়ে যাবে।”
দুজনে দ্রুত পা চালাল। দূর থেকে আসা সেই বাঁশির আওয়াজটা ধীরে ধীরে বাড়ছে। এতক্ষণ শান্ত হয়ে হাওয়া দিচ্ছিল, সেটাও যেন ধীরে ধীরে গতি নিচ্ছে। দূরে পাহাড়ের চুড়াটা দেখা যাচ্ছে। তার ওপরদিকটা মেঘে ঢাকা। আলোআঁধারের অদ্ভুত রঙে সেজেছে চারিদিক। চারপাশের স্থির নিস্তব্ধ পাথরগুলো যেন কীসের প্রতীক্ষায় উন্মুখ হয়ে আছে। এতগুলো ছেলেমেয়ে এখানে এসে নামল কিন্তু এখন কাউকে দেখা যাচ্ছে না। সবাই গেল কোথায়?
মিনু আর অন্তি আস্তে আস্তে পাহাড়ের কাছে পৌঁছল। মিনু শক্ত করে ধরে আছে অন্তির কবজিটা। লামিয়া কাছেপিঠেই কোথাও আছে। এখানে থাকলে সে দেখতে পাবে না বটে কিন্তু তার সটান নিচে দাঁড়িয়ে থাকার কথা ভাবলেই ভয়ে গলা বন্ধ হয়ে আসছে। একটা ফোকরের সামনে বসে দুজনে অপেক্ষা করতে লাগল। মিনু ঢোঁক গিলে কাঁপা কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করল, “ হ্যাঁরে, এলে বুঝব কী করে?”
“ঝুমুরের আওয়াজ, আর সাপের হিসহিস শুনতে পাবি।”
“যদি বুঝতে পারে আমরা এখানে আছি?”
অন্তি উত্তর দিল না। চারপাশটা নিস্তব্ধ। মিনু বেশ কয়েকবার কান পেতে শোনার চেষ্টা করল। ওই সর্বনাশা ঘুড়িটা যে তাকে এখানে নিয়ে আসবে তা সে স্বপ্নেও ভাবতে পারেনি। শেষ পর্যন্ত লামিয়ার পেটে যদি যেতেই হয় তাহলে ওই ঘুড়িটা অন্তত ছিঁড়ে দিয়ে এলে হত।
মিনু এইসব ভাবতে ভাবতে অন্যমনস্ক হয়ে গেছিল, এমন সময় হাতের ওপর চাপ পড়তেই সে চমকে উঠল। একটা হিসহিসে শব্দ শোনা যাচ্ছে। সাপের শিসের মত। বাড়ছে কমছে। শব্দটা ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে তাদের দিকে। মিনু বুঝতে পারল না সে নিঃশ্বাস নেবে কিনা। যতক্ষণ না লামিয়া দূরে না চলে যাচ্ছে ততক্ষণ যদি শ্বাস আটকে রাখতে পারে তাহলে অসুবিধা নেই, কিন্তু তা যদি না হয় তাহলে জোরে জোরে নিঃশ্বাস পড়বে। তখন? অন্তি শক্ত করে ধরে আছে তার কনুইটা। মনে হল এই বুঝি সমস্ত পাহাড়টা ভেঙে পড়বে তাদের মাথায়।
ফোকরের কাছে এসে হিসহিস শব্দটা থেমে গেল। সেটা আর ওপরের দিকে উঠছে না। তবে কি কিছু বুঝতে পেরেছে? গর্তটার ঠিক বাইরে থেকে একটা খিলখলে হাসির শব্দ ভেসে এলো, ফোকরের ভিতরের ফাঁকা দেওয়ালে ধাক্কা লেগে প্রতিধ্বনিত হতে লাগল হাসিটা। মিনু অন্তির মুখের দিকে তাকিয়ে দেখল তার চোখদুটো ভয়ে বিস্ফারিত হয়ে আছে, মাথা নামিয়ে সে বলল, “ কোনোদিন তো এভাবে হাসে না, আজ…”
মিনু আর কিছু বলতে পারল না, এই প্রথম তার বাড়ির সবার জন্য মন কেমন করতে লাগল। হিসহিস শব্দটা এখনও একই জায়গা থেকে আসছে। হাসিটা থেমে গেছে। কয়েক সেকেন্ড সব চুপচাপ তারপর ফোকরের ঠিক বাইরে যেন কিছু একটা নড়তে লাগল। অনেকটা সাপের গায়ে যেরকম দাগ থাকে সেইরকম। তারপরেই দেখা গেল একটা মুখ, মানুষের মতই তবে মানুষের নয়, টানা টানা ভয়ঙ্কর হলদে দুটো চোখে হিংসা জ্বলজ্বল করছে। থুতনিতে একটা লাল পাথর বসানো, বাঁকান ঠোঁটে ক্রূর হাসি, মাথায় সোনালি মুকুট।
ঠোঁট দুটো ফাঁক হয়ে জিভটা কয়েকবার বেরিয়ে এল। চেরা জিভ। অন্তি জড়িয়ে ধরেছে মিনুকে, আতঙ্কিত স্বরে কয়েকটা ভাঙা ভাঙা শব্দ উচ্চারণ করছে সে, “তাকাস না ওদিকে, মরে গেলেও ওর দিকে তাকাস না।” মিনুর চোখ দিয়ে জলের ধারা নেমে এল, তবু সে মুখ ফেরাতে পারল না। একটু একটু মাথার মধ্যে সব কিছু গুলিয়ে যাচ্ছে, এইবার হাত পা অবশ হয়ে আসছে, আর একটু সময় বাকি…
ঠিক এইসময় একটা আশ্চর্য ব্যাপার ঘটে গেল। ফোকরের সেই ভয়ঙ্কর মুখটা হঠাৎ তাদের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে একটা বিকৃত শব্দ করে বাইরে ছিটকে পড়ল। এতক্ষণ ভয়ে মিনু খেয়ালও করেনি যে সেই হালকা বাঁশির শব্দটা এখন বেশ জোরে শোনা যাচ্ছে। ব্যাপার কী? সে হতবাক হয়ে গিয়েছিল। ঠেলা দিয়ে অন্তিকে ডাকল, “ওই, ওঠ ওঠ, চলে গেছে রে।”
অন্তি কোন সাড়া দিল না, বোধহয় ভয়ে অজ্ঞান হয়ে গেছে। মিনু সাহস করে ফোকরের বাইরে পা বাড়াল, আর বাইরে এসে দাঁড়াতেই এক অদ্ভুত দৃশ্য দেখে তার বুকের ধুকপুকুনি কয়েক সেকেন্ডের জন্য বন্ধ হয়ে গেল। চাঁদের মাটির ওপর শুয়ে ছটফট করছে লামিয়া। আর তার বুকের ওপরেই তলোয়ার নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে আর একটা মানুষ। না, ঠিক মানুষ নয়, তার সারা শরীর নীলচে রঙের ফিনফিনে কাপড়ে ঢাকা, তার ওপর তারার মত জ্বলজ্বল করছে কয়েকটা বিন্দু, যেন রাতের আকাশ থেকে কেটে খানিকটা কাপড় গায়ে জড়িয়ে নিয়েছে সে। মুখটাও ঢাকা পড়েছে তাতে। এই কি তবে অন্তির দেখা সেই জন্তুটা? কিন্তু এর হাতে তো ঝলমল করছে আলোর তলোয়ার!
মিনু স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে দেখছিল সেই ভয়ঙ্কর যুদ্ধ। সাপটা বারবার ছোবল মারছে তলোয়ারধারীকে, পরমুহূর্তেই সে লুটিয়ে পড়ছে মাটির ওপরে। প্রচণ্ড চিৎকার আর আক্রমণের শব্দে মাটি কেঁপে উঠছে।
হঠাৎ মিনুর কাঁধে হাতের স্পর্শ লাগতে সে পিছন ফিরে তাকাল। অন্তি উঠে এসে দাঁড়িয়েছে তার পাশে। মিনু কিছু জিজ্ঞেস করতে যাবে, তার আগেই অন্তির মুখ দিয়ে একটা শব্দ বেরিয়ে এলো, “ সাইবিল।”
“সেটা কে?” মিনু অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল।
“যার হাতে তলোয়ার।”
মিনু আর কিছু জিজ্ঞেস করল না, সাক্ষাৎ মৃত্যুর হাত থেকে পালিয়ে আসতে পেরেছে এই অনেক। এবার বাড়ি ফিরবে কীভাবে সেটাই চিন্তা। এতক্ষণে সাইবিলকে বেশ কাবু করে ফেলেছে লামিয়া, তার মুখ থেকে বেরিয়ে আসছে আগুনের হলকা, সেই সাথে আকাশ ফাটানো চিৎকার। একটা হলকা এসে লাগল সাইবিলের হাতে, হাত থেকে দূরে ছিটকে পড়ল আলোর তলোয়ার। মিনু প্রমাদ গুনল। তবে কি হেরে যাবে সাইবিল? তাহলে তো আর লামিয়ার হাত থেকে নিস্তার নেই!
সাপের শরীর নিয়ে লামিয়া ধীরে ধীরে এগিয়ে যাচ্ছে। এইবার সে উঠে দাঁড়াল আহত সাইবিলের বুকের ওপর। কয়েকবার ডান হাত দিয়ে ছিটকে পড়া তলোয়ারটা ধরার চেষ্টা করল সাইবিল, কিন্তু পারল না। কবজির কাছ থেকে পুড়ে গেছে হাতটা। তার বুকের ওপর দাঁড়িয়ে আকাশ কাঁপিয়ে হাসল লামিয়া। হিংস্র জিভটা বেরিয়ে এলো কয়েকবার। দুহাতের বিষাক্ত নখগুলো তুলে ধরল মাথার ওপরে। এখুনি সেগুলো নেমে আসবে সাইবিলের বুকের ওপর।
পোড়া ডানহাত দিয়ে শেষ বারের মত তলোয়ার চেপে ধরার চেষ্টা করল অসহায় সাইবিল, আর ঠিক এই সময় এক অদ্ভুত কাণ্ড ঘটে গেল। পাহাড়ের একদম ওপর থেকে লামিয়ার ঘাড়ের ওপর বাঘের মত ঝাঁপিয়ে পড়ল একটা লোমশ জানোয়ার। কী বিরাট! মিনুদের গোটা বাড়িটাও এর থেকে ছোটো।
জানোয়ারটার ধাক্কায় বেশ কিছুদূরে ছিটকে পরেছিল লামিয়া। সে কিছু বুঝে ওঠার আগেই উঠে দাঁড়াল সাইবিল, তার বাঁ হাতে তুলে নিল তলোয়ার। মুহূর্তের মধ্যে সেটা বসিয়ে দিল লামিয়ার বুকের ঠিক মাঝখানে।
মিনু আর দাঁড়াল না। অন্তির হাত ধরে দৌড়াতে লাগল ভেসে থাকা মেঘগুলোর দিকে। আবার যদি জেগে ওঠে লামিয়া? আর একমুহূর্তও এখানে দাঁড়ানো ঠিক হবে না।
মেঘগুলো আর আগের মত নেই, তাদের সমস্ত গা জুড়ে এখন কালো রঙ ধরেছে, কিন্তু তাও থামলে চলবে না, ওগুলো করেই ভেসে পড়তে হবে ঘুড়িটার কাছে। একটা মেঘের ওপর উঠে বসল দুজনে। কিন্তু মেঘটা এক বিন্দুও নড়ল না, দুজনে দৌড়াতে লাগল। আর সাথে সাথে প্রচণ্ড গর্জন করে ভাঙতে লাগল কালো জমাট মেঘটা। ধীরে ধীরে সেটা বৃষ্টি হয়ে ঝরে পড়ছে, পুরোটা গলে যাবার আগেই অন্য মেঘে উঠতে হবে।
অন্তির পায়ের ঠিক পিছনেই খানিকটা মেঘ গরম হয়ে গলে পড়ল, সাথে বাজ পড়ার শব্দ। দুজনে প্রাণপণে দৌড়াতে লাগল। কয়েকটা মেঘের ওপারেই দেখা যাচ্ছে লাল ঘুড়িটাকে। কিন্তু অতদুর দৌড়াতে পারল না ওরা। আকাশে এখন একটাও রুপোলী মেঘ নেই। একটা নরম, প্রায় জল হয়ে যাওয়া মেঘের ওপর পা রাখতেই সেটা গলে পড়ল। শূন্য আকাশ বেয়ে নেমে আসতে লাগল দুটো শরীর। অন্তি মিনুকে চেপে ধরল, পায়ের নিচে আর কিচ্ছু নেই—
না। আছে। অনেক নিচে আছে, চেনা পৃথিবী, ঘর বাড়ি, মানুষ। বৃষ্টির জলের সাথে মিশে দুজনে নামতে লাগল নিচে। আস্তে আস্তে চাঁদ আর মেঘের দেশ দূরে চলে যাচ্ছে, এগিয়ে আসছে পৃথিবীর মাটি। মিনুর ঘুম পেল…
………
কানে টান পড়তেই সম্বিৎ ফিরল মিনুর । সাথে সাথে মায়ের ঝাঁঝালো গলা কানে এল, “গেছো মেয়ে কোথাকার! ফের তুই ছাদের পাঁচিলে উঠেছিলি? দাঁড়া, বাবাকে আসতে দে, তারপর তোর একদিন কি আমার একদিন।”
দুপুরের রোদ ঝলমল করছে। মিনু থমথমে মুখে নিচে নেমে এল। তারপর গামছা কাঁধে নিয়ে স্নান করতে ঢুকে গেল। তবে কি এতক্ষণ সব কিছুই তার ভাবনা ছিল? ছাদের পাঁচিলে দাঁড়িয়ে স্বপ্ন দেখছিল? ধুর… মিনুর মনটা খারাপ হয় গেল, আগে জানলে মেঘের আইসক্রিমটা আরও খানিকটা খেয়ে নিলেই হত।
স্নান করে মিনু খেতে বসল। চিংড়িমাছ সে একদম পছন্দ করে না। অথচ আজ মা সেটাই রান্না করেছে। কেন, লুচি করা যায় না? মা বাটি থেকে তরকারি তুলে থালায় দিচ্ছেন। হঠাৎ একটা ব্যাপার চোখে পড়তেই মিনু অবাক হয়ে গেল। কী যেন ভেবে প্রশ্ন করল, “ মা, তোমার হাতে অতটা পুড়ল কী করে?”
“তেলে তেজপাতা দিচ্ছিলাম, ছিটকে এসেছে। তুই খা এখন।”
মিনু চুপচাপ খাওয়া শেষ করে নিচে চলে এল। একতলার ঘরে বসেই সে পড়াশোনা করে। আজ কিন্তু ঘরটা খুলতেই দেখতে পেল জানলায় বসে ঘুমাচ্ছে প্লুটো। মিনুকে দেখতে পেয়েই সে একলাফে ঘরের ভিতর ঢুকে এলো। জুবুথুবু হয়ে বসে পড়ল কোলে। মিনু লক্ষ করল তার গলার নিচ থেকে একটা কাটা দাগ। যেন কিছু একটা আঁচড়ে দিয়েছে তাকে। অনেকক্ষণ থেকে একটা প্রশ্ন ঘুরছিল মনে, প্লুটোর কানের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে সেটাই জিজ্ঞেস করল মিনু, “তুই কি পাহাড়ের মাথা থেকে ঝাঁপ দিয়েছিলি লামিয়ার ঘাড়ে?”প্লুটো গর্বভরে মিনুর হাত চাটতে চাটতে বলল, “ ম্যাও।”
(আগেই বলেছি প্লুটোর ম্যাওয়ের অর্থ খালি মিনুই বুঝতে পারে, সেদিনও বুঝেছিল। তবে সেটা হ্যাঁ কি না তা আমাকে সে বলতে চায়নি। উল্টে বাকি গল্পটার জন্য আমার কাছ থেকে একটা ইংরিজি লেখা ক্যালকুলেটার হাতিয়ে নিয়েছে। অতএব আমি নাচার। আপনারাই চেষ্টা করে দেখুন ওর পেট থেকে কিছু বের করতে পারেন কিনা…)
ছবিঃ মৌসুমী